রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

২. বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়

হাদীস নং: ৭১৩
বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়
১৩ আপনজনকে বিদায় দেওয়া, সফর বা অন্য কোনও উপলক্ষ্যে বিচ্ছেদকালে তাকে অসিয়ত করা, তার জন্য দু'আ করা এবং তার কাছে দু'আ চাওয়া
উমরা আদায়ের জন্য হযরত উমর রাযি.-এর অনুমতি প্রার্থনা এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক তাঁর কাছে দু‘আ চাওয়া
হাদীছ নং: ৭১৩

হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাযি. বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে উমরা আদায়ের অনুমতি চাইলাম। তিনি আমাকে অনুমতি দিলেন আর বললেন, হে আমার প্রিয় ভাই! তোমার দু‘আয় আমাদেরকে ভুলো না। তিনি এমন একটি কথা বললেন, যার বিনিময়ে সারাটা দুনিয়া আমার হয়ে গেলেও তা আমার জন্য আনন্দদায়ক হতো না।
অপর এক বর্ণনায় আছে, তিনি আমাকে বললেন, হে আমার প্রিয় ভাই! তোমার দু‘আয় আমাদের শরীক রেখো। -আবু দাউদ ও তিরমিযী
(সুনানে আবূ দাউদ: ১৪৯৮; জামে তিরমিযী: ৩৫৫৭; সুনানে ইবন মাজাহ: ২৮৯৪; মুসনাদে আহমাদ: ১৯৫; মুসনাদে আবূ দাউদ তয়ালিসী: ১০; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ১০৩১৫; মুসনাদুল বাযযার: ১১৯; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা: ৫৫৫০; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ১৩৯৭)
كتاب الأدب
باب وداع الصاحب ووصيته عند فراقه للسفر وغيره والدعاء لَهُ وطلب الدعاء مِنْهُ
713 - وعن عمرَ بن الخطاب - رضي الله عنه - قَالَ: اسْتأذَنْتُ النَّبيَّ - صلى الله عليه وسلم - في العُمْرَةِ، فَأذِنَ، وقال: «لاَ تَنْسَانَا يَا أُخَيَّ مِنْ دُعَائِكَ» فقالَ كَلِمَةً ما يَسُرُّنِي أنَّ لِي بِهَا الدُّنْيَا.
وفي رواية قَالَ: «أشْرِكْنَا يَا أُخَيَّ في دُعَائِكَ». رواه أَبُو داود والترمذي، وقال: «حديث حسن صحيح». (1)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে জানানো হয়েছে যে, হযরত উমর রাযি. উমরা আদায়ের জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে অনুমতি চেয়েছিলেন। উমরা আদায় করা অনেক বড় ছাওয়াবের কাজ। এর জন্য অনুমতি চাওয়া জরুরি ছিল না। তা সত্ত্বেও হযরত উমর রাযি. অনুমতি চেয়েছিলেন। এটা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি তাঁর চূড়ান্ত রকমের আদবের পরিচায়ক। সেইসঙ্গে তাঁর প্রতি হযরত উমর রাযি.-এর পরিপূর্ণরূপে আত্মনিবেদিত থাকারও প্রমাণ বহন করে। তিনি নিজেকে এমনভাবেই প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে সমর্পণ করে দিয়েছিলেন যে, উমরার মতো একটি ছাওয়াবের কাজের জন্য সফর করাটাও তিনি তাঁর অনুমতি ছাড়া করতে পসন্দ করেননি। আত্মনিবেদনের এ পরাকাষ্ঠাই তাঁকে অত উচ্চমর্যাদায় পৌছিয়েছিল।

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুশিমনেই তাঁকে অনুমতি দিলেন। সেইসঙ্গে বললেন- لَا تَنْسَانا يَا أُخَيَّ مِنْ دُعَائِكَ ) হে আমার প্রিয় ভাই! তোমার দু'আয় আমাদেরকে ভুলো না)। হযরত উমর রাযি.-এর প্রতি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্নেহ-মমতা কী গভীর ছিল, তা তাঁর এ বাক্য দ্বারা অনুমান করা যায়। সেইসঙ্গে এদিকেও ইশারা হয় যে, হযরত উমর রাযি.-এর দু'আ আল্লাহ তা'আলার কাছে কবুল হত।

