রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

২. বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়

হাদীস নং: ৭১২
বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়
১৩ আপনজনকে বিদায় দেওয়া, সফর বা অন্য কোনও উপলক্ষ্যে বিচ্ছেদকালে তাকে অসিয়ত করা, তার জন্য দু'আ করা এবং তার কাছে দু'আ চাওয়া
এক প্রতিনিধিদলকে বিদায় দেওয়ার সময় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক তাদেরকে পরিবারের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য পালনের নির্দেশ
হাদীছ নং: ৭১২

হযরত আবূ সুলায়মান মালিক ইবনুল হুওয়ায়রিছ রাযি. বলেন, আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসলাম। আমরা সবাই ছিলাম কাছাকাছি বয়সের যুবক। আমরা তাঁর কাছে বিশ দিন থাকলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু ও কোমল চরিত্রের। তিনি ভাবলেন, আমরা পরিবারের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য আগ্রহী হয়ে পড়েছি। আমরা পরিবার-পরিজনের যাদেরকে রেখে এসেছি তাদের সম্পর্কে তিনি আমাদের জিজ্ঞেস করলেন। আমরা তাঁকে সে সম্পর্কে অবহিত করলাম। তিনি বললেন, তোমরা তোমাদের পরিবারবর্গের কাছে ফিরে যাও। তাদের মধ্যে অবস্থান করো। তাদেরকে শিক্ষাদান করো। তাদেরকে (দীনের উপর চলতে) আদেশ করো আর অমুক নামায অমুক সময়ে, অমুক নামায অমুক সময়ে আদায় করো। নামাযের সময় উপস্থিত হলে তোমাদের মধ্যে একজন আযান দেবে এবং তোমাদের মধ্যে যে সকলের বড় সে তোমাদের ইমামত করবে। -বুখারী ও মুসলিম
বুখারীর অপর এক বর্ণনায় আছে, তোমরা নামায পড়বে, যেরূপ আমাকে পড়তে দেখেছ।
(সহীহ বুখারী: ৬৩১; সহীহ মুসলিম: ৬৭৪; সুনানে নাসাঈ ৬৩৫; সহীহ ইবনে হিব্বান: ১৬৫৮; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর ৬৩৭; সুনানে দারা কুতনী: ১০৬৮; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ২২৬৯; সহীহ ইবনে খুযায়মা ৫৮৬; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ১৭২৫)
كتاب الأدب
باب وداع الصاحب ووصيته عند فراقه للسفر وغيره والدعاء لَهُ وطلب الدعاء مِنْهُ
712 - وعن أَبي سليمان مالِك بن الحُوَيْرِثِ - رضي الله عنه - قَالَ: أَتَيْنَا رسولَ الله - صلى الله عليه وسلم - وَنَحْنُ شَبَبَةٌ مُتَقَارِبُونَ، فَأقَمْنَا عِنْدَهُ عِشْرِينَ لَيْلَةً، وَكَانَ رسولُ الله - صلى الله عليه وسلم - رَحِيمًا رَفيقًا، فَظَنَّ أنّا قد اشْتَقْنَا أهْلَنَا، فَسَألَنَا عَمَّنْ تَرَكْنَا مِنْ أهْلِنَا، فَأخْبَرْنَاهُ، فَقَالَ: «ارْجِعُوا إِلَى أهْلِيكُمْ، فَأقِيمُوا فِيهمْ، وَعَلِّمُوهُم وَمُرُوهُمْ، وَصَلُّوا صَلاَةَ كَذَا فِي حِيْنِ كَذَا، وَصَلُّوا كَذَا في حِيْنِ كَذَا، فَإذَا حَضَرَتِ الصَّلاَةُ فَلْيُؤَذِّنْ لَكُمْ أحَدُكُمْ وَلْيَؤُمَّكُمْ أكْبَرُكُمْ». متفقٌ عَلَيْهِ. (1)
زاد البخاري في رواية لَهُ: «وَصَلُّوا كَمَا رَأيْتُمُونِي أُصَلِّي».
وَقَوْلُه: «رحِيمًا رَفِيقًا» رُوِيَ بِفاءٍ وقافٍ، وَرُوِيَ بقافينِ.

হাদীসের ব্যাখ্যা:

হযরত মালিক ইবনুল হুওয়ায়রিছ রাযি. তাঁর কাছাকাছি বয়সের একদল যুবকসহ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে টানা বিশ দিন অবস্থান করেন। এ সময়ে তারা কাছ থেকে তাঁকে দেখেছেন। তাঁর সাহচর্যে থেকে দীনের শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। তাঁকে কেমন দেখেছেন, সে সম্পর্কে হযরত মালিক রাযি. বলেন-
وَكَانَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ رَحِيمًا رَفِيقًا (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু ও কোমল চরিত্রের)। তিনি ছিলেন রহমাতুল লিল-আলামীন। সমস্ত মাখলুকের প্রতি ছিল তাঁর অপরিসীম দয়ামায়া। তাঁর মন ছিল অত্যন্ত কোমল। অন্যের দুঃখ তাঁকে পীড়া দিত। তাঁর কোনও কাজে কেউ যাতে কষ্ট না পায় সেদিকে তো লক্ষ রাখতেনই, সেইসঙ্গে কেউ অন্যের দ্বারা কষ্ট-ক্লেশের সম্মুখীন হলে সর্বদা তার সে কষ্টও নিবারণের চেষ্টা করতেন। কুরআনে তাঁর দয়ামায়ার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এভাবে-
لَقَدْ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مِنْ أَنْفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُمْ بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَحِيمٌ (128)
‘(হে মানুষ!) তোমাদের নিজেদের মধ্য থেকেই তোমাদের কাছে এক রাসূল এসেছে। তোমাদের যে-কোনও কষ্ট তার জন্য অতি পীড়াদায়ক। সে সতত তোমাদের কল্যাণকামী, মুমিনদের প্রতি অত্যন্ত সদয়, পরম দয়ালু।’ (সূরা তাওবা (৯), আয়াত ১২৮)

হযরত মালিক রাযি. ও তাঁর সঙ্গীগণ ছিলেন যুবক। স্বাভাবিকভাবেই তাদের অন্তরে বাড়ির প্রতি টান ছিল। একাধারে বিশ দিন বাইরে থাকায় বাড়িতে ফিরে যাওয়ার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে ওঠার কথা। কোমলপ্রাণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা উপলব্ধি করতে পারলেন। তাই তাদের কাছে তাদের বাড়ির খোঁজখবর নিলেন। বাড়িতে কে কে আছে তাও জেনে নিলেন। তিনি ভাবলেন এখন তাদের বাড়িতে যেতে দেওয়া উচিত। এর অতিরিক্ত থাকাটা তাদের পক্ষে কষ্টকর হবে। তবে তাদের সে যাওয়াটা যাতে কেবল মনের টানে পার্থিব যাওয়াই না হয়; বরং এর সঙ্গে দীনী চেতনা ও দীনী দায়িত্ব পালনের ইচ্ছাও সক্রিয় থাকে, সে লক্ষ্যে বললেন-
اِرْجِعُوْا إِلَى أَهْلِيْكُمْ، فَأَقِيمُوا فِيهِمْ، وَعَلِّمُوْهُمْ وَمُرُوهُمْ তোমরা তোমাদের পরিবারবর্গের কাছে ফিরে যাও। তাদের মধ্যে অবস্থান করো। তাদেরকে শিক্ষাদান করো। তাদেরকে (দীনের উপর চলতে) আদেশ করো'। এর মধ্যে কয়েকটি হুকুম রয়েছে। এক তো হল তাদের পরিবারবর্গের কাছে ফিরে যাওয়ার হুকুম। এ হুকুম দ্বারা তাদের পারিবারিক বন্ধনের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে এবং পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়ার স্বভাবগত ব্যাকুলতার মূল্যায়ন করা হয়েছে। এমন নয় যে, আমার কাছে ফিরে এসেছ, এ অবস্থায় আবার পরিবার-পরিজনের কথা মনে করা কেন? ওসব ছেড়ে-ছুঁড়ে দিয়ে আমার এখানেই পড়ে থাকো! না, পরিবারব্যবস্থাকে খাটো করা, পারিবারিক জীবনযাপনের স্বভাবগত চাহিদাকে উপেক্ষা করা ইসলামের শিক্ষা নয়। ইসলামের নবী তাঁর অনুসারীদেরকে পার্থিব সকল বন্ধন থেকে মুক্ত করে তাঁর দাসত্বের শেকল গলায় পরার আহ্বান জানান না। বরং প্রাকৃতিক চাহিদাজনিত সকল বন্ধনকে সুন্দর ও সুসংহত করার শিক্ষা দেন। ফলে তারা সেসকল বন্ধনের মাধুর্যে প্লাবিত হয়ে জীবনের সম্ভাবনাসমূহকে উৎকর্ষমণ্ডিত করে তোলার অনুপ্রেরণা পায়। এভাবে তারা বুঝতে পারে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা কী অমূল্য ধন। এ অনুভূতিতে তারা তাঁর ভক্তি-ভালোবাসা ও গোলামীর শেকল আপনিই আপন গলায় তুলে নেয়।

দ্বিতীয় হুকুম হল- তোমরা পরিবারের মধ্যেই অবস্থান করো। অর্থাৎ পরিবারকেন্দ্রিক জীবনযাপন করো। উপার্জনের জন্য বাইরে যাবে। উপার্জন শেষে ঘরে ফিরে আসবে। বাইরে যাওয়ার আরও বিভিন্ন অজুহাত থাকতে পারে। কিন্তু শেষটায় আপন ঘরই হবে ফেরার জায়গা। অহেতুক বাইরে ঘোরাফেরা করবে না। বাইরের প্রয়োজন সমাধার পর অবশিষ্ট সবটা সময় পরিবারকেই দেবে এবং তাদের প্রতি তোমার যেসকল যিম্মাদারী ও দায়িত্ব-কর্তব্য আছে তা পালনে সচেষ্ট থাকবে।

তৃতীয় হুকুম হল- তাদেরকে শিক্ষাদান করবে। অর্থাৎ আমার এখানে থেকে দীনের যে শিক্ষালাভ করলে, তাদেরকে তা শেখাবে। এটা পরিবারের কর্তার অবশ্যপালনীয় কর্তব্য। যে উলামার সাহচর্যে থেকে দীনের শিক্ষালাভ করবে। তারপর বাড়িতে এসে স্ত্রী ও সন্তানদের তা শেখাবে। পরিবারের সদস্যদেরকে দীনের শিক্ষাদান করা পরিবারের কর্তার দীনী দায়িত্ব। এ দায়িত্বে তার অবহেলা করার কোনও সুযোগ নেই।

চতুর্থ হুকুম হল দীনের শিক্ষা অনুযায়ী তারা যাতে আমল করে, তাদেরকে সে আদেশ করা। অর্থাৎ তাদের দীনী তরবিয়াত করা। দীনের শিক্ষা দিয়ে দেওয়াই যথেষ্ট নয়। শিক্ষা অনুযায়ী আমলের অনুশীলন করানোও জরুরি। ইসলামের শিক্ষা কেবল পাণ্ডিত্য অর্জনের জন্য নয়। বরং তার মূল উদ্দেশ্য জীবনগঠন। তাই শিক্ষাদানের পাশাপাশি তাদের জীবনাচরণে যাতে তা প্রতিফলিত হয়ে ওঠে, তার তত্ত্বাবধানও করতে হবে।

ইবাদত-বন্দেগীর মধ্যে নামায সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। তাই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে নামাযের বিষয়ে কিছুটা বিস্তারিত নির্দেশনা দান করেছেন। বলে দিয়েছেন কোন নামায কখন পড়তে হবে, নামায পড়তে হবে জামাতের সঙ্গে, এর জন্য আযান দিতে হবে, একজন ইমামত করবে, তবে যে-কেউ নয়; সবচে' যে বেশি উপযুক্ত সে, সবাই সমান উপযুক্ত হলে বয়সে যে সবার বড় সে ইমাম হবে। তিনি এককথায় বলে দিয়েছেন- তোমরা আমাকে যেভাবে নামায পড়তে দেখেছ, সেভাবে নামায পড়বে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. দয়া ও কোমলতা ছিল নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিশেষ গুণ। আমাদেরকেও এ গুণ অর্জন করতে হবে।

খ. পরিবারের প্রতি টান থাকা মানুষের স্বভাবগত বিষয়। এটা দোষের নয়। বরং এটা না থাকাই দোষের।

গ. মানুষের স্বভাবগত আবেগ-অনুভূতিকে মূল্য দিতে হবে।

ঘ. পারিবারিক দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করাও ইসলামী শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত।

ঙ. পরিবারকে সময় দেওয়া চাই। বাইরে বেহুদা সময় নষ্ট করা উচিত নয়।

চ. পরিবারের সদস্যদেরকে দীন শেখানো ও তাদের জীবনে দীনী শিক্ষার প্রতিফলন ঘটানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।

ছ. নামায যাতে সুন্নত মোতাবেক হয়, সেদিকে লক্ষ রাখা জরুরি।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)
রিয়াযুস সালিহীন - হাদীস নং ৭১২ | মুসলিম বাংলা