রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ৬৪১
অধ্যায়: ৭৪ সহনশীলতা, ধীরস্থিরতা ও কোমলতা
জাহান্নাম থেকে নাজাতপ্রাপ্তদের স্বভাব-চরিত্র
হাদীছ নং: ৬৪১

হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'ঊদ রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আমি কি তোমাদের জানাব না কোন ব্যক্তিকে জাহান্নামের জন্য হারাম করা হয় অথবা কার জন্য জাহান্নামকে হারাম করা হয়? জাহান্নামকে হারাম করা হয় প্রত্যেক ওই ব্যক্তির জন্য, যে (মানুষের) নিকটবর্তী, শান্ত, কোমল ও সহজস্বভাবের। -তিরমিযী
(জামে' তিরমিযী: ২৪৯০; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৪৭০; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা : ১৮৫৩ তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ১০৫৬২; শু'আবুল ঈমান: ৭৭৭৪; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩৫০৫)
ইমাম তিরমিযী রহ. বলেন, এটি হাসান হাদীছ।
74 - باب الحلم والأناة والرفق
641 - وعن ابن مسعود - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم: «ألاَ أخْبِرُكُمْ بِمَنْ يَحْرُمُ عَلَى النَّار؟ أَوْ بِمَنْ تَحْرُمُ عَلَيْهِ النَّار؟ تَحْرُمُ عَلَى كُلِّ قَرِيبٍ، هَيّنٍ، لَيِّنٍ، سَهْلٍ». رواه الترمذي، (1) وقال: «حديث حسن».

হাদীসের ব্যাখ্যা:

আখিরাতে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে জান্নাত লাভ করা মানবজীবনের পরম লক্ষ্য। কে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে, কী উপায়ে মুক্তি পাওয়া যাবে, এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটা প্রত্যেকের জানা দরকার। তাই এর প্রতি উৎসাহ দিতে গিয়ে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
أَلا أَخْبِرُكُمْ بِمَنْ يَحْرُمُ عَلَى النَّارِ؟ (আমি কি তোমাদের জানাব না কোন ব্যক্তিকে জাহান্নামের জন্য হারাম করা হয়)? প্রথমে 'আমি কি তোমাদের জানাব না' বলে শ্রোতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। তাদেরকে সতর্ক ও সচেতন করা হয়েছে, যাতে অন্যসব চিন্তা-ভাবনা ছেড়ে দিয়ে, অন্য সবকিছু থেকে মনোযোগ তুলে নিয়ে তাঁর বক্তব্যের দিকে মনোযোগ দেন এবং তিনি কী বলেন তা মন দিয়ে শোনেন।

কাউকে জাহান্নামের জন্য হারাম করার অর্থ বাহ্যত এই যে, জাহান্নামের আগুন থেকে দহনশক্তি কেড়ে নেওয়া হবে, ফলে জাহান্নাম তাকে জ্বালাতে পারবে না। যেমন হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে আগুন জ্বালাতে পারেনি। তবে এর দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য জাহান্নাম তাকে স্পর্শই করতে পারবে না। কেননা জাহান্নাম থেকে তাকে দূরে রাখা হবে।

أَوْ بِمَنْ تَحْرُمُ عَلَيْهِ النَّارِ؟ (অথবা কার জন্য জাহান্নামকে হারাম করা হয়)? উভয় বাক্য দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য মূলত এ কথাই যে, সে ব্যক্তিকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হবে। ফলে জাহান্নাম তাকে কষ্ট দিতে পারবে না। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দু'টি বাক্যের যে-কোনও একটি বলেছিলেন। কিন্তু বর্ণনাকারীর সন্দেহ হয়েছে যে, তিনি ঠিক কোনটি বলেছিলেন। সে কারণেই তিনি সুনির্দিষ্টভাবে একটি বাক্য উল্লেখ না করে দু'টিই উল্লেখ করে দিয়েছেন।

تَحْرُمُ عَلَى كُلِّ قَرِيبٍ، هَيْنِ، لَيْنِ، سَهْل জাহান্নামকে হারাম করা হয় প্রত্যেক ওই ব্যক্তির জন্য, যে (মানুষের) নিকটবর্তী, শান্ত, কোমল ও সহজস্বভাবের'। জাহান্নামকে যার জন্য হারাম করা হয় অর্থাৎ যে ব্যক্তি জাহান্নাম থেকে রক্ষা পাবে, এখানে তার বৈশিষ্ট্যাবলি বোঝানোর জন্য চারটি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। তার মধ্যে প্রথম হল قرِيب (নিকটবর্তী)। অর্থাৎ মানুষের সঙ্গে তার আচার-ব্যবহার আন্তরিকতাপূর্ণ ও সৌজন্যমূলক। ফলে মানুষ সহজেই তার কাছে আসতে পারে। অনেক লোক এমন হয়ে থাকে, যারা কাছে থেকেও যেন দূরবর্তী। কেননা কঠোর স্বভাবের কারণে মানুষ সহজে তার কাছে ভিড়তে পারে না। ফলে তারা তাকে এড়িয়ে চলে ও তার থেকে দূরে থাকে। কিন্তু যে ব্যক্তি জান্নাতবাসী হবে, জাহান্নাম যাকে স্পর্শ করতে পারবে না, সে এমন স্বভাবের নয়। সে সদাচারী ও আন্তরিক হওয়ায় লোকে সহজেই তার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতে পারে। এরূপ ব্যক্তি মানুষ থেকে দূরে থেকেও যেন খুব কাছের।

দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শব্দ হল هَين- لَيْن - سَهْل (শান্ত, কোমল ও সহজস্বভাবের) তিনওটি শব্দ কাছাকাছি অর্থের। এর দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য- জান্নাতবাসী ব্যক্তি দুনিয়ায় বিনয়ী ও কোমল স্বভাবের হয়ে থাকে। দুনিয়াবী বিষয়ে মানুষের সঙ্গে তাদের আচরণ হয় সহজ। তারা লেনদেনে হয় নমনীয়। ছাড় দিতে অভ্যস্ত থাকে। মানুষ তাদের সঙ্গে লেনদেন করে আরাম পায়। অপর এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
المُؤْمِنُونَ هَيِّنُوْنَ لَيِّنُوْنَ كَالْجَمَلِ الْأَنفِ، إِنْ قِيدَ انْقَادَ، وَإِنْ أُنِيخَ اسْتَنَاخَ عَلَى صَخْرَةٍ
মুমিনগণ সহজ ও কোমল হয়ে থাকে। পোষমানা উটের মতো। তাকে টেনে নেওয়া হলে চলতে থাকে। যদি বসানো হয়, পাথরের উপরও বসে পড়ে। (বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান ৭৭৭৭; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ : ৩৫০৬)

প্রকাশ থাকে যে, মুমিনদের এ নম্রতা কেবলই তাদের ব্যক্তিগত বা দুনিয়াবী বিষয়ে। দীনের ক্ষেত্রে তারা থাকে অটল ও আপোশহীন। সে ক্ষেত্রে তারা কখনও ছাড় দেয় না।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. আখিরাতে জাহান্নাম থেকে নাজাত পেয়ে জান্নাত লাভ করাই মুমিন ব্যক্তির পরম লক্ষ্যবস্তু হওয়া উচিত।

খ. মানুষের সঙ্গে মেলামেশা ও লেনদেনে কিছুতেই কঠোর হতে নেই। কেননা পার্থিব বিষয়ে নম্রতা ও কোমলতা অবলম্বন পরকালীন নাজাতলাভের পক্ষে সহায়ক।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
রিয়াযুস সালিহীন - হাদীস নং ৬৪১ | মুসলিম বাংলা