রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ৪৬১
অধ্যায়ঃ ৫৫ দুনিয়ার প্রতি নিরাসক্তির ফযীলত, অল্পেতুষ্টির প্রতি উৎসাহদান ও দারিদ্র্যের মাহাত্ম্য।
জান্নাতের সুখ ও জাহান্নামের কষ্টের বিপরীতে দুনিয়ার সুখ ও কষ্টের তুচ্ছতা
হাদীছ নং : ৪৬১

হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, কিয়ামতের দিন জাহান্নামীদের মধ্য থেকে দুনিয়ার সর্বাপেক্ষা সম্পদশালী ব্যক্তিকে হাজির করা হবে। তারপর তাকে ক্ষণিকের জন্য জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। তারপর বলা হবে, হে আদম সন্তান! তুমি কি কখনও কোনও কল্যাণ দেখেছ? তোমার কি কখনও কোনও সুখের সময় কেটেছে? সে বলবে, না, আল্লাহর কসম, হে আমার রব্ব! এমনিভাবে জান্নাতবাসীদের মধ্য থেকে দুনিয়ার সর্বাপেক্ষা কষ্ট-ক্লেশপ্রাপ্ত লোককে উপস্থিত করা হবে। তাকে ক্ষণিকের জন্য জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে। তারপর বলা হবে, হে আদম সন্তান! তুমি কি কখনও কষ্ট-ক্লেশ দেখেছ? তোমার উপর দিয়ে কি কখনও কোনও কঠিন সময় অতিবাহিত হয়েছে? সে বলবে, না, আল্লাহর কসম! আমার উপর দিয়ে কখনও কষ্ট-ক্লেশ যায়নি এবং আমি কখনও কোনও সংকট দেখিনি – মুসলিম ।
55 - باب فضل الزهد في الدنيا والحث على التقلل منها وفضل الفقر
461 - وعنه، قَالَ: قَالَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم: «يُؤْتَى بِأَنْعَمِ أَهْلِ الدُّنْيَا مِنْ أَهْلِ النَّارِ يَوْمَ القِيَامَةِ، فَيُصْبَغُ في النَّارِ صَبْغَةً (1)، ثُمَّ يُقَالُ: يَا ابْنَ آدَمَ، هَلْ رَأيْتَ خَيْرًا قَطُّ؟ هَلْ مَرَّ [ص:163] بِكَ نَعِيمٌ قَطُّ؟ فَيَقُولُ: لاَ وَاللهِ يَا رَبِّ، وَيُؤْتَى بِأشَدِّ النَّاسِ بُؤسًا في الدُّنْيَا مِنْ أهْلِ الجَنَّةِ، فَيُصْبَغُ صَبْغَةً في الجَنَّةِ، فَيُقَالُ لَهُ: يَا ابْنَ آدَمَ، هَلْ رَأيْتَ بُؤسًا قَطُّ؟ هَلْ مَرَّ بِكَ شِدَّةٌ قَطُّ؟ فيَقُولُ: لاَ وَاللهِ، مَا مَرَّ بِي بُؤْسٌ قَطُّ، وَلاَ رَأيْتُ شِدَّةً قَطُّ». رواه مسلم. (2)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছ দ্বারা জান্নাতের নি'আমতের তুলনায় দুনিয়ার নি'আমত এবং জাহান্নামের কষ্টের তুলনায় দুনিয়ার কষ্ট কত তুচ্ছ তা স্পষ্ট করা হয়েছে। প্রথমে দেখানো হয়েছে দুনিয়ার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও আরাম-আয়েশের তুচ্ছতা। জানানো হয়েছে যাদের জন্য জাহান্নামের ফয়সালা হয়ে যাবে তাদের মধ্যে দুনিয়ায় যে ব্যক্তি বেশি সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের ভেতর ছিল তাকে একবার জাহান্নামে ডোবানো হবে। অর্থাৎ জাহান্নামের শাস্তিদানের আগে প্রথম একবার জাহান্নামে ঢুকিয়ে তার শাস্তি কেমন তা উপভোগ করানো হবে। তারপর তাকে জাহান্নাম থেকে তুলে এনে জিজ্ঞেস করা হবে, দুনিয়ায় ভালো কিছু কখনও দেখেছ? তুমি কি কখনও কোনও নিআমত পেয়েছ? সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক! তোমার কসম করে বলছি, আমি কখনও সেরকম কিছু পাইনি ।

প্রশ্ন হচ্ছে, কেন সে এ কথা বলবে? দুনিয়ায় তো সে অনেক নি'আমত ভোগ করেছিল। তবে কি সে মিথ্যা বলবে?
না, আখিরাতে মিথ্যা বলার কোনও সুযোগ নেই। আসলে জাহান্নামের ওই ক্ষণিকের শাস্তিই এমন দুর্বিষহ ও এমন কঠিন হবে যে, তার কারণে দুনিয়ায় সে যে আরাম-আয়েশের জীবন কাটিয়েছিল তা সব ভুলে যাবে। তাই সে বলবে দুনিয়ায় সে কখনও সুখের দেখা পায়নি। অথবা ওই কঠিন শাস্তির সামনে দুনিয়ার আরাম-আয়েশ তার কাছে কোনও আরাম-আয়েশ বলেই গণ্য হবে না। সে কারণেই সে এমন কথা বলবে।

এমনিভাবে যাদের জন্য জান্নাতের ফয়সালা হয়ে যাবে তাদের মধ্যে দুনিয়ায় যে সর্বাপেক্ষা কষ্ট-ক্লেশের জীবন কাটিয়েছিল তাকে স্থায়ী জান্নাতবাসের আগে এখন একবার জান্নাতে ঘুরিয়ে আনা হবে। তারপর তাকে জিজ্ঞেস করা হবে, তুমি কি দুনিয়ায় কখনও কোনও কষ্ট দেখেছ? দুনিয়ায় কোনও কঠিন সময় কি তোমার কখনও গিয়েছিলা? সেও আল্লাহর নামে কসম করে বলবে যে, না, দুনিয়ার তার কখনও কোনও কষ্ট-ক্লেশ ভোগ করতে হয়নি।

এখানেও ওই একই প্রশ্ন আসে। দুনিয়ায় অশেষ কষ্টভোগ সত্ত্বেও তখন সে কেন তা অস্বীকার করবে?
মূল ব্যাপার এই যে, জান্নাতে ঢুকে সে যখন অবর্ণনীয় ও অকল্পনীয় সুখ-শান্তির স্পর্শ পাবে, তখন দুনিয়ার সব কষ্ট-কেশের কথা সে ভুলে যাবে। অথবা ক্ষণস্থায়ী জীবনের সসীম দুঃখ-কষ্ট তার কাছে ওই অসীম সুখ-শান্তির বিপরীতে নিতান্ত নগণ্য মনে হবে। তার কাছে সেসব কোনও দুঃখ-কষ্ট বলেই মনে হবে না। তাই সে তা অস্বীকার করবে।

লক্ষণীয়, জান্নাত ও জাহান্নামে প্রবেশ করানোকে يصبغ শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে। এর অর্থ কাপড়ে রং করা। কোনও কাপড়ে রং করার জন্য কাপড়টিকে রঙের পাত্রে ডোবানো হয়। জান্নাত ও জাহান্নামে প্রবেশ করানোকে এ শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করার তাৎপর্য হল জান্নাত হচ্ছে অবিমিশ্র সুখের ঠিকানা, আর জাহান্নাম অবিমিশ্র দুঃখ-কষ্টের স্থান। জান্নাতে কোনও কষ্ট নেই এবং জাহান্নামে লেশমাত্র সুখ নেই। যে ব্যক্তি জান্নাতে যাবে। সে যেন সুখের মধ্যে পুরোপুরি ডুবে যাবে। আর যে জাহান্নামে যাবে সে শাস্তিতে পুরোপুরি নিমজ্জিত হয়ে যাবে। দুনিয়ার সুখ ও দুঃখ এমন নয়। সুখী ব্যক্তির কিছু না কিছু দুঃখ থাকেই। দুঃখী ব্যক্তিকেও কিছু না কিছু সুখ স্পর্শ করে।

সুতরাং - يصبغ শব্দের মধ্যে জান্নাতের অবিমিশ্র সুখ ও জাহান্নামের অবিমিশ্র দুঃখের ইঙ্গিত রয়েছে। তাছাড়া কাপড় রাঙ্গালে সম্পূর্ণ কাপড়টির উপরই রঙের প্রকাশ ঘটে। তেমনি জান্নাতে প্রবেশ করলে জান্নাতবাসীর সম্পূর্ণ সত্ত্বায় সুখের প্রকাশ পরিলক্ষিত হবে। আর যে ব্যক্তি জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে, তারও গোটা সত্তায় দুঃখ-কষ্টের ছাপ লক্ষ করা যাবে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. দুনিয়ার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে আখিরাত ভুলে যাওয়া উচিত নয়। শেষগতি জাহান্নাম হলে দু'দিনের এ সুখ কিই বা কাজের? ওখানকার কষ্ট তো কখনও শেষ হওয়ার নয়।

খ. দুনিয়ার কষ্ট-ক্লেশেও আখিরাত ভুলতে নেই। ওই জগতে জান্নাত লাভ হলে ক্ষণিকের এ কষ্ট মনে থাকবে না। ওখানকার সুখ হবে অনন্তকালের।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)