হযরত উমর রাযি. আল্লাহ তা'আলার কাছে যে অতি উচ্চ মর্যাদাবান ছিলেন তাতে তো কোনও সন্দেহ নেই, কিন্তু তাই বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে তো আর তুলনীয় হতে পারে না! তিনি আল্লাহর হাবীব। সকল নবী-রাসূলের সেরা। তা সত্ত্বেও তিনি হযরত উমর রাযি.-এর কাছে দু'আ চেয়েছেন! এটা তাঁর পরম বিনয়ের নিদর্শন। সেইসঙ্গে এর দ্বারা উম্মতকে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে যে, তারা যেন কারও কাছে দু'আ চাইতে কুণ্ঠাবোধ না করে, তাতে যার কাছে দু'আ চাওয়া হয় তার তুলনায় দু'আপ্রার্থী যত উচ্চমর্যাদারই হোক না কেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের 'প্রিয়সম্ভাষণ' ও দু'আ প্রার্থনা হযরত উমর ফারুক রাযি.-এর অন্তরে যে কী গভীর দাগ কেটেছিল, তিনি এতে কতটা সিক্ত ও বিগলিত হয়েছিলেন, তা তাঁর অনুভূতি প্রকাশ দ্বারাই অনুমান করা যায়। তিনি বলেন-
فَقَالَ كَلِمَةً مَا يَسُرُّنِي أَنَّ لِيْ بِهَا الدُّنْيَا (তিনি এমন একটি কথা বললেন, যার বিনিময়ে সারাটা দুনিয়া আমার হয়ে গেলেও তা আমার জন্য আনন্দদায়ক হতো না)। অর্থাৎ ওই কথার পরিবর্তে যদি সমগ্র দুনিয়াও আমার হয়ে যেত, তাতে আমি খুশি হতাম না। কেননা তাঁর এ কথার মূল্য সমগ্র দুনিয়া অপেক্ষা বেশি। বস্তুত কোনও কোনও কথার মূল্য এত বেশি হয়ে থাকে, যা কোনও বস্তু দ্বারা পরিমাপ করা যায় না। তার বিপরীতে সারাটা দুনিয়াও তুচ্ছ সাব্যস্ত হয়। তবে হাঁ, সে কথার মূল্য অনুভব করার ক্ষমতাও থাকা চাই। সকলের সে ক্ষমতা থাকে না। হযরত উমর ফারুক রাযি. তো এমন ব্যক্তি ছিলেন, যাঁর পসন্দ ও চাহিদার অনুকূলে ওহীও নাযিল হত। তাহলে কী গভীর ছিল তাঁর মননশক্তি! নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাত্র অনুপাতেই তাঁর রত্নবাণী অর্পণ করেছিলেন। আমরা এর মর্ম কতটুকুই বা বুঝব?

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. দীনী সফরেও পিতা-মাতা ও মুরুব্বীদের অনুমতি নেওয়া বাঞ্ছনীয়।

খ. হজ্জ ও উমরাযাত্রীর কাছে দু'আ চাওয়া মুস্তাহাব।

গ. দু'আ চাওয়ার বেলায় যার কাছে দু'আ চাওয়া হয় সে দু'আপ্রার্থী অপেক্ষা উত্তম কি না তা বিবেচ্য নয়।

ঘ. আল্লাহওয়ালাদের কাছে দু'আ চাওয়া উচিত। তাদের দু'আ কবুলের সম্ভাবনা বেশি।

ঙ. শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির স্নেহসম্ভাষণকে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে গ্রহণ করা উচিত।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
রিয়াযুস সালিহীন - হাদীস নং ৭১৩ | মুসলিম বাংলা