রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ২৫০
মানুষের মধ্যে মীমাংসা করে দেওয়ার গুরুত্ব ও ফযীলত।
পাওনাদার ও দেনাদারের মধ্যে বিরোধ মীমাংসা
হাদীছ নং : ২৫০

উম্মুল মু'মিনীন হযরত আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দরজায় বাদ-বিবাদকারীদের আওয়াজ শুনতে পেলেন। তাদের আওয়াজ চড়া। লক্ষ করে দেখা গেল তাদের একজন অন্যজনের কাছে ঋণের পরিমাণ কিছুটা কমানোর অনুরোধ করছে এবং তার কাছে সদয় আচরণ কামনা করছে। অপরদিকে সে বলছে, আল্লাহর কসম! আমি তা করতে পারব না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের কাছে বের হয়ে এসে বললেন, কে সেই ব্যক্তি যে সৎকর্ম করবে না বলে আল্লাহর নামে কসম করছে ? সে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি । এখন সে যা কামনা করে তাই হবে-বুখারী ও মুসলিম।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ২৭০৫; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৫৫৭; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১০৬২৬; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ১০৭২৭)
31 - باب الإصلاح بَيْنَ الناس
250 - وعن عائشة رضي الله عنها، قَالَتْ: سَمِعَ رسولُ الله - صلى الله عليه وسلم - صَوْتَ خُصُومٍ بِالبَابِ عَاليةً أصْوَاتُهُمَا، وَإِذَا أَحَدُهُمَا يَسْتَوْضِعُ الآخَر وَيَسْتَرْفِقُهُ في شَيءٍ، وَهُوَ يَقُولُ: واللهِ لاَ أفْعَلُ، فَخَرجَ عَلَيْهِمَا رسولُ اللهِ - صلى الله عليه وسلم - فَقَالَ: «أيْنَ المُتَأَلِّي عَلَى اللهِ لاَ يَفْعَلُ المَعْرُوفَ؟»، فَقَالَ: أَنَا يَا رسولَ اللهِ، فَلَهُ أيُّ ذلِكَ أحَبَّ. مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (1)
معنى «يَسْتَوضِعُهُ»: يَسْأَلهُ أَنْ يَضَعَ عَنْهُ بَعضَ دَيْنِهِ. «وَيَسْتَرفِقُهُ»: يَسأَلُهُ الرِّفْقَ. «وَالمُتَأَلِّي»: الحَالِفُ.

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছটিও বিবাদমান দুই পক্ষের মধ্যে মীমাংসা সম্পর্কিত। এতে আম্মাজান হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. জানান, কিভাবে দুই ব্যক্তির মধ্যে দেনা-পাওনা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হচ্ছিল এবং তাদের হট্টগোল শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘর থেকে বের হয়ে গিয়ে কিভাবে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেন।
আম্মাজান বলেন- سمع رسول الله صلى الله عليه وسلم صوت خصوم بالباب ২৩০ (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দরজায় বাদ-বিবাদকারীদের আওয়াজ শুনতে পেলেন)। এ বাদ-বিবাদকারীগণ কারা, সুনির্দিষ্টভাবে তা জানা যায় না। সহীহ ইবনে হিব্বানের এক বর্ণনায় আছে, জনৈকা মহিলা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে আরয করেছিল যে, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার প্রতি আমার পিতা-মাতা উৎসর্গিত হোক, আমি ও আমার পুত্র অমুকের কাছ থেকে খেজুর কিনেছিলাম। সেই আল্লাহর কসম, যিনি আপনাকে সম্মানিত করেছেন, আমরা তা থেকে কেবল অতটুকুই নিয়েছি, যা দ্বারা আমরা আমাদের পেটের ক্ষুধা নিবারণ করি এবং বরকতের আশায় মিসকীনকে দান করি। তারপর আমরা তার কাছে এই অনুরোধ নিয়ে আসলাম যে, আমরা যে পরিমাণ কমিয়েছি তার মূল্য যেন সে ছেড়ে দেয়। কিন্তু সে আল্লাহর কসম করে বলল, আমাদের থেকে কিছুই কম নেবে না। এ কথা শুনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মন্তব্য করলেন যে, সে একটি সৎকর্ম না করারই কসম করেছে! তিনি এ কথা তিনবার বললেন।
তাঁর এই মন্তব্য যখন ওই ব্যক্তির কানে গেল, তখন সে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বলল, আপনার প্রতি আমার পিতা-মাতা উৎসর্গিত হোক, আপনি চাইলে তারা যা কমিয়েছে তার মূল্য ছেড়ে দেব, আর আপনি যদি আসল দাম থেকেই কিছু কমিয়ে দিতে বলেন, তাও করতে আমি প্রস্তুত আছি। অতঃপর তারা যে পরিমাণ খেজুর নিয়েছিল তার মূল্য ছেড়ে দেওয়া হয়।২৩১
আলোচ্য হাদীছের ঘটনাটি ও সহীহ ইবনে হিব্বানে যা বর্ণিত হয়েছে তা একই ঘটনা হতে পারে এবং ভিন্ন ঘটনাও হতে পারে। উভয় বর্ণনার মূল বিষয় একই অর্থাৎ দুই পক্ষের মধ্যে দেনা পাওনায় ছাড় দেওয়ার অনুরোধ ও সে অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করায় যে কলহ দেখা দিয়েছিল নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সে ব্যাপারে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেন।
ঘটনাটিতে পাওনাদার তার পাওনা কিছুমাত্র হ্রাস করবে না বলে যে কসম করেছিল, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা পসন্দ করেননি। তিনি সরাসরি তাকে তিরস্কার না করে কেবল মন্তব্য করেছেন যে, তার কসমটি হয়েছে একটি সৎকর্ম না করা সম্পর্কে। অর্থাৎ তিনি তার ভুলটির ধরন শনাক্ত করে দেন এবং হিকমতের সঙ্গে বুঝিয়ে দেন যে, প্রাপ্য অর্থে কিছুটা ছাড় দেওয়া একটি সৎকর্ম আর কোনও সৎকর্ম না করা সম্পর্কে কসম করা সমীচীন নয়।
কোনওরকম নিন্দা-তিরস্কার ও ধমক দেওয়ার বদলে কেবল কাজটি সঠিক না। হওয়ার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে সংশোধনের যে পন্থা তিনি অবলম্বন করেছেন তা বড়ই তাৎপর্যপূর্ণ। এতে করে যেমন প্রিয় শিষ্য ও অনুসারীর মনে তিরস্কার-ধমকের আঘাত দেওয়া হল না, তেমনি ধমক-তিরস্কার দ্বারা যে সংশোধন উদ্দেশ্য ছিল তাও চমৎকারভাবে অর্জিত হয়ে গেল।
সাহাবী বুঝে ফেললেন তার নিতান্তই ভুল হয়ে গেছে। তিনি তৎক্ষণাৎ নিজেকে সংশোধন করে ফেললেন। নিবেদিত ভঙ্গিতে আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি যা চান তাই হবে। আল্লাহু আকবার! এ আত্মনিবেদনেরও কোনও তুলনা হয়। প্রতিপক্ষকে কী ধরনের ছাড় দেবেন তা নিজ এখতিয়ারে রাখলেন না। আমিত্বের চরম বিলোপ। বিষয়টা ছেড়ে দিলেন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতে। তিনি যা চান তাই হবে। এটা আমাদের পক্ষে এক উৎকৃষ্ট নমুনা যে, পিতা, উস্তায ও শায়খের কাছে কিভাবে নিবেদিত থাকতে হয় এবং কিভাবে তাদের নির্দেশ ও পরামর্শ শিরোধার্য করতে হয়। সেইসঙ্গে মুরুব্বীদের জন্যও এর মধ্যে শিক্ষা রয়েছে যে, কিভাবে সম্পৃক্তজনদের ভুলত্রুটি সংশোধন করতে হয়।
হাদীছগ্ৰন্থসমূহে এ জাতীয় আরও একটি ঘটনা বর্ণিত আছে। বর্ণনাটি নিম্নরূপ-

عن كعب بن مالك، أنه كان له على عبد الله بن أبي حدرد الأسلمي مال، فلقيه، فلزمه حتى ارتفعت أصواتهما، فمر بهما النبي صلى الله عليه وسلم فقال: «يا كعب، فأشار بيده كأنه يقول النصف، تأخذ نصف ما له عليه، وترك نصفا

হযরত কাব ইবনে মালিক রাযি. বর্ণনা করেন যে, আব্দুল্লাহ ইবনে আবী হাদরাদ আল আসলামী রাযি.-এর কাছে তার কিছু অর্থ পাওনা ছিল। তিনি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সে পাওনার অর্থ পরিশোধের জন্য চাপ দিলেন। এতে করে তাদের আওয়াজ চড়া হয়ে গেল। ঠিক এ মুহূর্তে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি বললেন, হে কাব! এই বলে তিনি হাত দ্বারা ইশারা করলেন। যেন তিনি বোঝাচ্ছিলেন- অর্ধেক (অর্থাৎ অর্ধেক ছেড়ে দাও)। সুতরাং হযরত কাব রাযি, তার কাছ থেকে পাওনা অর্থের অর্ধেক গ্রহণ করলেন এবং অর্ধেক ছেড়ে দিলেন।২৩২
এ ঘটনায়ও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পাওনাদার কা'ব ইবনে মালিক রাযি.-কে তার পাওনার অর্থ থেকে অর্ধেক ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তাও স্পষ্ট মুখের কথায় নয়, কেবল হাতের ইশারায়। হযরত কা'ব রাযি.-ও বিনাবাক্যে সে পরামর্শ মেনে নিয়েছেন। এর দ্বারা যেমন হযরত কা'ব রাযি.-এর বুদ্ধিমত্তা ও আনুগত্যপ্রিয়তার পরিচয় পাওয়া যায়, তেমনি এ শিক্ষাও লাভ হয় যে, দেনাদার অসচ্ছল হলে পাওনাদারের উচিত তার প্রতি সদয় ব্যবহার করা এবং সম্ভব হলে কিছুটা ছাড়ও দেওয়া।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারা সাহাবায়ে কেরাম নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষা অনুসরণে কেমন তৎপর ছিলেন সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। আমাদেরও উচিত হাদীছের শিক্ষা অনুসরণে তাদের সে তৎপরতা রপ্ত করা।

খ. এ হাদীছ দ্বারা বিরোধ নিষ্পত্তির প্রয়োজনীয়তাও উপলব্ধি করা যায়। কোনও কলহ-বিবাদ সম্পর্কে জানতে পারলে আমাদের কর্তব্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে তা নিরসনে ভূমিকা রাখা।

গ. কোনও সৎকর্ম না করা সম্পর্কে কসম করা উচিত নয়।

ঘ. অন্যের ভুল সংশোধনে প্রথমত কোমল-মধুর পন্থা অবলম্বন বাঞ্ছনীয়।

ঙ. সচ্ছল পাওনাদারের উচিত অসচ্ছল দেনাদারকে যথাসম্ভব ছাড় দেওয়া। এটা একটা মহৎ আমল।

২৩০. سمع رسول الله ﷺ صوت خصوم بالباب এখানে صوت خصوم এর صوت শব্দটি একবচন ব্যবহার করা হয়েছে, যদিও এর مضاف اليه (সম্বন্ধযুক্ত পদ) خصوم শব্দটি বহুবচন। এর কারণ صوت শব্দটি এস্থলে মাসদার (ক্রিয়ামূল)-রূপে ব্যবহৃত, যা একবচন ও বহুবচন উভয় অবস্থায় অপরিবর্তিত থাকে। কুরআন মাজীদেও এর দৃষ্টান্ত আছে, যেমন আয়াত : خَتَمَ اللَّهُ عَلَى قُلُوبِهِمْ وَعَلَى سَمْعِهِمْ وَعَلَى أَبْصَارِهِمْ غِشَاوَةٌ (আল্লাহ তাদের অন্তরে ও তাদের কানে মোহর করে দিয়েছেন, আর তাদের চোখের উপর পর্দা পড়ে আছে - সূরা বাকারাহ : ৭)। এর سمع শব্দটি কোনও কোনও মুফাসসিরের মতে মাসদার। তাই সম্বন্ধযুক্ত পদ هم বহুবচন হওয়া সত্ত্বেও এটি একবচনই রয়েছে।
কেউ কেউ বলেন, (এটা মাসদার নয়; বরং ইসম বা বিশেষ্য পদ। তবে) তর্ক-বিতর্ককারীদের আওয়াজ পরস্পর মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়ায় সকলের আওয়াজ শুনতে যেন একই আওয়াজে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। তাই صوت শব্দটিকে একবচন ব্যবহার করা হয়েছে। তারপর বলা হয়েছে عالية اصواتهما (এর আক্ষরিক অর্থ— তাদের দুজনের আওয়াজসমূহ চড়া)।عالية- কে নসব ও জর্র উভয়রূপে পড়া যায়। ‘নসব'-এর সঙ্গে পড়লে শব্দটি أَصْوَاتُهُمَا - এর হাল (অবস্থাজ্ঞাপক পদ) হবে। আর যদি 'জর্-এর সঙ্গে পড়া হয় তবে خصوم - এর সিফাত (বিশেষণ) হবে।
কোনও কোনও বর্ণনায় أَصْوَاتُهُمَا এর স্থানে أَصْوَاتُهُم আছে। উভয়টাই সঠিক। দ্বিবচন এ হিসেবে যে, তর্ক-বিতর্ককারী ছিল মূলত দুজন। আর বহুবচনের কারণ সে তর্ক-বিতর্কের সময় অন্য লোকও উপস্থিত ছিল এবং তারাও কথা বলছিল। অথবা তর্ক-বিতর্ক চলছিল দুই পক্ষের বহুলোকের মধ্যে, সে হিসেবে বহুবচন। আবার লোক বহু হলেও যেহেতু পক্ষ ছিল দু'টি, তাই দ্বিবচন।
أَصْوَاتُهُمَا - এর সম্বন্ধযুক্ত পদ هُمَا দ্বিবচন হওয়া সত্ত্বেও সম্বন্ধ পদ أَصْوَاتُ বহুবচন হওয়ার কারণ আরবীতে দ্বিবচনের সঙ্গে দ্বিবচনের সম্বন্ধ স্থাপনকে সুন্দর ও সুশ্রাব্য গণ্য করা হয় না। এরূপ ক্ষেত্রে একটিকে বহুবচন করে ফেলা হয়ে থাকে।

২৩১. সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ৫০৩২

২৩২. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ২৭০৬; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৫৫৮; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৫৪১৪; সুনানে আবু দাউদ, হাদীছ নং ৩৫৯৫; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ৫০৪৮, মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৫৭৯১; বায়হাকী, আসসুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১১২৮৫; শু'আবুল ঈমান, হাদীছ নং ১০৭২৮; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীছ নং ২৪২৯
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)