রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ৩৪৬
অধ্যায়ঃ ৪৩

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরিবারবর্গের প্রতি সম্মানপ্রদর্শন ও তাদের মর্যাদার বর্ণনা

بيت -মানে ঘর। اهل بيت (আহলে বায়ত) মানে গৃহবাসী। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আহলে বায়ত দ্বারা প্রথমত তাঁর স্ত্রীগণকেই বোঝায়। তাঁর ঘরে তো তাঁরাই বাস করতেন। তবে পরিভাষায় শব্দটি আরও ব্যাপক। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীগণের পাশাপাশি হযরত আলী রাযি. হযরত ফাতিমা রাযি. এবং হযরত হাসান রাযি. ও হুসায়ন রাযি. ও আহলে বায়তের অন্তর্ভুক্ত। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. বর্ণনা করেন, একদিন ভোরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কালো পশমের কাজ করা একটি চাদর পরে বের হন। এমন সময় আলী রাযি.-এর পুত্র হাসান রাযি. এসে উপস্থিত হন। তিনি তাঁকে চাদরের মধ্যে ঢুকিয়ে নেন। তারপর হুসায়ন রাযি আসলেন। তাঁকেও চাদরের মধ্যে ঢুকিয়ে নেন। তারপর ফাতিমা রাযি. আসলেন। তাঁকে চাদরের মধ্যে ঢুকিয়ে নেন। সবশেষে আসলেন আলী রাযি.। তিনি তাঁকেও চাদরের মধ্যে ঢুকিয়ে নিলেন। তারপর পাঠ করলেন-

إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا

“হে নবী পরিবার (আহলে বায়ত)! আল্লাহ তো চান তোমাদের থেকে মলিনতা দূরে রাখতে এবং তোমাদেরকে সর্বতোপ্রকারে পবিত্রতা দান করতে? -সূরা আহযাব, আয়াত ৩৩।১৭২
হযরত সা'দ ইবন আবী ওয়াক্কাস রাযি. থেকে বর্ণিত আছে, যখন নাজরানের খ্রীষ্টান প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বিতর্ক হলো এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সত্যতা পরিস্ফুট হওয়া সত্ত্বেও তারা সত্যগ্রহণে প্রস্তুত হলো না, ফলে আয়াত নাযিল হলো-

فَمَنْ حَاجَّكَ فِيهِ مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَكَ مِنَ الْعِلْمِ فَقُلْ تَعَالَوْا نَدْعُ أَبْنَاءَنَا وَأَبْنَاءَكُمْ وَنِسَاءَنَا وَنِسَاءَكُمْ وَأَنْفُسَنَا وَأَنْفُسَكُمْ ثُمَّ نَبْتَهِلْ فَنَجْعَلْ لَعْنَتَ اللَّهِ عَلَى الْكَاذِبِينَ

[তোমার কাছে (হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের ঘটনা সম্পর্কে) যে প্রকৃত জ্ঞান এসেছে, তারপরও যারা এ বিষয়ে তোমার সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হয়, (তাদেরকে) বলে দাও, এস আমরা ডাকি আমাদের সন্তানদেরকে এবং তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে, আমরা আমাদের নারীদেরকে এবং তোমরা তোমাদের নারীদেরকে, আর আমাদের নিজ লোকদেরকে এবং তোমাদের নিজ লোকদেরকে, তারপর আমরা সকলে মিলে (আল্লাহর সামনে) কাকুতি-মিনতি করি এবং যারা মিথ্যাবাদী, তাদের প্রতি আল্লাহর লানত পাঠাই - সূরা আলে ইমরান, আয়াত ৬১], তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আলী রাযি. ফাতিমা রাযি. হাসান রাযি. ও হুসায়ন রাযি.-কে ডাকলেন। তারপর বললেন—

اللهم هؤلاء أهلي

(হে আল্লাহ! এরা আমার আহলে বায়ত)।১৭৩
হযরত উম্মু সালামা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়াত—

إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا

নাযিল হওয়ার পর হযরত আলী রাযি. ফাতিমা রাযি. হাসান রাযি. ও হুসায়ন রাযি.-কে ডাকলেন। তারপর তাদের সবাইকে একটা চাদরে জড়িয়ে নিলেন। তারপর বললেন-

اللهم هؤلاء أهل بيتي وخاصتي، أذهب عنهم الرجس وطهرهم تطهيرا

“হে আল্লাহ! এরা আমার আহলে বায়ত। আপনি এদের থেকে অপবিত্রতা দূর করুন এবং এদেরকে পরিপূর্ণরূপে পবিত্র করুন।
এরকম আরও অনেক হাদীছ আছে, যা দ্বারা পরিষ্কার বোঝা যায় আলী রাযি. ফাতিমা রাযি. হাসান রাযি. ও হুসায়ন রাযি.-ও আহলে বায়তের অন্তর্ভুক্ত।১৭৪
এক শ্রেণীর লোক এসকল হাদীছের দিকে লক্ষ করে কেবল এই চারজনকেই আহলে বায়তের অন্তর্ভুক্ত মনে করে থাকেন। তারা রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীগণকে আহলে বায়তের মধ্যে গণ্য করেন না। এটা তাদের এক ভয়ানক বিভ্রান্তি। কেননা কুরআন মাজীদের আয়াত-

إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا

এর দ্বারা তো সরাসরি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীদেরকেই আহলে বায়ত বলা হয়েছে। তাছাড়া এ আয়াতের আগে ও পরে সম্পূর্ণ রুকূ'টিতে কেবল তাঁদেরকে লক্ষ্য করেই কথা বলা হয়েছে এবং একাধিক স্থানে ঘরকে তাঁদের সঙ্গেই সম্বন্ধযুক্ত করা হয়েছে। এমনিভাবে আহলে বায়ত শব্দটির আক্ষরিক অর্থও তো কেবল তাঁদের জন্যই প্রযোজ্য হয়। সন্তান-সন্ততির জন্য তা প্রযোজ্য হয়। স্ত্রীদের অধীনে, মৌলিকভাবে নয়।
স্ত্রীদের জন্য আহলে বায়ত শব্দটি কুরআন মাজীদের অন্যত্রও ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন সূরা হূদে আছে-

أَتَعْجَبِينَ مِنْ أَمْرِ اللَّهِ رَحْمَتُ اللَّهِ وَبَرَكَاتُهُ عَلَيْكُمْ أَهْلَ الْبَيْتِ

'আপনি কি আল্লাহর হুকুম সম্বন্ধে বিস্ময়বোধ করছেন? আপনাদের মত সম্মানিত পরিবারবর্গের উপর রয়েছে আল্লাহর রহমত ও প্রভূত বরকত।১৭৫
এ কথাটি ফিরিশতাগণ হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের স্ত্রী সারা রাযি.-কে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, যখন পুত্রসন্তান জন্মের সুসংবাদ দেওয়ায় তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন।
মোটকথা, কুরআন মাজীদের আয়াতে সরাসরি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীগণকে 'আহলে বায়ত' শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে। তাই কোনও বিবেচনায়ই তাঁদেরকে আহলে বায়ত থেকে খারিজ করার সুযোগ নেই; তা করতে যাওয়াটা হবে কুরআন মাজীদের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করা বা তার অপব্যাখ্যা করার নামান্তর। তবে কুরআন মাজীদে শব্দটিকে তাঁদের জন্য এমনভাবে নির্দিষ্ট করা হয়নি যে, এটি অন্য কারও জন্য প্রযোজ্য হবে না। হাঁ, আয়াতের বাহ্যিক শব্দাবলীর প্রতি লক্ষ করে কেউ শব্দটিকে তাদের জন্যই নির্দিষ্ট বলে ধারণা করতে পারে। বাস্তবিকপক্ষে যেহেতু তাদের জন্য নির্দিষ্ট নয়; বরং এটি আরও ব্যাপক অর্থবোধক, তাই পরিষ্কার করা দরকার ছিল এর মধ্যে আর কারা কারা শামিল। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন হাদীছ দ্বারা তা পরিষ্কার করে দিয়েছেন। সুতরাং 'আহলুস্ সুন্নাহ ওয়াল জামাআত'-এর আকীদা এটাই যে, উম্মাহাতুল মুমিনীনের সঙ্গে হযরত আলী রাযি. ফাতিমা রাযি. হাসান রাযি. হুসায়ন রাযি. ও তাঁদের বংশধরগণও আহলে বায়তের অন্তর্ভুক্ত।
যাহোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আহলে বায়তের মর্যাদা অতি উচ্চে। তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি বজায় রাখা ও তাঁদেরকে ভালোবাসা ঈমানের দাবি। ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায় এ সম্পর্কিত কিছু আয়াত ও হাদীস উল্লেখ করেছেন। আমরা নিচে তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন।

১৭২. সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৪২৪; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ৩২০৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৩০৬১; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীছ নং ৩২১০২; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ২৮৫৮

১৭৩. সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৪০৪; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৯৯৯

১৭৪. জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ৩৮৭১; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২৬৫০৮

১৭৫. সূরা হূদ (১১), আয়াত ৭৩

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরিবারবর্গের প্রতি সম্মানপ্রদর্শন ও মর্যাদা সম্পর্কিত দুটি আয়াত

এক নং আয়াত

إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا

অর্থ : হে নবী পরিবার (আহলে বায়ত)! আল্লাহ তো চান তোমাদের থেকে মলিনতা দূরে রাখতে এবং তোমাদেরকে সর্বতোপ্রকারে পবিত্রতা দান করতে।১৭৬

ব্যাখ্যা

এটি সূরা আহযাবের ৩৩ নং আয়াতের শেষাংশ। এর মর্ম স্পষ্টভাবে বোঝার জন্য

পূর্ণ আয়াতটি সামনে রাখা দরকার। এ আয়াতের আগের অংশ হলো-

وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَى وَأَقِمْنَ الصَّلَاةَ وَآتِينَ الزَّكَاةَ وَأَطِعْنَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ

নিজ গৃহে অবস্থান কর (পর-পুরুষকে) সাজসজ্জা প্রদর্শন করে বেড়িও না, যেমন প্রাচীন জাহিলী যুগে প্রদর্শন করা হত এবং নামায কায়েম কর, যাকাত আদায় কর এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর।
এ আয়াতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীগণকে প্রথম হুকুম দেওয়া হয়েছে যে- وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ (নিজ গৃহে অবস্থান কর)। এটা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, নারীর আসল জায়গা হলো তার ঘর। এর অর্থ এমন নয় যে, ঘর থেকে বের হওয়া তার জন্য একদম জায়েয নয়। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীছ দ্বারা পরিষ্কারভাবেই জানা যায়, প্রয়োজনে তারা পর্দার সাথে বাইরে যেতে পারবে, কিন্তু এ আয়াত মূলনীতি বলে দিয়েছে যে, নারীর আসল কাজ তার গৃহে। তার প্রধান দায়িত্ব স্বামীর মনে প্রশান্তি যোগানো, সন্তানের লালন-পালন ও পরিবার গঠন। যেসব তৎপরতা এ দায়িত্ব পালনে বিঘ্ন ঘটায় তা নারী জীবনের মৌল উদ্দেশ্যের পরিপন্থী এবং তা দ্বারা সমাজের ভারসাম্য নষ্ট হয়। নারী ঘরের বাইরে গেলে শয়তান সুযোগ গ্রহণ করে। শয়তান পুরুষকে তার প্রতি আকৃষ্ট করে পারিবারিক বন্ধন শিথিল করে দেয় এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেরই চারিত্রিক অবক্ষয় ঘটানোর সুযোগ নেয়। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

الْمَرْأَةُ عَوْرَةٌ، وَإِنَّهَا إِذَا خَرَجَتِ اسْتَشْرَفَهَا الشَّيْطَانُ، وَإِنَّهَا لَا تَكُونُ إِلَى وَجْهِ الله أَقْرَبَ مِنْهَا فِي قَعْرِ بَيْتِهَا

‘নারীসত্তা আবরণীয়। সে ঘর থেকে বের হলে শয়তান তাকে উকি দিয়ে দেখে। সে তার প্রতিপালকের সর্বাপেক্ষা বেশি সন্তুষ্টিপ্রাপ্ত হয়, যখন সে নিজ গৃহকোটরে অবস্থান করে।১৭৭
তারপর আয়াতে তাঁদের প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে- وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَى (পর-পুরুষকে) সাজসজ্জা প্রদর্শন করে বেড়িও না, যেমন প্রাচীন জাহিলী যুগে প্রদর্শন করা হত।
تَبَرُّجَ শব্দটির উৎপত্তি برج থেকে। এর অর্থ প্রকাশ পাওয়া, উন্মুক্ত হওয়া। উঁচু ভবনকে برج বলে। কারণ তা সকলের সামনে উন্মুক্ত থাকে।تَبَرُّجَ অর্থ সৌন্দর্য প্রকাশ করা। সুন্দর পোশাক ও অলংকারসজ্জিত হয়ে লোকসম্মুখে বের হয়ে আসা। ইবন আবু নুজাইহ, মুজাহিদ প্রমুখ বলেন, تَبَرُّجَ অর্থ অহংকার ও আত্মগরিমার সঙ্গে আকর্ষণীয় অঙ্গভঙ্গিতে হেলেদুলে চলা।
প্রাচীন জাহিলিয়াত দ্বারা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রাক-আবির্ভাব কালকে বোঝানো হয়েছে। সেকালে নারীরা নির্লজ্জ সাজ-সজ্জার সাথে নিজেদেরকে প্রদর্শন করে বেড়াত। ‘প্রাচীন জাহিলিয়াত, শব্দটি ইঙ্গিত করছে নব্য জাহিলিয়াত বলে একটা জিনিসও আছে, যা এক সময় আসবে। অন্ততপক্ষে অশ্লীলতার দিক থেকে তো সেরকমের এক জাহিলিয়াত আমরা দেখতেই পাচ্ছি। এ নব্য জাহিলিয়াতের অশ্লীলতা এতটাই উগ্র যে, তার সামনে প্রাচীন জাহিলিয়াত কবেই হার মেনেছে।
তারপর এ আয়াতে সালাত কায়েম করা, যাকাত আদায় করা এবং আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য করার হুকুম দেওয়া হয়েছে। এসব বিধি-বিধান দেওয়ার পর আহলে বায়তকে সম্বোধন করে ইরশাদ হয়েছে-

إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا

'হে নবী পরিবার (আহলে বায়ত)! আল্লাহ তো চান তোমাদের থেকে মলিনতা দূরে রাখতে এবং তোমাদেরকে সর্বতোপ্রকারে পবিত্রতা দান করতে।'
অর্থাৎ এসব বিধি-বিধান দ্বারা উদ্দেশ্য তোমাদেরকে পাপের মলিনতা থেকে দূরে রাখা এবং সকল দিক থেকে তোমাদেরকে পবিত্র করে তোলা। যারা শরীআতের বিধান মোতাবেক চলে, পাপের পঙ্কিলতা তাদেরকে স্পর্শ করতে পারে না। দুর্ঘটনাক্রমে কখনও কোনও পাপ হয়ে গেলেও নামায, যাকাত ইত্যাদি ইবাদত-বন্দেগী দ্বারা সে পাপের ময়লা দূর হয়ে যায় এবং ইবাদতকারীর আত্মা পূতঃপবিত্র হয়ে ওঠে।
'আহলে বায়ত' বলতে এস্থলে সরাসরি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীগণকে বোঝানো হয়েছে, যেহেতু এর আগে-পরে তাঁদেরই সম্পর্কে আলোচনা। কিন্তু শাব্দিক ব্যাপকতার কারণে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কন্যাগণ ও তাঁদের সন্তান-সন্ততিও এর অন্তর্ভুক্ত। সহীহ মুসলিমের এক বর্ণনায় আছে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার হযরত ফাতিমা, হযরত আলী, হযরত হাসান ও হযরত হুসায়ন (রাযিয়াল্লাহু তাআলা আনহুম)-কে নিজ চাদর দ্বারা জড়িয়ে নিলেন। তারপর এ আয়াত পাঠ করলেন। কোনও কোনও রেওয়ায়াতে আছে, তিনি তখন এ কথাও বলেছিলেন যে, ‘হে আল্লাহ! এরা আমার আহলে বায়ত’ (ইবনে জারীর)। বিস্তারিত ভূমিকায় দেখুন।
প্রকাশ থাকে যে, পরিপূর্ণ পবিত্রতার অর্থ তারাও নবীগণের মতো মাছুম (নিষ্পাপ) হয়ে যাবেন, তা নয়; বরং এর অর্থ তারা অত্যন্ত তাকওয়া-পরহেযগারীর অধিকারী হয়ে যাবেন। ফলে গুনাহের পঙ্কিলতা তাদের থেকে দূর হয়ে যাবে। এক শ্রেণীর লোক বলে থাকে যে, এ আয়াত দ্বারা বোঝা যায় হযরত আলী রাযি., ফাতিমা রাযি. হাসান রাযি. ও হুসায়ন রাযি. মাসূম ও নিষ্পাপ ছিলেন। কাজেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর তাঁরাই খেলাফত ও ইমামতের হকদার, অন্য কেউ নয়। তাদের মতে ইমাম ও খলীফা হওয়ার জন্য মাসূম হওয়া শর্ত। এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা যখন তাদেরকে পাপ থেকে পবিত্র করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, তখন নিশ্চয়ই তাঁরা পাপ থেকে পবিত্র অর্থাৎ নিষ্পাপ বা মাসূম হয়ে গিয়েছিলেন। আল্লাহ তাআলার ইচ্ছার তো ব্যতিক্রম হতে পারে না।
কিন্তু আলোচ্য আয়াত দ্বারা তাদের এসব দাবি মোটেই প্রমাণ হয় না। কেননা এক তো এ আয়াতে যে আহলে বায়তকে পবিত্র করার কথা বলা হয়েছে, সে আহলে বায়ত দ্বারা কেবল উল্লিখিত ব্যক্তিবর্গকেই বোঝায় না; বরং মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পুণ্যবতী স্ত্রীগণও এর অন্তর্ভুক্ত। আয়াতটি তো সরাসরি নাযিলই হয়েছে তাঁদের সম্পর্কে। দ্বিতীয়ত এ আয়াতটি নিষ্পাপতা প্রমাণ করে না। অর্থাৎ আয়াতটি এ কথা বোঝাচ্ছে না যে, উল্লিখিত ব্যক্তিবর্গ মা'সুম ছিলেন। বরং বোঝাচ্ছে এ কথা যে, তোমাদেরকে যে বিধানগুলো দেওয়া হলো এগুলো যদি তোমরা অনুসরণ করে চল, তবে পাপ থেকে বেঁচে থাকতে পারবে এবং কখনও কোনও পাপ হয়ে গেলেও এসব ইবাদতের অছিলায় তা মাফ হয়ে যাবে। বলাবাহুল্য এ কথাটি যে-কোনও মুমিনের বেলায়ই প্রযোজ্য। আলোচনার ধারা যেহেতু নবী-পরিবারকে লক্ষ্য করে চলছিল, তাই সরাসরি কথাটি তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে। কিন্তু এর উদ্দেশ্য ব্যাপক। উল্লিখিত ব্যক্তিবর্গ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীগণ এবং মুসলিম উম্মাহ'র নারী- পুরুষ সকলেই এর আওতাভুক্ত। যে-কেউ নিজ ইচ্ছায় আল্লাহ তাআলার তাওফীকে শরীআত মোতাবেক চলবে, সেই পাপের পঙ্কিলতা থেকে বেঁচে থাকতে পারবে।
তাছাড়া ইমাম ও খলীফা হওয়ার জন্য মাসূম হওয়ার যে শর্ত বলা হয়েছে তারও কোনও ভিত্তি নেই। যে-কোনও নেককার মুসলিমই এ পদে অভিষিক্ত হতে পারে। আল্লাহ তাআলা তো হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম ও শামুয়েল আলাইহিস সালামের মত নিষ্পাপ নবীদের বর্তমানেও তালূতকে রাজপদের জন্য মনোনীত করেছিলেন। নবীগণ মাসুম ছিলেন, কিন্তু তিনি তো মাসূম ছিলেন না।

দুই নং আয়াত

وَمَنْ يُعَظِّمْ شَعَائِرَ اللَّهِ فَإِنَّهَا مِنْ تَقْوَى الْقُلُوبِ

অর্থ : আর কেউ আল্লাহর ‘শাআইর’-কে সম্মান করলে এটা তো অন্তরস্থ তাকওয়া থেকেই অর্জিত হয়।১৭৮

