রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
ভূমিকা অধ্যায়
হাদীস নং: ১৭৩
কল্যাণকর কাজের পথ দেখানো এবং সৎ পথ অথবা ভ্রান্ত পথের দিকে ডাকা
আমাদের এ দীনে মানুষকে কল্যাণকর কাজের পথ দেখানো ও সৎ পথের দিকে ডাকা অনেক বড় ফযীলতের কাজ। এতে রয়েছে প্রচুর ছাওয়াব। অপরদিকে যে কাজে মানুষের ক্ষতি হয় এবং মানুষ বিপথগামিতার শিকার হয়, সেরকম কাজের পথ দেখানো বা সেদিকে ডাকা অত্যন্ত নিন্দনীয় কাজ। এর গুনাহও বিপুল।
বস্তুত সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে মানুষকে ভালো কাজের কথা বলা ও সৎ পথে ডাকা একটি নৈতিক কর্তব্যও বটে। কেননা কেউ যদি কোনও মন্দ কাজে লিপ্ত থাকে, তবে তাতে কেবল সে নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, সমাজও দূষিত হয়। এর পরিণামে ন্যায়নিষ্ঠ ও সৎকর্মশীলরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এমনকি তাদের ন্যায় ও সৎকাজে টিকে থাকাটাও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এই অশুভ পরিণাম থেকে আত্মরক্ষা ও সমাজকে বাঁচানোর একমাত্র উপায় হচ্ছে সাধ্য অনুযায়ী মানুষকে সৎকাজের পথ দেখানো ও সৎ পথের দিকে ডাকা।
সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট হওয়ার জন্য ব্যক্তিবর্গের অন্যায় ও অসৎকর্মই দায়ী।ব্যক্তিবর্গের সংশোধন হয়ে গেলে এবং প্রত্যেকে ন্যায় ও সৎকাজে লিপ্ত থাকলে সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা আপনিই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। তাই প্রত্যেকের উচিত নিজেকে সংশোধন করার পাশাপাশি সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তিকে ন্যায় ও সত্য বোঝানো এবং প্রত্যেকে যাতে ন্যায্য ও সঠিক কাজ করে সেই প্রচেষ্টা চালানো। যখনই কেউ কাউকে কোনও অন্যায় কাজে লিপ্ত দেখবে, সে তাকে তা থেকে ফেরানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। সে কাজে দীন ও দুনিয়ার কী ক্ষতি তাকে তা বোঝাবে। তার বিপরীতে সঠিক ও ন্যায় কাজের কী উপকারিতা তাও তার সামনে তুলে ধরবে। প্রত্যেকে যদি আপন আপন সাধ্য অনুযায়ী এ চেষ্টা চালাতে থাকে, তবে অবশ্যই অন্যায়-অপরাধের মাত্রা কমে আসবে।
সেইসঙ্গে সাধারণ দাওয়াতও অব্যাহত রাখা চাই। সাধারণভাবে সকলের মধ্যে সৎকাজের উপকারিতা ও অসৎকাজের ক্ষতি সম্পর্কে আলোচনা চলতে থাকলে একদিকে মানুষের অপরাধপ্রবণতা দুর্বল হয়ে পড়ে, অন্যদিকে সৎকাজের উৎসাহ-উদ্দীপনা বাড়তে থাকে। এ প্রচেষ্টা নিরবচ্ছিন্নভাবে চালাতে থাকলে একপর্যায়ে অন্যায়-অপরাধ নির্মূল হয়ে একটি শান্তিপূর্ণ ও ন্যায়নিষ্ঠ সমাজ গড়ে উঠবেই ইনশাআল্লাহ। ইসলামের শুরুর দিকে এরকমই তো ছিল। কালক্রমে এ মেহনতে ক্রমাবনতি ঘটেছে এবং তারই অবধারিত পরিণাম হচ্ছে আজকের পাপ-পঙ্কিলতায় জর্জরিত সমাজ-বাস্তবতা। আগেই বলা হয়েছে এর থেকে মুক্তির একই পথ— মানুষকে সৎকাজের পথ দেখানো ও সর্বাত্মক দাওয়াতী মেহনত । কুরআন ও হাদীছে ব্যাপকভাবে এ মেহনতের জরুরতের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে এবং প্রত্যেকে যাতে আপন আপন সামর্থ্য অনুযায়ী এ মেহনত অব্যাহত রাখে তার জোর তাগিদ করা হয়েছে।
ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে সেরকম কিছু আয়াত ও হাদীছ উদ্ধৃত করেছেন। এবার আমরা সেসব আয়াত ও হাদীছের তরজমা ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তা'আলাই তাওফীকদাতা।
কল্যাণকর কাজের পথ দেখানো এবং সৎ পথ
অথবা ভ্রান্ত পথের দিকে ডাকা সম্পর্কিত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত
وَادْعُ إِلَى رَبِّكَ
অর্থ : এবং তুমি নিজ প্রতিপালকের দিকে মানুষকে ডাকতে থাক। সূরা কাসাস (২৮), আয়াত ৮৭
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে লক্ষ্য করে আদেশ করেছেন যেন তিনি মানুষকে তাঁর প্রতিপালক আল্লাহর দিকে ডাকেন। তিনি তো ডাকতেনই। তারপরও এ নির্দেশ দেওয়ার অর্থ হচ্ছে ডাকার কাজ অব্যাহত রাখা। মূল হুকুমটি তাঁর প্রতি হলেও উম্মতের প্রত্যেকেই এর অন্তর্ভুক্ত। কুরআন মাজীদে এমন আরও হুকুম আছে, যা সরাসরি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে লক্ষ্য করে দেওয়া হলেও প্রকৃতপক্ষে তাঁর উম্মতের প্রত্যেকেই সে হুকুমের আওতাভুক্ত।
সুতরাং আমাদের প্রত্যেকের কর্তব্য- আপন আপন শক্তি ও সামর্থ্য অনুযায়ী মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকা এবং ডাকার মেহনত সর্বদা অব্যাহত রাখা। এমন নয় যে, দু'-চারবার ডেকেই ক্ষান্ত হয়ে গেলাম; বরং মৃত্যু পর্যন্ত যখনই এ কাজের অবকাশ হয় তখনই তা করে যেতে হবে।
আয়াতে বলা হয়েছে- ডাক তোমার প্রতিপালকের দিকে। সুতরাং যে ব্যক্তি দাওয়াতের মেহনত করবে, তার তা ভালোভাবে জেনেশুনেই করতে হবে। কেননা জানা যদি সঠিক না হয়, তবে অজ্ঞতাবশত আল্লাহর দিকে ডাকতে গিয়ে ডাকা হয়ে যাবে অন্য কিছুর দিকে। আল্লাহর পথ তো একটিই, আর তা হচ্ছে দীনে ইসলাম। ইসলাম তা-ই, যা কুরআন-হাদীছ দ্বারা সরাসরি বা পরোক্ষভাবে প্রমাণিত। যে বিষয়টি কুরআন-হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত নয়, তা ইসলামও নয় এবং নয় আল্লাহর পথও। কাজেই কেউ যদি না জেনেশুনে মানুষকে কোনওকিছুর দিকে দাওয়াত দেয় তাহলে অসম্ভব নয় যে, তা আল্লাহর পথের দাওয়াত হবে না, ভ্রান্ত পথের দিকে ডাকা হবে। সুতরাং এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন জরুরি।
দুই নং আয়াত
ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ
অর্থ : তুমি নিজ প্রতিপালকের পথে মানুষকে ডাকবে হিকমত ও সদুপদেশের মাধ্যমে।সূরা নাহল (১৬), আয়াত ১২৫
ব্যাখ্যা
এখানে আয়াতে অংশবিশেষ আনা হয়েছে। এর পরে আছে-
وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنْ ضَلَّ عَنْ سَبِيلِهِ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ (125)
আর (যদি কখনও বিতর্কের দরকার পড়ে, তবে) তাদের সাথে বিতর্ক করবে উৎকৃষ্ট পন্থায়। নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক যারা তার পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে, তাদের সম্পর্কে ভালোভাবেই জানেন এবং তিনি তাদের সম্পর্কেও পরিপূর্ণ জ্ঞাত, যারা সৎপথে প্রতিষ্ঠিত।'
দাওয়াতের তিনটি মূলনীতি
এ আয়াতে আল্লাহর পথে ডাকার পদ্ধতি শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। এতে বর্ণিত
মূলনীতি হল তিনটি-
ক. হিকমত
খ. সদুপদেশ ও
গ. উৎকৃষ্ট পন্থায় বিতর্ক।
হিকমতের মর্ম হল- সত্য-সঠিক বিষয়বস্তুকে অকাট্য দলীল-প্রমাণের মাধ্যমে স্থান-কাল-পাত্রকে বিবেচনায় রেখে উপস্থাপন করা। মূলত কুরআন মাজীদে এ শব্দটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কোথাও এর দ্বারা কুরআন মাজীদ বোঝানো হয়েছে, কোথাও হাদীছ বোঝানো হয়েছে, কোথাও বোঝানো হয়েছে অকাট্য দলীল-প্রমাণ। রূহুল মা'আনী গ্রন্থে 'আল-বাহরুল মুহীত' নামক গ্রন্থের বরাতে হিকমতের ব্যাখ্যা করা হয়েছে এরকম-
إِنَّهَا الْكَلَامُ الصَّوَابُ الْوَاقِعُ مِنَ النَّفْسِ أَجْمَلَ مَوْقِع
হিকমত বলা হয় এমন সঠিক কথাকে, যা মানুষের অন্তরে চমৎকার রেখাপাত করে।' এ ব্যাখ্যাটি সুন্দর এবং ব্যাপক অর্থবোধক। উপরে বর্ণিত সবগুলো অর্থই এর মধ্যে এসে যায়। সারকথা হচ্ছে, আল্লাহর পথে ডাকতে হবে কুরআন দ্বারা, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীছ দ্বারা এবং অকাট্য দলীল-প্রমাণ দ্বারা। সেইসঙ্গে স্থান-কাল-পাত্রও বিবেচ্য। যাকে ডাকা হবে তার মর্যাদার দিকে লক্ষ রাখতে হবে। যেখানে শক্ত কথা বলার প্রয়োজন সেখানে শক্ত কথা বলা এবং যেখানে নরম কথা বলা দরকার সেখানে নরম কথা বলাও দাওয়াত গ্রহণের পক্ষে ফলপ্রসূ। তাছাড়া যেখানে আড়ালে দাওয়াত দেওয়া প্রয়োজন সেখানে আড়ালে দেওয়া এবং যেখানে প্রকাশ্যে দেওয়া প্রয়োজন সেখানে প্রকাশ্যে দেওয়াও ফলপ্রসূ। এসবই হিকমতের অন্তর্ভুক্ত।
সদুপদেশের অর্থ- যাকে দাওয়াত দেওয়া হবে তার ইজ্জত-সম্মানের প্রতি লক্ষ রেখে তার কল্যাণ কামনার্থে হৃদয়গ্রাহী ভাষায় ও নম্রতার সাথে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করা, যাতে তার মনে নম্রতা আসে এবং দাওয়াত গ্রহণের জন্য সে প্রস্তুত হয়ে যায়।
الموعظة (মাও‘ইযা) শব্দটির মূল অর্থের মধ্যে কল্যাণকামিতার একটি দিকও আছে।কাজেই উপদেশ এমনভাবে দেওয়া চাই, যাতে ব্যক্তি মনে করে উপদেশদাতা আমার পরম কল্যাণকামী। তার উপদেশ আমার গ্রহণ করা উচিত। সুতরাং এমন কোনও শব্দ ব্যবহার করা বা এমন ভাব-ভঙ্গি অবলম্বন করা কিছুতেই উচিত হবে না, যা ব্যক্তিকে আহত করে বা সে নিজেকে অপমানিত বোধ করে। এতে নসীহত কেবল ব্যর্থই হয় না। বরং উল্টো ফল ফলে। যাদেরকে দাওয়াত দেওয়া হয় তারা সম্পূর্ণ বিগড়ে যায়। পরবর্তীতে অন্য কারও উপদেশেও কর্ণপাত করতে চায় না। এজন্যই মাও‘ইযার সাথে "হাসানা' বিশেষণ ব্যবহার করা হয়েছে। বোঝানো উদ্দেশ্য, নসীহত যেন অবশ্যই উত্তম পন্থায় হয় এবং যা-কিছু নসীহত গ্রহণের পক্ষে বাধা তা এড়িয়ে চলা হয়।
আর উৎকৃষ্ট পন্থায় বিতর্ক করার অর্থ- সত্যকে প্রতিষ্ঠা করা ও প্রতিপক্ষকে তা বোঝানোর নিয়তে সত্যনিষ্ঠার সাথে ভদ্রোচিত ভাষায় যথোপযুক্ত যুক্তি-তর্ক ও দলীল-প্রমাণ পেশ করা, প্রতিপক্ষের মনে আঘাত লাগতে পারে বা জিদ সৃষ্টি হতে পারে—এ জাতীয় আচরণ পরিহার করা এবং সর্বাবস্থায় মাত্রাবোধ ও ন্যায়-ইনসাফের পরিচয় দেওয়া।
উদ্দেশ্য যখন মানুষের সামনে সত্য প্রতিষ্ঠিত করা এবং তাদেরকে সত্যগ্রহণে উৎসাহিত করা, তখন বিতর্কের পন্থা অবশ্যই ন্যায়নিষ্ঠ হওয়া উচিত এবং হওয়া উচিত হৃদয়গ্রাহী। আল্লাহ তা'আলা তো হযরত মূসা আলাইহিস সালামের মত জালীলুল কদর নবীকে ফির'আউনের মত মহাপাপিষ্ঠ ব্যক্তির সামনে নম্র পন্থায় দাওয়াত পেশের হুকুম দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে-
فَقُولَا لَهُ قَوْلًا لَيِّنًا لَعَلَّهُ يَتَذَكَّرُ أَوْ يَخْشَى (44)
'তোমরা গিয়ে তার সাথে নম্র কথা বলবে। হয়ত সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা (আল্লাহকে) ভয় করবে। সূরা ত্বহা (২০), আয়াত ৪৪
এমনিভাবে আহলে কিতাবের সঙ্গে বিতর্ক করা সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-
وَلَا تُجَادِلُوا أَهْلَ الْكِتَابِ إِلَّا بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ
"(হে মুসলিমগণ!) কিতাবীদের সাথে বিতর্ক করবে না উত্তম পন্থা ছাড়া। সূরা আনকাবুত (২৯), আয়াত ৪৬
দীন ও শরী'আত সম্পর্কিত কোনও বিষয়ে বিতর্কের উদ্দেশ্য কেবলই দীন ও শরী'আতের সত্যতা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করা, নিজ যোগ্যতা ও শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করা নয়। তা জাহিরের চেষ্টা অহমিকার লক্ষণ ও সম্পূর্ণ নাজায়েয। নিজ শ্রেষ্ঠত্ব জাহিরের উদ্দেশ্যে দাওয়াতী মেহনত তো পরের কথা, 'ইলমে দীন শেখাই জায়েয নয়। এক হাদীছে ইরশাদ-
لاَ تَعَلَّمُوا الْعِلْمَ لِتُبَاهُوا بِهِ الْعُلَمَاءَ، وَلاَ لِتُمَارُوا بِهِ السُّفَهَاءَ، وَلاَ تَخَيَّرُوا بِهِ الْمَجَالِسَ، فَمَنْ فَعَلَ ذَلِكَ فَالنَّارُ النَّارُ
তোমরা এ উদ্দেশ্যে ইলম শিখবে না যে, এর মাধ্যমে উলামার সঙ্গে অহমিকা করে বেড়াবে বা অজ্ঞজনদের সঙ্গে ঝগড়ায় লিপ্ত হবে কিংবা এর মাধ্যমে উৎকৃষ্ট আসনে সমাসীন হবে। এমনটা যে করবে তার জন্য জাহান্নাম জাহান্নাম। সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ২৫৪; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ৭৭
