রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
ভূমিকা অধ্যায়
হাদীস নং: ৩৩৬
অধ্যায়: ৪১
পিতা-মাতার অবাধ্যতা করা ও আত্মীয়তা ছিন্ন করার নিষিদ্ধতা
পিতা-মাতার আনুগত্য করাকে যেমন بر বলে, তেমনি তাদের অবাধ্যতা করাকে عقوق বলে। এ শব্দটির উৎপত্তি عق থেকে। এর অর্থ ছিন্ন করা, বিরোধিতা করা। সন্তানের যেসকল আচার-আচরণ দ্বারা পিতা-মাতার অমর্যাদা হয় এবং তারা কষ্ট পায়, পরিভাষায় তাকে عقوق বলা হয়ে থাকে। এটা সর্বোচ্চ পর্যায়ের কবীরা গুনাহ। পিতা মাতার প্রতি এরূপ আচরণকারী সন্তানকে عاق বলা হয়। যে-কোনও সন্তানের পক্ষে এটি অত্যন্ত মন্দ বিশেষণ। কোনও সন্তানের প্রতি যাতে এ বিশেষণ আরোপিত না হয়, তাই তার কর্তব্য সর্বাবস্থায় পিতা-মাতাকে খুশি রাখার চেষ্টা করা এবং শরীআতবিরোধী নয় এমন যাবতীয় বিষয়ে পিতা-মাতার অনুগত থাকা।
قطيعة الرحم -এর অর্থ আত্মীয়তা ছিন্ন করা। অর্থাৎ আত্মীয়ের প্রতি দুর্ব্যবহার করা, তাদের অধিকার খর্ব করা ও তাদের খোঁজখবর না রাখা। এটা صلة الأرحام এর বিপরীত। এটাও নাজায়েয ও কবীরা গুনাহ।
কুরআন-হাদীছে পিতা-মাতার আনুগত্য করা ও আত্মীয়তা রক্ষার যেমন তাকীদ এসেছে, তেমনি পিতা-মাতার অবাধ্যতা করা ও আত্মীয়তা ছিন্ন করা সম্পর্কেও এসেছে কঠিন সতর্কবাণী। বিভিন্নভাবে এর মন্দত্ব ও কদর্যতার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে, যা দ্বারা পরিষ্কার বোঝা যায় পিতা-মাতার অবাধ্যতা করা ও আত্মীয়ের প্রতি দুর্ব্যবহার করা কাফের-মুশরিকেরই বৈশিষ্ট্য; এটা কোনও মুমিন-মুসলিমের কাজ হতে পারে না। ইমাম নববী রহ. বক্ষ্যমাণ অধ্যায়ে এরকম কিছু আয়াত ও হাদীছ উদ্ধৃত করেছেন। নিচে
তার বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা পেশ করা যাচ্ছে।
‘পিতা-মাতার অবাধ্যতা করা ও আত্মীয়তা ছিন্ন করার নিষিদ্ধতা’-সম্পর্কিত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত
فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ أَنْ تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَتُقَطِّعُوا أَرْحَامَكُمْ (22) أُولَئِكَ الَّذِينَ لَعَنَهُمُ اللَّهُ فَأَصَمَّهُمْ وَأَعْمَى أَبْصَارَهُمْ
অর্থ : অতঃপর তোমরা (জিহাদ থেকে) মুখ ফিরিয়ে নিলে কি তোমাদের দ্বারা ভূমিতে অশান্তি বিস্তার এবং আত্মীয়তা ছিন্ন করার সম্ভাবনা আছে? এরাই তারা, যাদেরকে আল্লাহ লানত করেছেন (অর্থাৎ তার রহমত থেকে দূর করে দিয়েছেন।) কলে তাদেরকে বধির বানিয়ে দিয়েছেন এবং তাদের চোখ অন্ধ করে দিয়েছেন।১১৯
ব্যাখ্যা
আত্মীয়তা ছিন্ন করার পরিণাম যে কত ভয়াবহ তা কুরআন মাজীদের এ আয়াতে স্পষ্ট করা হয়েছে। বলা হয়েছে-
فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ أَنْ تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَتُقَطِّعُوا أَرْحَامَكُمْ
অতঃপর তোমরা (জিহাদ থেকে) মুখ ফিরিয়ে নিলে কি তোমাদের দ্বারা ভূমিতে অশান্তি বিস্তার এবং আত্মীয়তা ছিন্ন করার সম্ভাবনা আছে?' অর্থাৎ জিহাদের ব্যতিব্যস্ততা ছেড়ে দিলে সমাজে অশান্তি বিস্তারে লিপ্ত হয়ে পড়ার ও আত্মীয়তা ছিন্ন করার আশঙ্কা থাকে। জিহাদ করা অবস্থায় সবটা শক্তি ব্যয় হয় আল্লাহ তাআলার দুশমনদের দমন করার কাজে। মন-মস্তিষ্কও সেই ফিকিরেই রত থাকে। পক্ষান্তরে জিহাদ থেকে অবসর হয়ে কেবল দুনিয়াবী কাজকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়লে পরস্পরে হিংসা-বিদ্বেষ দেখা দেয় এবং তার পরিণামে দেখা দেয় আত্মকলহ। এভাবে যে শক্তি ব্যয় হত দীনের শত্রুদমনে, তা আত্মঘাতী ভ্রাতৃদমনে নিঃশেষ করা হয়। এতে কোনও সন্দেহ নেই যে, বর্তমানকার মুসলিম জাতির আত্মকলহ ও সর্বাত্মক পশ্চাদপদতা তাদের জিহাদবিমুখতারই পরিণাম।
تَوَلَّيْتُمْ এর এক অর্থ হতে পারে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব লাভ করা। এ হিসেবে আয়াতটির অর্থ হবে- 'তোমরা যদি কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার অধিকারী হও, তবে কি তোমাদের দ্বারা ভূমিতে অশান্তি বিস্তার এবং রক্তের আত্মীয়তা ছিন্ন করার সম্ভাবনা আছে?' অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতা মানুষকে আত্মকলহ ও আত্মীয়তা ছিন্ন করার পথে টেনে নেয়। ক্ষমতা দখল ও ক্ষমতা রক্ষার লোভ এমনই সর্বনাশা ব্যাধি, যা মানুষের অন্তর থেকে মায়া-মমতা কেড়ে নেয়। ক্ষমতালোভী ব্যক্তির কাছে আত্মীয়তার কোনও মূল্য থাকে না। ফলে কেবল আত্মীয়তা ছিন্ন করাই নয়, পরমাত্মীয় রক্তের ভাইকে পর্যন্ত হত্যা করতেও সে কুণ্ঠাবোধ করে না।
পৃথিবীতে অশান্তি বিস্তার করা ও আত্মীয়তা ছিন্ন করা অত্যন্ত কঠিন পাপ। এ পাপের পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ। পরের আয়াতে সে পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। বলা হচ্ছে- أُولَئِكَ الَّذِينَ لَعَنَهُمُ اللَّهُ فَأَصَمَّهُمْ وَأَعْمَى أَبْصَارَهُمْ 'এরাই তারা, যাদেরকে আল্লাহ লানত করেছেন (অর্থাৎ তার রহমত থেকে দূর করে দিয়েছেন।) ফলে তাদেরকে বধির বানিয়ে দিয়েছেন এবং তাদের চোখ অন্ধ করে দিয়েছেন'। অর্থাৎ এরূপ লোক আল্লাহ তাআলার রহমত থেকে বঞ্চিত হয়ে যায় এবং তাদের জীবন হয়ে পড়ে অভিশপ্ত জীবন । কান থাকা সত্ত্বেও তারা বধির হয়ে যায় এবং চোখ থাকা সত্ত্বেও অন্ধ হয়ে যায়। না তারা সত্য ও ন্যায়ের পথ দেখতে পায় আর না সত্য-ন্যায়ের বাণী শুনতে পায়।
দুই নং আয়াত
وَالَّذِينَ يَنْقُضُونَ عَهْدَ اللَّهِ مِنْ بَعْدِ مِيثَاقِهِ وَيَقْطَعُونَ مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ أَنْ يُوصَلَ وَيُفْسِدُونَ فِي الْأَرْضِ أُولَئِكَ لَهُمُ اللَّعْنَةُ وَلَهُمْ سُوءُ الدَّارِ
অর্থ : (অপর দিকে) যারা আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকারে দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ হওয়ার পর তা ভঙ্গ করে, আল্লাহ যে সম্পর্ক বজায় রাখার হুকুম দিয়েছেন তা ছিন্ন করে এবং যমীনে অশান্তি বিস্তার করে, তাদের জন্য রয়েছে লানত এবং প্রকৃত নিবাসে নিকৃষ্ট পরিণাম তাদেরই জন্য।১২০
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে তিনটি কঠিন গুনাহে লিপ্ত ব্যক্তিবর্গের অশুভ পরিণাম জানানো হয়েছে যে, তাদের প্রতি আল্লাহ তাআলার লা'নত বর্ষিত হয় এবং মৃত্যুর পর তারা হবে নিকৃষ্টতম ঠিকানা জাহান্নামের বাসিন্দা। সে তিনটি গুনাহ হচ্ছে- ক. অঙ্গীকার ভঙ্গ করা; খ. আত্মীয়তা ছিন্ন করা এবং গ. পৃথিবীতে ফিতনা-ফাসাদ বিস্তার করা।
‘আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকারে দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ হওয়ার পর তা ভঙ্গ করে'- এর অর্থ রূহানী জগতে কৃত রব্ব হিসেবে আল্লাহ তাআলার প্রতি আনুগত্যের অঙ্গীকার, যার দাবি হচ্ছে দুনিয়ায় তাঁর দেওয়া দীন ও শরীআত মোতাবেক চলা। কাজেই দীন ও শরীআত মোতাবেক না চললে আল্লাহ তাআলার সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গ করা হয়। এ দুনিয়ায় মানুষ একে অন্যের সঙ্গে যেসব ওয়াদা-অঙ্গীকার করে থাকে তা ভঙ্গ করার আল্লাহর সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গের শামিল, যেহেতু তা রক্ষা করাও শরীআতের হুকুম। সুতরাং সরাসরি আল্লাহর সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার রক্ষা করা যেমন জরুরি, তেমনি শরীআতসম্মত মানুষের পারস্পরিক ওয়াদা-অঙ্গীকার রক্ষা করাও সমান জরুরি। যে-কোনও প্রকারের অঙ্গীকার ভঙ্গ করাই মহাপাপ এবং তা আল্লাহ তাআলার লানত কুড়ানো ও জাহান্নামবাসের কারণ।
আল্লাহ যে সম্পর্ক বজায় রাখার হুকুম দিয়েছেন তা ছিন্ন করে'- এর অর্থ আত্মীয়তার সম্পর্ক। কুরআন ও হাদীছে আত্মীয়তা রক্ষার জোর তাকীদ করা হয়েছে। এবং আত্মীয়তা ছিন্ন করতে কঠিনভাবে নিষেধ করা হয়েছে। সুতরাং আত্মীয়তা ছিন্ন করা একটি মহাপাপ। যারা তা ছিন্ন করে তারা আল্লাহ তাআলার লা‘নতে পতিত হয় এবং আখেরাতেও তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের শাস্তি।
‘যমীনে অশান্তি বিস্তার করে'- এর অর্থ অন্যের উপর জুলুম করা ও অন্যকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা । জান, মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা প্রত্যেকের আল্লাহপ্রদত্ত অধিকার। এ অধিকার খর্ব করার দ্বারা অন্যের উপর জুলুম হয়। ফলে পারিবারিক ও সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট হয়।
এমনিভাবে মানুষের আরও একটি মৌলিক অধিকার হলো সত্য-সঠিক দীনের অনুসরণ করতে পারা। এতে বাধাদানও ফাসাদ সৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত। সত্য দীনের অপব্যাখ্যা, মনগড়া ধর্মমত বা ভ্রান্ত ধর্মের প্রচার-প্রচারণাও এক প্রকার বাধাদানই বটে। কেননা এর ফলে মানুষ বিভ্রান্তির শিকার হয় এবং সত্য দীনের অনুসরণে জটিলতা দেখা দেয়। কাজেই যারা এ জাতীয় কাজে লিপ্ত হয় তারাও আল্লাহর যমীনে ফিতনা-ফাসাদ বিস্তারেই ভূমিকা রাখে। মোটকথা দীনী ও দুনিয়াবী যে-কোনও প্রকার ফাসাদ সৃষ্টিই কঠিন পাপ। এরূপ পাপে লিপ্ত হওয়ার পরিণাম আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হওয়া ও জাহান্নামের শাস্তিভোগ । প্রত্যেক মুমিনের এর থেকে বিরত থাকা অবশ্যকর্তব্য।
তিন নং আয়াত
وَقَضَى رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلَاهُمَا فَلَا تَقُلْ لَهُمَا أُفٍّ وَلَا تَنْهَرْهُمَا وَقُلْ لَهُمَا قَوْلًا كَرِيمًا (23) وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَقُلْ رَبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا
অর্থ : তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তাকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না, পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো, পিতা-মাতার কোনও একজন কিংবা উভয়ে যদি তোমার কাছে বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে উফ পর্যন্ত বলো না। এবং তাদেরকে ধমক দিও না; বরং তাদের সঙ্গে সম্মানজনক কথা বলো। এবং তাদের প্রতি মমতাপূর্ণ আচরণের সঙ্গে তাদের সামনে নিজেকে বিনয়াবনত করো আর দু'আ করো, হে আমার প্রতিপালক! তারা যেভাবে আমার শৈশবে আমাকে লালন-পালন করেছে, তেমনি আপনিও তাদের প্রতি রহমতের আচরণ করুন।১২১
ব্যাখ্যা
এ দুই আয়াতে আল্লাহ তাআলা পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার সম্পর্কে কয়েকটি নির্দেশনা দিয়েছেন। শুরুতে কেবল আল্লাহ তাআলারই ইবাদত করার হুকুম দেওয়া হয়েছে। তারপর ইরশাদ হয়েছে-
وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا
(পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো)। এটা তাদের প্রতি সাধারণভাবে সদ্ব্যবহারের হুকুম। এরপর এ হুকুমের খানিকটা ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, যা দ্বারা সদ্ব্যবহারের বিশেষ কয়েকটি দিক পরিস্ফুট হয়েছে।
সুতরাং ইরশাদ হয়েছে—
إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلَاهُمَا فَلَا تَقُلْ لَهُمَا أُفٍّ
(পিতা-মাতার কোনও একজন কিংবা উভয়ে যদি তোমার কাছে বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে উফ্ পর্যন্ত বলো না)। ‘উফ্’ শব্দটি বিরক্তি প্রকাশক ও অপ্রীতিব্যাঞ্জক। উফ পর্যন্ত বলো না—এর অর্থ, তাদের প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করো না এবং তাদেরকে বিরক্তিসূচক কোনও কথা বলো না।
পিতা-মাতার প্রতি যখন বিরক্তি প্রকাশ করা পর্যন্ত সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, তখন তাদেরকে সরাসরি কষ্ট দেওয়া যে আরও কঠিনভাবে নিষিদ্ধ হবে তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদেরকে শারীরিক বা মানসিক কষ্ট নানাভাবেই দেওয়া হয়ে থাকে। এ ব্যাপারে প্রত্যেক সন্তানের সচেতন থাকা উচিত। আবার অনেকে তো পিতা-মাতাকে তীব্র ভাষায় আক্রমণও করে। আয়াতে পরের বাক্যে এ ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে।
ইরশাদ হয়েছে- وَلَا تَنْهَرْهُمَا (এবং তাদেরকে ধমক দিও না)। অনেক সময় পিতা-মাতার কোনও কথা বা কোনও কাজ পসন্দ না হলে সন্তান তাদেরকে ধমক দিয়ে বসে। কোনও কোনও দুর্ভাগা তো রীতিমত গালাগালিই করে। এটা অত্যন্ত ধ্বংসকর আচরণ। এরূপ অবাধ্য সন্তান নিজ আখেরাত তো বরবাদ করেই, দুনিয়ায়ও তাকে কঠিন দুর্ভোগের সম্মুখীন হতে হয়। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
كُل الذُّنُوبِ يَغْفِرُ اللهُ مِنْهَا مَا شَاءَ إِلَّا عُقوقَ الْوَالِدَيْنِ، فَإِنَّهُ يُعَجِّلُ لِصَاحِبِهِ فِي الْحَيَاةِ قَبْلَ الْمَمَاتِ
'সমস্ত পাপের ক্ষেত্রেই নিয়ম এই যে, আল্লাহ তাআলা তা থেকে যা ইচ্ছা মাফ করে দেবেন। কিন্তু পিতা-মাতার অবাধ্যতা এর ব্যতিক্রম। কেননা আল্লাহ এই অপরাধের অপরাধীকে মৃত্যুর আগে এ দুনিয়ায়ই নগদ শাস্তি দিয়ে দেন।১২২
সর্বাবস্থায়ই সন্তানদেরকে পিতা-মাতার সঙ্গে শান্তিদায়ী আচরণ করতে হবে। কথা বলতে হবে সম্মানজনক। সুতরাং এর পরবর্তী বাক্যে ইরশাদ হয়েছে-
وَقُلْ لَهُمَا قَوْلًا كَرِيمًا (বরং তাদের সঙ্গে সম্মানজনক কথা বলো)। অর্থাৎ যখনই তাদের সঙ্গে কথা বলবে, তখন মাথায় এই চিন্তা-চেতনা জাগ্রত রেখে কথা বলবে যে, তারা আমার পিতা-মাতা, সর্বাপেক্ষা শ্রদ্ধাভক্তির পাত্র। একজন কঠোর স্বভাবের মনিবের সঙ্গে তার অনুগত ও বাধ্যগত গোলাম যেমন নম্র ও বিনীত ভঙ্গিতে কথা বলে, প্রত্যেক সন্তানকে তার পিতা-মাতার সঙ্গে ঠিক সেইভাবে কথা বলতে হবে। পরবর্তী আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ (এবং তাদের প্রতি মমতাপূর্ণ আচরণের সঙ্গে তাদের সামনে নিজেকে বিনয়াবনত করো)। অর্থাৎ তাদের জন্য তোমার দু'হাত নম্র- কোমল রাখ। এর দ্বারা তাদের প্রতি বিনীত ও উদার থাকতে হুকুম করা হয়েছে। কাজেই তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে হবে বিনয়ের সাথে এবং আচার-আচরণ করতে হবে পূর্ণ আদব সহকারে।
বলা হয়েছে বৃদ্ধ পিতা-মাতার প্রতি আচরণ করতে হবে মমতাপূর্ণ। কেননা আজ তারা বার্ধক্যের কারণে তোমার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। স্মরণ কর, আজ তারা যেমন তোমার উপর নির্ভরশীল, তেমনি তুমিও একদিন তাদের উপর এরকম নির্ভরশীল ছিলে। তখন তারা পরম মমতায় নিজেদের সুখ ও আরাম ভুলে তোমার সুখ ও আরামের প্রতি লক্ষ রাখতেন। কাজেই আজ তাদের এই দুর্বল অবস্থায় তোমারও উচিত সর্বোচ্চ ধৈর্যের সঙ্গে তাদের প্রতি মমত্বপূর্ণ আচরণ করে যাওয়া।
পিতা-মাতার প্রতি যত্ন নেওয়ার পাশাপাশি তাদের দোজাহানের শান্তি ও মুক্তির জন্য আল্লাহ তাআলার কাছে দুআ করাও প্রত্যেক সন্তানের অবশ্যকর্তব্য। আয়াতের পরবর্তী অংশে সে দুআই শিক্ষা দেওয়া হয়েছে-
وَقُلْ رَبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا (আর দু'আ করো, হে আমার প্রতিপালক! তারা যেভাবে আমার শৈশবে আমাকে লালন-পালন করেছে, তেমনি আপনিও তাদের প্রতি রহমতের আচরণ করুন)। অর্থাৎ আমি যখন নিতান্তই দুর্বল ছিলাম, তখন তারা আমার লালন-পালনের জন্য নিজের সমস্ত সুখ ও আরাম বিসর্জন দিয়েছিলেন। নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী তারা আমার আরাম ও কল্যাণের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন। আজ তারা বয়সের ভারে ক্লান্ত-শ্রান্ত। হে আল্লাহ! আপনার তাওফীকে আমি তো আমার সামর্থ্য অনুযায়ী তাদের খেদমত করে যাচ্ছি। কিন্তু সন্তান হিসেবে যা কর্তব্য তা ঠিক পালন করা হচ্ছে না। সুতরাং হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে নিবেদন করছি, আপনি আজ তাদের প্রতি নিজ রহমত জারি রাখুন এবং মৃত্যুর পরও তাদের প্রতি আপন দয়ামায়ার আচরণ করুন। এ আয়াতের খানিকটা বিস্তারিত ব্যাখ্যা এর আগের অধ্যায়ে গত য়েছে। সেখানে দ্রষ্টব্য।
১১৯. সূরা মুহাম্মাদ (৪৭), আয়াত ২২-২৩
১২০. সূরা রাদ (১৩), আয়াত ২৫
১২১. সূরা বনী ইসরাঈল (১৭), আয়াত ২৩,২৪
১২২. বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৭৫০৬; খারাইতী, মাসাবিউল আখলাক, হাদীছ নং ২৩৬
পিতা-মাতার অবাধ্যতা করা ও আত্মীয়তা ছিন্ন করার নিষিদ্ধতা
পিতা-মাতার আনুগত্য করাকে যেমন بر বলে, তেমনি তাদের অবাধ্যতা করাকে عقوق বলে। এ শব্দটির উৎপত্তি عق থেকে। এর অর্থ ছিন্ন করা, বিরোধিতা করা। সন্তানের যেসকল আচার-আচরণ দ্বারা পিতা-মাতার অমর্যাদা হয় এবং তারা কষ্ট পায়, পরিভাষায় তাকে عقوق বলা হয়ে থাকে। এটা সর্বোচ্চ পর্যায়ের কবীরা গুনাহ। পিতা মাতার প্রতি এরূপ আচরণকারী সন্তানকে عاق বলা হয়। যে-কোনও সন্তানের পক্ষে এটি অত্যন্ত মন্দ বিশেষণ। কোনও সন্তানের প্রতি যাতে এ বিশেষণ আরোপিত না হয়, তাই তার কর্তব্য সর্বাবস্থায় পিতা-মাতাকে খুশি রাখার চেষ্টা করা এবং শরীআতবিরোধী নয় এমন যাবতীয় বিষয়ে পিতা-মাতার অনুগত থাকা।
قطيعة الرحم -এর অর্থ আত্মীয়তা ছিন্ন করা। অর্থাৎ আত্মীয়ের প্রতি দুর্ব্যবহার করা, তাদের অধিকার খর্ব করা ও তাদের খোঁজখবর না রাখা। এটা صلة الأرحام এর বিপরীত। এটাও নাজায়েয ও কবীরা গুনাহ।
কুরআন-হাদীছে পিতা-মাতার আনুগত্য করা ও আত্মীয়তা রক্ষার যেমন তাকীদ এসেছে, তেমনি পিতা-মাতার অবাধ্যতা করা ও আত্মীয়তা ছিন্ন করা সম্পর্কেও এসেছে কঠিন সতর্কবাণী। বিভিন্নভাবে এর মন্দত্ব ও কদর্যতার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে, যা দ্বারা পরিষ্কার বোঝা যায় পিতা-মাতার অবাধ্যতা করা ও আত্মীয়ের প্রতি দুর্ব্যবহার করা কাফের-মুশরিকেরই বৈশিষ্ট্য; এটা কোনও মুমিন-মুসলিমের কাজ হতে পারে না। ইমাম নববী রহ. বক্ষ্যমাণ অধ্যায়ে এরকম কিছু আয়াত ও হাদীছ উদ্ধৃত করেছেন। নিচে
তার বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা পেশ করা যাচ্ছে।
‘পিতা-মাতার অবাধ্যতা করা ও আত্মীয়তা ছিন্ন করার নিষিদ্ধতা’-সম্পর্কিত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত
فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ أَنْ تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَتُقَطِّعُوا أَرْحَامَكُمْ (22) أُولَئِكَ الَّذِينَ لَعَنَهُمُ اللَّهُ فَأَصَمَّهُمْ وَأَعْمَى أَبْصَارَهُمْ
অর্থ : অতঃপর তোমরা (জিহাদ থেকে) মুখ ফিরিয়ে নিলে কি তোমাদের দ্বারা ভূমিতে অশান্তি বিস্তার এবং আত্মীয়তা ছিন্ন করার সম্ভাবনা আছে? এরাই তারা, যাদেরকে আল্লাহ লানত করেছেন (অর্থাৎ তার রহমত থেকে দূর করে দিয়েছেন।) কলে তাদেরকে বধির বানিয়ে দিয়েছেন এবং তাদের চোখ অন্ধ করে দিয়েছেন।১১৯
ব্যাখ্যা
আত্মীয়তা ছিন্ন করার পরিণাম যে কত ভয়াবহ তা কুরআন মাজীদের এ আয়াতে স্পষ্ট করা হয়েছে। বলা হয়েছে-
فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ أَنْ تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَتُقَطِّعُوا أَرْحَامَكُمْ
অতঃপর তোমরা (জিহাদ থেকে) মুখ ফিরিয়ে নিলে কি তোমাদের দ্বারা ভূমিতে অশান্তি বিস্তার এবং আত্মীয়তা ছিন্ন করার সম্ভাবনা আছে?' অর্থাৎ জিহাদের ব্যতিব্যস্ততা ছেড়ে দিলে সমাজে অশান্তি বিস্তারে লিপ্ত হয়ে পড়ার ও আত্মীয়তা ছিন্ন করার আশঙ্কা থাকে। জিহাদ করা অবস্থায় সবটা শক্তি ব্যয় হয় আল্লাহ তাআলার দুশমনদের দমন করার কাজে। মন-মস্তিষ্কও সেই ফিকিরেই রত থাকে। পক্ষান্তরে জিহাদ থেকে অবসর হয়ে কেবল দুনিয়াবী কাজকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়লে পরস্পরে হিংসা-বিদ্বেষ দেখা দেয় এবং তার পরিণামে দেখা দেয় আত্মকলহ। এভাবে যে শক্তি ব্যয় হত দীনের শত্রুদমনে, তা আত্মঘাতী ভ্রাতৃদমনে নিঃশেষ করা হয়। এতে কোনও সন্দেহ নেই যে, বর্তমানকার মুসলিম জাতির আত্মকলহ ও সর্বাত্মক পশ্চাদপদতা তাদের জিহাদবিমুখতারই পরিণাম।
تَوَلَّيْتُمْ এর এক অর্থ হতে পারে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব লাভ করা। এ হিসেবে আয়াতটির অর্থ হবে- 'তোমরা যদি কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার অধিকারী হও, তবে কি তোমাদের দ্বারা ভূমিতে অশান্তি বিস্তার এবং রক্তের আত্মীয়তা ছিন্ন করার সম্ভাবনা আছে?' অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতা মানুষকে আত্মকলহ ও আত্মীয়তা ছিন্ন করার পথে টেনে নেয়। ক্ষমতা দখল ও ক্ষমতা রক্ষার লোভ এমনই সর্বনাশা ব্যাধি, যা মানুষের অন্তর থেকে মায়া-মমতা কেড়ে নেয়। ক্ষমতালোভী ব্যক্তির কাছে আত্মীয়তার কোনও মূল্য থাকে না। ফলে কেবল আত্মীয়তা ছিন্ন করাই নয়, পরমাত্মীয় রক্তের ভাইকে পর্যন্ত হত্যা করতেও সে কুণ্ঠাবোধ করে না।
পৃথিবীতে অশান্তি বিস্তার করা ও আত্মীয়তা ছিন্ন করা অত্যন্ত কঠিন পাপ। এ পাপের পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ। পরের আয়াতে সে পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। বলা হচ্ছে- أُولَئِكَ الَّذِينَ لَعَنَهُمُ اللَّهُ فَأَصَمَّهُمْ وَأَعْمَى أَبْصَارَهُمْ 'এরাই তারা, যাদেরকে আল্লাহ লানত করেছেন (অর্থাৎ তার রহমত থেকে দূর করে দিয়েছেন।) ফলে তাদেরকে বধির বানিয়ে দিয়েছেন এবং তাদের চোখ অন্ধ করে দিয়েছেন'। অর্থাৎ এরূপ লোক আল্লাহ তাআলার রহমত থেকে বঞ্চিত হয়ে যায় এবং তাদের জীবন হয়ে পড়ে অভিশপ্ত জীবন । কান থাকা সত্ত্বেও তারা বধির হয়ে যায় এবং চোখ থাকা সত্ত্বেও অন্ধ হয়ে যায়। না তারা সত্য ও ন্যায়ের পথ দেখতে পায় আর না সত্য-ন্যায়ের বাণী শুনতে পায়।
দুই নং আয়াত
وَالَّذِينَ يَنْقُضُونَ عَهْدَ اللَّهِ مِنْ بَعْدِ مِيثَاقِهِ وَيَقْطَعُونَ مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ أَنْ يُوصَلَ وَيُفْسِدُونَ فِي الْأَرْضِ أُولَئِكَ لَهُمُ اللَّعْنَةُ وَلَهُمْ سُوءُ الدَّارِ
অর্থ : (অপর দিকে) যারা আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকারে দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ হওয়ার পর তা ভঙ্গ করে, আল্লাহ যে সম্পর্ক বজায় রাখার হুকুম দিয়েছেন তা ছিন্ন করে এবং যমীনে অশান্তি বিস্তার করে, তাদের জন্য রয়েছে লানত এবং প্রকৃত নিবাসে নিকৃষ্ট পরিণাম তাদেরই জন্য।১২০
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে তিনটি কঠিন গুনাহে লিপ্ত ব্যক্তিবর্গের অশুভ পরিণাম জানানো হয়েছে যে, তাদের প্রতি আল্লাহ তাআলার লা'নত বর্ষিত হয় এবং মৃত্যুর পর তারা হবে নিকৃষ্টতম ঠিকানা জাহান্নামের বাসিন্দা। সে তিনটি গুনাহ হচ্ছে- ক. অঙ্গীকার ভঙ্গ করা; খ. আত্মীয়তা ছিন্ন করা এবং গ. পৃথিবীতে ফিতনা-ফাসাদ বিস্তার করা।
‘আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকারে দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ হওয়ার পর তা ভঙ্গ করে'- এর অর্থ রূহানী জগতে কৃত রব্ব হিসেবে আল্লাহ তাআলার প্রতি আনুগত্যের অঙ্গীকার, যার দাবি হচ্ছে দুনিয়ায় তাঁর দেওয়া দীন ও শরীআত মোতাবেক চলা। কাজেই দীন ও শরীআত মোতাবেক না চললে আল্লাহ তাআলার সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গ করা হয়। এ দুনিয়ায় মানুষ একে অন্যের সঙ্গে যেসব ওয়াদা-অঙ্গীকার করে থাকে তা ভঙ্গ করার আল্লাহর সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গের শামিল, যেহেতু তা রক্ষা করাও শরীআতের হুকুম। সুতরাং সরাসরি আল্লাহর সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার রক্ষা করা যেমন জরুরি, তেমনি শরীআতসম্মত মানুষের পারস্পরিক ওয়াদা-অঙ্গীকার রক্ষা করাও সমান জরুরি। যে-কোনও প্রকারের অঙ্গীকার ভঙ্গ করাই মহাপাপ এবং তা আল্লাহ তাআলার লানত কুড়ানো ও জাহান্নামবাসের কারণ।
আল্লাহ যে সম্পর্ক বজায় রাখার হুকুম দিয়েছেন তা ছিন্ন করে'- এর অর্থ আত্মীয়তার সম্পর্ক। কুরআন ও হাদীছে আত্মীয়তা রক্ষার জোর তাকীদ করা হয়েছে। এবং আত্মীয়তা ছিন্ন করতে কঠিনভাবে নিষেধ করা হয়েছে। সুতরাং আত্মীয়তা ছিন্ন করা একটি মহাপাপ। যারা তা ছিন্ন করে তারা আল্লাহ তাআলার লা‘নতে পতিত হয় এবং আখেরাতেও তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের শাস্তি।
‘যমীনে অশান্তি বিস্তার করে'- এর অর্থ অন্যের উপর জুলুম করা ও অন্যকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা । জান, মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা প্রত্যেকের আল্লাহপ্রদত্ত অধিকার। এ অধিকার খর্ব করার দ্বারা অন্যের উপর জুলুম হয়। ফলে পারিবারিক ও সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট হয়।
এমনিভাবে মানুষের আরও একটি মৌলিক অধিকার হলো সত্য-সঠিক দীনের অনুসরণ করতে পারা। এতে বাধাদানও ফাসাদ সৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত। সত্য দীনের অপব্যাখ্যা, মনগড়া ধর্মমত বা ভ্রান্ত ধর্মের প্রচার-প্রচারণাও এক প্রকার বাধাদানই বটে। কেননা এর ফলে মানুষ বিভ্রান্তির শিকার হয় এবং সত্য দীনের অনুসরণে জটিলতা দেখা দেয়। কাজেই যারা এ জাতীয় কাজে লিপ্ত হয় তারাও আল্লাহর যমীনে ফিতনা-ফাসাদ বিস্তারেই ভূমিকা রাখে। মোটকথা দীনী ও দুনিয়াবী যে-কোনও প্রকার ফাসাদ সৃষ্টিই কঠিন পাপ। এরূপ পাপে লিপ্ত হওয়ার পরিণাম আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হওয়া ও জাহান্নামের শাস্তিভোগ । প্রত্যেক মুমিনের এর থেকে বিরত থাকা অবশ্যকর্তব্য।
তিন নং আয়াত
وَقَضَى رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلَاهُمَا فَلَا تَقُلْ لَهُمَا أُفٍّ وَلَا تَنْهَرْهُمَا وَقُلْ لَهُمَا قَوْلًا كَرِيمًا (23) وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَقُلْ رَبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا
অর্থ : তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তাকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না, পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো, পিতা-মাতার কোনও একজন কিংবা উভয়ে যদি তোমার কাছে বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে উফ পর্যন্ত বলো না। এবং তাদেরকে ধমক দিও না; বরং তাদের সঙ্গে সম্মানজনক কথা বলো। এবং তাদের প্রতি মমতাপূর্ণ আচরণের সঙ্গে তাদের সামনে নিজেকে বিনয়াবনত করো আর দু'আ করো, হে আমার প্রতিপালক! তারা যেভাবে আমার শৈশবে আমাকে লালন-পালন করেছে, তেমনি আপনিও তাদের প্রতি রহমতের আচরণ করুন।১২১
ব্যাখ্যা
এ দুই আয়াতে আল্লাহ তাআলা পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার সম্পর্কে কয়েকটি নির্দেশনা দিয়েছেন। শুরুতে কেবল আল্লাহ তাআলারই ইবাদত করার হুকুম দেওয়া হয়েছে। তারপর ইরশাদ হয়েছে-
وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا
(পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো)। এটা তাদের প্রতি সাধারণভাবে সদ্ব্যবহারের হুকুম। এরপর এ হুকুমের খানিকটা ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, যা দ্বারা সদ্ব্যবহারের বিশেষ কয়েকটি দিক পরিস্ফুট হয়েছে।
সুতরাং ইরশাদ হয়েছে—
إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلَاهُمَا فَلَا تَقُلْ لَهُمَا أُفٍّ
(পিতা-মাতার কোনও একজন কিংবা উভয়ে যদি তোমার কাছে বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে উফ্ পর্যন্ত বলো না)। ‘উফ্’ শব্দটি বিরক্তি প্রকাশক ও অপ্রীতিব্যাঞ্জক। উফ পর্যন্ত বলো না—এর অর্থ, তাদের প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করো না এবং তাদেরকে বিরক্তিসূচক কোনও কথা বলো না।
পিতা-মাতার প্রতি যখন বিরক্তি প্রকাশ করা পর্যন্ত সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, তখন তাদেরকে সরাসরি কষ্ট দেওয়া যে আরও কঠিনভাবে নিষিদ্ধ হবে তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদেরকে শারীরিক বা মানসিক কষ্ট নানাভাবেই দেওয়া হয়ে থাকে। এ ব্যাপারে প্রত্যেক সন্তানের সচেতন থাকা উচিত। আবার অনেকে তো পিতা-মাতাকে তীব্র ভাষায় আক্রমণও করে। আয়াতে পরের বাক্যে এ ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে।
ইরশাদ হয়েছে- وَلَا تَنْهَرْهُمَا (এবং তাদেরকে ধমক দিও না)। অনেক সময় পিতা-মাতার কোনও কথা বা কোনও কাজ পসন্দ না হলে সন্তান তাদেরকে ধমক দিয়ে বসে। কোনও কোনও দুর্ভাগা তো রীতিমত গালাগালিই করে। এটা অত্যন্ত ধ্বংসকর আচরণ। এরূপ অবাধ্য সন্তান নিজ আখেরাত তো বরবাদ করেই, দুনিয়ায়ও তাকে কঠিন দুর্ভোগের সম্মুখীন হতে হয়। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
كُل الذُّنُوبِ يَغْفِرُ اللهُ مِنْهَا مَا شَاءَ إِلَّا عُقوقَ الْوَالِدَيْنِ، فَإِنَّهُ يُعَجِّلُ لِصَاحِبِهِ فِي الْحَيَاةِ قَبْلَ الْمَمَاتِ
'সমস্ত পাপের ক্ষেত্রেই নিয়ম এই যে, আল্লাহ তাআলা তা থেকে যা ইচ্ছা মাফ করে দেবেন। কিন্তু পিতা-মাতার অবাধ্যতা এর ব্যতিক্রম। কেননা আল্লাহ এই অপরাধের অপরাধীকে মৃত্যুর আগে এ দুনিয়ায়ই নগদ শাস্তি দিয়ে দেন।১২২
সর্বাবস্থায়ই সন্তানদেরকে পিতা-মাতার সঙ্গে শান্তিদায়ী আচরণ করতে হবে। কথা বলতে হবে সম্মানজনক। সুতরাং এর পরবর্তী বাক্যে ইরশাদ হয়েছে-
وَقُلْ لَهُمَا قَوْلًا كَرِيمًا (বরং তাদের সঙ্গে সম্মানজনক কথা বলো)। অর্থাৎ যখনই তাদের সঙ্গে কথা বলবে, তখন মাথায় এই চিন্তা-চেতনা জাগ্রত রেখে কথা বলবে যে, তারা আমার পিতা-মাতা, সর্বাপেক্ষা শ্রদ্ধাভক্তির পাত্র। একজন কঠোর স্বভাবের মনিবের সঙ্গে তার অনুগত ও বাধ্যগত গোলাম যেমন নম্র ও বিনীত ভঙ্গিতে কথা বলে, প্রত্যেক সন্তানকে তার পিতা-মাতার সঙ্গে ঠিক সেইভাবে কথা বলতে হবে। পরবর্তী আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ (এবং তাদের প্রতি মমতাপূর্ণ আচরণের সঙ্গে তাদের সামনে নিজেকে বিনয়াবনত করো)। অর্থাৎ তাদের জন্য তোমার দু'হাত নম্র- কোমল রাখ। এর দ্বারা তাদের প্রতি বিনীত ও উদার থাকতে হুকুম করা হয়েছে। কাজেই তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে হবে বিনয়ের সাথে এবং আচার-আচরণ করতে হবে পূর্ণ আদব সহকারে।
বলা হয়েছে বৃদ্ধ পিতা-মাতার প্রতি আচরণ করতে হবে মমতাপূর্ণ। কেননা আজ তারা বার্ধক্যের কারণে তোমার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। স্মরণ কর, আজ তারা যেমন তোমার উপর নির্ভরশীল, তেমনি তুমিও একদিন তাদের উপর এরকম নির্ভরশীল ছিলে। তখন তারা পরম মমতায় নিজেদের সুখ ও আরাম ভুলে তোমার সুখ ও আরামের প্রতি লক্ষ রাখতেন। কাজেই আজ তাদের এই দুর্বল অবস্থায় তোমারও উচিত সর্বোচ্চ ধৈর্যের সঙ্গে তাদের প্রতি মমত্বপূর্ণ আচরণ করে যাওয়া।
পিতা-মাতার প্রতি যত্ন নেওয়ার পাশাপাশি তাদের দোজাহানের শান্তি ও মুক্তির জন্য আল্লাহ তাআলার কাছে দুআ করাও প্রত্যেক সন্তানের অবশ্যকর্তব্য। আয়াতের পরবর্তী অংশে সে দুআই শিক্ষা দেওয়া হয়েছে-
وَقُلْ رَبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا (আর দু'আ করো, হে আমার প্রতিপালক! তারা যেভাবে আমার শৈশবে আমাকে লালন-পালন করেছে, তেমনি আপনিও তাদের প্রতি রহমতের আচরণ করুন)। অর্থাৎ আমি যখন নিতান্তই দুর্বল ছিলাম, তখন তারা আমার লালন-পালনের জন্য নিজের সমস্ত সুখ ও আরাম বিসর্জন দিয়েছিলেন। নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী তারা আমার আরাম ও কল্যাণের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন। আজ তারা বয়সের ভারে ক্লান্ত-শ্রান্ত। হে আল্লাহ! আপনার তাওফীকে আমি তো আমার সামর্থ্য অনুযায়ী তাদের খেদমত করে যাচ্ছি। কিন্তু সন্তান হিসেবে যা কর্তব্য তা ঠিক পালন করা হচ্ছে না। সুতরাং হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে নিবেদন করছি, আপনি আজ তাদের প্রতি নিজ রহমত জারি রাখুন এবং মৃত্যুর পরও তাদের প্রতি আপন দয়ামায়ার আচরণ করুন। এ আয়াতের খানিকটা বিস্তারিত ব্যাখ্যা এর আগের অধ্যায়ে গত য়েছে। সেখানে দ্রষ্টব্য।
১১৯. সূরা মুহাম্মাদ (৪৭), আয়াত ২২-২৩
১২০. সূরা রাদ (১৩), আয়াত ২৫
১২১. সূরা বনী ইসরাঈল (১৭), আয়াত ২৩,২৪
১২২. বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৭৫০৬; খারাইতী, মাসাবিউল আখলাক, হাদীছ নং ২৩৬
সর্বাপেক্ষা গুরুতর কয়েকটি পাপ
হাদীছ নং : ৩৩৬
হযরত আবূ বাকরা নুফাই' ইবনুল হারিছ রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আমি কি তোমাদেরকে সর্বাপেক্ষা কঠিন পাপ সম্পর্কে অবহিত করব না? তিনি এ কথা তিনবার বললেন। আমরা বললাম, অবশ্যই ইয়া রাসূলুল্লাহ। তিনি বললেন, আল্লাহর সঙ্গে শরীক করা, পিতা-মাতার অবাধ্যতা করা। এতক্ষণ তিনি হেলান দেওয়া অবস্থায় ছিলেন, এবার সোজা হয়ে বসলেন। তারপর বললেন শোন, এবং মিথ্যা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া। তিনি এ কথা বার বার বলতে থাকলেন। এমনকি আমরা বলতে লাগলাম, আহা! তিনি যদি ক্ষান্ত হতেন! -বুখারী ও মুসলিম।(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ২৬৫৪; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৮৭; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৩০১; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৫; তাবারানী, আল-মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ২৯৩; বায়হাকী, আসসুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ২০৩৮০; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৭৪৮২; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ২৪২৫)
হাদীছ নং : ৩৩৬
হযরত আবূ বাকরা নুফাই' ইবনুল হারিছ রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আমি কি তোমাদেরকে সর্বাপেক্ষা কঠিন পাপ সম্পর্কে অবহিত করব না? তিনি এ কথা তিনবার বললেন। আমরা বললাম, অবশ্যই ইয়া রাসূলুল্লাহ। তিনি বললেন, আল্লাহর সঙ্গে শরীক করা, পিতা-মাতার অবাধ্যতা করা। এতক্ষণ তিনি হেলান দেওয়া অবস্থায় ছিলেন, এবার সোজা হয়ে বসলেন। তারপর বললেন শোন, এবং মিথ্যা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া। তিনি এ কথা বার বার বলতে থাকলেন। এমনকি আমরা বলতে লাগলাম, আহা! তিনি যদি ক্ষান্ত হতেন! -বুখারী ও মুসলিম।(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ২৬৫৪; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৮৭; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৩০১; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৫; তাবারানী, আল-মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ২৯৩; বায়হাকী, আসসুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ২০৩৮০; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৭৪৮২; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ২৪২৫)
41 - باب تحريم العقوق وقطيعة الرحم
قَالَ الله تَعَالَى: {فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ أَنْ تُفْسِدُوا فِي الأَرْضِ وَتُقَطِّعُوا أَرْحَامَكُمْ أُولَئِكَ الَّذِينَ لَعَنَهُمُ اللهُ فَأَصَمَّهُمْ وَأَعْمَى أَبْصَارَهُمْ} [محمد: 22 - 23]، وَقالَ تَعَالَى: {وَالَّذِينَ يَنْقُضُونَ
عَهْدَ اللهِ مِنْ بَعْدِ مِيثَاقِهِ وَيَقْطَعُونَ مَا أَمَرَ اللهُ بِهِ أَنْ يُوصَلَ وَيُفْسِدُونَ فِي الأَرْضِ أُولَئِكَ لَهُمُ اللَّعْنَةُ وَلَهُمْ سُوءُ الدَّارِ} [الرعد: 25]، وَقالَ تَعَالَى: {وَقَضَى رَبُّكَ أَلاَّ تَعْبُدُوا إِلاَّ إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلاهُمَا فَلا تَقُلْ لَهُمَا أُفٍّ وَلا تَنْهَرْهُمَا وَقُلْ لَهُمَا قَوْلًا كَرِيمًا وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَقُلْ رَبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا} [الإسراء: 23 - 24].
قَالَ الله تَعَالَى: {فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ أَنْ تُفْسِدُوا فِي الأَرْضِ وَتُقَطِّعُوا أَرْحَامَكُمْ أُولَئِكَ الَّذِينَ لَعَنَهُمُ اللهُ فَأَصَمَّهُمْ وَأَعْمَى أَبْصَارَهُمْ} [محمد: 22 - 23]، وَقالَ تَعَالَى: {وَالَّذِينَ يَنْقُضُونَ
عَهْدَ اللهِ مِنْ بَعْدِ مِيثَاقِهِ وَيَقْطَعُونَ مَا أَمَرَ اللهُ بِهِ أَنْ يُوصَلَ وَيُفْسِدُونَ فِي الأَرْضِ أُولَئِكَ لَهُمُ اللَّعْنَةُ وَلَهُمْ سُوءُ الدَّارِ} [الرعد: 25]، وَقالَ تَعَالَى: {وَقَضَى رَبُّكَ أَلاَّ تَعْبُدُوا إِلاَّ إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلاهُمَا فَلا تَقُلْ لَهُمَا أُفٍّ وَلا تَنْهَرْهُمَا وَقُلْ لَهُمَا قَوْلًا كَرِيمًا وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَقُلْ رَبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا} [الإسراء: 23 - 24].
336 - وعن أَبي بكرة نُفَيع بن الحارث - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم: «ألا أُنَبِّئُكُمْ بأكْبَرِ الكَبَائِرِ؟» - ثلاثًا - قُلْنَا: بَلَى، يَا رَسُول الله، قَالَ: «الإشْرَاكُ بالله، وَعُقُوقُ [ص:125] الوَالِدَيْنِ»، وكان مُتَّكِئًا فَجَلَسَ، فَقَالَ: «ألاَ وَقَوْلُ الزُّورِ وَشَهَادَةُ الزُّورِ» فَمَا زَالَ يُكَرِّرُهَا حَتَّى قُلْنَا: لَيْتَهُ سَكَتَ. مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (1)
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছে বড় গুনাহের মধ্যে যেগুলো বেশি বড়, সেরকম কয়েকটি গুনাহ উল্লেখ করা হয়েছে। বোঝা গেল মৌলিকভাবে গুনাহ দুই প্রকার- সগীরা গুনাহ (ছোট গুনাহ) ও কবীরা গুনাহ (বড় গুনাহ)। আবার বড় গুনাহের মধ্যেও কিছু আছে অধিকতর বড়।
কেউ কেউ সগীরা গুনাহ'র অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন। তাদের মতে সব গুনাহই কবীরা। কিন্তু কুরআন-হাদীছের ভাষ্যের প্রতি লক্ষ করলে তা সঠিক মনে হয় না। কেননা কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা স্পষ্টভাবেই কবীরা গুনাহ'র উল্লেখ করেছেন। যেমন ইরশাদ হয়েছে-
إِنْ تَجْتَنِبُوا كَبَائِرَ مَا تُنْهَوْنَ عَنْهُ نُكَفِّرْ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَنُدْخِلْكُمْ مُدْخَلًا كَرِيمًا
‘তোমাদেরকে যেই বড় বড় গুনাহ করতে নিষেধ করা হয়েছে, তোমরা যদি তা পরিহার করে চল, তবে আমি নিজেই তোমাদের ছোট ছোট গুনাহ তোমাদের থেকে মিটিয়ে দেব এবং তোমাদেরকে এক মর্যাদাপূর্ণ স্থানে দাখিল করব ।১২৪
আরও ইরশাদ হয়েছে الَّذِينَ يَجْتَنِبُونَ كَبَائِرَ الْإِثْمِ وَالْفَوَاحِشَ إِلَّا اللَّمَمَ إِنَّ رَبَّكَ وَاسِعُ الْمَغْفِرَةِ “সেইসব লোককে, যারা বড়-বড় গুনাহ ও অশ্লীল কাজ থেকে বেঁচে থাকে, অবশ্য কদাচিৎ পিছলে পড়লে সেটা ভিন্ন কথা। নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক প্রশস্ত ক্ষমাশীল।১২৫
এর দ্বারা স্পষ্ট হয়ে যায় কতক গুনাহ ছোটও আছে। তবে এ কথা সত্য যে, ছোট গুনাহকে তাচ্ছিল্য করলে তখন আর তা ছোট থাকে না। কেননা এটা আল্লাহ তাআলার প্রতি ধৃষ্টতা প্রদর্শনের নামান্তর।
কবীরা গুনাহ কাকে বলে, উলামায়ে কেরাম তা বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তবে সব ব্যাখ্যারই সারকথা একই। তা এই যে, কুরআন ও হাদীছে যেসকল গুনাহকে কবীরা গুনাহ, জুলুম, ধ্বংসাত্মক ইত্যাদি গুরুতরতাজ্ঞাপক বিশেষণে বিশেষিত করা হয়েছে কিংবা যেসব অপরাধ সম্পর্কে কঠিন শাস্তির সতর্কবাণী ঘোষিত হয়েছে সেগুলো কবীরা গুনাহ।
ইমামুল হারামায়ন রহ. বলেন, যেসকল অপরাধ দীনের প্রতি ব্যক্তির বিশেষ তোয়াক্কা না থাকা এবং দীনদারীতে তার ঘাটতি থাকার ইঙ্গিত বহন করে সেগুলোই কবীরা গুনাহ।
কোন্ কোন্ অপরাধ কবীরা গুনাহ এ সম্পর্কে উলামায়ে কেরামের অনেকেই পৃথক কিতাব লিখেছেন। তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা সুন্দর ও পূর্ণাঙ্গ হলো মুহাক্কিক শিহাবুদ্দীন আহমাদ ইবন হাজার হায়তামী রহ.-এর লেখা আয-যাওয়াজির ‘আন ইকতিরাফিল কাবাইর।
এ হাদীছে চারটি বিষয়কে সর্বাপেক্ষা বড় কবীরা গুনাহ বলা হয়েছে- আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করা, পিতা-মাতার অবাধ্যতা করা, মিথ্যা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া।
আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করা
সর্বপ্রথম বলা হয়েছে— الإشراك بالله (আল্লাহর সঙ্গে শরীক করা)। এর দ্বারা বোঝানে উদ্দেশ্য সর্বপ্রকার কুফরী কর্ম। যেমন আল্লাহ তাআলার অস্তিত্ব অস্বীকার করা, দেব-দেবীর পূজা করা, আল্লাহর দেওয়া দীন প্রত্যাখ্যান করা, নবী-রাসূলকে অমান্য করা, কুরআন মাজীদকে আল্লাহ তাআলার কালাম বলে স্বীকার না করা ইত্যাদি।
যে ব্যক্তি শিরকে লিপ্ত হয় এবং মুশরিক অবস্থায় মারা যায়, তার পরিণাম স্থায়ী জাহান্নামবাস। তাকে কখনও ক্ষমা করা হবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدِ افْتَرَى إِثْمًا عَظِيمًا ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ এ বিষয়কে ক্ষমা করেন না যে, তার সঙ্গে কাউকে শরীক করা হবে। এর চেয়ে নিচের যে-কোনও বিষয়ে যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করে, সে এক গুরুতর পাপে লিপ্ত হলো।১২৬
আরও ইরশাদ হয়েছে إِنَّهُ مَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ 'নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে (কাউকে) শরীক করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন। তার ঠিকানা জাহান্নাম।১২৭
পিতা-মাতার অবাধ্যতা করা
দ্বিতীয় পর্যায়ে বলা হয়েছে- عقوق الوالدين(পিতা-মাতার অবাধ্যতা করা)। কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াতে আল্লাহ তাআলার ইবাদত-বন্দেগী করার পরই পিতা-মাতার আনুগত্য করার হুকুম দেওয়া হয়েছে। তা দ্বারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে আল্লাহ তাআলার ইবাদতের পর সর্বাপেক্ষা বেশি গুরুত্বপূর্ণ ফরয হলো পিতা-মাতার আনুগত্য করা। তা দ্বারা স্বাভাবিকভাবেই এটাও বোঝা যায় যে, আল্লাহ তাআলার ইবাদত-বন্দেগী না করা তথা কুফরীকর্ম করা সবচে' ভয়ংকর পাপ এবং তার পরপরই গুরুতর পাপ হলো পিতা-মাতার অবাধ্যতা। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ হাদীছে সেটিই স্পষ্ট করে দিলেন যে, আল্লাহ তাআলার সঙ্গে কাউকে শরীক করা সর্বোচ্চ পর্যায়ের কবীরা গুনাহ এবং তারপর হলো পিতা-মাতার অবাধ্যতা করা। অপর এক হাদীছে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
ثلاثة لا ينظر الله عز وجل إليهم يوم القيامة: العاق لوالديه، والمرأة المترجلة والديوث، وثلاثة لا يدخلون الجنة : العاق لوالديه، والمدمن على الخمر، والمنان بما أعطى
'তিন ব্যক্তি এমন, যাদের প্রতি আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন (রহমতের) দৃষ্টি দেবেন না- পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান, পুরুষের বেশধারী নারী ও স্ত্রীকে বেপর্দায় ছেড়ে দেওয়া পুরুষ। এবং তিন ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না- পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান, মদ্যপায়ী ও দান করার পর তা নিয়ে খোটা দানকারী।১২৮
মিথ্যা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া
তৃতীয় ও চতুর্থ পর্যায়ে বলেছেন- ألا وقول الزور وشهادة الزور (শোন, এবং মিথ্যা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া)। মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়াও মিথ্যা বলাই বটে। তা সত্ত্বেও এটিকে আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়েছে এ কারণে যে, সাধারণ মিথ্যা বলা অপেক্ষা মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া অধিকতর অনিষ্টকর। কেননা এর দ্বারা বিচারককে বিভ্রান্ত করা হয়। স্বার্থান্বেষী মহল মিথ্যা সাক্ষ্যের মাধ্যমে বান্দার অধিকার খর্ব করে এবং তাকে তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। অনেক সময় সাধারণ মিথ্যার দ্বারাও অন্যের অধিকার হরণ করা হয় বটে, কিন্তু তার পেছনে আইনের পোষকতা থাকে না। ফলে আইন-আদালতের আশ্রয় নিয়ে তার পক্ষে তার হারানো অধিকার ফিরে পাওয়ার সুযোগ থাকে। পক্ষান্তরে মিথ্যা সাক্ষ্য দ্বারা যে অধিকার হরণ করা হয়, তাতে যেহেতু আইন আদালত ব্যবহার করা হয়ে থাকে, সে কারণে অধিকারবঞ্চিত ব্যক্তির পক্ষে তার অধিকার ফিরে পাওয়া দুরূহ হয়ে যায়।
বস্তুত মিথ্যা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া একটি সামাজিক অপরাধ। এটা সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট করে। তাই এর প্রতি বাড়তি গুরুত্বারোপের জন্য নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথাটি বলার সময় নিজ ভাবভঙ্গির পরিবর্তন করেছেন। এর আগে তিনি হেলান দেওয়া অবস্থায় ছিলেন। কিন্তু এ কথাটি বলার সময় তিনি সোজা হয়ে বসেন, যাতে শ্রোতার উপর স্বতন্ত্র প্রভাব পড়ে এবং তারা মিথ্যা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার মন্দত্ব গভীরভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। এমনকি তিনি এ উপলব্ধিকে তাদের অন্তরে বদ্ধমূল করে দেওয়ার জন্য কথাটির বার বার পুনরাবৃত্তিও করতে থাকেন। বর্ণনাকারী সাহাবী বলেন فما زال يكررها ، حتى قلنا : ليته سكت (তিনি এ কথা বার বার বলতে থাকলেন। এমনকি আমরা বলতে লাগলাম, আহা! তিনি যদি ক্ষান্ত হতেন!)। তাঁরা তাঁর ক্ষান্ত হয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা করেছিলেন তাঁর প্রতি মমত্ববশত। তাঁরা লক্ষ করছিলেন কথাটির একাধারে পুনরাবৃত্তি করে যাওয়ায় তাঁর যথেষ্ট মানসিক ও দৈহিক কষ্ট হচ্ছে। বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে কোনও কথার বার বার পুনরাবৃত্তি ক্লান্তিকর বটে। এটা মুখ ও জবানের পক্ষে যথেষ্ট কষ্টদায়ক হয়ে থাকে। সাহাবায়ে কেরামের পক্ষে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ কষ্ট অসহনীয় বোধ হচ্ছিল। সন্দেহ নেই এটি তাঁদের গভীর নবীপ্রেমের পরিচায়ক। এর দ্বারা তাঁর প্রতি তাঁদের আদব রক্ষার প্রযত্নও উপলব্ধি করা যায়।
প্রশ্ন হতে পারে, যে-কোনও জিনিস সবচে' বড় তো একটিই হতে পারে, সে হিসেবে সবচে' বড় গুনাহও একটিই হবে বৈকি, আর তা হবে কেবলই আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করা, সুতরাং এ হাদীছে অনেকগুলো বিষয়কে সবচে' বড় পাপ কিভাবে বলা হলো?
উত্তর এই যে, আক্ষরিক অর্থে সবচে' বড় একটিই হতে পারে এ কথা সত্য। কিন্তু সবচে' বড় হওয়ার বিষয়টিকে যদি আপেক্ষিক ধরা হয়, তবে তা একাধিকও হতে পারে। এস্থলে মূলত আপেক্ষিক অর্থে সবচে' বড় গুনাহ বোঝানোই উদ্দেশ্য। অর্থাৎ অন্যান্য গুনাহের তুলনায় যেসব গুনাহ বেশি বড় তা হলো এই এই।
আরও কয়েকটি মহাপাপ
প্রকাশ থাকে যে, সবচে' বড় কবীরা গুনাহ কেবল এ চারটিই নয়; আরও আছে। যেমন এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
اجتنبوا السبع الموبقات، قالوا: يا رسول الله وما هنّ؟ قال: الشرك بالله، والسحر وقتل النفس التي حرم الله إلا بالحق، وأكل الربا، وأكل مال اليتيم، والتولي يوم الزحف، وقذف المحصنات المؤمنات الغافلات
“তোমরা ধ্বংসাত্মক সাতটি কর্ম হতে বাঁচ। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তা কী? তিনি বললেন, আল্লাহর সঙ্গে শিরক করা; জাদু করা; আল্লাহ যাকে হত্যা করা নিষিদ্ধ করেছেন তাকে হত্যা করা, অবশ্য ন্যায়সঙ্গতভাবে হলে (অর্থাৎ শরীআতের বিধান মোতাবেক হলে) ভিন্ন কথা; সুদ খাওয়া; ইয়াতীমের সম্পদ গ্রাস করা; যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করা এবং সরলা চরিত্রবর্তী মুমিন নারীর প্রতি (ব্যভিচারের) অপবাদ দেওয়া।১২৯
অপর এক হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
إن من أكبر الكبائر استطالة المرء في عرض رجل مسلم بغير حق، ومن الكبائر السبتان بالسبة
'সবচে বড় কবীরা গুনাহ হলো অন্যায়ভাবে মুসলিম ভাইয়ের সম্মানের উপর আঘাত করা। এক গালির বদলে দুই গালি দেওয়াও মহাপাপ।১৩০
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'ঊদ রাযি. বর্ণিত একটি হাদীছে আছে-
قلت: فأي الكبائر أكبر؟ قال: «أن تجعل لله ندا وهو خلقك»، قلت: ثم أي؟ قال: «أن تقتل ولدك من أجل أن يأكل معك»، قلت: ثم أي؟ قال: «ثم أن تزاني بحليلة جارك»، ثم تلا رسول اللہ ﷺ وَالَّذِينَ لَا يَدْعُونَ مَعَ اللَّهِ إِلَهًا آخَرَ وَلَا يَقْتُلُونَ النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللَّهُ إِلَّا بِالْحَقِّ وَلَا يَزْنُونَ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ يَلْقَ أَثَامًا »
'আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কোন্ কবীরা গুনাহ অধিকতর বড়? তিনি বললেন, যে আল্লাহ তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, অন্য কাউকে তাঁর সমকক্ষ বানানো। জিজ্ঞেস করলাম, তারপর? তিনি বললেন, নিজ সন্তানকে এ কারণে হত্যা করা যে, সে তোমার সঙ্গে খাওয়ায় শরীক হবে। জিজ্ঞেস করলাম, তারপর? তিনি বললেন, প্রতিবেশীর স্ত্রীর সঙ্গে ব্যভিচার করা। এই বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিলাওয়াত করলেন—
وَالَّذِينَ لَا يَدْعُونَ مَعَ اللَّهِ إِلَهًا آخَرَ وَلَا يَقْتُلُونَ النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللَّهُ إِلَّا بِالْحَقِّ وَلَا يَزْنُونَ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ يَلْقَ أَثَامًا
এবং যারা আল্লাহর সঙ্গে অন্য কোনও মাবুদের ইবাদত করে না এবং আল্লাহ যে প্রাণকে মর্যাদা দান করেছেন, তাকে অন্যায়ভাবে বধ করে না এবং তারা ব্যভিচার করে না। যে ব্যক্তিই এরূপ করবে তাকে তার গুনাহের (শাস্তির) সম্মুখীন হতে হবে' –সূরা ফুরকান, আয়াত ৬৮।১৩১
বিভিন্ন হাদীছে আরও কিছু গুনাহকে বড় কবীরা গুনাহ সাব্যস্ত করা হয়েছে। বোঝা যাচ্ছে সর্বাপেক্ষা বড় কবীরা গুনাহ অনেকগুলোই আছে। তা সত্ত্বেও এ হাদীছে মাত্র চারটি উল্লেখ করা হয়েছে। এটা ইসলামী শিক্ষার একটি পদ্ধতি যে, কোনও বিষয়েরই সবগুলো কথা একসঙ্গে বলা হয় না, যাতে শ্রোতার কাছে চাপবোধ না হয়। বরং ব্যক্তি ও স্থান অনুযায়ী যখন যা প্রয়োজন বোধ হত, তখন সে সম্পর্কে শিক্ষাদান করতেন। এ হাদীছেও চারটি বৃহত্তম কবীরা গুনাহের উল্লেখ সম্ভবত ব্যক্তি বা সময়ের চাহিদা অনুযায়ীই করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, সর্বাপেক্ষা বড় গুনাহগুলো পৃথকভাবে উল্লেখ করে দেওয়ার উদ্দেশ্য এছাড়া আর কিছুই নয় যে, আমরা যেন সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে এগুলো থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করি। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছে সর্বাপেক্ষা বড় যে গুনাহগুলো উল্লেখ করা হলো, আমাদেরকে অবশ্যই তা থেকে বেঁচে থাকতে হবে।
খ. শিরক ও কুফরের পর পিতা-মাতার অবাধ্যতা সর্বাপেক্ষা বড় গুনাহগুলোর একটি।
গ. মিথ্যা কথা বলা বিশেষত মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া অত্যন্ত ভয়ানক পাপ। এর থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে।
ঘ. ওয়াজ-নসীহতকালে গুরুত্বপূর্ণ আদেশ-উপদেশ পুনরাবৃত্তি করা ভালো। তা অন্তরে প্রভাব সৃষ্টিতে সহায়ক হয়।
১২৪. সূরা নিসা (৪), আয়াত ৩১
১২৫. সূরা নাজম (৫৩), আয়াত ৩২
১২৬. সূরা নিসা (৪), আয়াত ৪৮
১২৭.সূরা মায়িদা (৫), আয়াত ৭২
১২৮. সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ২৫৬২; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৭৩৪০; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ১৩১৮০; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৭৩৪২; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৭৪১৭
১২৯. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ২৭৬৬; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৮৯; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৩৬৭১; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ২৮৭৪; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৫৫৬১; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১২৬৬৭; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ২৮০; বাগাবী শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ৪৫;
১৩০. সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৮৭৭
১৩১. মুসনাদুল হুমাইদী, হাদীছ নং ১০৩
কেউ কেউ সগীরা গুনাহ'র অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন। তাদের মতে সব গুনাহই কবীরা। কিন্তু কুরআন-হাদীছের ভাষ্যের প্রতি লক্ষ করলে তা সঠিক মনে হয় না। কেননা কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা স্পষ্টভাবেই কবীরা গুনাহ'র উল্লেখ করেছেন। যেমন ইরশাদ হয়েছে-
إِنْ تَجْتَنِبُوا كَبَائِرَ مَا تُنْهَوْنَ عَنْهُ نُكَفِّرْ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَنُدْخِلْكُمْ مُدْخَلًا كَرِيمًا
‘তোমাদেরকে যেই বড় বড় গুনাহ করতে নিষেধ করা হয়েছে, তোমরা যদি তা পরিহার করে চল, তবে আমি নিজেই তোমাদের ছোট ছোট গুনাহ তোমাদের থেকে মিটিয়ে দেব এবং তোমাদেরকে এক মর্যাদাপূর্ণ স্থানে দাখিল করব ।১২৪
আরও ইরশাদ হয়েছে الَّذِينَ يَجْتَنِبُونَ كَبَائِرَ الْإِثْمِ وَالْفَوَاحِشَ إِلَّا اللَّمَمَ إِنَّ رَبَّكَ وَاسِعُ الْمَغْفِرَةِ “সেইসব লোককে, যারা বড়-বড় গুনাহ ও অশ্লীল কাজ থেকে বেঁচে থাকে, অবশ্য কদাচিৎ পিছলে পড়লে সেটা ভিন্ন কথা। নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক প্রশস্ত ক্ষমাশীল।১২৫
এর দ্বারা স্পষ্ট হয়ে যায় কতক গুনাহ ছোটও আছে। তবে এ কথা সত্য যে, ছোট গুনাহকে তাচ্ছিল্য করলে তখন আর তা ছোট থাকে না। কেননা এটা আল্লাহ তাআলার প্রতি ধৃষ্টতা প্রদর্শনের নামান্তর।
কবীরা গুনাহ কাকে বলে, উলামায়ে কেরাম তা বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তবে সব ব্যাখ্যারই সারকথা একই। তা এই যে, কুরআন ও হাদীছে যেসকল গুনাহকে কবীরা গুনাহ, জুলুম, ধ্বংসাত্মক ইত্যাদি গুরুতরতাজ্ঞাপক বিশেষণে বিশেষিত করা হয়েছে কিংবা যেসব অপরাধ সম্পর্কে কঠিন শাস্তির সতর্কবাণী ঘোষিত হয়েছে সেগুলো কবীরা গুনাহ।
ইমামুল হারামায়ন রহ. বলেন, যেসকল অপরাধ দীনের প্রতি ব্যক্তির বিশেষ তোয়াক্কা না থাকা এবং দীনদারীতে তার ঘাটতি থাকার ইঙ্গিত বহন করে সেগুলোই কবীরা গুনাহ।
কোন্ কোন্ অপরাধ কবীরা গুনাহ এ সম্পর্কে উলামায়ে কেরামের অনেকেই পৃথক কিতাব লিখেছেন। তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা সুন্দর ও পূর্ণাঙ্গ হলো মুহাক্কিক শিহাবুদ্দীন আহমাদ ইবন হাজার হায়তামী রহ.-এর লেখা আয-যাওয়াজির ‘আন ইকতিরাফিল কাবাইর।
এ হাদীছে চারটি বিষয়কে সর্বাপেক্ষা বড় কবীরা গুনাহ বলা হয়েছে- আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করা, পিতা-মাতার অবাধ্যতা করা, মিথ্যা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া।
আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করা
সর্বপ্রথম বলা হয়েছে— الإشراك بالله (আল্লাহর সঙ্গে শরীক করা)। এর দ্বারা বোঝানে উদ্দেশ্য সর্বপ্রকার কুফরী কর্ম। যেমন আল্লাহ তাআলার অস্তিত্ব অস্বীকার করা, দেব-দেবীর পূজা করা, আল্লাহর দেওয়া দীন প্রত্যাখ্যান করা, নবী-রাসূলকে অমান্য করা, কুরআন মাজীদকে আল্লাহ তাআলার কালাম বলে স্বীকার না করা ইত্যাদি।
যে ব্যক্তি শিরকে লিপ্ত হয় এবং মুশরিক অবস্থায় মারা যায়, তার পরিণাম স্থায়ী জাহান্নামবাস। তাকে কখনও ক্ষমা করা হবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدِ افْتَرَى إِثْمًا عَظِيمًا ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ এ বিষয়কে ক্ষমা করেন না যে, তার সঙ্গে কাউকে শরীক করা হবে। এর চেয়ে নিচের যে-কোনও বিষয়ে যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করে, সে এক গুরুতর পাপে লিপ্ত হলো।১২৬
আরও ইরশাদ হয়েছে إِنَّهُ مَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ 'নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে (কাউকে) শরীক করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন। তার ঠিকানা জাহান্নাম।১২৭
পিতা-মাতার অবাধ্যতা করা
দ্বিতীয় পর্যায়ে বলা হয়েছে- عقوق الوالدين(পিতা-মাতার অবাধ্যতা করা)। কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াতে আল্লাহ তাআলার ইবাদত-বন্দেগী করার পরই পিতা-মাতার আনুগত্য করার হুকুম দেওয়া হয়েছে। তা দ্বারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে আল্লাহ তাআলার ইবাদতের পর সর্বাপেক্ষা বেশি গুরুত্বপূর্ণ ফরয হলো পিতা-মাতার আনুগত্য করা। তা দ্বারা স্বাভাবিকভাবেই এটাও বোঝা যায় যে, আল্লাহ তাআলার ইবাদত-বন্দেগী না করা তথা কুফরীকর্ম করা সবচে' ভয়ংকর পাপ এবং তার পরপরই গুরুতর পাপ হলো পিতা-মাতার অবাধ্যতা। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ হাদীছে সেটিই স্পষ্ট করে দিলেন যে, আল্লাহ তাআলার সঙ্গে কাউকে শরীক করা সর্বোচ্চ পর্যায়ের কবীরা গুনাহ এবং তারপর হলো পিতা-মাতার অবাধ্যতা করা। অপর এক হাদীছে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
ثلاثة لا ينظر الله عز وجل إليهم يوم القيامة: العاق لوالديه، والمرأة المترجلة والديوث، وثلاثة لا يدخلون الجنة : العاق لوالديه، والمدمن على الخمر، والمنان بما أعطى
'তিন ব্যক্তি এমন, যাদের প্রতি আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন (রহমতের) দৃষ্টি দেবেন না- পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান, পুরুষের বেশধারী নারী ও স্ত্রীকে বেপর্দায় ছেড়ে দেওয়া পুরুষ। এবং তিন ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না- পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান, মদ্যপায়ী ও দান করার পর তা নিয়ে খোটা দানকারী।১২৮
মিথ্যা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া
তৃতীয় ও চতুর্থ পর্যায়ে বলেছেন- ألا وقول الزور وشهادة الزور (শোন, এবং মিথ্যা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া)। মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়াও মিথ্যা বলাই বটে। তা সত্ত্বেও এটিকে আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়েছে এ কারণে যে, সাধারণ মিথ্যা বলা অপেক্ষা মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া অধিকতর অনিষ্টকর। কেননা এর দ্বারা বিচারককে বিভ্রান্ত করা হয়। স্বার্থান্বেষী মহল মিথ্যা সাক্ষ্যের মাধ্যমে বান্দার অধিকার খর্ব করে এবং তাকে তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। অনেক সময় সাধারণ মিথ্যার দ্বারাও অন্যের অধিকার হরণ করা হয় বটে, কিন্তু তার পেছনে আইনের পোষকতা থাকে না। ফলে আইন-আদালতের আশ্রয় নিয়ে তার পক্ষে তার হারানো অধিকার ফিরে পাওয়ার সুযোগ থাকে। পক্ষান্তরে মিথ্যা সাক্ষ্য দ্বারা যে অধিকার হরণ করা হয়, তাতে যেহেতু আইন আদালত ব্যবহার করা হয়ে থাকে, সে কারণে অধিকারবঞ্চিত ব্যক্তির পক্ষে তার অধিকার ফিরে পাওয়া দুরূহ হয়ে যায়।
