রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
ভূমিকা অধ্যায়
হাদীস নং: ৬৭৩
নেতৃত্ব প্রার্থনায় নিষেধাজ্ঞা, নেতৃত্ব যদি কারও জন্য অবধারিত না হয়ে যায় বা তার জন্য তা গ্রহণের প্রয়োজন দেখা না দেয়, তবে তা গ্রহণ থেকে বিরত থাকা প্রসঙ্গ
নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব এক গুরুদায়িত্ব ও কঠিন আমানত। এ আমানত রক্ষা করা সকলের পক্ষে সম্ভব হয় না। এর জন্য যে বিচক্ষণতা, সতর্কতা ও সাহসিকতার প্রয়োজন, তা সকলের থাকে না। তা থাকে না বিধায় নেতৃত্ব গ্রহণকারীদের অধিকাংশেই যথাযথভাবে এ দায়িত্ব পালন করতে পারে না। ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় নানারকম ত্রুটি হয়ে যায় আর তাতে করে জনগণের নানা অধিকার খর্ব হয়, তাদের হক নষ্ট হয়। ব্যক্তিগতভাবে একজন দ্বারা আরেকজনের হক নষ্ট হওয়াও অনেক কঠিন ব্যাপার। সেখানে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বশীল ব্যক্তির দ্বারা যদি অন্যের হক নষ্ট হয়, তবে তা যে কত কঠিন ও কত গুরুতর, তা বলারই অপেক্ষা রাখে না। কেননা সে হক নষ্ট হওয়ার আওতায় পড়ে যায় বহু মানুষ। যার দ্বারা বহু লোকের অধিকার খর্ব হয়, আখিরাতে তার দুর্ভোগের কোনও সীমা থাকবে না। যে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব এহেন পরিণতি ডেকে আনে, তা কতইনা ভয়ংকর! নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
لا خَيْرَ فِي الْإِمَارَةِ لِرَجُلٍ مُؤْمِنٍ
‘মুমিন ব্যক্তির জন্য নেতৃত্বের ভেতর কোনও কল্যাণ নেই।(বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা ২০২১৭; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৫২৮৫; আবূ নু‘আয়ম,মা‘রিফাতুস সাহাবা:২২৭৬)
কেবল কি আখিরাতের ক্ষতি? নেতৃত্ব পার্থিব জীবনের জন্যও এক মহামসিবত। এর পেছনে যে পড়ে, তার জান-মাল, ইজ্জত-আব্রু সবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাহ্যত এটা লোভনীয় ও আকর্ষণীয়। তাই অপরিণামদর্শী মানুষ বিপুল উদ্যমে এ পথে পা বাড়ায়। এর ভেতর যে বিপত্তি লুকানো থাকে, তা টের পায় পরে। যখন সেই বাস্তবতার মুখোমুখি হয়, তখন আফসোসের সীমা থাকে না। তাই তো নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীছে ইরশাদ করেন-
إِنَّكُمْ سَتَحْرِصُوْنَ عَلَى الْإِمَارَةِ، وَسَتَكُونُ نَدَامَةً يَوْمَ الْقِيَامَةِ، فَنِعْمَ الْمُرْضِعَةُ وَبِئْسَتِ الْفَاطِمَةُ
‘অচিরেই তোমরা নেতৃত্বের প্রতি লালায়িত হবে। অথচ কিয়ামতের দিন তা হবে অনুতাপের কারণ। এটা এক চমৎকার স্তন্যদায়ী এবং অতি নিকৃষ্ট স্তন্যনিবারক।(সহীহ বুখারী: ৭১৪৮; সুনানে নাসাঈ: ৫৩৮৫; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৪৪৮২)
অর্থাৎ নেতৃত্ব ও ক্ষমতার সঙ্গে অর্থ, প্রতিপত্তি, আনন্দ, ভোগ-বিলাস ইত্যাদি সবই আছে। নেতৃত্ব লাভকারী এসব পায় ও চমৎকৃত হয়। কিন্তু তা কতদিন? একদিন না একদিন ক্ষমতা হারাতেই হয়। তখন এসব তো হারায়ই, সেইসঙ্গে হারায় মান-সম্মান। দিতে হয় দুর্নীতির খেসারত। সম্মুখীন হতে হয় জেল-জরিমানার। অনেক সময় প্রাণও যায়। সুতরাং নেতৃত্ব ও ক্ষমতা এমনই এক জননী, যে শুরুতে বড় মায়ায় দুধ পান করায়, কিন্তু পরিণামে যখন দুধ ছাড়ায় তখন সে বড় নিষ্ঠুর। প্রকৃত ভালো তো সেটাই, যার শেষটাও ভালো। শেষটা যার এমন মন্দ, তা কি আদৌ ভালো?
সুতরাং এহেন বিপজ্জনক নেতৃত্ব থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকাই শ্রেয়। আখিরাতের বিচারে যার ঈমান আছে, তার কিছুতেই নেতৃত্বের অভিলাষী হওয়া উচিত নয়। তবে হাঁ, যদি কখনও এমন পরিস্থিতি হয়, যখন কারও দৃষ্টিতে নেতৃত্বের জন্য তার চেয়ে উপযুক্ত কোনও লোক পাওয়া যাচ্ছে না এবং বিচক্ষণ ও বিবেচক ব্যক্তিবর্গ তাকেই এর জন্য উপযুক্ত মনে করছে, তখনকার কথা আলাদা। এরূপ ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই নেতৃত্বের জন্য সে নির্ধারিত হয়ে যায়। এ অবস্থায় তার জন্য নেতৃত্ব গ্রহণ করার অবকাশ আছে; বরং গ্রহণ করাই জরুরি। কেননা এটা সময়ের প্রয়োজন। এরূপ প্রয়োজন দেখা দিলে নেতৃত্ব চেয়ে নেওয়ারও অবকাশ থাকে।
বর্তমান অধ্যায়টি এ সম্পর্কেই। ইমাম নববী রহ. এ বিষয়ে একটি আয়াত ও কয়েকটি হাদীছ উল্লেখ করেছেন। আমরা তার তরজমা ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি।
‘নেতৃত্ব প্রার্থনায় নিষেধাজ্ঞা…’ সম্পর্কিত একটি আয়াত
এক নং আয়াত
تِلْكَ الدَّارُ الْآخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِينَ لَا يُرِيدُونَ عُلُوًّا فِي الْأَرْضِ وَلَا فَسَادًا وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِينَ (83)
অর্থ: ওই পরকালীন নিবাস তো আমি সেই সকল লোকের জন্যই নির্ধারণ করব, যারা পৃথিবীতে বড়ত্ব দেখাতে ও ফাসাদ সৃষ্টি করতে চায় না। শেষ পরিণাম তো মুত্তাকীদেরই অনুকূলে থাকবে।(সূরা কাসাস (২৮), আয়াত ৮৩)
ব্যাখ্যা
ইমাম নববী রহ. এ আয়াতটি এনেছেন নেতৃত্ব ও ক্ষমতা চাওয়া প্রসঙ্গে। নেতৃত্ব চাওয়াটা উপরে ওঠার অভিলাষ। এটা অহমিকার প্রকাশ। শুরুতে অহমিকা না থাকলেও পরে তা সৃষ্টি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে যথেষ্ট। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে মানুষ নেতৃত্ব কেন চাইবে? দেশের ও দশের নেতা হতে চাওয়াটা মূলত কিসের ইঙ্গিত বহন করে? নিজেকে অন্যদের তুলনায় বেশি যোগ্য ও উপযুক্ত মনে করা হয় বলেই তো এটা চাওয়া হয়। এটা অহংকারের লক্ষণ। নিতান্ত প্রয়োজন ও বাস্তবসম্মত না হলে এরূপ দাবি-দাওয়া করা বা চাওয়া কিছুতেই সমীচীন নয়। মানুষের প্রকৃত চাওয়ার বিষয় তো জান্নাত। পার্থিব উচ্চাভিলাষ জান্নাত পাওয়ার পক্ষে অন্তরায়। এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা বলেছেন-
تِلْكَ الدَّارُ الْآخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِينَ لَا يُرِيدُونَ عُلُوًّا فِي الْأَرْضِ وَلَا فَسَادًا (ওই পরকালীন নিবাস তো আমি সেই সকল লোকের জন্যই নির্ধারণ করব, যারা পৃথিবীতে বড়ত্ব দেখাতে ও ফাসাদ সৃষ্টি করতে চায় না)। عُلُوّ এর অর্থ উপর, উচ্চতা। কেউ যখন কোনও দিক থেকে কারও উপরে চলে যায়, তখন তার অন্তরে অহমিকা জন্মায়। তো আয়াতে বলা হচ্ছে, আল্লাহ তা'আলা জান্নাত দান করবেন ওইসব লোকের জন্য, যারা উচ্চাভিলাষী নয়, যারা পৃথিবীতে অন্যের উপরে উঠতে চায় না, অন্যের উপর বড়ত্ব জাহির করে না ও অহমিকা দেখায় না। ক্ষমতা ও উচ্চপদ চাওয়াটা এক রকম বড়ত্ব জাহির করাই বটে। কারও কারও ক্ষেত্রে শুরুতে এ অবস্থা থাকে না বটে, কিন্তু ক্ষমতা পাওয়ার পর বিনয়ভাব বজায় রাখা খুব সহজ কথা নয়। ক্ষমতার অহমিকা অনেককেই পেয়ে বসে। যারা সূক্ষ্ম অনুভূতিসম্পন্ন, তারা ছোট ছোট ক্ষমতার মধ্যেও সে অহমিকা অনুভব করে।
এ প্রসঙ্গে হযরত মিকদাদ রাযি.-এর একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়। একবার নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে কোনও এক কাজের আমীর বানিয়ে পাঠিয়েছিলেন। ফিরে আসার পর তিনি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আমীর’ পদটি কেমন পেলে হে মিকদাদ? তিনি উত্তর দেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার মনে হচ্ছিল সমস্ত লোক আমার চাকর-বাকর। সুতরাং আল্লাহর কসম! যতদিন জীবিত থাকি, কোনও কাজে আমীর হব না।(ইবন আসাকির, তারীখু দিমাশক, ৬০ খণ্ড, ১৬৯ পৃষ্ঠা; আল-মিযযী, তাহযীবুল কামাল, ২২ খণ্ড, ৩৭০ পৃষ্ঠা; যাহাবী, সিয়ারু আ'লামিন নুবালা, ৩ খণ্ড, ২৩৯ পৃষ্ঠা; মুনাবী, ফায়যুল কাদীর, হাদীছ নং ২৬৬৬; আবু নু'আয়ম, হিল্লিয়াতুল আওলিয়া, ১ খণ্ড, ১৭৪ পৃষ্ঠা)
فَسَاد অর্থ অশান্তি, বিপর্যয়, বিশৃঙ্খলা। যে-কোনও পাপকর্ম অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। তাই শব্দটি দ্বারা পাপকর্মও বোঝানো হয়ে থাকে। ক্ষমতার দাবিদার হওয়া বা ক্ষমতা চাওয়াটা ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টির এক কারণ। এ অভিলাষ যার অন্তরে থাকে, সে যে-কোনও উপায়ে তা পূরণ করতে চায়। তা রক্তপাতের মাধ্যমে হলেও। কোনও কারণে ক্ষমতা না পেলে সে ক্ষমতাপ্রাপ্তকে শান্তিতে থাকতে দেয় না। তার বিরুদ্ধে নানা অপতৎপরতা চালায়। ফলে দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট হয়ে যায়। এ আয়াতে জান্নাতলাভের উপায় বলা হয়েছে ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি থেকে বিরত থাকা। সুতরাং এর দাবি হল জান্নাতপ্রার্থী ব্যক্তি ক্ষমতার অভিলাষী হবে না। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদ তো নয়ই, ছোটখাটো রাষ্ট্রীয় পদ থেকেও সে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখবে।
আয়াতটির শেষে বলা হয়েছে- وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِينَ (শেষ পরিণাম তো মুত্তাকীদেরই অনুকূলে থাকবে)। শেষ পরিণাম মানে শুভ পরিণাম। অর্থাৎ জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও জান্নাতলাভ। এ সৌভাগ্য কেবল তাদেরই হবে, যারা তাকওয়ার অধিকারী। অর্থাৎ যারা আল্লাহ তা'আলার যাবতীয় আদেশ পালন করে এবং তিনি যা-কিছু নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকে। ক্ষমতা প্রার্থনা না করাও এর অন্তর্ভুক্ত। মুত্তাকী ব্যক্তি কখনও ক্ষমতা প্রার্থনা করে না। ক্ষমতার মোহ তাকওয়ার পরিপন্থী। ক্ষমতাসীন ব্যক্তির জন্য সবরকম লোভ-লালসা পূরণের সুযোগ অবারিত হয়ে যায়। কাজেই প্রবল নীতি-নৈতিকতা এবং দৃঢ় চারিত্রিক ক্ষমতার অধিকারী না হলে ক্ষমতাসীন ব্যক্তির পক্ষে তাকওয়া-পরহেযগারীর উপর চলা সম্ভব হয় না। অথচ এ আয়াতের বার্তা মোতাবেক শুভ পরিণাম অর্থাৎ জাহান্নাম হতে মুক্ত থেকে জান্নাত লাভ করা তাকওয়া-পরহেযগারী দ্বারাই সম্ভব। সুতরাং শুভ পরিণাম ও জান্নাতলাভের আশাবাদী ব্যক্তিদের জন্য যে-কোনও স্তরের রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে দূরে থাকাটাই নিরাপদ। এ অবস্থায় তার দাবি করা বা তা চাওয়াটা কীভাবে সমীচীন হতে পারে?
আয়াতটির শিক্ষা
ক. জান্নাত মুত্তাকীদের স্থায়ী বাসস্থান।
খ. অহংকার ও অহমিকা জান্নাতলাভের পক্ষে বাধা।
গ. জান্নাতের আশাবাদী ব্যক্তিকে অবশ্যই অশান্তিমূলক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে হবে।
ঘ. আল্লাহভীরু লোকদের কিছুতেই রাষ্ট্রক্ষমতার অভিলাষী হওয়া উচিত নয়। এমনকি রাষ্ট্রীয় কোনও পদও কামনা করা বাঞ্ছনীয় নয়।
নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব এক গুরুদায়িত্ব ও কঠিন আমানত। এ আমানত রক্ষা করা সকলের পক্ষে সম্ভব হয় না। এর জন্য যে বিচক্ষণতা, সতর্কতা ও সাহসিকতার প্রয়োজন, তা সকলের থাকে না। তা থাকে না বিধায় নেতৃত্ব গ্রহণকারীদের অধিকাংশেই যথাযথভাবে এ দায়িত্ব পালন করতে পারে না। ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় নানারকম ত্রুটি হয়ে যায় আর তাতে করে জনগণের নানা অধিকার খর্ব হয়, তাদের হক নষ্ট হয়। ব্যক্তিগতভাবে একজন দ্বারা আরেকজনের হক নষ্ট হওয়াও অনেক কঠিন ব্যাপার। সেখানে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বশীল ব্যক্তির দ্বারা যদি অন্যের হক নষ্ট হয়, তবে তা যে কত কঠিন ও কত গুরুতর, তা বলারই অপেক্ষা রাখে না। কেননা সে হক নষ্ট হওয়ার আওতায় পড়ে যায় বহু মানুষ। যার দ্বারা বহু লোকের অধিকার খর্ব হয়, আখিরাতে তার দুর্ভোগের কোনও সীমা থাকবে না। যে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব এহেন পরিণতি ডেকে আনে, তা কতইনা ভয়ংকর! নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
لا خَيْرَ فِي الْإِمَارَةِ لِرَجُلٍ مُؤْمِنٍ
‘মুমিন ব্যক্তির জন্য নেতৃত্বের ভেতর কোনও কল্যাণ নেই।(বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা ২০২১৭; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৫২৮৫; আবূ নু‘আয়ম,মা‘রিফাতুস সাহাবা:২২৭৬)
কেবল কি আখিরাতের ক্ষতি? নেতৃত্ব পার্থিব জীবনের জন্যও এক মহামসিবত। এর পেছনে যে পড়ে, তার জান-মাল, ইজ্জত-আব্রু সবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাহ্যত এটা লোভনীয় ও আকর্ষণীয়। তাই অপরিণামদর্শী মানুষ বিপুল উদ্যমে এ পথে পা বাড়ায়। এর ভেতর যে বিপত্তি লুকানো থাকে, তা টের পায় পরে। যখন সেই বাস্তবতার মুখোমুখি হয়, তখন আফসোসের সীমা থাকে না। তাই তো নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীছে ইরশাদ করেন-
إِنَّكُمْ سَتَحْرِصُوْنَ عَلَى الْإِمَارَةِ، وَسَتَكُونُ نَدَامَةً يَوْمَ الْقِيَامَةِ، فَنِعْمَ الْمُرْضِعَةُ وَبِئْسَتِ الْفَاطِمَةُ
‘অচিরেই তোমরা নেতৃত্বের প্রতি লালায়িত হবে। অথচ কিয়ামতের দিন তা হবে অনুতাপের কারণ। এটা এক চমৎকার স্তন্যদায়ী এবং অতি নিকৃষ্ট স্তন্যনিবারক।(সহীহ বুখারী: ৭১৪৮; সুনানে নাসাঈ: ৫৩৮৫; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৪৪৮২)
অর্থাৎ নেতৃত্ব ও ক্ষমতার সঙ্গে অর্থ, প্রতিপত্তি, আনন্দ, ভোগ-বিলাস ইত্যাদি সবই আছে। নেতৃত্ব লাভকারী এসব পায় ও চমৎকৃত হয়। কিন্তু তা কতদিন? একদিন না একদিন ক্ষমতা হারাতেই হয়। তখন এসব তো হারায়ই, সেইসঙ্গে হারায় মান-সম্মান। দিতে হয় দুর্নীতির খেসারত। সম্মুখীন হতে হয় জেল-জরিমানার। অনেক সময় প্রাণও যায়। সুতরাং নেতৃত্ব ও ক্ষমতা এমনই এক জননী, যে শুরুতে বড় মায়ায় দুধ পান করায়, কিন্তু পরিণামে যখন দুধ ছাড়ায় তখন সে বড় নিষ্ঠুর। প্রকৃত ভালো তো সেটাই, যার শেষটাও ভালো। শেষটা যার এমন মন্দ, তা কি আদৌ ভালো?
সুতরাং এহেন বিপজ্জনক নেতৃত্ব থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকাই শ্রেয়। আখিরাতের বিচারে যার ঈমান আছে, তার কিছুতেই নেতৃত্বের অভিলাষী হওয়া উচিত নয়। তবে হাঁ, যদি কখনও এমন পরিস্থিতি হয়, যখন কারও দৃষ্টিতে নেতৃত্বের জন্য তার চেয়ে উপযুক্ত কোনও লোক পাওয়া যাচ্ছে না এবং বিচক্ষণ ও বিবেচক ব্যক্তিবর্গ তাকেই এর জন্য উপযুক্ত মনে করছে, তখনকার কথা আলাদা। এরূপ ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই নেতৃত্বের জন্য সে নির্ধারিত হয়ে যায়। এ অবস্থায় তার জন্য নেতৃত্ব গ্রহণ করার অবকাশ আছে; বরং গ্রহণ করাই জরুরি। কেননা এটা সময়ের প্রয়োজন। এরূপ প্রয়োজন দেখা দিলে নেতৃত্ব চেয়ে নেওয়ারও অবকাশ থাকে।
বর্তমান অধ্যায়টি এ সম্পর্কেই। ইমাম নববী রহ. এ বিষয়ে একটি আয়াত ও কয়েকটি হাদীছ উল্লেখ করেছেন। আমরা তার তরজমা ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি।
‘নেতৃত্ব প্রার্থনায় নিষেধাজ্ঞা…’ সম্পর্কিত একটি আয়াত
এক নং আয়াত
تِلْكَ الدَّارُ الْآخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِينَ لَا يُرِيدُونَ عُلُوًّا فِي الْأَرْضِ وَلَا فَسَادًا وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِينَ (83)
অর্থ: ওই পরকালীন নিবাস তো আমি সেই সকল লোকের জন্যই নির্ধারণ করব, যারা পৃথিবীতে বড়ত্ব দেখাতে ও ফাসাদ সৃষ্টি করতে চায় না। শেষ পরিণাম তো মুত্তাকীদেরই অনুকূলে থাকবে।(সূরা কাসাস (২৮), আয়াত ৮৩)
ব্যাখ্যা
