রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
ভূমিকা অধ্যায়
হাদীস নং: ২০০
আমানত আদায় প্রসঙ্গ।
পর্যায়ক্রমে আমানত উঠে যাওয়া
হাদীছ নং : ২০০
হযরত হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে দু'টি কথা বলেছেন। তার একটি আমি দেখতে পেয়েছি আর অন্যটির অপেক্ষা করছি। তিনি আমাদেরকে বলেন, প্রথমত মানুষের অন্তরের অন্তস্তলে আমানত নাযিল হয়েছে। তারপর কুরআন নাযিল হয়েছে। অতঃপর লোকে কুরআন শিখেছে এবং সুন্নাহ শিখেছে।
তারপর তিনি আমাদেরকে আমানত তুলে নেওয়ার ব্যাপারে বললেন। তিনি বললেন, মানুষ স্বাভাবিকভাবে ঘুমিয়ে পড়বে। এ অবস্থায় তার অন্তর থেকে আমানত তুলে নেওয়া হবে। তারপর তার অন্তরে তার সামান্য ছাপ থেকে যাবে। তারপর সে স্বাভাবিকভাবে ঘুমিয়ে পড়বে। এ অবস্থায় তার অন্তর থেকে (অবশিষ্ট) আমানত তুলে নেওয়া হবে। ফলে তার অন্তরে ফোস্কার মত তার ছাপ থেকে যাবে। যেমন তুমি তোমার পায়ের ওপর আগুনের স্ফুলিঙ্গ গড়িয়ে দিলে, ফলে তাতে ফোস্কা পড়ে গেল। তুমি সেটি ফোলা অবস্থায় দেখতে পাও। কিন্তু তার ভেতর কিছুই থাকে না। – এই বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি করে নিয়ে সেটি নিজ পায়ের ওপর গড়িয়ে দিলেন। তারপর মানুষ সকালবেলা বেচাকেনা করবে, কিন্তু কেউ বলতে গেলে আমানত প্রায় আদায়ই করবে না। এমনকি বলা হবে, অমুক গোত্রে একজন আমানতদার লোক আছে। এমনকি একেকজন লোক সম্পর্কে বলা হবে, সে কতই না হুঁশিয়ার, কতই না চালাক এবং কতই না বুদ্ধিমান। অথচ তার অন্তরে সরিষার দানা পরিমাণও ঈমান থাকবে না।
(হযরত হুযায়ফা রাযি. বলেন,) আমার ওপর দিয়ে এমন একটা সময় অতিবাহিত হয়েছে, যখন আমি তোমাদের মধ্যে কার সাথে বেচাকেনা করেছি তা নিয়ে কোনও চিন্তাই করতাম না। কেননা সে মুসলিম হলে তার দীন তাকে দিয়ে আমার পাওনা আদায় করিয়ে দেবে, আর সে খ্রিষ্টান বা ইয়াহুদী হলে তার ওপর দায়িত্বশীল ব্যক্তি আমার প্রাপ্য আদায় করিয়ে দেবে। অথচ আজকের অবস্থা হচ্ছে এই যে, তোমাদের মধ্য থেকে অমুক অমুক ছাড়া অন্য কারও সাথে আমি বেচাকেনা করব না -বুখারী ও মুসলিম।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬৪৯৭, ৭০৮৬, ২৭৭৬; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৪৩; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২১৭৯; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৪০৫২: বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান, হাদীছ নং ৪৮৯০; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ৪২১৭)
হাদীছ নং : ২০০
হযরত হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে দু'টি কথা বলেছেন। তার একটি আমি দেখতে পেয়েছি আর অন্যটির অপেক্ষা করছি। তিনি আমাদেরকে বলেন, প্রথমত মানুষের অন্তরের অন্তস্তলে আমানত নাযিল হয়েছে। তারপর কুরআন নাযিল হয়েছে। অতঃপর লোকে কুরআন শিখেছে এবং সুন্নাহ শিখেছে।
তারপর তিনি আমাদেরকে আমানত তুলে নেওয়ার ব্যাপারে বললেন। তিনি বললেন, মানুষ স্বাভাবিকভাবে ঘুমিয়ে পড়বে। এ অবস্থায় তার অন্তর থেকে আমানত তুলে নেওয়া হবে। তারপর তার অন্তরে তার সামান্য ছাপ থেকে যাবে। তারপর সে স্বাভাবিকভাবে ঘুমিয়ে পড়বে। এ অবস্থায় তার অন্তর থেকে (অবশিষ্ট) আমানত তুলে নেওয়া হবে। ফলে তার অন্তরে ফোস্কার মত তার ছাপ থেকে যাবে। যেমন তুমি তোমার পায়ের ওপর আগুনের স্ফুলিঙ্গ গড়িয়ে দিলে, ফলে তাতে ফোস্কা পড়ে গেল। তুমি সেটি ফোলা অবস্থায় দেখতে পাও। কিন্তু তার ভেতর কিছুই থাকে না। – এই বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি করে নিয়ে সেটি নিজ পায়ের ওপর গড়িয়ে দিলেন। তারপর মানুষ সকালবেলা বেচাকেনা করবে, কিন্তু কেউ বলতে গেলে আমানত প্রায় আদায়ই করবে না। এমনকি বলা হবে, অমুক গোত্রে একজন আমানতদার লোক আছে। এমনকি একেকজন লোক সম্পর্কে বলা হবে, সে কতই না হুঁশিয়ার, কতই না চালাক এবং কতই না বুদ্ধিমান। অথচ তার অন্তরে সরিষার দানা পরিমাণও ঈমান থাকবে না।
(হযরত হুযায়ফা রাযি. বলেন,) আমার ওপর দিয়ে এমন একটা সময় অতিবাহিত হয়েছে, যখন আমি তোমাদের মধ্যে কার সাথে বেচাকেনা করেছি তা নিয়ে কোনও চিন্তাই করতাম না। কেননা সে মুসলিম হলে তার দীন তাকে দিয়ে আমার পাওনা আদায় করিয়ে দেবে, আর সে খ্রিষ্টান বা ইয়াহুদী হলে তার ওপর দায়িত্বশীল ব্যক্তি আমার প্রাপ্য আদায় করিয়ে দেবে। অথচ আজকের অবস্থা হচ্ছে এই যে, তোমাদের মধ্য থেকে অমুক অমুক ছাড়া অন্য কারও সাথে আমি বেচাকেনা করব না -বুখারী ও মুসলিম।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬৪৯৭, ৭০৮৬, ২৭৭৬; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৪৩; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২১৭৯; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৪০৫২: বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান, হাদীছ নং ৪৮৯০; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ৪২১৭)
25 - باب الأمر بأداء الأمانة
200 - وعن حذيفة بن اليمان - رضي الله عنه - قَالَ: حدثنا رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - حدِيثَينِ قَدْ رأيْتُ أحَدَهُمَا وأنا أنتظرُ الآخر: حدثنا أن الأمانة نَزلت في جَذرِ قلوبِ الرجال، ثُمَّ نزل القرآن فعلموا مِنَ القرآن، وعلِموا من السنةِ، ثُمَّ حدّثنا عن رفع الأمانة، فَقَالَ: «يَنَامُ الرَّجُلُ النَّوْمَةَ فَتُقْبَضُ الأَمَانَةُ مِنْ قَلْبهِ، فَيَظَلُّ أثَرُهَا مِثلَ الوَكْتِ، ثُمَّ يَنَامُ النَّومَةَ فَتُقْبَضُ الأَمَانَةُ مِنْ قَلْبهِ، فَيَظَلُّ أثَرُهَا مِثلَ أَثَرِ المَجْلِ، كَجَمْرٍ دَحْرَجْتَهُ عَلَى رِجْلِكَ فَنَفِطَ، فَتَرَاهُ مُنْتَبرًا وَلَيسَ فِيهِ شَيءٌ». ثُمَّ أخَذَ حَصَاةً فَدَحْرَجَهُ عَلَى رِجْلِهِ «فَيُصْبحُ النَّاسُ يَتَبَايعُونَ، فَلا يَكَادُ أحدٌ يُؤَدّي الأَمَانَةَ حَتَّى يُقَالَ: إنَّ في بَني فُلان رَجُلًا أمينًا، حَتَّى يُقَالَ لِلرَّجُلِ: مَا أجْلَدَهُ! مَا أَظْرَفَهُ! مَا أعْقَلَهُ! وَمَا في قَلْبِهِ مِثْقَالُ حَبَّة مِن خَرْدَل مِنْ إيمَان». وَلَقدْ أتَى عَلَيَّ زَمَانٌ وَمَا أُبَالِي أيُّكُمْ بَايَعْتُ: لَئن كَانَ مُسْلِمًا لَيَرُدَّنَّهُ عليَّ دِينهُ، وَإنْ كَانَ نَصْرانِيًّا أَوْ يَهُودِيًا لَيَرُدَّنَّهُ عَلَيَّ سَاعِيهِ، وَأَمَّا اليَوْمَ فَمَا كُنْتُ أُبَايعُ مِنْكُمْ إلاَّ فُلانًا وَفُلانًا (1)». مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (2) [ص:88]
قوله: «جَذْرُ» بفتح الجيم وإسكان الذال المعجمة: وَهُوَ أصل الشيء
وَ «الوكت» بالتاء المثناة من فوق: الأثر اليسير. وَ «المَجْلُ» بفتح الميم وإسكان الجيم: وَهُوَ تَنَفُّطٌ في اليدِ ونحوها من أثرِ عمل وغيرِهِ. قوله: «مُنْتَبرًا»: مرتفِعًا. قوله: «ساعِيهِ»: الوالي عَلَيهِ.
قوله: «جَذْرُ» بفتح الجيم وإسكان الذال المعجمة: وَهُوَ أصل الشيء
وَ «الوكت» بالتاء المثناة من فوق: الأثر اليسير. وَ «المَجْلُ» بفتح الميم وإسكان الجيم: وَهُوَ تَنَفُّطٌ في اليدِ ونحوها من أثرِ عمل وغيرِهِ. قوله: «مُنْتَبرًا»: مرتفِعًا. قوله: «ساعِيهِ»: الوالي عَلَيهِ.
হাদীসের ব্যাখ্যা:
হযরত হুযায়ফা রাযি. নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বহু হাদীছ বর্ণনা করেছেন এবং নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবীগণের সামনে দীন সম্পর্কিত বহু কথা বলেছেন। তার মধ্য থেকে হযরত হুযায়ফা রাযি. এখানে বিশেষ দু'টি হাদীছ সম্পর্কে বলছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ দু'টি আমাদেরকে বলেছেন। হাদীছদু'টিতে বর্ণিত বিষয়বস্তুর গুরুত্ব বিচারে তিনি আলাদাভাবে এর উল্লেখ করেছেন। হাদীছদু'টির একটি হচ্ছে মানুষের অন্তরে আমানত নাযিল হওয়া সম্পর্কিত এবং অন্যটি অন্তর থেকে আমানত তুলে নেওয়া সম্পর্কিত।
মানবস্বভাবে আমানতদারীর গুণ বিদ্যমান থাকা
বলা হয়েছে- الأمانة نزلت في جذر قلوب الرجال মানুষের অন্তরের অন্তস্তলে আমানত নাযিল হয়েছে'। جذر শব্দটি দ্বারা প্রতিটি জিনিসের মূল ও গোড়া বোঝানো হয়ে থাকে। অন্তরের মূল ও গোড়া বা অন্তস্তল বলে মূলত অন্তরই বোঝানো হয়ে থাকে। কেবল তাকিদ ও গুরুত্বারোপের জন্যই অন্তরের সাথে মূল, তল ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করা হয়। সুতরাং অন্তস্তলে আমানত নাযিল হয়েছে বলে বোঝানো হচ্ছে এ গুণটি বাহ্যিক বা ভাসাভাসা কোনও ব্যাপার নয়; বরং এটা মানুষের অন্তর ও স্বভাবের মধ্যে নিহিত থাকে। এ হাদীছ দ্বারা বোঝা গেল সব মানুষের অন্তরেই আমানতের গুণটি নিহিত রাখা হয়েছে। কেউ এ গুণ অনুযায়ী কাজ করে এবং কেউ করে না। যারা এ গুণ অনুযায়ী কাজ করে না তথা অব্যাহতভাবে আমানতের খেয়ানত করতে থাকে, তাদের স্বভাবগত এ গুণটি নিস্তেজ হয়ে পড়ে। ফলে খেয়ানত করাই তাদের অভ্যাস হয়ে যায়।
এ হাদীছে বর্ণিত আমানত মূলত ওই আমানতই, যা আয়াত –
إِنَّا عَرَضْنَا الْأَمَانَةَ عَلَى السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَالْجِبَالِ
এর মধ্যে বর্ণিত হয়েছে। এ আমানত ব্যাপক অর্থে ঈমানেরই সমার্থবোধক। বোঝা গেল ঈমানও স্বভাবগতভাবে সমস্ত মানুষের অন্তরে নিহিত থাকে। সুতরাং এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
كل مولود يولد على الفطرة، وأبواه يهودانه، وينصرانه، ويمجسانه
‘সব শিশুই স্বভাবধর্ম (ইসলাম)-এর ওপর জন্ম নেয় এবং তার পিতামাতা তাকে ইয়াহুদী, নাসারা বা অগ্নিপূজারী বানায়। (সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ১৩৫৮; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৬৫৮; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৭১৪; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২১৩৮; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৮৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৭১৮২; মুসনাদুল হুমায়দী, হাদীছ নং ১১৪৫)
স্বভাবের ভেতর নিহিত সেই ঈমান যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে প্রকাশ্যে স্বীকার করে নেয় সে-ই মু'মিন, আর যে ব্যক্তি তা স্বীকার করে না সে মু'মিন নয়। তো আলোচ্য হাদীছে যে অন্তস্তলে আমানত নাযিলের কথা বলা হয়েছে তা মূলত স্বভাবগত ওই ঈমানই। মানুষের পারস্পরিক আমানতসমূহ তারই শাখা-প্রশাখা।
অতঃপর এ হাদীছে বলা হয়েছে ‘তারপর কুরআন নাযিল হয়েছে এবং লোকে সে কুরআন শিখেছে এবং সুন্নাহ শিখেছে। অর্থাৎ স্বভাবগতভাবে আমানতের বোধ-অনুভব অর্জিত হওয়ার পর মানুষ কুরআন সুন্নাহ দ্বারাও আমানত সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জন করে নিল। যেমন, কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াতে এবং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিভিন্ন হাদীছে আমানতের যে গুরুত্ব ও ফযীলত বর্ণিত হয়েছে, তা মানুষ জানতে পেরেছে। সারকথা, যে আমানত ছিল মানুষের স্বভাবগত, তা মানুষ কুরআন-সুন্নাহ দ্বারা স্বেচ্ছায় অর্জন করতেও সক্ষম হয়েছে।
পর্যায়ক্রমে আমানতদারী উঠে যাওয়া
এই গেল আমানত সম্পর্কিত দুই হাদীছের প্রথমটি, যাতে মানুষের আমানত অর্জিত হওয়ার কথা বর্ণিত হয়েছে। তারপর আসছে দ্বিতীয় হাদীছ। এর বিষয়বস্তু হচ্ছে আমানত উঠিয়ে নেওয়া। এতে দুই স্তরে পর্যায়ক্রমে অন্তর থেকে আমানত লোপ করে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
প্রথম পর্যায়ে আমানতের গুণ খানিকটা তুলে নেওয়া হলে অন্তরে একটা কালো দাগ পড়ে। দ্বিতীয় পর্যায়ে বাকিটাও তুলে নেওয়া হয়, তাতে একটা ফোস্কার মত পড়ে। তারপর সকালবেলা যখন ঘুম ভাঙে, তখন তার অন্তরে আমানতের কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। এ অবস্থায় যখন লোকজন বেচাকেনা করে, তখন বলতে গেলে কেউই আমানতদারীর পরিচয় দেয় না।
প্রশ্ন হচ্ছে, আমানত উঠে যাওয়ার কারণে যে কালো দাগ পড়ে তা আসলে কী? উলামায়ে কিরাম বলেন, সে কালো দাগ হচ্ছে আমানত ও ঈমানের নূর চলে যাওয়ার ফলে সৃষ্ট অন্ধকার। প্রথমবার যেহেতু আংশিক নূর চলে যায়, তাই হালকা অন্ধকার দেখা দেয়। পরেরবার সম্পূর্ণ নূর চলে যাওয়ায় গভীর অন্ধকার দেখা দেয়, যাকে ফোস্কা শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করা হয়েছে। ফোস্কার ভেতর যেমন কিছু থাকে না, তেমনি ওই গভীর অন্ধকারের মধ্যেও আমানত ও ঈমানের কিছু অবশিষ্ট থাকে না।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিষয়টাকে পরিষ্কার করে দেওয়ার জন্য জ্বলন্ত অঙ্গারের তুলনা দিয়েছেন। পায়ের ওপর অঙ্গার গড়িয়ে দিলে অঙ্গার পড়ে যাওয়ার পরও যেমন ফোস্কা তারপর ফোস্কার দাগ থেকে যায়, তেমনি আমানত চলে যাওয়ার পর অন্তরে গভীর অন্ধকার থেকে যায়। তিনি এটাকে আরও স্পষ্ট করার লক্ষ্যে নিজ পায়ের ওপর একটি কঙ্কর গড়িয়ে দেন।
হাদীছের শেষে বলা হয়েছে- فيصبح الناس يتبايعون فلا يكاد أحد يؤدي الامانة তারপর মানুষ সকালবেলা বেচাকেনা করবে, কিন্তু কেউ বলতে গেলে আমানত প্রায় আদায়ই করবে না। অর্থাৎ মানুষের বেচাকেনা ও লেনদেনে আমানতদারী থাকবে না। আমানতদার লোক প্রায় খুঁজেই পাওয়া যাবে না। তখন মানুষ আমানতদারী অপেক্ষা চালাকি ও চাতুর্যকে প্রাধান্য দেবে। চালাকি করে অন্যকে ঠকাতে পারাকেই কৃতীত্ব মনে করবে। যে যতবেশি ঠক ও ধূর্ত হবে, তাকে ততবেশি কীর্তিমান মনে করা হবে। এই বলে প্রশংসা করা হবে যে- ما أجلده ما أظرفه ما أعقله লোকটি কত চালাক, কত হুঁশিয়ার ও কত বুদ্ধিমান। লোকে তো এভাবে চালাক ও বুদ্ধিমান ব্যক্তির প্রশংসা করবে এবং চালাকি করতে পারাটাকে সে নিজেও তার সফলতা গণ্য করবে। কিন্তু নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই বলে সতর্ক করছেন যে وما في قلبه مثقال حبة من خردل من إيمان অথচ তার অন্তরে সরিষার দানা পরিমাণ ঈমান থাকবে না। এই ঈমানবিহীন চাতুর্য ও চালাকি প্রকৃতপক্ষে বেঈমানী ও ধোঁকাবাজি ছাড়া আর কী? মানুষের ঈমান যখন নিস্তেজ হয়ে যায়, ফলে ঈমানীশক্তি দ্বারা চালিত হতে পারে না, তখন বেঈমানী ও ধোকাবাজির আশ্রয় নিয়ে থাকে। আজ সারা পৃথিবীতে তারই তাণ্ডব লক্ষ করা যাচ্ছে।
হাদীছদু'টি বয়ান করার পর হযরত হুযায়ফা রাযি, তাদের নিজেদের যমানার অর্থাৎ সাহাবায়ে কিরামের যমানার প্রশংসা করে বলেন, তখন কারও সঙ্গে লেনদেন করতে চিন্তাই করতে হত না যে, কার সঙ্গে তা করছি, সে বিশ্বস্ততার পরিচয় দেবে কি না এবং তার কাছে আমার যা প্রাপ্য হয় সে তা সময়মত ঠিক ঠিক আদায় করবে কি না। এ চিন্তা মু'মিনদের ক্ষেত্রে তো করতে হতই না, এমনকি ইয়াহুদী ও নাসারাদের ক্ষেত্রেও করতে হত না। কেননা মু'মিনগণ তো তার ঈমানদারীর কারণেই বিশ্বস্ততার পরিচয় দিত এবং তার দীন ও ঈমানই তাকে বাধ্য করত যাতে অন্যের প্রাপ্য যথাযথভাবে আদায় করে দেয়। আর ইয়াহুদী-নাসারার ক্ষেত্রে চিন্তা করতে হত না এ কারণে যে, তার ওপর তো দায়িত্বশীল অর্থাৎ ন্যায়পরায়ণ শাসক আছে। তার ন্যায়বিচারে তারা ভীত ও সতর্ক থাকত আর সে ভয়ে অন্যের প্রাপ্য পরিশোধে গড়িমসি করত না। যদি কখনও টালবাহানা করার আশঙ্কা থাকতও, তবে ন্যায়পরায়ণ শাসক থাকায় আপন প্রাপ্য উশুল হওয়ার ভরসা থাকত।
তারপর তিনি পরবর্তী সময়ের অবিশ্বস্ততার জন্য আফসোস করছেন যে, এখন আমানতদারী কত কমে গেছে! অমুক অমুক ছাড়া আর কারও সঙ্গে লেনদেন করতে ভরসা হয় না। এটা তাবি'ঈদের যমানার কথা, যখন সাহাবায়ে কিরামের অধিকাংশই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে গেছেন। আর এ কারণে অধিকাংশ লেনদেন ও বেচাকেনা তাবি'ঈদের সঙ্গেই করতে হয়। সন্দেহ নেই তাবি'ঈগণ ও ইসলামের মূল শিক্ষার ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। তাদের আখলাক-চরিত্রও অতি উন্নত ছিল। কিন্তু সাহাবীগণ তো সাহাবীই। তাদের সঙ্গে কাউকে তুলনা করা চলে না। তারা সাধারণভাবে সব তাবি'ঈকে তাদের মত অত উচ্চস্তরের না পাওয়ায় আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন যে, এখন লেনদেন কেবল অমুক অমুকের সাথেই করা যায়।
হযরত হুযায়ফা রাযি. যদিও দু'জনের কথা উল্লেখ করেছেন, কিন্তু এর দ্বারা এ কথা বোঝানো উদ্দেশ্য নয় যে, কেবল এ দু'জনই আমানতদার ছিলেন। বরং বোঝানো উদ্দেশ্য হচ্ছে আগের মত অত উন্নত আখলাকওয়ালা লোক এখন খুব বেশি নেই। যারা আছে তাদের সংখ্যা বড় কম।
এবার আমরা নিজেদের বিচার করে দেখতে পারি যে, আমাদের অবস্থা কী? আমাদের অবস্থা তো আমরা নিজ চোখে দেখতে পাচ্ছি। আমানতদারী ও বিশ্বস্ততা বলতে গেলে সম্পূর্ণ লোপ পেয়ে গেছে। নিজের প্রতিই যেন নিজের আস্থা হয় না, অন্যের প্রতি আর ভরসা কতটুকু হবে। অথচ আমানতদারী ছাড়া প্রকৃত মু'মিন হওয়া যায় না। এ গুণ না থাকা মুনাফিকের লক্ষণ। সুতরাং এখন দরকার সর্বব্যাপী
আমানতদারীর চর্চা। নিজেদের দীন ও ঈমানের হেফাজতকল্পে এ গুণ আমাদের অর্জন করতেই হবে। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন। প্রশ্ন হতে পারে, সাহাবায়ে কিরামের আমলেই যদি আমানতদারী উঠে গিয়ে থাকে, যেমনটা তাঁর বর্ণনা দ্বারা বোঝা যাচ্ছে, তাহলে তাঁর এ কথা বলার কী অর্থ থাকতে পারে। যে, আমি দ্বিতীয়টির অর্থাৎ আমানতদারী উঠে যাওয়ার অপেক্ষায় আছি?
এর উত্তর হচ্ছে, আমানতদারী সম্পূর্ণরূপে লোপ পেয়ে যাওয়া, যখন এতটুকু বলারও অবকাশ থাকবে না যে, অমুক অমুকের সাথে লেনদেন করতে পারি, অর্থাৎ আমানতদার ও বিশ্বস্ত লোক বিলকুল পাওয়া যাবে না। অবশ্য এ ক্ষেত্রেও স্মরণ রাখতে হবে যে, হযরত হুযায়ফা রাযি. এ কথা বলছেন তাঁর আপন অবস্থান থেকে। অর্থাৎ আমানতদারীরও বিভিন্ন স্তর আছে। তিনি ও অন্যান্য সাহাবীগণ তার সর্বোচ্চ স্তরে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে আমানত বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার কথা বোঝাচ্ছেন। অর্থাৎ তাঁর দৃষ্টিকোণ থেকে যখন আমানত সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যাবে, যার অপেক্ষা তিনি করছিলেন, আমাদের অবস্থান অনুযায়ী তখন এক স্তরের আমানত অবশিষ্ট থাকবে। তিনি যে কাল সম্পর্কে আশঙ্কা করছিলেন যে, যখন আমানত বলতে কিছু থাকবে না, তা অনেক আগেই পার হয়ে গেছে। তারপর যুগ-যুগ যাবৎ দুনিয়ায় ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহ টিকে আছে। সুতরাং স্বীকার করতে হবে আমানতদারীও কিছু না কিছু অবশিষ্ট আছে। হাঁ, এটাও সত্য যে, সাহাবায়ে কিরামের তুলনায় তা নিতান্তই নগণ্য।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. আমানতদারী ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য আপন ঈমানের হেফাজতকল্পে আমানতরক্ষায় যত্নবান থাকা।
খ. ঈমান ও আমানতদারী প্রত্যেকের স্বভাবের মধ্যেই নিহিত আছে। সে হিসেবে এটাও আল্লাহপ্রদত্ত আমানত। তাই এর হেফাজত জরুরি। অর্থাৎ কোনও ক্ষেত্রে কোনও অবস্থায়ই যাতে খেয়ানত না হয়ে যায় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকা চাই।
গ. যে চালাকি ও হুঁশিয়ারী আমানতের পরিপন্থী, তা বেঈমানী কাজ। সুতরাং কোনও মু'মিনের এরকম চালাকি করতে নেই।
ঘ. ঈমানের মত আমানতেরও নূর আছে। আমানতের খেয়ানত করলে অন্তর থেকে সে নূর লোপ পায় এবং অব্যাহত খেয়ানতের ফলে অন্তর সম্পূর্ণরূপে অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে যায়। অন্ধকারাচ্ছন্ন অন্তর নেককাজে আগ্রহ বোধ করে না।
ঙ. শাসকদের এটাও একটা কর্তব্য যে, তারা ন্যায়শাসনের মাধ্যমে মানুষের পারস্পরিক আমানত ও অধিকার বুঝে পাওয়ার বিষয়টা নিশ্চিত করবে এবং খেয়ানতকারীর খেয়ানতেরও বিচারের ব্যবস্থা করবে।
মানবস্বভাবে আমানতদারীর গুণ বিদ্যমান থাকা
বলা হয়েছে- الأمانة نزلت في جذر قلوب الرجال মানুষের অন্তরের অন্তস্তলে আমানত নাযিল হয়েছে'। جذر শব্দটি দ্বারা প্রতিটি জিনিসের মূল ও গোড়া বোঝানো হয়ে থাকে। অন্তরের মূল ও গোড়া বা অন্তস্তল বলে মূলত অন্তরই বোঝানো হয়ে থাকে। কেবল তাকিদ ও গুরুত্বারোপের জন্যই অন্তরের সাথে মূল, তল ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করা হয়। সুতরাং অন্তস্তলে আমানত নাযিল হয়েছে বলে বোঝানো হচ্ছে এ গুণটি বাহ্যিক বা ভাসাভাসা কোনও ব্যাপার নয়; বরং এটা মানুষের অন্তর ও স্বভাবের মধ্যে নিহিত থাকে। এ হাদীছ দ্বারা বোঝা গেল সব মানুষের অন্তরেই আমানতের গুণটি নিহিত রাখা হয়েছে। কেউ এ গুণ অনুযায়ী কাজ করে এবং কেউ করে না। যারা এ গুণ অনুযায়ী কাজ করে না তথা অব্যাহতভাবে আমানতের খেয়ানত করতে থাকে, তাদের স্বভাবগত এ গুণটি নিস্তেজ হয়ে পড়ে। ফলে খেয়ানত করাই তাদের অভ্যাস হয়ে যায়।
এ হাদীছে বর্ণিত আমানত মূলত ওই আমানতই, যা আয়াত –
إِنَّا عَرَضْنَا الْأَمَانَةَ عَلَى السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَالْجِبَالِ
এর মধ্যে বর্ণিত হয়েছে। এ আমানত ব্যাপক অর্থে ঈমানেরই সমার্থবোধক। বোঝা গেল ঈমানও স্বভাবগতভাবে সমস্ত মানুষের অন্তরে নিহিত থাকে। সুতরাং এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
كل مولود يولد على الفطرة، وأبواه يهودانه، وينصرانه، ويمجسانه
‘সব শিশুই স্বভাবধর্ম (ইসলাম)-এর ওপর জন্ম নেয় এবং তার পিতামাতা তাকে ইয়াহুদী, নাসারা বা অগ্নিপূজারী বানায়। (সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ১৩৫৮; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৬৫৮; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৭১৪; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২১৩৮; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৮৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৭১৮২; মুসনাদুল হুমায়দী, হাদীছ নং ১১৪৫)
স্বভাবের ভেতর নিহিত সেই ঈমান যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে প্রকাশ্যে স্বীকার করে নেয় সে-ই মু'মিন, আর যে ব্যক্তি তা স্বীকার করে না সে মু'মিন নয়। তো আলোচ্য হাদীছে যে অন্তস্তলে আমানত নাযিলের কথা বলা হয়েছে তা মূলত স্বভাবগত ওই ঈমানই। মানুষের পারস্পরিক আমানতসমূহ তারই শাখা-প্রশাখা।
অতঃপর এ হাদীছে বলা হয়েছে ‘তারপর কুরআন নাযিল হয়েছে এবং লোকে সে কুরআন শিখেছে এবং সুন্নাহ শিখেছে। অর্থাৎ স্বভাবগতভাবে আমানতের বোধ-অনুভব অর্জিত হওয়ার পর মানুষ কুরআন সুন্নাহ দ্বারাও আমানত সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জন করে নিল। যেমন, কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াতে এবং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিভিন্ন হাদীছে আমানতের যে গুরুত্ব ও ফযীলত বর্ণিত হয়েছে, তা মানুষ জানতে পেরেছে। সারকথা, যে আমানত ছিল মানুষের স্বভাবগত, তা মানুষ কুরআন-সুন্নাহ দ্বারা স্বেচ্ছায় অর্জন করতেও সক্ষম হয়েছে।
পর্যায়ক্রমে আমানতদারী উঠে যাওয়া
এই গেল আমানত সম্পর্কিত দুই হাদীছের প্রথমটি, যাতে মানুষের আমানত অর্জিত হওয়ার কথা বর্ণিত হয়েছে। তারপর আসছে দ্বিতীয় হাদীছ। এর বিষয়বস্তু হচ্ছে আমানত উঠিয়ে নেওয়া। এতে দুই স্তরে পর্যায়ক্রমে অন্তর থেকে আমানত লোপ করে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
প্রথম পর্যায়ে আমানতের গুণ খানিকটা তুলে নেওয়া হলে অন্তরে একটা কালো দাগ পড়ে। দ্বিতীয় পর্যায়ে বাকিটাও তুলে নেওয়া হয়, তাতে একটা ফোস্কার মত পড়ে। তারপর সকালবেলা যখন ঘুম ভাঙে, তখন তার অন্তরে আমানতের কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। এ অবস্থায় যখন লোকজন বেচাকেনা করে, তখন বলতে গেলে কেউই আমানতদারীর পরিচয় দেয় না।
প্রশ্ন হচ্ছে, আমানত উঠে যাওয়ার কারণে যে কালো দাগ পড়ে তা আসলে কী? উলামায়ে কিরাম বলেন, সে কালো দাগ হচ্ছে আমানত ও ঈমানের নূর চলে যাওয়ার ফলে সৃষ্ট অন্ধকার। প্রথমবার যেহেতু আংশিক নূর চলে যায়, তাই হালকা অন্ধকার দেখা দেয়। পরেরবার সম্পূর্ণ নূর চলে যাওয়ায় গভীর অন্ধকার দেখা দেয়, যাকে ফোস্কা শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করা হয়েছে। ফোস্কার ভেতর যেমন কিছু থাকে না, তেমনি ওই গভীর অন্ধকারের মধ্যেও আমানত ও ঈমানের কিছু অবশিষ্ট থাকে না।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিষয়টাকে পরিষ্কার করে দেওয়ার জন্য জ্বলন্ত অঙ্গারের তুলনা দিয়েছেন। পায়ের ওপর অঙ্গার গড়িয়ে দিলে অঙ্গার পড়ে যাওয়ার পরও যেমন ফোস্কা তারপর ফোস্কার দাগ থেকে যায়, তেমনি আমানত চলে যাওয়ার পর অন্তরে গভীর অন্ধকার থেকে যায়। তিনি এটাকে আরও স্পষ্ট করার লক্ষ্যে নিজ পায়ের ওপর একটি কঙ্কর গড়িয়ে দেন।
হাদীছের শেষে বলা হয়েছে- فيصبح الناس يتبايعون فلا يكاد أحد يؤدي الامانة তারপর মানুষ সকালবেলা বেচাকেনা করবে, কিন্তু কেউ বলতে গেলে আমানত প্রায় আদায়ই করবে না। অর্থাৎ মানুষের বেচাকেনা ও লেনদেনে আমানতদারী থাকবে না। আমানতদার লোক প্রায় খুঁজেই পাওয়া যাবে না। তখন মানুষ আমানতদারী অপেক্ষা চালাকি ও চাতুর্যকে প্রাধান্য দেবে। চালাকি করে অন্যকে ঠকাতে পারাকেই কৃতীত্ব মনে করবে। যে যতবেশি ঠক ও ধূর্ত হবে, তাকে ততবেশি কীর্তিমান মনে করা হবে। এই বলে প্রশংসা করা হবে যে- ما أجلده ما أظرفه ما أعقله লোকটি কত চালাক, কত হুঁশিয়ার ও কত বুদ্ধিমান। লোকে তো এভাবে চালাক ও বুদ্ধিমান ব্যক্তির প্রশংসা করবে এবং চালাকি করতে পারাটাকে সে নিজেও তার সফলতা গণ্য করবে। কিন্তু নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই বলে সতর্ক করছেন যে وما في قلبه مثقال حبة من خردل من إيمان অথচ তার অন্তরে সরিষার দানা পরিমাণ ঈমান থাকবে না। এই ঈমানবিহীন চাতুর্য ও চালাকি প্রকৃতপক্ষে বেঈমানী ও ধোঁকাবাজি ছাড়া আর কী? মানুষের ঈমান যখন নিস্তেজ হয়ে যায়, ফলে ঈমানীশক্তি দ্বারা চালিত হতে পারে না, তখন বেঈমানী ও ধোকাবাজির আশ্রয় নিয়ে থাকে। আজ সারা পৃথিবীতে তারই তাণ্ডব লক্ষ করা যাচ্ছে।
হাদীছদু'টি বয়ান করার পর হযরত হুযায়ফা রাযি, তাদের নিজেদের যমানার অর্থাৎ সাহাবায়ে কিরামের যমানার প্রশংসা করে বলেন, তখন কারও সঙ্গে লেনদেন করতে চিন্তাই করতে হত না যে, কার সঙ্গে তা করছি, সে বিশ্বস্ততার পরিচয় দেবে কি না এবং তার কাছে আমার যা প্রাপ্য হয় সে তা সময়মত ঠিক ঠিক আদায় করবে কি না। এ চিন্তা মু'মিনদের ক্ষেত্রে তো করতে হতই না, এমনকি ইয়াহুদী ও নাসারাদের ক্ষেত্রেও করতে হত না। কেননা মু'মিনগণ তো তার ঈমানদারীর কারণেই বিশ্বস্ততার পরিচয় দিত এবং তার দীন ও ঈমানই তাকে বাধ্য করত যাতে অন্যের প্রাপ্য যথাযথভাবে আদায় করে দেয়। আর ইয়াহুদী-নাসারার ক্ষেত্রে চিন্তা করতে হত না এ কারণে যে, তার ওপর তো দায়িত্বশীল অর্থাৎ ন্যায়পরায়ণ শাসক আছে। তার ন্যায়বিচারে তারা ভীত ও সতর্ক থাকত আর সে ভয়ে অন্যের প্রাপ্য পরিশোধে গড়িমসি করত না। যদি কখনও টালবাহানা করার আশঙ্কা থাকতও, তবে ন্যায়পরায়ণ শাসক থাকায় আপন প্রাপ্য উশুল হওয়ার ভরসা থাকত।
তারপর তিনি পরবর্তী সময়ের অবিশ্বস্ততার জন্য আফসোস করছেন যে, এখন আমানতদারী কত কমে গেছে! অমুক অমুক ছাড়া আর কারও সঙ্গে লেনদেন করতে ভরসা হয় না। এটা তাবি'ঈদের যমানার কথা, যখন সাহাবায়ে কিরামের অধিকাংশই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে গেছেন। আর এ কারণে অধিকাংশ লেনদেন ও বেচাকেনা তাবি'ঈদের সঙ্গেই করতে হয়। সন্দেহ নেই তাবি'ঈগণ ও ইসলামের মূল শিক্ষার ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। তাদের আখলাক-চরিত্রও অতি উন্নত ছিল। কিন্তু সাহাবীগণ তো সাহাবীই। তাদের সঙ্গে কাউকে তুলনা করা চলে না। তারা সাধারণভাবে সব তাবি'ঈকে তাদের মত অত উচ্চস্তরের না পাওয়ায় আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন যে, এখন লেনদেন কেবল অমুক অমুকের সাথেই করা যায়।
হযরত হুযায়ফা রাযি. যদিও দু'জনের কথা উল্লেখ করেছেন, কিন্তু এর দ্বারা এ কথা বোঝানো উদ্দেশ্য নয় যে, কেবল এ দু'জনই আমানতদার ছিলেন। বরং বোঝানো উদ্দেশ্য হচ্ছে আগের মত অত উন্নত আখলাকওয়ালা লোক এখন খুব বেশি নেই। যারা আছে তাদের সংখ্যা বড় কম।
এবার আমরা নিজেদের বিচার করে দেখতে পারি যে, আমাদের অবস্থা কী? আমাদের অবস্থা তো আমরা নিজ চোখে দেখতে পাচ্ছি। আমানতদারী ও বিশ্বস্ততা বলতে গেলে সম্পূর্ণ লোপ পেয়ে গেছে। নিজের প্রতিই যেন নিজের আস্থা হয় না, অন্যের প্রতি আর ভরসা কতটুকু হবে। অথচ আমানতদারী ছাড়া প্রকৃত মু'মিন হওয়া যায় না। এ গুণ না থাকা মুনাফিকের লক্ষণ। সুতরাং এখন দরকার সর্বব্যাপী
আমানতদারীর চর্চা। নিজেদের দীন ও ঈমানের হেফাজতকল্পে এ গুণ আমাদের অর্জন করতেই হবে। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন। প্রশ্ন হতে পারে, সাহাবায়ে কিরামের আমলেই যদি আমানতদারী উঠে গিয়ে থাকে, যেমনটা তাঁর বর্ণনা দ্বারা বোঝা যাচ্ছে, তাহলে তাঁর এ কথা বলার কী অর্থ থাকতে পারে। যে, আমি দ্বিতীয়টির অর্থাৎ আমানতদারী উঠে যাওয়ার অপেক্ষায় আছি?
এর উত্তর হচ্ছে, আমানতদারী সম্পূর্ণরূপে লোপ পেয়ে যাওয়া, যখন এতটুকু বলারও অবকাশ থাকবে না যে, অমুক অমুকের সাথে লেনদেন করতে পারি, অর্থাৎ আমানতদার ও বিশ্বস্ত লোক বিলকুল পাওয়া যাবে না। অবশ্য এ ক্ষেত্রেও স্মরণ রাখতে হবে যে, হযরত হুযায়ফা রাযি. এ কথা বলছেন তাঁর আপন অবস্থান থেকে। অর্থাৎ আমানতদারীরও বিভিন্ন স্তর আছে। তিনি ও অন্যান্য সাহাবীগণ তার সর্বোচ্চ স্তরে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে আমানত বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার কথা বোঝাচ্ছেন। অর্থাৎ তাঁর দৃষ্টিকোণ থেকে যখন আমানত সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যাবে, যার অপেক্ষা তিনি করছিলেন, আমাদের অবস্থান অনুযায়ী তখন এক স্তরের আমানত অবশিষ্ট থাকবে। তিনি যে কাল সম্পর্কে আশঙ্কা করছিলেন যে, যখন আমানত বলতে কিছু থাকবে না, তা অনেক আগেই পার হয়ে গেছে। তারপর যুগ-যুগ যাবৎ দুনিয়ায় ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহ টিকে আছে। সুতরাং স্বীকার করতে হবে আমানতদারীও কিছু না কিছু অবশিষ্ট আছে। হাঁ, এটাও সত্য যে, সাহাবায়ে কিরামের তুলনায় তা নিতান্তই নগণ্য।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. আমানতদারী ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য আপন ঈমানের হেফাজতকল্পে আমানতরক্ষায় যত্নবান থাকা।
খ. ঈমান ও আমানতদারী প্রত্যেকের স্বভাবের মধ্যেই নিহিত আছে। সে হিসেবে এটাও আল্লাহপ্রদত্ত আমানত। তাই এর হেফাজত জরুরি। অর্থাৎ কোনও ক্ষেত্রে কোনও অবস্থায়ই যাতে খেয়ানত না হয়ে যায় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকা চাই।
গ. যে চালাকি ও হুঁশিয়ারী আমানতের পরিপন্থী, তা বেঈমানী কাজ। সুতরাং কোনও মু'মিনের এরকম চালাকি করতে নেই।
ঘ. ঈমানের মত আমানতেরও নূর আছে। আমানতের খেয়ানত করলে অন্তর থেকে সে নূর লোপ পায় এবং অব্যাহত খেয়ানতের ফলে অন্তর সম্পূর্ণরূপে অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে যায়। অন্ধকারাচ্ছন্ন অন্তর নেককাজে আগ্রহ বোধ করে না।
ঙ. শাসকদের এটাও একটা কর্তব্য যে, তারা ন্যায়শাসনের মাধ্যমে মানুষের পারস্পরিক আমানত ও অধিকার বুঝে পাওয়ার বিষয়টা নিশ্চিত করবে এবং খেয়ানতকারীর খেয়ানতেরও বিচারের ব্যবস্থা করবে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)


বর্ণনাকারী: