রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ৩৯২
মানুষের উপর তাদের বাহ্যিক অবস্থা অনুযায়ী শরীআতের বিধান জারী করা এবং তাদের অভ্যন্তরীণ অবস্থা আল্লাহর উপর ছেড়ে দেওয়া।
কালেমা পাঠকারীকে হত্যা করার নিষেধাজ্ঞা
হাদীছ নং : ৩৯২

হযরত আবূ মা'বাদ মিকদাদ ইবন আসওয়াদ রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললাম, আপনি কী বলেন, যদি আমি কোনও কাফেরের মুখোমুখি হই, তারপর আমরা পরস্পর যুদ্ধে রত হই, একপর্যায়ে সে তরবারি দ্বারা আমার এক হাতে আঘাত করে এবং তা কেটে ফেলে, তারপর সে আমার থেকে বাঁচার জন্য কোনও গাছের আশ্রয় নেয় আর বলে উঠে, আমি আল্লাহর আনুগত্য স্বীকার করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সে এ কথা বলার পর আমি কি তাকে হত্যা করব? তিনি বললেন, তাকে হত্যা করো না। আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সে তো আমার দু'হাতের একটি কেটে ফেলেছে। সে তা কাটার পরই এ কথা বলেছে। তিনি বললেন, তাকে হত্যা করো না। কেননা তুমি যদি তাকে হত্যা কর, তবে সে তো (ইসলাম ঘোষণা দ্বারা) তোমার ওই স্তরে চলে এসেছিল, যে স্তরে তুমি তাকে হত্যা করার আগে ছিলে। আর তুমি চলে যাবে তার স্তরে, যেখানে সে এ কথা বলার আগে ছিল -বুখারী ও মুসলিম।৩২৯
ইমাম নববী রহ. বলেন, إِنَّهُ بِمَنْزِلَتِكَ এর অর্থ তার রক্ত নিরাপদ। এখন তার সম্পর্কে ফয়সালা হবে তার ইসলাম গ্রহণের দৃষ্টিকোণ থেকে।
إِنَّك بِمَنْزِلَتِه এর অর্থ, তোমার রক্ত হালাল। তার ওয়ারিশগণ তোমার থেকে কিসাস গ্রহণ করতে পারবে। এমন নয় যে, সে আগে যে কুফরীর স্তরে ছিল, তুমিও সেই স্তরে চলে যাবে।
সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৪০১৯; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৯৫; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ২৬৪৪; নাসাঈ, আসসুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৮৫৩৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২৩৮১১; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহ, হাদীছ নং ২৮৯৪৩; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ১৬৪; বায়হাকী, আস্সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৫৮৪৬
49 - باب إجراء أحكام الناس عَلَى الظاهر وسرائرهم إِلَى الله تَعَالَى
392 - وعن أَبي معبد المقداد بن الأسْود - رضي الله عنه - قَالَ: قُلْتُ لرسول الله - صلى الله عليه وسلم: أرَأيْتَ إنْ لَقِيتُ رَجُلًا مِنَ الكُفَّارِ، فَاقْتتَلْنَا، فَضَرَبَ إحْدَى يَدَيَّ بِالسَّيْفِ، فَقَطَعَها، ثُمَّ لاَذَ مِنِّي بِشَجَرَةٍ، فَقَالَ: أَسْلَمْتُ لِلهِ، أَأَقْتُلُهُ يَا رَسُول الله بَعْدَ أَنْ قَالَهَا؟ فَقَالَ: «لاَ تَقْتُلهُ» فَقُلْتُ: يَا رَسُول الله، قَطَعَ إحْدَى يَدَيَّ، ثُمَّ قَالَ ذلِكَ بَعْدَ مَا قَطَعَهَا؟! فَقَالَ: «لَا تَقتُلْهُ، فَإِنْ قَتَلْتَهُ فَإنَّهُ بِمَنْزِلَتِكَ قَبْلَ أَنْ تَقْتُلَهُ، وَإنَّكَ بِمَنْزِلَتِهِ قَبْلَ أَنْ يَقُولَ كَلِمَتَهُ التي قَالَ». مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (1)
ومعنى «أنه بمنزلتك» أي: معصوم الدم محكوم بإسلامه. ومعنى «أنك بمنزلته» أي: مباح الدمِ بالقصاص لورثتهِ لا أنه بمنزلته في الكفر، والله أعلم.

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক হাদীছ। কালেমা পাঠ করার দ্বারা আল্লাহ তাআলার কাছে মানুষ কত মর্যাদাবান হয়ে যায়, হাদীছটি দ্বারা তা অনুভব করা যায়। এমনিভাবে কোনও কালেমা পাঠকারী ব্যক্তিকে হত্যা করা কত গুরুতর অপরাধ, তাও স্পষ্ট বোঝা যায়, যদিও সে কালেমা পাঠ করে কুফরের পথে যুদ্ধরত অবস্থায় এবং বাহ্যত মুসলিম যোদ্ধার হাতে প্রাণ হারানোর আশঙ্কায়। এ হাদীছের বর্ণনা অনুযায়ী হযরত মিকদাদ রাযি. এমন কোনও ব্যক্তিকে হত্যা করা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, যে নিজ তরবারির আঘাতে কোনও মুসলিম যোদ্ধার হাত ছিন্ন করে ফেলল, তারপর পাল্টা আঘাতের ভয়ে সে কোনও গাছের আড়ালে আশ্রয় নিয়ে বলে উঠল, আমি আল্লাহর জন্য ইসলাম গ্রহণ করেছি। এ অবস্থায় সেই মুসলিম যোদ্ধা ওই ব্যক্তিকে হত্যা করতে পারবে কি না।

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিষ্কার নিষেধ করে দিলেন যে, তাকে হত্যা করবে না। ওই ব্যক্তি যে তার একটি হাত কেটে ফেলেছে, এই অজুহাত দেখানোর পরও তিনি তাকে হত্যার বৈধতা দিলেন না। বরং সতর্কবাণী শোনালেন-

فإن قتلته فإنه بمنزلتك قبل أن تقتله، وإنك بمنزلته قبل أن يقول كلمته التي قال

কেননা তুমি যদি তাকে হত্যা কর, তবে সে তো (ইসলাম ঘোষণা দ্বারা) তোমার ওই স্তরে চলে এসেছিল, যে স্তরে তুমি তাকে হত্যা করার আগে ছিলে। আর তুমি চলে যাবে তার স্তরে, যেখানে সে এ কথা বলার আগে ছিল'। ইমাম নববী রহ. বলেন, فإنه بمنزلتك (তোমার ওই স্তরে চলে এসেছিল)- এর অর্থ ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেওয়ার পর সে প্রাণের নিরাপত্তা লাভ করেছিল, সে মুসলিমরূপেই বিবেচ্য ছিল। إنك بمنزلته (তুমি চলে যাবে তার স্তরে)- এর অর্থ তার ওয়ারিশদের জন্য কিসাসস্বরূপ তোমাকে হত্যা করা বৈধ হয়ে যাবে। এর অর্থ এমন নয় যে, তুমি তার পূর্ববর্তী কুফরের পর্যায়ে চলে যাবে।

কেউ বলেন, এর অর্থ সে ওইসকল লোকের অন্তর্ভুক্ত ছিল, যারা কাফেরদের মধ্যে নিজেদের ঈমান গোপন রেখেছিল এবং তাকে তাদের সঙ্গে যুদ্ধে আসতে তারা বাধ্য করেছিল, যেমন তুমি মক্কায় থাকাকালে তোমার ঈমান কাফেরদের কাছে গোপন রাখতে।

ইমাম কুরতুবী রহ. বলেন, বুখারী শরীফে এ হাদীছটিতে অতিরিক্ত যে অংশ আছে,তা দ্বারা এ ব্যাখ্যার সমর্থন পাওয়া যায়। তাতে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত মিকদাদ রাযি.-কে বলেছিলেন-

إذا كان رجل مؤمن يخفي إيمانه مع قوم كفار، فأظهر إيمانه فقتلته؟ فكذلك كنت أنت تخفي إيمانك بمكة من قبل

“কোনও মুমিন যদি কাফেরদের সঙ্গে থাকা অবস্থায় নিজ ঈমানের কথা গোপন রাখে, তারপর সে তা প্রকাশ করে, তবে কি তুমি তাকে হত্যা করবে? তুমিও তো মক্কায় থাকা অবস্থায় এরকমই ছিলে।'

মোটকথা কারও সম্পর্কে বাহ্যদৃষ্টিতে যদি এরকমও বোঝা যায় যে, সে ঈমানের কথা প্রকাশ করছে প্রাণের ভয়ে, তবুও তাকে হত্যা করা যাবে না। হত্যা করলে তা মহাপাপ বলে গণ্য হবে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. ইসলামগ্রহণ দ্বারা মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। সুতরাং শরীআতসম্মত কারণ ছাড়া তাকে হত্যা করা যাবে না।

খ. কাফের অবস্থায় কেউ যদি কোনও মুসলিমের উপর আক্রমণ করে তাকে জখম করে ফেলে আর এ অবস্থায় সে নিজেকে মুমিন বলে ঘোষণা করে, তবে প্রাণভয়ে ঈমান আনার অজুহাতে তাকে হত্যা করা জায়েয হয় না।

গ. বিনা কারণে মুমিন ব্যক্তিকে হত্যা করা মহাপাপ। এরূপ ক্ষেত্রে শরীআতের বিধান হলো কিসাস অর্থাৎ নিহত ব্যক্তির ওয়ারিশগণ প্রতিশোধস্বরূপ হত্যাকারীর মৃত্যুদণ্ড দাবি করতে পারে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)
রিয়াযুস সালিহীন - হাদীস নং ৩৯২ | মুসলিম বাংলা