রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ৩৪১
অধ্যায়: ৪২

পিতা-মাতার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, স্ত্রী ও অন্য যেসকল লোককে সম্মান করা কাম্য তাদের প্রতি সদাচরণের ফযীলত

ইসলামে ভদ্রতা ও সৌজন্যমূলক আচরণের পরিধি অনেক ব্যাপক। এক হচ্ছে সাধারণ ভদ্রতা, যা মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সকলের ক্ষেত্রেই রক্ষা করা বাঞ্ছনীয়। আরেক হচ্ছে বিশেষ ভদ্রতা। এর বিভিন্ন স্তর আছে। যেমন, যারা মুসলিম, ঈমান ও ইসলামের সুবাদে অমুসলিম অপেক্ষা তারা সৌজন্যমূলক আচরণের অধিকতর হকদার। মুসলমানদের মধ্যেও যারা আত্মীয় বা প্রতিবেশী, তারা অন্যদের তুলনায় বেশি সদাচরণ পাওয়ার উপযুক্ত। আবার তাদের মধ্যেও নিকটাত্মীয় ও নিকট প্রতিবেশীর অধিকার অন্যদের তুলনায় বেশি। আত্মীয়বর্গের মধ্যে রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়দের মর্যাদা সবার উপরে। পিতা-মাতার স্বতন্ত্র হক ও মর্যাদা তো আছেই।
পিতা-মাতার অধিকার সরাসরি তাদের পিতৃত্ব ও মাতৃত্বের সুবাদে। আত্মীয় স্বজনের অধিকারও সরাসরি আত্মীয়তাসূত্রে নির্ধারিত। ইসলাম পিতা-মাতা ও আত্মীয়বর্গের যারা বন্ধুবান্ধব তাদেরও একরকম হক সাব্যস্ত করেছে। তাদের এ হক নির্ধারিত হয়েছে পিতা-মাতা ও আত্মীয়বর্গের সম্মানার্থে। কাজেই আদর্শ সন্তানের কর্তব্য পিতা-মাতার জীবদ্দশায় এবং তাদের মৃত্যুর পরও তাদের বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করে চলা। একই কথা আত্মীয়স্বজনের বন্ধু-বান্ধবের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আত্মীয়তার মর্যাদা রক্ষার খাতিরে প্রত্যেকের কর্তব্য তার আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যাদের বন্ধুত্ব আছে তাদের প্রতিও বিশেষ সৌজন্য প্রদর্শন করা।
এমনিভাবে স্বামী-স্ত্রীর বেলায়ও এ নীতি প্রযোজ্য। স্বামীর কর্তব্য স্ত্রীর সম্মানার্থে তার বান্ধবীদেরও সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া। অনুরূপ স্ত্রীরও কর্তব্য স্বামীর মর্যাদা রক্ষার্থে তার বন্ধুবান্ধবের মর্যাদা দেওয়া।
অনুরূপ যে-কোনও সম্মানী ব্যক্তি যেমন উস্‌তায, শায়খ, জনপ্রতিনিধি, ইমাম, শাসক প্রমুখের যথাযথ সম্মান রক্ষার পাশাপাশি তাদের সঙ্গে যারা সম্পর্ক রাখে, তাদের প্রতিও স্বতন্ত্র শিষ্টাচার প্রদর্শন করা। এ সবই মহান ইসলামের সর্বব্যাপী শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত। এ বিষয়ে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের জন্য যে শিক্ষা রেখে গেছেন, সে সম্পর্কিত কিছু হাদীছ তুলে ধরাই বর্তমান অধ্যায়ের লক্ষ্য। আমরা এ অধ্যায়ে উদ্ধৃত সেসব হাদীছের বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন।
পিতার বন্ধুবর্গের প্রতি সৌজন্য প্রদর্শন
হাদীছ নং : ৩৪১

হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, নেককাজ সমূহের মধ্যে একটি বড় নেককাজ হলো কোনও ব্যক্তির তার পিতার বন্ধুদের সঙ্গে সদাচরণ করা -মুসলিম।
সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৫৫২; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৯০৩; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৫১৪৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৫৬১২; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ৪৩০; তাবারানী, আল-মু'জামুল আওসাত, হাদীছ নং ৭৫০১; বায়হাকী, আসসুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৭৭৬৮; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৭৫১৫; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ৩৪৪৫
42 - باب فضل بر أصدقاء الأب والأم والأقارب والزوجة وسائر من يندب إكرامه
341 - عن ابن عمر رضي الله عنهما: أن النَّبيّ - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «إنّ أَبَرَّ البرِّ أَنْ يَصِلَ الرَّجُلُ وُدَّ أَبيهِ». (1)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

উপরে উদ্ধৃত একটি প্রেক্ষাপট আছে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. যে প্রেক্ষাপটে হাদীছটি বর্ণনা করেছিলেন সেই প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হলো।


হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি.-এর একটি ঘটনা
আব্দুল্লাহ ইবন দীনার রহ. হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. থেকে এ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। তিনি হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি.-এর মাওলা (আযাদকৃত গোলাম)। একবার তিনি হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি.-এর সঙ্গে মদীনা মুনাউওয়ারা থেকে মক্কা মুকাররামায় যাচ্ছিলেন। পথে জনৈক বেদুঈনের সঙ্গে দেখা হলে হযরত ইবন উমর রাযি. তার নাম-পরিচয় জিজ্ঞেস করলেন। তাতে জানা গেল সে বেদুঈন তাঁর পিতা হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাযি.-এর একজন বন্ধুস্থানীয় লোক। তখন তিনি নিজের কাছে থাকা অতিরিক্ত গাধাটি তাকে দিয়ে দিলেন। সফরকালে এ গাধাটি তিনি নিজের সঙ্গে রাখতেন। উটনীর পিঠে চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে তিনি কিছুক্ষণের জন্য ওই গাধাটি ব্যবহার করতেন। তারপর ক্লান্তি দূর হওয়ার পর ফের উটনীর পিঠে সওয়ার হতেন। এরকম প্রয়োজনীয় বাহনটি তো তাকে দিলেনই, সেইসঙ্গে নিজের ব্যবহার করা একটা পাগড়িও তাকে দিলেন ।

বেদুঈনকে এরূপ খাতির করতে দেখে আব্দুল্লাহ ইবন দীনার রহ.-এর আশ্চর্য বোধ হলো। তিনি বলেই ফেললেন যে, সামান্য কিছু পেলেই যারা খুশি হয়ে যায় তাদেরকে এমন দামী বস্তু দেওয়া কেন? এ কথা বলার আগে তিনি তাঁর জন্য দুআ করে নিলেন যে- اصلحك الله (আল্লাহ তাআলা আপনার কল্যাণ করুন) এবং غفر الله لك (আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন)। এটা এক সময়কার দীনদারদের মধ্যে ব্যবহৃত সম্বোধনের ভাষা। নিজের চেয়ে বড় ও সম্মানিত ব্যক্তিকে বিশেষ কোনও বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণকালে এরকম দুআ করা হতো। এর দ্বারা তার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের পাশাপাশি তার যদি কোনও ভুলও হয়ে থাকে, সেজন্য আল্লাহ তাআলার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা হয়। এর জন্য যে কাজের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় সেটি ভুল হওয়া জরুরি নয়। সেটি ভুল না হলেও মানুষের জীবনে কোনও না কোনও ভুলত্রুটি ও গুনাহখাতা থাকেই । কাজেই এরকম দুআ যে-কারও জন্যই করা যায়।

যাহোক আব্দুল্লাহ ইবন দীনার রহ. বিস্ময় প্রকাশ করলে হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. বললেন, এই ব্যক্তির পিতা আমার পিতা হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাযি.-এর বন্ধু ছিলেন। আর আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি— إنَّ مِنْ أبرِّ البرِّ أنْ يَصِلَ الرّجلُ أهلَ وُدِّ أبِيه بَعْدَ أَنْ يُوَلِّيَ (নেককাজসমূহের মধ্যে একটি বড় নেককাজ হলো কোনও ব্যক্তির তার পিতার মৃত্যুর পর তার বন্ধুদের সঙ্গে সদাচরণ করা)। হাদীছটির অর্থ এরকমও করা যায় যে, পিতার প্রতি একটি উৎকৃষ্ট সদাচরণ এইও যে, তার মৃত্যুর পর তার বন্ধুদের প্রতি সদাচরণ করা হবে। অর্থাৎ বন্ধুদের প্রতি সদাচরণ প্রকারান্তরে পিতার প্রতিই সদাচরণ। কেননা এর দ্বারা বন্ধুবর্গের মধ্যে পিতার ইজ্জত-সম্মান রক্ষা পায়। হযরত ইবন উমর রাযি. বোঝাচ্ছেন যে, আমি এ অনুসরণার্থেই এই ব্যক্তির প্রতি এরকম আচরণ করেছি।

লক্ষণীয়, ওই ব্যক্তি ছিল বেদুঈন, আমাদের অঞ্চলে যেমন কোনও গ্রাম্য ব্যক্তি। সামাজিকভাবে শহুরে ব্যক্তিদের মত তাদেরকে বিশেষ গুরুত্বের দৃষ্টিতে দেখা হয় না । কিন্তু হযরত ইবন উমর রাযি. তাকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখলেন না। কেননা এ জাতীয় সামাজিক বিভাজন ইসলামসম্মত নয়। তিনি তাকে দেখেছেন পিতার বন্ধুরূপে। বন্ধু শহুরে হোক বা গ্রামের হোক, বন্ধুত্বের মর্যাদা তার প্রাপ্য। অনুরূপ যে-কোনও ধরনের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সম্পর্কটাই লক্ষণীয়। বাসস্থান, পেশা ইত্যাদি বিবেচ্য নয়।

উল্লেখ্য, এ হাদীছে পিতার মৃত্যুর পর তার বন্ধুদের সঙ্গে সদাচরণ করার কথা বলা হলেও তার জীবদ্দশায়ও এটা সমান জরুরি। বিশেষভাবে মৃত্যুর কথা উল্লেখ করার কারণ এটা তার জীবিতাবস্থায় সদাচরণ করার একটা বিকল্পও বটে। পিতা যেহেতু জীবিত নেই, এখন কিভাবে তার সেবাযত্ন করা যাবে? তাই যেন একটা বিকল্প উপায় বলে দেওয়া হলো যে, তার বন্ধুদের সেবাযত্ন কর। প্রকারান্তরে এটা তারই সেবাযত্ন বলে গণ্য হবে। তবে এর মানে এই নয় যে, পিতার জীবদ্দশায় তাদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। এর সঙ্গে যেহেতু পিতার মান-সম্মানও জড়িত, তাই তার জীবদ্দশায়ও তাদের প্রতি সম্মান দেখানো চাই। একই কথা মায়ের সখী বান্ধবীদের বেলায়ও প্রযোজ্য।

হাদীছ থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. পিতার মৃত্যুর পর তার বন্ধু-বান্ধবদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়। তাদের খেদমত করাকে পিতৃসেবার বিকল্পরূপে গ্রহণ করা উচিত।

খ. পিতার জীবদ্দশায়ও তার বন্ধু-বান্ধবদের সম্মান করা উচিত। তাতে পিতার মানসম্মান রক্ষা হয়।

গ. পিতার বন্ধু-বান্ধবদের প্রতি যা করণীয়, মায়ের সখী বান্ধবীদের বেলায়ও তা প্রযোজ্য।

ঘ. পিতা-মাতার সাথে যাদের সম্পর্ক, তারা কোথাকার বাসিন্দা বা কোন্ পেশার লোক তা বিবেচ্য নয়; সম্পর্কটাকেই মূল্যায়ন করা চাই।

ঙ. শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির কোনও ত্রুটি-বিচ্যুতির প্রতি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করার সময় প্রথমে কথা ও কাজে তার প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি প্রদর্শন করা চাই।

চ. মাগফিরাতের দুআ জীবিত ও মৃত এবং বড় ও ছোট যে-কারও জন্যই এবং পেছনে ও সামনাসামনি যে-কোনও অবস্থায়ই করা যায়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)
রিয়াযুস সালিহীন - হাদীস নং ৩৪১ | মুসলিম বাংলা