রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ৬৪০
অধ্যায়: ৭৪ সহনশীলতা, ধীরস্থিরতা ও কোমলতা
যাবতীয় কাজে সহজ পন্থা অবলম্বন ও ব্যক্তিগত বিষয়ে ক্ষমাশীলতার প্রতি উৎসাহদান
হাদীছ নং: ৬৪০

হযরত আয়েশা রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যখনই দু'টি বিষয়ের কোনও একটি গ্রহণ করার এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে, তিনি অবশ্যই তার মধ্যে বেশি সহজটি গ্রহণ করেছেন, যতক্ষণ না তা কোনও গুনাহের বিষয় হত। তা কোনও গুনাহের বিষয় হলে তিনি তার থেকে সর্বাপেক্ষা বেশি দূরে অবস্থান করতেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনও নিজ ব্যক্তিগত কোনও বিষয়ে প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি। কিন্তু আল্লাহর কোনও বিধানের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করা হলে তিনি অবশ্যই আল্লাহ তা'আলার জন্য প্রতিশোধ নিতেন। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৩৫৬০; সহীহ মুসলিম: ২৩২৭; সুনানে আবূ দাউদ: ৪৭৮৫; মুআত্তা মালিক: ৩৩৫১; মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ৪৩৮২; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা ১৩২৮৩; বাগাবী শারহুস সুন্নাহ : ৩৭০৩; মুসনাদুল হুমায়দী: ২৬০; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক: ১৭৯৪২; মুসনাদুল বাযযার: ৯৮৮০)
74 - باب الحلم والأناة والرفق
640 - وعن عائشة رضي الله عنها، قالت: مَا خُيِّرَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - بَيْنَ أمْرَيْنِ قَطُّ إِلاَّ أَخَذَ أيْسَرَهُمَا، مَا لَمْ يَكُنْ إثمًا، فَإنْ كَانَ إثمًا، كَانَ أبْعَدَ النَّاسِ مِنْهُ. وَمَا انْتَقَمَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - لِنَفْسِهِ في شَيْءٍ قَطُّ، إِلاَّ أن تُنْتَهَكَ حُرْمَةُ الله، فَيَنْتَقِمَ للهِ تَعَالَى. متفقٌ عَلَيْهِ. (1)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

ইসলাম এক সহজ দীন। এর যাবতীয় বিধানের ভিত্তি সহজতার উপর। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
يُرِيدُ اللَّهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ
আল্লাহ তোমাদের পক্ষে যা সহজ সেটাই চান, তোমাদের জন্য জটিলতা চান না। (সূরা বাকারা (২), আয়াত ১৮৫)

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إِنَّ هَذَا الدِّيْنَ يُسْرُ
নিশ্চয়ই এ দীন সহজ। (সহীহ বুখারী : ৩৯; সুনানে নাসাঈ: ৫০৩৪; সহীহ ইবনে হিব্বান : ৩৫১; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ৪৭৪১; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৯৩৫)

দীনের চরিত্রই যেহেতু সহজতা, তাই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিজেরও স্বভাব এরকমই ছিল। এ হাদীছে জানানো হয়েছে-مَا خُيَّرَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ بَيْنَ أَمْرَيْنِ قَطْ إِلَّا أَخَذَ أَيْسَرَهُمَا (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যখনই দু'টি বিষয়ের কোনও একটি গ্রহণ করার এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে, তিনি অবশ্যই তার মধ্যে বেশি সহজটি গ্রহণ করেছেন)। যেমন কাফেরদের পক্ষ থেকে যদি যুদ্ধ ও সন্ধির মধ্যে কোনও একটি বেছে নেওয়ার এখতিয়ার তাঁকে দেওয়া হত, তবে তিনি সন্ধিকেই বেছে নিতেন। বদরের যুদ্ধে যেসকল মুশরিক বন্দী হয়েছিল, তাদের সম্পর্কে সাহাবায়ে কেরামের কেউ কেউ হত্যার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কেউ বলেছিলেন মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দিতে। তিনি এ দ্বিতীয় প্রস্তাবই গ্রহণ করেছিলেন। প্রথমটির তুলনায় এটি সহজ ছিল।

مَا لَمْ يَكُنْ إِثْمًا ، فَإِنْ كَانَ إِثْمًا، كَانَ أَبْعَدَ النَّاسِ مِنْهُ (যতক্ষণ না তা কোনও গুনাহের বিষয় হত। তা কোনও গুনাহের বিষয় হলে তিনি তার থেকে সর্বাপেক্ষা বেশি দূরে অবস্থান করতেন)। অর্থাৎ বেশি সহজটি যদি গুনাহের কাজ হত, তবে তিনি তা গ্রহণ করতেন না; ববং তা থেকে দূরে থাকতেন এবং সে ক্ষেত্রে তুলনামূলক কম সহজটি গ্রহণ করতেন। এখতিয়ারদাতা আল্লাহ তা'আলা হলে তিনি তো এমন কোনও কাজ বেছে নেওয়ার এখতিয়ার দিতেনই না, যাতে গুনাহ হয়।

وَمَا انْتَقَمَ رَسُوْلُ اللَّهِ ﷺ لِنَفْسِهِ فِي شَيْءٍ قَطُّ (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনও নিজ ব্যক্তিগত কোনও বিষয়ে প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি)। অর্থাৎ কেউ যদি শারীরিকভাবে তাঁকে কষ্ট দিত অথবা তাঁর আর্থিক ক্ষতি করত কিংবা তাঁর ইজ্জত-সম্মানে আঘাত করত, তবে সে কারণে তিনি প্রতিশোধ নিতেন না; বরং ক্ষমা করে দিতেন। মক্কার মুশরিকগণ সবরকমেই তাঁর উপর আঘাত হেনেছে। কিন্তু তিনি তাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন। তায়েফে কী নির্মম আচরণ তাঁর উপর করা হয়েছে! চাইলে তিনি প্রতিশোধ নিতে পারতেন। ফিরিশতা পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তিনি অনুমতি দিলে তারা তায়েফবাসীকে দুই পাহাড়ের মধ্যে ফেলে পিষে ফেলত। কিন্তু তিনি অনুমতি দেননি; বরং তাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন। আল্লাহ তা'আলা পরম ক্ষমাশীল। তাঁর সে ক্ষমাশীলতার গুণে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও ভূষিত ছিলেন। তাই ব্যক্তিগত বিষয়ে জীবনভর তিনি ক্ষমাই করে গেছেন।

إِلَّا أَنْ تُنْتَهَكَ حُرْمَةُ اللَّهِ، فَيَنْتَقِمَ لِلَّهِ تَعَالَى (কিন্তু আল্লাহর কোনও বিধানের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করা হলে তিনি অবশ্যই আল্লাহ তা'আলার জন্য প্রতিশোধ নিতেন)। অর্থাৎ কেউ যদি এমন কোনও অপরাধ করত, যদ্দরুন তার উপর শরী'আতের নির্ধারিত আইন প্রয়োগ অবধারিত হয়ে যায় আর তার সে অপরাধ প্রমাণিতও হয়ে যায়, তবে তিনি অবশ্যই তার উপর শরী'আতের সে আইন প্রয়োগ করতেন। তিনি তা ক্ষমা করতেন না। কাজেই কারও চুরির অপরাধ প্রমাণ হয়ে গেলে তিনি তার হাত কাটার হুকুম জারি করেছেন। কারও ব্যভিচার প্রমাণিত হলে নির্ধারিত দণ্ড প্রয়োগ করেছেন। কারও দ্বারা অন্যের প্রতি ব্যভিচারের অপবাদ আরোপের অপরাধ সাব্যস্ত হলে তাকেও ক্ষমা করেননি। এটাই নিয়ম। ব্যক্তিগত বিষয়ে ক্ষমাশীলতা কাম্য ও প্রশংসনীয়। কিন্তু শরী'আতের আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে ক্ষমার কোনও সুযোগ নেই। বিচারক তা কার্যকর করতে বাধ্য।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. কোনও বিষয়েই অহেতুক কঠোর ও কঠিন পন্থা অবলম্বন করা উচিত নয়; বরং অপেক্ষাকৃত সহজ পন্থা অবলম্বন করাই শ্রেয়।

খ. শরী'আত যেসব সহজ ব্যবস্থা দান করেছে, তা অবলম্বন করতে দ্বিধাবোধ করা বাঞ্ছনীয় নয়; বরং তা খুশিমনে গ্রহণ করে নেওয়ার ভেতরেই কল্যাণ।

গ. অন্যের দ্বারা কেউ ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাতে যথাসম্ভব সহনশীলতা প্রদর্শন করা বাঞ্ছনীয়।

ঘ. কেউ শরী'আতের অমর্যাদা করলে বা শরী'আতবিরোধী কাজ করলে বিচারকের তা ক্ষমা করার অধিকার থাকে না।

ঙ. কারও শরী'আতবিরোধী অবস্থানের ক্ষেত্রে ঈমানদার ব্যক্তির ঈমানী তেজস্বিতার পরিচয় দেওয়া উচিত।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন
রিয়াযুস সালিহীন - হাদীস নং ৬৪০ | মুসলিম বাংলা