রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং:
খায়বার যুদ্ধ

খায়বার মদীনা মুনাওয়ারা থেকে উত্তর-পশ্চিম কোণে প্রায় একশ' মাইল দূরে অবস্থিত একটি জনবসতির নাম। এখানে ১২টি দুর্গ ছিল। তাতে ইহুদী সম্প্রদায় বসবাস করত। তাদের অনেক খেজুরের বাগান ছিল এবং ছিল বহু কৃষিজমি।
ইহুদী সম্প্রদায় শুরু থেকেই ইসলামের বিরোধিতা করে আসছিল। ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার কারণে মদীনার ইহুদী গোত্র বনু নাযীরকে উৎখাত করা হলে তারাও খায়বারে চলে আসে। ফলে খায়বার এতদঞ্চলের ইহুদীদের কেন্দ্রে পরিণত হয়। এবার তারা পূর্ণোদ্যমে চারদিকের আরব গোষ্ঠীসমূহকে ইসলামের বিরুদ্ধে উস্কানি দিতে শুরু করে। তাদের এসব তৎপরতা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের গোচরীভূত হলে তিনি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেন। সুতরাং হিজরী ৭ সালের মুহাররাম মাসে ছয়শত মুজাহিদ নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালান। তাদের মধ্যে দু'শ মুজাহিদ ছিলেন আরোহী এবং চারশ' পদাতিক।
একদিন ভোরবেলা খায়বারের ইহুদীগণ কৃষিকার্যের সরঞ্জামাদি নিয়ে কৃষিক্ষেত্রে যাওয়ার জন্য দুর্গের বাইরে বের হয়ে আসে। হঠাৎ দেখতে পায় মুসলিম বাহিনী উত্তর দিক থেকে তাদের অবরোধ করে রেখেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতেই সেখানে পৌঁছে গিয়েছিলেন। কিন্তু রাতে তিনি কোনও জনবসতিতে আক্রমণ করতেন না। তাই এখানেও আক্রমণ না করে তিনি ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করছিলেন। ইহুদীরা এ দৃশ্য দেখে তাদের দুর্গের দিকে দৌড়ে যাচ্ছিল আর চিৎকার করে বলছিল, মুহাম্মাদ ও তার সৈন্যদল এসে পড়েছে। তিনি তা শুনে সঙ্গীগণকে খায়বার জয়ের সুসংবাদ দান করলেন।
সর্বপ্রথম জয় হয়েছিল 'নাঈম' নামক দুর্গ। তারপর এক এক করে সবগুলো দুর্গই জয় হয়ে যায়। সর্বাপেক্ষা সুরক্ষিত দুর্গের নাম ছিল 'আল-কামূস'। এ দুর্গ জয়ে হযরত আলী রাযি. বিশেষ বীরত্ব প্রদর্শন করেন। সবগুলো দুর্গ জয়ে প্রায় দু'মাস সময় লেগেছিল। এ অভিযানে ১৯ জন সাহাবী শাহাদাত বরণ করেন। শত্রুপক্ষে নিহত হয় ৯৩ জন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম চাইলে এখানকার সকল ইহুদীকে হত্যা করতে পারতেন এবং তাদের নারী ও শিশুদেরকে দাস-দাসী বানাতে পারতেন। কিন্তু জানা কথা, তিনি ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু। তাদের প্রতি দয়ার আচরণই করলেন এবং তাদের সকল অপরাধ ক্ষমা করে দিলেন।
এ যুদ্ধে জয়ের ফলে সমগ্র খায়বার উপত্যকা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের অধিকারে চলে আসে। তারপর পরাজিত ইহুদী সম্প্রদায় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আবেদন করে যে, তাদেরকে খায়বারে বসবাসের এবং এখানকার কৃষিজমি চাষাবাদের অনুমতি দেওয়া হোক। তাহলে তারা উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক মহানবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রদান করবে। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের প্রতি মহানুভবতা দেখালেন এবং তাদের আবেদন মঞ্জুর করলেন। তবে তিনি শর্ত দিয়েছিলেন, পরবর্তীকালে যখনই প্রয়োজন মনে করা হবে, তখন তাদেরকে খায়বার ত্যাগের হুকুম দেওয়া হবে। তাদেরকে অবশ্যই সে হুকুম মেনে খায়বার ছেড়ে চলে যেতে হবে। কিন্তু ইহুদী জাতি আদতেই ছিল চক্রান্তপ্রবণ। তাদের প্রতি এতটা মহত্ত্ব দেখানো সত্ত্বেও তারা ইসলাম ও মুসলিম জাতির বিরুদ্ধে একের পর এক ষড়যন্ত্র চালিয়ে যেতে থাকে। পরিশেষে উল্লিখিত শর্ত অনুযায়ী হযরত 'উমর ফারক রাযি. নিজ শাসনামলে তাদেরকে খায়বার থেকে উৎখাত করতে বাধ্য হন। এই যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণের জন্য সীরাত গ্রন্থাবলি দ্রষ্টব্য।
নেক আমলের উদ্দীপনা ও জিহাদের উদ্দেশ্য
হাদীছ নং: ৯৪

হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম খায়বার যুদ্ধের দিন ঘোষণা করেন, আমি এ পতাকা এমন এক ব্যক্তিকে দেব, যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসে। আল্লাহ তার হাতে বিজয় দান করবেন। হযরত উমর রাযি. বলেন, আমি কখনও নেতৃত্ব কামনা করিনি, ওই একদিন ছাড়া। আমি তাঁর সামনে উঁচু হয়ে দাঁড়ালাম এই আশায় যে, আমাকে সেজন্য ডাকা হবে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আলী ইবন আবূ তালিব রাযি.-কে ডাকলেন। তারপর পতাকাটি তাঁর হাতে দিলেন এবং বললেন, এগিয়ে যাও। আর কোনওদিকে ফিরে তাকিও না, যাবৎ না আল্লাহ তাআলা তোমার হাতে বিজয় দান করেন। আলী রাযি, কিছুদূর এগিয়ে গেলেন। তারপর থেমে গেলেন এবং না ফিরেই উচ্চৈঃস্বরে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! মানুষের সঙ্গে যুদ্ধ করব কিসের ভিত্তিতে? তিনি বললেন, তাদের সঙ্গে যুদ্ধ কর যতক্ষণ না তারা সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া কোনও মা'বূদ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসুল। যখন তারা এ সাক্ষ্য দেবে, তখন তারা নিজেদের জানমাল তোমার দিকথেকে নিরাপদ করে ফেলল। তবে এ কালেমার হকের ব্যাপারটা আলাদা আর তাদের হিসাবনিকাশ আল্লাহর দায়িত্বে। -মুসলিম (সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৪০৫)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছটি খায়বার যুদ্ধ সম্পর্কিত। এতে হযরত আলী রাযি.-এর হাতে পতাকা অর্পণ, পতাকা পাওয়ার জন্য হযরত 'উমর ফারূক রাযি.-এর গভীর আগ্রহ, হযরত 'আলী রাযি.-কে লক্ষ্য করে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপদেশসহ আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বর্ণিত হয়েছে।
উপরে বলা হয়েছে, খায়বারে ইহুদীদের অনেকগুলো দুর্গ ছিল। তার মধ্যে একটি দুর্গ ছিল অত্যন্ত সুরক্ষিত। সেটি কোনওক্রমেই জয় করা যাচ্ছিল না। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরপর দুদিন দুজন বিশিষ্ট সাহাবীকে সেনাপতি বানিয়ে পাঠিয়েছিলেন। তারা বহু চেষ্টাতেও দুর্গটি দখল করতে সমর্থ হননি। তারপর তিনি ঘোষণা করেন, আমি আগামীকাল এমন এক ব্যক্তির হাতে পতাকা অর্পণ করব, যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসে এবং আল্লাহ তা'আলা তার হাতে বিজয় দান করবেন।
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ ঘোষণাটি সাহাবায়ে কিরামের অন্তরে দারুণ রেখাপাত করে। কেননা এতে এমন দুটি কথা বলা হয়েছে, যার প্রত্যেকটিই সাহাবায়ে কিরামের কাছে ছিল নিজ প্রাণের চেয়েও বেশি মূল্যবান। এর প্রথমটি ছিল আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসার সনদ। এতে কোনও সন্দেহ নেই যে, প্রত্যেক সাহাবী প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিজ প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। সেই ভালোবাসার সনদ যদি খোদ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখ থেকে পাওয়া যায়, তবে তারচে' বেশি আনন্দের এবং তারচে' পরম প্রাপ্তি একজন মু'মিনের কাছে, আর তাও তিনি যদি হন একজন সাহাবী, আর কী হতে পারে?
আর দ্বিতীয়টি ছিল যুদ্ধজয়। জিহাদে শহীদ হয়ে যাওয়া ও বিজয়লাভ- দু'টিই অনেক বড় সৌভাগ্যের। আবার সেই যুদ্ধ যদি হয় ইহুদীদের বিরুদ্ধে, যারা সর্বকালে ইসলামের সর্বাপেক্ষা ঘোর শত্রু এবং যারা মদীনা মুনাওয়ারায় বসে সর্বক্ষণ ইসলাম ও ইসলামের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে চক্রান্তে লিপ্ত থাকত, তবে সে যুদ্ধে জয়লাভ করা এবং জয়লাভে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তো যে-কোনও মু'মিনেরই অন্তরে জাগার কথা। আর এখানে তো সাহাবায়ে কিরাম, যাদের কাছে ইসলাম ও প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের যে-কোনও খেদমত করা ছিল জীবনের সর্বপ্রধান লক্ষ্যবস্তু। এর জন্য তারা থাকতেন সর্বক্ষণ পাগলপারা এবং থাকতেন সদাপ্রস্তুত। সেই খেদমতের বিশেষ সুযোগ যখন এসে গেছে, তখন তাদের পক্ষে এটা হাতছাড়া করা সম্ভব ছিল কি?
খেদমত সাধারণ সৈন্যরূপেও করা যায় বৈকি, কিন্তু পতাকাবাহী হয়ে খেদমত করতে পারার যে মহিমা, তা তো সাধারণ সৈন্যরূপে লাভ করা যায় না। তাই অন্য কখনও নেতৃত্বের আকাঙ্ক্ষা না করলেও এইবার তারা প্রত্যেকেই এর জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলেন। তাদের প্রত্যেকে অধীর আগ্রহে সময় পার করছিলেন। সে রাত যেন তাদের কাটছিল না। প্রত্যেকের মনে আকাঙ্ক্ষা ছিল, যদি পতাকা গ্রহণের জন্য তাকেই ডাকা হত! হযরত 'উমর রাযি. তো বলেই ফেলেছেন, জীবনে আর কখনও নেতৃত্বের আকাঙ্ক্ষা না করলেও এইবার ব্যতিক্রম হল। এবার আমি নেতৃত্ব কামনা করলাম এবং উঁচু হয়ে দাঁড়ালাম, যাতে আমার প্রতি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চোখ পড়ে।
পরদিন ভোরবেলা হযরত আলী রাযি.-এর ডাক পড়ল। লোকে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তাঁর চোখে অসুখ হয়েছে। তা সত্ত্বেও তিনি তাঁকে ডাকালেন। তিনি তাঁর চোখে খানিকটা থুথু লাগিয়ে দিলেন। এতে তাঁর আরোগ্য লাভ হল এবং এমন সুস্থ হয়ে গেলেন, যেন তাঁর চোখে কখনও অসুখ ছিলই না। এটা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি মু'জিযা।
মহানবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ হাতে হযরত আলী রাযি.-এর হাতে পতাকা তুলে দিলেন। তারপর হুকুম দিলেন, এগিয়ে চল। জয়লাভ না করা পর্যন্ত কোনওদিকে ফিরে তাকাবে না।
হযরত আলী রাযি. হুকুমমত এগিয়ে চললেন। কিছুদূর যাওয়ার পরই তাঁর মনে হল, কোন কথার উপর যুদ্ধ করব তা তো জানা হল না। তিনি থেমে গেলেন, কিন্তু পেছন দিকে ফিরে তাকালেন না। ওই অবস্থায়ই উচ্চ আওয়াজে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি তাদের সাথে যুদ্ধ করব কোন্ কথার উপর?
এই ছিল প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে সাহাবায়ে কিরামের আদব রক্ষার দৃষ্টান্ত। তিনি যে বলেছিলেন জয়লাভ না করা পর্যন্ত কোনওদিকে ফিরে তাকাবে না, একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায় এ কথার কী উদ্দেশ্য। এর দ্বারা বোঝানো হচ্ছিল- এখন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়াই তোমার কাজ। কোনওরকম দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগবে না। কারও কোনও কথায় বিভ্রান্ত হবে না এবং কোনও অবস্থায়ই সংকল্প পরিবর্তন করবে না। অর্থাৎ পেছন দিকে ফিরে না তাকানোর যে হুকুম দেওয়া হয়েছে, এর সম্পর্ক ইচ্ছা ও সংকল্পের সঙ্গে, বাহ্যিকভাবে দেহ ও চোখ ঘোরানোর সঙ্গে নয়। তিনি এ কথা বোঝাতে চাননি যে, কোনও প্রয়োজনীয় কথা বা কাজ সারার জন্যও পেছন দিকে ফেরা যাবে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও হযরত আলী রাযি. পেছন দিকে ফেরেননি। কেননা ফিরলে হুকুমের মর্মবস্তুর খেলাফ করা না হলেও বাহ্যিক শব্দের বিপরীত হয়ে যায়। সাহাবায়ে কিরাম অতটুকু বিপরীত করাও পসন্দ করতেন না।
এর পাশাপাশি আমাদের কী অবস্থা? আমরা কি কেবল বাহ্যিক শব্দ ও ভাষার বিপরীত করি? আমরা হরহামেশা তাঁর মূল আদেশই অমান্য করছি। তিনি করতে বলেছেন একটা, করছি আরেকটা। কিন্তু সে নিয়ে আমাদের কোনও চিন্তা নেই। আদবের খেলাফ কী, প্রকাশ্য অবাধ্যতা করলেও যেন আমাদের কিছু যায় আসে না! আল্লাহ তা'আলা আমাদের অবস্থার প্রতি রহম করুন। আমাদের অন্তরে প্রকৃত নবীপ্রেম দান করুন, আমীন।
হযরত আলী রাযি.-এর প্রশ্নের উত্তরে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করবে, যাবৎ না তারা সাক্ষ্য দেয়-

لا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ

“আল্লাহ ছাড়া কোনও মা'বূদ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল।”

এটি ইসলামের মহান কালিমা। এর দ্বারা মানুষ কুফর থেকে ইসলামে প্রবেশ করে। এটি ইসলামের সদর দরজা।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ কথা দ্বারা জানা গেল, ইসলামী জিহাদের উদ্দেশ্য রাজ্যবিস্তার ও ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করা নয়। এর উদ্দেশ্য আল্লাহর কালিমাকে বুলন্দ করা এবং আল্লাহর বান্দাদেরকে আল্লাহর সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া। এজন্যই যুদ্ধের পূর্ণ প্রস্তুতি নেওয়ার পরও এমনকি রণাঙ্গনেও যদি শত্রুপক্ষ ইসলাম গ্রহণ করে ও কালেমায়ে শাহাদাত পাঠ করে, তখন আর তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করার অবকাশ থাকে না। কারণ যে উদ্দেশ্যে যুদ্ধ, তা হাসিল হয়ে গেছে। এজন্যই যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার আগে শত্রুপক্ষকে যুদ্ধের উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত করা উচিত। অর্থাৎ তাদেরকে কালেমার দাওয়াত দেওয়া উচিত। এটা ইসলামী যুদ্ধনীতির একটি অংশ। এর দ্বারা ইসলামী জিহাদ ও অন্যান্য যুদ্ধের মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
যাহোক, কোনও ব্যক্তি যদি খাঁটি মনে এ কালেমা উচ্চারণ করে এবং এর বিষয়বস্তু বিশ্বাস করে, তবে এ যাবৎকাল সে যে ধর্মেরই অনুসারী থাকুক না কেন, এ কথা বলামাত্রই মু'মিন ও মুসলিম হয়ে যায় এবং তার অতীতজীবনের সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে যায়। আর যদি এ কথার উপর তার মৃত্যু হয়, তবে সে জান্নাতবাসী হয়ে যায়।
এ একটি মহান কালেমা। এর সঙ্গে দুনিয়া ও আখিরাতের প্রভূত কল্যাণ নিহিত। পরকালীন নাজাতের পাশাপাশি ইহকালীন মুক্তিও এর সাথে জড়িত। এতদিন তার জন্য একরকম বিধান প্রযোজ্য হত, কিন্তু এ কালেমা উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে নতুন সব বিধান তথা ইসলামী শরী'আতের অধীনে সে এসে যায়। পরবর্তী বাক্যে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সে কথাই ব্যক্ত করেছেন।
তিনি ইরশাদ করেন- যখন তারা এ সাক্ষ্য দেবে, তখন তারা তোমার দিক থেকে তাদের জানমাল নিরাপদ করে ফেলল। তবে এ কালেমার 'হক'-এর ব্যাপারটা ভিন্ন। আর তাদের হিসাবনিকাশ আল্লাহর দায়িত্বে।
এখানে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনটি কথা বলেছেন।
ক. কালেমায়ে শাহাদাত পাঠ তথা ইসলামগ্রহণ দ্বারা মানুষের জান-মাল নিরাপদ হয়ে যায়।
খ. এমন কিছু কাজ আছে, যা করলে মুসলিম ব্যক্তিরও জানের নিরাপত্তা থাকে না। তাছাড়া ইসলামী বিধানে মানুষের মালের উপর কিছু শর'ঈ হক বর্তায়। সুনির্দিষ্ট নীতিমালার অধীনে মুসলিম ব্যক্তির সে হক আদায় করা অবশ্যকর্তব্য।
গ. কালেমায়ে শাহাদাত পাঠকারীকে মুসলিম গণ্য করা হবে। তার মনে কী আছে- না আছে সেদিকে লক্ষ করা যাবে না। মনের হিসাবগ্রহণ আল্লাহর কাজ। মুসলিম ব্যক্তির জানমালের নিরাপত্তা এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানাচ্ছেন, ইসলামগ্রহণ দ্বারা মানুষের জানমাল নিরাপদ হয়ে যায়। কাজেই কোনও মুসলিমের জানমালে হস্তক্ষেপ করা জায়েয নয়। কোনও মুসলিম ব্যক্তিকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা কঠিন পাপ। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

মুসলিম ব্যক্তির জানমালের নিরাপত্তা

এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানাচ্ছেন, ইসলামগ্রহণ দ্বারা মানুষের জানমাল নিরাপদ হয়ে যায়। কাজেই কোনও মুসলিমের জানমালে হস্তক্ষেপ করা জায়েয নয়। কোনও মুসলিম ব্যক্তিকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা কঠিন। পাপ। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

وَمَنْ يَقْتُلْ مُؤْمِنًا مُتَعَمِّدًا فَجَزَاؤُهُ جَهَنَّمُ خَالِدًا فِيهَا وَغَضِبَ اللَّهُ عَلَيْهِ وَلَعَنَهُ وَأَعَدَّ لَهُ عَذَابًا عَظِيمًا (93)

অর্থ : যে ব্যক্তি কোনও মুসলিমকে জেনেশুনে হত্যা করবে, তার শাস্তি জাহান্নাম, যাতে সে সর্বদা থাকবে এবং আল্লাহ তার প্রতি গযব নাযিল করবেন ও তাকে লানত করবেন। আর আল্লাহ তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছেন।সূরা নিসা, আয়াত ৯৩

হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে-

«قَتْلُ الْمُؤْمِنِ أَعْظَمُ عِنْدَ اللَّهِ مِنْ زَوَالِ الدُّنْيَا»

“মুমিন ব্যক্তিকে হত্যা করা আল্লাহর কাছে দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাওয়া অপেক্ষাও গুরুতর।সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৩৯৯০
এমনিভাবে মু'মিন ব্যক্তির অর্থসম্পদে অন্যায় হস্তক্ষেপও কঠিন পাপ। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ إِلَّا أَنْ تَكُونَ تِجَارَةً عَنْ تَرَاضٍ مِنْكُمْ وَلَا تَقْتُلُوا أَنْفُسَكُمْ إِنَّ اللَّهَ كَانَ بِكُمْ رَحِيمًا (29) وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ عُدْوَانًا وَظُلْمًا فَسَوْفَ نُصْلِيهِ نَارًا

অর্থ : হে মুমিনগণ! তোমরা একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না, তবে পারস্পরিক সন্তুষ্টিক্রমে কোনও ব্যবসায় করা হলে (তা জায়েয)। এবং তোমরা নিজেরা নিজেদের হত্যা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু। যে ব্যক্তি সীমালংঘন ও জুলুমের সাথে এরূপ করবে, আমি তাকে আগুনে ঢোকাব।সুরা নিসা, আয়াত ২৯-৩০
ইসলাম চুরি, ডাকাতি, সুদ, ঘুষ হারাম করেছে। কেননা এসবের মাধ্যমে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করা হয়। যারা অন্যের সম্পদ অন্যায় জবরদখল করে, তাদের জন্য কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। হাদীছ দ্বারা জানা যায়, তাদের ইবাদত- বন্দেগীও কবুল হয় না।
প্রকাশ থাকে যে, নরহত্যা মাত্রই কঠিন পাপ। কোনও মানুষকেই অন্যায়ভাবে হত্যা করা যায় না। এমনিভাবে কোনও মানুষেরই অর্থসম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করা জায়েয নয়। তবে মুসলিম ব্যক্তির ক্ষেত্রে এ বিধান অধিকতর কঠোর হয়ে যায়। সুনির্দিষ্ট কিছু কারণ ব্যতিরেকে কোনও মুসলিমের জানমালে কারও হস্তক্ষেপ করার কোনও সুযোগ নেই। অমুসলিমদের সঙ্গে সুনির্দিষ্ট নীতিমালার অধীনে সশস্ত্র জিহাদ করা জায়েয। বলাবাহুল্য, সশস্ত্র জিহাদে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু যারা মুসলিম, তাদের বিরুদ্ধে এরূপ জিহাদের কোনও প্রশ্ন নেই। এ ছাড়াও জানমালের নিরাপত্তার ব্যাপারে মুসলিম ও অমুসলিম ব্যক্তির মধ্যে আরও বিভিন্ন পার্থক্য আছে। এখানে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ নেই।

মুসলিম ব্যক্তির জানমালে ইসলামের হক

কালেমায়ে শাহাদাত পাঠের মাধ্যমে যখন কোনও ব্যক্তি ইসলামে প্রবেশ করে, তখন তার জন্য ইসলামী শরী'আতের বিধানাবলি প্রযোজ্য হয়ে যায়। সে হিসেবে যেমন সে জানমালের নিরাপত্তা লাভ করে, তেমনি বিশেষ বিশেষ কারণে সে নিরাপত্তা বিঘ্নিতও হয়। সুতরাং কোনও মু'মিন ব্যক্তি যদি কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে, তবে কিসাস হিসেবে তাকেও হত্যা করা হবে, যা কার্যকর করা ইসলামী সরকারের দায়িত্ব। এমনিভাবে কোনও বিবাহিত নর-নারী যদি ব্যভিচার করে, তবে তাদেরকেও হত্যা করার বিধান রয়েছে। অনুরূপ শাস্তি প্রযোজ্য হয় বিদ্রোহীদের জন্যও। এ সম্পর্কিত খুঁটিনাটি আলোচনার জন্য ফিকহী গ্রন্থাবলি দ্রষ্টব্য।

অন্তরের হিসাব আল্লাহর কাছে

এ হাদীছ আমাদের আরও জানাচ্ছে, যে ব্যক্তি কালেমায়ে শাহাদাত পাঠ করবে, তার অন্তরে কী আছে-না আছে তা দেখার দায়িত্ব আমাদের নয়। তার হিসাব আল্লাহ নেবেন। মৌখিকভাবে ইসলাম স্বীকার করে নেওয়াই জানমালের নিরাপত্তা লাভের জন্য যথেষ্ট। অন্তরে যদি বিশ্বাস না থাকে, সেজন্য পরকালে আল্লাহ তা'আলা তাকে পাকড়াও করবেন এবং কাফের হিসেবেই তাকে শাস্তিভোগ করতে হবে, কিন্তু দুনিয়ায় সে মুসলিমই গণ্য হবে। কেননা কার অন্তরে কী আছে তা জানা কোনও মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। কে মুসলিম কে মুসলিম নয়, দুনিয়ায় তা বাহ্যিক কাজকর্ম ও মুখের কথা দ্বারাই সাব্যস্ত হয়। এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রেও যদি কোনও অমুসলিম সৈনিক মুখে কালেমায়ে শাহাদাত পাঠ করে আর ঈমানবিরোধী কোনও কথা বা কাজ তার থেকে না পাওয়া যায়, ব্যস সে মুসলিম। এ অবস্থায় তাকে হত্যা করা জায়েয থাকে না।
ইসলামের শুরুর দিকে কখনও কখনও এমন ঘটনা ঘটেছে যে, যুদ্ধক্ষেত্রে কেউ কালেমা পাঠ করেছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও এই মনে করে তাকে হত্যা করা হয়েছে যে, সে হয়তো প্রাণ বাঁচানোর উদ্দেশ্যেই তা পাঠ করেছে। তার অন্তরে মূলত বিশ্বাস নেই। পরে যখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা জানতে পেরেছেন, তখন তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন এবং যে সাহাবী এমন ব্যক্তিকে হত্যা করেছেন তাকে তিরস্কার করে বলেছেন, তুমি তার অন্তর চিরে দেখলে না কেন? অর্থাৎ তার অন্তরে কী আছে-না আছে তা যখন তোমার জানা সম্ভব নয়, তখন কেন তুমি অন্তরের পেছনে পড়তে গেলে এবং তার মুখের কালেমা পাঠকে গ্রহণ করে নিলে না?
মোটকথা, শরী'আতের হুকুম আরোপিত হয় মানুষের বাহ্যিক আচরণের উপর, মনের অবস্থার উপর নয়। মনের অবস্থা দেখা আল্লাহর কাজ। যা কেবলই আল্লাহর কাজ, আমাদের উচিত তাতে হস্তক্ষেপ না করা। আমরা অনেক সময়ই তা করে বসি। বিশেষ দলীল-প্রমাণ ছাড়াই অন্যের নিয়ত নিয়ে সন্দেহ করি। মন্তব্য করি, সে এটা মানুষকে দেখানোর জন্য করেছে, এই জন্য করেছে, ওই জন্য করেছে ইত্যাদি। এসব মন্তব্য কিছুতেই সংগত নয়। বাস্তবিকই যদি কারও নিয়ত ও উদ্দেশ্য অসৎ থাকে, তবে তা দেখা আল্লাহর কাজ। নিখুঁতভাবে তা বোঝা আমাদের পক্ষে সম্ভবও নয়। এ অবস্থায় এ জাতীয় মন্তব্য করা নিছক কুধারণা। আর কুধারণা করা কঠিন পাপ। আল্লাহ তা'আলা এর থেকে আমাদের হেফাজত করুন, আমীন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছেরও প্রধান শিক্ষা আমলে গড়িমসি না করা সম্পর্কে। অর্থাৎ প্রত্যেকের উচিত আগামী দিনের অপেক্ষায় না থেকে বর্তমান সময়েই আল্লাহর অনুগত হয়ে চলা।

খ. দীনী কাজের বিষয়টা পার্থিব সুযোগ-সুবিধার বিপরীত। পার্থিব সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে নিজের উপর অন্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া পসন্দনীয়। কিন্তু দীনী কাজে পসন্দনীয় হচ্ছে প্রতিযোগিতার মনোভাব। সে ক্ষেত্রে কর্তব্য, কোনও নেক কাজের সুযোগ পাওয়া গেলে অন্যের জন্য ছেড়ে না দিয়ে সে সুযোগ নিজেই গ্রহণ করে নেওয়া।

গ. নেতৃত্ব বা উঁচু পদ পাওয়ার জন্য লালায়িত হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়।

ঘ. ইসলাম গ্রহণ দ্বারা মানুষের জানমাল নিরাপদ হয়ে যায়। সুতরাং কোনও মুসলিম ব্যক্তির জানমালে অন্যায় হস্তক্ষেপ জায়েয নয়।

ঙ. বাহ্যিক আচার-আচরণে যে ব্যক্তি মুসলিম, তার মনের অবস্থা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা সমীচীন নয়। কেননা মনের খবর আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। এর দ্বারা এ শিক্ষাও পাওয়া যায় যে, কারও বাহ্যিক আমল যদি ভালো হয়, তবে তার নিয়ত সম্পর্কে সন্দেহ করা ঠিক নয়।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন