রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
ভূমিকা অধ্যায়
হাদীস নং: ২৪৬
ভূমিকা অধ্যায়
অধ্যায়: ৩০
সুপারিশ করার গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য
শাফাআত (الشفاعة) অর্থ সুপারিশ করা। কারও কোনও হাজত নিজে পূরণ করতে না পারলে যে ব্যক্তি তা পূরণ করতে পারে, তাকে তা পূরণ করে দেওয়ার অনুরোধ জানানোকে শাফাআত বা সুপারিশ বলে। সুপারিশ করা একটি মহৎ কাজ। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে এটা করতেন। তিনি এটা আখেরাতেও করবেন। আখেরাতে সবচে' বড় সুপারিশ তাঁর জন্যই সংরক্ষিত। হাশরের ময়দানে সমস্ত মানুষ আল্লাহর পক্ষ থেকে বিচারকার্য শুরুর অপেক্ষা করতে করতে যখন অতিষ্ঠ হয়ে যাবে, তখন তারা একের পর এক নবী-রাসূলকে সুপারিশের জন্য ধরবেন। কেউ বাদ যাবে না। সবশেষে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাজি হবেন এবং আরশের তলে সিজদায় পড়ে যাবেন। আল্লাহ তাআলা বলবেন إرفع رأسك وسل تعطه، وقل يسمع واشفع تشفع “হে মুহাম্মাদ! মাথা তোল। চাও, দেওয়া হবে। বল, শোনা হবে এবং সুপারিশ কর, সুপারিশ গৃহীত হবে।২০৪
তিনি শাফী'উল মুযনিবীন- গুনাহগারদের সুপারিশকারী। তাঁর সুপারিশ হবে আল্লাহ তাআলার দরবারে। আল্লাহ তাআলা বেনিয়ায। তিনি সুপারিশ ছাড়াই সবকিছু করার ক্ষমতা রাখেন। তা সত্ত্বেও যখন তাঁর সমীপে তাঁকে সুপারিশ করতে বলা হচ্ছে, তখন মানুষের কাছে সুপারিশ করাটা যে একটি মহৎ কাজ হবে তা স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায়।
অনেক কাজ এমন আছে, যা মানুষ এমনিতে করে না বা করতে চায়ই না, কিন্তু যখন আকর্ষণীয়ভাবে সুপারিশ করা যায়, তখন তার মন নরম হয় এবং কাজটি করতে সে প্রস্তুত হয়ে যায়। বাস্তবে তা করেও ফেলে। যদি সুপারিশ করা না হত, তবে সে তা করত না। আর কাজটি না হওয়ায় যার সেটি প্রয়োজন ছিল, সে সংকটেই পড়ে থাকত। অনেক সময় সে প্রয়োজন এত কঠিন হয়ে থাকে যে, তা না মিটলে জীবন অচল হয়ে যায়। এটা শরীআতের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের পরিপন্থী। মানুষকে কোনও দুর্মোচনীয় সংকটে ফেলে রাখা শরীআতের কাম্য নয়। সেজন্যই সুপারিশের ব্যবস্থা।
সুপারিশ করা একটি ফযীলতপূর্ণ কাজ। এতে অনেক ছাওয়াব পাওয়া যায়। সরাসরি নিজে কারও সংকট মোচন করার দ্বারা যে ছাওয়াব পাওয়া যায়, সেরকম ছাওয়াব সুপারিশ দ্বারাও লাভ হয়। অর্থাৎ নিজের পক্ষে কারও সংকট মোচন করা সম্ভব না হলে যার তা মোচনের সামর্থ্য আছে, তার কাছে সে ব্যাপারে সুপারিশ করলেও সমপরিমাণ ছাওয়াবের আশা থাকে।
প্রকাশ থাকে যে, সুপারিশ করা নেককাজরূপে গণ্য হয় কেবল তখনই, যখন তা করা হয় কোনও বৈধ বিষয়ে। অবৈধ বিষয়ে সুপারিশ করা জায়েয নয়। ছাওয়াবের তো প্রশ্নই আসে না। কাজেই কাউকে কোনও অবৈধ সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার জন্য সুপারিশ করা যাবে না। শরীআত যে কাজের অনুমোদন করে না, যেমন যাত্রা, থিয়েটার, সঙ্গীতানুষ্ঠান, নৃত্যানুষ্ঠান, ক্যাসিনো বা এ জাতীয় কোনও জুয়ার আসর ইত্যাদি, সুপারিশ করে কারও পক্ষে এসব ব্যাপারে সরকারি অনুমোদন লাভ করিয়ে দেওয়া যাবে না।
ছাওয়াব পাওয়ার জন্য সুপারিশকে সুপারিশের পর্যায়ে রাখাও জরুরি। অর্থাৎ যার কাছে সুপারিশ করা হবে তাকে তা মানতে বাধ্য করা যাবে না। নিজ ক্ষমতা ও প্রভাব প্রতিপত্তির চাপ থেকে তাকে মুক্ত রাখতে হবে। কেননা সুপারিশ রক্ষা করা শরীআতের বাধ্যতামূলক বিধান নয়। শরীআত যা বাধ্যতামূলক করেনি তাকে বাধ্যতামূলক বানানো একরকম সীমালঙ্ঘন। সুপারিশ করতে গিয়ে সীমালঙ্ঘনে লিপ্ত হলে ছাওয়াবের পরিবর্তে গুনাহ হওয়ারই আশঙ্কা। সুতরাং সুপারিশ করার সময় সুপারিশকারীর কর্তব্য এ বিষয়টাও মাথায় রাখা।
সুপারিশের ছাওয়াব পাওয়ার জন্য এটাও শর্ত যে, তা করতে হবে কেবলই আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে, দুনিয়াবী কোনও স্বার্থে নয়। কাজেই সুপারিশের বিনিময়ে কোনওরকম উৎকোচ গ্রহণ করা যাবে না, তা আর্থিকরূপে হোক বা অন্য কোনও সুযোগ-সুবিধা আকারে। সুপারিশ করার পরও ইখলাস ও সহীহ নিয়ত রক্ষা করতে হবে। অর্থাৎ যার পক্ষে সুপারিশ করা হল তার কাছ থেকে অপ্রীতিকর কোনও আচরণ পাওয়া গেলেও সুপারিশের কথা মনে করিয়ে দিয়ে তাকে খোঁটা দেওয়া চলবে না।
