রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ২৪৮
অধ্যায়: ৩১

মানুষের মধ্যে মীমাংসা করে দেওয়ার গুরুত্ব ও ফযীলত

আমাদের এ দীনে মানুষের মধ্যে মীমাংসা করে দেওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। ইসলামী শরীআতের যাবতীয় বিধানেও সমাজবদ্ধতার বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষ রাখা হয়েছে। এমন কোনও বিধান দেওয়া হয়নি, যা দ্বারা মানুষের সমাজবদ্ধতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বরং ইসলামী বিধি-বিধান পরিপূর্ণভাবে মেনে চললে মানবসমাজ আরও বেশি সুসংগঠিত ও শান্তিপূর্ণ হয়। আবার সমাজ যতবেশি সম্প্রীতিপূর্ণ হয়, ততই সকলের পক্ষে দীন ও শরীআত মেনে চলাও বেশি সহজসাধ্য হয়। যাতে করে মানুষের দুনিয়া ও আখেরাত উভয়ই সাফল্যমণ্ডিত হয়। বোঝা যাচ্ছে সমাজের সদস্যগণের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান দীন ও দুনিয়া উভয় বিচারেই জরুরি। যদি দুই ব্যক্তির মধ্যে কলহ দেখা দেয়, তবে সে কলহ দ্বারা কেবল সে দুজনই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না; ক্রমান্বয়ে গোটা সমাজই ক্ষতির শিকার হয়ে যায়। দুই ব্যক্তির কলহের পরিণামে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর দুনিয়া ও আখেরাত বরবাদ যাওয়ার উপক্রম হয়। কাজেই কলহ দেখা দেওয়ামাত্র তা মিটমাট করে ফেলার উদ্যোগ নেওয়া একান্ত জরুরি। এটা অনেক বড় ছাওয়াবের কাজও বটে। কুরআন ও হাদীছ আমাদেরকে এ কাজের প্রতি বিপুল উৎসাহ দান করেছে। এটা করার জন্য জোর তাগিদও দিয়েছে। ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে সেরকম কিছু আয়াত ও হাদীস উল্লেখ করেছেন। আমরা নিছে তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তাআলাই তাউফীকদাতা।

মানুষের মধ্যে মীমাংসা করে দেওয়া

সম্পর্কিত কিছু আয়াত

এক নং আয়াত

لَا خَيْرَ فِي كَثِيرٍ مِنْ نَجْوَاهُمْ إِلَّا مَنْ أَمَرَ بِصَدَقَةٍ أَوْ مَعْرُوفٍ أَوْ إِصْلَاحٍ بَيْنَ النَّاسِ

অর্থ : 'মানুষের বহু গোপন কথায় কোনও কল্যাণ নেই। তবে কোনও ব্যক্তি দান- সদাকা বা কোনও সৎকাজের কিংবা মানুষের মধ্যে মীমাংসার আদেশ করলে, সেটা ভিন্ন কথা।২০৯

ব্যাখ্যা

এ আয়াতের দুটি অংশ। প্রথম অংশে বহু গোপন কথা সম্পর্কে জানানো হয়েছে যে, তাতে কোনও কল্যাণ নেই। এর দ্বারা ইঙ্গিত পাওয়া যায়, কোনও কোনও গোপন কথা ব্যতিক্রম। তার মধ্যে কল্যাণ আছে। সে কথাই আয়াতের পরের অংশে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে- إِلَّا مَنْ أَمَرَ بِصَدَقَةٍ أَوْ مَعْرُوفٍ أَوْ إِصْلَاحٍ بَيْنَ النَّاسِ (তবে কোনও ব্যক্তি দান-সদাকা বা কোনও সৎকাজের কিংবা মানুষের মধ্যে মীমাংসার আদেশ করলে সেটা ভিন্ন কথা)। এখানে তিনটি বিষয়কে ব্যতিক্রম সাব্যস্ত করা হয়েছে। তা হচ্ছে দান-সদাকার আদেশ করা, সৎকাজের আদেশ করা ও মীমাংসার আদেশ করা। এগুলো প্রকাশ্যেও করা যায়। তবে অনেক সময় পরিবেশ-পরিস্থিতি প্রকাশ্যে করার অনুকূল হয় না। তখন গোপনে করাই সমীচীন।
দান-খয়রাত করা একটি বড় নেক আমল। সাধারণত এ কাজ গোপনে করা উত্তম। প্রকাশ্যে দান-খয়রাত করার দ্বারা যেমন অন্তরে রিয়া ও মানুষকে দেখানোর মানসিকতা পয়দা হয়, তেমনি যাকে দেওয়া হয় তার জন্যও তা অমর্যাদাকর হয়। গোপনে দান করলে এ উভয়দিকই রক্ষা হয়। এমনিভাবে কাউকে এ কাজে উৎসাহিত করাটাও সাধারণত গোপনেই ভালো। প্রকাশ্যে করার দ্বারা তার আত্মসম্মানবোধে আঘাত লাগতে পারে। তাছাড়া ব্যক্তিবিশেষকে অর্থসাহায্যের পরামর্শ দিলে সে ব্যক্তির একরকম অসম্মান হয় । তাই গোপনীয়তাই বাঞ্ছনীয়।
দ্বিতীয়ত সৎকাজের আদেশকেও ব্যতিক্রম বলা হয়েছে। অর্থাৎ এটাও গোপনে করা কল্যাণকর। আয়াতে যে مَعْرُوفٍ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, এর দ্বারা এমন যে- কোনও কাজ বোঝানো হয়, যা শরীআতে পসন্দনীয় এবং যা পসন্দনীয় কাজ হিসেবে সুপরিচিত। এর বিপরীত শব্দ হল منكر (মুনকার)। মুনকার বলা হয় এমনসব কাজকে, যা শরীআতে অপসন্দনীয় এবং উম্মতের কাছেও অপরিচিত ও আপত্তিকর।
যাহোক সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার কাজটিও সাধারণত গোপনেই ভালো। গোপনে করার দ্বারাই সংশোধনের আশা বেশি থাকে। এ কাজ প্রকাশ্যে করার দ্বারা অনেক সময় অন্তরে জিদ দেখা দেয়। ফলে সৎকাজ পরিত্যাগে আগের চেয়ে আরও বেশি গোঁ ধরে বসে এবং অসৎকাজেও অধিকতর স্পর্ধিত হয়। তাছাড়া প্রকাশ্যে নিষেধ করার দ্বারা অন্যায়-অপরাধের একরকম প্রচারণাও হয়ে যায়। তাই এর থেকে বিরত থাকা উচিত। অবশ্য ক্ষেত্রবিশেষে প্রকাশ্যেও করতে হয়। গোপনে অনেক বোঝানো সত্ত্বেও যখন সংশোধন হয় না, একাধারে সৎকাজ পরিত্যাগ করতেই থাকে, অসৎকাজও ছাড়ার কোনও লক্ষণ দেখা যায় না, তখন প্রকাশ্যেই আদেশ-উপদেশ দেওয়ার পালা এসে যায়।
এ আয়াতে যে তিনটি ব্যতিক্রম বিষয়ের কথা বলা হয়েছে, তার তৃতীয় হচ্ছে মানুষের মধ্যে ইসলাহ তথা আপস-রফা ও মীমাংসা করে দেওয়া। অর্থাৎ দুই ভাই, দুই আত্মীয়, দুই প্রতিবেশী, দুই বন্ধু, স্বামী-স্ত্রী এবং এরকম যে-কোনও দুই পক্ষের মধ্যে মনোমালিন্য বা ঝগড়া-ফাসাদ দেখা দিলে অন্যদের কর্তব্য তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেওয়া এবং চেষ্টা করা যাতে তারা ফের আগের মতই মিল-মহব্বতের সঙ্গে দিন কাটায়। এটা অনেক বড় ফযীলতের কাজ। ইনশাআল্লাহ সামনে আমরা এ ফযীলত জানতে পারব
লক্ষণীয় যে, দান-সদাকা ও ইসলাহের কাজটি যদিও সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের অন্তর্ভুক্ত, তারপরও এ দু'টিকে আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এর দ্বারা এ দু'টির বিশেষ গুরুত্ব বোঝা যায়। বাস্তবিকই এ দু'টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কেননা একটি শান্তিপূর্ণ ও উৎকৃষ্ট সমাজগঠনে দান-সদাকা ও ইসলাহী কার্যক্রম গভীর ভূমিকা রাখে।
সমাজগঠনের জন্য মৌলিকভাবে দু'টি কাজ প্রয়োজন। এক প্রয়োজন মানুষকে যাবতীয় ক্ষতি থেকে রক্ষা করা, দ্বিতীয় প্রয়োজন তাদেরকে তাদের কল্যাণকর বিষয়াবলী সরবরাহ করা।
মানুষের কল্যাণসাধনের পক্ষে দান-খয়রাত এক উত্তম ব্যবস্থা। যথাযথভাবে যাকাত ও অবশ্যপ্রদেয় অর্থ (যেমন ফিত্রা, কাফ্ফারা, মানত ইত্যাদি) বিতরণ করা এবং আপন আপন সামর্থ্য অনুযায়ী নফল দান-খয়রাত করার দ্বারা সমাজের প্রভূত কল্যাণ সাধিত হয়ে থাকে। এর দ্বারা মানুষের দীনী ও দুনিয়াবী নানা প্রয়োজন সমাধা হয়। আর এর মধ্য দিয়ে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ঐক্য ও সম্প্রীতিও প্রতিষ্ঠিত হয়।
সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ দ্বারা ব্যক্তি ও সমাজকে যাবতীয় ক্ষতি থেকে রক্ষা করা যায়। এ কাজ বন্ধ থাকলে বহুমুখী অনিষ্ট ও অন্যায়-অনাচারের ক্রমবিস্তার ঘটে। একপর্যায়ে গোটা সমাজ অশান্তির অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে যায় । বর্তমান বিশ্ব যে সর্বগ্রাসী অন্যায়-অনাচারের বিষবাষ্পে খাবি খাচ্ছে, সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের দায়িত্ব পালনে চরম শৈথিল্যই কি এর জন্য মূল দায়ী নয়?
এ আয়াতের শিক্ষা এটাই যে, আমরা কথাবার্তা বলব হুঁশিয়ারীর সঙ্গে। কোনওক্রমেহ যাতে আমাদের কথা আমাদের দুনিয়া ও আখেরাতের পক্ষে অকল্যাণকর না হয়, সেদিকে লক্ষ করেই যা বলার বলব। অন্যথায় প্রকাশ্য-গোপন সব কথাই আমাদের দুনিয়া ও আখেরাত বরবাদির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মু হাবীবা রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