ব্যাখ্যা

আল্লাহর শা‘আইর মানে আল্লাহর দীনের শাআইর।شَعَائِرَ শব্দটি شعيرة বা شعارة এর বহুবচন। এর অর্থ আলামত ও নিদর্শন। পরিভাষায় শাআইর (شَعَائِرَ) বলা হয় এমনসব বিষয় ও বস্তুকে, যা কোনও ধর্ম বা মতাদর্শের একান্ত বিষয় ও তার পরিচায়ক। সুতরাং ‘দীনে ইসলাম'-এর শাআইর বলতে এমনসব বিষয় ও বস্তুকে বোঝাবে, যা এ দীনের পরিচয় বহন করে বা যা একান্তভাবে এ দীনের সঙ্গেই সম্পর্কযুক্ত। এভাবেও বলা যায় যে, যেসকল বিষয় দেখলে বা শুনলে বোঝা যায় যে, এটা কেবল ইসলামেরই জিনিস, অন্যকিছুর নয়, তাকেই দীনের শাআইর বলে। যেমন ওযূ, আযান, নামায, মসজিদ, বায়তুল্লাহ, হজ্জের স্থানসমূহ, কুরবানীর পশু, কুরআন এবং দীনের প্রকাশ্য বিধানাবলী।
এমনিভাবে যেসকল ব্যক্তিবর্গ দীন ইসলামের বিশেষ কোনও আমলের সঙ্গে এমনভাবে সম্পৃক্ত, যদ্দরুন সেই আমলের বিশেষণে তারা বিশেষিত হয়ে থাকে, তারাও ইসলামের শা'আইরের অন্তর্ভুক্ত। যেমন আযানদাতাকে বলা হয় মুআযযিন। ইমামতকারীকে বলা হয় ইমাম। খেলাফত পরিচালনাকারীকে বলা হয় খলীফা। হজ্জ আদায়ে রত ব্যক্তিকে বলা হয় হাজী। নামায আদায়ে মশগুল ব্যক্তিকে বলা হয় নামাযী । এসকল উপাধি অন্য কোনও ধর্মের আচার-অনুষ্ঠানকারীর জন্য প্রযোজ্য হয় না। এর যে কোনও উপাধি উচ্চারণ মাত্রই শ্রোতার দৃষ্টি চলে যায় ইসলামের দিকে। সুতরাং এ উপাধিধারীগণ ইসলামের নিদর্শন।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ইসলামের বিশেষ আমলে ব্যাপৃত ব্যক্তি যখন ইসলামের নিদর্শনরূপে গণ্য, তখন যেই মহান সত্তা ইসলাম নিয়ে এসেছেন, ইসলামের প্রচার করেছেন এবং নিজ জীবনকে ইসলামের বাস্তব নমুনারূপে উম্মতের সামনে পেশ করেছেন, সেই আখেরী নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ নিদর্শনই হবেন।
এ আয়াতে দীনের শাআইরের প্রতি সম্মান প্রদর্শন সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, فَإِنَّهَا مِنْ تَقْوَى الْقُلُوبِ ‘এটা অন্তরের তাকওয়া থেকেই অর্জিত হয়’ অর্থাৎ যার অন্তরে তাকওয়া ও আল্লাহভীতি আছে, সেই-ই এটা করে। সে হিসেবে এটা তাকওয়ার আলামতও বটে। এ আয়াত দ্বারা জানা গেল, তাকওয়া অন্তরের বিষয়। এক হাদীছেও আছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ বুকের দিকে ইশারা করে বলেন,

أَلَا إِنَّ التَّقْوَى ههُنَا
‘জেনে রেখ, তাকওয়া এখানে।

তাকওয়া যেহেতু অন্তরের বিষয়, তাই তা চোখে দেখা যায় না। আলামত দ্বারা বোঝা যায়। শাআইরকে সম্মান করা একটা আলামত। কেউ এটা করলে এর দ্বারা বোঝা যায় তার অন্তরে তাকওয়া আছে।
এ আয়াত দ্বারা মূলত মু'মিন-মুত্তাকীকে তাগিদ করা হয়েছে সে যেন দীনের শা‘আইর ও নিদর্শনসমূহকে সম্মান করে ও তার আদব বজায় রাখে। সুতরাং মুমিন ব্যক্তির কর্তব্য মসজিদ ও বায়তুল্লাহর আদব রক্ষা করা, কুরআন ও আযানের তাযীম করা, কুরবানীর পশুকে গুরুত্বদান ও যত্ন করা, দীনী কাজের কেন্দ্রসমূহ ও তাতে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের কদর করা, মুআযযিন ও ইমামকে সম্মান করা, হজ্জ আদায়ে রত ও নামাযরত ব্যক্তিকে সম্মান করা ইত্যাদি।
মহানবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ইসলামের শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন, তখন তাঁকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করা এবং তাঁকে সর্বাপেক্ষা বেশি ভালোবাসাও এ আয়াতের হুকুমের অন্তর্ভুক্ত হবে। বরং তাঁর সম্মানার্থে তাঁর আহলে বায়তকে সম্মান করাও এ উম্মতের পক্ষে অবশ্যকর্তব্য বলে গণ্য হবে।
এর আগের আয়াতে শিরকী কর্মকাণ্ডের নিন্দা করা হয়েছে, যার সারকথা হচ্ছে- গায়রুল্লাহকে সম্মান ও শ্রদ্ধাভক্তি করা একটি নিন্দনীয় কাজ এবং সে শ্রদ্ধাভক্তি যদি আল্লাহ তা'আলাকে শ্রদ্ধাভক্তির সমপর্যায়ের হয়ে যায়, তবে তো তা সম্পূর্ণরূপেই বেঈমানী কাজ। এর দ্বারা কেউ মনে করতে পারত যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনওকিছুকে কোনওপর্যায়েই শ্রদ্ধাভক্তি করা যাবে না। এ আয়াত সে ধারণা খণ্ডন করে দিচ্ছে। এতে বলা হয়েছে যে, যে-কোনও গায়রুল্লাহকে যে-কোনও পর্যায়ের শ্রদ্ধাভক্তি করা নিন্দনীয় নয়; বরং যেসকল ব্যক্তি ও বিষয় আল্লাহ তা'আলার সাথে সম্পৃক্ত, শরীআত প্রদর্শিত পন্থায় তার সম্মান রক্ষা করা আল্লাহ তা'আলারই হুকুম এবং এটা করা তাকওয়া ও আল্লাহভীতির অন্তর্ভুক্ত।

১৭৬. সূরা আহযাব (৩৩), আয়াত ৩৩

১৭৭. সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৫৫৯৮; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীছ নং ৭৬১৬; সুনানে তিরমিযী, হাদীছ নং ১১৭৩; সহীহ ইবন খুযাইমা, হাদীছ নং ১৬৮৫; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ১০১১৫

