রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং:
নেক কাজে অগ্রগামী হওয়া এবং নেক কাজের প্রতি অভিমুখী ব্যক্তিকে উৎসাহ দেওয়া, যাতে সে দোদুল্যমানতা ত্যাগ করে দৃঢ়সংকল্পের সাথে তা শুরু করে দেয়।
আমলের জন্য সাতটি বড় বাধা
হাদীছ নং : ৯৩

হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা সাতটি জিনিস আসার আগে আগে দ্রুত আমলে লিপ্ত হও। তোমরা কি অপেক্ষা করছ এমন দারিদ্র্যের, যা সবকিছু ভুলিয়ে দেয়? না এমন প্রাচুর্যের, যা অবাধ্য করে তোলে? না এমন রোগব্যাধির, যা অথর্ব করে তোলে? না এমন বার্ধক্যের, যা বুদ্ধি লোপ করে দেয়? না আকস্মিক আগত মৃত্যুর? না দাজ্জালের- সে তো এমন নিকৃষ্টতম অনুপস্থিত, যার আত্মপ্রকাশের অপেক্ষা করা হচ্ছে? না কিয়ামতের, যে কিয়ামত কিনা অত্যন্ত বিভীষিকাময় ও অতি তিক্ত?' -তিরমিযী।
ইমাম তিরমিযী রহ. বলেন, এটি একটি হাসান হাদীছ।
(জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৩৬০)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ উম্মতকে আমলে যত্নবান হয়ে বর্তমান সময়কে কাজে লাগাতে উৎসাহ দিয়েছেন। বর্তমান সময়কে কাজে লাগানোই প্রকৃত বুদ্ধিমানের কাজ। ভবিষ্যতের অপেক্ষায় থাকা চরম নির্বুদ্ধিতা। কেননা বর্তমানে যে সুযোগ আছে, ভবিষ্যতেও যে তা পাওয়া যাবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। ভবিষ্যতে যে-কোনও কঠিন বাধা সামনে এসে দাঁড়াতে পারে। অনেক বাধা এমন আছে, যার সম্মুখীন হলে আমল করার কোনও উপায় থাকে না। এ হাদীছে মহানবী সাল্লাল্লাহু "আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেরকম সাতটি বাধা উল্লেখ করেছেন। নিচে আমরা ধারাবাহিকভাবে সে বাধাগুলো সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করছি।

আমলের পক্ষে একটি বাধা : অতি দারিদ্র্য

প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ হাদীছে বলেন, তোমরা কি ওই দারিদ্র্যের অপেক্ষা করছ, যা সবকিছু ভুলিয়ে দেয়? অর্থাৎ তোমরা আমলের দিকে ধাবিত হচ্ছ না কেন? কিসের অপেক্ষা করছ? বর্তমানে যে অবস্থায় আছ, এটাই তো আমলের শ্রেষ্ঠ সুযোগ। তা সত্ত্বেও আমলে মনোযোগ না দেওয়ার অর্থ দাঁড়ায় তোমরা এর বিপরীত কোন অবস্থার অপেক্ষায় আছ। কিন্তু তোমরা জান না সে অবস্থা কেমন হতে পারে? তা তো এমনও হতে পারে, যা তোমাদের আমলের পক্ষে কঠিন বাধা হয়ে দাঁড়াবে। সেরকম একটা অবস্থা হচ্ছে সীমাতিরিক্ত দারিদ্র্য। অর্থাৎ এমন অভাব- অনটনের সম্মুখীন হয়ে পড়া, যার ফলে জীবনরক্ষার অতি প্রয়োজনীয় অবলম্বন জোগাড় করাও কঠিন হয়ে যায়। না ক্ষুধা নিবারণের মত খাদ্যসংগ্রহ সম্ভব হয়, আর না শরীর ঢাকার মত পোশাক। কিংবা কোথায় থাকবে সেই জায়গাও জুটছে না। এরকম অবস্থায় মানুষের একমাত্র চিন্তা হয়ে দাঁড়ায় সে কিভাবে তার ক্ষুধা মেটাবে, কোথায় পাবে শরীর ঢাকার কাপড় কিংবা কোথায় গিয়ে সে মাথা গুঁজবে। জীবনের এমন ন্যূনতম চাহিদা মেটানোর চিন্তায় যে অস্থির হয়ে থাকে, তার পক্ষে আমলে মনোযোগ দেওয়া কিভাবে সম্ভব? নফল তো পরের কথা, ফরয আমলসমূহ করাই তার পক্ষে মুশকিল হয়ে যায়। এমনকি অনেক সময় সীমাতিরিক্ত দারিদ্র্য মানুষের ঈমান-আকীদার জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।
ঈমান যার মজবুত নয়, সীমাতিরিক্ত দারিদ্র্যের কারণে সে অন্যের সুখসাচ্ছন্দ্য দেখে ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়ে। কখনও নিজ তাকদীরের উপর প্রশ্ন তোলে। আল্লাহ তা'আলা তাকে যে অবস্থায় রেখেছেন তাতে সন্তুষ্ট হতে পারে না। তাকদীরে সন্তুষ্ট না হওয়া কঠিন গুনাহ এবং আপত্তি তোলা তো সম্পূর্ণ ঈমানবিরোধী। তাহলে দেখা যাচ্ছে সীমাতিরিক্ত দারিদ্র্যের কবলে পড়লে মানুষ ‘ইবাদত-বন্দেগীর কথা ভুলে যায়। অর্থাৎ ‘ইবাদত-বন্দেগী করার মত সুযোগ ও মনমানসিকতা থাকে না। এমনকি ভুলে যায় ঈমান-আকীদা হেফাজত করার কথাও। তাই এ হাদীছে বলা হয়েছে- তোমরা কি ওই দারিদ্র্যের অপেক্ষা করছ, যা সবকিছু ভুলিয়ে দেয়?
প্রকাশ থাকে যে, দারিদ্র্য যদি সীমাতিরিক্ত না হয়; বরং সাধারণ পর্যায়ে থাকে, তবে তা আল্লাহ তা'আলার অনেক বড় নি'আমত। কেননা এ অবস্থায় অন্তরে ধনসম্পদের লোভলালসা কম থাকে। অন্যের সঙ্গে দুনিয়াদারীর প্রতিযোগিতা করার মনোভাব থাকে না; বরং মন আখিরাতমুখী থাকে ও অন্তরে আল্লাহর স্মরণ বিরাজ করে। ফলে 'ইবাদত-বন্দেগীতে মন দেওয়া সহজ হয় ও বেশি বেশি আল্লাহর যিকরে লিপ্ত থাকা যায়। এজন্যই বলা হয়ে থাকে, দারিদ্র্য নবীগণের ভূষণ ও ওলী-বুযুর্গদের বসন।
হাদীছে দারিদ্র্য ও দরিদ্রদের প্রশংসা করা হয়েছে। এক হাদীছে বলা হয়েছে- গরীবগণ ধনীদের পাঁচশ' বছর আগে জান্নাতে যাবে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের জন্য গরীবী অবস্থাকে বেছে নিয়েছিলেন। হযরত আনাস রাযি. বর্ণিত এক হাদীছে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম দু'আ করতেন-