মোটকথা, আল্লাহর পথে ডাকার জন্য দাঈকে কুরআন মাজীদে বর্ণিত এ তিনটি মূলনীতি অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে। দাওয়াত দেওয়া একটি উচ্চস্তরের দীনী কাজ। যে-কোনও দীনী কাজ কুরআন-হাদীছে বর্ণিত পন্থায় করাই বাঞ্ছনীয়। সেভাবে করলেই কৃতকার্যতা লাভের আশা থাকে। অন্যথায় সব মেহনত বেকার হয়ে যায়। আল্লাহ তা'আলা আমাদের সকলকে দা'ঈ হিসেবে কবুল করুন এবং তাঁর দেখানো পন্থায় দাওয়াতী মেহনতের তাওফীক দিন।
তিন নং আয়াত
وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى
অর্থ : তোমরা সৎকর্ম ও তাকওয়ার ক্ষেত্রে একে অন্যকে সহযোগিতা করবে। সূরা মায়িদা (৫), আয়াত ২
ব্যাখ্যা
الْبِرِّ বলা হয় ওই সকল কাজ করাকে, শরী'আতের পক্ষ থেকে যা করতে আদেশ করা হয়েছে, যথা- নামায পড়া, যাকাত দেওয়া, রোযা রাখা, হজ্জ করা, পর্দা করা, হালাল খাওয়া, পিতামাতার হুকুম মানা, বড়কে সম্মান করা, ছোটকে স্নেহ করা, আলেমদের মর্যাদা দেওয়া ইত্যাদি। আর التَّقْوَى হল ওই সকল কাজ থেকে বিরত থাকা, যা করতে শরী'আতে নিষেধ করা হয়েছে, যেমন- জুয়া খেলা, মাদক সেবন করা, চুরি করা, সুদ-ঘুষ খাওয়া, জুলুম করা, অমুসলিমদের অনুকরণ করা, নাচ, গান ও অশ্লীল কাজ করা ইত্যাদি। শরী'আতের যাবতীয় বিষয় এর মধ্যে এসে গেছে। এতে আমাদেরকে আদেশ করা হয়েছে, আমরা যেন করণীয় ও বর্জনীয় যাবতীয় বিষয়ে একে অন্যকে সাহায্য করি। এ সাহায্য হয় দীনী শিক্ষার প্রচার-প্রসারে ভূমিকা রাখার দ্বারা, বিশেষত মক্তব ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা, মক্তব ও মাদরাসায় শিক্ষকতা করা, দীনী পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা ও দাওয়াতী মেহনত পরিচালনা করার দ্বারা। এমনিভাবে আমলের প্রতি উৎসাহ দেওয়া এবং কারও আমলের পক্ষে যা-কিছু বাধা হয় তা অপসারণ করার দ্বারাও সৎকর্ম ও তাকওয়া অবলম্বনে সহযোগিতা করা হয়।
সমাজে এমন অনেক কিছুই চালু আছে, যার সংস্পর্শে এসে মানুষ সৎকর্মের উৎসাহ হারায় এবং অসৎকর্মে লিপ্ত হওয়ার উস্কানী পায়। সুতরাং সৎকর্ম ও তাকওয়া- পরহেযগারীতে সহযোগিতা করার জন্য সচেতন মহলের কর্তব্য শরী'আতবিরোধী কর্মকাণ্ডের দুনিয়াবী ও পরকালীন ক্ষতি সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করা এবং শরী আতবিরোধী কার্যকলাপের আখড়া ও কেন্দ্রসমূহ উৎখাতে নিয়মতান্ত্রিক প্রচেষ্টা চালানো। অনেক ক্ষেত্রে সন্তানের দীনদারীতে পিতামাতাও বাধা হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে পিতামাতাকে বোঝানোর চেষ্টা করাও অবশ্যকর্তব্য।
যেহেতু এ আয়াতে সৎকর্ম ও তাকওয়ার ক্ষেত্রে একে অন্যকে সাহায্য করতে আদেশ করা হয়েছে, তাই আপন আপন সামর্থ্য অনুযায়ী প্রত্যেকের জন্য এটা অবশ্যকরণীয়।
চার নং আয়াত
وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ
অর্থ : তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা চাই, যারা (মানুষকে) কল্যাণের দিকে ডাকবে।" সূরা আলে ইমরান (৩), আয়াত ১০৪
ব্যাখ্যা
এর আগের আয়াতে আল্লাহ তা'আলা মুসলিমগণকে আদেশ করেছিলেন- তারা যেন আল্লাহর রজ্জু তথা কুরআন মাজীদকে শক্ত করে ধরে রাখে এবং পরস্পর কলহ- বিবাদে লিপ্ত না হয়। তো আল্লাহর রশি মজবুত করে ধরে রাখা এবং পরস্পরের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য এটা জরুরি যে, উম্মতের মধ্যে এমন একটা দল সবসময় থাকবে, যারা তাদেরকে ওয়াজ-নসীহত ও আদেশ-উপদেশের মাধ্যমে এর প্রতি উৎসাহিত করবে। তারা এ কাজকে নিজেদের যিম্মাদারী হিসেবে গ্রহণ করবে আর সে হিসেবে নিজেদের কথা ও কাজ দ্বারা মানুষকে কুরআন-সুন্নাহ'র দিকে ডাকতে থাকবে। যখনই কাউকে গাফলাতি ও অসৎকর্মে লিপ্ত দেখতে পাবে, তখন সাধ্যমত তাদেরকে বোঝাবে এবং তা থেকে ফেরানোর চেষ্টা করবে।
বলাবাহুল্য, এ কাজ সকলের পক্ষে সম্ভব নয়। এটা কেবল তাদের পক্ষেই সম্ভব, যারা কুরআন ও সুন্নাহ সম্পর্কে অভিজ্ঞ, কোনটা সৎকাজ এবং কোটা অসৎকাজ সে সম্পর্কে ভালোভাবে জ্ঞাত এবং পরিবেশ-পরিস্থিতি সম্পর্কেও সচেতন। এরকম যোগ্যতা যাদের মধ্যে নেই, তাদের ওপর যিম্মাদারী অর্পণ করা হলে কিংবা তারা নিজেরাই এ যিম্মাদারী গ্রহণ করে নিলে ভালোর পরিবর্তে মন্দ ফল দেখা দেওয়ার আশঙ্কাই বেশি। হয় তারা ভালো কাজকে মন্দ মনে করে মানুষকে তা থেকে ফেরানোর চেষ্টা করবে অথবা মন্দ কাজকে ভালো মনে করে মানুষকে তা করতে উৎসাহ দেবে। কিংবা এমনও হতে পারে যে, নম্রতার স্থলে কঠোরতা বা কঠোরতার স্থলে নম্রতা অবলম্বন করবে। ফলে চেষ্টার কাঙ্ক্ষিত সুফল পাওয়া যাবে না কিংবা উল্টো ফলও ফলতে পারে। সম্ভবত এ কারণেই আয়াতে সকলের প্রতি এ যিম্মাদারী অর্পণ না করে বিশেষ এক দলকে এর জন্য মনোনীত করা হয়েছে, যে দলটি এ কাজের প্রয়োজনীয় যোগ্যতা রাখে।
এ আয়াতে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, যারা মানুষকে সত্য ও ন্যায়ের দিকে ডাকে তারা উম্মতের শ্রেষ্ঠ লোক। এ কারণেই আলাদাভাবে তাদের উল্লেখ করা হয়েছে।
উম্মতের একটি দলকে এ কাজে নিয়োজিত থাকার তাগিদ করার দ্বারা বোঝানো হচ্ছে যে, উম্মতের মধ্যে এমন একটি দল অবশ্যই থাকা চাই। অন্যথায় উম্মত তার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে অস্তিত্বের সংকটে পড়ে যাবে। বর্তমানে আমরা ব্যাপকভাবেই এ অবস্থা লক্ষ করছি।
উম্মতের একটি দলকে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের দায়িত্বে নিয়োজিত রাখার মূল দায়িত্ব সরকারের। সরকার এ দায়িত্ব পালন না করলে জনগণের উচিত হবে নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে একটা জামাতকে এ কাজে নিয়োজিত রাখা। জনগণও যদি এ ব্যাপারে উদাসীন থাকে, তখন উলামা-মাশায়েখের স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ দায়িত্ব পালন করা উচিত। বলাবাহুল্য, তারা আপন আপন স্থান থেকে এ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেনও। তবে তাদের সে চেষ্টার কাঙ্ক্ষিত সুফল পাওয়ার জন্য জরুরি ছিল জনগণের ব্যাপক সম্পৃক্ততা ও সরকারের সক্রিয় সহযোগিতা। কিন্তু সে সম্পৃক্ততা ও সহযোগিতার অভাব বড় প্রকট। বিষয়টি সকলের গভীরভাবে চিন্তা করা উচিত।
আমাদের এ দীনে মানুষকে কল্যাণকর কাজের পথ দেখানো ও সৎ পথের দিকে ডাকা অনেক বড় ফযীলতের কাজ। এতে রয়েছে প্রচুর ছাওয়াব। অপরদিকে যে কাজে মানুষের ক্ষতি হয় এবং মানুষ বিপথগামিতার শিকার হয়, সেরকম কাজের পথ দেখানো বা সেদিকে ডাকা অত্যন্ত নিন্দনীয় কাজ। এর গুনাহও বিপুল।
বস্তুত সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে মানুষকে ভালো কাজের কথা বলা ও সৎ পথে ডাকা একটি নৈতিক কর্তব্যও বটে। কেননা কেউ যদি কোনও মন্দ কাজে লিপ্ত থাকে, তবে তাতে কেবল সে নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, সমাজও দূষিত হয়। এর পরিণামে ন্যায়নিষ্ঠ ও সৎকর্মশীলরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এমনকি তাদের ন্যায় ও সৎকাজে টিকে থাকাটাও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এই অশুভ পরিণাম থেকে আত্মরক্ষা ও সমাজকে বাঁচানোর একমাত্র উপায় হচ্ছে সাধ্য অনুযায়ী মানুষকে সৎকাজের পথ দেখানো ও সৎ পথের দিকে ডাকা।
সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট হওয়ার জন্য ব্যক্তিবর্গের অন্যায় ও অসৎকর্মই দায়ী।ব্যক্তিবর্গের সংশোধন হয়ে গেলে এবং প্রত্যেকে ন্যায় ও সৎকাজে লিপ্ত থাকলে সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা আপনিই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। তাই প্রত্যেকের উচিত নিজেকে সংশোধন করার পাশাপাশি সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তিকে ন্যায় ও সত্য বোঝানো এবং প্রত্যেকে যাতে ন্যায্য ও সঠিক কাজ করে সেই প্রচেষ্টা চালানো। যখনই কেউ কাউকে কোনও অন্যায় কাজে লিপ্ত দেখবে, সে তাকে তা থেকে ফেরানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। সে কাজে দীন ও দুনিয়ার কী ক্ষতি তাকে তা বোঝাবে। তার বিপরীতে সঠিক ও ন্যায় কাজের কী উপকারিতা তাও তার সামনে তুলে ধরবে। প্রত্যেকে যদি আপন আপন সাধ্য অনুযায়ী এ চেষ্টা চালাতে থাকে, তবে অবশ্যই অন্যায়-অপরাধের মাত্রা কমে আসবে।
সেইসঙ্গে সাধারণ দাওয়াতও অব্যাহত রাখা চাই। সাধারণভাবে সকলের মধ্যে সৎকাজের উপকারিতা ও অসৎকাজের ক্ষতি সম্পর্কে আলোচনা চলতে থাকলে একদিকে মানুষের অপরাধপ্রবণতা দুর্বল হয়ে পড়ে, অন্যদিকে সৎকাজের উৎসাহ-উদ্দীপনা বাড়তে থাকে। এ প্রচেষ্টা নিরবচ্ছিন্নভাবে চালাতে থাকলে একপর্যায়ে অন্যায়-অপরাধ নির্মূল হয়ে একটি শান্তিপূর্ণ ও ন্যায়নিষ্ঠ সমাজ গড়ে উঠবেই ইনশাআল্লাহ। ইসলামের শুরুর দিকে এরকমই তো ছিল। কালক্রমে এ মেহনতে ক্রমাবনতি ঘটেছে এবং তারই অবধারিত পরিণাম হচ্ছে আজকের পাপ-পঙ্কিলতায় জর্জরিত সমাজ-বাস্তবতা। আগেই বলা হয়েছে এর থেকে মুক্তির একই পথ— মানুষকে সৎকাজের পথ দেখানো ও সর্বাত্মক দাওয়াতী মেহনত । কুরআন ও হাদীছে ব্যাপকভাবে এ মেহনতের জরুরতের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে এবং প্রত্যেকে যাতে আপন আপন সামর্থ্য অনুযায়ী এ মেহনত অব্যাহত রাখে তার জোর তাগিদ করা হয়েছে।
ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে সেরকম কিছু আয়াত ও হাদীছ উদ্ধৃত করেছেন। এবার আমরা সেসব আয়াত ও হাদীছের তরজমা ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তা'আলাই তাওফীকদাতা।
কল্যাণকর কাজের পথ দেখানো এবং সৎ পথ
অথবা ভ্রান্ত পথের দিকে ডাকা সম্পর্কিত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত
وَادْعُ إِلَى رَبِّكَ
অর্থ : এবং তুমি নিজ প্রতিপালকের দিকে মানুষকে ডাকতে থাক। সূরা কাসাস (২৮), আয়াত ৮৭
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে লক্ষ্য করে আদেশ করেছেন যেন তিনি মানুষকে তাঁর প্রতিপালক আল্লাহর দিকে ডাকেন। তিনি তো ডাকতেনই। তারপরও এ নির্দেশ দেওয়ার অর্থ হচ্ছে ডাকার কাজ অব্যাহত রাখা। মূল হুকুমটি তাঁর প্রতি হলেও উম্মতের প্রত্যেকেই এর অন্তর্ভুক্ত। কুরআন মাজীদে এমন আরও হুকুম আছে, যা সরাসরি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে লক্ষ্য করে দেওয়া হলেও প্রকৃতপক্ষে তাঁর উম্মতের প্রত্যেকেই সে হুকুমের আওতাভুক্ত।
সুতরাং আমাদের প্রত্যেকের কর্তব্য- আপন আপন শক্তি ও সামর্থ্য অনুযায়ী মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকা এবং ডাকার মেহনত সর্বদা অব্যাহত রাখা। এমন নয় যে, দু'-চারবার ডেকেই ক্ষান্ত হয়ে গেলাম; বরং মৃত্যু পর্যন্ত যখনই এ কাজের অবকাশ হয় তখনই তা করে যেতে হবে।
আয়াতে বলা হয়েছে- ডাক তোমার প্রতিপালকের দিকে। সুতরাং যে ব্যক্তি দাওয়াতের মেহনত করবে, তার তা ভালোভাবে জেনেশুনেই করতে হবে। কেননা জানা যদি সঠিক না হয়, তবে অজ্ঞতাবশত আল্লাহর দিকে ডাকতে গিয়ে ডাকা হয়ে যাবে অন্য কিছুর দিকে। আল্লাহর পথ তো একটিই, আর তা হচ্ছে দীনে ইসলাম। ইসলাম তা-ই, যা কুরআন-হাদীছ দ্বারা সরাসরি বা পরোক্ষভাবে প্রমাণিত। যে বিষয়টি কুরআন-হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত নয়, তা ইসলামও নয় এবং নয় আল্লাহর পথও। কাজেই কেউ যদি না জেনেশুনে মানুষকে কোনওকিছুর দিকে দাওয়াত দেয় তাহলে অসম্ভব নয় যে, তা আল্লাহর পথের দাওয়াত হবে না, ভ্রান্ত পথের দিকে ডাকা হবে। সুতরাং এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন জরুরি।
দুই নং আয়াত
ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ
অর্থ : তুমি নিজ প্রতিপালকের পথে মানুষকে ডাকবে হিকমত ও সদুপদেশের মাধ্যমে।সূরা নাহল (১৬), আয়াত ১২৫
ব্যাখ্যা
এখানে আয়াতে অংশবিশেষ আনা হয়েছে। এর পরে আছে-
وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنْ ضَلَّ عَنْ سَبِيلِهِ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ (125)
আর (যদি কখনও বিতর্কের দরকার পড়ে, তবে) তাদের সাথে বিতর্ক করবে উৎকৃষ্ট পন্থায়। নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক যারা তার পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে, তাদের সম্পর্কে ভালোভাবেই জানেন এবং তিনি তাদের সম্পর্কেও পরিপূর্ণ জ্ঞাত, যারা সৎপথে প্রতিষ্ঠিত।'
দাওয়াতের তিনটি মূলনীতি
এ আয়াতে আল্লাহর পথে ডাকার পদ্ধতি শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। এতে বর্ণিত
মূলনীতি হল তিনটি-
ক. হিকমত
খ. সদুপদেশ ও
গ. উৎকৃষ্ট পন্থায় বিতর্ক।
হিকমতের মর্ম হল- সত্য-সঠিক বিষয়বস্তুকে অকাট্য দলীল-প্রমাণের মাধ্যমে স্থান-কাল-পাত্রকে বিবেচনায় রেখে উপস্থাপন করা। মূলত কুরআন মাজীদে এ শব্দটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কোথাও এর দ্বারা কুরআন মাজীদ বোঝানো হয়েছে, কোথাও হাদীছ বোঝানো হয়েছে, কোথাও বোঝানো হয়েছে অকাট্য দলীল-প্রমাণ। রূহুল মা'আনী গ্রন্থে 'আল-বাহরুল মুহীত' নামক গ্রন্থের বরাতে হিকমতের ব্যাখ্যা করা হয়েছে এরকম-
إِنَّهَا الْكَلَامُ الصَّوَابُ الْوَاقِعُ مِنَ النَّفْسِ أَجْمَلَ مَوْقِع
হিকমত বলা হয় এমন সঠিক কথাকে, যা মানুষের অন্তরে চমৎকার রেখাপাত করে।' এ ব্যাখ্যাটি সুন্দর এবং ব্যাপক অর্থবোধক। উপরে বর্ণিত সবগুলো অর্থই এর মধ্যে এসে যায়। সারকথা হচ্ছে, আল্লাহর পথে ডাকতে হবে কুরআন দ্বারা, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীছ দ্বারা এবং অকাট্য দলীল-প্রমাণ দ্বারা। সেইসঙ্গে স্থান-কাল-পাত্রও বিবেচ্য। যাকে ডাকা হবে তার মর্যাদার দিকে লক্ষ রাখতে হবে। যেখানে শক্ত কথা বলার প্রয়োজন সেখানে শক্ত কথা বলা এবং যেখানে নরম কথা বলা দরকার সেখানে নরম কথা বলাও দাওয়াত গ্রহণের পক্ষে ফলপ্রসূ। তাছাড়া যেখানে আড়ালে দাওয়াত দেওয়া প্রয়োজন সেখানে আড়ালে দেওয়া এবং যেখানে প্রকাশ্যে দেওয়া প্রয়োজন সেখানে প্রকাশ্যে দেওয়াও ফলপ্রসূ। এসবই হিকমতের অন্তর্ভুক্ত।
সদুপদেশের অর্থ- যাকে দাওয়াত দেওয়া হবে তার ইজ্জত-সম্মানের প্রতি লক্ষ রেখে তার কল্যাণ কামনার্থে হৃদয়গ্রাহী ভাষায় ও নম্রতার সাথে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করা, যাতে তার মনে নম্রতা আসে এবং দাওয়াত গ্রহণের জন্য সে প্রস্তুত হয়ে যায়।
الموعظة (মাও‘ইযা) শব্দটির মূল অর্থের মধ্যে কল্যাণকামিতার একটি দিকও আছে।কাজেই উপদেশ এমনভাবে দেওয়া চাই, যাতে ব্যক্তি মনে করে উপদেশদাতা আমার পরম কল্যাণকামী। তার উপদেশ আমার গ্রহণ করা উচিত। সুতরাং এমন কোনও শব্দ ব্যবহার করা বা এমন ভাব-ভঙ্গি অবলম্বন করা কিছুতেই উচিত হবে না, যা ব্যক্তিকে আহত করে বা সে নিজেকে অপমানিত বোধ করে। এতে নসীহত কেবল ব্যর্থই হয় না। বরং উল্টো ফল ফলে। যাদেরকে দাওয়াত দেওয়া হয় তারা সম্পূর্ণ বিগড়ে যায়। পরবর্তীতে অন্য কারও উপদেশেও কর্ণপাত করতে চায় না। এজন্যই মাও‘ইযার সাথে "হাসানা' বিশেষণ ব্যবহার করা হয়েছে। বোঝানো উদ্দেশ্য, নসীহত যেন অবশ্যই উত্তম পন্থায় হয় এবং যা-কিছু নসীহত গ্রহণের পক্ষে বাধা তা এড়িয়ে চলা হয়।
আর উৎকৃষ্ট পন্থায় বিতর্ক করার অর্থ- সত্যকে প্রতিষ্ঠা করা ও প্রতিপক্ষকে তা বোঝানোর নিয়তে সত্যনিষ্ঠার সাথে ভদ্রোচিত ভাষায় যথোপযুক্ত যুক্তি-তর্ক ও দলীল-প্রমাণ পেশ করা, প্রতিপক্ষের মনে আঘাত লাগতে পারে বা জিদ সৃষ্টি হতে পারে—এ জাতীয় আচরণ পরিহার করা এবং সর্বাবস্থায় মাত্রাবোধ ও ন্যায়-ইনসাফের পরিচয় দেওয়া।
উদ্দেশ্য যখন মানুষের সামনে সত্য প্রতিষ্ঠিত করা এবং তাদেরকে সত্যগ্রহণে উৎসাহিত করা, তখন বিতর্কের পন্থা অবশ্যই ন্যায়নিষ্ঠ হওয়া উচিত এবং হওয়া উচিত হৃদয়গ্রাহী। আল্লাহ তা'আলা তো হযরত মূসা আলাইহিস সালামের মত জালীলুল কদর নবীকে ফির'আউনের মত মহাপাপিষ্ঠ ব্যক্তির সামনে নম্র পন্থায় দাওয়াত পেশের হুকুম দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে-
فَقُولَا لَهُ قَوْلًا لَيِّنًا لَعَلَّهُ يَتَذَكَّرُ أَوْ يَخْشَى (44)
'তোমরা গিয়ে তার সাথে নম্র কথা বলবে। হয়ত সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা (আল্লাহকে) ভয় করবে। সূরা ত্বহা (২০), আয়াত ৪৪
এমনিভাবে আহলে কিতাবের সঙ্গে বিতর্ক করা সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-
وَلَا تُجَادِلُوا أَهْلَ الْكِتَابِ إِلَّا بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ
"(হে মুসলিমগণ!) কিতাবীদের সাথে বিতর্ক করবে না উত্তম পন্থা ছাড়া। সূরা আনকাবুত (২৯), আয়াত ৪৬
দীন ও শরী'আত সম্পর্কিত কোনও বিষয়ে বিতর্কের উদ্দেশ্য কেবলই দীন ও শরী'আতের সত্যতা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করা, নিজ যোগ্যতা ও শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করা নয়। তা জাহিরের চেষ্টা অহমিকার লক্ষণ ও সম্পূর্ণ নাজায়েয। নিজ শ্রেষ্ঠত্ব জাহিরের উদ্দেশ্যে দাওয়াতী মেহনত তো পরের কথা, 'ইলমে দীন শেখাই জায়েয নয়। এক হাদীছে ইরশাদ-
لاَ تَعَلَّمُوا الْعِلْمَ لِتُبَاهُوا بِهِ الْعُلَمَاءَ، وَلاَ لِتُمَارُوا بِهِ السُّفَهَاءَ، وَلاَ تَخَيَّرُوا بِهِ الْمَجَالِسَ، فَمَنْ فَعَلَ ذَلِكَ فَالنَّارُ النَّارُ
তোমরা এ উদ্দেশ্যে ইলম শিখবে না যে, এর মাধ্যমে উলামার সঙ্গে অহমিকা করে বেড়াবে বা অজ্ঞজনদের সঙ্গে ঝগড়ায় লিপ্ত হবে কিংবা এর মাধ্যমে উৎকৃষ্ট আসনে সমাসীন হবে। এমনটা যে করবে তার জন্য জাহান্নাম জাহান্নাম। সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ২৫৪; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ৭৭
মোটকথা, আল্লাহর পথে ডাকার জন্য দাঈকে কুরআন মাজীদে বর্ণিত এ তিনটি মূলনীতি অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে। দাওয়াত দেওয়া একটি উচ্চস্তরের দীনী কাজ। যে-কোনও দীনী কাজ কুরআন-হাদীছে বর্ণিত পন্থায় করাই বাঞ্ছনীয়। সেভাবে করলেই কৃতকার্যতা লাভের আশা থাকে। অন্যথায় সব মেহনত বেকার হয়ে যায়। আল্লাহ তা'আলা আমাদের সকলকে দা'ঈ হিসেবে কবুল করুন এবং তাঁর দেখানো পন্থায় দাওয়াতী মেহনতের তাওফীক দিন।
তিন নং আয়াত
وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى
অর্থ : তোমরা সৎকর্ম ও তাকওয়ার ক্ষেত্রে একে অন্যকে সহযোগিতা করবে। সূরা মায়িদা (৫), আয়াত ২
ব্যাখ্যা
الْبِرِّ বলা হয় ওই সকল কাজ করাকে, শরী'আতের পক্ষ থেকে যা করতে আদেশ করা হয়েছে, যথা- নামায পড়া, যাকাত দেওয়া, রোযা রাখা, হজ্জ করা, পর্দা করা, হালাল খাওয়া, পিতামাতার হুকুম মানা, বড়কে সম্মান করা, ছোটকে স্নেহ করা, আলেমদের মর্যাদা দেওয়া ইত্যাদি। আর التَّقْوَى হল ওই সকল কাজ থেকে বিরত থাকা, যা করতে শরী'আতে নিষেধ করা হয়েছে, যেমন- জুয়া খেলা, মাদক সেবন করা, চুরি করা, সুদ-ঘুষ খাওয়া, জুলুম করা, অমুসলিমদের অনুকরণ করা, নাচ, গান ও অশ্লীল কাজ করা ইত্যাদি। শরী'আতের যাবতীয় বিষয় এর মধ্যে এসে গেছে। এতে আমাদেরকে আদেশ করা হয়েছে, আমরা যেন করণীয় ও বর্জনীয় যাবতীয় বিষয়ে একে অন্যকে সাহায্য করি। এ সাহায্য হয় দীনী শিক্ষার প্রচার-প্রসারে ভূমিকা রাখার দ্বারা, বিশেষত মক্তব ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা, মক্তব ও মাদরাসায় শিক্ষকতা করা, দীনী পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা ও দাওয়াতী মেহনত পরিচালনা করার দ্বারা। এমনিভাবে আমলের প্রতি উৎসাহ দেওয়া এবং কারও আমলের পক্ষে যা-কিছু বাধা হয় তা অপসারণ করার দ্বারাও সৎকর্ম ও তাকওয়া অবলম্বনে সহযোগিতা করা হয়।
সমাজে এমন অনেক কিছুই চালু আছে, যার সংস্পর্শে এসে মানুষ সৎকর্মের উৎসাহ হারায় এবং অসৎকর্মে লিপ্ত হওয়ার উস্কানী পায়। সুতরাং সৎকর্ম ও তাকওয়া- পরহেযগারীতে সহযোগিতা করার জন্য সচেতন মহলের কর্তব্য শরী'আতবিরোধী কর্মকাণ্ডের দুনিয়াবী ও পরকালীন ক্ষতি সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করা এবং শরী আতবিরোধী কার্যকলাপের আখড়া ও কেন্দ্রসমূহ উৎখাতে নিয়মতান্ত্রিক প্রচেষ্টা চালানো। অনেক ক্ষেত্রে সন্তানের দীনদারীতে পিতামাতাও বাধা হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে পিতামাতাকে বোঝানোর চেষ্টা করাও অবশ্যকর্তব্য।
যেহেতু এ আয়াতে সৎকর্ম ও তাকওয়ার ক্ষেত্রে একে অন্যকে সাহায্য করতে আদেশ করা হয়েছে, তাই আপন আপন সামর্থ্য অনুযায়ী প্রত্যেকের জন্য এটা অবশ্যকরণীয়।
চার নং আয়াত
وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ
অর্থ : তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা চাই, যারা (মানুষকে) কল্যাণের দিকে ডাকবে।" সূরা আলে ইমরান (৩), আয়াত ১০৪
ব্যাখ্যা
এর আগের আয়াতে আল্লাহ তা'আলা মুসলিমগণকে আদেশ করেছিলেন- তারা যেন আল্লাহর রজ্জু তথা কুরআন মাজীদকে শক্ত করে ধরে রাখে এবং পরস্পর কলহ- বিবাদে লিপ্ত না হয়। তো আল্লাহর রশি মজবুত করে ধরে রাখা এবং পরস্পরের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য এটা জরুরি যে, উম্মতের মধ্যে এমন একটা দল সবসময় থাকবে, যারা তাদেরকে ওয়াজ-নসীহত ও আদেশ-উপদেশের মাধ্যমে এর প্রতি উৎসাহিত করবে। তারা এ কাজকে নিজেদের যিম্মাদারী হিসেবে গ্রহণ করবে আর সে হিসেবে নিজেদের কথা ও কাজ দ্বারা মানুষকে কুরআন-সুন্নাহ'র দিকে ডাকতে থাকবে। যখনই কাউকে গাফলাতি ও অসৎকর্মে লিপ্ত দেখতে পাবে, তখন সাধ্যমত তাদেরকে বোঝাবে এবং তা থেকে ফেরানোর চেষ্টা করবে।
বলাবাহুল্য, এ কাজ সকলের পক্ষে সম্ভব নয়। এটা কেবল তাদের পক্ষেই সম্ভব, যারা কুরআন ও সুন্নাহ সম্পর্কে অভিজ্ঞ, কোনটা সৎকাজ এবং কোটা অসৎকাজ সে সম্পর্কে ভালোভাবে জ্ঞাত এবং পরিবেশ-পরিস্থিতি সম্পর্কেও সচেতন। এরকম যোগ্যতা যাদের মধ্যে নেই, তাদের ওপর যিম্মাদারী অর্পণ করা হলে কিংবা তারা নিজেরাই এ যিম্মাদারী গ্রহণ করে নিলে ভালোর পরিবর্তে মন্দ ফল দেখা দেওয়ার আশঙ্কাই বেশি। হয় তারা ভালো কাজকে মন্দ মনে করে মানুষকে তা থেকে ফেরানোর চেষ্টা করবে অথবা মন্দ কাজকে ভালো মনে করে মানুষকে তা করতে উৎসাহ দেবে। কিংবা এমনও হতে পারে যে, নম্রতার স্থলে কঠোরতা বা কঠোরতার স্থলে নম্রতা অবলম্বন করবে। ফলে চেষ্টার কাঙ্ক্ষিত সুফল পাওয়া যাবে না কিংবা উল্টো ফলও ফলতে পারে। সম্ভবত এ কারণেই আয়াতে সকলের প্রতি এ যিম্মাদারী অর্পণ না করে বিশেষ এক দলকে এর জন্য মনোনীত করা হয়েছে, যে দলটি এ কাজের প্রয়োজনীয় যোগ্যতা রাখে।
এ আয়াতে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, যারা মানুষকে সত্য ও ন্যায়ের দিকে ডাকে তারা উম্মতের শ্রেষ্ঠ লোক। এ কারণেই আলাদাভাবে তাদের উল্লেখ করা হয়েছে।
উম্মতের একটি দলকে এ কাজে নিয়োজিত থাকার তাগিদ করার দ্বারা বোঝানো হচ্ছে যে, উম্মতের মধ্যে এমন একটি দল অবশ্যই থাকা চাই। অন্যথায় উম্মত তার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে অস্তিত্বের সংকটে পড়ে যাবে। বর্তমানে আমরা ব্যাপকভাবেই এ অবস্থা লক্ষ করছি।
উম্মতের একটি দলকে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের দায়িত্বে নিয়োজিত রাখার মূল দায়িত্ব সরকারের। সরকার এ দায়িত্ব পালন না করলে জনগণের উচিত হবে নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে একটা জামাতকে এ কাজে নিয়োজিত রাখা। জনগণও যদি এ ব্যাপারে উদাসীন থাকে, তখন উলামা-মাশায়েখের স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ দায়িত্ব পালন করা উচিত। বলাবাহুল্য, তারা আপন আপন স্থান থেকে এ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেনও। তবে তাদের সে চেষ্টার কাঙ্ক্ষিত সুফল পাওয়ার জন্য জরুরি ছিল জনগণের ব্যাপক সম্পৃক্ততা ও সরকারের সক্রিয় সহযোগিতা। কিন্তু সে সম্পৃক্ততা ও সহযোগিতার অভাব বড় প্রকট। বিষয়টি সকলের গভীরভাবে চিন্তা করা উচিত।
নেক কাজের পথ দেখানোর ফযীলত
হাদীছ নং: ১৭৩
হযরত আবূ মাস'উদ 'উকবা ইবন আমর আল-আনসারী আল-বাদরী রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি কোনও ভালো কাজের পথ দেখায়, তার জন্য রয়েছে সেই ভালো কাজটি সম্পাদনকারীর মত ছাওয়াব - মুসলিম। (সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৮৯৩; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৬৭১; সুনানে আবু দাউদ, হাদীছ নং ৫১২৯; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ২৪০)
হাদীছ নং: ১৭৩
হযরত আবূ মাস'উদ 'উকবা ইবন আমর আল-আনসারী আল-বাদরী রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি কোনও ভালো কাজের পথ দেখায়, তার জন্য রয়েছে সেই ভালো কাজটি সম্পাদনকারীর মত ছাওয়াব - মুসলিম। (সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৮৯৩; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৬৭১; সুনানে আবু দাউদ, হাদীছ নং ৫১২৯; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ২৪০)
20 - باب في الدلالة عَلَى خير والدعاء إِلَى هدى أَوْ ضلالة
قَالَ تَعَالَى: {وَادْعُ إِلَى رَبِّكَ} [القصص: 87]، وَقالَ تَعَالَى: {ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَة} [النحل: 125]، وَقالَ تَعَالَى: {وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى} [المائدة:2]، وَقالَ تَعَالَى: {وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ} [آل عمران:104].
قَالَ تَعَالَى: {وَادْعُ إِلَى رَبِّكَ} [القصص: 87]، وَقالَ تَعَالَى: {ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَة} [النحل: 125]، وَقالَ تَعَالَى: {وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى} [المائدة:2]، وَقالَ تَعَالَى: {وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ} [آل عمران:104].
173 - وعن أَبي مسعود عُقبةَ بنِ عمرو الأنصاري البدري - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ رسولُ الله - صلى الله عليه وسلم: «مَنْ دَلَّ عَلَى خَيْرٍ فَلَهُ مِثْلُ أجْرِ فَاعِلِهِ». رواه مسلم. (1)
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছটি মূলত মুসলিম শরীফে বর্ণিত একটি হাদীছের অংশ। এর শুরুতে আছে- এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বলল, আমার বাহন উটটি মারা গেছে। সুতরাং আমাকে একটি বাহন দিন। তিনি বললেন, আমার কাছে কোনও বাহন নেই। তখন অপর এক ব্যক্তি বলে উঠল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি তাকে এমন এক ব্যক্তির কথা বলে দিতে পারি, যে তাকে বাহন দিতে পারে। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ হাদীছটি ইরশাদ করেন।
এ হাদীছে জানানো হয়েছে, কেউ যদি কাউকে কোনও ভালো কাজের কথা বলে দেয়, তবে সে ব্যক্তি কাজটি করার দ্বারা যে ছাওয়াব পাবে, অনুরূপ ছাওয়াব ওই ব্যক্তিও পারে যে তাকে বলে দিল। যেমন, কোথাও একটি মসজিদ নির্মাণ হচ্ছে। মসজিদটির কাজ শেষ করার জন্য আরও অর্থের প্রয়োজন। এক ব্যক্তির একান্ত ইচ্ছা মসজিদের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ব্যয় করবে। কিন্তু তার সে সামর্থ্য নেই। এ অবস্থায় সে যদি কোনও সামর্থ্যবান ব্যক্তির কাছে গিয়ে মসজিদটির প্রয়োজন সম্পর্কে জানায় আর তাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে সে ব্যক্তি মসজিদে দান করে, তবে দান করার দ্বারা সে যে ছাওয়াব পাবে, অনুরূপ ছাওয়াব ওই ব্যক্তির আমলনামায়ও লেখা হবে, যে তাকে উদ্বুদ্ধ করল। এমনিভাবে কোনও ইয়াতীম, বিধবা, আর্ত ও অনাথ ব্যক্তির সাহায্য করতে ইচ্ছুক ব্যক্তি নিজে অসমর্থ হয়েও তাদেরকে সাহায্য করার ছাওয়াব পেতে পারে, যদি সে কোনও সামর্থ্যবানকে তাদের সাহায্য করার জন্য উদ্বুদ্ধ করে। তাতে সাহায্যকারী ব্যক্তির ছাওয়াব কিছুমাত্র কমবে না।
উৎসাহদাতা ও উদ্বুদ্ধকারী ব্যক্তিকে কাজটি সম্পাদনকারীর সমান ছাওয়াব দেবেন, না কম, নাকি বেশি তা আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছা। আল্লাহ তা'আলার ভান্ডারে কোনওকিছুর কমতি নেই। তিনি বান্দার সঙ্গে আচরণ করেন বান্দার ইখলাস অনুযায়ী। এটাও অসম্ভব নয় যে, ইখলাস না থাকার কারণে কার্যসম্পাদনকারী ব্যক্তি কোনও ছাওয়াব পেল না, অথচ ইখলাস থাকার কারণে উৎসাহদাতা পূর্ণ ছাওয়াব পেয়ে গেল। আল্লাহ তা'আলা তো কেবল নিয়তের কারণেও ছাওয়াব দিয়ে থাকেন। যেমন এক হাদীছে আছে-
وَعَبدٍ رَزَقَهُ اللهُ عِلْمًا, وَلَمْ يَرْزُقْهُ مَالاً, فَهُوَ صَادِقُ النِّيَّةِ, يَقُولُ: لَوْ أَنَّ لِي مَالاً لَعَمِلْتُ بِعَمَلِ فُلاَنٍ, فَهُوَ بِنِيَّتِهِ, فَأَجْرُهُمَا سَوَاءٌ
‘যে ব্যক্তিকে আল্লাহ ইলম দান করেছেন কিন্তু মাল দান করেননি, আর সে খালেস নিয়তে কামনা করে- যদি আমার কাছে মাল থাকত তাহলে আমিও অমুকের মতো কাজ করতাম (নেক কাজে খরচ করতাম), তো এ ব্যক্তি তার নিয়ত অনুযায়ী ছাওয়াব পাবে। সে এবং খরচকারী মালদার ব্যক্তি সমান ছাওয়াবের অধিকারী হবে।' (জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৩২৫)
এ হাদীছে স্পষ্টভাবেই উভয়ের ছাওয়াব সমান বলা হয়েছে। এ সমতার কারণ উভয়ের ইখলাস। আলোচ্য হাদীছ দ্বারাও বাহ্যত উভয়ে সমান ছাওয়াব পাবে বলেই বোঝা যায়। সাহায্যদাতা ও তার উৎসাহদাতা উভয়ে সমান ইখলাসের অধিকারী হলে এটাই স্বাভাবিক যে, তারা সমপরিমাণ ছাওয়াবের অধিকারী হবে। এটা আল্লাহ তা'আলার খাস রহমত যে, গরীব ও সামর্থ্যহীন লোকদের জন্যও তিনি নেকী পাওয়ার দরজা খোলা রেখেছেন। সামর্থ্যবান ব্যক্তি নেকী লাভ করতে পারে ইখলাসের সঙ্গে অর্থ ব্যয় করে, আর সামর্থ্যহীন ব্যক্তি তা পেতে পারে ইখলাসের সঙ্গে উৎসাহদানের মাধ্যমে। অবশ্য অর্থব্যয় যেমন একটি কাজ, তেমনি উৎসাহ দান করাও একটি কাজই বটে। এমনিভাবে অভাবী ব্যক্তিকে সামর্থ্যবান দাতার খোঁজখবর দেওয়াও একটি কাজ। তাই বলা যায় এ ক্ষেত্রেও ছাওয়াব হয় ইখলাসের সঙ্গে কাজ করার দ্বারা। কিন্তু উপরে যে হাদীছটি উল্লেখ করা হল সেখানে বাহ্যিক কোনও কাজও নেই। কেবল মনের আক্ষেপ ও নিয়তের দ্বারাই আল্লাহ তা'আলা কার্য সম্পাদনের ছাওয়াব দিয়ে দেন। সুবহানাল্লাহ! ছাওয়াব দানেও আল্লাহ তা'আলার রহমত কত অবারিত।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. যার সরাসরি কোনও ক্ষেত্রে অর্থব্যয়ের মাধ্যমে নেকী অর্জনের ক্ষমতা নেই, নেকী লাভের জন্য তার উচিত যার সে ক্ষমতা আছে তাকে সেক্ষেত্রে অর্থব্যয়ে উৎসাহ দেওয়া।
খ. কোনও অভাবগ্রস্ত বা দুঃখী ও পীড়িত ব্যক্তিকে নিজে সাহায্য করতে না পারলে অন্ততপক্ষে তাদেরকে এমন কোনও ব্যক্তির খোঁজখবর দেওয়া চাই, যে এরূপ লোকদের প্রতি দরদ রাখে এবং প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতাও করে।
এ হাদীছে জানানো হয়েছে, কেউ যদি কাউকে কোনও ভালো কাজের কথা বলে দেয়, তবে সে ব্যক্তি কাজটি করার দ্বারা যে ছাওয়াব পাবে, অনুরূপ ছাওয়াব ওই ব্যক্তিও পারে যে তাকে বলে দিল। যেমন, কোথাও একটি মসজিদ নির্মাণ হচ্ছে। মসজিদটির কাজ শেষ করার জন্য আরও অর্থের প্রয়োজন। এক ব্যক্তির একান্ত ইচ্ছা মসজিদের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ব্যয় করবে। কিন্তু তার সে সামর্থ্য নেই। এ অবস্থায় সে যদি কোনও সামর্থ্যবান ব্যক্তির কাছে গিয়ে মসজিদটির প্রয়োজন সম্পর্কে জানায় আর তাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে সে ব্যক্তি মসজিদে দান করে, তবে দান করার দ্বারা সে যে ছাওয়াব পাবে, অনুরূপ ছাওয়াব ওই ব্যক্তির আমলনামায়ও লেখা হবে, যে তাকে উদ্বুদ্ধ করল। এমনিভাবে কোনও ইয়াতীম, বিধবা, আর্ত ও অনাথ ব্যক্তির সাহায্য করতে ইচ্ছুক ব্যক্তি নিজে অসমর্থ হয়েও তাদেরকে সাহায্য করার ছাওয়াব পেতে পারে, যদি সে কোনও সামর্থ্যবানকে তাদের সাহায্য করার জন্য উদ্বুদ্ধ করে। তাতে সাহায্যকারী ব্যক্তির ছাওয়াব কিছুমাত্র কমবে না।
উৎসাহদাতা ও উদ্বুদ্ধকারী ব্যক্তিকে কাজটি সম্পাদনকারীর সমান ছাওয়াব দেবেন, না কম, নাকি বেশি তা আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছা। আল্লাহ তা'আলার ভান্ডারে কোনওকিছুর কমতি নেই। তিনি বান্দার সঙ্গে আচরণ করেন বান্দার ইখলাস অনুযায়ী। এটাও অসম্ভব নয় যে, ইখলাস না থাকার কারণে কার্যসম্পাদনকারী ব্যক্তি কোনও ছাওয়াব পেল না, অথচ ইখলাস থাকার কারণে উৎসাহদাতা পূর্ণ ছাওয়াব পেয়ে গেল। আল্লাহ তা'আলা তো কেবল নিয়তের কারণেও ছাওয়াব দিয়ে থাকেন। যেমন এক হাদীছে আছে-
وَعَبدٍ رَزَقَهُ اللهُ عِلْمًا, وَلَمْ يَرْزُقْهُ مَالاً, فَهُوَ صَادِقُ النِّيَّةِ, يَقُولُ: لَوْ أَنَّ لِي مَالاً لَعَمِلْتُ بِعَمَلِ فُلاَنٍ, فَهُوَ بِنِيَّتِهِ, فَأَجْرُهُمَا سَوَاءٌ
‘যে ব্যক্তিকে আল্লাহ ইলম দান করেছেন কিন্তু মাল দান করেননি, আর সে খালেস নিয়তে কামনা করে- যদি আমার কাছে মাল থাকত তাহলে আমিও অমুকের মতো কাজ করতাম (নেক কাজে খরচ করতাম), তো এ ব্যক্তি তার নিয়ত অনুযায়ী ছাওয়াব পাবে। সে এবং খরচকারী মালদার ব্যক্তি সমান ছাওয়াবের অধিকারী হবে।' (জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৩২৫)
এ হাদীছে স্পষ্টভাবেই উভয়ের ছাওয়াব সমান বলা হয়েছে। এ সমতার কারণ উভয়ের ইখলাস। আলোচ্য হাদীছ দ্বারাও বাহ্যত উভয়ে সমান ছাওয়াব পাবে বলেই বোঝা যায়। সাহায্যদাতা ও তার উৎসাহদাতা উভয়ে সমান ইখলাসের অধিকারী হলে এটাই স্বাভাবিক যে, তারা সমপরিমাণ ছাওয়াবের অধিকারী হবে। এটা আল্লাহ তা'আলার খাস রহমত যে, গরীব ও সামর্থ্যহীন লোকদের জন্যও তিনি নেকী পাওয়ার দরজা খোলা রেখেছেন। সামর্থ্যবান ব্যক্তি নেকী লাভ করতে পারে ইখলাসের সঙ্গে অর্থ ব্যয় করে, আর সামর্থ্যহীন ব্যক্তি তা পেতে পারে ইখলাসের সঙ্গে উৎসাহদানের মাধ্যমে। অবশ্য অর্থব্যয় যেমন একটি কাজ, তেমনি উৎসাহ দান করাও একটি কাজই বটে। এমনিভাবে অভাবী ব্যক্তিকে সামর্থ্যবান দাতার খোঁজখবর দেওয়াও একটি কাজ। তাই বলা যায় এ ক্ষেত্রেও ছাওয়াব হয় ইখলাসের সঙ্গে কাজ করার দ্বারা। কিন্তু উপরে যে হাদীছটি উল্লেখ করা হল সেখানে বাহ্যিক কোনও কাজও নেই। কেবল মনের আক্ষেপ ও নিয়তের দ্বারাই আল্লাহ তা'আলা কার্য সম্পাদনের ছাওয়াব দিয়ে দেন। সুবহানাল্লাহ! ছাওয়াব দানেও আল্লাহ তা'আলার রহমত কত অবারিত।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. যার সরাসরি কোনও ক্ষেত্রে অর্থব্যয়ের মাধ্যমে নেকী অর্জনের ক্ষমতা নেই, নেকী লাভের জন্য তার উচিত যার সে ক্ষমতা আছে তাকে সেক্ষেত্রে অর্থব্যয়ে উৎসাহ দেওয়া।
খ. কোনও অভাবগ্রস্ত বা দুঃখী ও পীড়িত ব্যক্তিকে নিজে সাহায্য করতে না পারলে অন্ততপক্ষে তাদেরকে এমন কোনও ব্যক্তির খোঁজখবর দেওয়া চাই, যে এরূপ লোকদের প্রতি দরদ রাখে এবং প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতাও করে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)


বর্ণনাকারী: