রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ৩৩২
পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার ও আত্মীয়তা রক্ষা করা
আত্মীয়-স্বজনকে দান-খয়রাত করলে দ্বিগুণ ছাওয়াব
হাদীছ নং : ৩৩২

হযরত সালমান ইবন ‘আমির রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমাদের কেউ যখন ইফতার করে, সে যেন খেজুর দ্বারা ইফতার করে, কেননা এটা বরকত। খেজুর না পেলে পানি দ্বারা, কেননা এটা পবিত্রকারক। তিনি আরও বলেন, মিসকিনকে দান করা কেবলই দান। আর আত্মীয়স্বজনকে দান করলে দুটি হয়, এক তো দান এবং আরেক হচ্ছে আত্মীয়ের প্রতি সৌজন্য -তিরমিযী।
জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ৬৫৮; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ২৫৮২; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ৩৩৪৪; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৬২৩৩; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ১৮৪৪; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বাহ, হাদীছ নং ১০৫৪১; তাবারানী, আল-মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ৪৭২৩; মুসনাদুল হুমাইদী, হাদীছ নং ৮৪৪
40 - باب بر الوالدين وصلة الأرحام
332 - وعن سلمان بن عامر - رضي الله عنه - عن النَّبيّ - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «إِذَا أَفْطَرَ أَحَدُكُمْ، فَلْيُفْطرْ عَلَى تَمْرٍ؛ فَإنَّهُ بَرَكةٌ، فَإنْ لَمْ يَجِدْ تَمْرًا، فالمَاءُ؛ فَإنَّهُ طَهُورٌ»، وَقالَ: «الصَّدَقَةُ عَلَى المِسكينِ صَدَقةٌ، وعَلَى ذِي الرَّحِمِ ثِنْتَانِ: صَدَقَةٌ وَصِلَةٌ». رواه الترمذي، (1) وَقالَ: «حديث حسن».

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু'টি বিষয়ে শিক্ষাদান করেছেন- ইফতার ও দান-খয়রাত। ইফতার সম্পর্কে বলেছেন যে, তোমরা ইফতার করবে খেজুর দিয়ে। কেননা এতে বরকত আছে। বরকত বলা হয় যে বস্তু যে কাজের, তার অল্প পরিমাণ দ্বারাই সে কাজ পূরণ হয়ে যাওয়া। খেজুর এমন এক খাদ্য, যার অল্প দ্বারাই ক্ষুধা মেটে, দুর্বলতা দূর হয় ও যথেষ্ট পুষ্টি লাভ হয়। ইফতারকালে এ তিনওটি বিষয় প্রয়োজন। কেননা এ সময় অনেক ক্ষুধা থাকে। সারাদিন পানাহার থেকে বিরত থাকার ফলে শরীরে পুষ্টি সরবরাহ বন্ধ থাকে এবং শরীর দুর্বল হয়ে যায়। এ কারণে ইফতারে খেজুরের ব্যবহার সর্বাপেক্ষা বেশি উপযোগী। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেহেতু উৎসাহ দিয়েছেন, তাই খেজুর দ্বারা ইফতার করা মুস্তাহাবও বটে।

যদি খেজুর সহজে পাওয়া না যায়, তবে পানি দ্বারা ইফতার করবে। ইফতারে অন্য কোনও আয়োজন থাকলেও আগে পানি খেয়ে নেওয়া চাই। এতে করেও মুস্তাহাব আদায় হবে। যদি খেজুর ও পানি দু'টোই থাকে, তবে আগে খেজুর খেয়ে তারপর পানি খাওয়া উচিত।

প্রকাশ থাকে যে, ইফতার করা সুন্নতে মুআক্কাদা। এটা ইসলামী রোযার বিশেষত্ব।
আর এ সুন্নত আদায়ের মুস্তাহাব পন্থা হলো খেজুর বা পানি দ্বারা ইফতার করা। এ হাদীছে পানির বিশেষত্ব বলা হয়েছে যে, এটি طهور (পবিত্রকারক)। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

وَاَنْزَلْنَا مِنَ السَّمَاءِ مَاءً طَهُورًا

‘আমি তোমাদের জন্য আকাশ থেকে বর্ষণ করেছি পবিত্রকারী পানি।১১২

আরও ইরশাদ হয়েছে-

وَيُنَزِّلُ عَلَيْكُمْ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً لِيُطَهِّرَكُمْ بِهِ

‘তিনি আসমান থেকে তোমাদের প্রতি পানি বর্ষণ করেন তা দ্বারা তোমাদেরকে পবিত্র করার জন্য।১১৩

অর্থাৎ পানি ব্যবহার দ্বারা প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য নাপাকি দূর হয়ে যায়। ওযূ ও গোসল দ্বারা অপবিত্র শরীর পবিত্র হয়। বাহ্যিক এ পবিত্রতার প্রভাব অন্তরেও পড়ে। নিয়মিত ওযূ-গোসল করার দ্বারা গুনাহ মাফ হয় ও অন্তরের কলুষ দূর হয়। সুতরাং পানি বাহ্যিক ও গুপ্ত এবং দৃশ্য ও অদৃশ্য অপবিত্রতা থেকে পবিত্রকারক এক মহানিআমত।

দান-খয়রাত সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে যে, এটা গরীব-মিসকীনকে দিলে কেবল সদাকার ছাওয়াব পাওয়া যায়। আর আত্মীয়-স্বজনকে দিলে দ্বিগুণ ছাওয়াব হয়- এক তো দান-খয়রাতের ছাওয়াব, দ্বিতীয়ত আত্মীয়সেবার ছাওয়াব। এর দ্বারা আত্মীয়- স্বজনকে দান-খয়রাত করতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে এবং অন্যান্য গরীব-মিসকীনের উপর তাদের অগ্রাধিকার দিতে বলা হয়েছে।

এর দ্বারা বোঝা যায় আত্মীয়দের মধ্যে যে যতবেশি নিকটবর্তী, তাকে আর্থিকভাবে সাহায্য করাও ততবেশি গুরুত্বপূর্ণ ও ততবেশি উৎকৃষ্ট।

অবশ্য উলামায়ে কেরাম বলেন, অনাত্মীয় গরীব অপেক্ষা আত্মীয় গরীবকে দান করা সর্বাবস্থায়ই যে উত্তম তা নয়; অবস্থাবিশেষে এর ব্যতিক্রমও হতে পারে। যেমন আত্মীয় গরীব অপেক্ষা অনাত্মীয় গরীবের অর্থকষ্ট যদি বেশি হয়, সে ক্ষেত্রে অনাত্মীয় গরীবের কষ্ট দূর করাই বেশি জরুরি হবে। এমনিভাবে যদি অনাত্মীয় গরীবকে দান করার দ্বারা তার উপকার হওয়ার পাশাপাশি অন্যদেরও উপকারলাভের সম্ভাবনা থাকে, সে ক্ষেত্রেও তাকে দান করা বেশি উত্তম হবে। যেমন অনাত্মীয় গরীব ইলমে দীনের খেদমতে নিয়োজিত আছে। সে আয়-রোযগারে লেগে গেলে মানুষ তার দ্বারা দীনী উপকারলাভ থেকে বঞ্চিত হবে। এ ক্ষেত্রে সম্মানজনকভাবে অর্থসাহায্য করার দ্বারা তাকে আয়- রোযগারের ফিকির থেকে মুক্ত রাখা এবং একান্তভাবে ইলমে দীনের খেদমতে নিয়োজিত থাকার সুযোগ করে দেওয়া অধিকতর ছাওয়াবের কাজ বৈকি; বরং এটা সদাকায়ে জারিয়ারূপে গণ্য হবে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. খেজুর দ্বারা ইফতার করা মুস্তাহাব।

খ. খেজুর একটি বরকতপূর্ণ খাবার। এর বিশেষ মর্যাদা দেওয়া চাই।

গ. খেজুর পাওয়া না গেলে অন্যান্য ইফতারসামগ্রী খাওয়ার আগে পানি খেয়ে নেওয়া চাই।

ঘ. পানি প্রকাশ-অপ্রকাশ্য অপবিত্রতা থেকে মুক্তিলাভের এক মহামূল্যবান উপকরণ। এর মূল্য ও গুরুত্ব উপলব্ধি করা উচিত।

ঙ. আত্মীয়ের সেবা করা অতি গুরুত্বপূর্ণ আমল। দান-খয়রাতেও অন্যান্য গরীব-মিসকীন অপেক্ষা আত্মীয়দের অগ্রাধিকার দেওয়া চাই। এতে দ্বিগুণ ছাওয়াব।

১১২. সূরা ফুরকান (২৫), আয়াত ৪৮

১১৩. সূরা আনফাল (৮), আয়াত ১১
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
রিয়াযুস সালিহীন - হাদীস নং ৩৩২ | মুসলিম বাংলা