রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ২৫১
মানুষের মধ্যে মীমাংসা করে দেওয়ার গুরুত্ব ও ফযীলত।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক এক বিরোধ নিষ্পত্তিতে গমন ও আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর ইমামত
হাদীছ নং : ২৫১

হযরত সাহল ইবন সা'দ আস-সাইদী রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে সংবাদ পৌঁছল যে, বনু আওফ ইবন আমিরের লোকদের মধ্যে কলহ দেখা দিয়েছে। সুতরাং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কতিপয় সাহাবীকে নিয়ে তাদের মধ্যে মীমাংসা করার জন্য বের হয়ে পড়লেন। সেখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিলম্ব হয়ে গেল। এদিকে নামাযেরও সময় হয়ে গেল। তখন হযরত বিলাল রাযি. আবূ বকর রাযি.-এর কাছে এসে বললেন, হে আবূ বকর! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আটকা পড়ে গেছেন। এদিকে নামাযের সময় হয়ে গেছে। আপনি কি মানুষের নামাযে ইমামত করবেন? তিনি বললেন, হাঁ, তুমি যদি চাও। সুতরাং বিলাল রাযি. নামাযের ইকামত দিলেন এবং আবূ বকর রাযি. সামনে এগিয়ে গেলেন। তিনি আল্লাহু আকবার বললেন। লোকেরাও আল্লাহু আকবার বলল। এমন সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও এসে পড়লেন। তিনি কাতারের মাঝখান দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সামনের কাতারে এসে দাঁড়ালেন। লোকেরা হাতে তালি দিতে শুরু করল। কিন্তু আবূ বকর রাযি. নামাযে কোনওদিকে লক্ষ করতেন না। যখন লোকজন খুব বেশি তালি বাজাতে থাকল, তখন তিনি ফিরে তাকালেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখতে পেলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইশারায় তাঁকে নিজ স্থানে থাকতে বললেন। আবূ বকর রাযি. তাঁর হাত তুলে আল্লাহ তাআলার প্রশংসা করলেন এবং পেছন দিকে সরে আসলেন। তিনি এসে প্রথম কাতারে দাঁড়ালেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সামনে এগিয়ে গিয়ে লোকদের নিয়ে নামায পড়লেন। নামায শেষে তিনি লোকজনের দিকে মুখ করে বললেন, হে লোকসকল! তোমাদের কী হল যে, নামাযের মধ্যে কোনওকিছু ঘটলে তোমরা তালি বাজাতে শুরু কর? হাততালি দেওয়ার কাজটি তো মহিলাদের জন্য। কারও যদি নামাযের মধ্যে কিছু ঘটে, তবে সে যেন সুবহানাল্লাহ বলে। কেননা সে যখন সুবহানাল্লাহ বলবে, তখন যে তা শুনবে সে অবশ্যই তার দিকে লক্ষ করবে। হে আবূ বকর! আমি যখন তোমাকে ইশারা করলাম, তখন কোন্ জিনিস তোমাকে লোকদের নিয়ে নামায পড়তে বাধা দিল? আবূ বকর রাযি. বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে দাঁড়িয়ে লোকদের নিয়ে নামায পড়বে, এটা আবূ কুহাফার পুত্রের পক্ষে সমীচীন নয় -বুখারী ও মুসলিম।
সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬৮৪; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৪২১; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৭৮৪; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৯৪০; সহীহ ইবন খুযাইমা, হাদীছ নং ৮৭০; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ৫৬৯৩: বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৩৩২৯; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ৭৪৯
31 - باب الإصلاح بَيْنَ الناس
251 - وعن أَبي العباس سهل بن سَعد الساعِدِيّ - رضي الله عنه: أنَّ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - بَلَغَهُ أنَّ بَني عَمرو بن عَوْفٍ كَانَ بَيْنَهُمْ شَرٌّ، فَخَرَجَ رسولُ الله - صلى الله عليه وسلم - يُصْلِحُ بَينَهُمْ في أُنَاس مَعَهُ، فَحُبِسَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - وَحَانَتِ الصَّلاة، فَجَاءَ بِلالٌ إِلَى أَبي بكر رضي الله عنهما، فَقَالَ: يَا أَبا بَكْر، إنَّ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - قَدْ حُبِسَ وَحَانَتِ الصَّلاةُ فَهَلْ لَكَ أَنْ تَؤُمَّ النَّاس؟ قَالَ: نَعَمْ، إنْ شِئْتَ، فَأقَامَ بِلالٌ الصَّلاةَ، وتَقَدَّمَ أَبُو بَكْرٍ فَكَبَّرَ وَكَبَّرَ النَّاسُ، وَجَاءَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - يَمشي في الصُّفُوفِ حَتَّى قَامَ في الصَّفِّ، فَأَخَذَ النَّاسُ في التَّصْفيقِ، وَكَانَ أَبُو بكرٍ - رضي الله عنه - لاَ يَلْتَفِتُ في الصَّلاةِ، فَلَمَّا أكْثَرَ النَّاسُ في التَّصْفيقِ الْتَفَتَ، فإِذَا رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - فَأَشَارَ إِلَيْه رسولُ الله - صلى الله عليه وسلم - فَرَفَعَ أَبُو بَكْر - رضي الله عنه - يَدَهُ فَحَمِدَ اللهَ، وَرَجَعَ القَهْقَرَى (1) وَرَاءهُ حَتَّى قَامَ في الصَّفِّ، فَتَقَدَّمَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - فَصَلَّى للنَّاسِ، فَلَمَّا فَرَغَ أقْبَلَ عَلَى النَّاسِ، فَقَالَ: «أيُّهَا النَّاسُ، مَا لَكُمْ حِينَ نَابَكُمْ شَيْءٌ في الصَّلاةِ أخَذْتُمْ في التَّصفيق؟! إِنَّمَا التَّصفيق [ص:103] للنِّساء. مَنْ نَابَهُ شَيْءٌ في صَلاتِهِ فَلْيَقُلْ: سُبْحَانَ الله، فَإِنَّهُ لاَ يَسْمَعُهُ أحدٌ حِينَ يقُولُ: سُبْحَانَ الله، إلاَّ الْتَفَتَ. يَا أَبَا بَكْر: مَا مَنَعَكَ أَنْ تُصَلِّي بالنَّاسِ حِينَ أشَرْتُ إلَيْكَ؟»، فَقَالَ أَبُو بَكْرٍ: مَا كَانَ يَنْبَغي لابْنِ أَبي قُحَافَةَ أَنْ يُصَلِّي بالنَّاسِ بَيْنَ يَدَيْ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم. مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (2)
معنى «حُبِسَ»: أمْسَكُوهُ لِيُضِيفُوهُ.

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছ দ্বারা জানা যায়, আনসারদের একটি গোত্রের মধ্যে কলহ দেখা দিলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেখানে মীমাংসা করতে যান। তাঁর সেখান থেকে ফিরে আসতে দেরি হয়ে যায়। ইতোমধ্যে নামাযের ওয়াক্ত হয়ে যায়। ফলে তাঁর পরিবর্তে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর ইমামতিতে নামায শুরু করে দেওয়া হয়। নামায শেষ না হতেই তিনি ফিরে আসেন এবং মুসল্লীদের মাঝখান দিয়ে সামনের কাতারে চলে যান। প্রথমে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. সেদিকে লক্ষ করেননি। পরে যখন লোকজন অনবরত হাতে তালি দিতে থাকে, তখন তিনি পেছনে চলে আসেন এবং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইমাম হয়ে অবশিষ্ট নামায সমাপ্ত করেন।
এ হাদীছে যেহেতু বিবাদমান দুই পক্ষের মধ্যে আপস-নিষ্পত্তি করে দেওয়ার উল্লেখ আছে, সেই দৃষ্টিতে ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে হাদীছটি উদ্ধৃত করেছেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে গোত্রের বিবাদ মীমাংসার জন্য গিয়েছিলেন তার নাম বনূ আমর ইবন আওফ। এ গোত্রটি বিখ্যাত আওস গোত্রের একটি শাখা। আওস মদীনা মুনাউওয়ারার আনসারদের প্রধান দুই গোত্রের একটি। অপর গোত্রের নাম খাযরাজ। যাহোক আওস গোত্রের লোকজন কুবা অঞ্চলে বাস করত। বিবাদটি সেখানেই দেখা দিয়েছিল। এক বর্ণনায় আছে-

أن أهل قباء اقتتلوا حتى تراموا بالحجارة، فأخبر رسول الله صلى الله عليه وسلم بذلك، فقال: اذهبوا بنا نصلح بينهم

‘কুবাবাসী পরস্পর সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এমনকি তাদের মধ্যে পাথর ছোঁড়াছুঁড়ি শুরু হয়ে যায়। এ সংবাদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জানানো হলে তিনি বললেন, চল আমরা গিয়ে তাদের মধ্যে মীমাংসা করি।২৩৪
তাদের মধ্যে এ কলহ হয়েছিল দুপুরবেলা। তাবারানী রহ.-এর এক বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, এ সংবাদ যখন আসে তখন হযরত বিলাল রাযি. যোহরের আযান দিয়ে ফেলেছেন। ইমাম বুখারী রহ.-এর এক বর্ণনায় উল্লেখ আছে, তিনি সেখানে গিয়েছিলেন যোহরের নামায আদায় করার পর। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত উবাই ইবন কা'ব রাযি. সুহায়ল ইবন বাইদা রাযি. প্রমুখ সাহাবীকে নিয়ে সেখানে ছুটে গেলেন। স্বাভাবিকভাবেই দুই পক্ষের মধ্যে আপস-নিষ্পত্তি করতে সময় লেগে যায়। ততক্ষণে আসরের নামাযের ওয়াক্ত হয়ে যায়। মুসনাদে আহমাদ ও সুনানে আবূ দাউদের রেওয়ায়েত দ্বারা জানা যায়, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেখানে যাওয়ার সময় হযরত বিলাল রাযি. কে বলে গিয়েছিলেন, যদি আসরের ওয়াক্ত এসে যায় আর ততক্ষণে আমি ফিরে না আসি, তবে আবূ বকরকে নামাযের ইমামত করতে বলো। সুতরাং আসরের ওয়াক্ত হয়ে গেলে হযরত বিলাল রাযি আযান দিলেন, তারপর ইকামতও দিলেন এবং আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-কে ইমামত করতে বললেন। তিনি সামনে গিয়ে নামায শুরু করে দিলেন।২৩৫
আলোচ্য হাদীছে আছে, বিলাল রাযি. হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-কে লক্ষ্য করে বলেছিলেন- فهل لك أن تؤم الناس (আপনি কি মানুষের নামাযে ইমামত করবেন?)। প্রশ্ন হয়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যদি হযরত আবু বকর রাযি.-কে দিয়ে ইমামত করানোর হুকুমই দিয়ে থাকেন, তবে হযরত বিলাল রাযি, তাঁকে লক্ষ্য করে এ কথা কেন বলবেন?
প্রকৃতপক্ষে উভয় বর্ণনার মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। কেননা হযরত বিলাল রাযি.-এর প্রস্তাবনার অর্থ এরকম হতে পারে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো আপনাকে ইমামত করতে বলে গেছেন, এখন নামাযের ওয়াক্তও হয়ে গেছে, কাজেই আপনি কি এই শুরু ওয়াকেই নামায় আরম্ভ করে দেবেন, নাকি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এসে পড়েন কিনা সেজন্য একটু অপেক্ষা করবেন? হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. অপেক্ষা না করে নামায শুরুই করে দিলেন। কেননা তিনি কখন না কখন আসবেন তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। এদিকে মুস্তাহাব ওয়াক্ত হয়ে গেলে আর দেরি না করাই ভালো। তাই তিনি শুরু করাকেই প্রাধান্য দেন।

হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর শ্রেষ্ঠত্ব

লক্ষ্যণীয় যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইমামতীর জন্য আর কারও নাম না বলে হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি. এরই নাম বলেছেন। আর যদি তিনি বলে নাও গিয়ে থাকেন, হযরত বিলাল রাযি. ও অপরাপর সাহাবীগণ নিজেদের পক্ষ থেকে হযরত আবু বকর রাযি.-কেই ইমামতীর জন্য অগ্রগণ্য মনে করেছেন। এটা সুস্পষ্টরূপে প্রমাণ করে যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবীগণ হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-কে অন্য সকলের উপর অগ্রগণ্য মনে করতেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো তাঁর ওফাতপূর্ব নামাযসমূহে যথারীতি তাঁকেই ইমাম বানিয়েছিলেন। বলাবাহুল্য এ অগ্রগণ্যতাই ছিল। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাতের পর অবিসংবাদিতভাবে তাঁর ইমামত ও খেলাফতের পদে বরিত হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ।
নামায শুরুর একটু পরেই প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফিরে আসলেন। লোকজন হাততালি দিতে শুরু করল। কিন্তু হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি, সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলেন না। তিনি নামাযে কোনওদিক ভ্রুক্ষেপ করতেন না। কেননা নামাযে অন্যদিকে ভ্রুক্ষেপ করা নিষেধ। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে আছে-

سألت رسول الله صلى الله عليه وسلم عن الالتفات في الصلاة؟ فقال: هو اختلاس يختلسه الشيطان من صلاة العبد

'আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নামাযে এদিক-ওদিক ভ্রুক্ষেপ করা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, এটা শয়তানের থাবা। এর দ্বারা শয়তান বান্দার নামায থেকে একটা অংশ ছোঁ মেরে নিয়ে যায়।২৩৬
কিন্তু অনবরত হাততালি চলতে থাকলে অগত্যা তিনি ফিরে তাকালেন। অমনি দেখেন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাতারে দাঁড়ানো। তিনি পেছনে সরে আসতে চাইলেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইশারায় নিষেধ করলেন।
অতঃপর হাদীছে আছে-

فرفع أبو بكر رضى الله عنه يده فحمد الله ورجع القهقرى وراءه

(আবূ বকর রাযি, তাঁর হাত তুলে আল্লাহ তাআলার প্রশংসা করলেন এবং পেছন দিকে সরে আসলেন)। তিনি হাত তুলে আল্লাহর প্রশংসা করেছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষ থেকে বিশেষ মর্যাদালাভের কারণে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে তাঁকে নিজের সামনে দাঁড়িয়ে ইমামত করতে ইশারা করেছিলেন, এটা তাঁর পক্ষে এক বিরাট মর্যাদা বৈকি। আর সম্মান ও মর্যাদালাভও আল্লাহ তাআলার এক নিআমত। এজন্য তাঁর শোকর আদায় করা চাই।
তিনি আল্লাহর প্রশংসা কি মুখে করেছিলেন না কেবল হাত তুলে অঙ্গভঙ্গি দ্বারা প্রশংসা করেছিলেন, এ ব্যাপারে দুইরকম মত পাওয়া যায়। ইমাম ইবনুল জাওযী রহ. দাবি করেন যে, তিনি মুখে কিছু বলেননি; বরং হাতের ইশারা দ্বারাই আল্লাহ তাআলার প্রশংসা ও শোকর আদায় করেছিলেন। একটি রেওয়ায়েত দ্বারাও এর সমর্থন মেলে। তাতে বলা হয়েছে-

فرفع أبو بكر رأسه إلى السماء شكرا لله، ورجع القهقرى

‘আবূ বকর রাযি. আল্লাহ তাআলার শোকর আদায়স্বরূপ আকাশের দিকে মাথা তুললেন এবং পেছন দিকে ফিরে আসলেন।২৩৭
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. পেছন দিকে সরে আসলেন, কিন্তু চেহারা ঘুরালেন না। কেননা তাতে কিবলা পেছনে পড়ে যেত। চেহারা কিবলার দিক থেকে সরে গেলে নামায নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু দু'-চার কদম সরার দ্বারা নামায নষ্ট হয় না। তাই তিনি পেছনে সরে এসেছেন চেহারা না ঘুরিয়েই।

পুরুষদের জন্য তাসবীহ ও মহিলাদের জন্য হাতে তালি বাজানোর নির্দেশ এবং এর তাৎপর্য
নামায শেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামাযের ভেতর পুরুষদেরকে হাততালি দিতে নিষেধ করে দিলেন। তিনি ইরশাদ করলেন-

التصفيق للنساء من نابه شيء في صلاته فليقل سبحان الله

(হাততালি দেওয়ার কাজটি তো মহিলাদের জন্য। কারও যদি নামাযের মধ্যে কিছু ঘটে, তবে সে যেন সুবহানাল্লাহ বলে)। বস্তুত নামাযের পূর্ণাঙ্গ রূপ ও বিস্তারিত বিধি-নিষেধ একসঙ্গে নয়; বরং পর্যায়ক্রমে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। যখন তারা হাততালি দিয়েছিলেন, সম্ভবত তখনও পর্যন্ত এর প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়নি। এ-ই সর্বপ্রথম এটা নিষেধ করা হয়।
লক্ষ্যণীয়, হাততালি দেওয়ার নিষেধাজ্ঞা কেবল পুরুষদের জন্যই, নারীদের জন্য এটা জায়েয রাখা হয়েছে। বিষয়টা তাৎপর্যপূর্ণ। বস্তুত নামায হচ্ছে যিকর, তিলাওয়াত, দুআ, আল্লাহ অভিমুখিতা ও একান্তভাবে আল্লাহতে সমর্পিত থাকার সমষ্টি। হাতে তালি বাজানো এর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তাই ভুলের প্রতি ইমামের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যও এটা সমীচীন নয়। এর জন্য এমন কোনও পন্থাই অবলম্বন করা উচিত, যা নামাযের কার্যাবলীর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাসবীহ পড়া (সুবহানাল্লাহ বলা ) সেরকমই এক কাজ । সুতরাং ইমামের ভুল হলে মুসল্লীগণ সুবহানাল্লাহ বলবে, তাতেই ইমাম তার করণীয় বুঝে ফেলবে।
হাঁ, মহিলাদের জন্য হাতে তালি বাজানোর অবকাশ রাখা হয়েছে এজন্য যে, যদিও সুবহানাল্লাহ বলা উৎকৃষ্ট এক যিকর, কিন্তু মহিলাদের জন্য তা নিম্নস্বরে বলাই শ্রেয়। তাদের কন্ঠস্বরে আল্লাহ তাআলা বিশেষ আকর্ষণ রেখেছেন। এটা তাদের জন্য একটা নিআমত। কিন্তু সব নিআমতেরই সঙ্গত ব্যবহার কাম্য। অসঙ্গত ব্যবহার দ্বারা উৎকৃষ্ট নিআমতও ক্ষতির কারণ হয়ে যায়। তাই তাদের কণ্ঠস্বর দ্বারা যাতে পরপুরুষ প্রলুব্ধ না হয় সেদিকে লক্ষ রাখা জরুরি। ইমামের ভুল শোধরাতে গিয়ে তারা উচ্চস্বরে সুবহানাল্লাহ বলে উঠলে শয়তান সে স্বরকে তার বদমতলবে কাজে লাগাতে পারে। হয়তো কোনও পুরুষ-নামাযীর ধ্যান ভাঙিয়ে তার প্রতি মগ্ন করে দেবে। এটা অনেক বড় ক্ষতি। শয়তান যাতে সে ক্ষতি সাধন করতে না পারে, সে লক্ষ্যেই তাদেরকে তাসবীহ'র পরিবর্তে তালি বাজাতে বলা হয়েছে। এটা বড় ক্ষতি থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে ছোট ক্ষতি মেনে নেওয়ার পর্যায়ভুক্ত।

হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি. এর আদব ও বিনয়

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি. কে বললেন, হে আবু বকর! আমি তোমাকে ইমামত চালিয়ে যাওয়ার জন্য ইঙ্গিত করা সত্ত্বেও তুমি কেন তা করলে না, তখন তিনি উত্তরে বললেন-

ما كان ينبغي لابن أبي قحافة أن يصلي بالناس بين يدي رسول الله

(আবু কুহাফার পুত্রের পক্ষে এটা সমীচীন নয় যে, সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে দাঁড়িয়ে নামাযের ইমামত করবে)। এটা তাঁর আদব ও বিনয়ের প্রকাশ। এর দ্বারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হুকুম অমান্য করা হয়নি। কেননা তিনি তাঁকে ইমামত চালিয়ে যাওয়ার জন্য ইঙ্গিত করলেও তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, এটা অবশ্যপালনীয় হুকুম নয়। তার প্রতি এর দ্বারাও ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসল্লীদের মাঝখান দিয়ে প্রথম কাতারে চলে গিয়েছিলেন তো নিজে ইমামত করার জন্যই। কাজেই তাঁকে আপন স্থানে থাকতে বলাটা চূড়ান্ত হুকুম ছিল না। বরং সে ইঙ্গিত দ্বারা তিনি তাঁকে একরকম সম্মান ও মর্যাদা দান করেছিলেন। এ হিসেবে ইমামত চালিয়ে যাওয়া বা পেছনে চলে আসার এখতিয়ার তার থাকে। কাজেই তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদব রক্ষার্থে পেছনে চলে আসাকেই বেছে নিলেন।
তিনি উত্তরও দিলেন কী বিনয়ের সঙ্গে। উত্তম পুরুষের সঙ্গে উত্তর এরকম হওয়ার কথা ছিল যে, আপনার সামনে দাঁড়িয়ে নামায পড়ানো আমার জন্য সমীচীন নয়। কিন্তু তাতে এক তো বাহ্যিকভাবে হলেও আমিত্বের প্রকাশ হত, যা শব্দবিচারে নাজায়েয না হলেও মহান আবু বকর সিদ্দীক রাযি.-এর সমুচ্চ আখলাকের সঙ্গে যেন ঠিক যায় না। তার পরিবর্তে তিনি নিজেকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে দিয়ে, নাম ও উপনাম কোনওকিছুরই উল্লেখ না করে নিজেকে সম্পূর্ণ নামপুরুষে নিয়ে গিয়েছেন এবং 'আবু কুহাফার পুত্র' বলে এক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির পর্যায়ে নামিয়ে এনেছেন। এটা তাঁর চরম বিনয়।
দ্বিতীয়ত 'রাসূলুল্লাহ' বলার দ্বারা যে ভক্তি-শ্রদ্ধার প্রকাশ ঘটেছে, 'আপনার' বলে সম্বোধন করার দ্বারা তাও হত না। এটা বড়র সঙ্গে তার সম্পৃক্তজনদের কথাবার্তা কী আদব-লেহাজের সঙ্গে হওয়া উচিত, তার এক উৎকৃষ্ট নমুনা। আমাদের এটা রপ্ত করা চাই।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

এ হাদীছে বিস্তর শিক্ষা আছে। আমরা এস্থলে বিশেষ কয়েকটি উল্লেখ করছি।

ক. এ হাদীছ দ্বারা জানা যাচ্ছে মুসলিম ভ্রাতৃবর্গের পারস্পরিক দন্দ্ব-কলহ নিরসন করা এবং তাদের ঐক্য ও সংহতি রক্ষায় ভূমিকা রাখা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

খ. এ হাদীছ দ্বারা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ হয়।

গ. নামাযে ইমামের ভুল হলে পুরুষ মুক্তাদীর কর্তব্য সুবহানাল্লাহ বলে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা। মহিলা মুসল্লি সুবহানাল্লাহ না বলে হাতে তালি বাজাবে।

ঘ. দ্বীনী বা দুনিয়াবী যে-কোনও নিআমত অর্জিত হলে শোকর আদায় করা চাই। ইজ্জত-সম্মান লাভও একটি নিআমত।

ঙ. নামাযরত ব্যক্তিকে কোনও কিছু বোঝাতে চাইলে মুখে কিছু না বলে ইশারায় বোঝানো উত্তম।

চ. কেউ কাউকে বিশেষ কোনও মর্যাদায় ভূষিত করতে চাইলে তার তা গ্রহণ করা ও না করার এখতিয়ার থাকে, যদি না তা বাধ্যতামূলক কোনও বিষয় হয়।

ছ. সম্মানী ব্যক্তিকে তার প্রাপ্য সম্মান দেওয়া চাই, যেমন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-কে ইমামত বহাল রাখতে ইঙ্গিত করার মাধ্যমে সম্মান দেখিয়েছেন।

জ. এ দ্বারা বোঝা যাচ্ছে, সর্বোত্তম ব্যক্তির উপস্থিতিতে তার নিম্নস্তরের ব্যক্তি ইমামত করতে পারে।

ঝ. শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির সঙ্গে কথাবার্তায় আদব-ইহতিরাম রক্ষা করা বাঞ্ছনীয়।

২৩৪. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ২৬৯৩

২৩৫. সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৯৪১; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২২৮১৬; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৭৯৩; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ২২৬১; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর,হাদীছ নং ৫৯৩২

২৩৬. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৭৫১; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৯১০; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ৫৯০; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ১১৯৬; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২৪৪১২; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ২২৮৭; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৩৫২৯; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ২৮৫৬; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ৭৩২

২৩৭. মুসনাদুল হুমাইদী, হাদীছ নং ৯৫৬; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ৫৯১৪
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)