রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ৩৪২
পিতা-মাতার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, স্ত্রী ও অন্য যে সকল লোককে সম্মান করা কাম্য তাদের প্রতি সদাচরণের ফযীলত
পিতার বন্ধুবর্গের প্রতি সৌজন্য প্রদর্শন
হাদীছ নং : ৩৪২

আব্দুল্লাহ ইবন দীনার রহ. হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. থেকে বর্ণনা করেন যে, জনৈক বেদুঈন মক্কার পথে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করল। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর তাকে সালাম দিলেন এবং একটি গাধার পিঠে তাকে তুলে নিলেন, যে গাধাটিতে তিনি নিজে চড়তেন। তার মাথায় যে পাগড়িটি ছিল সেটিও তাকে দিয়ে দিলেন। আব্দুল্লাহ ইবন দীনার বলেন, আমরা তাকে বললাম, আল্লাহ তা'আলা আপনার কল্যা করুন। এরা তো বেদুঈন। সামান্যতেই খুশি হয়ে যায়। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর বললেন, এই ব্যক্তির পিতা উমর ইবনুল খাত্তাব রাযি.-এর বন্ধু ছিল। আর আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি নেককাজ সমূহের মধ্যে একটি বড় নেককাজ হলো, কোনও ব্যক্তির তার পিতার বন্ধুদের সঙ্গে সদাচরণ করা।
অপর এক বর্ণনায় আছে, আব্দুল্লাহ ইবন দীনার রহ. হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. সম্পর্কে বর্ণনা করেন যে, তার একটি গাধা ছিল। তিনি যখন মক্কা মুকাররামার উদ্দেশে বের হতেন আর উটের পিঠে চড়তে চড়তে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়তেন, তখন আরাম পাওয়ার জন্য ওই গাধার পিঠে সওয়ার হতেন। তিনি মাথায় পাগড়িও বেঁধে নিতেন। তো একদিনকার কথা। তিনি অভ্যাসমত গাধাটির উপর সওয়ার আছেন, এ অবস্থায় এক বেদুঈন তাঁর পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। তিনি বললেন, তুমি কি অমুকের পুত্র অমুক নও? সে বলল, হাঁ। তখন তিনি সেই গাধাটি তাকে দিয়ে দিলেন এবং বললেন, তুমি এতে চড়। তিনি পাগড়িটিও তাকে দিয়ে দিলেন এবং বললেন, এটি তোমার মাথায় বাঁধ। তাঁকে তাঁর কোনও এক সঙ্গী বলল, আল্লাহ তাআলা আপনার মাগফিরাত করুন। আপনি এ বেদুঈনকে গাধাটি দিয়ে দিলেন, অথচ এতে চড়ে আপনি আরাম বোধ করতেন। আবার যে পাগড়িটি নিজের মাথায় বাঁধতেন সেটিও তাকে দিয়ে দিলেন। তখন তিনি বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, নেককাজসমূহের মধ্যে একটি বড় নেককাজ হলো কোনও ব্যক্তির তার পিতার মৃত্যুর পর তার বন্ধুদের সঙ্গে সদাচরণ করা। এই ব্যক্তির পিতা উমর রাযি. এর বন্ধু ছিল -মুসলিম।সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৫৫২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৫৬৫৩; বায়হাকী, আসসুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৭৭৬৮; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৭৫১৮
42 - باب فضل بر أصدقاء الأب والأم والأقارب والزوجة وسائر من يندب إكرامه
342 - وعن عبد الله بن دينار، عن عبد الله بن عمر رضي الله عنهما: أنَّ رَجُلًا مِنَ الأعْرَابِ لَقِيَهُ بطَريق مَكَّةَ، فَسَلَّمَ عَلَيهِ عبدُ الله بْنُ عُمَرَ، وَحَمَلَهُ عَلَى حِمَارٍ كَانَ يَرْكَبُهُ، وَأَعْطَاهُ عِمَامَةً كَانَتْ عَلَى رَأسِهِ، قَالَ ابنُ دِينَار: فَقُلْنَا لَهُ: أَصْلَحَكَ اللهُ، إنَّهُمُ الأَعرَابُ وَهُمْ يَرْضَوْنَ باليَسِير، فَقَالَ عبد الله بن عمر: إنَّ أَبَا هَذَا كَانَ وُدًّا لِعُمَرَ بنِ الخطاب - رضي الله عنه - وإنِّي سَمِعتُ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - يقول: «إنَّ أبرَّ البِرِّ صِلَةُ الرَّجُلِ أَهْلَ وُدِّ أَبِيهِ». (1)

وفي رواية عن ابن دينار، عن ابن عمر: أنَّهُ كَانَ إِذَا خَرَجَ إِلَى مَكّةَ كَانَ لَهُ حِمَارٌ يَتَرَوَّحُ عَلَيهِ إِذَا مَلَّ رُكُوبَ الرَّاحِلةِ، وَعِمَامَةٌ يَشُدُّ بِهَا رَأسَهُ، فَبيْنَا هُوَ يَومًا عَلَى ذلِكَ الحِمَارِ إِذْ مَرَّ بِهِ أعْرابيٌّ، فَقَالَ: ألَسْتَ فُلاَنَ بْنَ فُلاَن؟ قَالَ: بَلَى. فَأَعْطَاهُ الحِمَارَ، فَقَالَ: ارْكَبْ هَذَا، وَأَعْطَاهُ العِمَامَةَ وَقالَ: اشْدُدْ بِهَا رَأسَكَ، فَقَالَ لَهُ بعضُ أصْحَابِهِ: غَفَرَ الله لَكَ أعْطَيْتَ هَذَا الأعْرَابيَّ حِمَارًا كُنْتَ تَرَوَّحُ عَلَيهِ، وعِمَامةً كُنْتَ تَشُدُّ بِهَا رَأسَكَ؟ فَقَالَ: إنِّي سَمِعتُ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - يَقُولُ: «إنَّ مِنْ أَبَرِّ البِرِّ أَنْ يَصِلَ الرَّجُلُ أهْلَ وُدِّ أبيهِ بَعْدَ أَنْ يُولِّيَ» وَإنَّ أبَاهُ كَانَ صَديقًا لعُمَرَ - رضي الله عنه.
رَوَى هذِهِ الرواياتِ كُلَّهَا مسلم.

হাদীসের ব্যাখ্যা:

হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি.-এর একটি ঘটনা
আব্দুল্লাহ ইবন দীনার রহ. হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. থেকে এ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। তিনি হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি.-এর মাওলা (আযাদকৃত গোলাম)। একবার তিনি হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি.-এর সঙ্গে মদীনা মুনাউওয়ারা থেকে মক্কা মুকাররামায় যাচ্ছিলেন। পথে জনৈক বেদুঈনের সঙ্গে দেখা হলে হযরত ইবন উমর রাযি. তার নাম-পরিচয় জিজ্ঞেস করলেন। তাতে জানা গেল সে বেদুঈন তাঁর পিতা হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাযি.-এর একজন বন্ধুস্থানীয় লোক। তখন তিনি নিজের কাছে থাকা অতিরিক্ত গাধাটি তাকে দিয়ে দিলেন। সফরকালে এ গাধাটি তিনি নিজের সঙ্গে রাখতেন। উটনীর পিঠে চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে তিনি কিছুক্ষণের জন্য ওই গাধাটি ব্যবহার করতেন। তারপর ক্লান্তি দূর হওয়ার পর ফের উটনীর পিঠে সওয়ার হতেন। এরকম প্রয়োজনীয় বাহনটি তো তাকে দিলেনই, সেইসঙ্গে নিজের ব্যবহার করা একটা পাগড়িও তাকে দিলেন ।

বেদুঈনকে এরূপ খাতির করতে দেখে আব্দুল্লাহ ইবন দীনার রহ.-এর আশ্চর্য বোধ হলো। তিনি বলেই ফেললেন যে, সামান্য কিছু পেলেই যারা খুশি হয়ে যায় তাদেরকে এমন দামী বস্তু দেওয়া কেন? এ কথা বলার আগে তিনি তাঁর জন্য দুআ করে নিলেন যে- اصلحك الله (আল্লাহ তাআলা আপনার কল্যাণ করুন) এবং غفر الله لك (আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন)। এটা এক সময়কার দীনদারদের মধ্যে ব্যবহৃত সম্বোধনের ভাষা। নিজের চেয়ে বড় ও সম্মানিত ব্যক্তিকে বিশেষ কোনও বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণকালে এরকম দুআ করা হতো। এর দ্বারা তার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের পাশাপাশি তার যদি কোনও ভুলও হয়ে থাকে, সেজন্য আল্লাহ তাআলার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা হয়। এর জন্য যে কাজের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় সেটি ভুল হওয়া জরুরি নয়। সেটি ভুল না হলেও মানুষের জীবনে কোনও না কোনও ভুলত্রুটি ও গুনাহখাতা থাকেই । কাজেই এরকম দুআ যে-কারও জন্যই করা যায়।

যাহোক আব্দুল্লাহ ইবন দীনার রহ. বিস্ময় প্রকাশ করলে হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. বললেন, এই ব্যক্তির পিতা আমার পিতা হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাযি.-এর বন্ধু ছিলেন। আর আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি— إنَّ مِنْ أبرِّ البرِّ أنْ يَصِلَ الرّجلُ أهلَ وُدِّ أبِيه بَعْدَ أَنْ يُوَلِّيَ (নেককাজসমূহের মধ্যে একটি বড় নেককাজ হলো কোনও ব্যক্তির তার পিতার মৃত্যুর পর তার বন্ধুদের সঙ্গে সদাচরণ করা)। হাদীছটির অর্থ এরকমও করা যায় যে, পিতার প্রতি একটি উৎকৃষ্ট সদাচরণ এইও যে, তার মৃত্যুর পর তার বন্ধুদের প্রতি সদাচরণ করা হবে। অর্থাৎ বন্ধুদের প্রতি সদাচরণ প্রকারান্তরে পিতার প্রতিই সদাচরণ। কেননা এর দ্বারা বন্ধুবর্গের মধ্যে পিতার ইজ্জত-সম্মান রক্ষা পায়। হযরত ইবন উমর রাযি. বোঝাচ্ছেন যে, আমি এ অনুসরণার্থেই এই ব্যক্তির প্রতি এরকম আচরণ করেছি।

লক্ষণীয়, ওই ব্যক্তি ছিল বেদুঈন, আমাদের অঞ্চলে যেমন কোনও গ্রাম্য ব্যক্তি। সামাজিকভাবে শহুরে ব্যক্তিদের মত তাদেরকে বিশেষ গুরুত্বের দৃষ্টিতে দেখা হয় না । কিন্তু হযরত ইবন উমর রাযি. তাকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখলেন না। কেননা এ জাতীয় সামাজিক বিভাজন ইসলামসম্মত নয়। তিনি তাকে দেখেছেন পিতার বন্ধুরূপে। বন্ধু শহুরে হোক বা গ্রামের হোক, বন্ধুত্বের মর্যাদা তার প্রাপ্য। অনুরূপ যে-কোনও ধরনের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সম্পর্কটাই লক্ষণীয়। বাসস্থান, পেশা ইত্যাদি বিবেচ্য নয়।

উল্লেখ্য, এ হাদীছে পিতার মৃত্যুর পর তার বন্ধুদের সঙ্গে সদাচরণ করার কথা বলা হলেও তার জীবদ্দশায়ও এটা সমান জরুরি। বিশেষভাবে মৃত্যুর কথা উল্লেখ করার কারণ এটা তার জীবিতাবস্থায় সদাচরণ করার একটা বিকল্পও বটে। পিতা যেহেতু জীবিত নেই, এখন কিভাবে তার সেবাযত্ন করা যাবে? তাই যেন একটা বিকল্প উপায় বলে দেওয়া হলো যে, তার বন্ধুদের সেবাযত্ন কর। প্রকারান্তরে এটা তারই সেবাযত্ন বলে গণ্য হবে। তবে এর মানে এই নয় যে, পিতার জীবদ্দশায় তাদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। এর সঙ্গে যেহেতু পিতার মান-সম্মানও জড়িত, তাই তার জীবদ্দশায়ও তাদের প্রতি সম্মান দেখানো চাই। একই কথা মায়ের সখী বান্ধবীদের বেলায়ও প্রযোজ্য।

হাদীছ থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. পিতার মৃত্যুর পর তার বন্ধু-বান্ধবদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়। তাদের খেদমত করাকে পিতৃসেবার বিকল্পরূপে গ্রহণ করা উচিত।

খ. পিতার জীবদ্দশায়ও তার বন্ধু-বান্ধবদের সম্মান করা উচিত। তাতে পিতার মানসম্মান রক্ষা হয়।

গ. পিতার বন্ধু-বান্ধবদের প্রতি যা করণীয়, মায়ের সখী বান্ধবীদের বেলায়ও তা প্রযোজ্য।

ঘ. পিতা-মাতার সাথে যাদের সম্পর্ক, তারা কোথাকার বাসিন্দা বা কোন্ পেশার লোক তা বিবেচ্য নয়; সম্পর্কটাকেই মূল্যায়ন করা চাই।

ঙ. শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির কোনও ত্রুটি-বিচ্যুতির প্রতি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করার সময় প্রথমে কথা ও কাজে তার প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি প্রদর্শন করা চাই।

চ. মাগফিরাতের দুআ জীবিত ও মৃত এবং বড় ও ছোট যে-কারও জন্যই এবং পেছনে ও সামনাসামনি যে-কোনও অবস্থায়ই করা যায়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)
রিয়াযুস সালিহীন - হাদীস নং ৩৪২ | মুসলিম বাংলা