كُلُّ كَلَام ابْنِ آدَمَ عَلَيْهِ لَا لَهُ إِلَّا أَمْرٌ بِمَعْرُوفٍ أَوْ نَهْي عَنْ مُنْكَرٍ أَوْ ذِكْرُ اللَّهِ

‘আদমসন্তানের সব কথাই তার জন্য ক্ষতিকর, কল্যাণকর নয়। তবে ব্যতিক্রম হচ্ছে সৎকাজের আদেশ, অসৎকাজে নিষেধ ও আল্লাহর যিকর।২১০

দুই নং আয়াত

وَالصُّلْحُ خَيْرٌ

অর্থ : ‘আর আপস-নিষ্পত্তিই উত্তম।২১১

ব্যাখ্যা
এ আয়াতাংশ মূলত স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার অসদ্ভাব নিরসন-সম্পর্কিত। আয়াতে এর আগে আছে-

وَإِنِ امْرَأَةٌ خَافَتْ مِنْ بَعْلِهَا نُشُوزًا أَوْ إِعْرَاضًا فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِمَا أَنْ يُصْلِحَا بَيْنَهُمَا صُلْحًا
‘কোনও নারী যদি তার স্বামীর পক্ষ হতে দুর্ব্যবহার বা উপেক্ষার আশঙ্কা করে, তবে তাদের জন্য এতে কোনও অসুবিধা নেই যে, তারা পারস্পরিক সম্মতিক্রমে কোনও রকমের আপস-নিষ্পত্তি করবে।'
এতে স্বামী-স্ত্রীকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে যে, তাদের উভয়পক্ষ বা কোনও একপক্ষ আপন অধিকারে ছাড় দিয়ে হলেও যেন আপস-নিষ্পত্তি করে নেয়। কোনও প্রকার ছাড় দিতে প্রস্তুত না হলে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয় না। নিরন্তর ঝগড়া- ফাসাদের সাথে কতদিন একসঙ্গে থাকা যায়? পরিণাম দাঁড়ায় বিবাহবিচ্ছেদ। বিবাহবিচ্ছেদ সর্বশেষ ব্যবস্থা। যতদিন এটি এড়ানো যায়, এড়ানোই উচিত। কেননা সাধারণভাবে এটা উভয়ের পক্ষেই ক্ষতিকর, বিশেষত যদি ছেলেমেয়ে থাকে। কাজেই সে ক্ষতিকর পর্যায়ে যাতে উপনীত হতে না হয়, সে লক্ষ্যে ছাড় দিয়ে হলেও আপস- রক্ষা করা চাই। সে কথাই আয়াতের এ অংশে বলা হয়েছে যে- وَالصُّلْحُ خَيْرٌ (আর আপস-নিষ্পত্তিই উত্তম)।
যদিও আয়াতটি স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কিত, কিন্তু সাধারণ শব্দে বলা হয়েছে- আপস- নিষ্পত্তিই উত্তম। ফলে স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া-ফাসাদ যেমন এর অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, তেমনি পারিবারিক ও সামাজিক যে-কোনওরকম দ্বন্দ্ব-কলহ এর মধ্যে এসে যায়। কাজেই যে- কোনও দ্বন্দ্ব-কলহে জিদ্ ও হঠকারিতার পন্থা অবলম্বন না করে সকল পক্ষের উচিত সন্ধিতে আসা ও আপস নিষ্পত্তির পথে অগ্রসর হওয়া। আল্লাহ তাআলা সেটিকেই উত্তম বলেছেন। দ্বন্দ্ব-কলহ কোনও কল্যাণ বয়ে আনে না। তা যত দীর্ঘস্থায়ী হয়, ক্ষতিও তত বেশিই হয়। সে ক্ষতি থেকে বাঁচার লক্ষ্যে আপস-নিষ্পত্তির পন্থাই অবলম্বন করা চাই। তবে সন্ধিস্থাপন ও আপস-নিষ্পত্তিতে শরীআতের নির্দিষ্ট মূলনীতিও আছে। সে মূলনীতি রক্ষা করেই তা সম্পাদন করতে হবে। এক হাদীছে বর্ণিত হয়েছে—

الصُّلْحُ جَائِزٌ بَيْنَ الْمُسْلِمِينَ إِلَّا صُلْحًا أَحَلَّ حَرَامًا ، أَوْ حَرَّمَ حَلَالًا

‘মুসলিমদের মধ্যে সন্ধিস্থাপন জায়েয, তবে ওই সন্ধি নয়, যা হারামকে হালাল করে বা হালালকে হারাম করে।২১২

অন্য এক হাদীছে ইরশাদ-

الْمُسْلِمُونَ عَلَى شُرُوطِهِمْ فِيْمَا وَافَقَ الْحَقَّ

‘মুসলিমদের পারস্পরিক (সন্ধি ও আপস-নিষ্পত্তিতে আরোপিত) সব শর্তই অবশ্যপালনীয়, যখন তা ন্যায়ানুগ (অর্থাৎ শরীআতসম্মত) হয়।২১৩
বোঝা গেল সন্ধিতে কোনও শরীআতবিরোধী শর্ত আরোপ করা হলে সে শর্ত রক্ষা করা জরুরি নয়; বরং তা রক্ষা করা জায়েযই নয়। যেমন, বিবদমান দুই পক্ষের এক পক্ষ বিবাদ মিটিয়ে ফেলার জন্য এই শর্ত দিল যে, আমি তোমার সঙ্গে মিলতে রাজি আছি, যদি তুমি তোমার অমুক আত্মীয়কে ত্যাগ কর। এমনিভাবে স্বামী-স্ত্রীর কলহ মিটমাটের জন্য স্বামী শর্ত দিল- আমি তোমাকে নিয়ে ঘর-সংসার করতে রাজি আছি, যদি তুমি পর্দাপুশিদা পরিত্যাগ কর, কিংবা স্ত্রী শর্ত দিল- আমি তোমার ঘর করতে রাজি আছি, যদি তুমি আমাকে আমার ইচ্ছামত ঘোরাফেরা করতে দাও; চাইলে আমি পুরুষ বন্ধুদের সঙ্গে বিদেশ ভ্রমণও করব। এসবই অবৈধ শর্ত। এসব শর্ত মানা জায়েয নয়। যদি এসব শর্তের ভিত্তিতে মীমাংসা হয়ে যায়, তবে পরে এ শর্ত রক্ষা করাও জায়েয নয়।

তিন নং আয়াত

فَاتَّقُوا اللَّهَ وَأَصْلِحُوا ذَاتَ بَيْنِكُمْ

অর্থ : 'সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং তোমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক শুধরে নাও।২১৪

ব্যাখ্যা

এ আয়াতে আদেশ করা হয়েছে যে, মুসলিমদের মধ্যে যদি কোনও বিষয়ে মনোমালিন্য দেখা দেয়, তবে তা দূর করে পারস্পরিক সম্পর্ক ঠিক করে নেওয়া চাই। কেননা পারস্পরিক মনোমালিন্য দেখা দিলে যদি তা যথাশীঘ্র মিটমাট করা না হয়, তবে তা বহুদূর পর্যন্ত গড়ায়। দুই ব্যক্তির মধ্যকার কলহ দুই পরিবারকেও স্পর্শ করে। এমনকি অনেক সময় তা পাড়ায় পাড়ায় দাঙ্গা সংঘর্ষেরও পর্যায়ে পৌঁছে যায়। সে পর্যায়ে পৌঁছার আগেই পরস্পরের মধ্যে মিটমাট করে নেওয়া চাই। নিজেরা তা করতে না পারলে অন্যদের কর্তব্য তাতে ভূমিকা রাখা। এটা অনেক বড় ছাওয়াবেরও কাজ। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

أَلَا أُخبِرُكُمْ بِأَفْضَلَ مِنْ دَرَجَةِ الصَّيَامِ وَالصَّلاةِ وَالصَّدَقَةِ؟ قَالُوا: بَلَى يَا رَسُولَ الله! قَالَ: إِصْلَاحُ ذَاتِ الْبَيْنِ، وَفَسَادُ ذَاتِ الْبَيْنِ الْحَالِقَة

‘আমি কি তোমাদেরকে এমন আমল সম্পর্কে অবহিত করব না, যা রোযা, নামায ও সদাকা অপেক্ষাও উত্তম? সাহাবীগণ বললেন, অবশ্যই ইয়া রাসূলাল্লাহ। তিনি বললেন, তা হচ্ছে পরস্পরের মধ্যে সন্ধি-মীমাংসা করে দেওয়া। কেননা পারস্পরিক অমিল-অশান্তি ধ্বংসকর।২১৫
পারস্পরিক সম্পর্ক নষ্ট হওয়াকে ধ্বংসকর বলা হয়েছে এ কারণে যে, এর ফলে হিংসা-বিদ্বেষ ও শত্রুতা সৃষ্টি হয়ে যায়। তখন একে অন্যের ক্ষতি করার জন্য নানারকম অবৈধ কাজকর্ম করা হয়- মিথ্যা কথা বলা হয়, গীবত করা হয়, অপবাদ দেওয়া হয়, জান-মালের ক্ষতিসাধনের জন্য বিভিন্ন অবৈধ পন্থা অবলম্বন করা হয়। এমনকি নামায-রোযা পর্যন্ত নষ্ট করা হয়। এভাবে পারস্পরিক কলহ-বিবাদ মানুষের দুনিয়া ও আখেরাত সবই বরবাদ যাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পরস্পরের মধ্যে মীমাংসা করে দেওয়ার দ্বারা যেহেতু উভয়পক্ষকে সে পরিণতি থেকে রক্ষা করা যায়, তাই এটা নফল ইবাদত-বন্দেগী অপেক্ষাও বেশি ফযীলতের কাজ।

চার নং আয়াত

إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ

অর্থ : ‘প্রকৃতপক্ষে সমস্ত মুসলিম ভাই-ভাই। সুতরাং তোমরা তোমাদের দু ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা করে দাও।২১৬

ব্যাখ্যা

এ আয়াতে মুমিনদের পরস্পরের মধ্যে কলহ দেখা দিলে তা মিটমাট করে দেওয়ার আদেশ করা হয়েছে। সে আদেশের পূর্বে বলা হয়েছে মুমিনগণ ভাই-ভাই। অর্থাৎ ভ্রাতৃত্বের দাবি হল মিলেমিশে থাকা ও কলহ-বিবাদে লিপ্ত না হওয়া। দুর্ঘটনাক্রমে কখনও কলহ দেখা দিলে যথাশীঘ্র মিলেমিশে যাওয়া চাই। মিলেমিশে যাওয়ার চেষ্টা প্রথমত তাদেরই করা উচিত, যাদের মধ্যে কলহ সৃষ্টি হয়েছে। যদি তাদের মধ্যে সে উদ্যোগ পরিলক্ষিত না হয়, তবে অন্যদের এগিয়ে আসা উচিত। কেননা যে দুই ব্যক্তির মধ্যে কলহ দেখা দিয়েছে তারা তাদের ভাই। দুই ভাইয়ের মধ্যে কলহ সৃষ্টি হলে অপর ভাই তার নীরব দর্শক হয়ে বসে থাকতে পারে না। তার কর্তব্য তাদেরকে নিবৃত্ত করার উদ্যোগ নেওয়া। আল্লাহ তাআলা বলছেন-
فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ (তোমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা করে দাও)। অর্থাৎ ভাই হিসেবে তোমার কাছে তাদের এটা প্রাপ্য যে, তুমি তাদের দ্বন্দ্ব নিরসনে ভূমিকা রাখবে।
বস্তুত দুই মুসলিম ভাইয়ের মধ্যে আত্মকলহ দেখা দিলে অপর মুসলিম ভাইয়ের তা নিরসন করার চেষ্টা কেবল তাদের স্বার্থেই নয়; বরং নিজ স্বার্থেও করা উচিত। কেননা দ্বন্দ্ব-কলহ প্রথমেই নিরসন করা না হলে আগুনের মত তা ছড়িয়ে পড়ে। ক্রমে তা অন্যদেরও গ্রাস করে নেয়। তার থাবা থেকে নীরব দর্শকও রেহাই পায় না। এজন্যই তারা নিজেরা মিটমাট না করলেও অন্যদের স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই তাদের মধ্যে মিটমাট করে দেওয়া উচিত।
আত্মকলহের একটা বড় ক্ষতি এইও যে, তাতে শত্রু সুযোগ পায়। শত্রু চায় কলহ দীর্ঘস্থায়ী হোক। আত্মকলহে যেমন আত্মিক শক্তি নষ্ট হয়, তেমনি অর্থবল ও পেশীশক্তিরও ক্রমক্ষয় ঘটে। শত্রু তো সেটাই চায়, যাতে করে মুমিনগণ নিজেরা মারামারি করে নিস্তেজ হয়ে পড়ে আর সে অবকাশে তারা নির্বিঘ্নে ভেতরে ঢুকে পড়তে পারে। আমরা শত্রুকে সে সুযোগ দেব কেন? ইতোমধ্যে সে সুযোগ আমরা তাদের অনেক দিয়ে ফেলেছি। একদিন যারা আমাদের দ্বারা শাসিত ছিল, আজ বিশ্বব্যাপী তাদেরই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শাসনের যাতাকলে আমরা পিষ্ট হচ্ছি। এ আমাদের আত্মকলহেরই পরিণাম। ক্ষুদ্র পরিসর থেকে বৃহৎ পরিসরে আমাদের আত্মকলহের সুযোগ তারা হরদমই নিয়ে যাচ্ছে। এর থেকে পরিত্রাণের প্রকৃষ্ট উপায় আত্মকলহ ভুলে পরস্পর ঐক্য-ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে সুদৃঢ় থাকা। যেখানেই যখন কোনও দ্বন্দ্ব-কলহ দেখা দেয়, যথাশীঘ্র তা মিটমাট করে ফেলা- বিবদমান দু'ভাই নিজেই কিংবা তৃতীয় ভাইয়ের উদ্যোগে।

২০৯. সূরা নিসা (৪), আয়াত ১১৪

২১০. সুনানে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৪১২; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৩৯৭৪; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ৪৮৪; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৫১১; মুসনাদ আবূ ইয়া'লা, হাদীছ নং ৭১৩২

২১১. সূরা নিসা (৪), আয়াত ১২৮

২১২. সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৩৫৯৪; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৪৪৩২; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ৩০; তহাবী, শারহু মাআনিল আছার, হাদীছ নং ৫৮৪৯

২১৩. মুসান্নাফ আব্দুর রাযযাক, হাদীছ নং ১৫৬০৯; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১১৪২৯; বায়হাকী, আস্ সুনানুস্ সাগীর, হাদীছ নং ২১০৫; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৪০৩৯; সুনানে দারা কুতনী, হাদীছ নং ২৮৯৪

২১৪. সূরা আনফাল (৮), আয়াত ১

২১৫. সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৯১৯; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৫০৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২৭৫০৮; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ৩১; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৫০৯২; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ৩৫৩৮; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ১০৫৭৮

২১৬. সূরা হুজুরাত (৪৯), আয়াত ১০
মানবদেহের জোড়াসমূহের বিপরীতে বিভিন্নরকম সদাকা আদায়ের নির্দেশনা
হাদীছ নং : ২৪৮

হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, সূর্য উদিত হয় এমন প্রতিটি দিনে মানবদেহের প্রতিটি জোড়ার উপর সদাকা আবশ্যিক হয়। কেউ দুই ব্যক্তির মধ্যে ন্যায্যভাবে মীমাংসা করে দিলে তা একটি সদাকা। কোনও ব্যক্তিকে সওয়ারিতে চড়তে সাহায্য করলে বা তার উপর তার মাল-সামানা তুলে দিলে তাও একটি সদাকা। উৎকৃষ্ট কথাও একটি সদাকা । কেউ নামাযে যাওয়ার জন্য যে পথ চলে, তার প্রতিটি কদম ফেলা একেকটি সদাকা। তুমি যদি রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে দাও, তাও একটি সদাকা -বুখারী ও মুসলিম।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ২৭০৭; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১০০৯; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৩৩৮১; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৮১৬৭; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৭৮২০; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৩০৫৩; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ১৬৪৫)
31 - باب الإصلاح بَيْنَ الناس

قَالَ الله تَعَالَى: {لا خَيْرَ فِي كَثِيرٍ مِنْ نَجْوَاهُمْ إِلاَّ مَنْ أَمَرَ بِصَدَقَةٍ أَوْ مَعْرُوفٍ أَوْ إِصْلاحٍ بَيْنَ النَّاسِ} [النساء: 114]، وَقالَ تَعَالَى: {وَالصُّلْحُ خَيْرٌ} [النساء: 128]، وَقالَ تَعَالَى: {فَاتَّقُوا اللهَ وَأَصْلِحُوا ذَاتَ بَيْنِكُمْ} [الأنفال: 1]، وَقالَ تَعَالَى: {إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ} [الحجرات: 10].
248 - وعن أَبي هريرة - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم: «كُلُّ سُلاَمَى مِنَ النَّاسِ عَلَيهِ صَدَقَةٌ، كُلَّ يَوْمٍ تَطْلُعُ فِيهِ الشَّمْسُ: تَعْدِلُ بَيْنَ الاثْنَينِ صَدَقَةٌ، وَتُعينُ الرَّجُلَ في دَابَّتِهِ فَتَحْمِلُهُ عَلَيْهَا، أَوْ تَرْفَعُ لَهُ عَلَيْهَا مَتَاعَهُ صَدَقَةٌ، وَالكَلِمَةُ الطَّيِّبَةُ صَدَقةٌ، وَبِكُلِّ خَطْوَةٍ تَمشِيهَا إِلَى الصَّلاةِ صَدَقَةٌ، وَتُميطُ الأَذى عَنِ الطَّريقِ صَدَقَةٌ». مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (1)
ومعنى «تَعدِلُ بينهما»: تُصْلِحُ بينهما بالعدل.

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে মানবদেহের জোড়াসমূহ ও প্রতিটি অঙ্গ যে আল্লাহ তাআলার অনেক বড় নিআমত, সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে এবং এর শোকর আদায়ের উপায় শিক্ষা দেওয়া হয়েছে।
মানবদেহের জোড়াসমূহ কত বড় নিআমত তা একটু চিন্তা করলেই বুঝে আসে। এ জোড়াসমূহের কারণে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যবহার অত্যন্ত সহজ হয়েছে। এগুলো না থাকলে সারা শরীর অখণ্ড এক কাঠের গুঁড়ি বা পাথরের মূর্তির মত হত। না তা ইচ্ছামত নাড়াচাড়া করা যেত আর না সুবিধামত ব্যবহার করা সম্ভব হত। আল্লাহ জাল্লা শানুহু সুনির্দিষ্ট কাজের জন্য যেমন পৃথক পৃথক অঙ্গ সৃষ্টি করেছেন, তেমনি ব্যবহারের সুবিধার্থে অঙ্গসমূহকে সুনিপুণভাবে পরস্পর জুড়ে দিয়েছেন।
প্রথমত অঙ্গসমূহের সুসমঞ্জস সৃষ্টি ও তার যথোপযুক্ত সন্ধিস্থাপন আল্লাহ তাআলার বিশাল নিআমত। তারপর এসব অঙ্গ ও অঙ্গসন্ধি সুস্থ ও সক্রিয় রাখা তাঁর অতি বড় মেহেরবানী। আমাদের প্রতি তিনি এ মেহেরবানী নিত্যদিন জারি রাখছেন। মানুষ সাধারণত দিন শেষে ক্লান্ত-শ্রান্ত শরীর নিয়ে বিশ্রাম যায় আবার ভোরবেলা সুস্থ ও চনমনে শরীর নিয়ে কর্মক্ষেত্রে নেমে পড়ে।
প্রতিদিন সকালবেলা আমরা আমাদের প্রতিটি অঙ্গকে সুস্থ ও সচল পাই। কখনও এমনও হয়ে যায় যে, ঘুম থেকে উঠার পর দেখা গেল হাঁটুতে খিল ধরে গেছে। আগের মত স্বাভাবিক নড়াচড়া করছে না। যার এমন হয় সে বুঝতে পারে হাঁটুর জোড়াটি কত বড় নিআমত। এতদিন সে কেমন অবলীলায় চলাফেরা করত, আজ তার চলতে কত কষ্ট। তারপরও অন্যসব অঙ্গ যেহেতু অবিকল আছে, তাই তার জীবন সম্পূর্ণ অচল হয়ে যায়নি। সে তার বেশিরভাগ অঙ্গ নিয়ে সচল রয়েছে। আল্লাহ তাআলা চাইলে তার সবগুলো অঙ্গ বিকল করে দিতে পারতেন। বিশেষত এ কারণেও যে, অঙ্গগুলো তো আল্লাহ তাআলার হুকুম মোতাবেক ব্যবহার করা হয় না। প্রতিটি অঙ্গ আল্লাহ তাআলার কত বড় নিআমত। এর কোনওটিকেই পাপকর্মে ব্যবহার করা উচিত নয়। কিন্তু হামেশাই তা করা হচ্ছে। তা সত্ত্বেও আল্লাহ তাআলা এ নিআমত কেড়ে না নিয়ে বহাল তবিয়তে রেখে দিয়েছেন। তো ঘুম থেকে জাগার পর যখন এসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও তাদের সন্ধিসমূহ সুস্থ-সবল দেখতে পাওয়া যায়, তখন স্বাভাবিকভাবেই কর্তব্য হয়ে পড়ে এসবের সৃষ্টিকর্তা ও রক্ষাকর্তার সামনে নিজেকে একজন শোকরগুযার বান্দারূপে পেশ করা। এ হাদীছে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সংক্ষিপ্ত ও তাৎপর্যপূর্ণ বাক্যে এ বিষয়টাই তুলে ধরেছেন।
তিনি ইরশাদ করেন- كل سلامى من الناس عليه صدقة كل يوم تطلع فيه الشمس (সূর্য উদিত হয় এমন প্রতিটি দিনে মানবদেহের প্রতিটি জোড়ার উপর সদাকা আবশ্যিক হয়)। ‘সূর্য উদিত হয়' এ কথাটি 'দিন'-এর ব্যাখ্যামূলক বিশেষণ। অর্থাৎ সূর্যোদয়ের দ্বারাই দিনের সূচনা ঘটে। যদি সূর্য না উঠত, দিন হত না। তাহলে সূর্যোদয়ও আমাদের প্রতি আল্লাহ তাআলার এক বিরাট অনুগ্রহ। একটা সময় আসবে। যখন আর সূর্যোদয় হবে না। অনন্ত অন্ধকারে নিখিল বিশ্ব আচ্ছন্ন হয়ে যাবে। সেটা রোজ কিয়ামত। যতদিন কিয়ামত না হচ্ছে, ততদিন সূর্যের উদয়-অস্ত ঘটতে থাকবে আর এর মাধ্যমে কুলমাখলূক আল্লাহর অপার অনুগ্রহ লাভ করতে থাকবে। ভোগ করতে থাকবে বহুবিচিত্র নিআমত।
সূর্যোদয়ের মাধ্যমে মানুষ নিত্যনতুন দিন পায়। এভাবে প্রতিদিন নতুন করে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ও অস্থিসমূহের নিআমত হাসিল করে। তাই প্রতিদিন নতুন করে আল্লাহর শোকর আদায় করা তার কর্তব্য হয়ে যায়। সদাকা আদায় কর্তব্য বলে সেদিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। সেইসঙ্গে সারাদিন যাতে সবগুলো অঙ্গ সুস্থ ও সক্রিয় থাকে এবং নিজ গুনাহের কারণে কোনও অঙ্গ কেড়ে নেওয়া না হয়, তাও প্রত্যেকেরই একান্ত কাম্য। এ কামনা যাতে পূরণ হয়, সে লক্ষ্যেও সদাকা আদায় করা কর্তব্য। কেননা সদাকা দ্বারা বিপদাপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন الصدقة تطفئ غضب الرب، وتدفع ميتة السوء ‘সদাকা আল্লাহর ক্রোধ নিবারণ করে এবং অপমৃত্যু রোধ করে।২১৮
মানবদেহে ৩৬০টি জোড়া আছে। প্রতিটি জোড়ার বিনিময়ে একটি সদাকা ওয়াজিব হলে প্রতিদিন সর্বমোট ৩৬০টি সদাকা দেওয়া কর্তব্য হয়। বাহ্যত বিষয়টা কঠিন। কোনও কোনও সাহাবী প্রশ্নও করেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! ৩৬০টি সদাকা দেওয়া কী করে সম্ভব? তার উত্তরে তিনি এ হাদীছ পেশ করেন, যা দ্বারা জানা গেল যে, সদাকা বলতে কেবল অর্থ-সম্পদ খরচ করাই বোঝায় না; বরং যে-কোনও নফল ইবাদত-বন্দেগীকেও সদাকা বলে। এ হাদীছে সেরকম কয়েকটি আমল উল্লেখ করা হয়েছে। তার মধ্যে সর্বপ্রথম হচ্ছে দুই ব্যক্তির মধ্যে আপস-মীমাংসা করে দেওয়া।

দুই পক্ষের মধ্যে মীমাংসা করার দ্বারা সদাকার ছাওয়াব
হাদীছে ইরশাদ হয়েছে تعدل بين الاثنين صدقة (কেউ দুই ব্যক্তির মধ্যে ন্যায্যভাবে মীমাংসা করে দিলে তা একটি সদাকা)। অর্থাৎ দুই ব্যক্তির মধ্যে যদি ঝগড়া-ফাসাদ হয় বা এমন মনোমালিন্য হয়, যদ্দরুন একে অন্যের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত বন্ধ করে দেয়, তবে তাদের মধ্যে ন্যায় ও ইনসাফের সাথে মীমাংসা করে দেওয়া একটি সদাকা । গরীব-দুঃখীর প্রতি যেমন তাদের অভাবের কষ্ট লাঘবের উদ্দেশ্যে দান-সদাকা করা হয়ে থাকে, মীমাংসার কাজটিও যেন তদ্রূপ বিবদমান দুই পক্ষের উপর একরকম মানবিক দান। এর দ্বারা তাদের মানসিক কষ্ট লাঘব হয়। সেইসঙ্গে কলহ-বিবাদের কারণে যেসকল অন্যায়-অনুচিত কথা ও কাজে তারা লিপ্ত হয়ে পড়ে, তা থেকেও
তাদেরকে রক্ষা করা হয়, যেমন দান-সদাকা দ্বারা অভাবগ্রস্তকে অনুচিত কাজে লিপ্ত হওয়া থেকে রক্ষা করা হয়।
বিবদমান দুই পক্ষ আদালতের দ্বারস্থ হলে তখন তো মীমাংসা করাটা বিচারকের দায়িত্ব হয়ে যায় আর বিচারক ইনসাফসম্মত মীমাংসা করলে তারও এজন্য সদাকার ছাওয়াব অর্জিত হয়। পক্ষান্তরে আদালতে মামলা রুজু হওয়ার আগেই যদি কোনও দায়িত্বশীল ব্যক্তি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেয়, তবে সেও সদাকার ছাওয়াব লাভ করবে। যাদের এটা করার মত যোগ্যতা ও ক্ষমতা আছে তাদের এটা করাই উচিত। এটা ভ্রাতৃত্ববোধের দাবি। এক মুমিন যখন অপর মুমিনের ভাই, তখন দুই ভাইয়ের পারস্পরিক বিরোধে তৃতীয় ভাইয়ের মীমাংসামূলক ভূমিকা রাখা কর্তব্য বৈকি, যেমন উপরে বর্ণিত চতুর্থ আয়াত দ্বারা আমরা জানতে পেরেছি।
মীমাংসায় ন্যায়-ইনসাফ রক্ষা জরুরি
এ হাদীছে দু'জনের মধ্যে মীমাংসা করাকে تعدل (তুমি ইনসাফ করবে) শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে। এটা ইঙ্গিত করে, সত্যিকারের মীমাংসা সেটাই, যা ন্যায় ও ইনসাফসম্মত হয় এবং সদাকার ছাওয়াব সেরকম মীমাংসা দ্বারাই অর্জিত হয়। পক্ষান্তরে যে মীমাংসা ইনসাফসম্মত হয় না, তা প্রকৃত মীমাংসাই নয়; বরং জুলুম ও অন্যায় পক্ষপাত। সেরকম মীমাংসা ছাওয়াবের কাজ নয়; বরং কঠিন গুনাহ।
অন্যায় ও পক্ষপাতদুষ্ট মীমাংসা যখন কঠিন পাপ, তখন এর থেকে বিরত থাকা এবং সর্বদা ইনসাফসম্মত ফয়সালা করা অবশ্যকর্তব্য, তাতে বিচারপ্রার্থী যে-ই হোক না কেন বা বিবদমান কোনও পক্ষের সঙ্গে মীমাংসাকারীর সম্পর্ক যত ঘনিষ্ঠ এবং অপর পক্ষ তার যত ঘোর শত্রুই হোক না কেন। সুতরাং কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ بِالْقِسْطِ شُهَدَاءَ لِلَّهِ وَلَوْ عَلَى أَنْفُسِكُمْ أَوِ الْوَالِدَيْنِ وَالْأَقْرَبِينَ إِنْ يَكُنْ غَنِيًّا أَوْ فَقِيرًا فَاللَّهُ أَوْلَى بِهِمَا فَلَا تَتَّبِعُوا الْهَوَى أَنْ تَعْدِلُوا

“হে মুমিনগণ! তোমরা ইনসাফ প্রতিষ্ঠাকারী হয়ে যাও আল্লাহর জন্য সাক্ষ্যদাতারূপে, যদিও তা তোমাদের নিজেদের বিরুদ্ধে কিংবা পিতা-মাতা ও আত্মীয় স্বজনের বিরুদ্ধে হয়। সে ব্যক্তি (যার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ার আদেশ করা হচ্ছে)। যদি ধনী বা গরীব হয়, তবে আল্লাহ উভয়প্রকার লোকের ব্যাপারে (তোমাদের চেয়ে) বেশি কল্যাণকামী। সুতরাং তোমরা ইনসাফ করার ব্যাপারে ইচ্ছা-অভিরুচির অনুসরণ করো না।২১৯
অপর এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ لِلَّهِ شُهَدَاءَ بِالْقِسْطِ وَلَا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآنُ قَوْمٍ عَلَى أَلَّا تَعْدِلُوا اعْدِلُوا هُوَ أَقْرَبُ لِلتَّقْوَى وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ

'হে মুমিনগণ! তোমরা হয়ে যাও আল্লাহর (বিধানাবলি পালনের) জন্য সদাপ্রস্তুত (এবং) ইনসাফের সাথে সাক্ষ্যদানকারী এবং কোনও সম্প্রদায়ের প্রতি শত্রুতা যেন তোমাদেরকে ইনসাফ পরিত্যাগে প্ররোচিত না করে। ইনসাফ অবলম্বন করো। এ পন্থাই তাকওয়ার বেশি নিকটবর্তী। এবং আল্লাহকে ভয় করে চলো। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কাজ সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে অবগত।২২০

বাহনে ওঠা-নামায় সহযোগিতা করা
তারপর এ হাদীছে বলা হয়েছে- وتعين الرجل في دابته فتحمله عليها او ترفع له এই (কোনও ব্যক্তিকে সওয়ারিতে চড়তে সাহায্য করলে বা তার উপর তার মাল-সামানা তুলে দিলে তাও একটি সদাকা)। এটি এক উন্নত মানবিক শিক্ষা। অনেক সময় বৃদ্ধ, রুগ্ন, ভারী বোঝা বহনকারী ব্যক্তি কিংবা এরকম অনেকের পক্ষে যানবাহনে ওঠা অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এ হাদীছ আমাদের উৎসাহ দিচ্ছে যেন তাদেরকে যানবাহনে উঠতে সাহায্য করি। এতে সদাকার ছাওয়াব পাওয়া যায় এবং শরীরের জোড়ার উপর যে সদাকা ওয়াজিব হয় তা আদায় হয়ে যায়। অনুরূপ কারও মালামাল যানবাহনে তুলে দেওয়ার দ্বারাও একইরকম ছাওয়াব হাসিল হয়। এমনিভাবে যানবাহন থেকে নামতে বা মালামাল নামাতে সাহায্য করাটাও অনুরূপ ছাওয়াবের কাজ। আমরা অনেক সময়ই এ বিষয়টা লক্ষ করি না। ফলে নিজে যেমন ছাওয়াবের অংশীদার হওয়া থেকে বঞ্চিত থাকি, তেমনি মুসলিম ভাই-বেরাদারকেও অবাঞ্ছনীয় কষ্টের মধ্যে ফেলে রাখি, যা কিনা মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত নিন্দনীয়।
এরকম আরও অনেক কাজ আছে, যা যানবাহনে ওঠানামায় সাহায্য করার পর্যায়ভুক্ত। যেমন, কাউকে বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামায় সাহায্য করা, নদী, খাল বা পথসেতু পার হতে সহযোগিতা করা, রাস্তা পারাপার করিয়ে দেওয়া ইত্যাদি।
কারও বাহনে তার মাল তুলে দেওয়া যখন সদাকারূপে গণ্য, তখন অন্যের বোঝা বহনে সাহায্য করা নিশ্চয়ই আরও বেশি ছাওয়াবের কাজ হবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের মধ্যে ব্যাপক অবহেলা বিরাজ করে। যাত্রাপথে অনেক সময়ই দেখা যায় একই পথের যাত্রী ভারী বোঝা নিয়ে চলছে। কিন্তু আমার বোঝা হালকা। তা সত্ত্বেও ওই ব্যক্তির সাহায্যে আমরা কমই হাত বাড়াই। অথচ এটা করলে সদাকার ছাওয়াব পাওয়া যেত এবং অস্থিসন্ধির পক্ষ থেকে একটা সদাকা আদায় হয়ে যেত। এ হাদীছ আমাদেরকে সে কাজেও উৎসাহ যোগায়।

উত্তম কথাও সদাকা
এ হাদীছে আরও ইরশাদ হয়েছে- الكلمة الطيبة صدقة , (উৎকৃষ্ট কথাও একটি সদাকা)। 'কালেমায়ে তায়্যিবা' বা উৎকৃষ্ট কথা বলতে এমন যে-কোনও কথাকে বোঝায়, যা দ্বারা মানুষের দুনিয়া বা আখেরাতের কোনও কল্যাণ সাধিত হয়, যেমন সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করা, কাউকে সুপরামর্শ দেওয়া, কারও পক্ষে সুপারিশ করা, কারও শোকতাপে সান্ত্বনা দেওয়া, কাউকে আশু বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করা, কাউকে দীনী কোনও বিষয় শিক্ষাদান করা ইত্যাদি।
এমনকি কারও সঙ্গে বৈধ মনোরঞ্জনমূলক কথা বলাও সদাকার অন্তর্ভুক্ত। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো কারও মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দেওয়াকেও সদাকা সাব্যস্ত করেছেন। যেমন হযরত আবূ যার রাযি. বর্ণিত এক হাদীছে আছে تبسمك في وجه أخيك صدقة “তোমার ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তোমার মুচকি হাসি দেওয়াটাও একটি সদাকা।২২১
আমরা যাকে কালেমায়ে তায়্যিবা বলি অর্থাৎ 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ' (আল্লাহ ছাড়া কোনও মাবূদ নেই এবং হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তাআলার রাসূল), এটাও এক উৎকৃষ্ট কথা বৈকি। সুতরাং এটা মুখে উচ্চারণ করাও একটি সদাকা। এমনিভাবে এ কালেমা অন্যকে শিক্ষাদান করার মধ্যেও রয়েছে সদাকার ছাওয়াব।
কুরআন মাজীদে কালেমায়ে তায়্যিবা বা উৎকৃষ্ট কথাকে উৎকৃষ্ট গাছের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, যে গাছের ফল মানুষ সর্বদা ভোগ করতে পারে। ইরশাদ হয়েছে-

أَلَمْ تَرَ كَيْفَ ضَرَبَ اللَّهُ مَثَلًا كَلِمَةً طَيِّبَةً كَشَجَرَةٍ طَيِّبَةٍ أَصْلُهَا ثَابِتٌ وَفَرْعُهَا فِي السَّمَاءِ تُؤْتِي أُكُلَهَا كُلَّ حِينٍ بِإِذْنِ رَبِّهَا

“তোমরা কি দেখনি আল্লাহ কালেমা তায়্যিবার কেমন দৃষ্টান্ত দিয়েছেন? তা এক পবিত্র বৃক্ষের মত, যার মূল (ভূমিতে) সুদৃঢ়ভাবে স্থিত আর তার শাখা-প্রশাখা আকাশে বিস্তৃত। তা নিজ প্রতিপালকের নির্দেশে প্রতি মুহূর্তে ফল দেয়।২২২
অর্থাৎ বৃক্ষের মূল যেমন মাটির নিচে স্থাপিত থাকে, তেমনি কালেমায়ে তায়্যিবার মূল তথা ঈমান ও বিশ্বাস মানুষের অন্তরে বদ্ধমূল থাকে। গাছের ডালপালার মত কালেমায়ে তায়্যিবারও ডালপালা আছে আর তা হচ্ছে সৎকর্মসমূহ। উৎকৃষ্ট গাছ বলতে মুফাসিরগণের মতে খেজুর গাছ বোঝানো হয়েছে, যার ফল সারা বছরই খেতে পাওয়া যায়। তেমনি কালেমায়ে তায়্যিবারও ফল অর্থাৎ আল্লাহ জাল্লা শানুহুর স্থায়ী ও অনন্ত সম্ভটি মুমিনগণ জান্নাতে নিরবচ্ছিন্নভাবে ভোগ করতে থাকবে। অপর এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে إِلَيْهِ يَصْعَدُ الْكَلِمُ الطَّيِّبُ وَالْعَمَلُ الصَّالِحُ يَرْفَعُهُ পবিত্র কালেমা তাঁরই দিকে আরোহণ করে এবং সৎকর্ম তাকে উপরে তোলে।২২৩
অর্থাৎ মুমিন ব্যক্তি আন্তরিক বিশ্বাসের সঙ্গে আল্লাহ তাআলার যে তাসবীহ তাহলীল ও যিকর আযকার করে থাকে, তা সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহ তাআলার কাছে পৌঁছতে থাকে।
যাহোক আলোচ্য হাদীছ দ্বারা জানা গেল কালেমায়ে তায়্যিবা তথা 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ'-এর সাক্ষ্যদান ও কুরআন তিলাওয়াতসহ যে-কোনও যিকর সদাকার অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং অপর এক হাদীছে আছে-

يصبح على كل سلامي من أحدكم صدقة، فكل تسبيحة صدقة وكل تحميدة صدقة وكل تهليلة صدقة وكل تكبيرة صدقة، وأمر بالمعروف صدقة ونهي عن المنكر صدقة، ويجزئ من ذلك ركعتان يركعهما من الضحى

“প্রতিদিন ভোরে তোমাদের শরীরের প্রতিটি জোড়ার বিনিময়ে সদাকা আবশ্যিক হয়ে যায়। তো প্রতিটি তাসবীহ একটি সদাকা; প্রতিটি তাহমীদ (আলহামদুলিল্লাহ বলা) একটি সদাকা প্রতিটি তাহলীল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলা) একটি সদাকা; প্রতিটি তাকবীর একটি সদাকা; একবার সৎকাজের আদেশ করা একটি সদাকা: একবার অসৎকাজে নিষেধ করা একটি সদাকা আর এ সমুদয়ের পরিবর্তে চাশতের দুঃ রাকআত নামায পড়াই যথেষ্ট হয়ে যায় -মুসলিম।২২৪

মসজিদে যাতায়াতের প্রতিটি কদম সদাকা
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মহামূল্যবান এ হাদীছে যেসকল বিষয়কে সদাকারূপে উল্লেখ করেছেন, তার একটি হচ্ছে নামাযের জন্য মসজিদে যাতায়াতের পদক্ষেপসমূহ। তিনি ইরশাদ করেন (কেউ নামাযে যাওয়ার জন্য যে পথ চলে, তার প্রতিটি কদম ফেলা একেকটি সদাকা)। সুবহানাল্লাহ, বান্দার প্রতি আল্লাহ তাআলার এই মেহেরবানীরও কি কোনও সীমা আছে? দান-সদাকা করার দ্বারা নিজের যেমন ছাওয়াব হয়, তেমনি অন্যেরও উপকার হয়। কিন্তু মসজিদে নামাযের জন্য যাওয়া হয় কেবলই নিজ কল্যাণার্থে। সরাসরি এর দ্বারা অন্যের কোনও উপকার করা হয় না। তা সত্ত্বেও এ হাদীছে মসজিদে যাতায়াতের প্রত্যেকটি কদমকে একেকটি সদাকা সাব্যস্ত করা হয়েছে। এটা কেবলই মাওলার মেহেরবানী।
প্রতিটি কদম যদি একটি সদাকা হয়, তবে প্রতিবার মসজিদে যাতায়াত দ্বারা কতগুলো সদাকা হয়ে থাকে? যার মসজিদে যেতে একশ' কদম লাগে তার একশ'টি সদাকা, যার পাঁচশ' কদম লাগে তার পাঁচশ'টি সদাকা আদায় হয়। এভাবে মসজিদ থেকে যার পথের দূরত্ব যতবেশি, তার ততবেশি সদাকার ছাওয়াব অর্জিত হবে। টাকার অঙ্কে হিসাব করলে মুমিনদের পক্ষে এটা বড়ই আশার বাণী। এর দ্বারা জামাতের সঙ্গে নামায পড়া ও মসজিদের সঙ্গে অন্তরের সম্পর্ক স্থাপন করার প্রতি বিশেষ উৎসাহ পাওয়া যায়।
উলামায়ে কেরাম বলেন, এ ছাওয়ার কেবল নামাযের উদ্দেশ্যে যাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। কেউ যদি ইলমে দীনের সন্ধানে বা আত্মীয়-স্বজনের খোঁজখবর নেওয়ার উদ্দেশ্যে কিংবা কেবলই মুমিন ভাইদের সঙ্গে সাক্ষাত করার লক্ষ্যে পথ চলে, তবে সে চলার প্রতিটি কদমেও সদাকার ছাওয়াব আছে।

রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দেওয়া
এ হাদীছে সর্বশেষ যে কাজটিকে সদাকা সাব্যস্ত করা হয়েছে তা হচ্ছে وتميط الأذى عن الطريق صدقة (তুমি যদি রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে দাও, তাও একটি সদাকা)। কষ্টদায়ক বস্তু বলতে এমনসব বস্তু বোঝানো উদ্দেশ্যে, যা দ্বারা যাতায়াতকারীগণ কষ্ট পেতে পারে, যেমন পাথর, কাঁটা, মানুষ বা পশুর মল, কোনও ফলের ছিলকা ইত্যাদি। রাস্তায় খানাখন্দ বা গর্ত থাকলে তা ভরাট করে দেওয়াও এর অন্তর্ভুক্ত হবে।
এ হাদীছ দ্বারা জানা গেল রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে দেওয়ার দ্বারা সদাকার ছাওয়াব পাওয়া যায়। অপর এক হাদীছে এটিকে ঈমানের অঙ্গ বলা হয়েছে, যা দ্বারা কাজটির গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়। অপর মুসলিমকে কষ্ট ও বিপদ থেকে হেফাজত করা ঈমানের দাবি। বরং প্রকৃত মুমিন সেই, যে কোনও মানুষকেই কোনওভাবে কষ্ট দেয় না।
পথ চলাকালে কষ্টদায়ক কোনও বস্তু চোখে পড়া সত্ত্বেও তা সরিয়ে না দেওয়া পরোক্ষভাবে অন্য মানুষকে কষ্ট দেওয়াই বটে। মূল কষ্টদাতা তো সেই ব্যক্তি, যে তা রাস্তায় ফেলল। কিন্তু দেখা সত্ত্বেও তা যদি না সরানো হয়, তারপর কেউ সে বস্তুটি দ্বারা কষ্ট পায়, তবে তা তো ওই ব্যক্তি তা না সরানোর কারণেই পেল। এ হিসেবে তার উপর একরকম দায় এসেই যায়। মহান ইসলাম আমাদেরকে কী সুন্দর শিক্ষাই না দান করেছে। পরোক্ষভাবেও কেউ যাতে পথিকের কষ্টের কারণ না হয়ে যায়, তাই কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দেওয়াকে ঈমানের অঙ্গ বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে এটাও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, এ কাজ করার দ্বারা সদাকার ছাওয়াব পাওয়া যাবে, যেহেতু এর দ্বারা দান-খয়রাতের মতই মানুষের উপকার সাধিত হয়।
রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরানো যখন ঈমানের অঙ্গ এবং এটা করার দ্বারা যখন সদাকার ছাওয়াব মেলে, তখন যারা এর বিপরীতে রাস্তায় কষ্টদায়ক বস্তু ফেলে, তাদের অবস্থাটা কী হতে পারে? তাদের ঈমান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি কষ্টদানের গুনাহও কি তাদের হয়ে যায় না? এ ব্যাপারে আমাদের সাবধান হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। মানুষের চলাচলে কষ্ট হয় বা বিঘ্ন ঘটে, এমন অনেক কিছুই অবলীলায় করা হয়ে থাকে। জনসভা করে তো রাস্তা আটকেই দেওয়া হয়। এসবই ইসলামী শিক্ষার পরিপন্থী।
প্রকাশ থাকে যে, আলোচ্য হাদীছে যে বিষয়গুলো উল্লেখ করা হল, সদাকা এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এর বাইরেও অনেক কিছু আছে। যেমন অপর এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

تبسمك في وجه أخيك لك صدقة، وأمرك بالمعروف ونهيك عن المنكر صدقة، وإرشادك الرجل في أرض الضلال لك صدقة، وبصرك للرجل الرديء البصر لك صدقة، وإماطتك الحجر والشوكة والعظم عن الطريق لك صدقة، وافراغك من دلوك في دلو أخيك لك صدقة

'তোমার ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তোমার হাসি দেওয়া তোমার জন্য একটি সদাকা; তোমার পক্ষ হতে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করা একটি সদাকা; কোনও ভূমিতে পথহারা ব্যক্তিকে তোমার পথ দেখিয়ে দেওয়াটাও তোমার জন্য একটি সদাকা; যার দৃষ্টিশক্তি দুর্বল হয়ে গেছে তার জন্য তোমার দৃষ্টিশক্তির ব্যবহারও তোমার জন্য একটি সদাকা; রাস্তা থেকে পাথর কাঁটা ও হাড় সরিয়ে দেওয়াও তোমার জন্য একটি সদাকা এবং তোমার পাত্র থেকে তোমার ভাইয়ের পাত্রে পানি ঢেলে দেওয়াও তোমার জন্য একটি সদাকা।২২৫
এর দ্বারা বোঝা যায়, অন্যের পক্ষে কল্যাণকর যে-কোনও বৈধ কাজই সদাকারূপে গণ্য। এমনকি যে আমল দ্বারা নিজ আখেরাতের কল্যাণ হয় তাও সদাকা।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও তার জোড়াসমূহ আল্লাহপ্রদত্ত অনেক বড় নিআমত। আমাদের কর্তব্য এর শোকর আদায় করা।

খ. সদাকা দ্বারা বিপদ-আপদ থেকে হেফাজত হয়। তাই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যাতে বিপদ আপদ থেকে মুক্ত থাকে, সে লক্ষ্যে সদাকা করা চাই।

গ. সূর্য আমাদের জন্য আল্লাহ তাআলার এক বিরাট দান। এর জন্যও আল্লাহর শোকর আদায় করা উচিত।

ঘ. বিবাদমান দুই ব্যক্তির মধ্যে মীমাংসা করে দেওয়া চাই। এতে সদাকারও ছাওয়াব পাওয়া যায়।

ঙ. কাউকে বাহনে উঠিয়ে দেওয়া বা মালামাল তুলে দেওয়া একটি নেক আমল।এটাও সদাকারূপে গণ্য। এটা আমাদেরকে মানবিকতাবোধের শিক্ষা দেয়।

চ. কালেমায়ে তায়্যিবা এবং উৎকৃষ্ট যে-কোনও কথাই সদাকা। সুতরাং বাকশক্তির অপব্যবহার না করে যতবেশি সম্ভব উৎকৃষ্ট কথায় তা ব্যবহার করা।

ছ. মসজিদে যাওয়ার প্রতিটি কদমে যখন সদাকার ছাওয়াব পাওয়া যায়, তখন আমাদের কর্তব্য বেশি বেশি মসজিদে যাতায়াতে অভ্যস্ত হওয়া।

জ. আমরা নিজেরা তো রাস্তায় কষ্টদায়ক বস্তু ফেলবই না; বরং রাস্তায় এমনকিছু নজরে আসলে অবশ্যই তা সরিয়ে দেব।

ঝ. সামগ্রিকভাবে এ হাদীছটি আমাদেরকে আল্লাহর শোকরগুয়ার হয়ে থাকার পাশাপাশি মানুষের প্রতি সদয় আচরণ ও মানবিকতাবোধের চর্চা করার প্রেরণা যোগায়।

২১৮, সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ৩৩০৯; তাবারানী, আল মুজামুল আওসাত, হাদীছ না ৭৭৬১; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৩০৮০

২১৯. সূরা নিসা (৪), আয়াত ১৩৫

২২০. সূরা মায়িদা (৫), আয়াত ৮

২২১. সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৪৭৪

২২২. সূরা ইবরাহীম (১৪), আয়াত ২৪-২৫

২২৩. সূরা ফাতির (৩৫), আয়াত ১০

২২৪. সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৭২০; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ১২৮৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২১৪৭৪; বায়হাকী, হাদীছ নং ৪৮৯৮; বাগাবী, হাদীছ নং ১০০৭

২২৫. জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৯৫৬; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৫২৯; তাবারানী, আল মুজামুল আওসাত, হাদীছ নং ৮৩৪২
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)
রিয়াযুস সালিহীন - হাদীস নং ২৪৮ | মুসলিম বাংলা