ইমাম নববী রহ. এ আয়াতটি এনেছেন নেতৃত্ব ও ক্ষমতা চাওয়া প্রসঙ্গে। নেতৃত্ব চাওয়াটা উপরে ওঠার অভিলাষ। এটা অহমিকার প্রকাশ। শুরুতে অহমিকা না থাকলেও পরে তা সৃষ্টি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে যথেষ্ট। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে মানুষ নেতৃত্ব কেন চাইবে? দেশের ও দশের নেতা হতে চাওয়াটা মূলত কিসের ইঙ্গিত বহন করে? নিজেকে অন্যদের তুলনায় বেশি যোগ্য ও উপযুক্ত মনে করা হয় বলেই তো এটা চাওয়া হয়। এটা অহংকারের লক্ষণ। নিতান্ত প্রয়োজন ও বাস্তবসম্মত না হলে এরূপ দাবি-দাওয়া করা বা চাওয়া কিছুতেই সমীচীন নয়। মানুষের প্রকৃত চাওয়ার বিষয় তো জান্নাত। পার্থিব উচ্চাভিলাষ জান্নাত পাওয়ার পক্ষে অন্তরায়। এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা বলেছেন-
تِلْكَ الدَّارُ الْآخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِينَ لَا يُرِيدُونَ عُلُوًّا فِي الْأَرْضِ وَلَا فَسَادًا (ওই পরকালীন নিবাস তো আমি সেই সকল লোকের জন্যই নির্ধারণ করব, যারা পৃথিবীতে বড়ত্ব দেখাতে ও ফাসাদ সৃষ্টি করতে চায় না)। عُلُوّ এর অর্থ উপর, উচ্চতা। কেউ যখন কোনও দিক থেকে কারও উপরে চলে যায়, তখন তার অন্তরে অহমিকা জন্মায়। তো আয়াতে বলা হচ্ছে, আল্লাহ তা'আলা জান্নাত দান করবেন ওইসব লোকের জন্য, যারা উচ্চাভিলাষী নয়, যারা পৃথিবীতে অন্যের উপরে উঠতে চায় না, অন্যের উপর বড়ত্ব জাহির করে না ও অহমিকা দেখায় না। ক্ষমতা ও উচ্চপদ চাওয়াটা এক রকম বড়ত্ব জাহির করাই বটে। কারও কারও ক্ষেত্রে শুরুতে এ অবস্থা থাকে না বটে, কিন্তু ক্ষমতা পাওয়ার পর বিনয়ভাব বজায় রাখা খুব সহজ কথা নয়। ক্ষমতার অহমিকা অনেককেই পেয়ে বসে। যারা সূক্ষ্ম অনুভূতিসম্পন্ন, তারা ছোট ছোট ক্ষমতার মধ্যেও সে অহমিকা অনুভব করে।
এ প্রসঙ্গে হযরত মিকদাদ রাযি.-এর একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়। একবার নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে কোনও এক কাজের আমীর বানিয়ে পাঠিয়েছিলেন। ফিরে আসার পর তিনি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আমীর’ পদটি কেমন পেলে হে মিকদাদ? তিনি উত্তর দেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার মনে হচ্ছিল সমস্ত লোক আমার চাকর-বাকর। সুতরাং আল্লাহর কসম! যতদিন জীবিত থাকি, কোনও কাজে আমীর হব না।(ইবন আসাকির, তারীখু দিমাশক, ৬০ খণ্ড, ১৬৯ পৃষ্ঠা; আল-মিযযী, তাহযীবুল কামাল, ২২ খণ্ড, ৩৭০ পৃষ্ঠা; যাহাবী, সিয়ারু আ'লামিন নুবালা, ৩ খণ্ড, ২৩৯ পৃষ্ঠা; মুনাবী, ফায়যুল কাদীর, হাদীছ নং ২৬৬৬; আবু নু'আয়ম, হিল্লিয়াতুল আওলিয়া, ১ খণ্ড, ১৭৪ পৃষ্ঠা)
فَسَاد অর্থ অশান্তি, বিপর্যয়, বিশৃঙ্খলা। যে-কোনও পাপকর্ম অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। তাই শব্দটি দ্বারা পাপকর্মও বোঝানো হয়ে থাকে। ক্ষমতার দাবিদার হওয়া বা ক্ষমতা চাওয়াটা ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টির এক কারণ। এ অভিলাষ যার অন্তরে থাকে, সে যে-কোনও উপায়ে তা পূরণ করতে চায়। তা রক্তপাতের মাধ্যমে হলেও। কোনও কারণে ক্ষমতা না পেলে সে ক্ষমতাপ্রাপ্তকে শান্তিতে থাকতে দেয় না। তার বিরুদ্ধে নানা অপতৎপরতা চালায়। ফলে দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট হয়ে যায়। এ আয়াতে জান্নাতলাভের উপায় বলা হয়েছে ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি থেকে বিরত থাকা। সুতরাং এর দাবি হল জান্নাতপ্রার্থী ব্যক্তি ক্ষমতার অভিলাষী হবে না। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদ তো নয়ই, ছোটখাটো রাষ্ট্রীয় পদ থেকেও সে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখবে।
আয়াতটির শেষে বলা হয়েছে- وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِينَ (শেষ পরিণাম তো মুত্তাকীদেরই অনুকূলে থাকবে)। শেষ পরিণাম মানে শুভ পরিণাম। অর্থাৎ জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও জান্নাতলাভ। এ সৌভাগ্য কেবল তাদেরই হবে, যারা তাকওয়ার অধিকারী। অর্থাৎ যারা আল্লাহ তা'আলার যাবতীয় আদেশ পালন করে এবং তিনি যা-কিছু নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকে। ক্ষমতা প্রার্থনা না করাও এর অন্তর্ভুক্ত। মুত্তাকী ব্যক্তি কখনও ক্ষমতা প্রার্থনা করে না। ক্ষমতার মোহ তাকওয়ার পরিপন্থী। ক্ষমতাসীন ব্যক্তির জন্য সবরকম লোভ-লালসা পূরণের সুযোগ অবারিত হয়ে যায়। কাজেই প্রবল নীতি-নৈতিকতা এবং দৃঢ় চারিত্রিক ক্ষমতার অধিকারী না হলে ক্ষমতাসীন ব্যক্তির পক্ষে তাকওয়া-পরহেযগারীর উপর চলা সম্ভব হয় না। অথচ এ আয়াতের বার্তা মোতাবেক শুভ পরিণাম অর্থাৎ জাহান্নাম হতে মুক্ত থেকে জান্নাত লাভ করা তাকওয়া-পরহেযগারী দ্বারাই সম্ভব। সুতরাং শুভ পরিণাম ও জান্নাতলাভের আশাবাদী ব্যক্তিদের জন্য যে-কোনও স্তরের রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে দূরে থাকাটাই নিরাপদ। এ অবস্থায় তার দাবি করা বা তা চাওয়াটা কীভাবে সমীচীন হতে পারে?
আয়াতটির শিক্ষা
ক. জান্নাত মুত্তাকীদের স্থায়ী বাসস্থান।
খ. অহংকার ও অহমিকা জান্নাতলাভের পক্ষে বাধা।
গ. জান্নাতের আশাবাদী ব্যক্তিকে অবশ্যই অশান্তিমূলক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে হবে।
ঘ. আল্লাহভীরু লোকদের কিছুতেই রাষ্ট্রক্ষমতার অভিলাষী হওয়া উচিত নয়। এমনকি রাষ্ট্রীয় কোনও পদও কামনা করা বাঞ্ছনীয় নয়।
চেয়ে নেতৃত্বগ্রহণ ও না চেয়ে পাওয়ার মধ্যে পার্থক্য
হাদীছ নং: ৬৭৩
হযরত আবূ সা‘ঈদ আব্দুর রহমান ইবন সামুরা রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলেছেন, হে আব্দুর রহমান ইবন সামুরা! তুমি নেতৃত্ব চেয়ো না। কেননা বিনা চাওয়ায় তোমাকে তা দেওয়া হলে তাতে তুমি সাহায্যপ্রাপ্ত হবে। আর যদি চাওয়ার কারণে তোমাকে তা দেওয়া হয়, তবে তোমাকে তাতে (বিনা সাহায্যে) ছেড়ে দেওয়া হবে। তুমি যখন কোনও বিষয়ে শপথ করবে, তারপর তার বিপরীত কাজকে তারচে' উত্তম দেখতে পাবে, তখন যা উত্তম তাই করবে আর তোমার শপথের কাফফারা আদায় করবে। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৭১৪৬; সহীহ মুসলিম: ১৬৫২; সুনানে আবূ দাউদ: ২৯২৯; জামে তিরমিযী: ১৬০৯; সুনানে নাসাঈ : ৫৩৮৪; মুসনাদে আহমাদ: ২০৬১৮; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৪৩৪৮; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ৫৯; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ১৯৮৪১; সুনানে দারিমী: ২৩৯১)
হাদীছ নং: ৬৭৩
হযরত আবূ সা‘ঈদ আব্দুর রহমান ইবন সামুরা রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলেছেন, হে আব্দুর রহমান ইবন সামুরা! তুমি নেতৃত্ব চেয়ো না। কেননা বিনা চাওয়ায় তোমাকে তা দেওয়া হলে তাতে তুমি সাহায্যপ্রাপ্ত হবে। আর যদি চাওয়ার কারণে তোমাকে তা দেওয়া হয়, তবে তোমাকে তাতে (বিনা সাহায্যে) ছেড়ে দেওয়া হবে। তুমি যখন কোনও বিষয়ে শপথ করবে, তারপর তার বিপরীত কাজকে তারচে' উত্তম দেখতে পাবে, তখন যা উত্তম তাই করবে আর তোমার শপথের কাফফারা আদায় করবে। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৭১৪৬; সহীহ মুসলিম: ১৬৫২; সুনানে আবূ দাউদ: ২৯২৯; জামে তিরমিযী: ১৬০৯; সুনানে নাসাঈ : ৫৩৮৪; মুসনাদে আহমাদ: ২০৬১৮; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৪৩৪৮; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ৫৯; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ১৯৮৪১; সুনানে দারিমী: ২৩৯১)
81 - باب النهي عن سؤال الإمارة واختيار ترك الولايات إذا لَمْ يتعين عليه أَوْ تَدْعُ حاجة إِلَيْهِ
قَالَ الله تَعَالَى: {تِلْكَ الدَّارُ الآخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِينَ لا يُريدُونَ عُلوًّا في الأَرْضِ وَلاَ فَسَادًا وَالعَاقِبَةُ للمُتَّقِينَ} [القصص: 83].
قَالَ الله تَعَالَى: {تِلْكَ الدَّارُ الآخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِينَ لا يُريدُونَ عُلوًّا في الأَرْضِ وَلاَ فَسَادًا وَالعَاقِبَةُ للمُتَّقِينَ} [القصص: 83].
673 - وعن أَبي سعيدٍ عبدِ الرحمانِ بن سَمُرَة - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ لي رسول الله - صلى الله عليه وسلم: «يَا عَبْدَ الرَّحْمن بن سَمُرَةَ، لاَ تَسْأَلِ الإمَارَةَ؛ فَإِنَّكَ إِنْ أُعْطِيتَهَا عَنْ غَيْرِ مَسْألَةٍ أُعِنْتَ عَلَيْهَا، وَإنْ أُعْطِيتَهَا عَنْ مَسْألَةٍ وُكِلْتَ إِلَيْهَا، وَإِذَا حَلَفْتَ عَلَى يَمِينٍ، فَرَأيْتَ غَيْرَهَا خَيْرًا مِنْهَا، فَأْتِ الَّذِي هُوَ خَيْرٌ وَكَفِّرْ عَنْ يَمِينكَ». متفقٌ عَلَيْهِ. (1)
হাদীসের ব্যাখ্যা:
কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওযু করছিলেন। এ সময় হযরত আব্দুর রহমান ইবন সামুরা রাযি. তাঁর কাছে আসেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে দেখে নিজের কাছে ডাকলেন। বললেন, এসো হে আব্দুর রহমান ইবন সামুরা! তুমি নেতৃত্ব চেয়ো না।
হতে পারে তাঁর অন্তরে নেতৃত্বের অভিলাষ ছিল। তিনি তা চাওয়ার জন্যই এসেছিলেন। এ কথা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ওহীর মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয়। তাই তিনি তাঁকে এই বলে সতর্ক করেন যে- لَا تَسْأَلِ الْإِمَارَةَ (তুমি নেতৃত্ব চেয়ো না)। বোঝা গেল নেতৃত্ব চাওয়া জায়েয নয়। কাজেই যে ব্যক্তি নেতৃত্ব চায়, তাকে নেতা বানানো উচিত নয়। সুতরাং এক ব্যক্তি নেতৃত্ব চাইলে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেছিলেন-
إِنَّا وَاللَّهِ لَا نُوَلِّي عَلَى هَذَا الْعَمَلِ أَحَدًا سَأَلَهُ، وَلَا أَحَدًا حَرَصَ عَلَيْهِ
আল্লাহর কসম! আমরা এ কাজের দায়িত্ব এমন কারও উপর অর্পণ করি না, যে তা চায় এবং এমন কারও উপরও নয়, যে তার লোভ করে। (সহীহ বুখারী: ৭১৪৯; সহীহ মুসলিম: ১৭৩৩)
এখানে সাধারণভাবে বলা হয়েছে, নেতৃত্ব চেয়ো না। বোঝা গেল, বড় নেতৃত্ব-ছোট নেতৃত্ব কোনওটাই চাওয়া জায়েয নয়। রাষ্ট্রক্ষমতাও চাওয়া জায়েয নয় এবং জনপ্রতিনিধিত্বমূলক অন্য কোনও পদও আর না রাষ্ট্রীয় অন্য কোনও দায়িত্ব। তবে হাঁ, যদি সরকারি কোনও পদ কোনও অযোগ্য ব্যক্তির উপর ন্যস্ত হওয়ার কারণে মানুষের ক্ষতি হবে বলে প্রবল আশঙ্কা থাকে, তবে এরূপ ঠেকা অবস্থায় সৎ, যোগ্য ও মুত্তাকী ব্যক্তির পক্ষে পদ প্রার্থনা করা জায়েয আছে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় হযরত ইয়ূসুফ আলাইহিস সালামের ঘটনায়। ইয়ূসুফ আলাইহিস সালাম মিশরের রাজাকে বলেছিলেন-
قَالَ اجْعَلْنِي عَلَى خَزَائِنِ الْأَرْضِ إِنِّي حَفِيظٌ عَلِيمٌ (55)
ইউসুফ বলল, আপনি আমাকে দেশের অর্থ-সম্পদের (ব্যবস্থাপনা) কার্যে নিযুক্ত করুন। নিশ্চিত থাকুন আমি রক্ষণাবেক্ষণ বেশ ভালো পারি এবং আমি (এ কাজের) পূর্ণ জ্ঞান রাখি। (সূরা ইয়ূসুফ (১২), আয়াত ৫৫)
তিনি আশঙ্কাবোধ করেছিলেন দুর্ভিক্ষকালে মানুষ অন্যায়-অবিচারের সম্মুখীন হতে পারে। এ অবস্থায় দেশের অর্থ-সম্পদের বিলি-বণ্টনব্যবস্থা কোনও সৎ ও যোগ্য ব্যক্তির হাতে থাকা দরকার। আর সেজন্য তাঁর বিশ্বাসমতে তিনি নিজেই ছিলেন সর্বাপেক্ষা বেশি উপযুক্ত। তাছাড়া মিশর দেশটি ছিল অমুসলিম অধ্যুষিত। সেখানে আল্লাহ তা'আলার আইন প্রতিষ্ঠা করার জন্য হযরত ইয়ূসুফ আলাইহিস সালামের নিজের দায়িত্ব গ্রহণ ছাড়া কোনও উপায়ও ছিল না। এ কারণেই তিনি দেশের অর্থ বিভাগের দায়িত্ব নিজ মাথায় তুলে নেন।
সুতরাং আজও যদি কেউ রাষ্ট্রীয় কোনও পদের ক্ষেত্রে মনে করে যে, সে পদ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার মতো উপযুক্ত কোনও লোক নেই আর তার নিজের প্রতি এ আত্মবিশ্বাস থাকে যে, তার পক্ষে তা যথাযথভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হবে আর সে পদের প্রতি তার নিজের কোনও লোভ নেই কিংবা ব্যক্তিগত কোনও স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যও তার নেই, উদ্দেশ্য কেবলই মানুষের সেবা করা ও আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি অর্জন করা, তবে তার জন্যও সে পদ চেয়ে নেওয়ার অবকাশ আছে। এরূপ ব্যতিক্রম অবস্থা ছাড়া সাধারণভাবে পদ প্রার্থনা করার কোনও সুযোগ নেই। কেন তা করা উচিত নয়, সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
فَإِنَّكَ إِنْ أُعْطِيتَهَا عَنْ غَيْرِ مَسْأَلَةٍ أُعِنْتَ عَلَيْهَا (কেননা বিনা চাওয়ায় তোমাকে তা দেওয়া হলে তাতে তুমি সাহায্যপ্রাপ্ত হবে)। অর্থাৎ তোমার মনে যদি নেতৃত্বের লোভ না থাকে এবং নিজের পক্ষ থেকে তা পাওয়ার জন্য আগ্রহও প্রকাশ না কর আর এ অবস্থায় আল্লাহ তা'আলা তোমাকে নেতৃত্বের আসনে বসান অথবা জনগণ তোমাকে ক্ষমতাসীন করে কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান নিজের থেকে তোমাকে কোনও দায়িত্বে নিয়োজিত করেন, তবে তোমার জন্য তা গ্রহণ করা নাজায়েয হবে না। বরং তুমি যাতে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পার, সেজন্য আল্লাহ তা'আলা তোমাকে সাহায্য করবেন। আল্লাহ তা'আলা তোমার উপযুক্ত সহযোগী মিলিয়ে দেবেন। জনগণ তোমার পক্ষে থাকবে। পরিবেশ-পরিস্থিতি তুমি অনুকূলে পাবে। ফলে দায়িত্ব পালন করা তোমার জন্য সহজ হয়ে যাবে। বোঝা গেল পদের প্রতি যদি চাহিদা না থাকে আর এ অবস্থায় তা এসে যায়, তবে গ্রহণ করা দোষের নয়; বরং আল্লাহর উপর ভরসা করে তা গ্রহণ করলে তা নিজের দুনিয়া ও আখিরাতের জন্য কল্যাণকর হবে এবং মানুষও উপকৃত হবে।
وَإِنْ أعْطِيتَهَا عَنْ مَسْأَلَةٍ وُكِلْتَ إِلَيْهَا ‘আর যদি চাওয়ার কারণে তোমাকে তা দেওয়া হয়, তবে তোমাকে তাতে (বিনা সাহায্যে) ছেড়ে দেওয়া হবে'। অর্থাৎ ক্ষমতা ও পদের প্রতি লোভী হয়ে যদি তুমি তার প্রার্থী হও আর এ অবস্থায় তোমাকে তাতে বসানো হয়, তবে তুমি আল্লাহর সাহায্য পাবে না। সে দায়িত্ব আঞ্জাম দেওয়ার ক্ষেত্রে আল্লাহ তা'আলা তোমাকে একাকী ছেড়ে দেবেন। তিনি জনমনে তোমার প্রতি ভালোবাসা ও সহানুভূতি সৃষ্টি করবেন না। তুমি তোমার পাশে উপযুক্ত সহযোগী পাবে না। পরিবেশ- পরিস্থিতি তোমার অনুকূলে থাকবে না। ফলে সহজ সহজ কাজও তোমার পক্ষে কঠিন হয়ে যাবে। তুমি দায়িত্বপালনে ব্যর্থতার পরিচয় দেবে। এভাবে তুমি দুনিয়ায়ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে আর আখিরাতও হারাবে। এটা লোভের খেসারত। কাজেই কোনও বুদ্ধিমান ব্যক্তির কিছুতেই ক্ষমতার প্রতি লোভ করা উচিত নয়। তা চাওয়া উচিত নয় কিছুতেই। হাঁ, সে যদি আগ্রহী না হয় আর এ অবস্থায় তাকে ক্ষমতায় বা বিশেষ কোনও পদে বসিয়ে দেওয়া হয়, তবে তাতে কোনও দোষ নেই; বরং এটা তার জন্য দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতে কল্যাণকর সাব্যস্ত হবে।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আব্দুর রহমান ইবন সামুরা রাযি.-কে শপথ সম্পর্কেও নির্দেশনা দান করেন। মানুষ অনেক সময় আবেগতাড়িত হয়ে বা উত্তেজনাবশত কোনও কাজ সম্পর্কে শপথ করে বসে যে, সে ওই কাজটি অবশ্যই করবে বা কিছুতেই তা করবে না। কিন্তু পরে যখন আবেগ স্বাভাবিক হয়ে আসে বা উত্তেজনা প্রশমিত হয়, তখন লক্ষ করে দেখে যে, তার এ শপথ করা ঠিক হয়নি। কারণ শপথের বিপরীত কাজটি তার জন্য ভালো ছিল। এখন শপথ করার কারণে সে আটকে গেছে। তার পক্ষে ওই ভালো কাজটি করা সম্ভব হচ্ছে না। তা করতে গেলে শপথ ভাঙতে হয়। কিন্তু শপথ করে তা ভেঙ্গে ফেলাও গুনাহের কাজ। এতে আল্লাহর নামের অমর্যাদা হয়। এ অবস্থায় তার করণীয় কী? কীভাবে এ উভয়সংকট থেকে সে বাঁচতে পারে? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশনা দান করেন-
وَإِذَا حَلَفْتَ عَلَى يَمِين، فَرَأَيْتَ غَيْرَهَا خَيْرًا مِنْهَا ، فَأْتِ الَّذِي هُوَ خَيْرٌ وَكَفِّرْ عَنْ يَمِينِكَ
(তুমি যখন কোনও বিষয়ে শপথ করবে, তারপর তার বিপরীত কাজকে তারচে' উত্তম দেখতে পাবে, তখন যা উত্তম তাই করবে আর তোমার শপথের কাফফারা আদায় করবে)। অর্থাৎ শপথ করাটা যেন তোমার সেই উত্তম কাজ করার পক্ষে বাধা না হয়। বরং তুমি শপথ ভেঙ্গে সেই উত্তম কাজটিই করবে। আর শপথ ভাঙ্গার কারণে কাফফারা আদায় করবে। শপথ ভাঙ্গার কাফফারা হল দশজন মিসকীনকে মধ্যম মানের খাবার সকাল-বিকাল দু'বেলা খাওয়ানো বা একজন মিসকীনকে দশদিন খাওয়ানো অথবা দশজন গরীবকে ছতর ঢাকা পরিমাণ কাপড় দেওয়া। আর যদি এর কোনওটিরই সামর্থ্য না থাকে, তবে পরপর তিনদিন তিনটি রোযা রাখা।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. নেতৃত্ব বা রাষ্ট্রীয় কোনও পদ নিজের পক্ষ থেকে চাইতে নেই।
খ. নিজ চাহিদা না থাকা সত্ত্বেও যদি কোনও পদ এসে যায়, তবে তা গ্রহণ করতে দোষ নেই।
গ. কোনও বিষয়ে কসম করলে যদি তার বিপরীত বিষয়টি উত্তম হয়, তবে কসমের কারণে সে বিপরীত বিষয়টি করা হতে বিরত থাকা উচিত নয়।
ঘ. যে-কোনও অবস্থায় কসম ভেঙ্গে ফেললে সেজন্য কাফফারা আদায় করা জরুরি।
হতে পারে তাঁর অন্তরে নেতৃত্বের অভিলাষ ছিল। তিনি তা চাওয়ার জন্যই এসেছিলেন। এ কথা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ওহীর মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয়। তাই তিনি তাঁকে এই বলে সতর্ক করেন যে- لَا تَسْأَلِ الْإِمَارَةَ (তুমি নেতৃত্ব চেয়ো না)। বোঝা গেল নেতৃত্ব চাওয়া জায়েয নয়। কাজেই যে ব্যক্তি নেতৃত্ব চায়, তাকে নেতা বানানো উচিত নয়। সুতরাং এক ব্যক্তি নেতৃত্ব চাইলে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেছিলেন-
إِنَّا وَاللَّهِ لَا نُوَلِّي عَلَى هَذَا الْعَمَلِ أَحَدًا سَأَلَهُ، وَلَا أَحَدًا حَرَصَ عَلَيْهِ
আল্লাহর কসম! আমরা এ কাজের দায়িত্ব এমন কারও উপর অর্পণ করি না, যে তা চায় এবং এমন কারও উপরও নয়, যে তার লোভ করে। (সহীহ বুখারী: ৭১৪৯; সহীহ মুসলিম: ১৭৩৩)
এখানে সাধারণভাবে বলা হয়েছে, নেতৃত্ব চেয়ো না। বোঝা গেল, বড় নেতৃত্ব-ছোট নেতৃত্ব কোনওটাই চাওয়া জায়েয নয়। রাষ্ট্রক্ষমতাও চাওয়া জায়েয নয় এবং জনপ্রতিনিধিত্বমূলক অন্য কোনও পদও আর না রাষ্ট্রীয় অন্য কোনও দায়িত্ব। তবে হাঁ, যদি সরকারি কোনও পদ কোনও অযোগ্য ব্যক্তির উপর ন্যস্ত হওয়ার কারণে মানুষের ক্ষতি হবে বলে প্রবল আশঙ্কা থাকে, তবে এরূপ ঠেকা অবস্থায় সৎ, যোগ্য ও মুত্তাকী ব্যক্তির পক্ষে পদ প্রার্থনা করা জায়েয আছে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় হযরত ইয়ূসুফ আলাইহিস সালামের ঘটনায়। ইয়ূসুফ আলাইহিস সালাম মিশরের রাজাকে বলেছিলেন-
قَالَ اجْعَلْنِي عَلَى خَزَائِنِ الْأَرْضِ إِنِّي حَفِيظٌ عَلِيمٌ (55)
ইউসুফ বলল, আপনি আমাকে দেশের অর্থ-সম্পদের (ব্যবস্থাপনা) কার্যে নিযুক্ত করুন। নিশ্চিত থাকুন আমি রক্ষণাবেক্ষণ বেশ ভালো পারি এবং আমি (এ কাজের) পূর্ণ জ্ঞান রাখি। (সূরা ইয়ূসুফ (১২), আয়াত ৫৫)
তিনি আশঙ্কাবোধ করেছিলেন দুর্ভিক্ষকালে মানুষ অন্যায়-অবিচারের সম্মুখীন হতে পারে। এ অবস্থায় দেশের অর্থ-সম্পদের বিলি-বণ্টনব্যবস্থা কোনও সৎ ও যোগ্য ব্যক্তির হাতে থাকা দরকার। আর সেজন্য তাঁর বিশ্বাসমতে তিনি নিজেই ছিলেন সর্বাপেক্ষা বেশি উপযুক্ত। তাছাড়া মিশর দেশটি ছিল অমুসলিম অধ্যুষিত। সেখানে আল্লাহ তা'আলার আইন প্রতিষ্ঠা করার জন্য হযরত ইয়ূসুফ আলাইহিস সালামের নিজের দায়িত্ব গ্রহণ ছাড়া কোনও উপায়ও ছিল না। এ কারণেই তিনি দেশের অর্থ বিভাগের দায়িত্ব নিজ মাথায় তুলে নেন।
সুতরাং আজও যদি কেউ রাষ্ট্রীয় কোনও পদের ক্ষেত্রে মনে করে যে, সে পদ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার মতো উপযুক্ত কোনও লোক নেই আর তার নিজের প্রতি এ আত্মবিশ্বাস থাকে যে, তার পক্ষে তা যথাযথভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হবে আর সে পদের প্রতি তার নিজের কোনও লোভ নেই কিংবা ব্যক্তিগত কোনও স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যও তার নেই, উদ্দেশ্য কেবলই মানুষের সেবা করা ও আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি অর্জন করা, তবে তার জন্যও সে পদ চেয়ে নেওয়ার অবকাশ আছে। এরূপ ব্যতিক্রম অবস্থা ছাড়া সাধারণভাবে পদ প্রার্থনা করার কোনও সুযোগ নেই। কেন তা করা উচিত নয়, সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
فَإِنَّكَ إِنْ أُعْطِيتَهَا عَنْ غَيْرِ مَسْأَلَةٍ أُعِنْتَ عَلَيْهَا (কেননা বিনা চাওয়ায় তোমাকে তা দেওয়া হলে তাতে তুমি সাহায্যপ্রাপ্ত হবে)। অর্থাৎ তোমার মনে যদি নেতৃত্বের লোভ না থাকে এবং নিজের পক্ষ থেকে তা পাওয়ার জন্য আগ্রহও প্রকাশ না কর আর এ অবস্থায় আল্লাহ তা'আলা তোমাকে নেতৃত্বের আসনে বসান অথবা জনগণ তোমাকে ক্ষমতাসীন করে কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান নিজের থেকে তোমাকে কোনও দায়িত্বে নিয়োজিত করেন, তবে তোমার জন্য তা গ্রহণ করা নাজায়েয হবে না। বরং তুমি যাতে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পার, সেজন্য আল্লাহ তা'আলা তোমাকে সাহায্য করবেন। আল্লাহ তা'আলা তোমার উপযুক্ত সহযোগী মিলিয়ে দেবেন। জনগণ তোমার পক্ষে থাকবে। পরিবেশ-পরিস্থিতি তুমি অনুকূলে পাবে। ফলে দায়িত্ব পালন করা তোমার জন্য সহজ হয়ে যাবে। বোঝা গেল পদের প্রতি যদি চাহিদা না থাকে আর এ অবস্থায় তা এসে যায়, তবে গ্রহণ করা দোষের নয়; বরং আল্লাহর উপর ভরসা করে তা গ্রহণ করলে তা নিজের দুনিয়া ও আখিরাতের জন্য কল্যাণকর হবে এবং মানুষও উপকৃত হবে।
وَإِنْ أعْطِيتَهَا عَنْ مَسْأَلَةٍ وُكِلْتَ إِلَيْهَا ‘আর যদি চাওয়ার কারণে তোমাকে তা দেওয়া হয়, তবে তোমাকে তাতে (বিনা সাহায্যে) ছেড়ে দেওয়া হবে'। অর্থাৎ ক্ষমতা ও পদের প্রতি লোভী হয়ে যদি তুমি তার প্রার্থী হও আর এ অবস্থায় তোমাকে তাতে বসানো হয়, তবে তুমি আল্লাহর সাহায্য পাবে না। সে দায়িত্ব আঞ্জাম দেওয়ার ক্ষেত্রে আল্লাহ তা'আলা তোমাকে একাকী ছেড়ে দেবেন। তিনি জনমনে তোমার প্রতি ভালোবাসা ও সহানুভূতি সৃষ্টি করবেন না। তুমি তোমার পাশে উপযুক্ত সহযোগী পাবে না। পরিবেশ- পরিস্থিতি তোমার অনুকূলে থাকবে না। ফলে সহজ সহজ কাজও তোমার পক্ষে কঠিন হয়ে যাবে। তুমি দায়িত্বপালনে ব্যর্থতার পরিচয় দেবে। এভাবে তুমি দুনিয়ায়ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে আর আখিরাতও হারাবে। এটা লোভের খেসারত। কাজেই কোনও বুদ্ধিমান ব্যক্তির কিছুতেই ক্ষমতার প্রতি লোভ করা উচিত নয়। তা চাওয়া উচিত নয় কিছুতেই। হাঁ, সে যদি আগ্রহী না হয় আর এ অবস্থায় তাকে ক্ষমতায় বা বিশেষ কোনও পদে বসিয়ে দেওয়া হয়, তবে তাতে কোনও দোষ নেই; বরং এটা তার জন্য দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতে কল্যাণকর সাব্যস্ত হবে।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আব্দুর রহমান ইবন সামুরা রাযি.-কে শপথ সম্পর্কেও নির্দেশনা দান করেন। মানুষ অনেক সময় আবেগতাড়িত হয়ে বা উত্তেজনাবশত কোনও কাজ সম্পর্কে শপথ করে বসে যে, সে ওই কাজটি অবশ্যই করবে বা কিছুতেই তা করবে না। কিন্তু পরে যখন আবেগ স্বাভাবিক হয়ে আসে বা উত্তেজনা প্রশমিত হয়, তখন লক্ষ করে দেখে যে, তার এ শপথ করা ঠিক হয়নি। কারণ শপথের বিপরীত কাজটি তার জন্য ভালো ছিল। এখন শপথ করার কারণে সে আটকে গেছে। তার পক্ষে ওই ভালো কাজটি করা সম্ভব হচ্ছে না। তা করতে গেলে শপথ ভাঙতে হয়। কিন্তু শপথ করে তা ভেঙ্গে ফেলাও গুনাহের কাজ। এতে আল্লাহর নামের অমর্যাদা হয়। এ অবস্থায় তার করণীয় কী? কীভাবে এ উভয়সংকট থেকে সে বাঁচতে পারে? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশনা দান করেন-
وَإِذَا حَلَفْتَ عَلَى يَمِين، فَرَأَيْتَ غَيْرَهَا خَيْرًا مِنْهَا ، فَأْتِ الَّذِي هُوَ خَيْرٌ وَكَفِّرْ عَنْ يَمِينِكَ
(তুমি যখন কোনও বিষয়ে শপথ করবে, তারপর তার বিপরীত কাজকে তারচে' উত্তম দেখতে পাবে, তখন যা উত্তম তাই করবে আর তোমার শপথের কাফফারা আদায় করবে)। অর্থাৎ শপথ করাটা যেন তোমার সেই উত্তম কাজ করার পক্ষে বাধা না হয়। বরং তুমি শপথ ভেঙ্গে সেই উত্তম কাজটিই করবে। আর শপথ ভাঙ্গার কারণে কাফফারা আদায় করবে। শপথ ভাঙ্গার কাফফারা হল দশজন মিসকীনকে মধ্যম মানের খাবার সকাল-বিকাল দু'বেলা খাওয়ানো বা একজন মিসকীনকে দশদিন খাওয়ানো অথবা দশজন গরীবকে ছতর ঢাকা পরিমাণ কাপড় দেওয়া। আর যদি এর কোনওটিরই সামর্থ্য না থাকে, তবে পরপর তিনদিন তিনটি রোযা রাখা।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. নেতৃত্ব বা রাষ্ট্রীয় কোনও পদ নিজের পক্ষ থেকে চাইতে নেই।
খ. নিজ চাহিদা না থাকা সত্ত্বেও যদি কোনও পদ এসে যায়, তবে তা গ্রহণ করতে দোষ নেই।
গ. কোনও বিষয়ে কসম করলে যদি তার বিপরীত বিষয়টি উত্তম হয়, তবে কসমের কারণে সে বিপরীত বিষয়টি করা হতে বিরত থাকা উচিত নয়।
ঘ. যে-কোনও অবস্থায় কসম ভেঙ্গে ফেললে সেজন্য কাফফারা আদায় করা জরুরি।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