اللهُمَّ أَحْيِنِي مِسْكِينًا, وَأَمِتْنِي مِسْكِينًا, وَاحْشُرْنِي فِي زُمْرَةِ المَسَاكِينِ يَوْمَ القِيَامَةِ

“হে আল্লাহ! আমাকে গরীবরূপে বাঁচিয়ে রাখ, গরীবরূপে আমার মৃত্যু দাও এবং কিয়ামতের দিন গরীবদের দলে আমার হাশর কর।”
এ দু'আ শুনে উম্মুল মু'মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু “আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলেন। তিনি বললেন, গরীবগণ ধনীদের চল্লিশ বছর আগে জান্নাতে প্রবেশ করবে। হে আয়েশা! কোনও মিসকীনকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিও না। একটা খেজুরের অংশ হলেও দিও। হে আয়েশা! মিসকীনদের ভালোবাসবে এবং তাদেরকে কাছে টানবে। তাহলে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তোমাকে কাছে রাখবেন।জামে তিরমিী, হাদীছ নং ২৩৫২। সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৪১২৭: বায়হাকী, হাদীছ নং ১৩১৫১; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীছ নং ৭৯১১
দেখা যাচ্ছে একদিকে হাদীছে দারিদ্র্যের প্রশংসা করা হয়েছে, অপরদিকে আলোচ্য হাদীছে দারিদ্র্যকে আমলের জন্য বাধা বলা হয়েছে। মূলত এ দুই কথার মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। কেননা প্রশংসা করা হয়েছে সে দারিদ্র্যের, যা স্বাভাবিক ও সাধারণ পর্যায়ের দারিদ্র্য। অর্থাৎ সাদামাটাভাবে বেঁচে থাকার জন্য যতটুকু সম্পদ দরকার তা থাকা। এ পরিমাণ সম্পদ যার থাকে তাকে কেউ ধনী বলে না। সে গরীবই। এবং এ পর্যায়ের গরীব থাকা দীন ও ঈমান রক্ষার পক্ষে সহায়ক। পক্ষান্তরে যে দারিদ্র্যকে ঈমান-আমলের জন্য বাধা বলা হয়েছে তা হচ্ছে সীমাতিরিক্ত দারিদ্র্য। অর্থাৎ প্রাণরক্ষার মত উপায়-অবলম্বনও না থাকা, যেমনটা উপরে বলা হয়েছে। প্রত্যেকের উচিত সেরকম কঠিন অভাব-অনটনে যাতে পড়তে না হয় সে ব্যাপারে সচেষ্ট থাকা এবং নেক কাজে যত্নবান থেকে পরকালীন সফলতা লাভের চেষ্টা করা।
আমলের পক্ষে দ্বিতীয় বাধা : অতিরিক্ত ধনসম্পদ
আমলের প্রতি উৎসাহ দিতে গিয়ে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ হাদীছে দ্বিতীয় যে বাধার উল্লেখ করেছেন তা হচ্ছে অতিরিক্ত ধনসম্পদ। তিনি ইরশাদ করেন- أو غنى مطغيا “তোমরা কি অপেক্ষা করছ ওই প্রাচুর্যের, যা অবাধ্য করে তোলে”? مطغيا শব্দটির উৎপত্তি الطغيان থেকে, যার অর্থ উদ্ধত্য ও অবাধ্যতা। مطغيا মানে ঔদ্ধত্য ও অবাধ্যতায় লিপ্তকারী। অতি ধনাঢ্যতা মানুষকে শরী'আতের অবাধ্য করে তোলে। এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম সে কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তিনি বোঝাতে চাচ্ছেন, তোমরা কি অপেক্ষা করছ ওই প্রাচুর্যের, যা মানুষকে শরী'আতের বিধানাবলির প্রতি অবাধ্য করে তোলে? অর্থাৎ এখন তো মনে করছ তোমার যে সম্পদ আছে তা পর্যাপ্ত নয়। এ দিয়ে কোনওমতে জীবনযাপন করা গেলেও অন্যদের মত আরাম-আয়েশ করতে হলে আরও টাকা দরকার। তাছাড়া ভবিষ্যৎ রয়েছে, তখন আরামে থাকতে হলে আরও উপার্জন করা চাই। সুতরাং এখন সময়টা হচ্ছে উপার্জনের। বেশি ইবাদত-বন্দেগী করতে গেলে উপার্জন বাধাগ্রস্ত হবে। কাজেই এখন উপার্জন করি, বেশি ইবাদত-বন্দেগী ভবিষ্যতে করা যাবে। প্রকৃতপক্ষে তোমাদের এ ধারণা ভুল। টাকাপয়সা বেশি হলে তখন নিশ্চিন্তে বসে 'ইবাদত-বন্দেগী করতে পারবে- এটা মনের ধোঁকা। কেননা টাকাপয়সা বেশি হলে প্রতিযোগিতার মনোভাব এসে যায়। তখন একদিকে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা থাকে, অন্যদিকে নিজের চেয়ে যাদের টাকাপয়সা কম তাদেরকে হেয় মনে করা হয়। তখন অন্তরে অহংকার বাসা বাঁধে।
প্রতিযোগিতার মনোভাব ও অহংকার- উভয়ই মানুষকে শরী'আতের প্রতি অবাধ্য করে তোলে। অতীতের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সবকালেই যারা আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়েছে ও শরী'আত অমান্য করেছে তাদের অধিকাংশই ছিল ধনী শ্রেণির লোক। যার যতবেশি ধন ছিল, সেই ততবেশি নাফরমানী করেছে এবং পরিণামে আল্লাহর আযাব ও গযবের শিকার হয়েছে। বর্তমানকালেও চারদিকে লক্ষ করলে দেখা যাবে যারা অনেক বেশি টাকাওয়ালা, তুলনামূলকভাবে তারাই বেশি জোরজুলুম ও অন্যায়-অনাচারে লিপ্ত। অর্থসম্পদের বিপুলতা তাদেরকে আখিরাত থেকে বিমুখ করে রেখেছে। তাদের সমস্ত দৌড়ঝাপ আরও বেশি ধনসম্পদ অর্জনের পেছনে। টাকার ক্ষুধা তাদের কিছুতেই মেটে না। ফলে ‘ইবাদত-বন্দেগীতে মনোযোগ দেওয়ার সুযোগও তাদের হয় না। বস্তুত দারিদ্র্য অপেক্ষা ঐশ্বর্য মানুষের দীন ও ঈমানের পক্ষে বেশি ক্ষতিকর। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