বস্তুত মিথ্যা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া একটি সামাজিক অপরাধ। এটা সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট করে। তাই এর প্রতি বাড়তি গুরুত্বারোপের জন্য নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথাটি বলার সময় নিজ ভাবভঙ্গির পরিবর্তন করেছেন। এর আগে তিনি হেলান দেওয়া অবস্থায় ছিলেন। কিন্তু এ কথাটি বলার সময় তিনি সোজা হয়ে বসেন, যাতে শ্রোতার উপর স্বতন্ত্র প্রভাব পড়ে এবং তারা মিথ্যা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার মন্দত্ব গভীরভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। এমনকি তিনি এ উপলব্ধিকে তাদের অন্তরে বদ্ধমূল করে দেওয়ার জন্য কথাটির বার বার পুনরাবৃত্তিও করতে থাকেন। বর্ণনাকারী সাহাবী বলেন فما زال يكررها ، حتى قلنا : ليته سكت (তিনি এ কথা বার বার বলতে থাকলেন। এমনকি আমরা বলতে লাগলাম, আহা! তিনি যদি ক্ষান্ত হতেন!)। তাঁরা তাঁর ক্ষান্ত হয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা করেছিলেন তাঁর প্রতি মমত্ববশত। তাঁরা লক্ষ করছিলেন কথাটির একাধারে পুনরাবৃত্তি করে যাওয়ায় তাঁর যথেষ্ট মানসিক ও দৈহিক কষ্ট হচ্ছে। বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে কোনও কথার বার বার পুনরাবৃত্তি ক্লান্তিকর বটে। এটা মুখ ও জবানের পক্ষে যথেষ্ট কষ্টদায়ক হয়ে থাকে। সাহাবায়ে কেরামের পক্ষে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ কষ্ট অসহনীয় বোধ হচ্ছিল। সন্দেহ নেই এটি তাঁদের গভীর নবীপ্রেমের পরিচায়ক। এর দ্বারা তাঁর প্রতি তাঁদের আদব রক্ষার প্রযত্নও উপলব্ধি করা যায়।
প্রশ্ন হতে পারে, যে-কোনও জিনিস সবচে' বড় তো একটিই হতে পারে, সে হিসেবে সবচে' বড় গুনাহও একটিই হবে বৈকি, আর তা হবে কেবলই আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করা, সুতরাং এ হাদীছে অনেকগুলো বিষয়কে সবচে' বড় পাপ কিভাবে বলা হলো?
উত্তর এই যে, আক্ষরিক অর্থে সবচে' বড় একটিই হতে পারে এ কথা সত্য। কিন্তু সবচে' বড় হওয়ার বিষয়টিকে যদি আপেক্ষিক ধরা হয়, তবে তা একাধিকও হতে পারে। এস্থলে মূলত আপেক্ষিক অর্থে সবচে' বড় গুনাহ বোঝানোই উদ্দেশ্য। অর্থাৎ অন্যান্য গুনাহের তুলনায় যেসব গুনাহ বেশি বড় তা হলো এই এই।
আরও কয়েকটি মহাপাপ
প্রকাশ থাকে যে, সবচে' বড় কবীরা গুনাহ কেবল এ চারটিই নয়; আরও আছে। যেমন এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
اجتنبوا السبع الموبقات، قالوا: يا رسول الله وما هنّ؟ قال: الشرك بالله، والسحر وقتل النفس التي حرم الله إلا بالحق، وأكل الربا، وأكل مال اليتيم، والتولي يوم الزحف، وقذف المحصنات المؤمنات الغافلات
“তোমরা ধ্বংসাত্মক সাতটি কর্ম হতে বাঁচ। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তা কী? তিনি বললেন, আল্লাহর সঙ্গে শিরক করা; জাদু করা; আল্লাহ যাকে হত্যা করা নিষিদ্ধ করেছেন তাকে হত্যা করা, অবশ্য ন্যায়সঙ্গতভাবে হলে (অর্থাৎ শরীআতের বিধান মোতাবেক হলে) ভিন্ন কথা; সুদ খাওয়া; ইয়াতীমের সম্পদ গ্রাস করা; যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করা এবং সরলা চরিত্রবর্তী মুমিন নারীর প্রতি (ব্যভিচারের) অপবাদ দেওয়া।১২৯
অপর এক হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
إن من أكبر الكبائر استطالة المرء في عرض رجل مسلم بغير حق، ومن الكبائر السبتان بالسبة
'সবচে বড় কবীরা গুনাহ হলো অন্যায়ভাবে মুসলিম ভাইয়ের সম্মানের উপর আঘাত করা। এক গালির বদলে দুই গালি দেওয়াও মহাপাপ।১৩০
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'ঊদ রাযি. বর্ণিত একটি হাদীছে আছে-
قلت: فأي الكبائر أكبر؟ قال: «أن تجعل لله ندا وهو خلقك»، قلت: ثم أي؟ قال: «أن تقتل ولدك من أجل أن يأكل معك»، قلت: ثم أي؟ قال: «ثم أن تزاني بحليلة جارك»، ثم تلا رسول اللہ ﷺ وَالَّذِينَ لَا يَدْعُونَ مَعَ اللَّهِ إِلَهًا آخَرَ وَلَا يَقْتُلُونَ النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللَّهُ إِلَّا بِالْحَقِّ وَلَا يَزْنُونَ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ يَلْقَ أَثَامًا »
'আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কোন্ কবীরা গুনাহ অধিকতর বড়? তিনি বললেন, যে আল্লাহ তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, অন্য কাউকে তাঁর সমকক্ষ বানানো। জিজ্ঞেস করলাম, তারপর? তিনি বললেন, নিজ সন্তানকে এ কারণে হত্যা করা যে, সে তোমার সঙ্গে খাওয়ায় শরীক হবে। জিজ্ঞেস করলাম, তারপর? তিনি বললেন, প্রতিবেশীর স্ত্রীর সঙ্গে ব্যভিচার করা। এই বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিলাওয়াত করলেন—
وَالَّذِينَ لَا يَدْعُونَ مَعَ اللَّهِ إِلَهًا آخَرَ وَلَا يَقْتُلُونَ النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللَّهُ إِلَّا بِالْحَقِّ وَلَا يَزْنُونَ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ يَلْقَ أَثَامًا
এবং যারা আল্লাহর সঙ্গে অন্য কোনও মাবুদের ইবাদত করে না এবং আল্লাহ যে প্রাণকে মর্যাদা দান করেছেন, তাকে অন্যায়ভাবে বধ করে না এবং তারা ব্যভিচার করে না। যে ব্যক্তিই এরূপ করবে তাকে তার গুনাহের (শাস্তির) সম্মুখীন হতে হবে' –সূরা ফুরকান, আয়াত ৬৮।১৩১
বিভিন্ন হাদীছে আরও কিছু গুনাহকে বড় কবীরা গুনাহ সাব্যস্ত করা হয়েছে। বোঝা যাচ্ছে সর্বাপেক্ষা বড় কবীরা গুনাহ অনেকগুলোই আছে। তা সত্ত্বেও এ হাদীছে মাত্র চারটি উল্লেখ করা হয়েছে। এটা ইসলামী শিক্ষার একটি পদ্ধতি যে, কোনও বিষয়েরই সবগুলো কথা একসঙ্গে বলা হয় না, যাতে শ্রোতার কাছে চাপবোধ না হয়। বরং ব্যক্তি ও স্থান অনুযায়ী যখন যা প্রয়োজন বোধ হত, তখন সে সম্পর্কে শিক্ষাদান করতেন। এ হাদীছেও চারটি বৃহত্তম কবীরা গুনাহের উল্লেখ সম্ভবত ব্যক্তি বা সময়ের চাহিদা অনুযায়ীই করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, সর্বাপেক্ষা বড় গুনাহগুলো পৃথকভাবে উল্লেখ করে দেওয়ার উদ্দেশ্য এছাড়া আর কিছুই নয় যে, আমরা যেন সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে এগুলো থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করি। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছে সর্বাপেক্ষা বড় যে গুনাহগুলো উল্লেখ করা হলো, আমাদেরকে অবশ্যই তা থেকে বেঁচে থাকতে হবে।
খ. শিরক ও কুফরের পর পিতা-মাতার অবাধ্যতা সর্বাপেক্ষা বড় গুনাহগুলোর একটি।
গ. মিথ্যা কথা বলা বিশেষত মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া অত্যন্ত ভয়ানক পাপ। এর থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে।
ঘ. ওয়াজ-নসীহতকালে গুরুত্বপূর্ণ আদেশ-উপদেশ পুনরাবৃত্তি করা ভালো। তা অন্তরে প্রভাব সৃষ্টিতে সহায়ক হয়।
১২৪. সূরা নিসা (৪), আয়াত ৩১
১২৫. সূরা নাজম (৫৩), আয়াত ৩২
১২৬. সূরা নিসা (৪), আয়াত ৪৮
১২৭.সূরা মায়িদা (৫), আয়াত ৭২
১২৮. সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ২৫৬২; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৭৩৪০; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ১৩১৮০; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৭৩৪২; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৭৪১৭
১২৯. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ২৭৬৬; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৮৯; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৩৬৭১; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ২৮৭৪; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৫৫৬১; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১২৬৬৭; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ২৮০; বাগাবী শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ৪৫;
১৩০. সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৮৭৭
১৩১. মুসনাদুল হুমাইদী, হাদীছ নং ১০৩
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)


বর্ণনাকারী: