রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

২. বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়

হাদীস নং: ৭১১
বিবিধ আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়
আপনজনকে বিদায় দেওয়া, সফর বা অন্য কোনও উপলক্ষ্যে বিচ্ছেদকালে তাকে অসিয়ত করা, তার জন্য দু'আ করা এবং তার কাছে দু'আ চাওয়া

দুনিয়ায় মানুষের জীবন অবিচ্ছেদ্য নয়। নানা প্রয়োজনে একে অন্যের থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হয়। দীনী বা দুনিয়াবি দায়িত্ব-কর্তব্য পালনের জন্য অনেক সময় দূর-দূরান্তের সফরেও যেতে হয়। আরেক স্থায়ী বিচ্ছেদ তো আছেই। তা হচ্ছে মৃত্যু। মৃত্যুতে একের থেকে অন্যের যে বিচ্ছেদ ঘটে, তারপর ইহলোকে আর মিলনের কোনও সম্ভাবনা থাকে না। তো দুনিয়ার অস্থায়ী বিচ্ছেদ হোক বা মৃত্যুর স্থায়ী বিচ্ছেদ, উভয়রকম বিচ্ছেদের মুহূর্তটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়ে মানুষের আবেগ উচ্ছ্বসিত হয়। একের প্রতি অন্যের মন বিগলিত হয়ে ওঠে। এ সময়ে পারস্পরিক যে কথাবার্তা হয়, তা অন্তরে খুব দাগ কাটে। এটা মানুষের এক স্বাভাবিক অবস্থা।
আমাদের ইসলাম এক মহান দীন। এ দীন মানুষের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকেও তার মনুষ্যত্ব বিকাশের মহান লক্ষ্যের সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছে। প্রতিটি সুযোগকে মহৎ কাজে ব্যবহার করাই এ দীনের চরিত্র। পারস্পরিক বিচ্ছেদের আবেগঘন মুহূর্ত একটি সুযোগ। এ সুযোগের সদ্ব্যবহার দ্বারা মানুষ তার উৎকর্ষ বিকাশের পথে অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারে। তাই ইসলাম এ মুহূর্তটির বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। বিচ্ছেদের আবেগ-অনুভূতি যাতে এমনি এমনিই নিঃশেষ না হয়ে যায়; বরং জীবনগঠনে তা ভূমিকা রাখতে পারে, সে লক্ষ্যে এ মুহূর্তের সঙ্গে অর্থবহ অসিয়ত-উপদেশের বিধান জুড়ে দিয়েছে।
ইসলামে অসিয়ত-উপদেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা মানুষের অন্তরে প্রভাব বিস্তার করে। মানুষের জীবনবদলে এর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। আবার এটা যদি হয় পারস্পরিক বিচ্ছেদকালে, তবে এর উপকার হয় সুদূরপ্রসারী। তাই সফরকালে বা মৃত্যুর আগে জীবনগঠনমূলক অসিয়ত করা উচিত। মৃত্যুর আগে তো মৃত্যুপথযাত্রী অসিয়ত করবে। আর সফরকালে বিদায়দাতা বা বিদায় গ্রহণকারী উভয়ের যে-কেউ অসিয়ত করতে পারে। তবে তাদের মধ্যে কেউ অভিভাবক হয়ে থাকলে তার দিক থেকে অসিয়ত করাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
অসিয়ত দ্বারাই যে সবকিছু হয়ে যাবে এটা অনিবার্য নয়। এর জন্য আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে তাওফীক লাভ করাটাও জরুরি। তাই বিদায়কালে অসিয়তের পাশাপাশি আল্লাহ তা'আলার কাছে দু'আও করতে হবে।
ইসলাম অন্যসব জরুরি বিষয়ে যেমন আমাদেরকে দিকনির্দেশনা দান করেছে, তেমনি বিদায়কালীন কর্তব্য তথা অসিয়ত ও দু'আ সম্পর্কেও শিক্ষাদান করেছে যে, অসিয়ত কেমন হওয়া দরকার এবং বিদায়কালে আমরা কেমন কেমন দু'আ করব। এ বিষয়টি যেমন কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াতে বিবৃত হয়েছে, তেমনি এ সম্পর্কে আছে বহু হাদীছও। এ পরিচ্ছেদের আয়াত ও হাদীছসমূহ মূলত সে সম্পর্কেই। এগুলো মনোযোগ ও চিন্তা-ফিকিরের সঙ্গে পড়লে আমরা আলোচ্য বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা পেয়ে যাব। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে তা বোঝার ও আমল করার তাওফীক দান করুন।


‘আপনজনকে বিদায় দেওয়া…’ সম্পর্কিত একটি আয়াত

وَوَصَّى بِهَا إِبْرَاهِيمُ بَنِيهِ وَيَعْقُوبُ يَابَنِيَّ إِنَّ اللَّهَ اصْطَفَى لَكُمُ الدِّينَ فَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ (132) أَمْ كُنْتُمْ شُهَدَاءَ إِذْ حَضَرَ يَعْقُوبَ الْمَوْتُ إِذْ قَالَ لِبَنِيهِ مَا تَعْبُدُونَ مِنْ بَعْدِي قَالُوا نَعْبُدُ إِلَهَكَ وَإِلَهَ آبَائِكَ إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ إِلَهًا وَاحِدًا وَنَحْنُ لَهُ مُسْلِمُونَ (133)
অর্থ: ইবরাহীম তাঁর সন্তানদেরকে এ কথারই অসিয়ত করল এবং ইয়া‘কূবও (তাঁর সন্তানদেরকে) যে, হে আমার পুত্রগণ! আল্লাহ তোমাদের জন্য এ দীন মনোনীত করেছেন। সুতরাং তোমাদের মৃত্যু যেন এ অবস্থায়ই আসে, যখন তোমরা মুসলিম থাকবে। তোমরা নিজেরা কি সেই সময় উপস্থিত ছিলে, যখন ইয়া‘কূবের মৃত্যুক্ষণ এসে গিয়েছিল, যখন সে তার পুত্রদের বলেছিল, আমার পর তোমরা কার ইবাদত করবে? তারা সকলে বলেছিল, আমরা সেই এক আল্লাহরই ইবাদত করব, যিনি আপনার মাবুদ এবং আপনার বাপ-দাদা ইবরাহীম, ইসমাঈল ও ইসহাকেরও মাবুদ। আমরা কেবল তাঁরই অনুগত।(সূরা বাকারা (২), আয়াত ১৩২, ১৩৩)

ব্যাখ্যা
এ আয়াতের আগের আয়াতে অর্থাৎ সূরা বাকারা ১৩১ নং আয়াতে জানানো হয়েছে যে, হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের দীন ছিল ইসলাম। তিনি জীবনভর এ দীনের উপর চলেছেন। এখানকার প্রথম আয়াতে বলা হয়েছে, তিনি ওফাতের সময় নিজ সন্তানদেরকে এ দীন আঁকড়ে ধরার অসিয়ত করেছিলেন। হযরত ইয়া'কূব আলাইহিস সালাম ছিলেন তাঁর নাতি। অর্থাৎ তাঁর পুত্র ইসহাক আলাইহিস সালামের সন্তান। তিনিও ওফাতকালে নিজ সন্তানদের ইসলাম ধর্মে প্রতিষ্ঠিত থাকার অসিয়ত করে গেছেন। তাঁদের উভয়ের অসিয়তের ভাষা হল-
إِنَّ اللَّهَ اصْطَفَى لَكُمُ الدِّينَ فَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ (আল্লাহ তোমাদের জন্য এ দীন মনোনীত করেছেন। সুতরাং তোমাদের মৃত্যু যেন এ অবস্থায়ই আসে, যখন তোমরা মুসলিম থাকবে)। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলা যখন তোমাদের জন্য দীন হিসেবে ইসলামকে মনোনীত করেছেন, তখন তোমাদের কর্তব্য এরই উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা এবং এছাড়া অন্যসব মত ও পথ সর্বতোভাবে অগ্রাহ্য করা। তোমরা সর্বদা সকল ক্ষেত্রে এ দীনের উপর চলতে থাকবে। কখনও কোনও ক্ষেত্রেই এর থেকে বিমুখ হবে না। তবেই তোমাদের মৃত্যু তোমাদের মুসলিম থাকা অবস্থায় সংঘটিত হবে। মুসলিমরূপে মৃত্যুবরণ খুবই জরুরি। কেননা কবর-হাশর সকল ক্ষেত্রে মুক্তিলাভ করা এরই উপর নির্ভর করে। আল্লাহর কাছে যেহেতু ইসলামই একমাত্র মনোনীত দীন, তাই এছাড়া অন্য কোনও দিনের উপর মৃত্যুবরণ করলে আখিরাতে মুক্তিলাভ সম্ভব হবে না।
ইহুদিরা বলত, হযরত ইয়া'কুব আলাইহিস সালাম মৃত্যুকালে অসিয়ত করে গেছেন যেন তাঁর বংশধরগণ ইহুদিধর্মে প্রতিষ্ঠিত থাকে। তাদের এ দাবি যে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, সেদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ তা'আলা দ্বিতীয় আয়াতে বলছেন-
أَمْ كُنْتُمْ شُهَدَاءَ إِذْ حَضَرَ يَعْقُوبَ الْمَوْتُ (তোমরা নিজেরা কি সেই সময় উপস্থিত ছিলে, যখন ইয়া'কূবের মৃত্যুক্ষণ এসে গিয়েছিল)? অর্থাৎ তোমরা তো তখন উপস্থিত ছিলে না। তাহলে কী করে বলছ তিনি ইহুদিধর্মে প্রতিষ্ঠিত থাকার জন্য অসিয়ত করেছিলেন? তোমাদের এ দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। প্রকৃতপক্ষে তিনি অসিয়ত করেছিলেন তাঁর পূর্বপুরুষদের দীন ইসলামের উপর চলার জন্য। তিনি এ বিষয়ে তাঁর সন্তানদের থেকে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছিলেন। এসব কথা আল্লাহ তা'আলার জানা আছে। তিনি ওহীর মাধ্যমে তাঁর আখেরী নবী মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তা অবহিত করেছেন।
হযরত ইয়া'কুব আলাইহিস সালাম তাঁর সন্তানদের জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমার মৃত্যুর পর তোমরা কার ইবাদত করবে? অর্থাৎ তোমরা কোন দীনের উপর চলবে? এর উত্তরে তারা সকলেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল-
نَعْبُدُ إِلَهَكَ وَإِلَهَ آبَائِكَ إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ إِلَهًا وَاحِدًا وَنَحْنُ لَهُ مُسْلِمُونَ (আমরা সেই এক আল্লাহরই ইবাদত করব, যিনি আপনার মাবুদ এবং আপনার বাপ-দাদা ইবরাহীম, ইসমাঈল ও ইসহাকেরও মাবুদ। আমরা কেবল তাঁরই অনুগত)। অর্থাৎ আপনার পূর্বপুরুষগণ নিজেরা যে দীনের উপর ছিলেন এবং যে দীনের উপর আপনি নিজেও আছেন, আপনার পরে আমরাও সে দীন তথা ইসলামের উপরই প্রতিষ্ঠিত থাকব। আমরা মুসলিম তথা আল্লাহর অনুগত বান্দারূপে জীবনযাপন করব।
লক্ষণীয়, হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ও হযরত ইয়া'কূব আলাইহিস সালাম ওফাতের সময় তাঁর সন্তানদের যে অসিয়ত করেছিলেন তা ছিল কেবলই দীন সম্পর্কিত। তাঁরা জীবদ্দশায়ও সন্তানদের দীনী তরবিয়াত করেছেন, তাদেরকে দীনের উপর পরিচালিত করেছেন। তারপর তাঁদের মৃত্যুর পর তাঁরা যাতে দীনের উপর চলে, সে বিষয়েও সতর্ক থেকেছেন। অসিয়ত করাটা সে সতর্কতারই পরিচায়ক। এর মধ্যে

আমাদের জন্য শিক্ষা রয়েছে।
সাধারণত বাবা-মায়েরা সন্তানদের ভবিষ্যৎচিন্তায় তাদের জন্য টাকা-পয়সা জমা করে। নিজেদের মৃত্যুর পর যাতে তারা সচ্ছলভাবে চলতে পারে, তার ব্যবস্থা করে যায়। তাদের চিন্তা দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী ভবিষ্যৎকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। অথচ এরচে’ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল সমস্ত মানুষের আসল ভবিষ্যৎ আখিরাতের নাজাত ও সাফল্য কীভাবে লাভ হতে পারে সেই চিন্তা করা। এ চিন্তা নিজের জন্যও করা এবং সন্তানদের জন্যও। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا
‘হে মুমিনগণ! নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবারবর্গকে রক্ষা করো আগুন থেকে।’(সূরা তাহরীম (৬৬), আয়াত ৬)
পিতার জীবিতকালে তো ছেলেমেয়েরা তার তত্ত্বাবধানে থাকে। সে তাদের দীনী চালচলনের প্রতি লক্ষ রাখে এবং তা রাখা সম্ভব হয়। কিন্তু মৃত্যুর পর তারা কেমন চলবে তা তো জানা নেই। তাই মৃত্যুকালে বিশেষভাবে এ বিষয়ে অসিয়ত করে যাওয়া উচিত। সাধারণত সন্তান-সন্ততি অসিয়তের বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। কাজেই অসিয়ত যদি দীন সম্পর্কে হয়, তবে আশা থাকে তারা সে অসিয়ত রক্ষা করে দীনের উপর চলার চেষ্টা করবে। ফলে তারা আখিরাতে নাজাত পেয়ে যাবে এবং দীনদার পিতা-মাতার সঙ্গে মিলিত হতে পারবে। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে এ বিষয়ে সচেতন হওয়ার তাওফীক দান করুন।

আয়াতটির শিক্ষা
ক. ইসলাম আল্লাহ তা'আলার একমাত্র মনোনীত দীন।
খ. সর্বাবস্থায় সকল ক্ষেত্রে ইসলামের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে হবে। তাতে মুসলিমরূপে মৃত্যুর আশা থাকে।
গ. জীবদ্দশায় যেমন সন্তানদের দীনী তরবিয়াতে সচেষ্ট থাকা জরুরি, তেমনি তারা যাতে মৃত্যুর পরও দীনের উপর চলে সেই অসিয়ত করাও একান্ত কাম্য।
ঘ. পূর্বপুরুষগণ যদি দীনদার হয়, তবে তাদের অনুসরণ করাটা মোটেই দূষণীয় নয়: বরং সেটাই কাম্য এবং একে নিন্দা করাটাই নিন্দনীয়।
ঙ. দলীল-প্রমাণ ছাড়া মনগড়াভাবে বা অনুমান করে কোনও দাবি করা উচিত নয়। এরূপ দাবি করাটা ইহুদিদের চরিত্র।
চ. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অতীতের বিভিন্ন বিষয়ে আমাদেরকে অবহিত করেছেন। অথচ এসব বিষয়ে তাঁর জ্ঞানলাভের বাহ্যিক কোনও মাধ্যম ছিল না। এটা প্রমাণ করে আল্লাহ তা'আলা তাঁকে ওহীর মাধ্যমে তা জানিয়েছেন। সুতরাং তিনি নিঃসন্দেহে সত্যনবী।
কুরআনের অনুসরণ ও আহলে বায়তের মর্যাদা রক্ষা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসিয়ত
হাদীছ নং: ৭১১

হযরত যায়দ ইবন আরকাম রাযি. বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের মধ্যে ভাষণ দিতে দাঁড়ালেন। তিনি আল্লাহ তা'আলার হাম্দ ও গুণগান করার পর আমাদের উপদেশ দিলেন ও নসিহত করলেন। তারপর বললেন, হে লোক সকল! আমি একজন মানুষমাত্র। হয়তো অচিরেই আমার প্রতিপালকের দূত এসে যাবে এবং আমি তাঁর ডাকে সাড়া দেব। আমি তোমাদের মধ্যে দু'টি ভার রেখে যাচ্ছি। তার প্রথমটি হচ্ছে আল্লাহর কিতাব। তাতে আছে হিদায়াত ও আলো। তোমরা আল্লাহর কিতাব ধরে রেখো এবং তা শক্তভাবে ধরো। এভাবে তিনি আল্লাহর কিতাবের প্রতি উৎসাহ দিলেন ও তার প্রতি উদ্বুদ্ধ করলেন। তারপর বললেন, আর (দ্বিতীয়টি হচ্ছে) আমার আহলে বায়ত (পরিবারবর্গ)। আমি তোমাদেরকে আমার আহলে বায়তের ব্যাপারে আল্লাহকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম: ২৪০৮; মুসনাদে আহমাদ: ১৯২৬৫; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা : ১০৭১২; নাসাঈ, আসসুনানুল কুবরা: ৮১১৯; সহীহ ইবনে খুযায়মা: ২৩৫৭; তাবারানী, আল-মু'জামুল কাবীর: ৫০২৮; বায়হাকী, আস্সুনানুল কুবরা ১৩২৩৮)
كتاب الأدب
باب وداع الصاحب ووصيته عند فراقه للسفر وغيره والدعاء لَهُ وطلب الدعاء مِنْهُ
قَالَ الله تَعَالَى: {وَوَصَّى بِهَا إبْرَاهِيمُ بَنِيهِ وَيَعْقُوبُ يَا بَنِيَّ إنَّ اللهَ اصْطَفَى لَكُمُ الدّينَ فَلاَ تَمُوتُنَّ إِلاَّ وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ أَمْ كُنْتُمْ شُهَدَاءَ إذْ حَضَرَ يَعْقُوبَ المَوْتُ إذْ قَالَ لِبَنيهِ مَا تَعْبُدُونَ مِنْ بَعْدِي قَالُوا نَعْبُدُ إلهَكَ وَإلهَ آبَائِكَ إبْراهِيمَ وَإسْمَاعِيلَ وَإسْحاقَ إلهًا وَاحِدًا وَنَحْنُ لَهُ مُسْلِمُونَ} [البقرة: 132 - 133].
711 - حديث زيد بن أرقم - رضي الله عنه - الَّذِي سبق في بَابِ إكرام أهْلِ بَيْتِ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: قَامَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - فِينَا خَطِيبًا، فَحَمِدَ الله، وَأثْنَى عَلَيْهِ، وَوَعَظَ وَذَكَّرَ، ثُمَّ قَالَ: «أمَّا بَعْدُ، ألاَ أيُّهَا النَّاسُ، إنَّمَا أنَا بَشَرٌ يُوشِكُ أَنْ يَأتِيَ رَسُولُ رَبِّي فَأُجِيبَ، وَأنَا تَارِكٌ فِيكُمْ ثَقَلَيْنِ، أوَّلَهُمَا: كِتَابُ اللهِ، فِيهِ الْهُدَى وَالنُّورُ، فَخُذُوا بِكِتَابِ اللهِ وَاسْتَمْسِكُوا بِهِ»، فَحَثَّ عَلَى كِتَابِ اللهِ، وَرَغَّبَ فِيهِ، ثُمَّ قَالَ: «وَأَهْلُ بَيْتِي، أذَكِّرُكُمُ اللهَ في أهْلِ بَيْتِي». رواه مسلم، (1) وَقَدْ سَبَقَ بِطُولِهِ.

হাদীসের ব্যাখ্যা:

পবিত্র মক্কা ও মদীনার মাঝখানে 'গাদীরে খুম' নামক একটা জলাশয় ছিল। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজ্জ থেকে ফেরার সময় সে জলাশয়ের তীরে একটি ভাষণ দিয়েছিলেন। এ হাদীছটি সে ভাষণের অংশবিশেষ। হযরত যায়দ ইবন আরকাম রাযি. এটি বর্ণনা করেছেন। তাতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
أَلا أَيُّهَا النَّاسُ ، فَإِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ يُوْشِكَ أَنْ يَأْتِيَ رَسُوْلُ رَبِّي فَأَجِيْبَ (হে লোক সকল! আমি তো একজন মানুষই। হয়তো অচিরেই আমার প্রতিপালকের দূত এসে যাবে এবং আমি তাঁর ডাকে সাড়া দেব)। 'আমি তো একজন মানুষই' বলে তিনি তাঁর সম্পর্কে বাড়াবাড়িমূলক আকীদা-বিশ্বাস তৈরির ব্যাপারে সাবধান করেছেন।

প্রকাশ থাকে যে, প্রত্যেক নবীর সত্যতার প্রমাণস্বরূপ আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে বিভিন্ন মু'জিযা ও অলৌকিক ঘটনা প্রকাশ করা হয়েছিল। তেমনি আমাদের নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াতের সত্যতা প্রমাণার্থেও বহু নিদর্শন দেখানো হয়েছে। তাঁর শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন কুরআন মাজীদ। কুরআন আল্লাহ তা'আলার কালাম। কোনও মানুষের পক্ষে কুরআন মাজীদের সর্বপ্রকার ছোট সূরার মতো একটি সূরাও তৈরি করা সম্ভব নয়।

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আরও বহু মু'জিযা ছিল। তাঁর আঙ্গুলের ফাঁক থেকে পানির ফোয়ারা ছুটেছে, সামান্য এক পেয়ালা দুধে বহু লোকের ক্ষুধা মিটেছে, তাঁর আঙ্গুলের ইশারায় চাঁদ দু'টুকরো হয়েছে, রাতের সামান্য সময়ের মধ্যে পবিত্র মক্কা থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস এবং সেখান থেকে সপ্তাকাশ সফর করে এসেছেন, ক্ষুধার্ত উট তাঁর কাছে এসে মালিকের বিরুদ্ধে নালিশ জানিয়েছে। তাঁর ছিল এ জাতীয় আরও বহু মু'জিযা।

এসব মু'জিযা দেখে কারও দ্বারা তাঁর সম্পর্কে এ বিশ্বাস তৈরির আশঙ্কা ছিল যে, তিনি মানুষ নন; বরং আল্লাহর অবতার বা তাঁর ক্ষমতাসম্পন্ন কোনও সত্তা (না'ঊযু বিল্লাহি মিন যালিক), যেমন এক শ্রেণির লোক এ কালে বলছে যে, তিনি আল্লাহর নূরের সৃষ্টি। এ জাতীয় ভ্রান্ত আকীদা প্রতিরোধকল্পে তাঁর পক্ষ থেকে স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে যে, আমি তো একজন মানুষই। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ يُوحَى إِلَيَّ أَنَّمَا إِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ
‘বলে দাও, আমি তো তোমাদের মতো একজন মানুষই। (তবে) আমার প্রতি এই ওহী আসে যে, তোমাদের মাবুদ কেবল একই মাবুদ।’ (সূরা কাফ্ফ (১৮), আয়াত ১১০)
অর্থাৎ মানুষ হওয়ার ব্যাপারে তোমাদের সঙ্গে আমার পার্থক্য নেই। তবে হাঁ, আমি - যেহেতু একজন নবী বরং শ্রেষ্ঠতম ও সর্বশেষ নবী এবং আমার প্রতি ওহী নাযিল হয়, তাই নবুওয়াতের অপরিহার্য গুণাবলী আমার মধ্যে বিদ্যমান আছে। যেমন গুনাহ না করা, সর্বোচ্চ পর্যায়ের আখলাক-চরিত্রের অধিকারী হওয়া, নিখুঁত জ্ঞানবুদ্ধি থাকা, সাহসিকতা ও আল্লাহনির্ভরতার সর্বোচ্চ শিখরে অধিষ্ঠিত থাকা ইত্যাদি।
মানুষ মাত্রই মরণশীল। তিনি যখন একজন মানুষ তখন স্বাভাবিকভাবেই একদিন তাঁরও মৃত্যু হবে। তাঁর আগেও যত নবী-রাসূল এসেছিলেন তাদের মৃত্যু হয়েছে। - আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَمَا مُحَمَّدٌ إِلَّا رَسُولٌ قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهِ الرُّسُلُ

‘আর মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) একজন রাসূল বৈ তো নন! তাঁর পূর্বে বহু রাসূল গত হয়েছে।’ (সূরা আলে 'ইমরান (৩), আয়াত ১৪৪)

অন্যত্র ইরশাদ-
إِنَّكَ مَيِّتٌ وَإِنَّهُمْ مَيِّتُونَ (30)
‘(হে রাসূল!) নিশ্চয়ই তুমি মরণশীল এবং তারাও অবশ্যই মরণশীল।’ (সূরা যুমার (৩৯), আয়াত ৩০)

সুতরাং সৃষ্টি সম্পর্কে আল্লাহ তা'আলার এ চিরন্তন বিধান অনুযায়ী একদিন তাঁরও মৃত্যু হবে। সে কথাই তিনি স্পষ্ট করে দেন যে, অচিরেই আমার প্রতিপালকের দূত মালাকুল মাওত এসে যাবে। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে আমি তোমাদের নিকট থেকে বিদায় নিয়ে কবরের জগতে চলে যাব।

তাঁর এ ঘোষণায় শ্রোতামণ্ডলীর অন্তরে ভয় জাগার কথা যে, তিনি যতদিন জীবিত আছেন মানুষকে হিদায়াতের পথ দেখাচ্ছেন। তাঁর দ্বারা যে-কোনও জটিলতার সমাধান হয়ে যাচ্ছে। তিনি চলে যাওয়ার পর কে তাদের পথ দেখাবে? আপতিত সমস্যার সমাধান তখন কীভাবে নেওয়া যাবে? তিনি এ ভয় ও শঙ্কার নিরসনকল্পে ইরশাদ করেন-
أَنَا تَارِكٌ فِيْكُمْ ثَقَلَيْنِ (আমি তোমাদের মধ্যে দু'টি ভার রেখে যাচ্ছি)। ভার মানে মর্যাদাবান ও গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। আরবীতে যে-কোনও মূল্যবান ও মর্যাদাপূর্ণ বস্তু ও বিষয়কে ثَقَل (ভার) বলে। বাংলায়ও বলা হয়, ওজনদার কথা বা ওজনদার লোক। অর্থাৎ গুরুত্বপূর্ণ কথা ও মর্যাদাবান লোক। এ হাদীছে যে দু'টি বিষয় রেখে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে, অত্যন্ত মর্যাদাবান হওয়ায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে দু'টোকে ثَقَل শব্দে ব্যক্ত করেছেন। কী সে দু'টো বিষয়? সামনে তিনি এর ব্যাখ্যা করছেন-
أَوَّلُهُمَا كِتَابُ اللَّهِ، فِيْهِ الْهُدَى وَالنُّوْرُ (তার প্রথমটি হচ্ছে আল্লাহর কিতাব। তাতে আছে হিদায়াত ও আলো)। অর্থাৎ প্রথমটি হচ্ছে কুরআন মাজীদ। তাতে কিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত মানুষের জন্য হিদায়াত ও পথনির্দেশ আছে। তাতে আছে পথচলার আলো। আমি দুনিয়া থেকে চলে যাওয়ার পরও এ হিদায়াত ও আলো তোমাদের মধ্যে থাকবে। কিয়ামত পর্যন্ত তা সুরক্ষিত থাকার নিশ্চয়তা আছে। কেউ তা বিকৃত করতে পারবে না। তোমাদের দোজাহানের মুক্তি ও সফলতার লক্ষ্যে অনুসরণীয় সবকিছুই এতে বিদ্যমান আছে। যে-কোনও পরিস্থিতিতেই এ কিতাব তোমাদের পথ দেখাবে। যত জটিল সমস্যাই হোক না কেন, এর আলোকে তোমরা তার সমাধান করতে পারবে। এর অনুসরণ করলে তোমাদের পথ হারানোর কোনও ভয় নেই। কোনও জটিলতার আবর্তে পড়ে থাকার কোনও আশঙ্কা নেই। যেমন অপর এক বর্ণনায় আছে-
وَهُوَ حَبْلُ اللهِ ، مَنِ اتَّبَعَهُ كَانَ عَلَى الْهُدَى، وَمَنْ تَرَكَهُ كَانَ عَلَى ضَلَالَةٍ ( আর তা হচ্ছে আল্লাহর রশি। যে ব্যক্তি তার অনুসরণ করবে সে হিদায়াতের উপর থাকবে। আর যে তা পরিত্যাগ করবে সে পথভ্রষ্ট হবে)। সুতরাং তোমাদের কাজ কেবল সর্বাবস্থায় এ কিতাব আঁকড়ে ধরে থাকা।

অতঃপর তিনি কুরআন মাজীদ আঁকড়ে ধরে রাখার প্রতি উৎসাহ দান করেন। কোনও অবস্থায়ই তা থেকে বিচ্যুত না হওয়ার তাগিদ দেন। প্রকাশ থাকে যে, কুরআন আঁকড়ে ধরার জন্য হাদীছের অনুসরণ অপরিহার্য। কুরআনের সঙ্গে হাদীছের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। কাজেই কুরআনের পাশাপাশি হাদীছকেও আঁকড়ে ধরতে হবে। বিদায় হজ্জেরই অপর এক ভাষণে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
تَرَكْتُ فِيْكُمْ أَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوْا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا كِتَابَ اللَّهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ
‘আমি তোমাদের মধ্যে দু'টি বস্তু রেখে যাচ্ছি। যতক্ষণ তোমরা তা আঁকড়ে ধরে রাখবে, কিছুতেই পথভ্রষ্ট হবে না। আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নাহ।’ (মুআত্তা মালিক: ৬৭৮)

তারপর দ্বিতীয় বিষয়টি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন- وَأَهْلُ بَيْتِي أذَكِّرُكُمُ اللَّه فِي أَهْلِ بَيْتِي (আমার আহলে বায়ত। আমি তোমাদেরকে আমার আহলে বায়তের ব্যাপারে আল্লাহকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি)। অর্থাৎ দ্বিতীয় যে মর্যাদাপূর্ণ বিষয় তোমাদের মধ্যে রেখে যাচ্ছি তা হচ্ছে আমার আহলে বায়ত। সাবধান! তোমরা তাদের মর্যাদা রক্ষা করো। কিছুতেই তাদের অমর্যাদা করো না।

উল্লেখ্য, এ হাদীছটি ৫ম খণ্ডের ৩৪৬ ক্রমিক নম্বরে গত হয়েছে। সেখানে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. বক্তব্য ও ভাষণ দেওয়ার আগে আল্লাহর হাম্দ ও ছানা পড়ে নেওয়া চাই।

খ. কুরআন মাজীদ আল্লাহর কিতাব, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিজের রচনা নয়।

গ. যে ব্যক্তি কুরআন মাজীদ শক্ত করে ধরে রাখবে, সে হিদায়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে, পথভ্রষ্টতার শিকার হবে না।

ঘ. কুরআনই আলো। সর্বপ্রকার অন্ধকার ও পাশববৃত্তি থেকে মুক্ত আলোকিত জীবন গড়ার একমাত্র উপায় কুরআনের অনুসরণ।

ঙ. মুসলিম উম্মাহ'র মধ্যে আহলে বায়তের বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। তাদের সে মর্যাদা রক্ষা করা সকলের অবশ্যকর্তব্য।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)