রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ৩৮৬
অধ্যায়ঃ ৪৭

বান্দাকে আল্লাহ তা'আলার ভালোবাসার আলামত
ও তা অর্জনে সচেষ্ট থাকার প্রতি উৎসাহদান

কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াত ও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিভিন্ন হাদীছ দ্বারা জানা যায় যে, এমন অনেক আমল আছে, যা আল্লাহ তাআলার ভালোবাসার প্রমাণ বহন করে। অর্থাৎ যে ব্যক্তি সেসব আমল করে, আল্লাহ তাআলা তাকে ভালোবাসেন। এটা তো সত্য যে, মানুষ মাত্রই আল্লাহ তাআলাকে ভালোবাসে, যদি না কোনও কারণে তার মানসিক ও মানবিক বিকৃতি ঘটে গিয়ে থাকে। কিন্তু আল্লাহ তাআলাকে ভালোবাসলেই যে তাঁরও ভালোবাসা পাওয়া যাবে এটা অনিবার্য নয়। তাঁর ভালোবাসা পাওয়া যাবে কেবল তখনই, যখন তাঁর পসন্দমত কাজও করা হবে। বস্তুত শরীআত যেসব কাজের আদেশ করেছে তা করা এবং যা নিষেধ করেছে তা থেকে বিরত থাকাই আল্লাহ তাআলার পসন্দ। সুতরাং কেবল তাঁরই ভালোবাসায় উজ্জীবিত হয়ে যে ব্যক্তি শরীআত পালন করবে, সে আল্লাহ তাআলার ভালোবাসা পাবেই। তারপরও সুনির্দিষ্টভাবেও কোনও কোনও আমল সম্পর্কে জানানো হয়েছে যে, তাতে লিপ্ত থাকলে আল্লাহ তাআলার ভালোবাসা পাওয়া যায়। এমনিভাবে কোনও কোনও গুণ সম্পর্কেও স্পষ্ট বলে দেওয়া হয়েছে যে, তার অধিকারী হতে পারাটা আল্লাহ তাআলার ভালোবাসা পাওয়ার আলামত। সেগুলো যখন আল্লাহ তাআলার ভালোবাসা পাওয়ার আলামত, তখন প্রত্যেক আল্লাহপ্রেমিকের উচিত মনেপ্রাণে সেসব আমল করতে সচেষ্ট থাকা, সেসকল গুণ অর্জনের সাধনায় রত থাকা।
ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে সেরকম আমল ও গুণের বর্ণনা সম্বলিত কয়েকটি আয়াত ও হাদীছ উদ্ধৃত করেছেন। আমরা তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন।
‘বান্দাকে আল্লাহ তা'আলার ভালোবাসার আলামত
ও তা অর্জনে সচেষ্ট থাকার প্রতি উৎসাহদান’

-সম্পর্কিত দু'টি আয়াত

এক নং আয়াত

قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ

অর্থ : (হে নবী! মানুষকে) বলে দাও, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবেসে থাক, তবে আমার অনুসরণ কর, তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপরাশি ক্ষমা করবেন। আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

ব্যাখ্যা

ইহুদী ও খ্রীষ্টান সম্প্রদায় বলত- نَحْنُ أَبْنَاءُ اللَّهِ وَأَحِبَّاؤُهُ (আমরা আল্লাহর সন্তান ও তাঁর প্রিয়পাত্র)৩০৫। তারই জবাবে এ আয়াত নাযিল হয়।

এক বর্ণনা অনুযায়ী জানা যায়, কুরায়শরা হারাম শরীফের ভেতর প্রতিমা স্থাপন করে সেগুলোর উপর উটপাখির ডিম লটকে দিয়েছিল এবং কানে দুল পরিয়ে দিয়েছিল। তারা এগুলোর সামনে সিজদা করত। একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের বললেন, আল্লাহর কসম, তোমরা তোমাদের পিতা ইবরাহীম ও ইসমাঈলের ধর্মাদর্শের বিরোধিতা করছ। তারা বলল- مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَا إِلَى اللَّهِ زُلْفَى 'আমরা তো এগুলোর উপাসনা করি (আল্লাহর ভালোবাসায়), যাতে এগুলো আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেয়। তারই জবাবে এ আয়াত নাযিল হয়েছে।
এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হুকুম দিয়েছেন যে- قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي (আপনি তাদেরকে বলুন, তোমরা যদি সত্যিই আল্লাহকে ভালোবাস তবে আমার অনুসরণ কর)। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলাকে ভালোবাসার দাবিই হচ্ছে তাঁকে খুশি করার চেষ্টা করা। তাঁকে খুশি করা যায় তাঁর আনুগত্য করার দ্বারা। তাঁর আনুগত্য করার অর্থ হলো তিনি যে কাজ পসন্দ করেন তা করা আর যা অপসন্দ করেন তা ছেড়ে দেওয়া। তিনি কোন কাজ পসন্দ করেন এবং কোন কাজ অপসন্দ করেন তা নিজ জ্ঞান-বুদ্ধি দ্বারা জানা যায় না। তা জানা যায় কেবলই আল্লাহপ্রদত্ত শিক্ষা দ্বারা। আল্লাহ তাআলার সে শিক্ষা আমরা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে পেয়েছি। কাজেই আল্লাহ তাআলাকে ভালোবেসে থাকলে তাঁর নবীর অনুসরণ করতে হবে। তাঁর নবীর অনুসরণ না করে। আল্লাহপ্রেমের দাবি করা বৃথা। কেননা এর দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়া যাবে না। তাঁর সন্তুষ্টি পাওয়া যাবে কেবলই তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ দ্বারা। সুতরাং তিনি এ আয়াতে বলেছেন-

يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ (তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন)। অর্থাৎ তোমাদের আল্লাহপ্রেমের দাবি সত্য হলে তোমরা আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ কর অর্থাৎ তার সুন্নত ও তাঁর তরিকা অনুযায়ী চল। তাঁর অনুসরণ করলে তোমাদের আল্লাহপ্রেম বৃথা যাবে না, আল্লাহ তাআলাও তোমাদের ভালোবাসবেন। এর দ্বারা বোঝা যায়, সুন্নতের অনুসরণ খাঁটি আল্লাহপ্রেমের আলামত। এমনিভাবে সুন্নতের অনুসরণ আল্লাহ তাআলার ভালোবাসা লাভেরও আলামত বটে। যে ব্যক্তি সুন্নতের অনুসরণ করে, তাকে আল্লাহ তাআলা ভালোবাসেন বলে ধরে নেওয়া যায়।
এ আয়াতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করলে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে দু'টি পুরস্কার পাওয়া যায় বলে জানানো হয়েছে। একটি হলো আল্লাহর ভালোবাসা। দ্বিতীয়টি আয়াতের পরের অংশে জানানো হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-

يَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ

(তিনি তোমাদের পাপরাশি ক্ষমা করবেন। আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু)। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা যেহেতু অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও দয়ালু, তখন যে-কেউ তাঁর ভালোবাসায় তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করবে, তিনি দয়াপরবশ হয়ে তাঁর জীবনের পাপরাশিও ক্ষমা করে দেবেন।
প্রকাশ থাকে যে, সুন্নত মোতাবেক জীবনযাপন করলে তার দ্বারা পাপ হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। কবীরা গুনাহ হয় না বললেই চলে। তারপরও কখনও-কখনও হয়ে গেলে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষানুযায়ী সে দ্রুত তাওবা করে নেয়। তাওবার বদৌলতে আল্লাহ তাআলা তার সে গুনাহও ক্ষমা করে দেন। তার বাকি থাকতে পারে কেবল সগীরা গুনাহ। সুন্নত অনুসরণ করার কল্যাণে আল্লাহ তাআলা নিজ মেহেরবানীতে তাও ক্ষমা করে দেন। ফলে তার জীবন হয়ে যায় নিষ্পাপ ও পবিত্র জীবন। সারা জীবন সুন্নত মোতাবেক চললে পবিত্র ও নিষ্পাপরূপেই তার কবরযাত্রা হয়। এরূপ ব্যক্তির জান্নাত লাভের প্রবল আশা তো থাকেই। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন--

«كُلُّ أُمَّتِي يَدْخُلُونَ الجَنَّةَ إِلَّا مَنْ أَبَى»، قَالُوا: يَا رَسُولَ اللَّهِ، وَمَنْ يَأْبَى؟ قَالَ: «مَنْ أَطَاعَنِي دَخَلَ الجَنَّةَ، وَمَنْ عَصَانِي فَقَدْ أَبَى»

‘আমার সকল উম্মত জান্নাতে প্রবেশ করবে, তবে যে অস্বীকার করে সে নয়। সাহাবীগণ বললেন, কে অস্বীকারকারী ইয়া রাসূলাল্লাহ? তিনি বললেন, যে আমার আনুগত্য করে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে, আর যে আমার অবাধ্যতা করে সে তো অস্বীকারই করে।৩০৭
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যথার্থ অনুসরণের তাওফীক দান করুন। আমীন।

দুই নং আয়াত

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا مَنْ يَرْتَدَّ مِنْكُمْ عَنْ دِينِهِ فَسَوْفَ يَأْتِي اللَّهُ بِقَوْمٍ يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَهُ أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى الْكَافِرِينَ يُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلَا يَخَافُونَ لَوْمَةَ لَائِمٍ ذَلِكَ فَضْلُ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ

অর্থ : হে মুমিনগণ! তোমাদের মধ্য হতে কেউ যদি নিজ দীন থেকে ফিরে যায়, তবে আল্লাহ এমন লোক সৃষ্টি করবেন, যাদেরকে তিনি ভালোবাসবেন এবং তারাও তাকে ভালোবাসবে। তারা মুমিনদের প্রতি কোমল এবং কাফেরদের প্রতি কঠোর হবে। তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে এবং কোনও নিন্দুকের নিন্দাকে ভয় করবে না। এটা আল্লাহর অনুগ্রহ, যা তিনি যাকে ইচ্ছা করেন দান করেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।৩০৮

ব্যাখ্যা

এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, তারা যেন কিছুতেই নিজেদের দীন পরিত্যাগ না করে। আল্লাহ না করুন, কেউ তা করলে তাতে আল্লাহ তাআলার কোনও ক্ষতি নেই; সে নিজেই ধ্বংস হবে। আল্লাহ তাআলা তাঁর দীন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এ শ্রেণীর লোকদের পরিবর্তে উন্নত গুণাবলীর অধিকারী লোকদের দাঁড় করিয়ে দেবেন। তারা কী কী সদগুণের অধিকারী হবে তাও এ আয়াতে বলে দেওয়া হয়েছে।
তাদের প্রথম বৈশিষ্ট্য বলা হয়েছে- يُحِبُّهُمْ (তিনি তাদের ভালোবাসবেন)। অর্থাৎ যারা ইসলাম পরিত্যাগ করবে, তাদের পরিবর্তে আল্লাহ তাআলা যাদেরকে দাঁড় করাবেন তাদেরকে তিনি ভালোবাসবেন। উপরের আয়াত দ্বারা আমরা জানতে পেরেছি, আল্লাহ ভালোবাসেন তাদেরকেই, যারা তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করে। বোঝা গেল, তাদের প্রথম গুণ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করা, যার ফলশ্রুতিতে আল্লাহ তাআলা তাদের ভালোবাসবেন।
দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো- يُحِبُّونَهُ (তারাও তাকে ভালোবাসবে)। অর্থাৎ সে দলটির মধ্যে আল্লাহপ্রেম থাকবে। আর আল্লাহপ্রেমের দাবি হলো নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করা, যেমনটা উপরের আয়াতে বলা হয়েছে। এ হিসেবে প্রকৃতপক্ষে উভয়টিই একই গুণ। কেননা আল্লাহ তাআলাকে ভালোবেসে থাকলে কর্তব্য সুন্নতের অনুসরণ করা। আর সুন্নতের অনুসরণ করলে আল্লাহ তাআলার ভালোবাসা পাওয়া যায়। তাহলে দেখা যাচ্ছে সুন্নতের অনুসরণই মূল কথা। এ গুণ যার মধ্যে থাকে, সে সত্যিকারের আল্লাহপ্রেমিকও এবং আল্লাহ তাআলার মাহবূব ও ভালোবাসার পাত্রও।
তাদের তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হলো- أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى الْكَافِرِينَ (তারা মুমিনদের প্রতি কোমল এবং কাফেরদের প্রতি কঠোর হবে)। অর্থাৎ আল্লাহপ্রেমের দাবিতে তারা ভালোবাসবে মুমিনদেরও। ফলে তাদের প্রতি নম্র-কোমল আচরণ করবে, তাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে থাকবে, তাদেরকে নিজ দেহের অংশস্বরূপ মনে করবে, তাদের সুখ-দুঃখের অংশীদার হয়ে থাকবে, কখনও তাদের সঙ্গে ঝগড়া-ফাসাদে লিপ্ত হবে না; বরং তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকবে ও ক্ষমাশীলতার পরিচয় দেবে।
অপরদিকে তারা কাফের ও অমুসলিমদের প্রতি থাকবে কঠোর ও কঠিন। পার্থিব বিষয়ে ছাড় দিলেও দীনের ব্যাপারে তাদের সঙ্গে কখনও আপস করবে না। প্রয়োজনে জান-মাল দিয়ে লড়াই করবে। আত্মীয়-স্বজন, ভাই-বেরাদার এমনকি পিতা-মাতাও যদি দীনের বিরুদ্ধাচরণ করে, তবে তাদের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়াতে দ্বিধাবোধ করবে না। এটাই প্রকৃত মুমিনের পরিচায়ক।
তাদের চতুর্থ বৈশিষ্ট্য হলো- يُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ (তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে)। অর্থাৎ দীনের প্রচার-প্রসারকল্পে তারা জিহাদে রত হবে। তারা জিহাদ করবে তাদের মুখ দিয়ে, তারা জিহাদ করবে কলম দিয়ে, অর্থ দিয়ে এবং সর্বপ্রকার ক্ষমতা ও সামর্থ্য দিয়ে। প্রাণ দিতেও কার্পণ্য করবে না। তারা নিজেদেরকে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর পথে উৎসর্গ করে দেবে, নিজেদেরকে আল্লাহর কাছে বিকিয়ে দেবে। যেমনটা আল্লাহ তাআলা বলেছেন-

إِنَّ اللَّهَ اشْتَرَى مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنْفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ بِأَنَّ لَهُمُ الْجَنَّةَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَيَقْتُلُونَ وَيُقْتَلُونَ

‘বস্তুত আল্লাহ মুমিনদের কাছ থেকে তাদের জীবন ও তাদের সম্পদ খরিদ করে নিয়েছেন, তাদের জন্য জান্নাত আছে-এর বিনিময়ে। তারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে। ফলে হত্যা করে ও নিহতও হয়।৩০৯
তাদের পঞ্চম বৈশিষ্ট্য হলো- وَلَا يَخَافُونَ لَوْمَةَ لَائِمٍ (কোনও নিন্দুকের নিন্দাকে ভয় করবে না)। অর্থাৎ দীনের অনুসরণ ও দীনের প্রচার-প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় কখনও কারও নিন্দা-তিরস্কারকে গ্রাহ্য করবে না। যারা আল্লাহর পথে চলতে চায়, তাদের কারও নিন্দা-তিরস্কারকে গ্রাহ্য করলে চলে না। যারা তা গ্রাহ্য করে, তাদের পক্ষে আল্লাহর পথে চলা সম্ভব হয় না। সব যুগেই যারা এ পথে চলেছে, তারা ওসব অগ্রাহ্য করেই চলেছে। নবী-রাসূলগণকে তিরস্কার করা হয়েছে, কিন্তু তাঁরা তাতে ভ্রুক্ষেপ করেননি। নিন্দা করা হয়েছে সাহাবায়ে কেরামকেও। তারাও তা অগ্রাহ্য করেছেন। নিন্দা করেছে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং আপন-পর সকলে। গোটা সমাজ তাদেরকে ব্যাঙ্গ- বিদ্রুপ করেছে। পাগল বলেছে, নির্বোধ বলেছে, সমাজচ্যুত বলেছে, পশ্চাদপদ ও সেকেলে ঠাওরিয়েছে, প্রতিক্রিয়াশীল ও অশান্তি সৃষ্টিকারী সাব্যস্ত করেছে। কোনওকিছুই বলতে ছাড়েনি। সর্বাবস্থায় তারা মনোবল অটুট রেখেছেন। সকলের সব মন্তব্য উপেক্ষা করে দীনের উপর অবিচল থেকেছেন। প্রকৃত দীনদারকে এমনই করতে হয়। কিন্তু আমাদের সমস্যা হলো আমরা সকল মন্তব্যে কান দিই। ‘পাছে লোকে কিছু বলে'-এর পেছনে পড়ে দীনদারীতে অবিচল থাকতে পারি না। আল্লাহ তাআলার পসন্দের বান্দা হতে হলে মনের এ দুর্বলতা ছাড়তে হবে।
আয়াতের শেষে বলা হয়েছে-

ذَلِكَ فَضْلُ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ

(এটা আল্লাহর অনুগ্রহ, যা তিনি যাকে ইচ্ছা করেন দান করেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ)। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার প্রিয় বান্দা হতে পারা, আল্লাহ তাআলাকে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসা, মুমিনদের সঙ্গে বিনয়ের আচরণ করা, কাফেরদের বিরুদ্ধে কঠোর থাকা এবং কোনও নিন্দুকের নিন্দার তোয়াক্কা না করে যে-কোনও পরিবেশ-পরিস্থিতিতে সত্য দীনের উপর অবিচল থাকা ও অন্যদেরকেও অবিচল থাকতে সহযোগিতা করা মানুষের জন্য অনেক বড় সৌভাগ্য, আল্লাহ তাআলার অনেক বড় অনুগ্রহ। এ সৌভাগ্য ও অনুগ্রহ বুদ্ধিবলে বা বাহুবলে পাওয়া যায় না। এটা আল্লাহ তাআলারই দান। আল্লাহ তাআলা যাকে চান দিয়ে থাকেন। তিনি জানেন কে এর উপযুক্ত। সে অনুযায়ীই তিনি দান করেন। কাজেই কেউ নিজের মধ্যে এসব গুণের উপস্থিতি দেখতে পেলে তার কর্তব্য অহংকার-অহমিকায় লিপ্ত না হয়ে আল্লাহ তাআলার শোকর আদায় করা। যে বস্তু নিজে অর্জন করেনি; বরং আল্লাহ তাআলাই দান করেছেন, তার জন্য মানুষের গৌরব করা সাজে না। আল্লাহ তাআলা তাঁর এসকল মহা দানের মধ্যে আমাদেরও শামিল রাখুন।
উল্লেখ্য, এ আয়াতে পরোক্ষভাবে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরবর্তীকাল সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে যে, তখন একদল লোক দীন থেকে ফিরে যাবে, তারা মুরতাদ হয়ে যাবে। তখন আল্লাহ তাআলা তাদের পরিবর্তে উল্লিখিত গুণ বিশিষ্ট একদল লোক দাঁড় করিয়ে দেবেন, যারা তাদের বিরুদ্ধে জান-মাল দিয়ে জিহাদ করবে।
স্বঘোষিত নবীদের বিরুদ্ধে সাহাবায়ে কেরামের জিহাদ
এ ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণ হয়েছিল। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পর একদল লোক মুরতাদ হয়ে গিয়েছিল। কয়েকজন ভণ্ড নবীর আবির্ভাব ঘটেছিল। বহুলোক সে ভণ্ড নবীদের অনুসরণ করেছিল। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন। নবুওয়াত দাবি করেছিল ইয়ামানের আসওয়াদ আনাসী, ইয়ামামার মুসায়লিমা কাযযাব এবং উত্তর আরবের তুলায়হা ইবন খুওয়ায়লিদ। মূলত এরা নবুওয়াত দাবি করেছিল নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায়ই। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসওয়াদ আনাসীর বিরুদ্ধে ইয়ামানের গভর্নর হযরত মু'আয ইবন জাবাল রাযি.-কে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। তিনি ফায়রূয দায়লামী রাযি.-কে এ কাজের জন্য নিযুক্ত করেন। তাঁর হাতে আসওয়াদের পতন হয়। কিন্তু আসওয়াদের পতন-সংবাদ মদীনা মুনাউওয়ারায় পৌঁছার আগেই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাত হয়ে যায় এবং হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর খেলাফতকাল শুরু হয়ে যায়।
মুসায়লিমা কাযযাব আগে নবুওয়াত দাবি করলেও তার প্রভাব-প্রতিপত্তির বিস্তার ঘটে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পর। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. তার বিরুদ্ধে খালিদ ইবনুল ওয়ালীদ রাযি.-এর নেতৃত্বে সেনাভিযান প্রেরণ করেন। উভয়পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়। তাতে বহু লোক হতাহত হয়। শেষপর্যন্ত হযরত ওয়াহশী রাযি. মুসায়লিমাকে হত্যা করতে সক্ষম হন। ইনি সেই ওয়াহশী, উহুদের যুদ্ধে যার হাতে হযরত হামযা রাযি. শাহাদাত বরণ করেছিলেন। হযরত ওয়াহ্শী রাযি. বলতেন, ইসলাম গ্রহণের আগে আমি সর্বোত্তম মানুষ (হযরত হামযা রাযি.)-কে হত্যা করেছি এবং ইসলাম গ্রহণের পর হত্যা করেছি নিকৃষ্টতম মানুষ মুসায়লিমা কাযযাবকে।
মিথ্যা নবুওয়াতের দাবিদার তুলায়হা ইবন খুওয়ায়লিদের পেছনেও বহু লোক জুটে গিয়েছিল। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. তাদের বিরুদ্ধেও হযরত খালিদ ইবনুল ওয়ালীদ রাযি.-কে প্রেরণ করেন। তুমুল যুদ্ধের পর তুলায়হার বাহিনী পরাজিত হয়। তুলায়হা প্রাণ নিয়ে পলায়ন করে এবং সিরিয়ায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। তারপর সে তাওবা করে পুনরায় ইসলামে ফিরে আসে। তার এ তাওবা খাঁটিমনেই হয়েছিল। পরবর্তী জীবনে তার দ্বারা ইসলামের উল্লেখযোগ্য খেদমত হয়েছিল।
সাজাহ নামের এক মহিলাও নিজেকে নবী বলে দাবি করেছিল। তারও বিপুল সংখ্যক অনুসারী ছিল। পরে মুসায়লিমার সঙ্গে তার বিবাহ হয়। হযরত খালিদ ইবনুল ওয়ালীদ রাযি. তাদের সম্মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করেছিলেন। সে যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর সাজাহ্ তাওবা করে পুনরায় ইসলামে ফিরে আসে।
এসকল ভণ্ড নবী ও তার অনুসারীরা ইসলামের মত মহা নিআমতের কদর করেনি। দুনিয়ার হীন স্বার্থে তারা ইসলাম ছেড়ে দিয়েছিল। আল্লাহ তাআলা তাদের বিরুদ্ধে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর নেতৃত্বে সাহাবায়ে কেরামকে সংগঠিত রাখেন। বিপুল সংখ্যক খাঁটি তাবি'ঈনও তাঁদের সঙ্গে থাকেন। আল্লাহপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে তারা সম্মিলিতভাবে নিজেদের জান-মাল দ্বারা ইসলামের এসকল শত্রুর বিরুদ্ধে জিহাদ করতে থাকেন। এতে তারা কোনওকিছুর তোয়াক্কা করেননি। তারা নিজেদের রক্তের বিনিময়ে ইসলামের মর্যাদা সমুন্নত রেখেছেন। এভাবে তাদের দ্বারা আলোচ্য আয়াতে বর্ণিত ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
প্রকাশ থাকে যে, হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর জমানায় আলোচ্য আয়াতের ভবিষ্যদ্বাণীটি বাস্তবায়িত হয়ে গেলেও আয়াতটির মর্মবাণী ও এর বার্তা কিয়ামত পর্যন্তই কার্যকর থাকবে। সুতরাং যারাই এ আয়াতে বর্ণিত গুণাবলীর অধিকারী হয়ে আল্লাহর দুশমন ও মুরতাদদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রাম জারি রাখবে, তাদের জন্যই এ আয়াত প্রযোজ্য হবে।

৩০৪. সূরা আলে ইমরান (৩), আয়াত ৩১

৩০৫. সূরা মায়িদা (৫), আয়াত ১৮

৩০৬. সূরা যুমার (৩৯), আয়াত ৩

৩০৭. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৭২৮০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৮৭২৮

৩০৮. সূরা মায়িদা (৫), আয়াত ৫৪

৩০৯. সূরা তাওবা (৯), আয়াত ১১১
আল্লাহর ওলীকে কষ্ট দেওয়ার পরিণাম এবং ফরয ও নফল ইবাদতের ফযীলত
হাদীছ নং : ৩৮৬

হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ তা'আলা বলেন, যে-কেউ আমার বন্ধুর সঙ্গে দুশমনি করে, আমি তার সঙ্গে যুদ্ধের ঘোষণা দিই। আমি আমার বান্দার প্রতি যা ফরয করেছি, সে আমার কাছে তার চেয়ে বেশি প্রিয় কোনওকিছু দ্বারা আমার নৈকট্য অর্জন করতে পারে না। বান্দা নফল ইবাদত-বন্দেগী দ্বারা আমার নিকটবর্তী হতে থাকে। একপর্যায়ে আমি তাকে ভালোবেসে ফেলি। আমি যখন তাকে ভালোবেসে ফেলি তখন আমি হয়ে যাই তার কান, যা দিয়ে সে শোনে; তার চোখ, যা দিয়ে সে দেখে; তার হাত, যা দিয়ে সে ধরে এবং তার পা যা দিয়ে সে চলে। সে আমার কাছে কোনওকিছু চাইলে আমি তাকে তা দিই এবং আমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করলে তাকে আশ্রয় দান করি -বুখারী।
সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬৫০২; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীছ নং ৩৯৮৯; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ৩৪৭; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৬৩৯৫; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ১২৪৭
47 - باب علامات حُبِّ الله تَعَالَى للعبد والحث عَلَى التخلق بِهَا والسعي في تحصيلها

قَالَ الله تَعَالَى: {قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ} [آل عمران: 31]، وَقالَ تَعَالَى: {يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا مَنْ يَرْتَدَّ مِنْكُمْ عَنْ دِينِهِ فَسَوْفَ يَأْتِي اللهُ بِقَوْمٍ يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَهُ أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى الْكَافِرِينَ يُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللهِ وَلا يَخَافُونَ لَوْمَةَ لائِمٍ ذَلِكَ فَضْلُ اللهِ يُؤْتِيهِ مَنْ يَشَاءُ وَاللهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ} [المائدة: 54].
386 - وعن أَبي هريرة - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم: «إنَّ الله تَعَالَى قَالَ: مَنْ عَادَى لِي وَلِيًّا، فَقَدْ آذَنْتُهُ بِالْحَرْبِ، وَمَا تَقَرَّبَ إِلَيَّ عَبْدِي بِشَيءٍ أَحَبَّ إِلَيَّ مِمَّا افْتَرَضْتُ عَلَيهِ، وَمَا يَزَالُ عَبْدِي يَتَقَرَّبُ إِلَيَّ بِالنَّوَافِلِ حَتَّى أُحِبَّهُ، فَإِذَا أَحْبَبْتُهُ، كُنْتُ سَمْعَهُ الَّذِي يَسْمَعُ بِهِ، وَبَصَرَهُ الَّذِي يُبْصِرُ بِهِ، ويَدَهُ الَّتي يَبْطِشُ (1) بِهَا، وَرجْلَهُ الَّتِي يَمْشِي بِهَا، وَإنْ سَألَنِي أعْطَيْتُهُ، وَلَئِن اسْتَعَاذَنِي لأعِيذَنَّهُ». رواه البخاري. (2)
معنى «آذنته»: أعلمته بأني محارِب لَهُ. وقوله: «استعاذني» روي بالباءِ وروي بالنون.

হাদীসের ব্যাখ্যা:

ولي শব্দটির উৎপত্তি ولي থেকে। অর্থ নৈকট্য। ولي অর্থ নিকটবর্তী। এর দ্বারা আল্লাহ তাআলার নৈকট্যপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে বোঝানো হয়। অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার আদেশ-নিষেধ পালনের মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য অর্জন করেছে। অথবা এর উৎপত্তি موالاة থেকে, যার অর্থ বন্ধুত্ব ও মৈত্রীস্থাপন। অর্থাৎ যে ব্যক্তি ইবাদত-আনুগত্য ও তাকওয়া-পরহেযগারীর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলাকে বন্ধু বানিয়ে নেয়, ফলে নিজেও আল্লাহর বন্ধু হয়ে যায়, সে-ই আল্লাহর ওলী। কুরআন মাজীদে ওলী-আওলিয়ার পরিচয় দেওয়া হয়েছে এভাবে-

أَلَا إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللَّهِ لَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ (62) الَّذِينَ آمَنُوا وَكَانُوا يَتَّقُونَ (63) لَهُمُ الْبُشْرَى فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْآخِرَةِ

‘স্মরণ রেখ, যারা আল্লাহর বন্ধু তাদের কোনও ভয় থাকবে না এবং তারা দুঃখিতও হবে না। তারা সেইসব লোক, যারা ঈমান এনেছে এবং তাকওয়া অবলম্বন করেছে। তাদের দুনিয়ার জীবনেও সুসংবাদ আছে এবং আখেরাতেও।৩১১

আলোচ্য হাদীছে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন- مَنْ عَادَى لِي وَلِيًّا فَقَدْ آذَنْتُهُ بِالحَرْبِ (যে ব্যক্তি আমার ওলীর সঙ্গে শত্রুতা করে, আমি তার সঙ্গে যুদ্ধের ঘোষণা দিই)। অর্থাৎ তিনিও তাকে নিজ শত্রুরূপে গ্রহণ করেন। আর আল্লাহ তাআলা যাকে শত্রুরূপে গ্রহণ করেন, তাকে ধ্বংস করে ছাড়েন। এটি আল্লাহ তাআলার প্রিয় বান্দাদের সঙ্গে শত্রুতা করা সম্পর্কে এক কঠোর সতর্কবাণী। এর দ্বারা এ কথা বুঝে আসে যে, যে ব্যক্তি আল্লাহর ওলীকে বন্ধু বানিয়ে নেবে, সে আল্লাহ তাআলারও বন্ধু হয়ে যাবে। সুতরাং যারা আল্লাহর বন্ধুত্ব কামনা করে, তাদের কর্তব্য আল্লাহর বন্ধুদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করা, তার শত্রুদের নয়। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন-

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا عَدُوِّي وَعَدُوَّكُمْ أَوْلِيَاءَ تُلْقُونَ إِلَيْهِمْ بِالْمَوَدَّةِ

‘হে মুমিনগণ! আমার শত্রু ও তোমাদের নিজেদের শত্রুকে এমন বন্ধু বানিও না যে, তাদের কাছে ভালোবাসার বার্তা পৌঁছাতে শুরু করবে।৩১২

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى أَوْلِيَاءَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ وَمَنْ يَتَوَلَّهُمْ مِنْكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ

‘হে মুমিনগণ! ইহুদী ও খ্রীষ্টানদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তারা নিজেরাই একে অন্যের বন্ধু! তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি তাদেরকে বন্ধু বানাবে, সে তাদেরই মধ্যে গণ্য হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ জালিমদেরকে হিদায়াত দান করেন না।৩১৩

আরও ইরশাদ হয়েছে

إِنَّمَا وَلِيُّكُمُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَالَّذِينَ آمَنُوا الَّذِينَ يُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَهُمْ رَاكِعُونَ (55) وَمَنْ يَتَوَلَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَالَّذِينَ آمَنُوا فَإِنَّ حِزْبَ اللَّهِ هُمُ الْغَالِبُونَ (56)

‘(হে মুসলিমগণ!) তোমাদের বন্ধু তো কেবল আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও মুমিনগণ, যারা (আল্লাহর সামনে) বিনীত হয়ে সালাত আদায় করে ও যাকাত দেয়। কেউ আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও মুমিনগণকে বন্ধু বানালে (সে আল্লাহর দলভুক্ত হয়ে যাবে) আল্লাহর দলই তো বিজয়ী হবে।৩১৪
হাদীছটির পরের অংশে আল্লাহ তাআলার নৈকট্যলাভের উপায় ও নৈকট্যলাভের কয়েকটি সুফল বয়ান করা হয়েছে। প্রথমে জানানো হয়েছে যে, আল্লাহ তাআলা বান্দার উপর যা ফরয করেছেন, আল্লাহ তাআলার কাছে সে আমলই সর্বাপেক্ষা বেশি প্রিয়। আল্লাহ তাআলার নৈকট্যলাভের জন্য তারচে' উত্তম কোনও মাধ্যম নেই। যেসকল আমল ফরয করা হয়েছে তার অনুরূপ নফল আমলও আছে। যেমন নফল নামায, কুরআন তিলাওয়াত, তাসবীহ পাঠ, নফল রোযা, নফল হজ্জ ও নফল সদাকা অর্থাৎ আল্লাহর পথে দান-খয়রাত।

যে ব্যক্তি যতবেশি নফল ইবাদত করে, সে আল্লাহ তাআলার ততবেশি নৈকট্য লাভ করতে থাকে। একপর্যায়ে আল্লাহ তাআলা তাকে ভালোবেসে ফেলেন। আর আল্লাহ তাআলা যখন কাউকে ভালোবেসে ফেলেন, তখন তিনি তার কান, চোখ, হাত ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে পরিণত হয়ে যান। তার মানে তিনি বান্দার হৃদয়-মন তাঁর ইশ্বক ও মহব্বত দ্বারা ভরে দেন, তাঁর মা'রিফাতের নূর দ্বারা আলোকিত করে দেন। তাকওয়া- পরহেযগারী ও আল্লাহর মাহাত্ম্য-মহিমার অনুধ্যানে তাকে জাগ্রতচেতন করে দেন। তাঁর প্রতি আগ্রহ-উদ্দীপনার উচ্ছ্বাসে তাকে আপ্লুত করে তোলেন। এভাবে সে দেহমনে চিন্তা-ভাবনায় একান্তভাবে আল্লাহ তাআলার হয়ে যায়। তখন আল্লাহ তাআলা তাকে সর্বদা এসকল অঙ্গের শরীআতসম্মত ব্যবহারে সাহায্য করেন। ফলে সে তার কান দিয়ে অবৈধ কিছু শোনে না, চোখ দিয়ে নাজায়েয কিছু দেখে না, হাত দিয়ে হারাম কিছু স্পর্শ করে না এবং পা দিয়ে পাপের পথে চলে না। সে এসকল অঙ্গের কেবল বৈধ ব্যবহারই করে। যেসকল কাজে ছাওয়াব পাওয়া যায় ও আল্লাহ খুশি হন, কেবল তাতেই ব্যবহার করে। যেসব কাজে গুনাহ হয় এবং আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন, তাতে ব্যবহার করে না। যেমন এক বর্ণনায় আছে, সে আমার সাহায্যেই শোনে, আমার সাহায্যেই দেখে, আমার সাহায্যেই ধরে এবং আমার সাহায্যেই চলে।

তারপর দ্বিতীয় সুফল বলা হয়েছে যে- وَإن سَأَلَنِي أَعْطَيْتُهُ (সে আমার কাছে কিছু চাইলে আমি তাকে তা দিই)। অর্থাৎ বৈধ ও কল্যাণকর যা-কিছু চায়। যেমন ইবাদত- বন্দেগীর তাওফীক, হালাল রুযি, দীনের উপর অবিচলতা, নেক কাজে মনের প্রশান্তি ইত্যাদি।

তৃতীয়ত জানানো হয়েছে যে -وَلَئِنِ اسْتَعَاذَنِي لَأُعِيذَنَّهُ (আমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করলে তাকে আশ্রয় দান করি)। অর্থাৎ যে-কোনও অনিষ্ট থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করলে তা থেকে তাকে আশ্রয় দিই। যেমন শয়তানের কুমন্ত্রণা, নফসের ওয়াসওয়াসা, মানুষের শত্রুতা, প্রকাশ্য ও গুপ্ত বিপদ-আপদ ইত্যাদি।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. ওলী-বুযুর্গদের কষ্ট দেওয়া আল্লাহর বড় গযব ও নারাজির কারণ। তাই কিছুতেই তাদের কষ্ট দেওয়া ও তাদের সঙ্গে বেআদবী করা উচিত নয়।

খ. ফরয আমলসমূহ যত্নের সঙ্গে পালন করা আল্লাহ তাআলার নৈকট্যলাভের সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়। কাজেই ফরয আমলে কখনও অবহেলা করতে নেই।

গ. নফল ইবাদতসমূহও গুরুত্বের সঙ্গে পালন করা চাই। তা দ্বারা আল্লাহ তাআলার মহব্বত ও ভালোবাসা লাভ করা যায়।

ঘ. আল্লাহ তাআলার ভালোবাসা পেলে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহের শরীআতসম্মত ব্যবহার নিশ্চিত হয়। তাই যেসব উপায়ে আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়া যায়, সেগুলো শক্তভাবে ধরা চাই।

ঙ. দুআ কবুল ও আল্লাহর আশ্রয় লাভের পক্ষে তাঁর ভালোবাসা সহায়ক হয়ে থাকে। তাই এজন্যও নফল ইবাদতের গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

৩১১. সূরা ইয়ূনুস (১০), আয়াত ৬২-৬৪

৩১২. সূরা মুমতাহিনা (৬০), আয়াত ১

৩১৩. সূরা মায়িদা (৫), আয়াত ৫১

৩১৪. সূরা মুমতাহিনা (৫), আয়াত ৫৫-৫৬
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)
রিয়াযুস সালিহীন - হাদীস নং ৩৮৬ | মুসলিম বাংলা