১৭৮. সূরা হজ্জ (২২), আয়াত ৩২
হাদীছ নং : ৩৪৬
ইয়াযীদ ইবন হায়্যান বলেন, আমি, হুসায়ন ইবন্ সাবরাহ ও আমর ইবন মুসলিম হযরত যায়দ ইবন আরকাম রাযি. এর কাছে গেলাম। আমরা তাঁর কাছে বসলে হুসায়ন তাঁকে বললেন, হে যায়দ! আপনি বিপুল কল্যাণ লাভ করেছেন। আপনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছেন, তাঁর কথা শুনেছেন, তাঁর সঙ্গে থেকে যুদ্ধ করেছেন এবং তাঁর পেছনে নামায আদায় করেছেন। হে যায়দ। আপনি বিপুল কন্যাগ লাভ করেছেন। হে যায়দ! আপনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে যা শুনেছেন আমাদের কাছে তা বর্ণনা করুন। তিনি বললেন, হে ভাতিজা। আমার বয়স বেশি হয়ে গেছে। আমার জীবনকাল পুরানো হয়ে গেছে। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে যা-কিছু মনে রেখেছিলাম তার কিছুটা ভুলেও গেছি। সুতরাং আমি তোমাদের কাছে যা বর্ণনা করব তোমরা তা গ্রহণ করো। আর যা বর্ণনা করব না সেজন্য আমাকে পীড়াপীড়ি করো না। তারপর বললেন, একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লা আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা ও মদীনার মাঝখানে ‘খুম’ নামক এক জলাশয়ের পাশে আমাদের মধ্যে ভাষণ দিতে দাঁড়ালেন। তিনি আল্লাহ তা'আলার হাম্দ ও গুণগান করার পর আমাদের উপদেশ দিলেন ও নসিহত করলেন। তারপর বললেন, হে লোক সকল! আমি একজন মানুষমাত্র। হয়তো অচিরেই আমার প্রতিপালকের দূত এসে যাবে এবং আমি তাঁর ডাকে সাড়া দেব। আমি তোমাদের মধ্যে দু'টি ভার রেখে যাচ্ছি। তার প্রথমটি হচ্ছে আল্লাহর কিতাব। তাতে আছে হিদায়াত ও আলো। তোমরা আল্লাহর কিতাব ধরে রেখো এবং তা শক্তভাবে ধরো। এভাবে তিনি আল্লাহর কিতাবের প্রতি উৎসাহ দিলেন ও তার প্রতি উদ্বুদ্ধ করলেন। তারপর বললেন, আর (দ্বিতীয়টি হচ্ছে) আমার আহলে বায়ত (পরিবারবর্গ)। আমি তোমাদেরকে আমার আহলে বায়তের ব্যাপারে আল্লাহকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। আমি তোমাদেরকে আমার আহলে বায়তের ব্যাপারে আল্লাহকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি।'
হুসায়ন তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, হে যায়দ! তাঁর আহলে বায়ত কারা? তাঁর স্ত্রীগণ কি তাঁর আহলে বায়তের অন্তর্ভুক্ত নন? তিনি বললেন, তাঁর স্ত্রীগণও আহলে বায়তের অন্তর্ভুক্ত। তবে (সাধারণভাবে) আহলে বায়ত বলতে তাদেরকে বোঝানো হয়, তাঁর ওফাতের পর যাদের জন্য সদাকা (খাওয়া) হারাম করা হয়েছে। হুসায়ন জিজ্ঞেস করলেন, তারা কারা? তিনি বললেন, তারা হচ্ছে আলীর বংশধরগণ, আকীলের বংশধরগণ, জাফরের বংশধরগণ এবং আব্বাসের বংশধরগণ। হুসায়ন জিজ্ঞেস করলেন, এদের সকলের প্রতি সদাকা হারাম করা হয়েছে? তিনি বললেন, হাঁ -মুসলিম ।১৭৯
অপর এক বর্ণনায় আছে, শোন হে ! আমি তোমাদের মধ্যে দুটি ভার রেখে যাচ্ছি। তার একটি আল্লাহর কিতাব। আর তা হচ্ছে আল্লাহর রশি। যে ব্যক্তি তার অনুসরণ করবে। সে হিদায়াতের উপর থাকবে। আর যে তা পরিত্যাগ করবে সে পথভ্রষ্ট হবে।
সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৪০৮; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৯২৬৫; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা, হাদীছ নং ১০৭১২; নাসাঈ, আসসুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৮১১৯; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হাদীছ নং ২৩৫৭; তাবারানী, আল-মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ৫০২৮; বায়হাকী, আস্সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৩২৩৮
43 - باب إكرام أهل بيت رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - وبيان فضلهم

قَالَ الله تَعَالَى: {إِنَّمَا يُرِيدُ اللهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا} [الأحزاب: 33]، وَقالَ تَعَالَى: {وَمَنْ يُعَظِّمْ شَعَائِرَ اللهِ فَإِنَّهَا مِنْ تَقْوَى الْقُلُوبِ} [الحج: 32].
346 - وعن يزيد بن حَيَّانَ، قَالَ: انْطَلَقْتُ أنَا وحُصَيْنُ بْنُ سَبْرَة، وَعَمْرُو ابن مُسْلِم إِلَى زَيْد بْنِ أرقَمَ - رضي الله عنهم - فَلَمَّا جَلَسْنَا إِلَيْهِ قَالَ لَهُ حُصَيْن: لَقَدْ لقِيتَ يَا زَيْدُ خَيْرًا كَثِيرًا، رَأيْتَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - وسمعتَ حديثَهُ، وغَزوْتَ مَعَهُ، وَصَلَّيْتَ خَلْفَهُ: لَقَدْ لَقِيتَ يَا زَيْدُ خَيْرًا كَثيرًا، حَدِّثْنَا يَا زَيْدُ مَا سَمِعْتَ مِنْ رسولِ الله - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: يَا ابْنَ أخِي، وَاللهِ لقد كَبِرَتْ سِنِّي، وَقَدُمَ عَهدِي، وَنَسيتُ بَعْضَ الَّذِي كُنْتُ أَعِي مِنْ رسولِ الله - صلى الله عليه وسلم - فما حَدَّثْتُكُمْ، فَاقْبَلُوا، ومَا لاَ فَلاَ تُكَلِّفُونيهِ. ثُمَّ قَالَ: قام رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - يَومًا فينا خَطِيبًا بمَاءٍ يُدْعَى خُمًّا بَيْنَ مَكَّةَ وَالمَدِينَةِ، فَحَمِدَ الله، وَأثْنَى عَلَيهِ، وَوَعَظَ وَذَكَّرَ، ثُمَّ قَالَ: «أمَّا بَعدُ، ألاَ أَيُّهَا النَّاسُ، فَإنَّمَا أنَا بَشَرٌ يُوشِكَ أَنْ يَأتِي رسولُ ربِّي فَأُجِيبَ، وَأنَا تاركٌ فيكم ثَقَلَيْنِ: أوَّلُهُمَا كِتَابُ اللهِ، فِيهِ الهُدَى وَالنُّورُ، فَخُذُوا بِكتابِ الله، وَاسْتَمْسِكُوا بِهِ»، فَحَثَّ عَلَى كِتَابِ الله، وَرَغَّبَ فِيهِ، ثُمَّ قَالَ: «وَأَهْلُ بَيْتِي أُذكِّرُكُمُ اللهُ في أهلِ بَيْتي، أذكرُكُمُ الله في أهل بيتي» فَقَالَ لَهُ حُصَيْنٌ: وَمَنْ أهْلُ بَيتهِ يَا زَيْدُ، أَلَيْسَ نِسَاؤُهُ مِنْ أهْلِ بَيْتِهِ؟ قَالَ: نِسَاؤُهُ مِنْ أهْلِ بَيتهِ، وَلكِنْ أهْلُ بَيتِهِ مَنْ حُرِمَ الصَّدَقَةَ بَعدَهُ، قَالَ: وَمَنْ هُمْ؟ قَالَ: هُمْ آلُ عَلِيٍّ، وَآلُ عقيل، وَآلُ جَعفَرَ، وآلُ عَبَّاسٍ. قَالَ: كُلُّ هؤلاء حُرِمَ الصَّدَقَةَ؟ قَالَ: نَعَمْ. رواه مسلم. (1)
وفي رواية: «ألاَ وَإنّي تَارِكٌ فِيكُمْ ثَقَليْنِ: أحَدُهُما كِتَابُ الله وَهُوَ حَبْلُ الله، مَنِ اتَّبَعَهُ كَانَ عَلَى الهُدَى، وَمَنْ تَرَكَهُ كَانَ عَلَى ضَلاَلَة».

হাদীসের ব্যাখ্যা:

আলোচ্য হাদীছটি হযরত যায়দ ইবন আরকাম রাযি. থেকে বর্ণনা করেছেন ইয়াযীদ ইবন হায়্যান রহ.। তিনি, হুসায়ন ইবন সাবরা রহ. ও আমর ইবন মুসলিম রহ.- এ তিনজন মিলে হযরত যায়দ ইবন আরকাম রাযি.-এর সঙ্গে সাক্ষাত করতে গিয়েছিলেন। তখন হুসায়ন ইবন সাবরা রহ. হযরত যায়দ ইবন আরকাম রাযি.-কে লক্ষ্য করে বলেন-

لقد لقيت يا زيد خيرا كثيرا

(হে যায়দ! আপনি প্রভূত কল্যাণ অর্জন করেছেন)।
তারপর সে কল্যাণসমূহ কী তার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিশেষ কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করেছেন। আর তা হচ্ছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখতে পাওয়া, সরাসরি তাঁর হাদীছ ও বাণী শুনতে পাওয়া, তার সঙ্গে জিহাদে শরীক থাকা ও তাঁর পেছনে নামায আদায় করা। সন্দেহ নেই এর প্রত্যেকটিই অতি বড় নি'আমত। ইহজগতে এরচে' বড় কোনও নিআমত কল্পনা করা যায় না।

ঈমানের সঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখা ও তার সাহাবী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জনের মত অমূল্য সম্পদ আর কী হতে পারে? তারপর আবার সরাসরি নিজ কানে তাঁর মিষ্টিমধুর, জ্ঞান-প্রজ্ঞায় ভরপুর ও প্রাণজুড়ানো নূরাণী কথা শুনতে পাওয়া। চোখেও নূরের বিকিরণ, হৃদয়মনেও নূরের বিচ্ছুরণ। নূরুন আলা নূর। আরও খোশনসীব জিহাদে অংশগ্রহণ, যে জিহাদের আমীর স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তাঁর ছায়ায়, তাঁরই কমান্ডে আল্লাহর শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই, দীনের জন্য প্রাণদানের উদ্‌যাপন। এ মহাপ্রাপ্তির কি কোনও তুলনা হয়? রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে নামায। আল্লাহ তাআলার সামনে এবং তাঁর সর্বাপেক্ষা বেশি নৈকট্যে বান্দার হাজিরা। এ নামাযের ইমাম মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে। তাঁর তাকবীর অনুসরণে রুকূ-সিজদা করা, তাঁর 'সামিআল্লাহু লিমান হামিদাহ্' ধ্বনির উত্তরে 'রাব্বানা লাকাল হাম্দ' বলা। একজন বান্দার পক্ষে ইহলোকে এরচে' বেশি পাওয়ার আর কী থাকতে পারে? হযরত যাযদ ইবন আরকাম রাযি. এর সবক'টিই লাভ করেছেন।

হযরত যায়দ ইবন আরকাম রাযি.-কে সম্বোধন করে হুসায়ন রহ. ও তাঁর সঙ্গীদের এ বক্তব্য ছিল তাঁর প্রতি নিজেদের অন্তরে লালিত ভক্তি-শ্রদ্ধার অভিব্যক্তি। এ অভিব্যক্তি পুনর্ব্যক্ত করে তাঁরা আবারও বললেন-

لقد لقيت يا زيد خيرا كثيرا

(হে যায়দ! আপনি প্রভূত কল্যাণ অর্জন করেছেন)।
তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল তাঁর কাছ থেকে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীছ শোনা। সে লক্ষ্যেই প্রথমে এ ভক্তিমূলক বক্তব্য পেশ করেন। প্রশংসা-প্রশস্তি ক্ষতিকারক না হওয়ার প্রবল ধারণা থাকলে সে ক্ষেত্রে এরূপ সম্মুখ-প্রশংসা দোষের নয়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও ব্যক্তিবিশেষের ক্ষেত্রে এরকম সম্মুখ- প্রশংসা অনেকবারই করেছেন। নিশ্চয়ই হযরত যায়দ ইবন আরকাম রাযি.-এর ঈমানী পরিপক্কতা এবং তাঁর জ্ঞান ও তত্ত্বজ্ঞানের গভীরতাদৃষ্টে সামনা-সামনি গুণকীর্তণ তাঁর ক্ষতি করবে না বলে তাদের প্রবল ধারণা ছিল। যাহোক এসব প্রাথমিক কথাবার্তার পর তারা তাদের মূল উদ্দেশ্য ব্যক্ত করলেন-

حدثنا يا زيد ما سمعت من رسول الله

(হে যায়দ! আপনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে যা শুনেছেন আমাদের কাছে তা বর্ণনা করুন)। এর দ্বারা হাদীছ শিক্ষার প্রতি তাদের গভীর আগ্রহ ফুটে ওঠে। সেইসঙ্গে তাদের এ সতর্কতাও অনুভব করা যায় যে, তারা হাদীছ শিক্ষার জন্য উপযুক্ত লোক বেছে নিয়েছেন। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । অনেক সময় লক্ষ করা যায় দীনী বিষয়ে জানার জন্য অর্থ ও সময় ব্যয় করে উপযুক্ত লোকের কাছে যাওয়ার চিন্তা করা হয় না। ধারেকাছে যাকে পাওয়া যায় তাকেই জিজ্ঞেস করা হয়, তার সে বিষয়ে ভালো জানা থাকুক বা না-ই থাকুক।

ইমাম মুহাম্মাদ ইবন সীরীন রহ. বলেন-

إِنَّ هَذَا الْعِلْمَ دِيْنٌ، فَانظُرُوا عَمَّنْ تَأْخُذُونَ دِينَكُمْ

‘এই ইলম দীনের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং লক্ষ করে দেখ তোমরা তোমাদের দীন কার নিকট থেকে গ্রহণ করছ।’

কোনও আলেমের নিকট দীন সম্পর্কে জানতে আগ্রহী কোনও ব্যক্তি হাজির হলে সে আলেমের কর্তব্য তার আগ্রহের মূল্যায়ন করা এবং আপন সামর্থ্য অনুযায়ী তার ইলমের পিপাসা নিবারণ করা। এটাই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা। সুতরাং হযরত যায়দ ইবন আরকাম রাযি. তাই করলেন। তিনি উপস্থিত শিক্ষার্থীদের হাদীছ শোনালেন । তবে তার আগে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দিয়ে নিলেন।

তাতে তিনি প্রথমে 'হে ভাতিজা' বলে স্নেহ-সম্বোধন করলেন, যা দ্বারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা অনুযায়ী তিনি শিক্ষার্থীর প্রতি নিজ স্নেহ-মমতা প্রকাশ করলেন। শিক্ষার্থীর প্রতি মমত্বপূর্ণ আচরণ করা আদর্শ শিক্ষকের এক অপরিহার্য গুণ।

তারপর তিনি নিজের বার্ধক্য এবং শিক্ষাকাল থেকে এ পর্যন্ত অনেক দীর্ঘ সময় গত হওয়ার উল্লেখপূর্বক স্পষ্ট করে দিলেন যে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে যা-কিছু শিখেছিলেন তার সবটা মনে নেই, কিছু কিছু ভুলে গেছেন। বয়স বেশি হলে মানুষের স্মরণশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

وَمِنْكُمْ مَنْ يُرَدُّ إِلَى أَرْذَلِ الْعُمُرِ لِكَيْ لَا يَعْلَمَ بَعْدَ عِلْمٍ شَيْئًا

‘তোমাদের মধ্যে কতক এমন হয়, যাদেরকে বয়সের সর্বাপেক্ষা অকর্মণ্য স্তরে পৌঁছানো হয়, যেখানে পৌঁছার পর তারা সবকিছু জানার পরও কিছুই জানে না।’১৮২

সুতরাং তাঁর যতটুকু মনে আছে কেবল ততটুকুই বলবেন, এর বেশি বলতে যেন তাকে পীড়াপীড়ি করা না হয়। এই ভূমিকার পর তিনি বিদায় হজ্জ থেকে প্রত্যাবর্তনকালে পবিত্র মক্কা ও মদীনার মাঝখানে ‘গাদীরে খুম’ নামক এক জলাশে তীরে প্রদত্ত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভাষণের অংশবিশেষ তাদের সামনে বর্ণনা করলেন। তাতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লা ইরশাদ করেছিলেন-
أَلا أَيُّهَا النَّاسُ، فَإِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ يُوشِكُ أَنْ يَأْتِيَ رسولُ ربِّي فَأُجيبَ
(হে লোক সকল! আমি একজন মানুষমাত্র। হয়তো অচিরেই আমার প্রতিপালকের দূত এসে যাবে এবং আমি তাঁর ডাকে সাড়া দেব)। 'আমি একজন মানুষ মাত্র' বলে তিনি তাঁর সম্পর্কে বাড়াবাড়িমূলক আকীদা-বিশ্বাস তৈরির ব্যাপারে সাবধান করেছেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একজন মরণশীল মানুষ হওয়া
অন্যান্য নবীদের সত্যতার প্রমাণস্বরূপ যেমন বিভিন্ন মু'জিযা ও অলৌকিক ঘটনাবলী প্রকাশ করা হয়েছিল, তেমনি আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে তাঁর সত্যতা সম্পর্কেও বহু নিদর্শন দেখানো হয়েছে। তাঁর শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন কুরআন মাজীদ। আল্লাহ তাআলার কালাম হওয়ায় কোনও মানুষের পক্ষে কুরআন মাজীদের সর্বপ্রকার ছোট সূরার মত একটি সূরাও তৈরি করা সম্ভব নয়। তাছাড়া তাঁর আঙ্গুলের ফাঁক থেকে পানির ফোয়ারা ছুটেছে, সামান্য এক পেয়ালা দুধে বহু লোকের ক্ষুধা মিটেছে, তাঁর আঙ্গুলের ইশারায় চাঁদ দু'টুকরো হয়েছে, রাতের সামান্য সময়ের মধ্যে পবিত্র মক্কা থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস এবং সেখান থেকে সপ্তাকাশ সফর করে এসেছেন, ক্ষুধার্ত উট তাঁর কাছে এসে মালিকের বিরুদ্ধে নালিশ জানিয়েছে, এ জাতীয় আরও বহু মু'জিযা দেখে কারও দ্বারা তাঁর সম্পর্কে এ বিশ্বাস তৈরির আশঙ্কা ছিল যে, তিনি মানুষ নন; বরং আল্লাহর অবতার বা তাঁর ক্ষমতাসম্পন্ন কোনও সত্তা (না'ঊযু বিল্লাহি মিন যালিক), যেমন এক শ্রেণীর লোক এ কালে বলছে যে, তিনি আল্লাহর নূরের সৃষ্টি। এ জাতীয় ভ্রান্ত আকীদা প্রতিরোধকল্পে তাঁর পক্ষ থেকে স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে যে, আমি তো একজন মানুষই। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ يُوحَى إِلَيَّ أَنَّمَا إِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ

‘বলে দাও, আমি তো তোমাদের মত একজন মানুষই। (তবে) আমার প্রতি এই ওহী আসে যে, তোমাদের মাবুদ কেবল একই মাবুদ।'১৮৩
অর্থাৎ মানুষ হওয়ার ব্যাপারে তোমাদের সঙ্গে আমার পার্থক্য নেই। তবে হাঁ, আমি যেহেতু একজন নবী বরং শ্রেষ্ঠতম ও সর্বশেষ নবী এবং আমার প্রতি ওহী নাযিল হয়, তাই নবুওয়াতের অপরিহার্য গুণাবলী আমার মধ্যে বিদ্যমান আছে। যেমন গুনাহ না করা, সর্বোচ্চ পর্যায়ের আখলাক-চরিত্রের অধিকারী হওয়া, নিখুঁত জ্ঞানবুদ্ধি থাকা, সাহসিকতা ও আল্লাহনির্ভরতার সর্বোচ্চ শিখরে অধিষ্ঠিত থাকা ইত্যাদি।

মানুষ মাত্রই মরণশীল। তিনি যখন একজন মানুষ তখন স্বাভাবিকভাবেই একদিন তাঁরও মৃত্যু হবে। তাঁর আগেও যত নবী-রাসূল এসেছিলেন তাদের মৃত্যু হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَمَا مُحَمَّدٌ إِلَّا رَسُولٌ قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهِ الرُّسُلُ

'আর মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) একজন রাসূল বৈ তো নন। তাঁর পূর্বে বহু রাসূল গত হয়েছে ।১৮৪

অন্যত্র ইরশাদ-

إِنَّكَ مَيِّتٌ وَإِنَّهُمْ مَيِّتُونَ

(হে রাসূল!) নিশ্চয় তুমি মরণশীল এবং তারাও অবশ্যই মরণশীল।১৮৫

সুতরাং সৃষ্টি সম্পর্কে আল্লাহ তাআলার এ চিরন্তন বিধান অনুযায়ী একদিন তাঁরও মৃত্যু হবে। সে কথাই তিনি স্পষ্ট করে দেন যে, অচিরেই আমার প্রতিপালকের দূত মালাকুল মাওত এসে যাবে। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে আমি তোমাদের নিকট থেকে বিদায় নিয়ে কবরের জগতে চলে যাব।

কুরআন মাজীদ আঁকড়ে ধরে রাখার তাগিদ
তাঁর এ ঘোষণায় শ্রোতামণ্ডলীর অন্তরে ভয় জাগার কথা যে, তিনি যতদিন জীবিত আছেন মানুষকে হিদায়াতের পথ দেখাচ্ছেন। তাঁর দ্বারা যে-কোনও জটিলতার সমাধান হয়ে যাচ্ছে। তিনি চলে যাওয়ার পর কে তাদের পথ দেখাবে? আপতিত সমস্যার সমাধান তখন কিভাবে নেওয়া যাবে? তিনি এ ভয় ও শঙ্কার নিরসনকল্পে ইরশাদ করেন-
انا تارك فيكم ثقلين (আমি তোমাদের মধ্যে দু'টি ভার রেখে যাচ্ছি)। ভার মানে মর্যাদাবান ও গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। আরবীতে যে-কোনও মূল্যবান ও মর্যাদাপূর্ণ বস্তু ও বিষয়কে ثقل (ভার) বলে। বাংলায়ও বলা হয়, ওজনদার কথা বা ওজনদার লোক। অর্থাৎ গুরুত্বপূর্ণ কথা ও মর্যাদাবান লোক। এ হাদীছে যে দু'টি বিষয় রেখে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে, অত্যন্ত মর্যাদাবান হওয়ায় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে দু'টোকে ثقل শব্দে ব্যক্ত করেছেন। কী সে দু'টো বিষয়? সামনে তিনি এর ব্যাখ্যা করছেন-
أَوَّلهُما كِتابُ اللَّهِ، فِيهِ الهُدى وَالنُّورُ (তার প্রথমটি হচ্ছে আল্লাহর কিতাব। তাতে আছে হিদায়াত ও আলো)। অর্থাৎ প্রথমটি হচ্ছে কুরআন মাজীদ। তাতে কিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত মানুষের জন্য হিদায়াত ও পথনির্দেশ আছে। তাতে আছে পথচলার আলো। আমি দুনিয়া থেকে চলে যাওয়ার পরও এ হিদায়াত ও আলো তোমাদের মধ্যে থাকবে। কিয়ামত পর্যন্ত তা সুরক্ষিত থাকার নিশ্চয়তা আছে। কেউ তা বিকৃত করতে পারবে না। তোমাদের দোজাহানের মুক্তি ও সফলতার লক্ষ্যে অনুসরণীয় সবকিছুই এতে বিদ্যমান আছে। যে-কোনও পরিস্থিতিতেই এ কিতাব তোমাদের পথ দেখাবে। যত জটিল সমস্যাই হোক না কেন, এর আলোকে তোমরা তার সমাধান করতে পারবে। এর অনুসরণ করলে তোমাদের পথ হারানোর কোনও ভয় নেই। কোনও জটিলতার আবর্তে পড়ে থাকার কোনও আশঙ্কা নেই। যেমন অপর এক বর্ণনায় আছে-

وَهُو حبْلُ اللَّه، منِ اتَّبَعه كَانَ عَلَى الهُدى، ومَنْ تَرَكَهُ كانَ عَلَى ضَلالَةٍ

(আর তা হচ্ছে আল্লাহর রশি। যে ব্যক্তি তার অনুসরণ করবে সে হিদায়াতের উপর থাকবে। আর যে তা পরিত্যাগ করবে সে পথভ্রষ্ট হবে)। সুতরাং তোমাদের কাজ কেবল সর্বাবস্থায় এ কিতাব আঁকড়ে ধরে থাকা।
অতঃপর তিনি কুরআন মাজীদ আঁকড়ে ধরে রাখার প্রতি উৎসাহ দান করেন। কোনও অবস্থায়ই তা থেকে বিচ্যুত না হওয়ার তাগিদ দেন। প্রকাশ থাকে যে, কুরআন আঁকড়ে ধরার জন্য হাদীছের অনুসরণ অপরিহার্য। কুরআনের সঙ্গে হাদীছের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। কাজেই কুরআনের পাশাপাশি হাদীছকেও আঁকড়ে ধরতে হবে। বিদায় হজ্জেরই অপর এক ভাষণে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

تَرَكْتُ فِيْكُمْ أَمْرَيْنِ، لَنْ تَضِلُّوْا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا: كِتَابَ اللَّهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ

‘আমি তোমাদের মধ্যে দুটি বস্তু রেখে যাচ্ছি। যতক্ষণ তোমরা তা আঁকড়ে ধরে রাখবে, কস্মিনকালেও পথভ্রষ্ট হবে না –আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নত।১৮৬

তারপর দ্বিতীয় বিষয়টি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন-

وأَهْلُ بَيْتِي، أُذكِّركم اللَّه في أهلِ بيْتي، أذكِّرُكم اللَّه في أهل بيتي

(আমার আহলে বায়ত। আমি তোমাদেরকে আমার আহলে বায়তের ব্যাপারে আল্লাহকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। আমি তোমাদেরকে আমার আহলে বায়তের ব্যাপারে আল্লাহকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি)। অর্থাৎ দ্বিতীয় যে মর্যাদাপূর্ণ বিষয় তোমাদের মধ্যে রেখে যাচ্ছি তা হচ্ছে আমার আহলে বায়ত। সাবধান! তোমরা তাদের মর্যাদা রক্ষা করো। কিছুতেই তাদের অমর্যাদা করো না।

হযরত যায়দ ইবন আরকাম রাযি, যখন হাদীছটি বর্ণনা করা শেষ করলেন, তখন হুসায়ন ইবন সাবরা রহ. তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীগণ তাঁর আহলে বায়ত কি না। তিনি স্বীকার করলেন যে, তারাও আহলে বায়ত। তবে তিনি আরও বৃহত্তর অর্থে আহলে বায়তের ব্যাখ্যা দিলেন। বললেন- তবে (সাধারণভাবে) আহলে বায়ত বলতে তাদেরকে বোঝানো হয়, যাদের জন্য সদাকা (খাওয়া) হারাম করা হয়েছে। আর তারা হচ্ছেন- আলীর বংশধরগণ, আকীলের বংশধরগণ, জাফরের বংশধরগণ এবং আব্বাসের বংশধরগণ। পরিভাষায় তাদেরকে সায়্যিদ বলা হয়। তাদের জন্য সদাকা অর্থাৎ যাকাত, ফিতরা, মানত ইত্যাদি খাওয়া জায়েয নয়। আরও বৃহত্তর পরিসরে বনূ হাশিমের জন্যও সদাকা যাকাত খাওয়া খারাম।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

এ হাদীছটির মধ্যে আমাদের জন্য বহু শিক্ষা রয়েছে। যেমন-
ক. মুসলিম উম্মাহ'র মধ্যে আহলে বায়তের বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। তাদের সে মর্যাদা রক্ষা করা সকলের অবশ্যকর্তব্য।

খ. কুরআন মাজীদ আল্লাহর কিতাব, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিজের রচনা নয়।

গ. যে ব্যক্তি কুরআন মাজীদ শক্ত করে ধরে রাখবে, সে হিদায়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে, পথভ্রষ্টতার শিকার হবে না।

ঘ. কুরআনই আলো। সর্বপ্রকার অন্ধকার ও পাশববৃত্তি থেকে মুক্ত আলোকিত জীবন গড়ার একমাত্র উপায় কুরআনের অনুসরণ।

ঙ. বক্তব্য ও ভাষণ দেওয়ার আগে আল্লাহ তাআলার হাম্দ ও ছানা পড়ে নেওয়া চাই।

চ. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীগণ আহলে বায়তের অন্তর্ভুক্ত। তাঁরা আমাদের মা। তাঁদের প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা-ভক্তি বজায় রাখতে হবে।

ছ. আহলে বায়ত ও বনূ হাশিমের জন্য যাকাত-সদাকা ভোগ করা হারাম।

জ. দীনী ইলম শেখার জন্য গভীর জ্ঞানসম্পন্ন মুত্তাকী-পরহেযগার উস্তায বেছে নেওয়া চাই।

ঝ. দীনী ইলম অর্জনের জন্য উস্তাযের কাছে যাওয়া চাই। এ মহামূল্যবান সম্পদ ঘরে বসে অর্জন করা যায় না।

ঞ. শিক্ষার্থীকে অবশ্যই উস্তাযের আদব-সম্মান বজায় রাখতে হবে।

ট. তালিবে ইলম ও শিক্ষার্থীর প্রতি মমতাশীল থাকা দীনী ইলমের উস্তাযের একটি অপরিহার্য গুণ ।

ঠ. বৃদ্ধকালে স্মরণশক্তি দুর্বল হয়ে যায়। তাই এ বয়সে মুখস্থ বিষয় বর্ণনা করার ব্যাপারে অত্যধিক সতর্কতা জরুরি।

ড. যে বিষয় পুরোপুরি স্মরণ নেই তা কিছুতেই বর্ণনা করা উচিত নয়।

১৮০. সূরা মুনাফিকূন (৬৩), আয়াত ১-২ এবং ৭-৮

১৮১. ইবন হিশাম, আস্ সীরাতুন নাবাবিয়্যাহ, গাযওয়া বনুল মুস্তালিক দ্র.।

১৮২. সূরা নাহল (১৬), আয়াত ৭০

১৮৩. সূরা কাহফ (১৮), আয়াত ১১০

১৮৪. সূরা আলে ইমরান (৩), আয়াত ১৪৪

১৮৫. সূরা যুমার (৩৯), আয়াত ৩০

১৮৬. মুআত্তা মালিক, হাদীছ নং ৬৭৮
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)
রিয়াযুস সালিহীন - হাদীস নং ৩৪৬ | মুসলিম বাংলা