(২০৪. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৪৪৭৬; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৯৩; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৪৩৪; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৪৩১২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৫; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৬৪৬৪; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ৮৫১; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৩০৩; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ৪৩৩২)
‘সুপারিশ করার গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য’ সম্পর্কিত একটি আয়াত
مَنْ يَشْفَعْ شَفَاعَةً حَسَنَةً يَكُنْ لَهُ نَصِيبٌ مِنْهَا
অর্থ : 'যে ব্যক্তি কোনও ভালো সুপারিশ করে, তার তাতে অংশ থাকে।২০৫
ব্যাখ্যা
ভালো সুপারিশ করার অর্থ যে বিষয়ে সুপারিশ করা হয় সেটি শরীআতসম্মত হওয়া এবং যে পন্থায় সুপারিশ করা হয় তাও বিধিসম্মত হওয়া। যে সুপারিশের মধ্যে এ উভয় শর্ত রক্ষা করা হয়, সেটি ভালো সুপারিশ আর এরূপ সুপারিশ দ্বারা পুণ্য লাভ হয়। ‘তাতে অংশ থাকে বলে পুণ্যলাভই বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ যার কাছে সুপারিশ করা হয় সে সুপারিশ রক্ষা করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাজটি করে দিলে যে ছাওয়াব পাবে, অনুরূপ ছাওয়াব সুপারিশকারীর আমলনামায়ও লেখা হবে।
প্রকাশ থাকে যে, সুপারিশের ছাওয়াব সুপারিশ করুলের উপর নির্ভরশীল নয়। যার কাছে সুপারিশ করা হয় সে সুপারিশ মঞ্জুর না করলেও সুপারিশকারী ছাওয়াব পেয়ে যাবে। কবুল না করার কারণে সেই ব্যক্তি ছাওয়াব থেকে বঞ্চিত থাকবে। কিন্তু সুপারিশ করা যেহেতু একটি নেক আমল আর সে যেহেতু তা করেছে, তাই সে অবশ্যই ছাওয়াব পাবে।
যার কাছে সুপারিশ করা হয়, সুপারিশ কবুল না করার কারণে সেও ছাওয়াব থেকে বঞ্চিত থাকবে কেবল তখনই, যখন কবুল করাটাই সমীচীন হয়। পক্ষান্তরে সে যদি মনে করে তা কবুল করাটা সমীচীন নয় আর সে কারণে আল্লাহর সন্তুষ্টি সামনে রেখেই সে তা কবুল করা থেকে বিরত থাকে, তবে এ বিরত থাকার দ্বারাও ছাওয়াবের আশা রয়েছে।
আয়াতে যে 'ভালো সুপারিশ বলা হয়েছে, এর দ্বারা বোঝা যায় কোনও কোনও সুপারিশ মন্দও হতে পারে। আলোচ্য আয়াতেই শেষে ইরশাদ হয়েছে-
وَمَنْ يَشْفَعْ شَفَاعَةً سَيِّئَةً يَكُنْ لَهُ كِفْلٌ مِنْهَا
‘আর যে ব্যক্তি কোনও মন্দ সুপারিশ করে, তারও তাতে অংশ থাকে।২০৬
অর্থাৎ যে ব্যক্তি কোনও নাজায়েয কাজে কিংবা বৈধ কাজেই নাজায়েয পন্থায় সুপারিশ করে সে গুনাহগার হয়। সে এজন্য আখেরাতে শাস্তির সম্মুখীন হবে। তাই সুপারিশকারীর কর্তব্য কোন্ বিষয়ে সুপারিশ করা হচ্ছে সেদিকে লক্ষ রাখা, যাতে কোনও অবৈধ বিষয়ে সুপারিশ না হয়ে যায়। এমনিভাবে এদিকেও লক্ষ রাখা জরুরি যে, যে পন্থায় সুপারিশ করা হয় তা যেন বৈধ হয়। অন্যথায় বিষয়টি বৈধ হওয়া সত্ত্বেও সুপারিশের পন্থা অবৈধ হওয়ার কারণে ছাওয়াবের পরিবর্তে গুনাহ হয়ে যাবে। তাই তো আল্লাহ তাআলা এই বলে আয়াতের উপসংহার টানছেন যে-
وَكَانَ اللَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ مُقِيتًا
‘আর আল্লাহ সব বিষয়ে নজর রাখেন।'
مُقِيتًا শব্দটির এক অর্থ সতর্ক দৃষ্টিদানকারী বা তত্ত্বাবধায়ক। আরেক অর্থ ক্ষমতাবান। এর তৃতীয় অর্থ হচ্ছে রিযিকদাতা।
প্রথম অর্থ হিসেবে এ বাক্যটির ব্যাখ্যা এরকম যে, তিনি দেখেন তোমরা বৈধ কাজে সুপারিশ কর না অবৈধ কাজে। তিনি এটাও দেখেন যে, তোমরা সুপারিশের ক্ষেত্রে বৈধ পন্থা অবলম্বন কর না অবৈধ পন্থা। এমনিভাবে ছাওয়াবের আশায় তোমরা ভালো সুপারিশ কর নাকি সুপারিশ করা হতে গা বাঁচিয়ে রাখ, তাও তিনি লক্ষ করেন। তিনি এসব লক্ষ করেন কাজ অনুযায়ী তোমাদের প্রতিদান দেওয়ার জন্য। সুতরাং তিনি সে হিসেবে তোমাদের প্রতিদান দান করবেন।
দ্বিতীয় অর্থ হিসেবে এর ব্যাখ্যা হচ্ছে, তিনি তোমাদেরকে তোমাদের সুপারিশের ধরন অনুযায়ী প্রতিদান দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। কাজেই সুপারিশ ভালো হলে তিনি ভালো প্রতিদান দেবেন এবং সুপারিশ মন্দ হলে সেজন্য মন্দ প্রতিদান তথা শাস্তিদান করবেন। সুতরাং তোমাদের কর্তব্য সুপারিশ করার আগ্রহও রাখা, সেইসঙ্গে পূর্ণ সতর্কতাও অবলম্বন করা।
তৃতীয় অর্থ অনুযায়ী ব্যাখ্যা হবে এরকম- আল্লাহ তাআলাই যেহেতু তোমাদের একমাত্র রিযিকদাতা, সেহেতু তিনি তোমাদের যার জন্য যে পরিমাণ রিযিক নির্দিষ্ট করেছেন সে তা পাবেই। কারও সুপারিশ করার দ্বারা তাতে কিছুমাত্র কমবেশি হবে না। কারও সুপারিশ তিনি মানতে বাধ্য নন যে, সে অনুযায়ী তাঁর নির্ধারণের কোনও নড়চড় হবে। তা সত্ত্বেও তিনি সুপারিশের হুকুম দিয়েছেন কেবল তোমাদেরই স্বার্থে। সুপারিশ দ্বারা তাঁর সিদ্ধান্তের নড়চড় না হোক, কিন্তু তোমরা ছাওয়াব পেয়ে যাবে। কাজেই সে উদ্দেশ্যেই তোমরা এ কাজটি করবে।
২০৫. সূরা নিসা (৪), আয়াত ৮৫
২০৬. সূরা নিসা (৪), আয়াত ৮৫
সুপারিশ করার গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য
শাফাআত (الشفاعة) অর্থ সুপারিশ করা। কারও কোনও হাজত নিজে পূরণ করতে না পারলে যে ব্যক্তি তা পূরণ করতে পারে, তাকে তা পূরণ করে দেওয়ার অনুরোধ জানানোকে শাফাআত বা সুপারিশ বলে। সুপারিশ করা একটি মহৎ কাজ। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে এটা করতেন। তিনি এটা আখেরাতেও করবেন। আখেরাতে সবচে' বড় সুপারিশ তাঁর জন্যই সংরক্ষিত। হাশরের ময়দানে সমস্ত মানুষ আল্লাহর পক্ষ থেকে বিচারকার্য শুরুর অপেক্ষা করতে করতে যখন অতিষ্ঠ হয়ে যাবে, তখন তারা একের পর এক নবী-রাসূলকে সুপারিশের জন্য ধরবেন। কেউ বাদ যাবে না। সবশেষে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাজি হবেন এবং আরশের তলে সিজদায় পড়ে যাবেন। আল্লাহ তাআলা বলবেন إرفع رأسك وسل تعطه، وقل يسمع واشفع تشفع “হে মুহাম্মাদ! মাথা তোল। চাও, দেওয়া হবে। বল, শোনা হবে এবং সুপারিশ কর, সুপারিশ গৃহীত হবে।২০৪
তিনি শাফী'উল মুযনিবীন- গুনাহগারদের সুপারিশকারী। তাঁর সুপারিশ হবে আল্লাহ তাআলার দরবারে। আল্লাহ তাআলা বেনিয়ায। তিনি সুপারিশ ছাড়াই সবকিছু করার ক্ষমতা রাখেন। তা সত্ত্বেও যখন তাঁর সমীপে তাঁকে সুপারিশ করতে বলা হচ্ছে, তখন মানুষের কাছে সুপারিশ করাটা যে একটি মহৎ কাজ হবে তা স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায়।
অনেক কাজ এমন আছে, যা মানুষ এমনিতে করে না বা করতে চায়ই না, কিন্তু যখন আকর্ষণীয়ভাবে সুপারিশ করা যায়, তখন তার মন নরম হয় এবং কাজটি করতে সে প্রস্তুত হয়ে যায়। বাস্তবে তা করেও ফেলে। যদি সুপারিশ করা না হত, তবে সে তা করত না। আর কাজটি না হওয়ায় যার সেটি প্রয়োজন ছিল, সে সংকটেই পড়ে থাকত। অনেক সময় সে প্রয়োজন এত কঠিন হয়ে থাকে যে, তা না মিটলে জীবন অচল হয়ে যায়। এটা শরীআতের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের পরিপন্থী। মানুষকে কোনও দুর্মোচনীয় সংকটে ফেলে রাখা শরীআতের কাম্য নয়। সেজন্যই সুপারিশের ব্যবস্থা।
সুপারিশ করা একটি ফযীলতপূর্ণ কাজ। এতে অনেক ছাওয়াব পাওয়া যায়। সরাসরি নিজে কারও সংকট মোচন করার দ্বারা যে ছাওয়াব পাওয়া যায়, সেরকম ছাওয়াব সুপারিশ দ্বারাও লাভ হয়। অর্থাৎ নিজের পক্ষে কারও সংকট মোচন করা সম্ভব না হলে যার তা মোচনের সামর্থ্য আছে, তার কাছে সে ব্যাপারে সুপারিশ করলেও সমপরিমাণ ছাওয়াবের আশা থাকে।
প্রকাশ থাকে যে, সুপারিশ করা নেককাজরূপে গণ্য হয় কেবল তখনই, যখন তা করা হয় কোনও বৈধ বিষয়ে। অবৈধ বিষয়ে সুপারিশ করা জায়েয নয়। ছাওয়াবের তো প্রশ্নই আসে না। কাজেই কাউকে কোনও অবৈধ সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার জন্য সুপারিশ করা যাবে না। শরীআত যে কাজের অনুমোদন করে না, যেমন যাত্রা, থিয়েটার, সঙ্গীতানুষ্ঠান, নৃত্যানুষ্ঠান, ক্যাসিনো বা এ জাতীয় কোনও জুয়ার আসর ইত্যাদি, সুপারিশ করে কারও পক্ষে এসব ব্যাপারে সরকারি অনুমোদন লাভ করিয়ে দেওয়া যাবে না।
ছাওয়াব পাওয়ার জন্য সুপারিশকে সুপারিশের পর্যায়ে রাখাও জরুরি। অর্থাৎ যার কাছে সুপারিশ করা হবে তাকে তা মানতে বাধ্য করা যাবে না। নিজ ক্ষমতা ও প্রভাব প্রতিপত্তির চাপ থেকে তাকে মুক্ত রাখতে হবে। কেননা সুপারিশ রক্ষা করা শরীআতের বাধ্যতামূলক বিধান নয়। শরীআত যা বাধ্যতামূলক করেনি তাকে বাধ্যতামূলক বানানো একরকম সীমালঙ্ঘন। সুপারিশ করতে গিয়ে সীমালঙ্ঘনে লিপ্ত হলে ছাওয়াবের পরিবর্তে গুনাহ হওয়ারই আশঙ্কা। সুতরাং সুপারিশ করার সময় সুপারিশকারীর কর্তব্য এ বিষয়টাও মাথায় রাখা।
সুপারিশের ছাওয়াব পাওয়ার জন্য এটাও শর্ত যে, তা করতে হবে কেবলই আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে, দুনিয়াবী কোনও স্বার্থে নয়। কাজেই সুপারিশের বিনিময়ে কোনওরকম উৎকোচ গ্রহণ করা যাবে না, তা আর্থিকরূপে হোক বা অন্য কোনও সুযোগ-সুবিধা আকারে। সুপারিশ করার পরও ইখলাস ও সহীহ নিয়ত রক্ষা করতে হবে। অর্থাৎ যার পক্ষে সুপারিশ করা হল তার কাছ থেকে অপ্রীতিকর কোনও আচরণ পাওয়া গেলেও সুপারিশের কথা মনে করিয়ে দিয়ে তাকে খোঁটা দেওয়া চলবে না।
(২০৪. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৪৪৭৬; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৯৩; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৪৩৪; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৪৩১২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৫; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৬৪৬৪; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ৮৫১; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৩০৩; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ৪৩৩২)
‘সুপারিশ করার গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য’ সম্পর্কিত একটি আয়াত
مَنْ يَشْفَعْ شَفَاعَةً حَسَنَةً يَكُنْ لَهُ نَصِيبٌ مِنْهَا
অর্থ : 'যে ব্যক্তি কোনও ভালো সুপারিশ করে, তার তাতে অংশ থাকে।২০৫
ব্যাখ্যা
ভালো সুপারিশ করার অর্থ যে বিষয়ে সুপারিশ করা হয় সেটি শরীআতসম্মত হওয়া এবং যে পন্থায় সুপারিশ করা হয় তাও বিধিসম্মত হওয়া। যে সুপারিশের মধ্যে এ উভয় শর্ত রক্ষা করা হয়, সেটি ভালো সুপারিশ আর এরূপ সুপারিশ দ্বারা পুণ্য লাভ হয়। ‘তাতে অংশ থাকে বলে পুণ্যলাভই বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ যার কাছে সুপারিশ করা হয় সে সুপারিশ রক্ষা করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাজটি করে দিলে যে ছাওয়াব পাবে, অনুরূপ ছাওয়াব সুপারিশকারীর আমলনামায়ও লেখা হবে।
প্রকাশ থাকে যে, সুপারিশের ছাওয়াব সুপারিশ করুলের উপর নির্ভরশীল নয়। যার কাছে সুপারিশ করা হয় সে সুপারিশ মঞ্জুর না করলেও সুপারিশকারী ছাওয়াব পেয়ে যাবে। কবুল না করার কারণে সেই ব্যক্তি ছাওয়াব থেকে বঞ্চিত থাকবে। কিন্তু সুপারিশ করা যেহেতু একটি নেক আমল আর সে যেহেতু তা করেছে, তাই সে অবশ্যই ছাওয়াব পাবে।
যার কাছে সুপারিশ করা হয়, সুপারিশ কবুল না করার কারণে সেও ছাওয়াব থেকে বঞ্চিত থাকবে কেবল তখনই, যখন কবুল করাটাই সমীচীন হয়। পক্ষান্তরে সে যদি মনে করে তা কবুল করাটা সমীচীন নয় আর সে কারণে আল্লাহর সন্তুষ্টি সামনে রেখেই সে তা কবুল করা থেকে বিরত থাকে, তবে এ বিরত থাকার দ্বারাও ছাওয়াবের আশা রয়েছে।
আয়াতে যে 'ভালো সুপারিশ বলা হয়েছে, এর দ্বারা বোঝা যায় কোনও কোনও সুপারিশ মন্দও হতে পারে। আলোচ্য আয়াতেই শেষে ইরশাদ হয়েছে-
وَمَنْ يَشْفَعْ شَفَاعَةً سَيِّئَةً يَكُنْ لَهُ كِفْلٌ مِنْهَا
‘আর যে ব্যক্তি কোনও মন্দ সুপারিশ করে, তারও তাতে অংশ থাকে।২০৬
অর্থাৎ যে ব্যক্তি কোনও নাজায়েয কাজে কিংবা বৈধ কাজেই নাজায়েয পন্থায় সুপারিশ করে সে গুনাহগার হয়। সে এজন্য আখেরাতে শাস্তির সম্মুখীন হবে। তাই সুপারিশকারীর কর্তব্য কোন্ বিষয়ে সুপারিশ করা হচ্ছে সেদিকে লক্ষ রাখা, যাতে কোনও অবৈধ বিষয়ে সুপারিশ না হয়ে যায়। এমনিভাবে এদিকেও লক্ষ রাখা জরুরি যে, যে পন্থায় সুপারিশ করা হয় তা যেন বৈধ হয়। অন্যথায় বিষয়টি বৈধ হওয়া সত্ত্বেও সুপারিশের পন্থা অবৈধ হওয়ার কারণে ছাওয়াবের পরিবর্তে গুনাহ হয়ে যাবে। তাই তো আল্লাহ তাআলা এই বলে আয়াতের উপসংহার টানছেন যে-
وَكَانَ اللَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ مُقِيتًا
‘আর আল্লাহ সব বিষয়ে নজর রাখেন।'
مُقِيتًا শব্দটির এক অর্থ সতর্ক দৃষ্টিদানকারী বা তত্ত্বাবধায়ক। আরেক অর্থ ক্ষমতাবান। এর তৃতীয় অর্থ হচ্ছে রিযিকদাতা।
প্রথম অর্থ হিসেবে এ বাক্যটির ব্যাখ্যা এরকম যে, তিনি দেখেন তোমরা বৈধ কাজে সুপারিশ কর না অবৈধ কাজে। তিনি এটাও দেখেন যে, তোমরা সুপারিশের ক্ষেত্রে বৈধ পন্থা অবলম্বন কর না অবৈধ পন্থা। এমনিভাবে ছাওয়াবের আশায় তোমরা ভালো সুপারিশ কর নাকি সুপারিশ করা হতে গা বাঁচিয়ে রাখ, তাও তিনি লক্ষ করেন। তিনি এসব লক্ষ করেন কাজ অনুযায়ী তোমাদের প্রতিদান দেওয়ার জন্য। সুতরাং তিনি সে হিসেবে তোমাদের প্রতিদান দান করবেন।
দ্বিতীয় অর্থ হিসেবে এর ব্যাখ্যা হচ্ছে, তিনি তোমাদেরকে তোমাদের সুপারিশের ধরন অনুযায়ী প্রতিদান দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। কাজেই সুপারিশ ভালো হলে তিনি ভালো প্রতিদান দেবেন এবং সুপারিশ মন্দ হলে সেজন্য মন্দ প্রতিদান তথা শাস্তিদান করবেন। সুতরাং তোমাদের কর্তব্য সুপারিশ করার আগ্রহও রাখা, সেইসঙ্গে পূর্ণ সতর্কতাও অবলম্বন করা।
তৃতীয় অর্থ অনুযায়ী ব্যাখ্যা হবে এরকম- আল্লাহ তাআলাই যেহেতু তোমাদের একমাত্র রিযিকদাতা, সেহেতু তিনি তোমাদের যার জন্য যে পরিমাণ রিযিক নির্দিষ্ট করেছেন সে তা পাবেই। কারও সুপারিশ করার দ্বারা তাতে কিছুমাত্র কমবেশি হবে না। কারও সুপারিশ তিনি মানতে বাধ্য নন যে, সে অনুযায়ী তাঁর নির্ধারণের কোনও নড়চড় হবে। তা সত্ত্বেও তিনি সুপারিশের হুকুম দিয়েছেন কেবল তোমাদেরই স্বার্থে। সুপারিশ দ্বারা তাঁর সিদ্ধান্তের নড়চড় না হোক, কিন্তু তোমরা ছাওয়াব পেয়ে যাবে। কাজেই সে উদ্দেশ্যেই তোমরা এ কাজটি করবে।
২০৫. সূরা নিসা (৪), আয়াত ৮৫
২০৬. সূরা নিসা (৪), আয়াত ৮৫
সুপারিশের জন্য ছাওয়াবের ওয়াদা
হাদীছ নং : ২৪৬
হযরত আবূ মূসা আশআরী রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে কোনও হাজত পূরণের আকাঙ্ক্ষী আসলে তিনি উপস্থিত লোকদের লক্ষ্য করে বলতেন, সুপারিশ করো, প্রতিদান পাবে। আল্লাহ যা পসন্দ করেন, তাঁর নবীর জবানিতে তারই ফয়সালা করবেন -বুখারী ও মুসলিম।
সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ১৪৩২; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৬২৭; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ২৫৫৬; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৯৫৮৪; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৫৩১; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৬৬৭৯
হাদীছ নং : ২৪৬
হযরত আবূ মূসা আশআরী রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে কোনও হাজত পূরণের আকাঙ্ক্ষী আসলে তিনি উপস্থিত লোকদের লক্ষ্য করে বলতেন, সুপারিশ করো, প্রতিদান পাবে। আল্লাহ যা পসন্দ করেন, তাঁর নবীর জবানিতে তারই ফয়সালা করবেন -বুখারী ও মুসলিম।
সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ১৪৩২; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৬২৭; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ২৫৫৬; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৯৫৮৪; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৫৩১; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৬৬৭৯
مقدمة الامام النووي
30 - باب الشفاعة
قَالَ الله تَعَالَى: {مَنْ يَشْفَعْ شَفَاعَةً حَسَنَةً يَكُنْ لَهُ نَصِيبٌ مِنْهَا} [النساء: 85].
قَالَ الله تَعَالَى: {مَنْ يَشْفَعْ شَفَاعَةً حَسَنَةً يَكُنْ لَهُ نَصِيبٌ مِنْهَا} [النساء: 85].
246 - وعن أَبي موسى الأشعري - رضي الله عنه - قَالَ: كَانَ النَّبيّ - صلى الله عليه وسلم - إِذَا أتاهُ طَالِبُ حَاجَةٍ أقبَلَ عَلَى جُلَسَائِهِ، فَقَالَ: «اشْفَعُوا تُؤْجَرُوا، وَيَقْضِي الله عَلَى لِسَانِ نَبِيِّهِ مَا أحَبَّ». مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (1)
وفي رواية: «مَا شَاءَ».
وفي رواية: «مَا شَاءَ».
হাদীসের ব্যাখ্যা:
اشفعوا (সুপারিশ করো)-এর উৎপত্তি الشفاعة । (শাফাআত) থেকে। শাফাআতের অর্থ ও এ সম্পর্কিত জরুরি ব্যাখ্যা ভূমিকায় চলে গেছে। এ হাদীছে প্রথমত সুপারিশের আদেশ করা হয়েছে, দ্বিতীয়ত এর ফযীলত বয়ান করা হয়েছে এবং তৃতীয়ত এর হাকীকতের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।
সুপারিশের আদেশ করে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ কাজটিকে তাঁর শরীআতের একটি ঐচ্ছিক অঙ্গ বানিয়ে দিয়েছেন। কারও সুপারিশের প্রয়োজন হয় বিভিন্ন কারণে। কেউ যখন অর্থসংকটে পড়ে, তখন আর্থিক অনুদান বা ঋণ গ্রহণের জন্য অনেক সময় সুপারিশের দরকার হয়। যার কাছে তা পাওয়া যাবে, তার কাছে সে নিজে সরাসরি যেতে পারে না। এ অবস্থায় তার কাছে যার যাতায়াত আছে বা তার সঙ্গে যার সুসম্পর্ক আছে, তাকে সুপারিশের জন্য ধরা হয়। সে বলে দিলে ওই ব্যক্তি তাকে ঋণ বা আর্থিক অনুদান দেবে বলে আশা আছে। এমনিভাবে এটা প্রয়োজন হয় মিথ্যা মামলায় সুবিচারের জন্য, প্রয়োজন হয় চাকরি-বাকরি বা কোনও কাজ পাওয়ার জন্য। এমনকি সুপারিশ প্রয়োজন হয় বেচাকেনা, বিবাহশাদি ইত্যাদিতেও। যে-কোনও ঠ্যাকার ক্ষেত্রে যার দ্বারা সেই ঠ্যাকার সমাধান হতে পারে, নিজে সরাসরি তার কাছে পৌঁছার সুযোগ না পেলে বা নিজ কথায় কাজ না হলে তখন মানুষ উপযুক্ত ব্যক্তির সুপারিশ কামনা করে। সে সুপারিশ করলে তার কাজটি হয়ে যায়, অন্যথায় তার পেরেশানি চলতে থাকে। এক মুমিন আরেক মুমিনের ভাই। তাই প্রত্যেকের কর্তব্য অন্যের পেরেশানিকে নিজ পেরেশানি গণ্য করা। যদি মুখের একটি কথা দ্বারা অন্যের পেরেশানি দূর হওয়ার আশা থাকে, এক মুমিন তা করবে না কেন? এ হাদীছে তাই উৎসাহ দেওয়া হয়েছে যে, তোমরা তোমাদের অভাবগ্রস্ত বা বিপদগ্রস্ত ভাইয়ের জন্য সুপারিশ করো।
সুপারিশ করার দ্বারা কারও উপকার হওয়ার আশা থাকলে নৈতিকভাবেই তা করা বাঞ্ছনীয় হয়ে যায়। তা ঈমানেরও দাবি। কাজেই একজন আদর্শ মুমিন তা করবে বৈকি। তবে যেহেতু এটা ফরয-ওয়াজিব নয়, তাই হয়তো কেউ সুপারিশের প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও তা করতে আগ্রহ দেখাবে না। এরূপ লোককে আগ্রহী করে তোলার জন্য হাদীছে সুপারিশ করার ফায়দাও বলে দেওয়া হয়েছে। বলাবাহুল্য আমাদের মহান দীন কোনও কাজে আগ্রহী করে তোলার লক্ষ্যে সাধারণত পরকালীন ফায়দাই বর্ণনা করে থাকে। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- تؤجروا - (তোমরা প্রতিদান পাবে)। অর্থাৎ সরাসরি প্রয়োজনগ্রস্ত ব্যক্তির প্রয়োজন মেটানোর দ্বারা যেই ছাওয়াব পাওয়া যায়, সুপারিশ করার দ্বারা তোমরাও অনুরূপ ছাওয়াবের অধিকারী হয়ে যাবে, তাতে তোমাদের সুপারিশ গৃহীত হোক বা নাই হোক।
হযরত মুআবিয়া রাযি. সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, তিনি তাঁর কাছে কোনও অভাবী বা বিপদগ্রস্ত লোক সাহায্যের জন্য আসলে তিনি সাহায্য করতে বিলম্ব করতেন, সঙ্গে সঙ্গেই তিনি তার আবেদন মঞ্জুর করতেন না। তিনি নিজেই এর কারণ ব্যাখ্যা করেন যে, আমি বিলম্ব করি এই ইচ্ছায় যে, তোমরা তার জন্য আমার কাছে সুপারিশ করবে। কেননা সুপারিশ করার দ্বারা ছাওয়াব পাওয়া যায়। এই বলে তিনি আলোচ্য হাদীছটি বর্ণনা করেন। এভাবে অন্যকে ছাওয়াব অর্জনের সুযোগ দান করাটা ছিল তাঁর এক মহত্ত্ব।
তৃতীয় পর্যায়ে হাদীছটিতে সুপারিশের হাকীকতের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে- ويقضي الله على لسان نبيه ما أحب (আল্লাহ যা পসন্দ করেন, তাঁর নবীর জবানিতে তারই ফয়সালা করবেন)। অর্থাৎ তোমরা যা সুপারিশ করবে তাই হবে। এমন কোনও কথা নেই। হবে তাই, যা আল্লাহ চান। তিনি তাঁর নবীকে দিয়ে নিজ মর্জি মোতাবেক ফয়সালা করাবেন। তোমাদের সুপারিশে তার কোনও নড়চড় হবে না। তা সত্ত্বেও তোমরা সুপারিশ করবে। তা করবে এজন্য যে, তাতে নিজ ভাইয়ের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ পাবে আর এ কারণে আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে আজর ও ছাওয়াব দান করবেন।