كَلَّا إِنَّ الْإِنْسَانَ لَيَطْغَى (6) أَنْ رَآهُ اسْتَغْنَى (7)

অর্থ : সাবধান! নিশ্চয়ই মানুষ ঔদ্ধত্যে লিপ্ত হয়ে পড়ে, যখন সে নিজেকে ঐশ্বর্যবান দেখে।সূরা 'আলাক, আয়াত ৬-৭
এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

فَوَاللَّهِ لاَ الفَقْرَ أَخْشَى عَلَيْكُمْ، وَلَكِنْ أَخَشَى عَلَيْكُمْ أَنْ تُبْسَطَ عَلَيْكُمُ الدُّنْيَا كَمَا بُسِطَتْ عَلَى مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ، فَتَنَافَسُوهَا كَمَا تَنَافَسُوهَا وَتُهْلِكَكُمْ كَمَا أَهْلَكَتْهُ

“আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের ব্যাপারে দারিদ্র্যের ভয় করি না। বরং আমি ভয় করি যে, তোমাদের জন্য দুনিয়া (এর ধনসম্পদ) প্রশস্ত করে দেওয়া হবে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিসমূহের জন্য প্রশস্ত করে দেওয়া হয়েছিল। অতঃপর তোমরা এর আসক্তিতে পরস্পর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে, যেমন প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিল তারা। ফলে এ দুনিয়া তোমাদের ধ্বংস করে দেবে, যেমন ধ্বংস করে দিয়েছিল তাদেরকে। সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৩১৫৮; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৯৬১; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৩৯৯৮; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৪৬২: বায়হাকী, হাদীছ নং ১৮৬৫৮; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১০৯৫৮
প্রকাশ থাকে যে, অতিরিক্ত ধনসম্পদ যে মানুষের দীন ও ঈমানের ক্ষতি করে, এটা সাধারণ অবস্থা। এর ব্যতিক্রমও আছে। বিভিন্ন সময় দেখা গেছে অনেক বড় বড় ধনী ‘ইবাদত-বন্দেগী ও দীনী কাজে অন্যদের ছাড়িয়ে গেছে। সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে হযরত ‘উছমান গনী রাযি. এর শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত। বর্তমানেও কোনও কোনও ধনীকে দেখা যায়, ধনের মোহ তাকে দীন থেকে দূরে রাখতে পারেনি। মূলত এটা ঈমানের দৃঢ়তার উপর নির্ভর করে। ঈমান যার বেশি শক্তিশালী, ধন তাকে ঈমানী কাজকর্ম থেকে দূরে সরাতে পারে না। কিন্তু সেরকম শক্ত ঈমানের লোক বড় কম। আমাদের মত সাধারণ লোকদের পক্ষে অতি ধন ও অতি দারিদ্র্য অপেক্ষা মাঝামাঝি অবস্থাই বেশি নিরাপদ।

আমলের পক্ষে তৃতীয় বাধা : কঠিন রোগব্যাধি

أو مرضا مفسدا “না এমন রোগব্যাধির, যা অথর্ব করে তোলে?” مفسد শব্দটির উৎপত্তি الفساد থেকে, যার অর্থ নষ্ট, বিলোপ, বিনাশ, বিকৃতি ইত্যাদি। مفسد মানে নষ্ট ও লোপকারী। এমন অনেক রোগ আছে, যা মানুষের শরীর সম্পূর্ণ নষ্ট করে দেয় এবং বিবেকবুদ্ধির বিলোপ ঘটায়। সেরকম রোগ দেখা দিলে মানুষের পক্ষে কোনও ‘ইবাদত- বন্দেগী ভালোভাবে আদায় করা কিংবা একেবারেই আদায় করা সম্ভব হয় না। তাই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ হাদীছে বলছেন, (তোমরা যে 'ইবাদত- বন্দেগীতে লিপ্ত হচ্ছ না) তবে কি এমন রোগব্যাধির অপেক্ষা করছ, যা শরীর-মন সব নষ্ট করে দেয়?
বস্তুত সুস্বাস্থ্য মানুষের পক্ষে অনেক বড় নি'আমত। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই এ নি'আমতের মূল্য বোঝে না এবং এর শোকর আদায় করে না। যে-কোনও নি'আমতেরই দাবি- তার জন্য আল্লাহর শোকর আদায় করা। শোকর আদায় করলে আল্লাহ সে নি'আমত আরও বেশি বেশি দেন। আর তা না করলে আল্লাহর আযাব নেমে আসে। সুস্বাস্থ্য যখন একটা বড় নি'আমত, তখন এর জন্যও শোকরগুযার হওয়া দরকার। কিন্তু আমরা অধিকাংশই এ নি'আমতের শোকর আদায় করি না; বরং একে অবহেলায় নষ্ট করি। দরকার ছিল স্বাস্থ্য যখন ভালো থাকে, তখন 'ইবাদত-বন্দেগীতে মনোযোগী হওয়া। কিন্তু আমরা তা করি না। আমরা বরং তখন ফুর্তি করে সময় কাটাই। ‘ইবাদতে গড়িমসি করি। ভাবটা এমন যে, এ স্বাস্থ্য চিরদিন থাকবে, পরে আমার ইচ্ছামত কখনও 'ইবাদত করে নেব। কিন্তু কারও স্বাস্থ্যই চিরদিন থাকে না। একসময় রোগব্যাধি ঘিরে ধরে। শরীর ও মন নষ্ট হয়ে যায়। তখন হয়তো ইবাদতের ইচ্ছাই হয় না। আর ইচ্ছা হলেও শরীর সায় দেয় না। তখন কেবল আফসোসই করা যায়। কিন্তু সময় হারিয়ে সে আফসোসের কী ফায়দা? তাই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক হাদীছে ইরশাদ করেন-

" نِعْمَتَانِ مَغْبُونٌ فِيهِمَا كَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ: الصِّحَّةُ وَالْفَرَاغُ"

“দু'টি নি'আমত এমন, যাতে বহুলোক লোকসানের মধ্যে আছে। তার একটি হল সুস্বাস্থ্য, অন্যটি অবসর।সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬৪১২: জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৩০৪: সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৪১৭০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২৩৪০
অর্থাৎ যার স্বাস্থ্য ভালো তার উচিত ছিল এটাকে এক মূল্যবান পুঁজি মনে করা আর এ পুঁজি খাটিয়ে কতবেশি লাভবান হওয়া যায় সে চেষ্টা করা। মু'মিন ব্যক্তির প্রকৃত লাভ সেটাই, যা আখিরাতে কাজে আসে। কাজেই মু'মিন ব্যক্তি তার ‘সুস্বাস্থ্য' নামক পুঁজি খাঁটিয়ে বেশি বেশি পুণ্য অর্জনের চেষ্টা করবে, যাতে আখিরাতের জীবনে সফলতা লাভ করতে পারে।
সুস্বাস্থ্য দ্বারা পুণ্য অর্জনের উপায় হচ্ছে বেশি বেশি ইবাদত-বন্দেগী করা। সে “ইবাদত যেমন নামায-রোযা ইত্যাদি হতে পারে, তেমনি হতে পারে ‘খেদমতে খালক'। স্বাস্থ্য যখন ভালো থাকে, তখন সৃষ্টির সেবা করে অনেক বেশি পুণ্যার্জন করা যায়। একজন স্বাস্থ্যবান ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব রোগীর সেবাযত্ন করা, বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানো, মানুষের মাথায় বোঝা তুলে দেওয়া বা বোঝা নামানো, দুর্যোগ-কবলিত স্থানে ছুটে গিয়ে ত্রাণ তৎপরতা ও উদ্ধারকর্মে লিপ্ত হওয়া ইত্যাদি। স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে এ জাতীয় ছাওয়াবের কাজ করা কিছুতেই সম্ভব হয় না। কিন্তু আমরা বড় উদাসীন। স্বাস্থ্য যখন ভালো থাকে, তখন সৃষ্টিসেবার কথা চিন্তা না করে আপন ধান্দায় ডুবে থাকি। এছাড়া অন্যান্য নেক কাজেও মন বড় কম দিই। এভাবে সুস্বাস্থ্যের নি'আমত দ্বারা আখিরাতের যে মুনাফা অর্জন করা সম্ভব ছিল তা করি না।
ওদিকে স্বাস্থ্য তো একভাবে থাকে না। বয়স বাড়তে থাকে, আর বিভিন্ন রকমের রোগব্যাধিও শুরু হয়ে যায়। পুঁজি নষ্ট হতে থাকে। মুনাফা তো অর্জন করাই হয় না; একসময় মূলধনও শেষ হয়ে যায়। এটা কত বড়ই না লোকসান! এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেদিকেই উম্মতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, যাতে তারা সুস্বাস্থ্যের নি'আমত কাজে লাগায় এবং লোকসান থেকে বেঁচে থাকে।
সুস্থ অবস্থাকে সৎকাজে লাগালে তার একটা বাড়তি লাভও আছে। তা হচ্ছে- অসুস্থ অবস্থায় যখন নেক কাজ করা সম্ভব হয় না, তখন সুস্থ অবস্থায় যে সমস্ত নেক কাজ করা হত, আল্লাহ তা'আলার দয়ায় তার আমলনামায় সে সমস্ত নেক কাজের ছাওয়াব লেখা হতে থাকে। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

إِنَّ الْعَبْدَ إِذَا كَانَ عَلَى طَرِيقَةٍ حَسَنَةٍ مِنَ الْعِبَادَةِ ، ثُمَّ مَرِضَ ، قِيلَ لِلْمَلَكِ الْمُوَكَّلِ بِهِ : اكْتُبْ لَهُ مِثْلَ عَمَلِهِ إِذَا كَانَ طَلِيقًا ، حَتَّى أُطْلِقَهُ ، أَوْ أَكْفِتَهُ إِلَيَّ

“বান্দা যখন সুস্থ অবস্থায় কোনও ভালো তরিকার উপর থাকে অর্থাৎ বিশেষ কোনও ইবাদতে প্রতিষ্ঠিত থাকে, তারপর সে অসুস্থ হয়ে যায়, তখন তার দায়িত্বে নিযুক্ত ফিরিশতাকে বলা হয়- তার আমলনামায় ওই সমস্ত আমলের মত আমল লিখে দাও, যা সে সুস্থ অবস্থায় করত, যতক্ষণ না আমি তাকে সুস্থ করে দিই কিংবা তাকে আমার কাছে নিয়ে আসি”।মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৬৮৯৫; সুনানে বায়হাকী, হাদীছ নং ৬৫৪৬; শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ১৪২৮
পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি সুস্থ অবস্থায় ইবাদত-বন্দেগী করে না সে যখন অসুস্থ হয়ে পড়ে, তখন সে দুইরকম ক্ষতির শিকার হয়। এক তো সে তখন ইবাদত-বন্দেগী করতে পারে না, যার ছাওয়াব থেকে সে বঞ্চিত হয়ে যায়। অপরদিকে সুস্থ অবস্থায় ইবাদত- বন্দেগী না করার কারণে অসুস্থ অবস্থায় সুস্থকালীন যে ইবাদত-বন্দেগীর ছাওয়াব লেখা হতে পারত তাও লেখা হয় না। এটা কত বড়ই না মাহরূমী!
উম্মত যাতে এ বহুবিধ ক্ষতি থেকে বেঁচে যায়, তাই আলোচ্য হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বর্তমান সময়কে অর্থাৎ স্বাস্থ্য ভালো থাকা অবস্থায় ‘ইবাদত-বন্দেগীতে মনোযোগ দেওয়ার জন্য উৎসাহ দিয়ে বলছেন- তোমরা কেন “ইবাদত-বন্দেগীতে লিপ্ত হচ্ছ না? স্বাস্থ্য ভালো থাকা সত্ত্বেও যে বেশি বেশি ‘ইবাদত করছ না, তা কিসের অপেক্ষায়? তবে কি তোমরা এমন রোগব্যাধির অপেক্ষা করছ, যা তোমাদের শরীর-মন সব নষ্ট করে দেবে? বাস্তবিকপক্ষে তা-ই যদি হয়, অর্থাৎ তোমরা কঠিন রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়, তখন তো তোমাদের পক্ষে কোনও 'ইবাদত করাই সম্ভব হবে না। সুতরাং সময় নষ্ট না করে এখনই নেক আমলের দিকে ধাবিত হও। কে কত বেশি নেক আমল করতে পার সেই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে পড়।

আমলের পক্ষে চতুর্থ বাধা : অতি বার্ধক্য

اوهرما مفندا؟ “নাকি বুদ্ধিনাশা বার্ধক্যের?” هرم মানে অতি বার্ধক্য। مفند শব্দটির উৎপত্তি الفند থেকে। الفند এর অর্থ মিথ্যা, ভ্রম, বিস্মৃতি। مفند মানে বিস্মৃতি ও বিভ্রম সৃষ্টিকারী। অতি বার্ধক্য মানুষের স্মৃতিনাশ ঘটায়। কেউ যখন অতিরিক্ত বৃদ্ধ হয়ে পড়ে তখন কোনওকিছুই মনে থাকে না। এরূপ অবস্থায় মানুষ ঠিকভাবে 'ইবাদত-বন্দেগী করতে পারে না। একটা করতে গিয়ে আরেকটা করে ফেলে। সব ভুল হয়ে যায়। কাজেই অতি বার্ধক্য ইবাদত-বন্দেগীর জন্য একটি বড় বাধা। নবী কারীম সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ হাদীছে সে কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
বস্তুত যৌবন ও তারুণ্য মানুষের জন্য আল্লাহ তা'আলার এক বিরাট দান। যৌবনশক্তিকে কাজে লাগিয়ে মানুষের পক্ষে অনেক বড় বড় কাজ করা সম্ভব। মানুষের আপন সম্ভাবনার বিকাশ ও জাতীয় উন্নতি সাধনে এ শক্তি বিশাল ভূমিকা রাখতে পারে। যদি সহীহ নিয়তের সঙ্গে সে ভূমিকা রাখা যায়, তাহলে তা দ্বারা আখিরাতের এত উচ্চমর্যাদা লাভ করা সম্ভব, যা অন্যদের পক্ষে রীতিমত ঈর্ষার ব্যাপার হয়ে যায়। ইসলামের ইতিহাসে এমন বহু মহান যুবকের সাক্ষাৎ মেলে, যাঁদের সুকীর্তি যুগের পর যুগ মানুষকে আপন জীবন কর্মময় করে তোলার প্রেরণা জুগিয়ে আসছে। এর পাশাপাশি এমনসব যুবকেরও সন্ধান পাওয়া যায়, যাদের কুকীর্তি ইতিহাসের বিভীষিকা হয়ে আছে। বস্তুত যৌবন এমনই এক শক্তি, যার সদ্ব্যবহার দ্বারা মানুষ উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে যেতে পারে। অপরদিকে যদি এর অসদ্ব্যবহার করা হয়, তবে তা মানুষের অধঃপতন ঘটিয়ে তাকে এমন পর্যায়ে নামিয়ে দিতে পারে, যেখানে নামা কোনও পশুর পক্ষেও সম্ভব নয়। সে অধঃপতনে মানুষের দুনিয়া-আখিরাত সবই বরবাদ হয়ে যায়। তা থেকে আত্মরক্ষার জন্য প্রত্যেকের কর্তব্য যৌবনকালকে আল্লাহর 'ইবাদত-বন্দেগীর ভেতর কাটিয়ে দেওয়া।
যৌবনকালের ইবাদত-বন্দেগী অনেক বেশি মূল্যবান। এক হাদীছ দ্বারা জানা যায়, যে ব্যক্তি তার যৌবনকালকে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগীর ভেতর কাটায়, হাশরের ময়দানে সে আল্লাহর আরশের ছায়াতলে জায়গা পাবে। কিন্তু আমরা বড় গাফেল। যেখানে দরকার ছিল যৌবনকালকে বেশি বেশি ছাওয়াব অর্জনের কাজে ব্যয় করা, সেখানে আমরা এ সময়টাকে ফুর্তির ভেতর নষ্ট করে দিই। মনে করি ইবাদত-বন্দেগী এ সময়কার কাজ নয় । এটা বৃদ্ধ বয়সের কাজ। এটা কত বড়ই না ভুল ধারণা। বার্ধক্য যখন আসে, তা তার সব পারিপার্শ্বিকতা নিয়েই আসে। তখন শরীর-মন জরাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

وَمَنْ نُعَمِّرْهُ نُنَكِّسْهُ فِي الْخَلْقِ أَفَلَا يَعْقِلُونَ (68)

অর্থ : আমি যাকে দীর্ঘায়ু দান করি, গঠনগতভাবে তাকে উল্টিয়ে দেই। তথাপি কি তারা উপলব্ধি করবে না?সূরা ইয়াসীন, আয়াত ৬৮
মানুষ যখন অত্যধিক বৃদ্ধ হয়ে যায় তখন তার শক্তিসমূহ নিঃশেষ হয়ে যায়। তার আর দেখার, শোনার, বলার ও বোঝার মত ক্ষমতা থাকে না। থাকলেও তা এতই সামান্য, যা বিশেষ কাজে আসে না। একদম শিশুর মত হয়ে যায়। ফলে এ সময় সে সম্পূর্ণ নিষ্কর্মা হয়ে পড়ে। না ইবাদত-বন্দেগী করার মত মন থাকে, না থাকে সেই শক্তি। উপরন্তু সে তখন অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। শিশু যেমন নিজে নিজের কিছুই করতে পারে না, তার সবকিছু অন্যকে করে দিতে হয়, তেমনি অতিবৃদ্ধ ব্যক্তিরও সবকিছু অন্যকে করে দিতে হয়।
মোটকথা, অতিরিক্ত বৃদ্ধ হয়ে পড়লে তখন কোনওরকম নেক কাজ করা সম্ভব হয় না। অথচ নেক কাজ সকলের জন্যই জরুরি। এটা আখিরাতের পাথেয়। অতিরিক্ত বার্ধক্যে যখন সে পাথেয় সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না, তখন তার আগেই যৌবনকালেই তা অর্জন করে নেওয়া উচিত।
এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সে উৎসাহই উম্মতকে দিয়েছেন। তিনি আমাদের সতর্ক করে বলছেন- যুবক থাকা অবস্থায়ও যে বেশি বেশি ইবাদত করছ না, তা তোমরা কিসের অপেক্ষায় আছ? বৃদ্ধকালের? তোমরা ভাবছ বৃদ্ধকালে ইবাদত-বন্দেগীতে মন দেবে, তখন বেশি বেশি নেক কাজ করবে? এটা বৃথা ভাবনা। তখন কিছুই করতে পারবে না। যা করার এখনই করে নাও। বার্ধক্য এক কঠিন অবস্থা। তখন কোনও নেক কাজ তো করতে পারবেই না, উল্টো তোমার জীবনটাই একটা বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়াটা কিছু মর্যাদাকর বিষয় নয়। তা থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাওয়া উচিত। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও অতি বার্ধক্য হতে আল্লাহর কাছে পানাহ চাইতেন।

আমলের পক্ষে পঞ্চম বাধা : আকস্মিক মৃত্যু

اوموتا مجهزا؟ “নাকি আকস্মিক মৃত্যুর"? مجهز শব্দটির উৎপত্তি جهز থেকে। এর অর্থ দ্রুত সম্পাদন করা। বলা হয়ে থাকে, جهز و اجهز على الجريح অর্থাৎ আহত ব্যক্তির হত্যাকার্য দ্রুত সম্পাদন করল। সে হিসেবে مجهز মানে দ্রুত সম্পাদনকারী। আকস্মিক মৃত্যুকে বলা হয়েছে এ কারণে যে, তা এমন দ্রুততার সাথে ব্যক্তির জীবনাবসান ঘটায় যে, সে তাওবা করা, অসিয়ত করা ইত্যাদি কোনও কিছুরই সুযোগ পায় না। অথবা এর দ্বারা যৌবনকালে মৃত্যু হয়ে যাওয়া বোঝানো হয়েছে। মানুষের আশা থাকে, সে অনেক বয়স পেয়ে মারা যাবে। যখন সে আশা পূরণ হয় না এবং যৌবনকালেই মারা যায়, তখন বলা হয়- সে খুব তাড়াতাড়ি মারা গেল এবং মৃত্যু খুব অল্পদিনেই তার জীবন শেষ করে দিল। مجهز এর এক অর্থ سريع । অর্থাৎ যা অতি শীঘ্র ঘটে যায়। যে মৃত্যু যৌবনকালে হয় বা যে মৃত্যু হঠাৎ করেই হয়ে যায়, তাকে الموت المجهز বলে। আকস্মিক মৃত্যুকে موت الفجأة -ও বলা হয়ে থাকে।
বস্তুত আল্লাহ তা'আলা মানুষকে একটা সীমিত সময়ের জন্য এ দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। সে সময় যখন ফুরিয়ে যাবে, তখন প্রত্যেককেই মৃত্যুবরণ করতে হবে।মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মানুষের আমল করার সুযোগ থাকে। মৃত্যু দ্বারা যেমন ইহজীবনের সমাপ্তি হয়, তেমনি আমলেরও পরিসমাপ্তি ঘটে। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-

" إِذَا مَاتَ الْإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلَّا مِنْ ثَلَاثَةٍ: إِلَّا مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ، أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ، أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ "

“মানুষ যখন মারা যায় তার আমল বন্ধ হয়ে যায়। তবে তিনটি আমল ব্যতিক্রম।

ক. সদাকায়ে জারিয়া;

খ. এমন ইলমের প্রচার, যা দ্বারা মানুষ উপকৃত হয়;

গ. নেক সন্তান, যে তার জন্য দু'আ করবে (অর্থাৎ এ তিনটির ছাওয়াব মৃত্যুর পরও জারি থাকে)।”সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৬৩১; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৩৬৫১; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৩৭৬; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ২৪২; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ২৮৮০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৮৮৪৪
কার কখন আয়ু ফুরাবে কেউ জানে না। সে হিসেবে সব মৃত্যুই আকস্মিক। কিন্তু তারপরও কিছু কিছু মৃত্যু এমন আছে, মানুষ যাকে স্বাভাবিক গণ্য করে থাকে। যেমন বৃদ্ধ বয়সে মারা যাওয়া, কঠিন কোনও রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ইত্যাদি। সাধারণত রোগাক্রান্ত অবস্থায় একটা মানসিক প্রস্তুতি থাকে। রোগী নিজেও মনে করে। আমি বেশি দিন বাঁচব না। অন্যরাও মনে করে, যে-কোনও দিন তার মৃত্যু হয়ে যেতে পারে। এমনিভাবে কারও বয়স যদি অনেক বেশি হয়ে যায়, তখন মনে করা হয় তার আর বেশি দিন আয়ু নেই। এ অবস্থায় তার মৃত্যুকে স্বাভাবিক মৃত্যু গণ্য করা হয়ে থাকে। এরূপ মৃত্যুর আগে সাধারণত তাওবা করার অবকাশ হয়। মানুষ জীবনের সমস্ত গুনাহ থেকে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয় এবং যথাসম্ভব বেশি ইবাদত-বন্দেগীতে লিপ্ত থাকার চেষ্টা করে আর আল্লাহ তা'আলার কাছে দু'আ করে, যেন ঈমানের সঙ্গে তার মৃত্যু হয়।
কিন্তু কোনও কোনও মৃত্যুর এমন প্রকাশ্য পূর্বাভাস থাকে না। এ অবস্থায় মারা গেলে লোকে অবাক হয়ে বলাবলি করে, সে এভাবে হঠাৎ মারা গেল! কারণ তার মৃত্যুর ব্যাপারে তার নিজের এবং অন্য কারও মানসিক প্রস্তুতি ছিল না। যেমন, কেউ ঘুমের মধ্যে মারা গেল বা গাড়ির অ্যাকসিডেন্টে মারা গেল কিংবা কর্মক্ষেত্রে কাজ করছিল আর এ অবস্থায় হার্টফেল করে মারা গেল। এসব মৃত্যুকে সাধারণত আকস্মিক মৃত্যু মনে করা হয়ে থাকে। এরূপ মৃত্যুর আগে সাধারণ লোকজনের মৃত্যুর প্রস্তুতি থাকে না। তাওবা ও ইস্তিগফারেরও সুযোগ হয় না। ফলে হয়তো তার মৃত্যু এমন অবস্থায় ঘটে, দীনী দৃষ্টিকোণ থেকে যে অবস্থাটি প্রশংসনীয় নয়। হয়তো তখন কালেমা পড়ারই অবকাশ হয় না, অথবা কালেমাওয়ালা আমল অর্থাৎ কোনও নেক আমলের সাথে মৃত্যু হয় না।
এক বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, যার যে অবস্থায় মৃত্যু হবে সে অবস্থায় তার হাশর হবে। কাজেই প্রত্যেকের ক্ষেত্রে নেক অবস্থার মৃত্যুই কাম্য। সাধারণ লোকজনের ক্ষেত্রে আকস্মিক মৃত্যুকালে যে অবস্থা থাকে তা অনেক সময়ই নেক অবস্থা হয় না। এজন্যই আকস্মিক মৃত্যু কখনও কাম্য নয়। নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও আকস্মিক মৃত্যু থেকে আল্লাহ তা'আলার কাছে পানাহ চেয়েছেন।
এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতকে আমলের উৎসাহ দিতে গিয়ে আকস্মিক মৃত্যুর কথা উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ তোমরা যে দ্রুত আমলের দিকে ধাবিত হচ্ছ না, দুনিয়াদারীতে সময় নষ্ট করছ, এর কারণ কী? তোমাদের কিসের অপেক্ষা? মৃত্যুর অপেক্ষা কি? মৃত্যু তো যে-কোনও সময়ই হয়ে যেতে পারে। কোনও পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া আকস্মিকভাবেও ঘটে যেতে পারে। তখন তো আর কোনও আমলের সুযোগ থাকবে না। বরং তখন শুরু হয়ে যাবে আমলের ফলভোগের কাল। যেমন আমল নিয়ে কবরে যাবে তেমনি ফল সেখানে পাবে। সুতরাং অবহেলায় সময় নষ্ট না করে নেক আমলে মনোযোগী হও এবং মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নাও।
আমলের পক্ষে ষষ্ঠ বাধা: দাজ্জালের আবির্ভাব

এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমলের পক্ষে ষষ্ঠ যে বাধার কথা উল্লেখ করেছেন তা হচ্ছে দাজ্জালের আবির্ভাব। তার আবির্ভাব হবে মানুষের পক্ষে সর্বাপেক্ষা কঠিন ফিতনা। আল্লাহ যাকে রক্ষা করবেন সে ছাড়া আর কেউ তার ফিতনা হতে নিস্তার পাবে না।
الدجال শব্দটি আতিশয্যবোধক। এর উৎপত্তি دجل থেকে, যার অর্থ মিথ্যা বলা ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা। দাজ্জাল হবে এক চরম মিথ্যুক ও কঠিন বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী। কিয়ামতের আগে তার আবির্ভাব ঘটবে। আল্লাহ তা'আলা তাকে অনেক ক্ষমতা দান করবেন। এমনকি তার আদেশে বৃষ্টি হবে। তার হুকুমে যমীন থেকে ফসল উদ্‌গত হবে। তার সঙ্গে একটি উদ্যান ও একটি অগ্নিকুণ্ড থাকবে, যাকে সে তার জান্নাত ও জাহান্নাম বলে প্রচার করবে। সে নিজেকে 'রব্ব' বলে দাবি করবে। মানুষকে তার প্রতি ঈমান আনতে বলবে। যে ঈমান আনবে তাকে তার জান্নাতে স্থান দেবে। আর যে ঈমান আনবে না তাকে তার জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন যে, “সাবধান! প্রকৃতপক্ষে তার জান্নাতই হবে জাহান্নামের টুকরা, আর তার জাহান্নাম হবে জান্নাতের মত শান্তিদায়ক।” অর্থাৎ যে ব্যক্তি ঈমানের উপর মজবুত থাকবে এবং তাকে রব্ব বলে স্বীকার করবে না, আর এ কারণে সে তাকে তার জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে, আল্লাহ তা'আলা তার জন্য তার জাহান্নামকে জান্নাত বানিয়ে দেবেন। আগুন তার কোনও ক্ষতি করতে পারবে না। বরং তার জন্য শান্তিদায়ক হয়ে যাবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি তার প্রতি ঈমান আনবে ও তাকে রব্ব বলে স্বীকার করবে, আর এ কারণে সে তাকে জান্নাত দান করবে, আল্লাহ তা'আলা সে জান্নাতকে তার জন্য জাহান্নামে পরিণত করে দেবেন।
বস্তুত দাজ্জালের ফিতনা মানুষের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন ফিতনা। পরিপক্ক ঈমান ও আল্লাহর সাহায্য ছাড়া সে ফিতনায় নিজেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না। যখন দেখা যাবে তার কথায় বৃষ্টি হচ্ছে, সে মৃত মানুষকে জীবিত করে তুলছে, আবার তার কথা না শুনলে তাকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হচ্ছে, তখন আল্লাহর সাহায্য না হলে নিজ ঈমানের উপর অবিচল থাকা কার পক্ষে সম্ভব হবে?
তার অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ড দেখে যাতে কেউ বিভ্রান্ত না হয় এবং তাকে 'আল্লাহ' মনে না করে বসে, সেজন্য নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুস্পষ্টভাবে তার আলামত বলে দিয়েছেন। যেমন একটি আলামত হল সে হবে এক চোখবিশিষ্ট। একটি চোখ থাকবে না। সে চোখের জায়গা মাংসপিণ্ড দ্বারা ঢাকা থাকবে। যে চোখটি থাকবে সেটিও এতবেশি উপরে উত্থিত থাকবে যে, মনে হবে যেন ঠিকরে বের হয়ে আসছে। হাদীছে সেটিকে এক থোকা আঙ্গুরের উপর আলাদাভাবে উপড়ে উঠে থাকা একটি আঙ্গুরের দানার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। তার দুই চোখের মাঝখানে লেখা থাকবে। ك ف ر (কাফের)। প্রত্যেক মু'মিন তা পড়তে পারবে। কিন্তু কাফের ও মুনাফিক ব্যক্তি তা পড়তে পারবে না।
তাকে হত্যা করার জন্য আল্লাহ তা'আলা হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে পাঠাবেন। ফিলিস্তীনের 'বাবে লুদ' নামক স্থানে তিনি তাকে হত্যা করবেন। এটাই হবে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের দুনিয়ায় আগমনের প্রধান উদ্দেশ্য।
মোটকথা দাজ্জালের ফিতনা হবে অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। সব নবীই তার ফিতনা সম্পর্কে নিজ নিজ উম্মতকে সতর্ক করে গেছেন। তার বিষয়টা সর্বাপেক্ষা বেশি স্পষ্ট করেছেন সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তিনি তার ফিতনা থেকে নিরাপত্তার জন্য দু'আ শিক্ষা দিয়েছেন-

«اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ القَبْرِ، وَمِنْ عَذَابِ النَّارِ، وَمِنْ فِتْنَةِ المَحْيَا وَالمَمَاتِ، وَمِنْ فِتْنَةِ المَسِيحِ الدَّجَّالِ»

“ হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই কবরের আযাব থেকে, জাহান্নামের আযাব থেকে, জীবন ও মরণের পরীক্ষাসমূহ থেকে এবং কানা দাজ্জালের ফিতনা থেকে।” সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ১৩৭৭: সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৫৮৮; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ৩৪৯৫; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৫৫০৯; সুনানে আবু দাউদ, হাদীছ নং ১৫৪২; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৯০৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২৩৪১

আমলের পক্ষে সপ্তম বাধা : কিয়ামত

এ হাদীছে আমলের সর্বশেষ বাধা বলা হয়েছে কিয়ামতকে। কিয়ামত যখন সংঘটিত হবে, তখন যে ভয়ংকর অবস্থা দেখা দেবে তাতে কারও পক্ষে কোনও আমল করার প্রশ্নই আসে না। এমনকি তাওবা করার মত অবস্থাও থাকবে না। তখন তাওবা কবুলও হবে না । কিয়ামতের বিভীষিকা সম্পর্কে কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

يَاأَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمْ إِنَّ زَلْزَلَةَ السَّاعَةِ شَيْءٌ عَظِيمٌ (1) يَوْمَ تَرَوْنَهَا تَذْهَلُ كُلُّ مُرْضِعَةٍ عَمَّا أَرْضَعَتْ وَتَضَعُ كُلُّ ذَاتِ حَمْلٍ حَمْلَهَا وَتَرَى النَّاسَ سُكَارَى وَمَا هُمْ بِسُكَارَى وَلَكِنَّ عَذَابَ اللَّهِ شَدِيدٌ (2)

অর্থ : হে মানুষ! নিজ প্রতিপালকের (ক্রোধকে) ভয় কর। জেনে রেখ, কিয়ামতের প্রকম্পন এক সাংঘাতিক জিনিস। যেদিন তোমরা তা দেখতে পাবে, সেদিন প্রত্যেক স্তন্যদাত্রী সেই শিশুকে (পর্যন্ত) ভুলে যাবে, যাকে সে দুধ পান করিয়েছে এবং প্রত্যেক গর্ভবতী তার গর্ভপাত ঘটিয়ে ফেলবে আর মানুষকে তুমি এমন দেখবে, যেন তারা নেশাগ্রস্ত, অথচ তারা নেশাগ্রস্ত নয়; বরং (সেদিন) আল্লাহর শাস্তিই হবে অতি কঠোর।সূরা হজ্জ, আয়াত ১-২
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিয়ামতকে বলেছেন অতি ভয়াবহ ও অতি তিক্ত। কুরআন মাজীদও সে কথাই বলেছে। ইরশাদ হয়েছে-

بَلِ السَّاعَةُ مَوْعِدُهُمْ وَالسَّاعَةُ أَدْهَى وَأَمَرُّ (46)

অর্থ : বরং তাদের প্রকৃত প্রতিশ্রুত কাল তো কিয়ামত। আর কিয়ামত তো আরও বেশি কঠিন, অনেক বেশি তিক্ত।সূরা কামার, আয়াত ৪৬
যাহোক, এ হাদীছে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আপন উম্মতকে এ সাতটি বিষয় সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে আমলে যত্নবান হওয়ার তাগিদ করেছেন। আমরা প্রত্যেকেই সাধারণত বর্তমান সময়কে অবহেলা করে কাটাই। আমলের বিষয়টিকে আগামী দিনের জন্য রেখে দিই। প্রকৃতপক্ষে বর্তমান সময়ই আমলের জন্য উৎকৃষ্ট সময়। এসময় শরীরে শক্তি থাকে, মনে উৎসাহ থাকে এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থাও আমলের জন্য তুলনামূলকভাবে বেশি উপযোগী। তাই যা আমল করার এখনই করে নেওয়া উচিত। পরে সুযোগ পাওয়া যাবে কিনা তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। এ হাদীছে যেসব বাধার কথা বলা হয়েছে তার যে-কোনও একটি দেখা দিতে পারে।
তাছাড়া এরকম কোনও বাধা না আসলেও বর্তমানের আমল ভবিষ্যতের আমলের পক্ষে সহায়ক হয়। কেননা আমল করতে থাকলে আমল করার অভ্যাস হয়ে যায়। বর্তমানে যেমন অভ্যাস করা হয়, সাধারণত ভবিষ্যৎ সময়টাও সে অভ্যাস অনুযায়ী কাটানো হয়। এখন নেক আমলের অভ্যাস করলে আগামী দিনগুলোও নেক আমলের ভেতর কাটানো সম্ভব হবে। পক্ষান্তরে বর্তমান সময়ে গড়িমসি করলে নেক আমলের অভ্যাস গড়ে উঠবে না। পরে আমলে মনোযোগী হওয়া কঠিন হয়ে যাবে। সুতরাং কোনও গড়িমসি নয়। আমলের প্রকৃত সময় এখনই। এখনই তাতে লেগে পড়া উচিত। আল্লাহ তা'আলা আমাদের তাওফীক দান করুন, আমীন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছও আমাদেরকে অলসতা ছেড়ে এখনই আমলে লিপ্ত হয়ে পড়ার শিক্ষা দেয়।

খ. অতি দারিদ্র্য ঈমান-আমলের জন্য ক্ষতিকর। তাই প্রত্যেকের উচিত যাতে কঠিন অভাব-অনটনের শিকার হতে না হয়, সেজন্য হালাল পথে উপার্জনের চেষ্টা করা।

গ. সাধারণত অতিরিক্ত অর্থসম্পদ ঔদ্ধত্য সৃষ্টি করে। তাই বেশি ধনী হওয়ার আশা না করে অল্পে সন্তুষ্ট থাকার গুণ অর্জন করা উচিত।

ঘ. কঠিন রোগব্যাধিতে 'ইবাদত-বন্দেগী করা কঠিন হয়ে যায়। অনেক সময় মানুষ তাতে ধৈর্যও হারিয়ে ফেলে। তাই তা থেকে আল্লাহর পানাহ চাওয়া উচিত।

ঙ. সুস্বাস্থ্য আল্লাহ তা'আলার এক বড় নি'আমত। প্রত্যেকের উচিত সেজন্য আল্লাহর শোকর আদায় করা এবং স্বাস্থ্য রক্ষায় যত্নবান থাকা।

চ. অতিরিক্ত বার্ধক্য যেমন নেক আমলের জন্য বাধা, তেমনি তা মানুষের জীবনকে অন্যের বোঝায় পরিণত করে। তাই তা থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাওয়া উচিত।

ছ. মৃত্যু সকলেরই অবধারিত। কিন্তু আকস্মিকভাবে মৃত্যু হলে তাওবা-ইস্তিগফার ও অসিয়ত করার সুযোগ হয় না। এ জাতীয় মৃত্যু কাম্য নয়। তাই যথাসম্ভব সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত এবং আল্লাহর কাছে এর থেকেও পানাহ চাওয়া উচিত।

জ. দাজ্জালের ফিতনা সবচে' বেশি ভয়ংকর ফিতনা। হাদীছে তার থেকে পানাহ চাওয়ার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। এ সম্পর্কে হাদীছে যে দু'আ শেখানো হয়েছে সেটি মুখস্থ করে নিয়মিত পড়া চাই।

ঝ. একদিন কিয়ামত হবে। সারা বিশ্ব ধ্বংস হয়ে যাবে। কিয়ামতের ঘটনা অত্যন্ত বিভীষিকাময়। অন্তরে তার ভয় রাখা ঈমানের আলামত।

ঞ. মানুষকে নেক আমলের প্রতি উৎসাহ দান করা নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নত, যেমনটা এ হাদীছে লক্ষ করা যায়। আমাদের উচিত এ সুন্নতের অনুসরণ করা।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান