রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

২. বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়

হাদীস নং: ৭১৪
বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়
১৩ আপনজনকে বিদায় দেওয়া, সফর বা অন্য কোনও উপলক্ষ্যে বিচ্ছেদকালে তাকে অসিয়ত করা, তার জন্য দু'আ করা এবং তার কাছে দু'আ চাওয়া
বিদায় জানানোর দু‘আ
হাদীছ নং: ৭১৪

সালিম ইবন আব্দুল্লাহ ইবন উমর বলেন, কোনও লোক যখন সফরের ইচ্ছা করত, তখন আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. তাকে বলতেন, আমার কাছে এসো। যাতে আমি তোমাকে বিদায় দিতে পারি, যেভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে বিদায় দিতেন। তিনি বলতেন- أسْتَوْدِعُ اللَّهَ دِيْنَكَ وَأَمَانَتَكَ وَخَوَاتِيْمَ عَمَلِكَ (আমি তোমার দীন, তোমার আমানত ও তোমার শেষ আমলসমূহ আল্লাহর নিকট গচ্ছিত রাখছি)। -তিরমিযী
(জামে' তিরমিযী: ৩৪৩৮; সুনানে আবূ দাউদ: ২৬০০; মুসনাদে আহমাদ: ৪৫২৩; সুনানে ইবন মাজাহ: ২৮২৫; মুসনাদুল বাযযার ৬০৮০; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা: ৮৭৫৪ সহীহ ইবনে খুযায়মা ২৫৩১; হাকিম, আল মুস্তাদরাক ১৬১৭; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ১০৩১২)
كتاب الأدب
باب وداع الصاحب ووصيته عند فراقه للسفر وغيره والدعاء لَهُ وطلب الدعاء مِنْهُ
714 - وعن سالم بنِ عبدِ الله بنِ عمر: أنَّ عبدَ اللهِ بن عُمَرَ رضي الله عنهما، كَانَ يَقُولُ للرَّجُلِ إِذَا أرَادَ سَفَرًا: ادْنُ مِنِّي حَتَّى أُوَدِّعَكَ كَمَا كَانَ رسولُ الله - صلى الله عليه وسلم - يُوَدِّعُنَا، فَيَقُولُ: «أَسْتَوْدِعُ اللهَ دِينَكَ، وَأمَانَتَكَ، وَخَواتِيمَ عَمَلِكَ». رواه الترمذي، (1) وقال: «حديث حسن صحيح».

হাদীসের ব্যাখ্যা:

বিদায় জানানোর দু‘আ সম্পর্কে দুটি হাদীস দেখুন:

১. সালিম ইবন আব্দুল্লাহ ইবন উমর বলেন, কোনও লোক যখন সফরের ইচ্ছা করত, তখন আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. তাকে বলতেন, আমার কাছে এসো। যাতে আমি তোমাকে বিদায় দিতে পারি, যেভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে বিদায় দিতেন। তিনি বলতেন– أسْتَوْدِعُ اللَّهَ دِيْنَكَ وَأَمَانَتَكَ وَخَوَاتِيْمَ عَمَلِكَ (আমি তোমার দীন, তোমার আমানত ও তোমার শেষ আমলসমূহ আল্লাহর নিকট গচ্ছিত রাখছি)।

২. হযরত আব্দুল্লাহ ইবন ইয়াযীদ আল–খাতমী রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোনও সেনাদলকে বিদায় দেওয়ার ইচ্ছা করতেন, তখন أَسْتَوْدِعُ اللهَ دِينَكُمْ وَأَمَانَتَكُمْ وَخَوَاتِيمَ أَعْمَالِكُمْ (আমি তোমাদের আমানত ও তোমাদের শেষ আমলসমূহ আল্লাহর নিকট গচ্ছিত রাখছি)।

হাদীছদু'টির ব্যাখ্যাঃ

কেউ যখন সফরে যায় বা বিদায় গ্রহণ করে, তখন তার জন্য যে দু'আ করতে হয় তা এ হাদীছদু'টিতে শেখানো হয়েছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাউকে বা কোনও দলকে বিদায় জানানোর সময় এ দু'আ পড়তেন। বিদায়প্রার্থী একজন হলে তিনি বলতেন-
أَسْتَوْدِعُ اللَّهَ دِينَكَ وَأَمَانَتَكَ وَخَوَاتِيمَ عَمَلِكَ
‘আমি তোমার দীন, তোমার আমানত ও তোমার শেষ আমলসমূহ আল্লাহর নিকট গচ্ছিত রাখছি'।

আর বিদায়প্রার্থী একাধিক হলে বলতেন-
أَسْتَوْدِعُ اللَّهَ دِينَكُمْ وَأَمَانَتَكُمْ وَخَوَاتِيْمَ أَعْمَالِكُمْ
‘আমি তোমাদের দীন, তোমাদের আমানত ও তোমাদের শেষ আমলসমূহ আল্লাহর নিকট গচ্ছিত রাখছি'।

