রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
ভূমিকা অধ্যায়
হাদীস নং: ১৯৯
আমানত আদায় প্রসঙ্গ
امانة (আমানত) শব্দটি أمن থেকে নির্গত, যেমন إيمان (ঈমান) শব্দটিও أمن থেকেই নির্গত হয়েছে। উভয়টির মূল হরফ যেমন অভিন্ন, তেমনি বাস্তবেও উভয়টি অবিচ্ছেদ্য। সুতরাং আমানত ঈমানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। এটা অতি ব্যাপক। আমরা সাধারণত আমানত বলতে গচ্ছিত অর্থ-সম্পদকেই বুঝে থাকি। অথচ এটা আমানতের একটা দিক মাত্র। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো পরামর্শকেও 'আমানত' সাব্যস্ত করেছেনঃ- المستشار مؤتمن 'যার কাছে পরামর্শ চাওয়া হয় তার ওপর আমানত ভার অর্পিত (অর্থাৎ তাকে আমানতদারী ও বিশ্বস্ততার সঙ্গেই পরামর্শ দিতে হবে, অন্যথায় খেয়ানত হবে)।
(সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৫১২৮, জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৫২৬: সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৩৭৪৫; তাবারানী, আল-মু'জামুল আওসাত, হাদীছ নং ২১৯৫; মুস্তাদরাক হাকিম, হাদীছ নং ৭১৭৮; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৪২৮৪)
অপর এক হাদীছে খাস মজলিসের কথাবার্তাকে আমানত সাব্যস্ত করা হয়েছে। যেমন ইরশাদঃ- المجالس بالأمانة ‘মজলিসসমূহ (এর কথাবার্তা ও আলোচনা) আমানতের সাথে সম্পৃক্ত। (সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৮৬৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৪৬৯৩; মুস্তাদরাক হাকিম, ৭৭০৯; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান, হাদীছ নং ১০৬৭৯)
এমনিভাবে কাউকে কোনও পদে নিযুক্ত করার বিষয়টিও আমানত। অযোগ্য ব্যক্তিকে কোনও পদে নিয়োগদান খেয়ানতের অন্তর্ভুক্ত। একবার কিয়ামত সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন, যখন (ব্যাপকভাবে)আমানত নষ্ট করা হবে, তখন কিয়ামতের অপেক্ষা করো। জিজ্ঞেস করা হল, আমানত নষ্ট করা হয় কিভাবে? তিনি ইরশাদ করলেনঃ- إذا وسد الأمر إلى غير أهله ‘যখন কোনও দায়িত্ব অনুপযুক্ত ব্যক্তির ওপর অর্পণ করা হবে (অর্থাৎ অনুপযুক্ত ব্যক্তির ওপর দায়িত্ব অর্পণ করাই আমানত নষ্ট করা)। (সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৫৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৮৭১৪ : সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ১০৪)
এসব হাদীছ দ্বারা স্পষ্টভাবেই বোঝা যায় যে, আমানতের বিষয়টি অতি ব্যাপক। দীনী এবং দুনিয়াবী যাবতীয় বিষয়ই এর অন্তর্ভুক্ত। বোঝার সুবিধার্থে সংক্ষেপে আমানতকে এভাবে ভাগ করা যায়
প্রথমত আমানত দুই প্রকার। ক. আল্লাহপ্রদত্ত আমানত এবং খ. মানুষের আমানত। আল্লাহপ্রদত্ত আমানতও দুই প্রকার- জাহেরী বা প্রকাশ্য আমানত এবং বাতেনী বা গুপ্ত আমানত। আল্লাহ তা'আলা মানুষকে যা-কিছু নি'আমত দিয়েছেন সবই আমানতের অন্তর্ভুক্ত। জাহেরী নি'আমতসমূহ জাহেরী আমানতের অন্তর্ভুক্ত এবং বাতেনী নি'আমতসমূহ বাতেনী আমানতের অন্তর্ভুক্ত।
জাহেরী নি‘আমতের মধ্যে আছে মানুষের নিজের অস্তিত্ব, তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, অঙ্গ প্রত্যঙ্গের শক্তিসমূহ, ক্ষমতা ও সক্ষমতা, তার প্রকাশ্য সৌন্দর্য, দুনিয়ায় তার জীবনরক্ষার যাবতীয় আসবাব উপকরণ- যথা আলো, বাতাস, পানি, ঘরবাড়ি, ভূমি, রাস্তাঘাট, নদী-নালা, গাছ-বৃক্ষ, হাজারও রকম খাদ্যসামগ্রী, ফলমূল, পশুপাখি ইত্যাদি। এ সবই আল্লাহর দেওয়া আমানত। এর প্রত্যেকটির হেফাজত জরুরি। এর কোনওটির অপচয় ও অপব্যবহার করা এবং কোনওটি অহেতুক নষ্ট-ধ্বংস করা কঠিন খেয়ানত।
বাতেনী নি'আমতের মধ্যে আছে ঈমান, দীন ও শরী'আত, জ্ঞান-বিদ্যা-বুদ্ধি, চিন্তাশক্তি, উদ্ভাবনীশক্তি, সাহস, উদ্যম-স্ফূর্তি, মায়া-মমতা ইত্যাদি। এগুলো আল্লাহ তা'আলার অপার দান। এগুলোর হেফাজত জরুরি। এর কোনওটি অপচয়-অপব্যবহার করা খেয়ানত ও কঠিন গুনাহ।
মানুষের আমানতও দুই রকম। ক. বৈষয়িক আমানত ও খ. বিমূর্ত আমানত। বৈষয়িক আমানতের মধ্যে আছে টাকা-পয়সা, আসবাবপত্র, জমি-জমা ইত্যাদি। বিমূর্ত আমানত অর্থাৎ এমন আমানত, যার সম্পর্ক সরাসরি কোনও বস্তুর সঙ্গে নয়, এরকম আমানতের মধ্যে আছে অভিভাবকত্ব, পদ ও পদীয় দায়িত্ব, গুপ্ত কথা, পরামর্শ, খাস মজলিসের কথাবার্তা ইত্যাদি।
আল্লাহর দেওয়া আমানত ও মানুষের আমানত- এ উভয় প্রকার আমানতের সমষ্টিই তো দীন ও ঈমান। সুতরাং এ কথা বলা যেতেই পারে যে, আমানত ও ঈমান অভিন্ন বিষয়বস্তুর নাম। তাই তো দেখা যায়, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক হাদীছে ইরশাদ করেছেনঃ- لا إيمان لمن لا أمانة له ‘ওই ব্যক্তির ঈমান নেই, যার আমানতদারী নেই। (বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান, হাদীছ নং ৪০৪৫. বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ৩৯; তাবারানী, আল-মু'জামুল আওসাত, হানীছ নং ২২৯২: সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ১৯৪; সহীহ ইবন মুযাইমা, হাদীছ নং ২৩৩৬: খারাইতী, মাকারিমুল আখলাক, হাদীছ নং ১৬৩)
এর দ্বারা ইসলামী শিক্ষায় আমানত রক্ষার বিষয়টি যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা অনুভব করা যায় । যে ব্যক্তি সর্বপ্রকার আমানত নষ্ট করবে সে তো সম্পূর্ণরূপেই ঈমান হারাবে, আর যে ব্যক্তি ক্ষেত্রবিশেষে আমানতের খেয়ানত করবে তার ঈমান অংশত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সুতরাং নিজ ঈমানের হেফাজতকল্পে প্রত্যেকের উচিত সর্বপ্রকার আমানতরক্ষায় যত্নবান থাকা। ইমাম নববী রহ. আমানতদারীর গুরুত্ব সম্পর্কে এ অধ্যায়ে কিছু আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করেছেন। আমরা নিচে তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তা'আলাই তাওফীকদাতা।
আমানত আদায় সম্পর্কিত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا
অর্থ : (হে মুসলিমগণ।) নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ করছেন যে, তোমরা আমানতসমূহ তার হকদারকে আদায় করে দেবে। সুনা নিসা (৪), আয়াত ৫৮
ব্যাখ্যা
এ আয়াতের শানে নুযূল সম্পর্কে তাফসীর গ্রন্থসমূহে একটি চমৎকার ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। ঘটনাটি এস্থলে উল্লেখযোগ্য। সে ঘটনাটি কা'বাঘরের চাবিসংক্রান্ত।
ইসলামী যুগের আগে কা'বাঘর সংক্রান্ত একেকটি কাজের দায়িত্ব একেক ব্যক্তির যিম্মায় ছিল। কা'বাঘরের চাবি ছিল উছমান ইবন তালহার কাছে। প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার কা'বাঘর খুলে দেওয়া হত এবং উছমান ইবন তালহা নিজে সে দায়িত্ব পালন করত। একদিন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম কা'বাঘরে প্রবেশ করতে চাইলেন। কিন্তু উছমান তাঁর জন্য কা'বাঘর খুলতে রাজি হল না। সেদিন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে উছমানের যে ঘটনা ঘটেছিল, উছমান পরবর্তীকালে ইসলাম গ্রহণের পর সে ঘটনা যেভাবে বর্ণনা করেছেন তার সারমর্ম নিম্নরূপ-
একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম কা'বাঘরে প্রবেশ করতে চাইলে সে তো তাঁকে চাবি দিলই না; উল্টো তাঁর সঙ্গে রূঢ় ব্যবহার করল এবং তাঁকে গালমন্দ করল। কিন্তু তিনি তার আচরণে অশেষ ধৈর্যধারণ করেন। তারপর তিনি উছমানকে লক্ষ্য করে বলেন, হে উছমান! অচিরেই একদিন আসবে, যখন কা'বাঘরের চাবি আমার হাতে দেখতে পাবে। সেদিন আমি যাকে ইচ্ছা এ চাবি প্রদান করব। উছমান বলল, তাহলে সেদিন কুরায়শ বংশ চরম অপদস্থ হবে। তিনি বললেন, না, সেদিন তাদের সত্যিকারের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে। তাঁর এ কথা উছমানের মনে দাগ কাটল। সে নিশ্চিত হল যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা বললেন তা অবশ্যই একদিন ঘটবে। তখনই সে ইসলাম গ্রহণের ইচ্ছা করেছিল। কিন্তু তার গোত্রের লোকেরা তা শুনে তাকে খুব গালমন্দ করল এবং ইসলামগ্রহণে তাকে বাধা দিল। ফলে উছমান তার বাপ-দাদার ধর্মেই রয়ে গেল।
তারপর হিজরী ৮ম সালে যেদিন মক্কা বিজিত হল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম উছমানকে ডেকে পাঠালেন এবং চাবি নিয়ে আসার নির্দেশ দিলেন। চাবিটি ছিল তার মায়ের কাছে। প্রথমে তিনি সেটি দিতে রাজি হননি। পরে যখন উছমান তার কাছে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করল এবং চাবি না দিলে কী ঘটতে পারে সে ব্যাপারে তাকে সাবধান করল, তখন অগত্যা তিনি চাবিটি দিয়ে দিলেন। উছমান চাবি নিয়ে এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতে সমর্পণ করল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম কা'বাঘর খুলে ভেতরে ঢুকলেন এবং দু' রাক'আত নামায পড়লেন। তারপর কা'বাঘরের ভেতরে থাকা অবস্থায়ই আয়াত
নাযিল হল-
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا
(হে মুসলিমগণ!) নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ করছেন যে, তোমরা আমানতসমূহ তার হকদারকে আদায় করে দেবে।
তিনি কা'বাঘর থেকে বের হয়ে আবার উছমানকে ডাকলেন এবং তার হাতে চাবি ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, এটি তুমি স্থায়ীভাবে গ্রহণ কর। এটি স্থায়ীভাবে তোমার ও তোমার বংশধরদের হাতে থাকবে। একমাত্র জালেম ছাড়া আর কেউ এটি ছিনিয়ে নিতে পারবে না।
উছমান ইবন তালহা এখন একজন সাহাবী। তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন। তিনি যখন কা'বার চাবি নিয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন, তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবার তাকে ডাকলেন। উছমান ফিরে আসলেন। এবার তিনি অতীতের সেই ঘটনাটি স্মরণ করিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, হে উছমান! আমি তোমাকে সেদিন যে কথা বলেছিলাম তা কি সত্যে পরিণত হয়নি? উছমান বললেন, হাঁ, অবশ্যই। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আপনি আল্লাহর রাসূল।
এমনই ছিল মহানবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের মহৎ চরিত্র। ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তিনি উছমান ইবন তালহা থেকে কোনও প্রতিশোধ তো নিলেনই না; উল্টো তাকে ইসলামী যুগেও কা'বাঘরের চাবিরক্ষক হওয়ার মর্যাদা দান করলেন, তাও স্থায়ী মর্যাদা। কিয়ামত পর্যন্ত তার বংশেই চাবি থাকার অপরিবর্তনীয় সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন। আজও পর্যন্ত কা'বাঘরের চাবি এ বংশেরই হেফাজতে আছে।
যদিও এ আয়াতটি নাযিল হয়েছে বিশেষ ঘটনাকে কেন্দ্র করে, কিন্তু এর শব্দ ব্যাপক। বহুবচনে الْأمَانَات শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। জানানো হচ্ছে যে, সর্বপ্রকার আমানতই তার হকদারকে বুঝিয়ে দেবে। আল্লাহপ্রদত্ত আমানত আল্লাহকে বুঝিয়ে দেবে অর্থাৎ শরী'আতের যাবতীয় আদেশ-নিষেধ যথাযথভাবে পালন করবে। আর বান্দারও যত রকম আমানত আছে তাও পুরোপুরি সংরক্ষণ করবে এবং যথাসময়ে আদায় করবে।
সরাসরি আদেশটি করা হয়েছিল নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে লক্ষ্য করে। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও বহুবচনের সর্বনাম كم ব্যবহার দ্বারা অন্য সকলকেও এ আদেশের অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ আপন আপন স্থান থেকে সকলেই কোনও না কোনও আমানতের ভারবাহী। কাজেই সকলকেই আপন আপন আমানতের হেফাজতে যত্নবান থাকতে হবে এবং সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে যথাযথভাবে তা আদায় করতে হবে।
প্রকৃতপক্ষে আমানত আদায়ের হুকুম এমনই একটি ব্যাপক বিষয় যে, যদি কেউ এই এক হুকুম যথাযথভাবে পালন করে, তবে তার দ্বারা গোটা দীন ও শরী'আতই পালন হয়ে যাবে। যে ব্যক্তি সর্বপ্রকার আমানত রক্ষা করে চলবে, সে সত্যিকারের মু'মিন হয়ে যাবে। অতএব আমাদের প্রত্যেকের উচিত এর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া।
দুই নং আয়াত
إِنَّا عَرَضْنَا الْأَمَانَةَ عَلَى السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَالْجِبَالِ فَأَبَيْنَ أَنْ يَحْمِلْنَهَا وَأَشْفَقْنَ مِنْهَا وَحَمَلَهَا الْإِنْسَانُ إِنَّهُ كَانَ ظَلُومًا جَهُولًا (72)
অর্থ : আমি আমানত পেশ করেছিলাম আকাশমণ্ডলী, পৃথিবী ও পাহাড়-পর্বতের সামনে। তারা তা বহন করতে অস্বীকার করল ও তাতে শংকিত হল আর তা বহন করে নিল মানুষ। বস্তুত সে ঘোর জালেম, ঘোর অজ্ঞ।সূরা আহযাব (৩৩), আয়াত ৭২
ব্যাখ্যা
এস্থলে আমানত অর্থ 'নিজের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ব্যবহার করে আল্লাহ তাআলার আদেশ-নিষেধ মেনে চলার যিম্মাদারী গ্রহণ'। বিশ্বজগতে আল্লাহ তাআলার কিছু বিধান তো সৃষ্টিগত বা প্রাকৃতিক (তাকবীনী), যা মেনে চলতে সমস্ত সৃষ্টি বাধ্য। কারও পক্ষে তা অমান্য করা সম্ভবই নয়। যেমন জীবন ও মৃত্যু সংক্রান্ত ফায়সালা। কিন্তু আল্লাহ তাআলা চাইলেন এমন কিছু বিধান দিতে যা সৃষ্টি তার স্বাধীন ইচ্ছা বলে মান্য করবে। এজন্য তিনি তার কোনও-কোনও সৃষ্টির সামনে এই প্রস্তাবনা রাখলেন যে, কিছু বিধানের ব্যাপারে তাদেরকে এখতিয়ার দেওয়া হবে। চাইলে তারা নিজ ইচ্ছায় সেসব বিধান মেনে আল্লাহ তাআলার আনুগত্য করবে কিংবা চাইলে তা অমান্য করবে। মান্য করলে তারা জান্নাতের স্থায়ী নেয়ামত লাভ করবে আর যদি অমান্য করে তবে তাদেরকে জাহান্নামে শাস্তি দেওয়া হবে। যখন এ প্রস্তাব আকাশমণ্ডলী, পৃথিবী ও পর্বতমালার সামনে রাখা হল, তারা এ যিম্মাদারী গ্রহণ করতে ভয় পেয়ে গেল ফলে তারা এটা গ্রহণ করল না। ভয় পেল এ কারণে যে, এর পরিণতিতে জাহান্নামে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। কিন্তু যখন মানুষকে এ প্রস্তাব দেওয়া হল, তারা এটা গ্রহণ করে নিল।
আসমান, যমীন ও পাহাড় আপাতদৃষ্টিতে যদিও এমন বস্তু, যাদের কোনও বোধশক্তি নেই, কিন্তু কুরআন মাজীদের কয়েকটি আয়াত দ্বারা জানা যায়, তাদের মধ্যে এক পর্যায়ের বোধশক্তি আছে, যেমন সূরা বনী ইসরাঈলে ইরশাদ হয়েছে-
تُسَبِّحُ لَهُ السَّمَاوَاتُ السَّبْعُ وَالْأَرْضُ وَمَنْ فِيهِنَّ وَإِنْ مِنْ شَيْءٍ إِلَّا يُسَبِّحُ بِحَمْدِهِ وَلَكِنْ لَا تَفْقَهُونَ تَسْبِيحَهُمْ إِنَّهُ كَانَ حَلِيمًا غَفُورًا (44)
“সাত আসমান ও যমীন এবং এদের অন্তর্ভুক্ত সমস্ত সৃষ্টি তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করে, এমন কোনও জিনিস নেই, যা তাঁর সপ্রশংস তাসবীহ পাঠ করে না। কিন্তু তোমরা তাদের তাসবীহ বুঝতে পার না। বস্তুত তিনি পরম সহিষ্ণু, অতি ক্ষমাশীল। সূরা বনী ইসরাঈল (১৭), আয়াত ৪৪
এ আয়াতে সুস্পষ্ট অর্থ তো এটাই যে, প্রতিটি বস্তু প্রকৃত অর্থেই তাসবীহ পাঠ করে, কিন্তু আমরা তা বুঝতে পারি না। কেননা আল্লাহ তাআলা জগতের প্রতিটি জিনিস, এমনকি পাথরের ভেতরও এক রকমের অনুভূতিশক্তি দান করেছেন, যে শক্তি দ্বারা সবকিছুর পক্ষেই তাসবীহ পাঠ সম্ভব। কুরআন মাজীদের বেশ ক'টি আয়াতের আলোকে এ ব্যাখ্যাই বেশি সঠিক মনে হয়। আধুনিক বিজ্ঞানও স্বীকার করে নিয়েছে যে, পাথরের মধ্যেও এক ধরনের অনুভবশক্তি আছে।
অপর এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
ثُمَّ اسْتَوَى إِلَى السَّمَاءِ وَهِيَ دُخَانٌ فَقَالَ لَهَا وَلِلْأَرْضِ ائْتِيَا طَوْعًا أَوْ كَرْهًا قَالَتَا أَتَيْنَا طَائِعِينَ (11)
"তারপর তিনি আকাশের দিকে মনোযোগ দান করলেন, যা ছিল ধোঁয়ারূপে। তিনি তাকে ও পৃথিবীকে বললেন, তোমরা চলে এসো ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়। উভয়ে বলল, আমরা ইচ্ছাক্রমেই আসলাম। সূরা হা-মীম সাজদা (৪১), আয়াত ১১
এ আয়াতে দেখা যাচ্ছে আল্লাহ তা'আলা আসমান-যমীনকে লক্ষ্য করে একটি আদেশ করেছেন, তাঁর সে আদেশ তারা বুঝতে পেরেছে এবং সে আদেশ তারা মান্য করেছে বলে সুস্পষ্ট ভাষায় প্রকাশও করেছে।
কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা'আলার হুকুমে মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দান করবে। তাতে মানুষ অবাক হয়ে তাদের প্রশ্ন করবে- তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে কিভাবে সাক্ষ্য দিলে? তার উত্তরে তারা বলবে-
أَنْطَقَ كُلَّ شَيْءٍ وَهُوَ خَلَقَكُمْ أَوَّلَ مَرَّةٍ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ (21)
“তারা বলবে, আল্লাহ আমাদেরকে বাকশক্তি দান করেছেন, যিনি বাকশক্তি দান করেছেন প্রতিটি জিনিসকে। তিনিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন প্রথমবার আর তাঁরই কাছে তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।'সূরা হা-মীম সাজদা (৪১), আয়াত ২১
সুতরাং এসব আয়াতের দৃষ্টিতে যদি বলা হয়, আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে আসমান-যমীন ও পাহাড়-পর্বতকে আমানতগ্রহণের যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল সেটা প্রতীকী অর্থে নয়; বরং বাস্তব অর্থে এবং তাদের অস্বীকৃতিও ছিল বাস্তব অর্থেই, তাতে আপত্তির কোনও অবকাশ নেই। অবশ্য এটাও সম্ভব যে, আমানত গ্রহণের প্রস্তাব দান ও তাদের প্রত্যাখ্যান প্রতীকী অর্থে হয়েছিল। অর্থাৎ আমানত বহনের যোগ্যতা না থাকাকে প্রত্যাখ্যান শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে।
এ আয়াতে আমানতভার গ্রহণ করায় মানুষকে চরম জালেম ও অজ্ঞ সাব্যস্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে-
إِنَّهُ كَانَ ظَلُومًا جَهُولًا
বস্তুত সে ঘোর জালেম, ঘোর অজ্ঞ।"
কেন তারা জালেম ও অজ্ঞ? 'উলামায়ে কিরামের একদল বলেন, এটা বলা হয়েছে কাফেরদেরকে, যারা এ আমানত রক্ষা করেনি। না তারা নিজেদের বিবেক-বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে সত্য-সঠিক পথের সন্ধান করেছে, আর না নবী-রাসূলগণের ডাকে সাড়া দিয়ে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছে। যারা মুমিন ও নেককার, তারা বিবেক-বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে এবং নবী-রাসূলগণের দাওয়াত কবুল করে যেমন জ্ঞানের অধিকারী হয়েছে, তেমনি সত্য-সঠিক পথে চলে ন্যায়-নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছে। সুতরাং তারা জালেম ও অজ্ঞ নয়।
আবার অনেকের মতে এ কথা বলা হয়েছে সমস্ত মানুষকে লক্ষ্য করে। সব মানুষের স্বভাবের ভেতরই জুলুম অবিচার ও অজ্ঞতা বিদ্যমান। তবে আল্লাহ তা'আলা মু'মিনদের প্রতি অনুগ্রহ করেন, ফলে তারা দীন সম্পর্কে জানতে পারে এবং দীনের ওপর চলতে সচেষ্ট থাকে। এভাবে তাদের স্বভাবে জুলুম ও অজ্ঞতা নিহিত থাকলেও কার্যত তারা জ্ঞানী ও ন্যায়-নিষ্ঠ হয়ে যায় এবং আমানতের যে ভার তারা বহন করেছিল তা রক্ষা করতে সক্ষম হয়।
امانة (আমানত) শব্দটি أمن থেকে নির্গত, যেমন إيمان (ঈমান) শব্দটিও أمن থেকেই নির্গত হয়েছে। উভয়টির মূল হরফ যেমন অভিন্ন, তেমনি বাস্তবেও উভয়টি অবিচ্ছেদ্য। সুতরাং আমানত ঈমানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। এটা অতি ব্যাপক। আমরা সাধারণত আমানত বলতে গচ্ছিত অর্থ-সম্পদকেই বুঝে থাকি। অথচ এটা আমানতের একটা দিক মাত্র। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো পরামর্শকেও 'আমানত' সাব্যস্ত করেছেনঃ- المستشار مؤتمن 'যার কাছে পরামর্শ চাওয়া হয় তার ওপর আমানত ভার অর্পিত (অর্থাৎ তাকে আমানতদারী ও বিশ্বস্ততার সঙ্গেই পরামর্শ দিতে হবে, অন্যথায় খেয়ানত হবে)।
(সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৫১২৮, জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৫২৬: সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৩৭৪৫; তাবারানী, আল-মু'জামুল আওসাত, হাদীছ নং ২১৯৫; মুস্তাদরাক হাকিম, হাদীছ নং ৭১৭৮; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৪২৮৪)
অপর এক হাদীছে খাস মজলিসের কথাবার্তাকে আমানত সাব্যস্ত করা হয়েছে। যেমন ইরশাদঃ- المجالس بالأمانة ‘মজলিসসমূহ (এর কথাবার্তা ও আলোচনা) আমানতের সাথে সম্পৃক্ত। (সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৮৬৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৪৬৯৩; মুস্তাদরাক হাকিম, ৭৭০৯; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান, হাদীছ নং ১০৬৭৯)
এমনিভাবে কাউকে কোনও পদে নিযুক্ত করার বিষয়টিও আমানত। অযোগ্য ব্যক্তিকে কোনও পদে নিয়োগদান খেয়ানতের অন্তর্ভুক্ত। একবার কিয়ামত সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন, যখন (ব্যাপকভাবে)আমানত নষ্ট করা হবে, তখন কিয়ামতের অপেক্ষা করো। জিজ্ঞেস করা হল, আমানত নষ্ট করা হয় কিভাবে? তিনি ইরশাদ করলেনঃ- إذا وسد الأمر إلى غير أهله ‘যখন কোনও দায়িত্ব অনুপযুক্ত ব্যক্তির ওপর অর্পণ করা হবে (অর্থাৎ অনুপযুক্ত ব্যক্তির ওপর দায়িত্ব অর্পণ করাই আমানত নষ্ট করা)। (সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৫৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৮৭১৪ : সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ১০৪)
এসব হাদীছ দ্বারা স্পষ্টভাবেই বোঝা যায় যে, আমানতের বিষয়টি অতি ব্যাপক। দীনী এবং দুনিয়াবী যাবতীয় বিষয়ই এর অন্তর্ভুক্ত। বোঝার সুবিধার্থে সংক্ষেপে আমানতকে এভাবে ভাগ করা যায়
প্রথমত আমানত দুই প্রকার। ক. আল্লাহপ্রদত্ত আমানত এবং খ. মানুষের আমানত। আল্লাহপ্রদত্ত আমানতও দুই প্রকার- জাহেরী বা প্রকাশ্য আমানত এবং বাতেনী বা গুপ্ত আমানত। আল্লাহ তা'আলা মানুষকে যা-কিছু নি'আমত দিয়েছেন সবই আমানতের অন্তর্ভুক্ত। জাহেরী নি'আমতসমূহ জাহেরী আমানতের অন্তর্ভুক্ত এবং বাতেনী নি'আমতসমূহ বাতেনী আমানতের অন্তর্ভুক্ত।
জাহেরী নি‘আমতের মধ্যে আছে মানুষের নিজের অস্তিত্ব, তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, অঙ্গ প্রত্যঙ্গের শক্তিসমূহ, ক্ষমতা ও সক্ষমতা, তার প্রকাশ্য সৌন্দর্য, দুনিয়ায় তার জীবনরক্ষার যাবতীয় আসবাব উপকরণ- যথা আলো, বাতাস, পানি, ঘরবাড়ি, ভূমি, রাস্তাঘাট, নদী-নালা, গাছ-বৃক্ষ, হাজারও রকম খাদ্যসামগ্রী, ফলমূল, পশুপাখি ইত্যাদি। এ সবই আল্লাহর দেওয়া আমানত। এর প্রত্যেকটির হেফাজত জরুরি। এর কোনওটির অপচয় ও অপব্যবহার করা এবং কোনওটি অহেতুক নষ্ট-ধ্বংস করা কঠিন খেয়ানত।
বাতেনী নি'আমতের মধ্যে আছে ঈমান, দীন ও শরী'আত, জ্ঞান-বিদ্যা-বুদ্ধি, চিন্তাশক্তি, উদ্ভাবনীশক্তি, সাহস, উদ্যম-স্ফূর্তি, মায়া-মমতা ইত্যাদি। এগুলো আল্লাহ তা'আলার অপার দান। এগুলোর হেফাজত জরুরি। এর কোনওটি অপচয়-অপব্যবহার করা খেয়ানত ও কঠিন গুনাহ।
মানুষের আমানতও দুই রকম। ক. বৈষয়িক আমানত ও খ. বিমূর্ত আমানত। বৈষয়িক আমানতের মধ্যে আছে টাকা-পয়সা, আসবাবপত্র, জমি-জমা ইত্যাদি। বিমূর্ত আমানত অর্থাৎ এমন আমানত, যার সম্পর্ক সরাসরি কোনও বস্তুর সঙ্গে নয়, এরকম আমানতের মধ্যে আছে অভিভাবকত্ব, পদ ও পদীয় দায়িত্ব, গুপ্ত কথা, পরামর্শ, খাস মজলিসের কথাবার্তা ইত্যাদি।
আল্লাহর দেওয়া আমানত ও মানুষের আমানত- এ উভয় প্রকার আমানতের সমষ্টিই তো দীন ও ঈমান। সুতরাং এ কথা বলা যেতেই পারে যে, আমানত ও ঈমান অভিন্ন বিষয়বস্তুর নাম। তাই তো দেখা যায়, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক হাদীছে ইরশাদ করেছেনঃ- لا إيمان لمن لا أمانة له ‘ওই ব্যক্তির ঈমান নেই, যার আমানতদারী নেই। (বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান, হাদীছ নং ৪০৪৫. বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ৩৯; তাবারানী, আল-মু'জামুল আওসাত, হানীছ নং ২২৯২: সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ১৯৪; সহীহ ইবন মুযাইমা, হাদীছ নং ২৩৩৬: খারাইতী, মাকারিমুল আখলাক, হাদীছ নং ১৬৩)
এর দ্বারা ইসলামী শিক্ষায় আমানত রক্ষার বিষয়টি যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা অনুভব করা যায় । যে ব্যক্তি সর্বপ্রকার আমানত নষ্ট করবে সে তো সম্পূর্ণরূপেই ঈমান হারাবে, আর যে ব্যক্তি ক্ষেত্রবিশেষে আমানতের খেয়ানত করবে তার ঈমান অংশত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সুতরাং নিজ ঈমানের হেফাজতকল্পে প্রত্যেকের উচিত সর্বপ্রকার আমানতরক্ষায় যত্নবান থাকা। ইমাম নববী রহ. আমানতদারীর গুরুত্ব সম্পর্কে এ অধ্যায়ে কিছু আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করেছেন। আমরা নিচে তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তা'আলাই তাওফীকদাতা।
আমানত আদায় সম্পর্কিত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا
অর্থ : (হে মুসলিমগণ।) নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ করছেন যে, তোমরা আমানতসমূহ তার হকদারকে আদায় করে দেবে। সুনা নিসা (৪), আয়াত ৫৮
ব্যাখ্যা
এ আয়াতের শানে নুযূল সম্পর্কে তাফসীর গ্রন্থসমূহে একটি চমৎকার ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। ঘটনাটি এস্থলে উল্লেখযোগ্য। সে ঘটনাটি কা'বাঘরের চাবিসংক্রান্ত।
ইসলামী যুগের আগে কা'বাঘর সংক্রান্ত একেকটি কাজের দায়িত্ব একেক ব্যক্তির যিম্মায় ছিল। কা'বাঘরের চাবি ছিল উছমান ইবন তালহার কাছে। প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার কা'বাঘর খুলে দেওয়া হত এবং উছমান ইবন তালহা নিজে সে দায়িত্ব পালন করত। একদিন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম কা'বাঘরে প্রবেশ করতে চাইলেন। কিন্তু উছমান তাঁর জন্য কা'বাঘর খুলতে রাজি হল না। সেদিন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে উছমানের যে ঘটনা ঘটেছিল, উছমান পরবর্তীকালে ইসলাম গ্রহণের পর সে ঘটনা যেভাবে বর্ণনা করেছেন তার সারমর্ম নিম্নরূপ-
একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম কা'বাঘরে প্রবেশ করতে চাইলে সে তো তাঁকে চাবি দিলই না; উল্টো তাঁর সঙ্গে রূঢ় ব্যবহার করল এবং তাঁকে গালমন্দ করল। কিন্তু তিনি তার আচরণে অশেষ ধৈর্যধারণ করেন। তারপর তিনি উছমানকে লক্ষ্য করে বলেন, হে উছমান! অচিরেই একদিন আসবে, যখন কা'বাঘরের চাবি আমার হাতে দেখতে পাবে। সেদিন আমি যাকে ইচ্ছা এ চাবি প্রদান করব। উছমান বলল, তাহলে সেদিন কুরায়শ বংশ চরম অপদস্থ হবে। তিনি বললেন, না, সেদিন তাদের সত্যিকারের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে। তাঁর এ কথা উছমানের মনে দাগ কাটল। সে নিশ্চিত হল যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা বললেন তা অবশ্যই একদিন ঘটবে। তখনই সে ইসলাম গ্রহণের ইচ্ছা করেছিল। কিন্তু তার গোত্রের লোকেরা তা শুনে তাকে খুব গালমন্দ করল এবং ইসলামগ্রহণে তাকে বাধা দিল। ফলে উছমান তার বাপ-দাদার ধর্মেই রয়ে গেল।
তারপর হিজরী ৮ম সালে যেদিন মক্কা বিজিত হল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম উছমানকে ডেকে পাঠালেন এবং চাবি নিয়ে আসার নির্দেশ দিলেন। চাবিটি ছিল তার মায়ের কাছে। প্রথমে তিনি সেটি দিতে রাজি হননি। পরে যখন উছমান তার কাছে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করল এবং চাবি না দিলে কী ঘটতে পারে সে ব্যাপারে তাকে সাবধান করল, তখন অগত্যা তিনি চাবিটি দিয়ে দিলেন। উছমান চাবি নিয়ে এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতে সমর্পণ করল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম কা'বাঘর খুলে ভেতরে ঢুকলেন এবং দু' রাক'আত নামায পড়লেন। তারপর কা'বাঘরের ভেতরে থাকা অবস্থায়ই আয়াত
নাযিল হল-
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا
(হে মুসলিমগণ!) নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ করছেন যে, তোমরা আমানতসমূহ তার হকদারকে আদায় করে দেবে।
তিনি কা'বাঘর থেকে বের হয়ে আবার উছমানকে ডাকলেন এবং তার হাতে চাবি ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, এটি তুমি স্থায়ীভাবে গ্রহণ কর। এটি স্থায়ীভাবে তোমার ও তোমার বংশধরদের হাতে থাকবে। একমাত্র জালেম ছাড়া আর কেউ এটি ছিনিয়ে নিতে পারবে না।
উছমান ইবন তালহা এখন একজন সাহাবী। তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন। তিনি যখন কা'বার চাবি নিয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন, তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবার তাকে ডাকলেন। উছমান ফিরে আসলেন। এবার তিনি অতীতের সেই ঘটনাটি স্মরণ করিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, হে উছমান! আমি তোমাকে সেদিন যে কথা বলেছিলাম তা কি সত্যে পরিণত হয়নি? উছমান বললেন, হাঁ, অবশ্যই। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আপনি আল্লাহর রাসূল।
এমনই ছিল মহানবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের মহৎ চরিত্র। ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তিনি উছমান ইবন তালহা থেকে কোনও প্রতিশোধ তো নিলেনই না; উল্টো তাকে ইসলামী যুগেও কা'বাঘরের চাবিরক্ষক হওয়ার মর্যাদা দান করলেন, তাও স্থায়ী মর্যাদা। কিয়ামত পর্যন্ত তার বংশেই চাবি থাকার অপরিবর্তনীয় সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন। আজও পর্যন্ত কা'বাঘরের চাবি এ বংশেরই হেফাজতে আছে।
যদিও এ আয়াতটি নাযিল হয়েছে বিশেষ ঘটনাকে কেন্দ্র করে, কিন্তু এর শব্দ ব্যাপক। বহুবচনে الْأمَانَات শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। জানানো হচ্ছে যে, সর্বপ্রকার আমানতই তার হকদারকে বুঝিয়ে দেবে। আল্লাহপ্রদত্ত আমানত আল্লাহকে বুঝিয়ে দেবে অর্থাৎ শরী'আতের যাবতীয় আদেশ-নিষেধ যথাযথভাবে পালন করবে। আর বান্দারও যত রকম আমানত আছে তাও পুরোপুরি সংরক্ষণ করবে এবং যথাসময়ে আদায় করবে।
সরাসরি আদেশটি করা হয়েছিল নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে লক্ষ্য করে। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও বহুবচনের সর্বনাম كم ব্যবহার দ্বারা অন্য সকলকেও এ আদেশের অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ আপন আপন স্থান থেকে সকলেই কোনও না কোনও আমানতের ভারবাহী। কাজেই সকলকেই আপন আপন আমানতের হেফাজতে যত্নবান থাকতে হবে এবং সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে যথাযথভাবে তা আদায় করতে হবে।
প্রকৃতপক্ষে আমানত আদায়ের হুকুম এমনই একটি ব্যাপক বিষয় যে, যদি কেউ এই এক হুকুম যথাযথভাবে পালন করে, তবে তার দ্বারা গোটা দীন ও শরী'আতই পালন হয়ে যাবে। যে ব্যক্তি সর্বপ্রকার আমানত রক্ষা করে চলবে, সে সত্যিকারের মু'মিন হয়ে যাবে। অতএব আমাদের প্রত্যেকের উচিত এর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া।
দুই নং আয়াত
إِنَّا عَرَضْنَا الْأَمَانَةَ عَلَى السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَالْجِبَالِ فَأَبَيْنَ أَنْ يَحْمِلْنَهَا وَأَشْفَقْنَ مِنْهَا وَحَمَلَهَا الْإِنْسَانُ إِنَّهُ كَانَ ظَلُومًا جَهُولًا (72)
অর্থ : আমি আমানত পেশ করেছিলাম আকাশমণ্ডলী, পৃথিবী ও পাহাড়-পর্বতের সামনে। তারা তা বহন করতে অস্বীকার করল ও তাতে শংকিত হল আর তা বহন করে নিল মানুষ। বস্তুত সে ঘোর জালেম, ঘোর অজ্ঞ।সূরা আহযাব (৩৩), আয়াত ৭২
ব্যাখ্যা
এস্থলে আমানত অর্থ 'নিজের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ব্যবহার করে আল্লাহ তাআলার আদেশ-নিষেধ মেনে চলার যিম্মাদারী গ্রহণ'। বিশ্বজগতে আল্লাহ তাআলার কিছু বিধান তো সৃষ্টিগত বা প্রাকৃতিক (তাকবীনী), যা মেনে চলতে সমস্ত সৃষ্টি বাধ্য। কারও পক্ষে তা অমান্য করা সম্ভবই নয়। যেমন জীবন ও মৃত্যু সংক্রান্ত ফায়সালা। কিন্তু আল্লাহ তাআলা চাইলেন এমন কিছু বিধান দিতে যা সৃষ্টি তার স্বাধীন ইচ্ছা বলে মান্য করবে। এজন্য তিনি তার কোনও-কোনও সৃষ্টির সামনে এই প্রস্তাবনা রাখলেন যে, কিছু বিধানের ব্যাপারে তাদেরকে এখতিয়ার দেওয়া হবে। চাইলে তারা নিজ ইচ্ছায় সেসব বিধান মেনে আল্লাহ তাআলার আনুগত্য করবে কিংবা চাইলে তা অমান্য করবে। মান্য করলে তারা জান্নাতের স্থায়ী নেয়ামত লাভ করবে আর যদি অমান্য করে তবে তাদেরকে জাহান্নামে শাস্তি দেওয়া হবে। যখন এ প্রস্তাব আকাশমণ্ডলী, পৃথিবী ও পর্বতমালার সামনে রাখা হল, তারা এ যিম্মাদারী গ্রহণ করতে ভয় পেয়ে গেল ফলে তারা এটা গ্রহণ করল না। ভয় পেল এ কারণে যে, এর পরিণতিতে জাহান্নামে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। কিন্তু যখন মানুষকে এ প্রস্তাব দেওয়া হল, তারা এটা গ্রহণ করে নিল।
আসমান, যমীন ও পাহাড় আপাতদৃষ্টিতে যদিও এমন বস্তু, যাদের কোনও বোধশক্তি নেই, কিন্তু কুরআন মাজীদের কয়েকটি আয়াত দ্বারা জানা যায়, তাদের মধ্যে এক পর্যায়ের বোধশক্তি আছে, যেমন সূরা বনী ইসরাঈলে ইরশাদ হয়েছে-
تُسَبِّحُ لَهُ السَّمَاوَاتُ السَّبْعُ وَالْأَرْضُ وَمَنْ فِيهِنَّ وَإِنْ مِنْ شَيْءٍ إِلَّا يُسَبِّحُ بِحَمْدِهِ وَلَكِنْ لَا تَفْقَهُونَ تَسْبِيحَهُمْ إِنَّهُ كَانَ حَلِيمًا غَفُورًا (44)
“সাত আসমান ও যমীন এবং এদের অন্তর্ভুক্ত সমস্ত সৃষ্টি তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করে, এমন কোনও জিনিস নেই, যা তাঁর সপ্রশংস তাসবীহ পাঠ করে না। কিন্তু তোমরা তাদের তাসবীহ বুঝতে পার না। বস্তুত তিনি পরম সহিষ্ণু, অতি ক্ষমাশীল। সূরা বনী ইসরাঈল (১৭), আয়াত ৪৪
এ আয়াতে সুস্পষ্ট অর্থ তো এটাই যে, প্রতিটি বস্তু প্রকৃত অর্থেই তাসবীহ পাঠ করে, কিন্তু আমরা তা বুঝতে পারি না। কেননা আল্লাহ তাআলা জগতের প্রতিটি জিনিস, এমনকি পাথরের ভেতরও এক রকমের অনুভূতিশক্তি দান করেছেন, যে শক্তি দ্বারা সবকিছুর পক্ষেই তাসবীহ পাঠ সম্ভব। কুরআন মাজীদের বেশ ক'টি আয়াতের আলোকে এ ব্যাখ্যাই বেশি সঠিক মনে হয়। আধুনিক বিজ্ঞানও স্বীকার করে নিয়েছে যে, পাথরের মধ্যেও এক ধরনের অনুভবশক্তি আছে।
অপর এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
ثُمَّ اسْتَوَى إِلَى السَّمَاءِ وَهِيَ دُخَانٌ فَقَالَ لَهَا وَلِلْأَرْضِ ائْتِيَا طَوْعًا أَوْ كَرْهًا قَالَتَا أَتَيْنَا طَائِعِينَ (11)
"তারপর তিনি আকাশের দিকে মনোযোগ দান করলেন, যা ছিল ধোঁয়ারূপে। তিনি তাকে ও পৃথিবীকে বললেন, তোমরা চলে এসো ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়। উভয়ে বলল, আমরা ইচ্ছাক্রমেই আসলাম। সূরা হা-মীম সাজদা (৪১), আয়াত ১১
এ আয়াতে দেখা যাচ্ছে আল্লাহ তা'আলা আসমান-যমীনকে লক্ষ্য করে একটি আদেশ করেছেন, তাঁর সে আদেশ তারা বুঝতে পেরেছে এবং সে আদেশ তারা মান্য করেছে বলে সুস্পষ্ট ভাষায় প্রকাশও করেছে।
কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা'আলার হুকুমে মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দান করবে। তাতে মানুষ অবাক হয়ে তাদের প্রশ্ন করবে- তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে কিভাবে সাক্ষ্য দিলে? তার উত্তরে তারা বলবে-
أَنْطَقَ كُلَّ شَيْءٍ وَهُوَ خَلَقَكُمْ أَوَّلَ مَرَّةٍ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ (21)
“তারা বলবে, আল্লাহ আমাদেরকে বাকশক্তি দান করেছেন, যিনি বাকশক্তি দান করেছেন প্রতিটি জিনিসকে। তিনিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন প্রথমবার আর তাঁরই কাছে তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।'সূরা হা-মীম সাজদা (৪১), আয়াত ২১
সুতরাং এসব আয়াতের দৃষ্টিতে যদি বলা হয়, আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে আসমান-যমীন ও পাহাড়-পর্বতকে আমানতগ্রহণের যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল সেটা প্রতীকী অর্থে নয়; বরং বাস্তব অর্থে এবং তাদের অস্বীকৃতিও ছিল বাস্তব অর্থেই, তাতে আপত্তির কোনও অবকাশ নেই। অবশ্য এটাও সম্ভব যে, আমানত গ্রহণের প্রস্তাব দান ও তাদের প্রত্যাখ্যান প্রতীকী অর্থে হয়েছিল। অর্থাৎ আমানত বহনের যোগ্যতা না থাকাকে প্রত্যাখ্যান শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে।
এ আয়াতে আমানতভার গ্রহণ করায় মানুষকে চরম জালেম ও অজ্ঞ সাব্যস্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে-
إِنَّهُ كَانَ ظَلُومًا جَهُولًا
বস্তুত সে ঘোর জালেম, ঘোর অজ্ঞ।"
কেন তারা জালেম ও অজ্ঞ? 'উলামায়ে কিরামের একদল বলেন, এটা বলা হয়েছে কাফেরদেরকে, যারা এ আমানত রক্ষা করেনি। না তারা নিজেদের বিবেক-বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে সত্য-সঠিক পথের সন্ধান করেছে, আর না নবী-রাসূলগণের ডাকে সাড়া দিয়ে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছে। যারা মুমিন ও নেককার, তারা বিবেক-বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে এবং নবী-রাসূলগণের দাওয়াত কবুল করে যেমন জ্ঞানের অধিকারী হয়েছে, তেমনি সত্য-সঠিক পথে চলে ন্যায়-নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছে। সুতরাং তারা জালেম ও অজ্ঞ নয়।
আবার অনেকের মতে এ কথা বলা হয়েছে সমস্ত মানুষকে লক্ষ্য করে। সব মানুষের স্বভাবের ভেতরই জুলুম অবিচার ও অজ্ঞতা বিদ্যমান। তবে আল্লাহ তা'আলা মু'মিনদের প্রতি অনুগ্রহ করেন, ফলে তারা দীন সম্পর্কে জানতে পারে এবং দীনের ওপর চলতে সচেষ্ট থাকে। এভাবে তাদের স্বভাবে জুলুম ও অজ্ঞতা নিহিত থাকলেও কার্যত তারা জ্ঞানী ও ন্যায়-নিষ্ঠ হয়ে যায় এবং আমানতের যে ভার তারা বহন করেছিল তা রক্ষা করতে সক্ষম হয়।
মুনাফিকের আলামতসমূহ
হাদীছ নং : ১৯৯
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, মুনাফিকের আলামত তিনটি যখন কথা বলে মিথ্যা বলে; যখন ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করে এবং যখন তাদের কাছে আমানত রাখা হয় তাতে খেয়ানত করে -বুখারী ও মুসলিম।
অপর এক বর্ণনায় আছে, যদিও সে রোযা রাখে ও নামায পড়ে এবং মনে করে সে একজন মুসলিম।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৩৩; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৫৯; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৬৩১; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৫০২১: মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৮৬৭০; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ৩৫)
হাদীছ নং : ১৯৯
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, মুনাফিকের আলামত তিনটি যখন কথা বলে মিথ্যা বলে; যখন ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করে এবং যখন তাদের কাছে আমানত রাখা হয় তাতে খেয়ানত করে -বুখারী ও মুসলিম।
অপর এক বর্ণনায় আছে, যদিও সে রোযা রাখে ও নামায পড়ে এবং মনে করে সে একজন মুসলিম।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৩৩; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৫৯; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৬৩১; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৫০২১: মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৮৬৭০; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ৩৫)
25 - باب الأمر بأداء الأمانة
قَالَ الله تَعَالَى: {إِنَّ اللهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا} [النساء: 58]، وَقالَ تَعَالَى: {إِنَّا عَرَضْنَا الأَمَانَةَ عَلَى السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ وَالْجِبَالِ فَأَبَيْنَ أَنْ يَحْمِلْنَهَا وَأَشْفَقْنَ مِنْهَا وَحَمَلَهَا الإنْسَانُ إِنَّهُ كَانَ ظَلُومًا جَهُولًا} [الأحزاب: 72].
قَالَ الله تَعَالَى: {إِنَّ اللهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا} [النساء: 58]، وَقالَ تَعَالَى: {إِنَّا عَرَضْنَا الأَمَانَةَ عَلَى السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ وَالْجِبَالِ فَأَبَيْنَ أَنْ يَحْمِلْنَهَا وَأَشْفَقْنَ مِنْهَا وَحَمَلَهَا الإنْسَانُ إِنَّهُ كَانَ ظَلُومًا جَهُولًا} [الأحزاب: 72].
199 - وعن أَبي هريرة - رضي الله عنه: أن رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «آيةُ (1) المُنافقِ ثلاثٌ: إِذَا حَدَّثَ كَذَبَ، وَإِذَا وَعدَ أخْلَفَ (2)، وَإِذَا اؤْتُمِنَ خَانَ». مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (3)
وفي رواية (4): «وَإِنْ صَامَ وَصَلَّى وَزَعَمَ أنَّهُ مُسْلِمٌ».
وفي رواية (4): «وَإِنْ صَامَ وَصَلَّى وَزَعَمَ أنَّهُ مُسْلِمٌ».
হাদীসের ব্যাখ্যা:
অপর এক হাদীছে আছে, মুনাফিকের আলামত চারটি। ইরশাদ হয়েছে-
أربع من كن فيه كان منافقا خالصا، ومن كانت فيه خصلة منهن كانت فيه خصلة من النفاق حتى يدعها : إذا اؤتمن خان، وإذا حدث كذب، وإذا عاهد غدر، وإذا خاصم فجر
চারটি বিষয় যে ব্যক্তির মধ্যে থাকবে সে একজন খাঁটি মুনাফিক সাব্যস্ত হবে। যার মধ্যে তা থেকে একটি থাকবে তার মধ্যে মুনাফিকীরই একটা খাসলত থাকবে, যাবৎ না সে তা ছেড়ে দেয়। তা হচ্ছে- তার কাছে যখন আমানত রাখা হয় খেয়ানত করে, যখন কথা বলে মিথ্যা বলে, যখন প্রতিশ্রুতি দেয় তা ভঙ্গ করে আর যখন কলহ বিবাদ করে তখন সীমালঙ্ঘন করে। (সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৩৪; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৫৮; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৬৮৮; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৬৩২; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ২৫৪)
ইমাম ইব্ন হাজার আসকালানী রহ. বলেন, উভয় হাদীছের মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। কেননা এই হাদীছে তিনটি আলামত উল্লেখ করার দ্বারা এ কথা প্রমাণ হয় না যে, অপর হাদীছে বর্ণিত চতুর্থটি আলামত নয়। মূল কথা হচ্ছে সবগুলোই মুনাফিকের আলামত, তবে সময় অনুপাতে একেকবার একেক ধরনের আলামত উল্লেখ করা হয়েছে।
মুনাফিকের প্রথম আলামত
এ হাদীছে বর্ণিত তিনটি আলামতের প্রথমটি হচ্ছে- إذا حدث كذب (যখন কথা বলে, মিথ্যা বলে)। এর দ্বারা মিথ্যা কথা কত গুরুতর পাপ তা অনুমান করা যায়। কেননা প্রকৃত মুনাফিক হচ্ছে একজন সুবিধাবাদী কাফের। সে অন্তরে তার কুফর ও বেঈমানী গোপন রাখে আর বিভিন্ন স্বার্থ ও সুবিধাভোগের খাতিরে নিজেকে মুসলিম বলে জাহির করে। তার সবচে' বড় মিথ্যাচার হচ্ছে কাফের হয়েও নিজেকে মু'মিন ও মুসলিম বলে প্রকাশ করা। এত বড় বিষয়েও যখন সে মিথ্যা বলতে দ্বিধাবোধ করে না, তখন অন্যান্য ক্ষেত্রে তার মিথ্যা বলাটা তো খুবই স্বাভাবিক।
মোটকথা মিথ্যা বলাটা মুনাফিকের স্বভাব। কাজেই একজন মুসলিম ব্যক্তির কোনওক্রমেই মিথ্যা বলা উচিত নয়। যদি কখনও সে মিথ্যা কথা বলে ফেলে, তবে তার নিজ ঈমানের ব্যাপারে চিন্তা করা উচিত যে, তার ঈমান আসলে কোন্ স্তরে আছে।
একবার হযরত আব্দুল্লাহ ইব্ন জারাদ রাযি. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ইয়া নাবিয়্যাল্লাহ! মু'মিন কি ব্যভিচার করতে পারে? তিনি বললেন, হাঁ, কখনও তার দ্বারা এটা ঘটে যেতে পারে। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, মু'মিন কি চুরি করতে পারে? তিনি বললেন, হাঁ, এটাও তার দ্বারা কখনও ঘটে যেতে পারে। তাঁর শেষ প্রশ্ন ছিল-
يا نبي الله ! هل يكذب المؤمن؟ قال: «لا». ثم أتبعها رسول الله ﷺ ، فقال لهذه الكلمة إنما يفتري الكذب الذين لا يؤمنون بآيات الله وأولئك هم الكاذبون
‘ইয়া নাবিয়্যাল্লাহ! মু'মিন কি মিথ্যা বলতে পারে? তিনি বললেন, না। এই বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম আয়াত পাঠ করলেনঃ-
إِنَّمَا يَفْتَرِي الْكَذِبَ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِآيَاتِ اللَّهِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْكَاذِبُونَ
[আল্লাহর প্রতি অপবাদ আরোপ তো (নবী নয়, বরং) তারাই করে, যারা আল্লাহর আয়াতের ওপর ঈমান রাখে না। প্রকৃতপক্ষে তারাই মিথ্যাবাদী]। (সূরা নাহল (১৬), আয়াত ১০৫) (আল-খারাইতী, মাসাবিউল আখলাক, হাদীছ নং ১২৭)
মুনাফিকের দ্বিতীয় আলামত
মুনাফিকের দ্বিতীয় আলামত হল- إذا وعد أخلف (যখন ওয়াদা করে, তা ভঙ্গ করে)। মু'মিন ব্যক্তি ওয়াদা রক্ষাকারী হয়ে থাকে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছেঃ-
وَالْمُوفُونَ بِعَهْدِهِمْ إِذَا عَاهَدُوا
“এবং যারা কোনও প্রতিশ্রুতি দিলে তা পূরণে যত্নবান থাকে। (সূরা বাকারা (২), আয়াত ১৭৭)
ওয়াদাভঙ্গ কথা দ্বারাও হতে পারে, কাজ দ্বারাও হতে পারে। উভয়টিই মুনাফিকের আলামত। তবে এটা মুনাফিকের আলামত হবে তখনই, যখন ওয়াদা দেওয়ার সময়ই মনে মনে তা রক্ষা করার নিয়ত না থাকে। পক্ষান্তরে যদি রক্ষা করার নিয়ত থাকে কিন্তু বাস্তবিক কোনও ওযরবশত সে তা রক্ষা করতে না পারে, তবে তা মুনাফিকের আলামতরূপে গণ্য হবে না।
মুনাফিকের তৃতীয় আলামত
মুনাফিকের তৃতীয় আলামত হচ্ছে- إذا اؤتمن خان (যখন তার কাছে আমানত রাখা হয়, সে তাতে খেয়ানত করে)। আমানত রক্ষা করা মু'মিন ব্যক্তির এক অপরিহার্য গুণ। আল্লাহ তা'আলা মু'মিনের পরিচয় দিতে গিয়ে যেসকল গুণের উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে এটিও একটি। ইরশাদ হয়েছেঃ-
وَالَّذِينَ هُمْ لِأَمَانَاتِهِمْ وَعَهْدِهِمْ رَاعُونَ
“এবং যারা তাদের আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে। (সূরা মা'আরিজ (৭০), আয়াত ৩২)
যেহেতু আমানত রক্ষা মু'মিনের অপরিহার্য গুণ, তাই আমানতের খেয়ানত করতে কঠিনভাবে নিষেধ করা হয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছেঃ-
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَخُونُوا اللَّهَ وَالرَّسُولَ وَتَخُونُوا أَمَانَاتِكُمْ وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ
“হে মুমিনগণ! আল্লাহ ও রাসূলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করো না এবং জেনেশুনে নিজেদের আমানতের খেয়ানত করো না। (সূরা আনফাল (৮), আয়াত ২৭)
এতে সম্বোধন করা হয়েছে 'মুমিন' বলে। অর্থাৎ খেয়ানত করা মু'মিনের কাজ হতে পারে না। আর আলোচ্য হাদীছ দ্বারা জানা গেল এটা মুনাফিকের আলামত।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের যমানার মুনাফিকদের মধ্যে এ সবগুলো আলামত বিদ্যমান ছিল। কোনও মু'মিন-মুসলিম কখনও মিথ্যা বলত না,আমানতের খেয়ানত করত না এবং ওয়াদাখেলাপিও করত না। এগুলো করত কেবল মুনাফিকরাই। যারা এগুলো করত, বোঝা যেত প্রকৃতপক্ষে তারা মুনাফিক। মুখে যে ঈমান ও ইসলামের কথা বলছে তা কেবলই ধোঁকা।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন এগুলোকে মুনাফিকের আলামত সাব্যস্ত করেছেন, তখন সব যুগের মুনাফিকদের মধ্যেই এগুলো অবশ্যই পাওয়া যাবে। তবে যাদের মধ্যেই এসব চরিত্র দেখা যাবে তাদেরকেই যে মুনাফিক ও বেঈমান সাব্যস্ত করা যাবে, বিষয়টি এমন নয়। কেননা কালপরিক্রমায় মুমিন-মুসলিমদেরও অনেক আখলাকী অধঃপতন ঘটেছে। যেসব খাসলাত কেবল মুনাফিক ও বেঈমানদের মধ্যেই পাওয়া যেত, এখন তার অনেক কিছু মুসলিমদের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে। যেমন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের যমানায় খাঁটি মুমিনগণ সকলেই জামাতে নামায পড়ত। জামাত ছাড়ত কেবল মুনাফিকগণ। কিন্তু এখন কেবল মুনাফিক নয়; মুমিনদেরও অধিকাংশ লোক জামাতে নামায পড়ছে না।
মুনাফিকদের এ আলামতটি এখন মুসলমানদের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তাই বলে তারাও যে মুনাফিক, এমন নয়। হাদীছে যে কারও মধ্যে এ সবগুলো পাওয়া গেলে তাকে খালেস মুনাফিক বলা হয়েছে তা সেই যমানার কথা। বর্তমানকালে এটা সাধারণভাবে প্রযোজ্য হবে না, যেহেতু মুসলিমগণদের মধ্যেও ব্যাপকভাবে এসব পাওয়া যাচ্ছে। তবে হাঁ, এতে কোনও সন্দেহ নেই যে, যাদের মধ্যে এসব দোষ পাওয়া যাবে তারা মুনাফিক না হলেও পূর্ণাঙ্গ মু'মিনও নয়। তারা ত্রুটিযুক্ত ঈমানওয়ালা। তাই তাদের কর্তব্য পূর্ণাঙ্গ মু'মিন হওয়ার জন্য এসব খাসলাত ছেড়ে দেওয়া এবং এর বিপরীত গুণাবলী তথা আমানত রক্ষা করা, সত্য কথা বলা ও ওয়াদা রক্ষা করার গুণ পরিপূর্ণরূপে অর্জন করা।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা ইসলামে আখলাক-চরিত্র কত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তা অনুমান করা যায়।
খ. হাদীছে যে তিনটি বিষয়কে মুনাফিকের আলামত বলা হয়েছে, প্রত্যেক মু'মিনের উচিত সর্বপ্রযত্নে তা থেকে বেঁচে থাকা।
গ. নামায, রোযা ইত্যাদি ফরযগুলো নিঃসন্দেহে অবশ্যপালনীয়। কিন্তু এগুলো আদায় করেই ক্ষান্ত হয়ে যাওয়া উচিত নয়; নিজের ভেতর থেকে অসচ্চরিত্র দূর করে সচ্চরিত্র অর্জনেরও চেষ্টা করা উচিত।
أربع من كن فيه كان منافقا خالصا، ومن كانت فيه خصلة منهن كانت فيه خصلة من النفاق حتى يدعها : إذا اؤتمن خان، وإذا حدث كذب، وإذا عاهد غدر، وإذا خاصم فجر
চারটি বিষয় যে ব্যক্তির মধ্যে থাকবে সে একজন খাঁটি মুনাফিক সাব্যস্ত হবে। যার মধ্যে তা থেকে একটি থাকবে তার মধ্যে মুনাফিকীরই একটা খাসলত থাকবে, যাবৎ না সে তা ছেড়ে দেয়। তা হচ্ছে- তার কাছে যখন আমানত রাখা হয় খেয়ানত করে, যখন কথা বলে মিথ্যা বলে, যখন প্রতিশ্রুতি দেয় তা ভঙ্গ করে আর যখন কলহ বিবাদ করে তখন সীমালঙ্ঘন করে। (সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৩৪; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৫৮; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৬৮৮; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৬৩২; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ২৫৪)
ইমাম ইব্ন হাজার আসকালানী রহ. বলেন, উভয় হাদীছের মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। কেননা এই হাদীছে তিনটি আলামত উল্লেখ করার দ্বারা এ কথা প্রমাণ হয় না যে, অপর হাদীছে বর্ণিত চতুর্থটি আলামত নয়। মূল কথা হচ্ছে সবগুলোই মুনাফিকের আলামত, তবে সময় অনুপাতে একেকবার একেক ধরনের আলামত উল্লেখ করা হয়েছে।
মুনাফিকের প্রথম আলামত
এ হাদীছে বর্ণিত তিনটি আলামতের প্রথমটি হচ্ছে- إذا حدث كذب (যখন কথা বলে, মিথ্যা বলে)। এর দ্বারা মিথ্যা কথা কত গুরুতর পাপ তা অনুমান করা যায়। কেননা প্রকৃত মুনাফিক হচ্ছে একজন সুবিধাবাদী কাফের। সে অন্তরে তার কুফর ও বেঈমানী গোপন রাখে আর বিভিন্ন স্বার্থ ও সুবিধাভোগের খাতিরে নিজেকে মুসলিম বলে জাহির করে। তার সবচে' বড় মিথ্যাচার হচ্ছে কাফের হয়েও নিজেকে মু'মিন ও মুসলিম বলে প্রকাশ করা। এত বড় বিষয়েও যখন সে মিথ্যা বলতে দ্বিধাবোধ করে না, তখন অন্যান্য ক্ষেত্রে তার মিথ্যা বলাটা তো খুবই স্বাভাবিক।
মোটকথা মিথ্যা বলাটা মুনাফিকের স্বভাব। কাজেই একজন মুসলিম ব্যক্তির কোনওক্রমেই মিথ্যা বলা উচিত নয়। যদি কখনও সে মিথ্যা কথা বলে ফেলে, তবে তার নিজ ঈমানের ব্যাপারে চিন্তা করা উচিত যে, তার ঈমান আসলে কোন্ স্তরে আছে।
একবার হযরত আব্দুল্লাহ ইব্ন জারাদ রাযি. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ইয়া নাবিয়্যাল্লাহ! মু'মিন কি ব্যভিচার করতে পারে? তিনি বললেন, হাঁ, কখনও তার দ্বারা এটা ঘটে যেতে পারে। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, মু'মিন কি চুরি করতে পারে? তিনি বললেন, হাঁ, এটাও তার দ্বারা কখনও ঘটে যেতে পারে। তাঁর শেষ প্রশ্ন ছিল-
يا نبي الله ! هل يكذب المؤمن؟ قال: «لا». ثم أتبعها رسول الله ﷺ ، فقال لهذه الكلمة إنما يفتري الكذب الذين لا يؤمنون بآيات الله وأولئك هم الكاذبون
‘ইয়া নাবিয়্যাল্লাহ! মু'মিন কি মিথ্যা বলতে পারে? তিনি বললেন, না। এই বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম আয়াত পাঠ করলেনঃ-
إِنَّمَا يَفْتَرِي الْكَذِبَ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِآيَاتِ اللَّهِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْكَاذِبُونَ
[আল্লাহর প্রতি অপবাদ আরোপ তো (নবী নয়, বরং) তারাই করে, যারা আল্লাহর আয়াতের ওপর ঈমান রাখে না। প্রকৃতপক্ষে তারাই মিথ্যাবাদী]। (সূরা নাহল (১৬), আয়াত ১০৫) (আল-খারাইতী, মাসাবিউল আখলাক, হাদীছ নং ১২৭)
মুনাফিকের দ্বিতীয় আলামত
মুনাফিকের দ্বিতীয় আলামত হল- إذا وعد أخلف (যখন ওয়াদা করে, তা ভঙ্গ করে)। মু'মিন ব্যক্তি ওয়াদা রক্ষাকারী হয়ে থাকে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছেঃ-
وَالْمُوفُونَ بِعَهْدِهِمْ إِذَا عَاهَدُوا
“এবং যারা কোনও প্রতিশ্রুতি দিলে তা পূরণে যত্নবান থাকে। (সূরা বাকারা (২), আয়াত ১৭৭)
ওয়াদাভঙ্গ কথা দ্বারাও হতে পারে, কাজ দ্বারাও হতে পারে। উভয়টিই মুনাফিকের আলামত। তবে এটা মুনাফিকের আলামত হবে তখনই, যখন ওয়াদা দেওয়ার সময়ই মনে মনে তা রক্ষা করার নিয়ত না থাকে। পক্ষান্তরে যদি রক্ষা করার নিয়ত থাকে কিন্তু বাস্তবিক কোনও ওযরবশত সে তা রক্ষা করতে না পারে, তবে তা মুনাফিকের আলামতরূপে গণ্য হবে না।
মুনাফিকের তৃতীয় আলামত
মুনাফিকের তৃতীয় আলামত হচ্ছে- إذا اؤتمن خان (যখন তার কাছে আমানত রাখা হয়, সে তাতে খেয়ানত করে)। আমানত রক্ষা করা মু'মিন ব্যক্তির এক অপরিহার্য গুণ। আল্লাহ তা'আলা মু'মিনের পরিচয় দিতে গিয়ে যেসকল গুণের উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে এটিও একটি। ইরশাদ হয়েছেঃ-
وَالَّذِينَ هُمْ لِأَمَانَاتِهِمْ وَعَهْدِهِمْ رَاعُونَ
“এবং যারা তাদের আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে। (সূরা মা'আরিজ (৭০), আয়াত ৩২)
যেহেতু আমানত রক্ষা মু'মিনের অপরিহার্য গুণ, তাই আমানতের খেয়ানত করতে কঠিনভাবে নিষেধ করা হয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছেঃ-
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَخُونُوا اللَّهَ وَالرَّسُولَ وَتَخُونُوا أَمَانَاتِكُمْ وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ
“হে মুমিনগণ! আল্লাহ ও রাসূলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করো না এবং জেনেশুনে নিজেদের আমানতের খেয়ানত করো না। (সূরা আনফাল (৮), আয়াত ২৭)
এতে সম্বোধন করা হয়েছে 'মুমিন' বলে। অর্থাৎ খেয়ানত করা মু'মিনের কাজ হতে পারে না। আর আলোচ্য হাদীছ দ্বারা জানা গেল এটা মুনাফিকের আলামত।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের যমানার মুনাফিকদের মধ্যে এ সবগুলো আলামত বিদ্যমান ছিল। কোনও মু'মিন-মুসলিম কখনও মিথ্যা বলত না,আমানতের খেয়ানত করত না এবং ওয়াদাখেলাপিও করত না। এগুলো করত কেবল মুনাফিকরাই। যারা এগুলো করত, বোঝা যেত প্রকৃতপক্ষে তারা মুনাফিক। মুখে যে ঈমান ও ইসলামের কথা বলছে তা কেবলই ধোঁকা।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন এগুলোকে মুনাফিকের আলামত সাব্যস্ত করেছেন, তখন সব যুগের মুনাফিকদের মধ্যেই এগুলো অবশ্যই পাওয়া যাবে। তবে যাদের মধ্যেই এসব চরিত্র দেখা যাবে তাদেরকেই যে মুনাফিক ও বেঈমান সাব্যস্ত করা যাবে, বিষয়টি এমন নয়। কেননা কালপরিক্রমায় মুমিন-মুসলিমদেরও অনেক আখলাকী অধঃপতন ঘটেছে। যেসব খাসলাত কেবল মুনাফিক ও বেঈমানদের মধ্যেই পাওয়া যেত, এখন তার অনেক কিছু মুসলিমদের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে। যেমন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের যমানায় খাঁটি মুমিনগণ সকলেই জামাতে নামায পড়ত। জামাত ছাড়ত কেবল মুনাফিকগণ। কিন্তু এখন কেবল মুনাফিক নয়; মুমিনদেরও অধিকাংশ লোক জামাতে নামায পড়ছে না।
মুনাফিকদের এ আলামতটি এখন মুসলমানদের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তাই বলে তারাও যে মুনাফিক, এমন নয়। হাদীছে যে কারও মধ্যে এ সবগুলো পাওয়া গেলে তাকে খালেস মুনাফিক বলা হয়েছে তা সেই যমানার কথা। বর্তমানকালে এটা সাধারণভাবে প্রযোজ্য হবে না, যেহেতু মুসলিমগণদের মধ্যেও ব্যাপকভাবে এসব পাওয়া যাচ্ছে। তবে হাঁ, এতে কোনও সন্দেহ নেই যে, যাদের মধ্যে এসব দোষ পাওয়া যাবে তারা মুনাফিক না হলেও পূর্ণাঙ্গ মু'মিনও নয়। তারা ত্রুটিযুক্ত ঈমানওয়ালা। তাই তাদের কর্তব্য পূর্ণাঙ্গ মু'মিন হওয়ার জন্য এসব খাসলাত ছেড়ে দেওয়া এবং এর বিপরীত গুণাবলী তথা আমানত রক্ষা করা, সত্য কথা বলা ও ওয়াদা রক্ষা করার গুণ পরিপূর্ণরূপে অর্জন করা।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা ইসলামে আখলাক-চরিত্র কত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তা অনুমান করা যায়।
খ. হাদীছে যে তিনটি বিষয়কে মুনাফিকের আলামত বলা হয়েছে, প্রত্যেক মু'মিনের উচিত সর্বপ্রযত্নে তা থেকে বেঁচে থাকা।
গ. নামায, রোযা ইত্যাদি ফরযগুলো নিঃসন্দেহে অবশ্যপালনীয়। কিন্তু এগুলো আদায় করেই ক্ষান্ত হয়ে যাওয়া উচিত নয়; নিজের ভেতর থেকে অসচ্চরিত্র দূর করে সচ্চরিত্র অর্জনেরও চেষ্টা করা উচিত।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