আল্লাহর ফয়সালা যেহেতু তোমাদের সুপারিশের উপর নির্ভরশীল নয় আবার তোমাদের সুপারিশও বৃথা যায় না, তোমরা ছাওয়াব ঠিকই পেয়ে যাও, তাই ফয়সালা যাই হোক তাতে তোমাদের সন্তুষ্ট থাকা চাই। কেন সুপারিশ মোতাবেক কাজ করা হল না, এই আপত্তি তোলা বাঞ্ছনীয় নয়। এর দ্বারা ফায়দা তো কিছু হয়ই না, উল্টো তাতে সুপারিশটি মন্দ সুপারিশ হয়ে যায় এবং ছাওয়াব নষ্ট হয়।
এস্থলে যে বলা হয়েছে আল্লাহ তাঁর রাসূলের মাধ্যমে নিজ পসন্দমত ফয়সালা করিয়ে থাকেন, এ কথাটি কেবল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি সর্বকালীন বিধান। প্রত্যেক সুপারিশকারীকেই সুপারিশকালে মনে রাখতে হবে যে, আমার সুপারিশ মোতাবেক কাজ হওয়া জরুরি নয়; হবে সেটাই, যা আল্লাহ চান। কাজেই আমি যার কাছে সুপারিশ করছি তিনি আমার সুপারিশ রাখলেও আমি খুশি থাকব, না রাখলেও খুশি থাকব। কোনও অবস্থায়ই তার উপর চাপ সৃষ্টি করব না ও নাখোশ হব না। ব্যস এটাই সুপারিশের হাকীকত যে, এর দ্বারা মুমিন ব্যক্তিকে মানবিকতাবোধে উজ্জীবিত করা ও আখেরাতের পুরস্কারে ভূষিত করা উদ্দেশ্য। এটা কোনও বাধ্যতামূলক বিষয় নয়, যা রক্ষা করা অবশ্যকর্তব্য। এ বিষয়টি পরবর্তী হাদীছ দ্বারা অধিকতর পরিস্ফুট হয়।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. সুপারিশ করা একটি মহৎ কাজ। এর দ্বারা আখেরাতের প্রভূত ছাওয়াব লাভ করা যায়।
খ. সুপারিশ রক্ষা করা বাধ্যতামূলক নয়। কাজেই যার কাছে সুপারিশ করা হবে, তার সে অনুযায়ী কাজ করা বা না করা উভয় এখতিয়ারই থাকে।
গ. সুপারিশকালে তা রক্ষার জন্য চাপ সৃষ্টি করা বাঞ্ছনীয় নয়। তাতে সুপারিশের মহিমা ক্ষুণ্ণ হয়।
ঘ. সুপারিশ রক্ষা করা না হলে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করা উচিত নয়। কেননা আখেরাতের প্রতিদান পাওয়াই এর একমাত্র লক্ষ্য। সুপারিশ রক্ষা করা না হলেও সে প্রতিদান ঠিকই পাওয়া যাবে। কাজেই সুপারিশ না রাখায় সুপারিশ করা বৃথা যায়নি।
সুপারিশের আদেশ করে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ কাজটিকে তাঁর শরীআতের একটি ঐচ্ছিক অঙ্গ বানিয়ে দিয়েছেন। কারও সুপারিশের প্রয়োজন হয় বিভিন্ন কারণে। কেউ যখন অর্থসংকটে পড়ে, তখন আর্থিক অনুদান বা ঋণ গ্রহণের জন্য অনেক সময় সুপারিশের দরকার হয়। যার কাছে তা পাওয়া যাবে, তার কাছে সে নিজে সরাসরি যেতে পারে না। এ অবস্থায় তার কাছে যার যাতায়াত আছে বা তার সঙ্গে যার সুসম্পর্ক আছে, তাকে সুপারিশের জন্য ধরা হয়। সে বলে দিলে ওই ব্যক্তি তাকে ঋণ বা আর্থিক অনুদান দেবে বলে আশা আছে। এমনিভাবে এটা প্রয়োজন হয় মিথ্যা মামলায় সুবিচারের জন্য, প্রয়োজন হয় চাকরি-বাকরি বা কোনও কাজ পাওয়ার জন্য। এমনকি সুপারিশ প্রয়োজন হয় বেচাকেনা, বিবাহশাদি ইত্যাদিতেও। যে-কোনও ঠ্যাকার ক্ষেত্রে যার দ্বারা সেই ঠ্যাকার সমাধান হতে পারে, নিজে সরাসরি তার কাছে পৌঁছার সুযোগ না পেলে বা নিজ কথায় কাজ না হলে তখন মানুষ উপযুক্ত ব্যক্তির সুপারিশ কামনা করে। সে সুপারিশ করলে তার কাজটি হয়ে যায়, অন্যথায় তার পেরেশানি চলতে থাকে। এক মুমিন আরেক মুমিনের ভাই। তাই প্রত্যেকের কর্তব্য অন্যের পেরেশানিকে নিজ পেরেশানি গণ্য করা। যদি মুখের একটি কথা দ্বারা অন্যের পেরেশানি দূর হওয়ার আশা থাকে, এক মুমিন তা করবে না কেন? এ হাদীছে তাই উৎসাহ দেওয়া হয়েছে যে, তোমরা তোমাদের অভাবগ্রস্ত বা বিপদগ্রস্ত ভাইয়ের জন্য সুপারিশ করো।
সুপারিশ করার দ্বারা কারও উপকার হওয়ার আশা থাকলে নৈতিকভাবেই তা করা বাঞ্ছনীয় হয়ে যায়। তা ঈমানেরও দাবি। কাজেই একজন আদর্শ মুমিন তা করবে বৈকি। তবে যেহেতু এটা ফরয-ওয়াজিব নয়, তাই হয়তো কেউ সুপারিশের প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও তা করতে আগ্রহ দেখাবে না। এরূপ লোককে আগ্রহী করে তোলার জন্য হাদীছে সুপারিশ করার ফায়দাও বলে দেওয়া হয়েছে। বলাবাহুল্য আমাদের মহান দীন কোনও কাজে আগ্রহী করে তোলার লক্ষ্যে সাধারণত পরকালীন ফায়দাই বর্ণনা করে থাকে। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- تؤجروا - (তোমরা প্রতিদান পাবে)। অর্থাৎ সরাসরি প্রয়োজনগ্রস্ত ব্যক্তির প্রয়োজন মেটানোর দ্বারা যেই ছাওয়াব পাওয়া যায়, সুপারিশ করার দ্বারা তোমরাও অনুরূপ ছাওয়াবের অধিকারী হয়ে যাবে, তাতে তোমাদের সুপারিশ গৃহীত হোক বা নাই হোক।
হযরত মুআবিয়া রাযি. সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, তিনি তাঁর কাছে কোনও অভাবী বা বিপদগ্রস্ত লোক সাহায্যের জন্য আসলে তিনি সাহায্য করতে বিলম্ব করতেন, সঙ্গে সঙ্গেই তিনি তার আবেদন মঞ্জুর করতেন না। তিনি নিজেই এর কারণ ব্যাখ্যা করেন যে, আমি বিলম্ব করি এই ইচ্ছায় যে, তোমরা তার জন্য আমার কাছে সুপারিশ করবে। কেননা সুপারিশ করার দ্বারা ছাওয়াব পাওয়া যায়। এই বলে তিনি আলোচ্য হাদীছটি বর্ণনা করেন। এভাবে অন্যকে ছাওয়াব অর্জনের সুযোগ দান করাটা ছিল তাঁর এক মহত্ত্ব।
তৃতীয় পর্যায়ে হাদীছটিতে সুপারিশের হাকীকতের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে- ويقضي الله على لسان نبيه ما أحب (আল্লাহ যা পসন্দ করেন, তাঁর নবীর জবানিতে তারই ফয়সালা করবেন)। অর্থাৎ তোমরা যা সুপারিশ করবে তাই হবে। এমন কোনও কথা নেই। হবে তাই, যা আল্লাহ চান। তিনি তাঁর নবীকে দিয়ে নিজ মর্জি মোতাবেক ফয়সালা করাবেন। তোমাদের সুপারিশে তার কোনও নড়চড় হবে না। তা সত্ত্বেও তোমরা সুপারিশ করবে। তা করবে এজন্য যে, তাতে নিজ ভাইয়ের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ পাবে আর এ কারণে আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে আজর ও ছাওয়াব দান করবেন।
আল্লাহর ফয়সালা যেহেতু তোমাদের সুপারিশের উপর নির্ভরশীল নয় আবার তোমাদের সুপারিশও বৃথা যায় না, তোমরা ছাওয়াব ঠিকই পেয়ে যাও, তাই ফয়সালা যাই হোক তাতে তোমাদের সন্তুষ্ট থাকা চাই। কেন সুপারিশ মোতাবেক কাজ করা হল না, এই আপত্তি তোলা বাঞ্ছনীয় নয়। এর দ্বারা ফায়দা তো কিছু হয়ই না, উল্টো তাতে সুপারিশটি মন্দ সুপারিশ হয়ে যায় এবং ছাওয়াব নষ্ট হয়।
এস্থলে যে বলা হয়েছে আল্লাহ তাঁর রাসূলের মাধ্যমে নিজ পসন্দমত ফয়সালা করিয়ে থাকেন, এ কথাটি কেবল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি সর্বকালীন বিধান। প্রত্যেক সুপারিশকারীকেই সুপারিশকালে মনে রাখতে হবে যে, আমার সুপারিশ মোতাবেক কাজ হওয়া জরুরি নয়; হবে সেটাই, যা আল্লাহ চান। কাজেই আমি যার কাছে সুপারিশ করছি তিনি আমার সুপারিশ রাখলেও আমি খুশি থাকব, না রাখলেও খুশি থাকব। কোনও অবস্থায়ই তার উপর চাপ সৃষ্টি করব না ও নাখোশ হব না। ব্যস এটাই সুপারিশের হাকীকত যে, এর দ্বারা মুমিন ব্যক্তিকে মানবিকতাবোধে উজ্জীবিত করা ও আখেরাতের পুরস্কারে ভূষিত করা উদ্দেশ্য। এটা কোনও বাধ্যতামূলক বিষয় নয়, যা রক্ষা করা অবশ্যকর্তব্য। এ বিষয়টি পরবর্তী হাদীছ দ্বারা অধিকতর পরিস্ফুট হয়।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. সুপারিশ করা একটি মহৎ কাজ। এর দ্বারা আখেরাতের প্রভূত ছাওয়াব লাভ করা যায়।
খ. সুপারিশ রক্ষা করা বাধ্যতামূলক নয়। কাজেই যার কাছে সুপারিশ করা হবে, তার সে অনুযায়ী কাজ করা বা না করা উভয় এখতিয়ারই থাকে।
গ. সুপারিশকালে তা রক্ষার জন্য চাপ সৃষ্টি করা বাঞ্ছনীয় নয়। তাতে সুপারিশের মহিমা ক্ষুণ্ণ হয়।
ঘ. সুপারিশ রক্ষা করা না হলে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করা উচিত নয়। কেননা আখেরাতের প্রতিদান পাওয়াই এর একমাত্র লক্ষ্য। সুপারিশ রক্ষা করা না হলেও সে প্রতিদান ঠিকই পাওয়া যাবে। কাজেই সুপারিশ না রাখায় সুপারিশ করা বৃথা যায়নি।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
বর্ণনাকারী: