রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ৬৭৪
অধ্যায় : ৮১ নেতৃত্ব প্রার্থনায় নিষেধাজ্ঞা, নেতৃত্ব যদি কারও জন্য অবধারিত না হয়ে যায় বা তার জন্য তা গ্রহণের প্রয়োজন দেখা না দেয়, তবে তা গ্রহণ থেকে বিরত থাকা প্রসঙ্গ
হযরত আবু যার রাযি.-কে আমীর ও মুতাওয়াল্লী হতে নিষেধ করা
হাদীছ নং: ৬৭৪

হযরত আবু যার রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, হে আবু যার! আমি তোমাকে দুর্বল দেখতে পাচ্ছি। আমি তোমার জন্য তাই পসন্দ করি, যা আমার নিজের জন্য পসন্দ করি। তুমি কিছুতেই দু'জনের উপরও নেতৃত্ব দিয়ো না এবং এতিমের মালের তত্ত্বাবধায়ক হয়ো না। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম : ১৮২৬; সুনানে নাসাঈ ৩৬৬৭; সুনানে আবু দাউদ: ৮২৬৮; মুসনাদে আহমাদ: ২১৫৬৩; সহীহ ইবনে হিব্বান ৫৫৬৪; হাকিম, আল মুস্তাদরাক: ৭০১৭; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ৫৩৪৬; শু'আবুল ঈমান : ৭০৫২)
81 - باب النهي عن سؤال الإمارة واختيار ترك الولايات إذا لَمْ يتعين عليه أَوْ تَدْعُ حاجة إِلَيْهِ
674 - وعن أَبي ذرٍّ - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم: «يَا أَبَا ذَرٍّ، إنِّي أَرَاكَ ضَعِيفًا، وَإنِّي أُحِبُّ لَكَ مَا أُحِبُّ لِنَفْسِي. لاَ تَأَمَّرَنَّ عَلَى اثْنَيْنِ، وَلاَ تَوَلَّيَنَّ مَالَ يَتِيمٍ». رواه مسلم (1).

হাদীসের ব্যাখ্যা:

শারীরিক শক্তির মতো মানসিক শক্তিতেও মানুষের মধ্যে পার্থক্য থাকে। কারও মানসিক শক্তি বেশি থাকে, কারও কম। অনেক সময় নিজে নিজে তা বোঝা যায় না। অভিজ্ঞ ও বিচক্ষণ ব্যক্তিগণ বুঝতে পারে কে মানসিক শক্তিতে বলীয়ান এবং কে দুর্বল। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বাপেক্ষা বেশি বিচক্ষণ ছিলেন। সেইসঙ্গে উনি ওহী দ্বারাও বহুকিছু জানতে পারতেন। সুতরাং তিনি হযরত আবু যার রাযি. সম্পর্কে জানতে ও বুঝতে পেরেছিলেন যে, মানসিক শক্তিতে তিনি খুব বলীয়ান নন; বরং অনেকের তুলনায় দুর্বল। অথচ নেতৃত্বদানের জন্য মানসিক শক্তির প্রয়োজন খুব বেশি। হযরত আবূ যার রাযি. সেদিক থেকে অন্যদের তুলনায় পিছিয়ে ছিলেন। এর সঙ্গত কারণও ছিল। স্বভাবত তিনি ছিলেন দুনিয়াবিমুখ মানুষ। দুনিয়াকে অত্যন্ত তুচ্ছ গণ্য করতেন। যারা দুনিয়া এবং দুনিয়ার মাল ও দৌলতকে অবহেলার দৃষ্টিতে দেখে, তারা সাধারণত দুনিয়াবী ব্যবস্থাপনায় সুদক্ষ হয় না। অবহেলাটাই সে অদক্ষতার কারণ। দুনিয়াবী ব্যবস্থাপনার সঙ্গে দীনেরও অনেক বিষয় জড়িত থাকে। রাষ্ট্রীয় কোনও পদে অদক্ষ ব্যক্তিকে নিয়োগদান করা হলে তার দ্বারা কেবল দুনিয়াবী ব্যবস্থাপনাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, দীনের অনেক কাজও ব্যাহত হবে। তাই এরূপ ব্যক্তিকে রাষ্ট্রীয় কোনও পদে নিযুক্ত করা উচিত নয় এবং তাদের নিজেদেরও তা গ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ বাঞ্ছনীয় নয়। হযরত আবূ যার রাযি. এই শ্রেণির লোক হওয়ায় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু অমলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে রাষ্ট্রীয় পদ ও নেতৃত্ব গ্রহণ করতে নিষেধ করে দেন। তা নিষেধ করার আগে তাঁর মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে বললেন-
يَا أَبَا ذَرُ ، إِنِّي أَرَاكَ ضَعِيفًا، وَإِنِّي أُحِبُّ لَكَ مَا أُحِبُّ لِنَفْسِي (হে আবূ যার্র! আমি তোমাকে দুর্বল দেখতে পাচ্ছি। আমি তোমার জন্য তাই পসন্দ করি, যা আমার নিজের জন্য পসন্দ করি)। তিনি হযরত আবূ যার্র রাযি.-এর জন্য নেতৃত্বগ্রহণ পসন্দ করেননি। এর দ্বারা বোঝা যায় তিনি নিজের জন্যও তা পসন্দ করতেন না। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁকে নেতৃত্ব গ্রহণ করতে হয়েছে। কারণ তিনি এর শতভাগ উপযুক্ত ছিলেন। আল্লাহ তা'আলা তাঁকে প্রয়োজনীয় সবরকম শক্তি ও ক্ষমতা দান করেছিলেন। সুতরাং তিনি বিভিন্ন যুদ্ধে তো নেতৃত্ব দিয়েছেনই, উম্মতের সামগ্রিক পরিচালনায়ও তিনি অতুলনীয় কৃতিত্বের সঙ্গে এ দায়িত্ব পালন করে গেছেন।

لَا تَأمَّرَنَّ عَلَى اثْنَيْنِ (তুমি কিছুতেই দু'জনের উপরও নেতৃত্ব দিয়ো না)। অর্থাৎ বড় আকারের নেতৃত্বগ্রহণ তো নয়ই, ক্ষুদ্র পরিসরেও তুমি কিছুতেই নেতৃত্ব গ্রহণ করবে না। কেননা অন্যের উপর নেতৃত্ব দেওয়াটা অনেক বড় যিম্মাদারী। এ যিম্মাদারী আমানতস্বরূপ। যিম্মাদারী যথাযথভাবে পালন না করাটা খেয়ানত। খেয়ানত করা কঠিন গুনাহ। নেতা বা আমীরকে অধীনস্থদের ভালো-মন্দের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হয়। তাকে যে বিষয়ে আমীর বানানো হয়েছে, সে বিষয়ে পরিপূর্ণ জ্ঞান ও দক্ষতার অধিকারী হতে হয়। দায়িত্ব পালনের সময় অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়া স্বাভাবিক। সে ক্ষেত্রে ধৈর্য-স্থৈর্যের পরিচয় দিতে হয়। এসব যোগ্যতা কম লোকেরই থাকে। তাই যে-কারওই অন্যের দায়িত্ব নিতে যাওয়া সমীচীন নয়। এটা কেবল তারই সাজে বিচক্ষণ ব্যক্তিবর্গ যাকে এর জন্য উপযুক্ত মনে করে।

وَلَا تَوَلَّينَّ مَالَ يَتِيْمٍ (এবং এতিমের মালের তত্ত্বাবধায়ক হয়ো না)। কেননা এতিমের যথাযথ তত্ত্বাবধান করা খুব সহজ কাজ নয়। অথচ এটা আমানত। যার হাতে এতিমের মাল থাকে, তার কর্তব্য পূর্ণ বিশ্বস্ততার সঙ্গে তার হেফাজত করা। যার আত্মবিশ্বাস আছে সে তা করতে পারবে, কেবল তারই উচিত এ দায়িত্ব গ্রহণ করা, অন্য কারও নয় । সুতরাং তোমার মতো দুর্বলদের এর থেকে দূরে থাকাই বাঞ্ছনীয়।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. নেতৃত্বের দায়-দায়িত্ব পালন করার ক্ষমতা সকলের থাকে না। যার সে ক্ষমতা নেই, তার কিছুতেই তা গ্রহণ করা উচিত নয়।

খ. এতিমের মাল আমানতস্বরূপ। দুর্বল ব্যক্তি সে আমানতের ভার নিজ কাঁধে নেওয়া থেকে বিরত থাকবে।

গ. কাউকে কোনও দায়িত্ব গ্রহণ করা না করার পরামর্শ দেওয়ার বেলায় তার যোগ্যতা দক্ষতার বিষয়টি বিবেচনায় রাখা উচিত।

ঘ. কাউকে তার কোনও দুর্বল দিকের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করার সময় তার প্রতি সহমর্মিতার পরিচয় দেওয়া চাই, যাতে সে দৃষ্টি আকর্ষণ তার মনোকষ্টের কারণ না হয়।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন