রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ২৪৭
সুপারিশ করার গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য।
হযরত বারীরা রাযি.-এর ঘটনা
হাদীছ নং : ২৪৭

হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. বারীরা ও তার স্বামীর ঘটনা প্রসঙ্গে বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে (বারীরাকে) বললেন, তুমি যদি তাকে (তোমার স্বামীকে) পুনরায় গ্রহণ করতে? বারীরা বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি কি আমাকে হুকুম করছেন? তিনি বললেন, আমি কেবল সুপারিশই করছি। বারীরা বললেন, তাকে আমার প্রয়োজন নেই -বুখারী।
সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৫২৮৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৮৪৪; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ২০৭৫; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৪২৬৮; সুনানে দারা কুতনী, হাদীছ নং ২১৪০; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ২২৯৯
30 - باب الشفاعة
247 - وعن ابن عباس رضي الله عنهما في قِصَّةِ برِيرَةَ وَزَوْجِهَا، قَالَ: قَالَ لَهَا النَّبيُّ - صلى الله عليه وسلم: «لَوْ رَاجَعْتِهِ؟» قَالَتْ: يَا رَسُولَ اللهِ تَأمُرُنِي؟ قَالَ: «إنَّمَا أَشْفَع» قَالَتْ: لاَ حَاجَةَ لِي فِيهِ. رواه البخاري. (1)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

হযরত বারীরা রাযি. একজন বিখ্যাত মহিলা সাহাবী। তিনি এককালে দাসীর জীবন যাপন করেছেন। পরে উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রাযি. তাঁর মালিকের কাছে তাঁর মূল্য পরিশোধ করে তাঁকে আযাদ করে দেন। মুক্তিলাভের আগেই তাঁর বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিল। তাঁর স্বামীর নাম মুগীছ। কেউ কেউ মু'আত্তিব বলেছেন। তিনি ছিলেন কোনও এক গোত্রের গোলাম এবং ছিলেন সহজ-সরল এক কৃষ্ণাঙ্গ । অপরদিকে হযরত বারীরা রাযি. ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমতি ও সুন্দরী। হযরত মুগীছ রাযি. তাঁকে বেজায় ভালোবাসতেন।
দাসী থাকা অবস্থায় যদি কোনও নারীর বিবাহ হয় এবং তার স্বামীও দাস হয়, তবে মুক্তিলাভ করার পর শরীআতের পক্ষ থেকে সেই নারীর নিজ বিবাহ বহাল রাখা না রাখার এখতিয়ার লাভ হয়। তো উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. যখন বারীরা রাযি.-কে মুক্তিদান করলেন, তখন তাঁরও সেই এখতিয়ার লাভ হল। সেমতে তিনি তাঁর স্বামীকে পরিত্যাগ করলেন। এতে হযরত মুগীছ রাযি. ভীষণ শোকার্ত হয়ে পড়েন। তিনি কেঁদে কেঁদে দিন কাটাতে থাকেন। তিনি একান্তমনে কামনা করছিলেন যেন বারীরা তাঁর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন এবং তাঁকে স্বামী হিসেবে পুনরায় গ্রহণ করে নেন। কিন্তু বারীরা রাযি. তাঁর সিদ্ধান্তের অনড়।
হযরত মুগীছ রাযি.-এর শোকার্ত অবস্থা দেখে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দয়া হয়। সুতরাং তিনি তাঁকে ফেরত গ্রহণের জন্য বারীরা রাযি.-এর কাছে সুপারিশ করলেন। সে কথাই এ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। তিনি হযরত বারীরা রাযি.-কে বললেন- لو راجعته তুমি যদি তাকে (তোমার স্বামীকে) পুনরায় গ্রহণ করতে?'। অর্থাৎ তুমি যদি তাঁকে পুনরায় গ্রহণ করতে, তবে ভালো হত। তিনি কী কোমলভাবে এবং কতটা মনোরঞ্জনের সঙ্গে তাঁকে এ কথাটি বললেন! এর দ্বারা সুপারিশ করার ভাষা ও ভঙ্গিও শিক্ষালাভ করা যাচ্ছে।
এ কথাটির মধ্যে পরোক্ষভাবে আদেশের অর্থ নিহিত রয়েছে। তাই হযরত বারীরা রাযি. নিশ্চিত হতে চাইলেন যে, এটা তাঁর আদেশ কি না। কেননা আদেশ হলে তিনি তা মানতে বাধ্য। নবীর আদেশ অমান্য করার কোনও এখতিয়ার কারও থাকে না। হযরত বারীরা রাযি.-এর তা জানা ছিল। সুতরাং তিনি প্রশ্ন করলেন- يا رسول الله تأمرني؟ (ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি কি আমাকে হুকুম করছেন)? অর্থাৎ আপনি কি তাকে পুনরায় স্বামী হিসেবে গ্রহণ করে নেওয়ার জন্য আমাকে আদেশ করছেন, যা মানা আমার জন্য অবশ্যকর্তব্য? যদি তাই হয়, ব্যস তবে আমার কোনও কথা নেই, আমি তাকে পুনরায় গ্রহণ করে নেব।
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- إنما أشفع (আমি কেবল সুপারিশই করছি)। অর্থাৎ এটা অবশ্যপালনীয় আদেশ নয়; বরং সুপারিশ। এটা রাখা ও না রাখা তোমার এখতিয়ার। না রাখলে তোমার কোনও গুনাহ হবে না। সুতরাং হযরত বারীরা রাযি. হযরত মুগীছ রাযি.-কে পুনরায় গ্রহণ না করাকেই বেছে নিলেন । তিনি সুপারিশ রক্ষা করলেন না। বললেন- لا حاجة لي فيه (তাকে আমার প্রয়োজন নেই)। অর্থাৎ তাঁকে পুনরায় গ্রহণ দ্বারা আমার প্রয়োজন পূরণ হবে না। তাঁর প্রতি যেহেতু আমার মন নেই, তাই ফেরত গ্রহণ করলে আমাদের জীবন শান্তিপূর্ণ হবে বলে মনে হয় না। সুতরাং তিনি সুপারিশ গ্রহণ করতে না পারার ওজর পেশ করলেন। বোঝা গেল সুপারিশ সম্পূর্ণ ঐচ্ছিক বিষয়। যার কাছে সুপারিশ করা হয়, তার তা রাখা ও না রাখা উভয়েরই এখতিয়ার থাকে। এমনকি বড় ব্যক্তিও যদি তার অধীন বা সাধারণ কারও কাছে সুপারিশ করে, তখনও সে এখতিয়ার আরোপের অধিকার তার আছে। চাইলে সে তার সুপারিশ রাখতেও পারে, নাও রাখতে পারে। এটা বড়র সঙ্গে ছোটর বেআদবী বলে গণ্য হবে না। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর এক সাধারণ উম্মতের পক্ষ থেকে তাঁর সুপারিশ গ্রহণ না করাকে বেআদবীরূপে নেননি। তাঁর কাছ থেকে আমাদের এ মহত্ত্বও শেখার রয়েছে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

এ হাদীছের মধ্যে শিক্ষণীয় আছে অনেক কিছু। এখানে তা থেকে কয়েকটি উল্লেখ করা যাচ্ছে।

ক. অন্যের বিপদ ও সংকট এবং দুঃখ-কষ্টে সহমর্মিতা প্রকাশ করা চাই। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত মুগীছ রাযি.-এর প্রতি তাই করেছেন।

খ. কারও শোক ও দুঃখ নিবারণের ব্যবস্থা গ্রহণ করার ক্ষমতা যার আছে, তার কাছে সেই ব্যক্তির পক্ষে সুপারিশ করা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নত, যেমন তিনি মুগীছ রাযি.-এর পক্ষে বারীরা রাযি.-এর কাছে সুপারিশ করেছেন।

গ. সুপারিশের ভাষা হওয়া চাই কোমল ও মনোরঞ্জনমূলক।

ঘ. স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার ভালোবাসা থাকা-নাথাকা আল্লাহপ্রদত্ত বিষয়। এ জন্য কারও নিন্দা করা চলে না, যেহেতু এটা কারও ইচ্ছাধীন নয়।

ঙ. স্ত্রীর প্রতি স্বামীর ভালোবাসা প্রকাশ দূষণীয় নয়।

চ. কোনও স্ত্রী তার স্বামীকে মন দিয়ে গ্রহণ করে নিতে না পারলে অভিভাবকের তাকে তার ঘর করতে বাধ্য করা উচিত নয়।

ছ. অনুরূপ যে স্ত্রী তার স্বামীকে মনেপ্রাণে ভালোবাসে, তাকে স্বামী থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা বাঞ্ছনীয় নয়।

জ. বড় ব্যক্তি তার অধীন বা সাধারণ কারও কাছে সুপারিশ করলে তা মানা বাধ্যতামূলক হয়ে যায় না।

ঝ. সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করা হলে সুপারিশকারীর ব্যথিত হওয়া উচিত নয়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)
রিয়াযুস সালিহীন - হাদীস নং ২৪৭ | মুসলিম বাংলা