রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ২৫২
অধ্যায়ঃ ৩২

দুর্বল, গরীব ও অখ্যাত-গুরুত্বহীন মুসলিমদের মর্যাদা

ضعفة শব্দটি ضعيف -এর বহুবচন। এর অর্থ দুর্বল। এর দ্বারা এমনসব লোককে বোঝানো হয়, যারা তেমন অর্থ-বিত্তের মালিক নয়, যাদের নেই প্রভাব-প্রতিপত্তি এবং যারা পদ ও ক্ষমতা থেকেও দূরে থাকে।
الفقراء শব্দটি فقير -এর বহুবচন। এর অর্থ গরীব ও দরিদ্র, যাদের উল্লেখযোগ্য অর্থ-সম্পদ নেই এবং যাদের উপর যাকাত ফরয হয় না; বরং তারাই যাকাত গ্রহণের উপযুক্ত।
الخاملين শব্দটি خامل -এর বহুবচন। এটা এমন লোককে বলে, যারা প্রচার ও খ্যাতিবিমুখ এবং সমাজচোখে যারা বিশেষ গুরুত্ব রাখে না। এর জন্য গরীব হওয়া শর্ত নয়। যে বিত্তবান প্রচার ও খ্যাতি থেকে আত্মরক্ষা করে চলে, সেও এর অন্তর্ভুক্ত।
দুনিয়ায় সাধারণত এ তিন শ্রেণীর লোককে অবজ্ঞা করা হয়। কেননা মানুষের কাছে অর্থবিত্ত ও শক্তি-ক্ষমতাই মর্যাদার মাপকাঠি। তাদের তা না থাকায় মানুষের দৃষ্টিতে তাদের বিশেষ মর্যাদাও নেই। সুতরাং তাদের গুরুত্ব দেওয়া হবে কেন? অধিকাংশ মানুষ ইজ্জত-সম্মানের বড় কাঙ্গাল, আর তা যেহেতু পাওয়া যায় শক্তি ক্ষমতা ও অর্থবিত্ত দ্বারা, তাই তারা এসব খুব পসন্দ করে। কাজেই তারা এগুলোর অর্জনকেই জীবনের সাধনা বানিয়ে নেয়। এর জন্য পরস্পর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। সে প্রতিযোগিতা মানুষকে কলহ-বিবাদ ও নানারকম অন্যায়-অনাচারে লিপ্ত করে। এর পরিণামে মানুষের পার্থিব জীবনও বিপর্যস্ত হয় এবং পরকালীন জীবন হয় ক্ষতিগ্রস্ত। সে ক্ষতি থেকে আত্মরক্ষার সহজ উপায় এ প্রতিযোগিতা এড়িয়ে চলা। অন্তর থেকে বিত্ত, ক্ষমতা ও খ্যাতির মোহ দূর করা গেলে এ প্রতিযোগিতা আপনিই খতম হয়ে যায়।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রিয় সাহাবীদের অন্তর থেকে এ মোহ দূর করার বহুমুখী চেষ্টা করেছেন। ফলে তারা এসবের মোহমুক্ত আদর্শ মানবরূপে গড়ে উঠেছিলেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতকে নির্মোহ করার যে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন তার একটা এইও যে, আল্লাহ তা'আলা দুর্বল, গরীব ও প্রচারবিমুখ মুসলিমকে যে বিশেষ মর্যাদা দান করেছেন, তিনি তাদের সামনে তা তুলে ধরতেন। যেমন এ সম্পর্কিত একটি হাদীছ লক্ষ করুন-

عن أبي الدرداء قال: سمعت رسول اللہ ﷺ یقول: أبغوني ضعفاءكم، فإنكم إنما ترزقون وتنصرون بضعفائكم

'হযরত আবুদ দারদা রাযি. বর্ণনা করেন যে, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, তোমরা আমার জন্য তোমাদের মধ্যে যারা দুর্বল তাদের সন্ধান কর। তোমরা তো তোমাদের দুর্বলদের অসিলায়ই (আল্লাহর পক্ষ থেকে) রিযিক ও সাহায্য লাভ করে থাক।২৩৮
অর্থাৎ তাদের খুঁজে পেতে তোমরা আমাকে সাহায্য কর এবং তাদেরকে আমার কাছে নিয়ে আস। কেননা, আমার মজলিসে তারাই বসার বেশি হকদার এবং তারাই আমার ঘনিষ্ঠতালাভের বেশি উপযুক্ত। কুরআন মাজীদ দ্বারাও এ বক্তব্য সমর্থিত, যেমন সামনে আসছে।
বলাবাহুল্য সাহাবায়ে কেরাম প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশনা সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করতেন এবং সে অনুযায়ী জীবনগঠনের চেষ্টা করতেন। সে প্রচেষ্টায় তারা পুরোপুরি সফলও হয়েছিলেন। এটাই তাদের শ্রেষ্ঠতম মানুষে পরিণত হওয়ার মূল রহস্য। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষা কিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত মানুষের জন্য। তাই আমাদের উচিত অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে সে শিক্ষা জানা ও তার অনুসরণ করা, বিশেষত গরীব ও সামাজিকভাবে গুরুত্বহীন দীনদার শ্রেণীর ব্যাপারে ইসলাম যে দৃষ্টিভঙ্গি শিক্ষা দিয়েছে তা আত্মস্থ করা অতীব জরুরি। এতে করে নিজেদের অন্তর থেকে যেমন দুনিয়ার মোহ ঘুচবে, তেমনি গরীব দীনদারদের অবহেলা করার কারণে আমরা যে নানাবিধ আখলাকী ও কর্মগত অন্যায় অপরাধে লিপ্ত হচ্ছি তা থেকেও বাঁচতে পারব।

২৩৮. সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৩১৭৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২১৭৩১; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৭০২; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ২৫৯৪; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ৪৭৬৭; মুস্তাদরাকে হাকিম, হাদীছ নং ২৫০৯; বায়হাকী, আস্-সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৬৩৮৮; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ৪০৬২

‘দুর্বল, গরীব ও অখ্যাত-গুরুত্বহীন মুসলিমদের মর্যাদা’ সম্পর্কিত একটি আয়াত

এক নং আয়াত

وَاصْبِرْ نَفْسَكَ مَعَ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجْهَهُ وَلَا تَعْدُ عَيْنَاكَ عَنْهُمْ

অর্থ : ধৈর্য-স্থৈর্যের সাথে নিজেকে সেই সকল লোকের সংসর্গে রাখ, যারা সকাল ও সন্ধ্যায় নিজেদের প্রতিপালককে এ কারণে ডাকে যে, তারা তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করে। তোমার দৃষ্টি যেন তাদের থেকে সরে না যায়।২৩৯

ব্যাখ্যা

এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হুকুম দিয়েছেন, তিনি যেন ওইসব লোকের সঙ্গে ধৈর্য সহকারে থাকেন, যারা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে পরিপূর্ণ ইখলাসের সঙ্গে সর্বদা ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থাকে। তারা সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহ তাআলাকে ডাকে। অর্থাৎ পাঁচ ওয়াক্ত নামায নিয়মিত আদায় করে, আল্লাহ তাআলার যিকর করে, কুরআন তিলাওয়াত করে, হালাল-হারাম বিচার করে চলে, মানুষের সঙ্গে আচার-আচরণে আল্লাহ তাআলাকে স্মরণ রাখে, আল্লাহ তাআলার হক আদায়ের পাশাপাশি মাখলুকের হক আদায়েও যত্নবান থাকে। তারা গরীব কিসিমের লোক হতে পারে, কিন্তু তাদের অন্তর ঐশ্বর্যে ভরা। দুনিয়ার প্রতি তাদের কোনও লোভ-লালসা নেই। দুনিয়াদারদের যা আছে সেজন্য তারা লালায়িতও নয় এবং নয় সে কারণে তাদের প্রতি ঈর্ষান্বিত।
সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে হযরত আম্মার ইবন ইয়াসির রাযি. হযরত সুহায়ব রাযি., হযরত বিলাল রাযি., হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাযি. প্রমুখ সাহাবী এসকল গুণের অধিকারী ছিলেন। আল্লাহ জাল্লা শানুহু নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এসকল গরীব আল্লাহওয়ালাদের সঙ্গে ধৈর্যসহকারে থাকতে বলেছেন।
বাহ্যত বোঝা যাচ্ছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাদের সাহচর্যে থাকার হুকুম দেওয়া হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে বোঝানো উদ্দেশ্য- আপনি ধৈর্যসহকারে তাদেরকে নিজ সাহচর্যে থাকতে দিন এবং আপনার সাহচর্যে থেকে তারা যাতে নিজেদেরকে আল্লাহর খাঁটি বান্দারূপে গড়ে তুলতে পারে আর এভাবে আখেরাতের সাফল্য অর্জনে সক্ষম হতে পারে, সে সুযোগ তাদেরকে দান করুন।
যদিও আয়াতের মূল উদ্দেশ্য গরীব সাহাবীদেরকে নিজ সাহচর্যে রাখার হুকুম দান করা, কিন্তু বাকভঙ্গি অবলম্বন করা হয়েছে এর বিপরীত। অর্থাৎ রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাদের সাহচর্যে থাকতে বলা হচ্ছে। তা বলার কারণ সম্ভবত আমাদেরকে সবক দেওয়া যে, আমরা যেন উল্লিখিত গুণসম্পন্ন ব্যক্তিদের সাহচর্যে থাকি। এভাবেও বলা যায় যে, আমাদেরকে আল্লাহওয়ালাদের সাহচর্য অবলম্বনের হুকুম দেওয়া হয়েছে আর কিভাবে চিনব কে সত্যিকারের আল্লাহওয়ালা, সেজন্য তাদের গুণাবলীও উল্লেখ করে দেওয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে সতর্ক করা হয়েছে যাতে করে কোনও আল্লাহওয়ালা গরীব হলে সে কারণে যেন তাদের সাহচর্য পরিত্যাগ না করি। আল্লাহওয়ালা চেনার মাপকাঠি যেন ধন-সম্পদ না হয়; বরং তা যেন হয় উল্লিখিত গুণাবলী। যাদের মধ্যে এসব গুণ নেই, পার্থিব দিক থেকে তারা যতই সুপ্রতিষ্ঠিত হোক, প্রকৃতপক্ষে তারা এর উপযুক্ত নয় যে, তাদের সাহচর্য গ্রহণ করা যেতে পারে। তা করতে পারে কেবল এমন লোক, যাদের উদ্দেশ্য পার্থিব ভোগ-উপভোগ। আয়াতের পরের অংশে সেদিকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলা হয়েছে-

وَلَا تَعْدُ عَيْنَاكَ عَنْهُمْ تُرِيدُ زِينَةَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا

‘পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য কামনায় তোমার দৃষ্টি যেন তাদের থেকে সরে না যায়।’

অর্থাৎ মুখলিস গরীবদের ছেড়ে বিত্তবান অহংকারীদের দিকে নজর দিও না। তুমি হয়তো এই উদ্দেশ্যে তাদের দিকে নজর দেবে যে, তারা মুসলিম হয়ে গেলে ইসলাম শক্তিশালী হবে। এ চিন্তা ভুল। ইসলামের প্রকৃত শক্তি ও মর্যাদা অর্থবিত্তের মধ্যে নিহিত নয়; বরং তার উৎস হচ্ছে খাঁটি ঈমান, তাকওয়া-পরহেযগারী ও উন্নত আখলাক-চরিত্র। এটাই প্রকৃত সম্পদ, যা ওই গরীব মুমিনদের মধ্যে আছে। অহংকারী বিত্তবানেরা এর থেকে বঞ্চিত। কাজেই তাদের জন্য অতিরিক্ত আশাবাদী না হয়ে বরং ওই গরীব আল্লাহওয়ালাদের সঙ্গেই নিজেকে জুড়ে রাখা চাই।
এ প্রসঙ্গে আয়াতের পরবর্তী অংশও উল্লেখযোগ্য। বলা হয়েছে-

وَلَا تُطِعْ مَنْ أَغْفَلْنَا قَلْبَهُ عَنْ ذِكْرِنَا وَاتَّبَعَ هَوَاهُ وَكَانَ أَمْرُهُ فُرُطًا

(এমন কোনও ব্যক্তির কথা মানবে না, যার অন্তরকে আমি আমার স্মরণ থেকে গাফেল করে রেখেছি, যে নিজ খেয়াল-খুশির পেছনে পড়ে রয়েছে এবং যার কার্যকলাপ সীমা ছাড়িয়ে গেছে)। কোনও কোনও বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, কুরায়শ গোত্রীয় কোনও কোনও মোড়ল নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে প্রস্তাব পেশ করেছিল যে, আপনি ওই নিম্নস্তরের লোকগুলোকে সরিয়ে দিন, তাহলে আমরা অভিজাত ও সম্ভ্রান্ত শ্রেণী আপনার কাছে বসতে পারব এবং আপনি কী বলেন তা শুনব। তারা নিম্নস্তরের লোক বলেছিল গরীব মুমিনদেরকে আর অভিজাত বলেছিল বিত্তবান কাফেরদেরকে। হয়তো বা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চিন্তা করেছিলেন আমার গরীব সাহাবীগণ তো খাঁটি মুমিনই। তাদের ঈমান পরিপক্ক। কাজেই সাময়িকভাবে যদি তাদেরকে মজলিসে না আসতে বলা হয়, তাতে কোনও ক্ষতি নেই, তারা মনে কষ্ট পাবে না। এ অবকাশে এসব মোড়লকে দীনের কথা শোনানো যাবে। হয়তো তারা ঈমানও আনবে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে এ আয়াত নাযিল হয় এবং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সতর্ক করে দেওয়া হয় যে, আপনি এ উদ্যত শ্রেণীর কথায় কান দেবেন না। এরা শুধু শুধুই এ প্রস্তাব করছে। আসলে তাদের ঈমান আনার ইচ্ছাই নেই। ঈমান আনতে চাইলে তারা এতদিনে তা এনেই ফেলত। তাদের সামনে সত্যদীন পরিস্ফুট হতে কিছু বাকি নেই। আসলে তাদের অন্তর দুনিয়ার নেশায় মত্ত। তারা আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল। তারা সর্বক্ষণ মনের খাহেশ পূরণে ব্যস্ত। আল্লাহর আনুগত্য করতে গেলে তারা তাদের মনের অসৎ চাহিদা পূরণ করতে পারবে না। তাই মনের চাহিদাকে অগ্রাধিকার দিয়ে আল্লাহর আনুগত্য পাশ কাটিয়ে চলছে এবং কুফর ও অবাধ্যতায় লিপ্ত থেকে সীমালঙ্ঘন ও বাড়াবাড়ির চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এহেন নফসের পূজারীদের কথায় বিলকুল কর্ণপাত করবেন না।
মোটকথা তিনটি অসৎগুণ যাদের মধ্যে আছে, কিছুতেই তাদের আনুগত্য করা যাবে না, এমনকি তাদের সঙ্গ ও সাহচর্যও অবলম্বন করা উচিত হবে না। সে অসৎ গুণগুলো হচ্ছে-

ক. অন্তরের গাফলাত এবং আল্লাহর যিকর ও স্মরণ থেকে বিমুখ থাকা;

খ. নফসের আনুগত্য তথা মনের অসৎ চাহিদা পূরণে লিপ্ত থাকা এবং

গ. সত্য ও ন্যায়ের সীমা লঙ্ঘন করা ও বাড়াবাড়িতে লিপ্ত থাকা।
যে-কারও বদ্দীন হওয়ার জন্য এ তিনটি স্বভাবের যে-কোনও একটিই যথেষ্ট। কারও মধ্যে তিনওটি থাকার অর্থ সে চরম পর্যায়ের বেদীন। এরূপ লোকের কথায় চলা বা তাদের সাহচর্য অবলম্বন করার পরিণাম নিজেরও গোমরাহ হয়ে যাওয়া, যা কোনও মুমিন-মুসলিমের কাম্য হতে পারে না।
আয়াতটির শুরুতে ধৈর্যসহকারে আল্লাহওয়ালা লোকের সাহচর্যে থাকতে বলা হয়েছে, তাতে তারা গরীবই হোক না কেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে সতর্ক করা হয়েছে যেন দুনিয়ার ভোগ-উপভোগের আশায় গরীব আল্লাহওয়ালাদের ছেড়ে দুনিয়াদারদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে না পড়া হয় । তৃতীয় পর্যায়ে নফসের পূজারী গাফেল সীমালঙ্ঘনকারীদের অনুসরণ ও আনুগত্য করতে নিষেধ করা হয়েছে।
এ আয়াতটি সাহাবায়ে কেরামের উচ্চমর্যাদার এক সুস্পষ্ট দলীল। আয়াতটি নাযিল হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই বলে আল্লাহ তাআলার শোকর আদায় করেন-

الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي لَمْ يُمِثْنِي حَتَّى أَمَرَنِي أَنْ أَصْبِرَ نَفْسِي مَعَ قَوْمٍ مِنْ أُمَّتِي، مَعَكُمْ الْمَحْيَا وَمَعَكُمُ الْمَمَاتُ

‘আল্লাহ তাআলার শোকর, তিনি আমার উম্মতেরই একদল লোকের সঙ্গে আমাকে ধৈর্যসহকারে থাকার আদেশ দান না করা পর্যন্ত আমার মৃত্যু ঘটাননি। (ওহে আমার সাহাবীগণ!) তোমাদেরই সঙ্গে আমার জীবন এবং তোমাদেরই সঙ্গে মরণ।২৪০

২৩৯. সূরা কাহফ (১৮), আয়াত নং ২৮

২৪০. শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ১০০১২; তাবারানী, আল-মুজামুস সগীর, হাদীছ নং ১০৭৪
জান্নাতবাসী ও জাহান্নামীদের পরিচয়
হাদীছ নং : ২৫২

হযরত হারিছা ইবুন ওয়াহব রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, জান্নাতবাসী কারা সে সম্পর্কে কি আমি তোমাদের অবহিত করব না? তারা হচ্ছে প্রত্যেক দুর্বল ব্যক্তি, যে মানুষের কাছেও দুর্বল গণ্য, যে আল্লাহর নামে শপথ করলে আল্লাহ অবশ্যই তার শপথ রক্ষা করেন। আমি কি তোমাদের অবহিত করব না কারা জাহান্নামী? তারা হচ্ছে প্রত্যেক রূঢ়, উদ্ধত, অহংকারী ব্যক্তি -বুখারী ও মুসলিম।
সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৪৯১৮; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৮৫৩; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৬০৫; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীছ নং ৪১১৬; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ৫৬৭৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৮৭২৮; বায়হাকী, আস-সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ২০৮০৫; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৭৮২৪; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ৩২৫৫
32 - باب فضل ضعفة المسلمين والفقراء والخاملين

قَالَ الله تَعَالَى: {وَاصْبِرْ نَفْسَكَ مَعَ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجْهَهُ وَلا تَعْدُ عَيْنَاكَ عَنْهُمْ} [الكهف: 28].
252 - وعن حارثة بن وهْبٍ - رضي الله عنه - قَالَ: سمعت رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - يقولُ: «ألاَ أُخْبِرُكُمْ بِأهْلِ الجَنَّةِ؟ كُلُّ ضَعِيف مُتَضَعَّف (1)، لَوْ أقْسَمَ عَلَى اللهِ لأَبَرَّهُ، أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِأهْلِ النَّارِ؟ كُلُّ عُتُلٍّ جَوّاظٍ مُسْتَكْبِرٍ». مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (2)
«العُتُلُّ»: الغَلِيظُ الجَافِي. «وَالجَوَّاظُ»: بفتح الجيم وتشديد الواو وبالظاء المعجمة: وَهُوَ الجَمُوعُ المَنُوعُ، وَقِيلَ: الضَّخْمُ المُخْتَالُ في مِشْيَتِهِ، وَقِيلَ: القَصِيرُ البَطِينُ.

হাদীসের ব্যাখ্যা:

একজন মুমিনের জীবনের পরম লক্ষ্য জাহান্নাম থেকে নাজাত পাওয়া ও জান্নাতের অধিকারী হওয়া। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে এ লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন রাখার চেষ্টা করতেন। এর জন্য যেমন তাদের সামনে জাহান্নামের কঠিন আযাব ও জান্নাতের পরম সুখ-শান্তির উপকরণসমূহ তুলে ধরতেন, তেমনি যেসকল আমল দ্বারা জাহান্নাম থেকে নাজাত পাওয়া যায় ও জান্নাতের অধিকারী হওয়া যায় তাও বয়ান করতেন। আলোচ্য হাদীছে তিনি কী চরিত্রের লোক জান্নাতবাসী হবে এবং কেমন লোক জাহান্নামে যাবে তার নমুনা তুলে ধরেছেন। সাহাবায়ে কেরাম তো বটেই, কিয়ামত পর্যন্ত এ হাদীছের সকল শ্রোতা ও পাঠককে এটি জীবন গড়ার অনুপ্রেরণা যোগায়। এখন আমাদের কর্তব্য জান্নাতবাসীর নমুনা অনুযায়ী নিজ জীবন গড়ে তোলা আর সাবধান থাকা যেন কোনওক্রমেই জাহান্নামবাসীর স্বভাব-চরিত্র নিজের মধ্যে শেকড় গাড়তে না পারে।
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে প্রশ্ন করেন যে, আমি কি তোমাদেরকে অবহিত করব না কারা জান্নাতী? এ প্রশ্ন দ্বারা তিনি তাদের অন্তরে জান্নাত লাভ করা ও নিজেদেরকে জান্নাতীসুলভ ব্যক্তিরূপে গড়ে তোলার আগ্রহ জাগানোর চেষ্টা করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে তারা আগ্রহ ব্যক্তও করেছেন, যদিও বর্ণনায় বর্ণনাকারী তা উল্লেখ করেননি। কেননা সে কথা এমনিই বোঝা যায়। তারা আগ্রহ ব্যক্ত করলে তিনি বললেন- كل ضعيف متضعف لو أقسم على الله لأبره (তারা হচ্ছে প্রত্যেক দুর্বল ব্যক্তি, যে মানুষের কাছেও দুর্বল গণ্য, যে আল্লাহর নামে শপথ করলে আল্লাহ অবশ্যই তার শপথ রক্ষা করেন)। এখানে পাশাপাশি ضعيف ও متضعف এ দু'টি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। উভয়টির মূলধাতু ضعف , অর্থ দুর্বলতা। ضعيف বলা হয় ওই দুর্বল ব্যক্তিকে, যার পার্থিব আসবাব উপকরণ খুব কম এবং চারিত্রিক দিক থেকে বিনয়ী।
متضعف শব্দটি দুইভাবে পড়া যায়- ع হরফটিতে তাশদীদ ও যবর দিয়ে متضعف অথবা ع হরফটিতে তাশদীদ ও যের দিয়ে متضعف । প্রথম অবস্থায় এর দ্বারা এমন ব্যক্তিকে বোঝানো হয়, লোকে দুনিয়াবী অবস্থার দুর্বলতাহেতু যাকে দুর্বল ও তুচ্ছ গণ্য করে এবং তার উপর নিজেদের বড়ত্ব প্রকাশ করে। দ্বিতীয় অবস্থায় বোঝানো হয় ওই ব্যক্তিকে, যে প্রচারবিমুখ এবং একজন তুচ্ছ ও সাধারণ লোকরূপে জীবনযাপন করে। কেউ বলেন, এর অর্থ এমন ব্যক্তি, যে আল্লাহর জন্য বিনীত থাকে এবং তাঁর উদ্দেশ্যে নিজেকে ছোট করে।
সারকথা এ শব্দদু'টি দ্বারা এমন গরীব দীনদারকে বোঝানো হয়, যে নির্মোহ, বিনয়নম্র, প্রচারবিমুখ ও অতি সাধারণ জীবনযাপনকারী। বাক্যের পরবর্তী অংশটি প্রথম অংশের বিশেষণ, যা দ্বারা আল্লাহ তাআলার কাছে এ শ্রেণীর লোকদের মর্যাদা তুলে ধরা হয়েছে। বলা হচ্ছে- لو أقسم على الله لأبره (যে আল্লাহর নামে শপথ করলে আল্লাহ অবশ্যই তার শপথ রক্ষা করেন)। অর্থাৎ তার শপথের মর্যাদা রক্ষার্থে সে যে উদ্দেশ্যে শপথ করেছে, আল্লাহ তাআলা তা পূর্ণ করেন। এ ব্যাপারে হযরত আনাস ইবনুন নাযর রাযি. ও তাঁর বোন রুবায়্যি রাযি.-এর ঘটনা উল্লেখযোগ্য।
হযরত রুবায়্যি রাযি.-এর সঙ্গে একবার এক মহিলার কলহ দেখা দেয়। তাতে হযরত রুবায়্যি রাযি.-এর এক আঘাতে সে মহিলার একটি দাঁত ভেঙে যায়। তাঁর পক্ষের লোকজন সে মহিলার পক্ষের লোকজনকে অনুরোধ জানাল যেন তারা ক্ষমা করে দেয়। তারা ক্ষমা করতে রাজি হল না। তারপর অনুরোধ জানাল, তাহলে তোমরা এর অর্থমূল্য নিয়ে নাও। তাতেও রাজি হল না। তাদের এক দাবি- দাঁতের বদলে দাঁত, আমরা রুবায়্যিরও একটা দাঁত ভেঙ্গে দেব।
শেষপর্যন্ত বিচার আসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদালতে। তিনি রায় দিলেন- রুবায়্যিরও দাঁত ভেঙ্গে দেওয়া হবে। এ রায় শুনে হযরত আনাস ইবনুন নাযর রাযি. বলে উঠলেন- রুবায়্যির দাঁত ভেঙ্গে ফেলা হবে? ইয়া রাসূলাল্লাহ! ওই আল্লাহর কসম, যিনি আপনাকে সত্যসহ পাঠিয়েছেন! রুবায়্যির দাঁত ভাঙ্গা হবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি কী বলছ হে আনাস, এটা তো আল্লাহর বিধান, কিসাস গ্রহণ তাঁর কিতাবের ফয়সালা? কিন্তু তাঁর একই কথা- তার দাঁত ভাঙ্গা হবে না। এটা কুরআনের বিধান ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ফয়সালা অমান্য করা নয়; বরং আল্লাহর প্রতি গভীর আস্থার বহিঃপ্রকাশ। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, আল্লাহ তাআলা কোনও সহজ সুরত পয়দা করে দেবেন। সে কারণেই তিনি কসম করে বলছিলেন- তার দাঁত ভাঙ্গা হবে না। আল্লাহ তাআলা তাঁর কসমের মর্যাদা রাখলেন। অপরপক্ষ কিসাস গ্রহণের দাবি ত্যাগ করল এবং অর্থদণ্ড গ্রহণে রাজি হয়ে গেল। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আকস্মিক পরিবর্তনে আশ্চর্য হয়ে গেলেন। তারপর তিনি মন্তব্য করলেন-

إن من عباد الله من لو أقسم على الله لأبره

"আল্লাহর এমন কোনও কোনও বান্দাও আছে, যে আল্লাহর নামে কসম করলে আল্লাহ তা পূর্ণ করেন।২৪২

জাহান্নামীদের কিছু বৈশিষ্ট্য

তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জাহান্নামীদের পরিচয় দান করেন- كل عتل جواظ مستكبر (তারা হচ্ছে প্রত্যেক রূঢ়, উদ্যত, অহংকারী ব্যক্তি)। ইমাম নববী রহ. عتل -এর অর্থ করেছেন কঠোর-কঠিনপ্রাণ। তিনি جواظ -এর অর্থ করেছেন, এমন ব্যক্তি, যে ধন-সম্পদ খুব সঞ্চয় করে কিন্তু তা থেকে গরীব-দুঃখীকে কিছু দেয় না । তিনি বলেন, কারও মতে এর অর্থ মোটাতাজা শরীরের এমন লোক, যে দর্পিত ভঙ্গিতে চলাফেরা করে। কেউ বলেন, খাটো ভুঁড়িওয়ালা লোক।
শব্দদু'টির এছাড়া আরও ব্যাখ্যা আছে। যেমন কেউ বলেন, عتل অর্থ কাফের। দাউদী রহ. বলেন, মোটাতাজা শরীরের এমন লোক, যার ঘাড় মোটা ও পেট বড়। হারাবী রহ. বলেন, এমন ব্যক্তি, যে ধন-সম্পদ খুব সঞ্চয় করে কিন্তু তা থেকে গরীব দুঃখীকে কিছু দেয় না। আবার কেউ বলেন, খাঁটো দেহের স্থূলোদর ব্যক্তি। কারও মতে, এমন লোক, যে খুব বেশি পানাহার করে ও অন্যদের উপর জুলুম-অত্যাচার চালায়। কারও মতে এর অর্থ অত্যধিক কলহ-বিবাদকারী ও হীন স্বভাববিশিষ্ট। আবার কেউ বলেন, এমন কঠোর-কঠিন চরিত্রের লোক, যে ভালো কিছু মানতে চায় না। শব্দটির ব্যাখ্যা সম্পর্কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। তিনি উত্তরে বলেন-

هو الشديد الخلق المصحح، الأكول الشروب، الواجد للطعام والشراب، الظلوم للناس، رحيب الجوف

‘পরিপুষ্ট, শক্ত-সমর্থ, সুস্থ-সবল লোক, যে খুব বেশি পানাহার করে, পানাহার সামগ্রী যার হস্তগত, মানুষের প্রতি জুলুম-অত্যাচারকারী ও স্থূলোদর ব্যক্তি।২৪৩
جواظ -এর অর্থ ইমাম নববী রহ. যা বলেছেন, বিভিন্ন তাফসীর গ্রন্থে এর সমর্থনে হাদীছও উদ্ধৃত হয়েছে। হযরত ইবন আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, এর অর্থ কী? তিনি বলেন, এমন লোক, যে খুব অর্থ-সম্পদ জমা করে, কিন্তু সে কৃপণ, তা থেকে কাউকে কিছু দেয় না।
ইমাম খাত্তাবী ও জাওহারী রহ. শব্দটির অর্থ করেছেন স্থূলদেহী ও চালচলনে অহংকারী। নেহায়া গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, এর অর্থ খাটো, লোভাতুর ও স্থূলোদর, পেট ভরে খাওয়া ছাড়া যার অন্য কোনও চিন্তা নেই।
এ শব্দদু'টির যেসকল অর্থ বর্ণিত হয়েছে তা সবই নিন্দনীয় স্বভাবের পরিচায়ক। এর কোনওটিই ইসলাম পসন্দ করে না। বিভিন্ন হাদীছে এর নিন্দা জানানো হয়েছে ও মুমিনদেরকে এর ব্যাপারে সাবধান করা হয়েছে। যেমন হাদীছ দ্বারা জানা যায়, কঠোর-কঠিন স্বভাবের লোক আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত থাকে। লোভ-লালসাবশে অর্থ সঞ্চয় করা এবং তা থেকে গরীব-দুঃখীকে কিছু না দেওয়া কাফের-মুনাফিকের স্বভাব। অহংকারী ও দর্পিত স্বভাবের লোক জান্নাতে যাবে না। ভোগ-বিলাসিতায় মেতে থাকার কারণে মোটাতাজা হয়ে যাওয়াটা আখেরাতবিমুখিতার লক্ষণ। তর্কপ্রবণতা ও সত্যগ্রহণে অস্বীকৃতি ছিল ঘোর কাফেরদের খাসলাত। কুরআন মাজীদে এর তীব্র নিন্দা জানানো হয়েছে। আলোচ্য হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ শব্দদু'টির উল্লেখ করে আমাদের সাবধান করেছেন যে, এর দ্বারা যে নিন্দনীয় স্বভাব বোঝানো হয়ে থাকে তা থেকে তোমরা দূরে থাকবে। কেননা এ স্বভাবের লোক জাহান্নামে যাবে।
এ হাদীছে জান্নাতী ও জাহান্নামীদের যে স্বভাব উল্লেখ করা হয়েছে তা দ্বারা এ কথা বোঝানো উদ্দেশ্য নয় যে, কেবল এই স্বভাবের লোকেরাই জান্নাতে বা জাহান্নামে যাবে, এছাড়া আর কেউ যাবে না। বরং বোঝানো উদ্দেশ্য হচ্ছে, যেসকল সৎগুণের কারণে মানুষ জান্নাতে যাবে এবং যেসকল অসৎগুণের কারণে জাহান্নামে যাবে, এগুলোও তার অন্তর্ভুক্ত। এছাড়াও এমন অনেক সৎগুণ আছে, জান্নাতলাভের জন্য যা জরুরি এবং এমন অনেক মন্দ স্বভাব আছে, যা মানুষকে জাহান্নামে নিয়ে যাবে। তাই সেসব গুণের ব্যাপারেও মুমিনদের সচেতন থাকা অবশ্যকর্তব্য।
এ হাদীছে জাহান্নামীদের তৃতীয় বৈশিষ্ট্য বলা হয়েছে যে, তারা অর্থাৎ অহংকারী। অহংকার অত্যন্ত নিন্দনীয় স্বভাব। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন لا يدخل الجنة من كان في قلبه مثقال ذرة من كبر ‘যার অন্তরে কণা পরিমাণ অহংকার আছে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।২৪৪
প্রশ্ন হচ্ছে, অহংকার কী? অনেকে সুন্দর পোশাক পরা, ভালো খাওয়া-দাওয়া করা ও পরিপাটি চলাফেরাকে অহংকার মনে করে থাকে। এ ধারণা ঠিক নয়। জীবনমাণে আপন সামর্থ্যের প্রকাশ দূষণীয় নয়; বরং ক্ষেত্রবিশেষে তা কাম্যও। আল্লাহ তাআলা যাকে যে সামর্থ্য দান করেছেন, কাজকর্মে তা প্রকাশ করা শোকরেরও অন্তর্ভুক্ত। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন إن الله يحب أن يرى أثر نعمته على عبده “আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দার উপর নিজ নিআমতের প্রকাশ দেখতে পসন্দ করেন।২৪৫
চালচলন ও বেশভূষায় সামর্থ্যের প্রকাশ দোষের হয় তখনই, যখন তুলনামূলক কম সামর্থ্যবানকে হেয়জ্ঞান করা হয়। সেটা অহংকারের মধ্যে পড়ে। সুতরাং উল্লিখিত হাদীছটি শুনে এক সাহাবী বলেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কোনও কোনও মানুষ এমন আছে, যে ভালো জামা-জুতা পসন্দ করে, সুন্দর হয়ে চলাটা তার প্রিয়। এর উত্তরে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন যে, আল্লাহ সুন্দর, তিনি সৌন্দর্য পসন্দ করেন। অর্থাৎ তুমি যা বলছ তা অহংকার নয়। তারপর তিনি অহংকারের সংজ্ঞা দান করলেন যে الكبر بطر الحق وغمط الناس ‘অহংকার হচ্ছে সত্য প্রত্যাখ্যান করা ও মানুষকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা।২৪৬
এর দ্বারা অহংকার কী তা বোঝা গেল। সুতরাং কোনও বিষয় নিয়ে কারও সঙ্গে মতভিন্নতা দেখা দিলে বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখা চাই কার মত সত্য ও সঠিক। যদি স্পষ্ট হয়ে যায় প্রতিপক্ষের মত সঠিক, তবে সে যে-ই হোক না কেন তা মেনে নেওয়া চাই। সে গরীব, শিক্ষা-দীক্ষায় কম বা সামাজিক অবস্থান নিচে, সে তুলনায় আমি উপরে, এ জাতীয় চিন্তাভাবনার কারণে যদি তার মত মেনে নিতে কুণ্ঠাবোধ হয়, তবে নিঃসন্দেহে তা অহংকার। এমনিভাবে কাউকে কোনওদিক থেকে নিজের চেয়ে কম মনে হলে সে কারণে তাকে তুচ্ছ করা হলে তা অহংকার বটে। আর আলোচ্য হাদীছ দ্বারা যখন জানা গেল অহংকার জাহান্নামীদের বৈশিষ্ট্য, তখন অবশ্যই এ জাতীয় আচরণ পরিহার করে চলতে হবে। এটাই এ হাদীছের দাবি।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারা ধারণা পাওয়া যায় যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের লক্ষ্যবস্তু ছিল উম্মতকে জাহান্নাম থেকে বাঁচানো ও তাদেরকে জান্নাতের জন্য প্রস্তুত করা।

খ. জান্নাতের আকাঙ্ক্ষী মুমিনদের একান্ত কর্তব্য সাদামাঠা জীবনযাপন করা ও নিজেকে সাধারণদের অন্তর্ভুক্ত করে রাখা। প্রভাবশালী হয়ে থাকা ও জশখ্যাতির পেছনে পড়াটা জান্নাতলাভের পক্ষে অন্তরায়।

গ. মুমিনদের চেষ্টা করা উচিত অন্তরে কঠোরতার পরিবর্তে নম্রতা ও দয়ামায়া সৃষ্টির চেষ্টা করা।

ঘ. কিছুতেই অর্থবিত্তের মোহে পড়তে নেই। নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী দান-খয়রাত করা উচিত।

ঙ. চলাফেরায় দর্পিতভঙ্গি অত্যন্ত নিন্দনীয়। চলাফেরায় বিনয়ভঙ্গি বজায় রাখাই প্রকৃত মুমিনের শান।

চ. ভোগ-বিলাসিতা পরিহার করে যথাসম্ভব যুহদ ও সাদামাটা জীবনযাপনে অভ্যস্ত হওয়া চাই।

২৪২. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৪৬১১; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৫৯৫; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৪৭৫৬; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ২৬৪৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১২৭০৪; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৫৮৮৩; তহাবী, শারহু মাআনিল আছার, হাদীছ নং ৪৯৯৫; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ২৫২৯

২৪৩, মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৭৯৯১

২৪৪. সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৯১; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৯৯৯; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৫৯; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪০৯১; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৫৪৬৬; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৫৭৮২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৩৭৮৯; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ৬৬৬৮

২৪৫. জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৮১৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৮১০৯; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৫৪১৭; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৬০৯৩; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৪২৫১; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ২৮১; আল মুজামুল আওসাত, হাদীছ নং ৪৬৬৮; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ৩১১৯
২৪৬. সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৯১; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪০৯২; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৯৯৯; আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদীছ নং ৫৫৬; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৫৪৬৬; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ৬৪৭৯; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৫৭৮২; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ৩৫৮৭
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)
রিয়াযুস সালিহীন - হাদীস নং ২৫২ | মুসলিম বাংলা