উভয়টি একই দু'আ। শুধু একবচন-বহুবচনের পার্থক্য। দু'আয় বিদায়প্রার্থীর দীন, আমানত ও মৃত্যুপূর্ববর্তী আমলকে আল্লাহ তা'আলার উপর ন্যস্ত করা হয়েছে। প্রথমে বলা হয়েছে- أَسْتَوْدِعُ اللَّهَ دِينَكَ (আমি তোমার দীন আল্লাহর নিকট গচ্ছিত রাখছি)। কারও কাছে কোনওকিছু গচ্ছিত রাখা হলে তার কর্তব্য পুরোপুরিভাবে তা সংরক্ষণ করা। অবহেলার কারণে নষ্ট হলে জরিমানা দিতে হয়। আল্লাহর কাছে গচ্ছিত রাখার অর্থ এই প্রার্থনা করা- যেন আল্লাহ তা পুরোপুরি হেফাজত করেন। প্রথমে গচ্ছিত রাখা হয়েছে বিদায়প্রার্থীর দীন। দীনই মানুষের আসল সম্পদ। সফরে মানুষ নানা পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। তখন দীনদারিতে বিঘ্ন ঘটার আশঙ্কা থাকে। এ অবস্থায় আপন দীন রক্ষার জন্য আল্লাহর সাহায্য অপরিহার্য। তিনি যেন এ সাহায্য করেন, সেজন্যই এ দু'আ।

দু'আর দ্বিতীয় বিষয় হল- وَأَمَانَتَكَ (আমি তোমার আমানত আল্লাহর নিকট গচ্ছিত রাখছি)। আমানত কথাটি ব্যাপক। আল্লাহ তা'আলা যেসকল বিধান বান্দার উপর আরোপ করেছেন তাও আমানত। শরী'আতের যাবতীয় আদেশ-নিষেধ পালন করার দ্বারা সে আমানত রক্ষা করা হয়। মানুষ একজন আরেকজনের কাছে যা-কিছু গচ্ছিত রাখে তাও আমানত। এরও হেফাজত জরুরি। এমনিভাবে স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিও আল্লাহর দেওয়া আমানত। এদের যাবতীয় হক আদায় করার দ্বারা সে আমানতের হেফাজত হয়। মানুষ যখন সফরে যায়, তখন এসকল আমানতের রক্ষণাবেক্ষণে ত্রুটি ঘটার আশঙ্কা থাকে। তাই এ ক্ষেত্রে আল্লাহর সাহায্য খুব বেশি প্রয়োজন। সেজন্যই দু'আ করা হয়েছে যে, আল্লাহ তা'আলা যেন বান্দার এসকল আমানত নিজ হেফাজতে নিয়ে নেন। তাঁর সদয় দৃষ্টি থাকলে সফরের ঝক্কি-ঝামেলা সত্ত্বেও বান্দার এসকল আমানতের কোনওরকম ক্ষতি সাধিত হবে না।

সবশেষে আছে- وَخَوَاتِيْمَ عَمَلِكَ (এবং তোমার শেষ আমলসমূহ আল্লাহর নিকট গচ্ছিত রাখছি)। এর দ্বারা বান্দার ওইসকল আমল বোঝানো উদ্দেশ্য, যা মৃত্যুর আগে আগে করা হয়। জীবনের শেষবেলার আমল অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় আমল যেমন হবে, বান্দার হাশর সে অনুযায়ীই হবে। বান্দার জীবনের শেষ সময়টায় শয়তান তার ঈমান-আমল বরবাদ করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে। কারণ এটা তার শেষ সুযোগ। এরপর আর সে বান্দাকে নাগালে পাবে না। তাই এ সময় আল্লাহ তা'আলার সাহায্যের প্রয়োজন সর্বাপেক্ষা বেশি। অন্যদিকে সফরে মানুষ নানা পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। আকস্মিক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে হতাহতেরও শিকার হয়। ফলে সফর থেকে অনেক সময় জীবন নিয়ে ঘরে ফেরা সম্ভব হয় না। তাই দু'আ করা হচ্ছে তার জীবনের শেষবেলার আমল যেন আল্লাহর হেফাজতে হয়। আল্লাহ তা'আলা হেফাজত করলে শয়তান সুযোগ পাবে না। ফলে মৃত্যু হয়ে গেলে সে মৃত্যু হবে নেক আমলের সঙ্গেই।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. দীন ও আমানতের হেফাজতে আল্লাহ তা'আলার সাহায্য খুব জরুরি। তাই আপন সতর্কতা ও চেষ্টার পাশাপাশি এর জন্য আল্লাহর কাছে দু'আও করা চাই।

খ. জীবনের শেষবেলার আমল খুব গুরুত্বপূর্ণ। কার জীবনের শেষবেলা কখন, তা কেউ জানে না। তাই সদাসর্বদা নেক আমলে মশগুল থাকা দরকার। যাতে মৃত্যুটা নেক আমলে মশগুল থাকা অবস্থায় হয়।

গ. কাউকে বিদায় দেওয়ার সময় হাদীছে বর্ণিত এ দু'আ পড়ার মাধ্যমে বিদায় গ্রহণকারীর জন্য শুভকামনা করা উচিত।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
রিয়াযুস সালিহীন - হাদীস নং ৭১৪ | মুসলিম বাংলা