রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং:
মুজাহাদা ও সাধনা-সংগ্রাম


‘মুজাহাদা’ শব্দের অর্থ ও ব্যাখ্যা

مجاهدة (মুজাহাদা) শব্দটির উৎপত্তি جهد থেকে। جهد অর্থ চেষ্টা, শ্রম, শক্তি ও সামর্থ্য। مجاهدة অর্থ সর্বোচ্চ চেষ্টা ও সামর্থ্য ব্যয় করা। দীনের প্রচারপ্রসারের কাজে এবং দীনের পথে চলার ক্ষেত্রে যে সকল বাধাবিপত্তি দেখা দেয়, তার প্রতিরোধে সর্বোচ্চ পর্যায়ের শক্তি-সামর্থ্য ব্যয় করা ও সর্বোচ্চ সংগ্রাম-সাধনাকে 'মুজাহাদা' বলে।
মুজাহাদা তিন প্রকারঃ-
ক. প্রকাশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করা;
খ. শয়তানের বিরুদ্ধে লড়াই করা;
গ. নফসের বিরুদ্ধে লড়াই করা।
দীনের পথে চলতে হলে মানুষকে এ তিনও প্রকার সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হয়। কখনও প্রকাশ্য শত্রু পথের বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ইসলামের শুরু থেকেই মুশরিক, ইহুদী, খ্রিষ্টান প্রভৃতি অমুসলিম সম্প্রদায় ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজে বাধা দিয়ে এসেছে। যারা ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী জীবনযাপন করতে চায়, তাদের পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের সে শত্রুতা আজও সমানতালে অব্যাহত আছে। অতীতের সাহসী মুসলিমগণ কখনও সে শত্রুতায় দমে যায়নি। তারা সর্বাবস্থায় সত্যদীনের উপর অটল থেকেছে এবং জানমাল দিয়ে শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। তাদের সে সংগ্রামীজীবন আমাদের পথচলার অনুপ্রেরণা। আমাদেরও কর্তব্য হবে শত্রুর কোনও ষড়যন্ত্রে দমে না যাওয়া এবং দীনের উপর অটল থেকে তাদের মুকাবিলা করে যাওয়া।
আজকাল ‘মুসলিম' নামে পরিচিত একশ্রেণির লোকও ইসলামী জীবনযাত্রার পথে বাধা। যারা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নত মোতাবেক জীবনযাপন করতে চায়, ওই শ্রেণির লোক তাদের উপর কখনও মানসিক নির্যাতন চালায়, কখনও বৈষয়িক ক্ষতিসাধন করে এবং কখনও সামাজিক অবরোধও আরোপ করে। তারা সুযোগ পেলে শারীরিক নির্যাতনেও কুণ্ঠাবোধ করে না। দীনের খাঁটি অনুসারীর কর্তব্য এ ক্ষেত্রেও হিম্মতের পরিচয় দেওয়া এবং আল্লাহর উপর ভরসা করে শরী'আতের অনুসরণে অবিচল থাকা।
শয়তান মানুষের ঘোর শত্রু। মানবসৃষ্টির সূচনা থেকেই সে শত্রুতা করে আসছে। এবং সে শপথ করেছে, সর্বদা মানুষের সাথে শত্রুতা করে যাবে এবং তাদেরকে দীন থেকে বিচ্যুত করে জাহান্নামে নেওয়ার চেষ্টা করবে। সে অনেক চাতুরী জানে।সে নানা ছলাকলায় মানুষকে ভোলানোর চেষ্টা করে। যুক্তিতর্কের মাধ্যমে সত্যকে মিথ্যা মিথ্যাকে সত্য করে দেখায়। নানাভাবে প্রলোভন ও প্ররোচনা দেয়, যাতে মানুষ আখিরাত ভুলে যায় এবং দুনিয়াকেই সব ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেয়। তার ছলচাতুরা থেকে বাঁচার জন্য শক্ত মুজাহাদা দরকার। প্রয়োজন সহীহ দীন জানা, প্রকৃত সাহচর্য অবলম্বন করা এবং তাকওয়া-পরহেযগারীতে নিজেকে বলিষ্ঠ করে তোলা।
মানুষের আরেক শত্রু তার নফস ও মন। মানবমন সর্বদা আরাম-আয়েশ চায়। দুনিয়ার সুখশান্তি খোঁজে। দুনিয়ায় যা-কিছু আকর্ষণীয় বস্তু আছে, মন শুধু তার দিকেই ঝোঁকে। কী করে তা অর্জন করা যায় সেই ধান্দায় থাকে। সর্বদা হালাল পথে তা অর্জন করা যায় না। মনের চাহিদা অনেক বড়। তার সব চাহিদা পূরণ করতে গেলে অন্যায় পথে চলতে হয়। নাজায়েয উপায়ও অবলম্বন করতে হয়। কিন্তু নফস বড় নাছোড়। অন্যায় ও নাজায়েয পন্থায় হলেও তার চাহিদা পূরণ করতেই হবে। ধন, জন, পদ ও সম্মান এবং শারীরিক ও মানসিক সবরকম চাহিদা পূরণের জন্য যে-কোনও অন্যায় অনাচারে লিপ্ত হতে সে উৎসাহ যোগাতেই থাকে। তার ফাঁদ থেকে বাঁচা বড় কঠিন। অধিকাংশ মানুষই বাঁচতে পারে না। ফলে নফসের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে তারা নানারকম পাপাচারে লিপ্ত হয়ে পড়ে এবং নিজ আখিরাত ধ্বংস করে দেয়।
আবার কোনও নেক কাজ করতে গেলেও শয়তানের মত নফসও কঠিন বাধা হয়ে দাঁড়ায়। নেক কাজ করতে গেলে পার্থিব কী কী ক্ষতি হতে পারে সেগুলো সামনে তুলে ধরে। নেক কাজ করতে গেলে কিছু না কিছু শারীরিক কষ্ট হয়ই। অনেক নেক কাজ এমন, যা করতে চাইলে অর্থব্যয়ের প্রয়োজন পড়ে। আবার কোনও কোনও নেক কাজে মানসম্মানের উপর আঘাত আসে। এসবই কষ্টের ব্যাপার। নফস এসব কষ্ট বরদাশত করতে চায় না। কষ্ট করা নফসের ধাতে নেই। তার খাসলত শুধু ভোগ করা। কিন্তু নেক কাজ ভোগের পরিপন্থি। তাই নফস তাতে সায় দেয় না।
কোনও বীরপুরুষ নফসকে পরাজিত করে যখন কোনও নেক কাজে অবতীর্ণ হয়, তখনও নফস আবার ফিরে আসে। নতুনভাবে হামলা চালায়। এবারকার হামলা হয় অনেক সূক্ষ্ম। সে আঘাত করে ইখলাসের উপর। আল্লাহকে খুশি করার উদ্দেশ্যে যে কাজ শুরু করা হয়েছিল, সে কাজের ভেতর দুনিয়ার সুনামসুখ্যাতি কুড়ানোর ইচ্ছা জাগ্রত করে দেয়। এতক্ষণ মনের ঝোঁক ছিল আল্লাহর দিকে। এবার তা ফিরে যায় মাখলূকের দিকে। কে দেখল সেদিকে নজর চলে যায় এবং কিভাবে মানুষের মধ্যে তা প্রচার পাবে সেই চেষ্টা শুরু হয়ে যায়। এভাবে নফস মানুষের নিয়ত ও ইখলাসের উপর হামলা চালিয়ে সহীহ-শুদ্ধ আমলও নষ্ট ও ভ্রষ্ট করে দেয়।
বোঝাই যাচ্ছে শয়তান ও মানবশত্রু অপেক্ষাও নফস অনেক বেশি বিপজ্জনক। তাই তো দেখা যায়, হাদীছে নফসের সঙ্গে সংগ্রাম করাকে বড় জিহাদ বলা হয়েছে। কেননা এ শত্রু যেমন সসস্ত্র যুদ্ধেও কার্যকর থাকে, তেমনি সক্রিয় থাকে একান্ত নিভৃত ইবাদত-বন্দেগীতেও।
সুতরাং নিজ আখিরাত হেফাজত করতে হলে এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে জান্নাতের অধিকারী হতে হলে মহাশত্রু নফসের ধোঁকা থেকে নিজেকে রক্ষা করতেই হবে। এর জন্য যত কঠিন সাধনা ও যত কঠোর মুজাহাদারই দরকার হোক, তার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে এবং কার্যত তা সর্বক্ষণ চালিয়ে যেতে হবে।
মূলত ইসলাম তার অনুসারীকে এ তিনও প্রকার মুজাহাদা ও সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য উৎসাহ যোগায়। যেমন কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছেঃ- وَجَاهِدُوا فِي اللَّهِ حَقَّ جِهَادِهِ অর্থ : এবং তোমরা আল্লাহর পথে জিহাদ কর, যেভাবে জিহাদ করা উচিত। সূরা হজ্জ, আয়াত ৭৮
উল্লিখিত তিনও প্রকার মুজাহাদাই এ আয়াতের অন্তর্ভুক্ত। অন্যত্র ইরশাদ হয়েছেঃ- وَجَاهِدُوا بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ অর্থ : এবং নিজেদের জানমাল দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ কর।সূরা তাওবা, আয়াত ৪১
প্রকাশ থাকে যে, কাফের ও মুশরিকদের সঙ্গে যখন প্রয়োজন হয় তখন সসস্ত্র যুদ্ধ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘ইবাদত। ইসলামী পরিভাষায় এরূপ সংগ্রামকে ‘জিহাদ' বলা হয়ে থাকে। কুরআন ও হাদীছে এর বিপুল ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। শয়তান ও নফসের বিরুদ্ধে যে লড়াই করতে হয় সে লড়াইকে সাধারণত ‘মুজাহাদা' বলা হয়। জিহাদ শব্দটি মৌলিকভাবে সসস্ত্র সংগ্রামের জন্যই প্রযোজ্য, যদিও এর আভিধানিক অর্থ ব্যাপক এবং সে হিসেবে সৎকাজের আদেশ করা, অসৎকাজে নিষেধ করা, দলীল-প্রমাণ দ্বারা বাতিলপন্থিদের রদ করা, দাওয়াত ও তাবলীগের কাজে জানমাল খরচ করা, সামাজিক রেওয়াজ-প্রথার বিপরীতে দাঁড়িয়ে দীনের রীতিনীতি আঁকড়ে ধরে রাখা এবং আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী ও শরী'আতের অনুশাসন মেনে চলায় নফসের বিরুদ্ধাচারণে রত থাকা সবই জিহাদের আভিধানিক অর্থের অন্তর্ভুক্ত।

মুজাহাদা সম্পর্কে কয়েকটি আয়াত

এক নং আয়াত

وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا وَإِنَّ اللَّهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِينَ (69)

অর্থ : যারা আমার উদ্দেশ্যে প্রচেষ্টা চালায়, আমি তাদেরকে অবশ্যই আমার পথে উপনীত করব। নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সঙ্গে আছেন।সূরা আনকাবূত, আয়াত ৬৯

ব্যাখ্যা

অর্থাৎ যে সকল মু'মিন আমার সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করে, আমার দেওয়া হিদায়াত মোতাবেক আমল করে, আমার ইবাদত-আনুগত্যে রত থাকে এবং আমার রাসুলের সুন্নত মোতাবেক জীবনযাপনে সচেষ্ট থাকে আর এর জন্য যে-কোনও ত্যাগস্বীকারে প্রস্তুত থাকে, আমি তাদেরকে আমার সন্তুষ্টি লাভের সকল পন্থা দেখিয়ে দেব, আমার ছাওয়াব ও পুরস্কার পাওয়ার সকল উপায় বুঝিয়ে দেব, আর এভাবে আমি তাদেরকে সর্বপ্রকার নেক কাজ করার তাওফীক দান করব।
আয়াতে سُبُل শব্দটি سبيل -এর বহুবচন। এর অর্থ 'পথসমূহ'। মৌলিকভাবে আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছার পথ একটিই। আর তা হচ্ছে 'দীনে ইসলাম'। তা সত্ত্বেও যে এখানে আল্লাহ তা'আলা বহুবচনে لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا (তাদেরকে আমার পথসমূহ দেখিয়ে দেব) বলেছেন, এটা বলেছেন ইসলামের শাখাগত আমলসমূহের দিকে লক্ষ করে। অর্থাৎ ইসলামের একেকটি আমল যেন আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি লাভের একেকটি পথ বা উপায়। যেমন শারীরিক ইবাদত একটি পথ, অর্থসম্পদ সম্পর্কিত ইবাদত একটি পথ, সৎকাজের আদেশ করা ও অসৎকাজে নিষেধ করা একটি পথ, জিহাদ একটি পথ ইত্যাদি। তবে এ প্রত্যেকটিই শাখাগত পথ, যা মূল রাজপথ ইসলামের সাথে মিশেছে। আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি লাভের জন্য এর কোনও একটির অবলম্বন যথেষ্ট নয়। তাঁর সন্তুষ্টি লাভ করতে হলে প্রথমে মূল রাজপথের উপর দাঁড়াতে হবে অর্থাৎ ঈমান আনার মাধ্যমে পূর্ণ ইসলামের উপর চলার জন্য অঙ্গিকারাবদ্ধ হতে হবে। তারপর এক এক করে এর শাখাগত সবগুলো পন্থা অবলম্বন করা হবে। শুনতে কঠিন মনে হলেও এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা সুসংবাদ দিয়েছেন- যারা চেষ্টা করবে, আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে অবশ্যই সবগুলো পন্থা অবলম্বনের তাওফীক দান করবেন।

দুই নং আয়াত

আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-

وَاذْكُرِ اسْمَ رَبِّكَ وَتَبَتَّلْ إِلَيْهِ تَبْتِيلًا (8)

অর্থ : এবং তোমার প্রতিপালকের নামের যিকির কর এবং সকলের থেকে পৃথক হয়ে সম্পূর্ণরূপে তাঁরই হয়ে থাক।সূরা মুয্যাম্মিল, আয়াত ৮

ব্যাখ্যা

এটি সূরা মুয্যাম্মিলের ৮ম আয়াত। শুরুর ছয় আয়াতে আল্লাহ তা'আলা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রাতজেগে নামায পড়া ও কুরআন তিলাওয়াত করার হুকুম দিয়েছেন। ৭ম আয়াতে ইরশাদ করেছেন-

إنَّ لَكَ فِي النَّهَارِ سَبْحًا طَوِيلًا

অর্থ : দিনের বেলা তো তোমার থাকে দীর্ঘ কর্মব্যস্ততা। অর্থাৎ দিনের বেলা তা'লীম ও তারবিয়াত, দাওয়াত ও তাবলীগ, বিচার-আচার, প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাক্ষাৎকার, সেনাবাহিনী প্রেরণ, কর্মচারী নিয়োগ ও বদলি, পারিবারিক কাজকর্ম প্রভৃতি নানারকম ব্যতিব্যস্ততা থাকে। আপনার পক্ষে যদিও এসব কাজ ‘ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত, তারপরও সরাসরি ইবাদত-বন্দেগী এবং যিকর ও দু'আর জন্য একটা সময় নির্দিষ্ট থাকা উচিত। সেজন্য রাতের সময়টাই বেশি উপযোগী। তাই এ সময় আপনি একান্তে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগীতে লিপ্ত থাকুন। এরপরই আল্লাহ তা'আলা আলোচ্য আয়াতে ইরশাদ করেছেন-
“এবং তোমার প্রতিপালকের নামের যিকির কর এবং সকলের থেকে পৃথক হয়ে সম্পূর্ণরূপে তাঁরই হয়ে থাক।”
এ আয়াতে যিকির বলতে মুখে আল্লাহ তাআলার নাম উচ্চারণ করা এবং অন্তরে তাঁর ধ্যান করা- উভয়টাই বোঝায়। “সকলের থেকে পৃথক হওয়া”-এর অর্থ দুনিয়ার সব সম্পর্ক ছিন্ন করা নয়। বরং এর অর্থ হচ্ছে, সকল সম্পর্কের উপর আল্লাহ তাআলার সঙ্গে সম্পর্ককে প্রাধান্য দেওয়া, যাতে অন্যান্য সম্পর্ক আল্লাহ তাআলার হুকুম পালনের পক্ষে বাধা না হয়; অন্যসব সম্পর্কও আল্লাহ তাআলার হুকুম মোতাবেক পরিচালিত হয় এবং এভাবে সেসব সম্পর্কও তাঁরই জন্য হয়ে যায়। ফলে ব্যক্তিগত ও মানুষের সাথে সম্পর্কিত কাজসমূহ বাহ্যিকভাবে দুনিয়াবী কাজ মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা আল্লাহর কাজে পরিণত হবে। বাহ্যিক সম্পর্ক থাকবে মাখলুকের সাথে, কিন্তু অন্তর আল্লাহর 'ইশক ও মহব্বতে নিমজ্জিত থাকবে। দুনিয়ার প্রয়োজনীয় সবকিছুই করা হবে, কিন্তু তার ভেতর দিয়েও হৃদয়-মনের বন্ধন থাকবে কেবল আল্লাহরই সঙ্গে। যেন সকলের সঙ্গে থেকেও প্রকৃতপক্ষে কারও সঙ্গেই থাকা হবে না। সর্বত্র সকল কাজে প্রাণ-চেতনা আল্লাহতেই লীন হয়ে থাকবে। এটাই হচ্ছে সকলের থেকে পৃথক হয়ে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহরই হয়ে থাকা।
দেহমনে এভাবে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর হয়ে থাকা খুব সহজ কথা নয়। এর জন্য দরকার কঠোর সাধনা ও মুজাহাদা। সরাসরি এ হুকুম তো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি, কিন্তু পরোক্ষভাবে এটা আমাদের প্রতিও বর্তায়। তাঁর প্রকৃত উম্মত ও আল্লাহ তা'আলার একজন খাঁটি 'আশেক বান্দা হওয়ার জন্য আমাদেরও কর্তব্য সকলের মাঝে ও সকল কাজে থেকেও প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর হয়ে থাকা। এটা সম্ভব অন্তরে ও বাইরে শরীআতের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ দ্বারা। এর জন্য যে-কোনও রকম ত্যাগস্বীকারে প্রস্তুত থাকতে হবে। নফস ও শয়তান এবং মানবশত্রুদের পক্ষ থেকে যতরকম বাধাই আসুক, তা উপেক্ষা করে আপন কর্তব্যকর্মে অবিচল থাকতে হবে। এটা অনেক বড় জিহাদ ও মুজাহাদা। হিম্মতের সাথে এরূপ জিহাদে অবতীর্ণ হলে আল্লাহর সাহায্য লাভ হবেই, যেমনটা প্রথম আয়াতে জানানো হয়েছে।

তিন নং আয়াত

وَاعْبُدْ رَبَّكَ حَتَّى يَأْتِيَكَ الْيَقِينُ (99)

অর্থ : এবং নিজ প্রতিপালকের ইবাদত করতে থাক, যাবৎ না যার আগমন সুনিশ্চিত তোমার কাছে তা এসে যায়।সুরা হিজর, আয়াত ৯৯

ব্যাখ্যা

الْيَقِينُ -এর অর্থ সুনিশ্চিত বিষয়। এ আয়াতে এর দ্বারা মৃত্যু বোঝানো উদ্দেশ্য। কুরআন ও হাদীছের বিভিন্ন স্থানে শব্দটি 'মৃত্যু' অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। বিজ্ঞ মুফাসসিরগণও শব্দটিকে মৃত্যু অর্থেই গ্রহণ করেছেন।
মৃত্যুকে الْيَقِينُ বা সুনিশ্চিত বিষয় বলা হয়েছে এ কারণে যে, এ ব্যাপারে কারও কোনও সন্দেহ নেই। ঘোর নাস্তিকও স্বীকার করে যে, জীবমাত্রকেই একদিন না একদিন মরতে হবে। মৃত্যু থেকে নিস্তার নেই কারও। হাজারও সত্যের মধ্যে মৃত্যুই একমাত্র বিষয়, যার নিশ্চয়তা সম্পর্কে কেউ কোনও সন্দেহ করে না। তাই মৃত্যুকে “ইয়াকীন” শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে।
আয়াতে বলা হচ্ছে- মানুষের জন্য ইবাদত-বন্দেগী এমন এক নিয়মিত কাজ, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যা থেকে কারও অবসর নেই। কোনও ব্যক্তি ইবাদত করতে করতে আধ্যাত্মিক উন্নতির যত উচ্চতায়ই পৌঁছুক, তার পক্ষে এ কথা বলার কোনও সুযোগ নেই যে, যথেষ্ট হয়ে গেছে, এখন আর ইবাদত দরকার নেই। কেউ যদি একটানা ইবাদত করতে থাকে, তারপর একপর্যায়ে তা ছেড়ে দিয়ে সম্পূর্ণরূপে দুনিয়াদারীতে লিপ্ত হয়ে যায় আর এ অবস্থায় তার মৃত্যু হয়ে যায়, তবে তার সব ইবাদত-বন্দেগী বৃথা হয়ে যাবে। কেননা শেষ অবস্থাই ধর্তব্য। তাই তো আল্লাহ তা'আলার হুকুম-

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ (102)

অর্থ : হে মুমিনগণ! অন্তরে আল্লাহকে সেভাবে ভয় কর, যেভাবে তাকে ভয় করা উচিত। (সাবধান! অন্য কোনও অবস্থায় যেন) তোমাদের মৃত্যু (না আসে, বরং) এই অবস্থায়ই যেন আসে যে, তোমরা মুসলিম।সূরা আলে-ইমরান, আয়াত ১০২
বলাবাহুল্য মুসলিম অবস্থায় মৃত্যু তখনই সম্ভব, যখন নিয়মিতভাবে ইবাদত-বন্দেগী চালিয়ে যাওয়া হবে এবং সর্বাবস্থায় শরী'আতের উপর অবিচল থাকা হবে, কখনও তা ছেড়ে দেওয়া হবে না। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর হুকুম অনুযায়ী চলার তাওফীক দান করুন, আমীন।

চার নং আয়াত

فَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَرَهُ (7)

অর্থ : সুতরাং কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করে থাকলে সে তা দেখতে পাবে। সূরা যিলযাল, আয়াত ৭

ব্যাখ্যা

এ আয়াতে বান্দাকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে- সে যেন সদাসর্বদা নেক কাজে যত্নবান থাকে। কেননা তার কোনও নেক কাজ বৃথা যাবে না। সে ছোট-বড় যে-কোনও নেক কাজ করবে, আখিরাতে আল্লাহ তা'আলার কাছে তার প্রতিদান অবশ্যই পাবে। তার একেকটি কাজের জন্য আল্লাহ তা'আলা নয়নপ্রীতিকর কী কী পুরস্কার নির্দিষ্ট করে রেখেছেন, বান্দা নিজ চোখে তা দেখতে পাবে। কাজেই কোনও নেক কাজকেই অবহেলা করা উচিত নয়। আখিরাতে তার উপকারে আসবে কেবল নেক কাজই। এর বদৌলতে সে মুক্তি পাবে এবং জান্নাতে এর ছাওয়াব ও পুরস্কারই সে ভোগ করবে। তাই তো নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতকে এই বলে উৎসাহ দান করেন যে-

«لَا تَحْقِرَنَّ مِنَ الْمَعْرُوفِ شَيْئًا، وَلَوْ أَنْ تَلْقَى أَخَاكَ بِوَجْهٍ طَلْقٍ»

“কোনও নেক কাজকেই তুচ্ছ মনে করো না, এমনকি তা যদি তোমার ভাইয়ের সাথে হাসিমুখে সাক্ষাৎ করার ব্যাপারটাও হয়।সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৬২৬ মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২০৬৩৫

পাঁচ নং আয়াত

وَمَا تُقَدِّمُوا لِأَنْفُسِكُمْ مِنْ خَيْرٍ تَجِدُوهُ عِنْدَ اللَّهِ هُوَ خَيْرًا وَأَعْظَمَ أَجْرًا

অর্থ : তোমরা নিজেদের জন্য উত্তম যা-ই অগ্রিম পাঠাবে, আল্লাহর কাছে গিয়ে তোমরা তা আরও উৎকৃষ্ট অবস্থায় এবং মহাপুরস্কাররূপে বিদ্যমান পাবে।সূরা মুয্যাম্মিল, আয়াত ২০

ব্যাখ্যা

অর্থাৎ ইহকালে তোমরা যা-কিছু নেক কাজ করবে, আখিরাতে আল্লাহ তা'আলার কাছে তার উত্তম পুরস্কার পাবে। কোনও সৎকাজই দুনিয়ায় শেষ হয়ে যায় না; বরং তা আখিরাতের সঞ্চয় হয়ে থাকে। বান্দা যা-কিছু নেক কাজ দুনিয়ায় করছে, সবই আখিরাতের খাতায় জমা হচ্ছে। প্রয়োজনের সময় তা ঠিকই পাওয়া যাবে, যদিও দুনিয়ায় তা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। দুনিয়ায় দেখতে পাওয়া যায় কেবল সেইসব কাজের ফলাফল, যা দুনিয়াবী উদ্দেশ্যে করা হয়। কিন্তু তা দুনিয়াতেই শেষ হয়ে যায়। দুনিয়ার উদ্দেশ্যে মানুষ যা-কিছু করে, সে তা এই ভেবে করে যে, এটাই আমার অর্জন। তার বাড়ি-গাড়ি হয়, টাকাপয়সা হয়, সম্পদ বাড়ে, সুনামসুখ্যাতি হয় আর মনে মনে ভাবে, অনেক কিছু হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে কিছুই হচ্ছে না।
একদিন সে মরবে। তখন এর কোনওকিছুই তার সঙ্গে যাবে না। যদি কিছু নেক কাজ করে থাকে, কেবল তা-ই জমা থাকবে এবং তা-ই তার সঙ্গে যাবে।
একদিন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘরে এসে আম্মাজান আয়েশা সিদ্দীকা রাযি.-কে জিজ্ঞেস করলেন, কিছু আছে কি? তিনি বললেন, ছাগলের সামনের একটি রান আছে, আর সব বিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি বললেন, মূলত এই রানটিই নেই, বাকি সব আছে।জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৪৭০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২৪২৪০
অর্থাৎ এ রানটি খেয়ে শেষ করে ফেলা হবে, বিনিময়ে কিছু লাভ হবে না। পক্ষান্তরে যা-কিছু বিলিয়ে দিয়েছ, তার ছাওয়াব লেখা হবে এবং আখিরাতে তার প্রতিদান পাওয়া যাবে।
অপর এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমাদের মধ্যে এমন কে আছে, যার কাছে তার ওয়ারিশের সম্পদ নিজ সম্পদ অপেক্ষা বেশি প্রিয়? সাহাবীগণ বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ। আমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই। বরং আমাদের প্রত্যেকের কাছেই ওয়ারিশের সম্পদ অপেক্ষা নিজ সম্পদই বেশি প্রিয়। তিনি বললেন, তোমরা যা বললে বুঝে দেখ। তারা বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা তো এটাই জানি। তিনি বললেন, প্রকৃতপক্ষে তোমাদের প্রত্যেকেই এমন যে, তার কাছে নিজ সম্পদ অপেক্ষা ওয়ারিশের সম্পদই বেশি প্রিয়। তারা বললেন, কিভাবে ইয়া রাসুলাল্লাহ? তিনি বললেন, তোমাদের প্রত্যেকের সম্পদ তো আসলে সেটাই, যা তোমরা আখিরাতের জন্য পাঠাও। আর যা দুনিয়ায় রেখে যাও তা তো ওয়ারিশের সম্পন।সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬৪৪২; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৩৬১২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৩৬২৬
মোটকথা, এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা বান্দাকে আখিরাতের জন্য আমল করার প্রতি উৎসাহ দান করছেন। এতে জানানো হয়েছে যে, তোমরা দুনিয়ার জন্য যা সঞ্চয় কর, প্রকৃতপক্ষে তা কোনও কাজের নয়। কাজের কেবল তাই, যা আখিরাতের জন্য করে থাক। তোমরা আখিরাতের উদ্দেশ্যে যা-কিছু খরচ কর, তা শারীরিক শ্রম হোক বা অর্থ- সম্পদ, তোমাদের পক্ষে তাই শ্রেয়। তোমরা আল্লাহর কাছে তার উত্তম প্রতিদান পাবে।

ছয় নং আয়াত

وَمَا تَفْعَلُوا مِنْ خَيْرٍ فَإِنَّ اللَّهَ بِهِ عَلِيمٌ (215)

অর্থ : আর তোমরা কল্যাণকর যে কাজই কর না কেন, আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত।সূরা বাকারা, আয়াত ২১৫

ব্যাখ্যা

এ আয়াতেও আল্লাহ তা'আলা বান্দাকে নেক কাজের প্রতি উৎসাহিত করেছেন। তিনি জানাচ্ছেন যে, তোমরা যা-কিছুই ভালো কাজ কর, তা আল্লাহর পথে দান-সদাকা হোক বা শারীরিক ইবাদত-বন্দেগী, সবই আল্লাহ তা'আলা জানেন। এর কোনও কিছুই বৃথা যাবে না। আখিরাতে তিনি তোমাদেরকে এর পুরোপুরি প্রতিদান দেবেন। সুতরাং তোমরা কেবল ফরয আদায় করেই ক্ষান্ত হয়ো না, যতটা সম্ভব নফল ইবাদত-বন্দেগীও করতে থাক।
আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য এ আয়াত এক উৎসাহ বাণী। এর প্রতি লক্ষ রাখলে মুজাহাদা সহজ হয়ে যায়। কেননা যে-কোনও নেক কাজ করতে গেলেই নফস ও শয়তানের পক্ষ থেকে বাধা আসে। বাধা দেয় মানুষজনও। তখন যদি এ আয়াতের ধ্যান করা যায় এবং চিন্তা করা হয় যে, যে যা-ই বলুক না কেন, আল্লাহ তা'আলা দেখছেন এবং তিনি জানেন আমি কী করছি এবং কেন করছি, আমি এ কাজ করছি কেবলই আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টির জন্য, কাজেই আমি তাঁর কাছে এর পুরোপুরি প্রতিদান পাব- এরূপ চিন্তা করলে মনে শক্তি পাওয়া যায় এবং সকল বাধা টপকে ইবাদত-বন্দেগী করা সহজ হয়ে যায়।
পরোক্ষভাবে এ আয়াতে একটা সতর্কবাণীও আছে। বলা হয়েছে, আল্লাহ জানেন বান্দা কী নেক কাজ করছে। আল্লাহ যেমন কাজের প্রকাশ্য দিক জানেন, তেমনি জানেন গোপন অবস্থাও। সুতরাং আমল করতে হবে কেবলই আল্লাহ তা'আলাকে খুশি করার জন্য, দুনিয়াবী কোনও উদ্দেশ্যে নয়। এমনিভাবে আমল করতে হবে সুন্দরভাবে ও সুচারুরূপে। দানখয়রাতও করতে হবে নিজের পক্ষে যা সম্ভব সেই পরিমাণ, কোনওরূপে দায়সারাভাবে নয় । এবং দান করতে হবে উৎকৃষ্ট বস্তু, নিকৃষ্ট ও নিম্নমানের জিনিস নয়।
উপরে বর্ণিত প্রত্যেকটি আয়াতেই বান্দাকে মুজাহাদার প্রতি উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ এর দ্বারা বোঝানো হয়েছে যে, তোমরা শরী'আতের উপর চলা এবং আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী করার কাজে যত্নবান থাক। কোনও বাধাবিপত্তির পরোয়া করো না। নফস ও শয়তান কিংবা দীনবিমুখ মানুষ যত প্ররোচনাই দিক, তাতে ভ্রুক্ষেপ করো না। এদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে যাও। আখিরাতের জন্য প্রস্তুতি নাও। কুরআন মাজীদে এ সম্পর্কে আরও বহু আয়াত আছে। এখানে এ ছয়টি আয়াতেই ক্ষান্ত করা হল।
আল্লাহর ওলীর মর্যাদা, ওলীকে কষ্ট দেওয়ার পরিণাম এবং ওলী হওয়ার উপায়
হাদীছ নং: ৯৫

হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ তা'আলা বলেন, যে ব্যক্তি আমার কোনও ওলীর সাথে দুশমনি করে, আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিই। আমি আমার বান্দার উপর যা ফরয করেছি, আমার কাছে তারচে' বেশি প্রিয় এমন কোনও কাজ নেই, যা দ্বারা বান্দা আমার নৈকট্য লাভ করতে পারে। বান্দা নফল আমল দ্বারা আমার নৈকট্য লাভ করতে থাকে। একপর্যায়ে আমি তাকে ভালোবেসে ফেলি। আর আমি যখন তাকে ভালোবেসে ফেলি, তখন আমি তার কান হয়ে যাই, যা দিয়ে সে শোনে, তার চোখ হয়ে যাই, যা দিয়ে সে দেখে, তার হাত হয়ে যাই, যা দিয়ে সে ধরে এবং তার পা হয়ে যাই, যা দিয়ে সে চলে। তখন সে যদি আমার কাছে কিছু চায়, আমি তাকে তা দান করি। এবং সে যদি আমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে, তাকে অবশ্যই আশ্রয় দান করি। -বুখারী।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬৫০২)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এটি একটি হাদীছে কুদসী। 'হাদীছে কুদসী' বলা হয় এমন হাদীছকে, যার ভাব আল্লাহর, ভাষা রাসূলের এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা ব্যক্ত করেন আল্লাহর বরাতে। কুরআন মাজীদের সঙ্গে এর পার্থক্য এই যে, কুরআনের ভাষা অলৌকিক, কোনও মানুষের পক্ষে তার ছোট্ট একটি সূরার মত বাক্যমালা তৈরি করা সম্ভব নয়, কিন্তু হাদীছে কুদসীর ভাষা অলৌকিক নয়। কুরআন মাজীদ না বুঝে তিলাওয়াত করলেও ছাওয়াব হয়, কিন্তু হাদীছ যদি 'হাদীছে কুদসী'-ও হয়, তবুও তার তিলাওয়াতে ছাওয়াবের কোনও ওয়াদা নেই। কুরআন মাজীদ অপবিত্র অবস্থায় স্পর্শ করা জায়েয নয়, কিন্তু সর্বপ্রকার হাদীছই অপবিত্র অবস্থায়ও স্পর্শ করা যায়।

এ হাদীছে মৌলিকভাবে তিনটি বিষয় বর্ণিত হয়েছে।

ক. আল্লাহর ওলীর সঙ্গে দুশমনী করার পরিণাম;

খ. আল্লাহর ওলী হওয়ার উপায়;

গ. আল্লাহর ওলীর মর্যাদা ও মাহাত্ম্য।

আল্লাহর ওলীর সঙ্গে দুশমনি করার পরিণাম

এ হাদীছে আল্লাহ তা'আলা বলেন, যে ব্যক্তি আমার কোনও বন্ধুর সাথে শত্রুতা করে, আমি তার সঙ্গে যুদ্ধের ঘোষণা দিই। অর্থাৎ আমার বন্ধুর সঙ্গে শত্রুতার কারণে সে আমারও শত্রু হয়ে যায়। তাই আমি তার সঙ্গে শত্রুর মত আচরণ করি।
এটা একটা কঠিন সতর্কবাণী। ওলীর শত্রুকে আল্লাহ নিজ শত্রুরূপে গণ্য করেছেন। এবং তার সঙ্গে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছেন। আল্লাহ তা'আলা যার সঙ্গে যুদ্ধের ঘোষণা দেন, সে কখনও সফল হতে পারে কি? তার জন্য তো ধ্বংস অনিবার্য। আল্লাহ তা'আলা এক অসীম শক্তিমান সত্তা। কোনও মাখলুক যত বড়ই শক্তিশালী হোক, তার ক্ষমতা যত বিপুল হোক, সর্বাবস্থায়ই তার শক্তি ও ক্ষমতা সীমিত। অসীম শক্তিমানের বিরুদ্ধে সসীম ক্ষমতাবানের কোনও তুলনা হয় না। এ দুইয়ের মধ্যে কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে না। কাজেই আল্লাহ তা'আলা যদি কাউকে শাস্তি দিতে চান তা ঠেকানোর সাধ্য কারও নেই।
আল্লাহ তাঁর ওলীর শত্রুকে যেভাবে ইচ্ছা শাস্তি দিতে পারেন। অতীতে এর বিভিন্ন রকম নজির আছে। আল্লাহর ওলীকে কষ্ট দেওয়ার ফলে কারও অপমৃত্যু হয়েছে, কেউ অন্ধ, কেউ বিকলাঙ্গ হয়ে গেছে, কেউ অগ্নিকাণ্ডের শিকার হয়েছে, কেউ বা অন্য কোনও বিপদে পড়েছে।
অনেক সময় আল্লাহ কাকে কিভাবে শাস্তি দেন তা উপলব্ধিও করা যায় না। ফলে শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তি বুঝতে পারে না যে, সে শাস্তিভোগের ভেতর দিয়ে চলছে। এরকম শাস্তিই বেশি ভয়ানক। অনেক সময় আল্লাহর ওলীর দুশমন বেশ বেঁচে-বর্তে থাকে। মনে করা হয় তার দিন তো ভালোই কাটছে। প্রকৃতপক্ষে তার দিন ভালো কাটে না। কেননা আল্লাহ তা'আলা তার ন্যায়-অন্যায়বোধ লোপ করে দেন। পাপাচারকে তার কাছে প্রিয় করে তোলেন। সে শত্রুতা করে মজা পায়। অন্যায়-অনাচারে আনন্দ বোধ করে। তা করে এই জন্যে যে, তার স্বভাবপ্রকৃতি বিকৃত হয়ে গেছে। বোধবুদ্ধি নষ্ট হয়ে গেছে। মনের সুকুমারবৃত্তির বিলোপ ঘটেছে। ফলে আকৃতিতে মানুষ থাকলেও প্রকৃতিতে মানুষ থাকে না। মানবরূপের অমানুষ হয়ে যায়। এ তো সাক্ষাৎ শাস্তি! এককালে আল্লাহ তা'আলা আকৃতি বিকৃত করার শাস্তিও দিতেন। কঠিন পাপীকে শূকর, বানর বানিয়ে দিতেন। এ উম্মতকে সেরকম শাস্তি দেওয়া হয় না। তবে স্বভাবপ্রকৃতি বিকৃত করার শাস্তি দেওয়া হয়ে থাকে, যা অনেক সময় মানুষ বুঝতে পারে না। ফলে সে আরও বেশি পাপাচারে লিপ্ত হয় এবং একপর্যায়ে ঈমানহারা হয়ে জাহান্নামের ইন্ধনে পরিণত হয়। এমন ঘটনাও আছে যে, এককালের দীনের খাদেম ও প্রচারক পরবর্তীকালে বেদীন-বেঈমান হয়ে কবরে চলে গেছে। একবার দীনী গবেষক এবং সুবক্তা ও সুলেখক পরবর্তীকালে নাস্তিক বা ভণ্ড নবী সেজে বসেছে। অনুসন্ধান করে দেখা গেছে তার এ পরিণতি কোনও আল্লাহওয়ালাকে কষ্ট দেওয়া বা কোনও বুযুর্গের সঙ্গে বেআদবী করার ফল। কাজেই এ ব্যাপারে খুব সাবধান হওয়া উচিত। আল্লাহ তা'আলা আমাদের হেফাজত করুন।

আল্লাহর ওলী হওয়ার উপায়

'ওলী' শব্দের অর্থ বুঝতে পারলে ওলী হওয়ার উপায় সহজেই বোঝা যাবে। ٌُوَلِىّ (ওলী) শব্দটির উৎপত্তি وَلْىٌُ থেকে, যার অর্থ নিকটবর্তী হওয়া। সে হিসেবে وَلِىٌُ অর্থ নিকটবর্তী ও ঘনিষ্ঠ। অথবা এর উৎপত্তি وِلايَةٌ থেকে, যার অর্থ ভালোবাসা, বন্ধুত্ব করা ও আসক্ত হওয়া। সে হিসেবে ٌُوَلِىّ মানে বন্ধু ও প্রিয়জন। উভয় অর্থের মধ্যে মিল স্পষ্ট। যে ব্যক্তি কারও বন্ধু ও ভালোবাসার পাত্র, সে তার ঘনিষ্ঠ ও নিকটবর্তীও বটে। যারা আল্লাহর ওলী, তারা কোনও উপায়ে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করে। ফলে তাঁর মহব্বত ও ভালোবাসার পাত্র হয়ে যায়। তা কী উপায়ে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা যায়? কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

أَلَا إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللَّهِ لَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ (62) الَّذِينَ آمَنُوا وَكَانُوا يَتَّقُونَ (63)

অর্থ : স্মরণ রেখ, যারা আল্লাহর বন্ধু তাদের কোনও ভয় থাকবে না এবং তারা দুঃখিতও হবে না। তারা সেইসব লোক, যারা ঈমান এনেছে এবং তাকওয়া অবলম্বন করেছে।সূরা ইউনুস, আয়াত ৬১-৬২

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-

إِنْ أَوْلِيَاؤُهُ إِلَّا الْمُتَّقُونَ

অর্থ : তাঁর ওলী তো ওই সকল লোক, যারা তাকওয়া অবলম্বন করে চলে।সূরা আনফাল, আয়াত ৩৪
তাকওয়া অবলম্বন করা মানে আল্লাহ তা'আলার আদেশ-নিষেধ মেনে চলা এবং মনের সম্পর্ক গায়রুল্লাহ থেকে ছিন্ন করে আল্লাহর সঙ্গে এমনভাবে স্থাপন করা যে, প্রত্যেকটি কাজে কেবল তাঁর সন্তুষ্টিই হয় লক্ষ্যবস্তু আর তাঁর নৈকট্য ও ভালোবাসা পাওয়াই হয় তার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান। যাদের মনের অবস্থা এরকম হয়, তারা ফরয- ওয়াজিব আদায়ের পাশাপাশি বেশি বেশি নফল আমলে যত্নবান থাকে, সর্বক্ষণ তাঁর যিকর-আযকারে রত থাকে এবং একমুহূর্তও তাঁর স্মরণ থেকে গাফেল হয় না।
এ হাদীছে আল্লাহর ওলী হওয়ার উপায় বলা হয়েছে 'ইবাদত-বন্দেগীকে। এটা যেন ওই সকল আয়াতেরই ব্যাখ্যা, যাতে তাকওয়া-পরহেযগারীকে ওলীর গুণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ হাদীছে কুদসীতে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেছেন, ফরয আমলই তাঁর কাছে সবচে' বেশি প্রিয়। এর মাধ্যমেই তাঁর নৈকট্য বেশি লাভ হয়। আল্লাহর নৈকট্যলাভের জন্য এর সমতুল্য অন্য কোনও আমল নেই।
ফরয আমল দুই প্রকার- হাক্কুল্লাহ ও হাক্কুল ইবাদ। নামায, রোযা ইত্যাদি হচ্ছে হাক্কুল্লাহ- আল্লাহর হক। বান্দার হক নানারকম। এর মধ্যে রয়েছে পিতামাতার হক, ছেলেমেয়ের হক, স্বামী-স্ত্রীর হক, প্রতিবেশীর হক, ছোট ও বড়র হক, 'উলামায়ে কিরামের হক, বিভিন্ন রকমের আমানত আদায়, সত্য কথা বলা, ওয়াদা রক্ষা করা, ন্যায়বিচার করা ইত্যাদি। এ সবই ফরয। আল্লাহর ওলী হওয়ার জন্য এসব ফরয আদায় করা অবশ্যকর্তব্য। নফলের তুলনায় এর গুরুত্ব অনেক অনেক বেশি। কেননা নফল আমল আদায় করলে ছাওয়াব পাওয়া যায়, কিন্তু আদায় না করলে কোনও গুনাহ নেই এবং কোনও শাস্তিও নেই। পক্ষান্তরে ফরয আমল আদায় করলে তার ছাওয়াব তো আছেই, সেইসঙ্গে আদায় না করলে হয় কঠিন গুনাহ এবং সে কারণে বান্দা শাস্তির উপযুক্ত হয়ে যায়, যা তাওবা ছাড়া মাফও হয় না। সুতরাং নফল অপেক্ষা ফরয বেশি পূর্ণাঙ্গ। তাই আল্লাহর নৈকট্য লাভের পক্ষেও বেশি সহায়ক।
প্রকাশ থাকে যে, আল্লাহ তা'আলা যেসব কাজ হারাম করেছেন তা থেকে বেঁচে থাকাও ফরয। সুতরাং ফরয আমলের কথা বললে হারাম থেকে বেঁচে থাকার বিষয়টাও চলে আসে। যদি কোনও ব্যক্তি হারাম কাজ থেকে বেঁচে না থাকে, তবে সে ফরয তরকের গুনাহে লিপ্ত হল। এ অবস্থায় নফল দ্বারা তার পক্ষে বেশি অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়। বরং কোনও হারাম তো এমন আছে, যাতে লিপ্ত হলে নফল তো বটেই, ফরয কাজও আটকে যায়, যেমন হারাম উপার্জন। যার পানাহার হালাল নয়, পরিধানের কাপড়ও হারাম টাকায় কেনা, আল্লাহ তা'আলার কাছে তার কোনও ইবাদত-বন্দেগী কবুল হয় না। সুতরাং আল্লাহর নৈকট্যকামীর কর্তব্য এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা।
অনেকে এ বিষয়টা বোঝে না। তারা অনেক নফল আমলে বেশ যত্নবান থাকে। অন্যদিকে বহু ফরয আদায়ে অবহেলা করে। হারাম উপার্জন থেকেও বেঁচে থাকে না। এবং অন্যান্য নিষিদ্ধ কাজে লিপ্ত হতেও দ্বিধাবোধ করে না। হয়তো রাতভর তাহাজ্জুদ পড়ে। কিন্তু পিতামাতার হক আদায় করে না। হয়তো পাগড়ি বেঁধে চলাফেরা করে। অপরদিকে প্রতিবেশীকেও কষ্ট দেয়। দাওয়াতের কাজে দিনরাত ব্যস্ত থাকে। অপরদিকে মীরাছের প্রাপ্য অংশ থেকে বোনকে বঞ্চিত করে কিংবা আমানত আদায়ে অবহেলা করে আর এভাবে হারাম পানাহারে লিপ্ত থাকে।
এরকম আরও উদাহরণ দেওয়া যায়, যাতে সুন্নত ও নফলে আগ্রহের পাশাপাশি ফরয-ওয়াজিবে অবহেলা প্রদর্শন করা হয়। এটা নিতান্তই ভুল। ফরয অবজ্ঞা করে যতবেশিই নফল আদায় করা হোক না কেন, তা দ্বারা কোনওদিন আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যাবে না। আল্লাহর নৈকট্যলাভের জন্য ফরয হচ্ছে মূল ভিত্তি। নফল সে ভিত্তির উপর স্থাপিত দালান-কোঠা। ভিত্তি মজবুত না করে যদি উপরে উপরে ইট গাঁথা হয়, তবে তা দিয়ে দালান-কোঠা হয় না। তদ্রূপ ফরয আদায় না করে যতই নফল আমল করা হোক, তা দিয়ে বেলায়েত হাসিল হবে না। এজন্যই আল্লাহ তা'আলা এ হাদীছে প্রথমে ফরয আদায় করার কথা বলেছেন, যাতে বেলায়েতের ভিত্তি স্থাপিত হয়ে যায়। তারপর নফলের কথা বলেছেন।
আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন, আমার বান্দা নফলের মাধ্যমে আমার নৈকট্য অর্জন করতে থাকে। পরিশেষে আমি তাকে ভালোবেসে ফেলি। প্রকাশ থাকে যে, যত রকম ফরয ইবাদত আছে তার প্রত্যেকটির সমজাতীয় নফলও আছে। যেমন, ফরয নামাযের পাশাপাশি নফল নামায, যাকাতের পাশাপাশি নফল দান-সদাকা, ফরয হজ্জের পর নফল হজ্জ এবং ফরয রোযার সঙ্গে নফল রোযা। এমনিভাবে কুরআন তিলাওয়াত, যিকর-আযকার, বিভিন্ন কাজের আগের পরের দু'আ ও দুরূদ শরীফ পাঠ- এগুলোও অনেক মূল্যবান নফল আমল। এগুলোর মাধ্যমেও আল্লাহ তা'আলার নৈকট্য লাভ করা যায়।
কুরআন মাজীদ আল্লাহর কালাম। আল্লাহর নিকট থেকে মানুষের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে। বুযুর্গানে দীন বলেন, যে জিনিস আল্লাহর নিকট থেকে মানুষের কাছে এসেছে, আল্লাহর নৈকট্য লাভের পক্ষে তা অনেক বড় অবলম্বন। সুতরাং যে ব্যক্তি যত বেশি কুরআন তিলাওয়াত করবে, আল্লাহর নৈকট্যও তার তত বেশি অর্জিত হবে। বস্তুত কুরআন তিলাওয়াত শ্রেষ্ঠতম যিকর। আর যিকর সম্পর্কে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-

فَاذْكُرُونِي أَذْكُرْكُمْ

তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমিও তোমাদের স্মরণ করব।সূরা বাকারা, আয়াত ১৫২
যিকরের মর্যাদা ও মহিমা বোঝার জন্য এরচে' বড় সনদ আর কী হতে পারে? যে কাজ করলে আল্লাহ স্বয়ং বান্দাকে স্মরণ করেন, সে কাজ কতই না মহিমাপূর্ণ।
বান্দার হকের ক্ষেত্রেও ফরযের পাশাপাশি নফল আমলও আছে। পিতামাতার যতটুকু সেবাযত্ন করা ফরয, কেউ যদি তারচে' বেশি করে তবে তা নফল হবে। কিন্তু সে নফল অনেক মূল্যবান। বেশি বেশি খেদমত করে যে যত তাদেরকে খুশি করতে পারবে, দুনিয়া ও আখিরাতে সে ততই লাভবান হবে। অনুরূপ আল্লাহ তা'আলার সৃষ্টিমালার প্রতি নিজ কর্তব্যপালনের পর অতিরিক্ত যত সেবা দান করা যাবে, আল্লাহ তা'আলার ততই বেশি সন্তুষ্টি লাভ হবে। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে- “সৃষ্টিমালা আল্লাহর পরিবার। আল্লাহর সর্বাপেক্ষা প্রিয় বান্দা সে-ই, যে আল্লাহর পরিবারের সদস্যবর্গের প্রতি বেশি সময় থাকে”। আল্লাহর প্রিয় হওয়া তাঁর ওলী হওয়াই তো বটে। সুতরাং আল্লাহর ওলী হওয়ার একটা বড় মাধ্যম এটাও যে, প্রাণভরে তাঁর সৃষ্টিসমূহের সেবা করা হবে।

আল্লাহর ওলীর মর্যাদা ও মাহাত্ম্য

এ হাদীছে আল্লাহ তা'আলা তাঁর ওলীর তিনটি ফযীলত বয়ান করেছেন।

ক. তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঠিক ব্যবহার হওয়া;

খ. তার দু'আ কবুল হওয়া;

গ. বিপদ-আপদ থেকে তাকে রক্ষা করা।

আল্লাহ তা'আলা জানান যে, বান্দা যখন ফরয ইবাদতের পাশাপাশি নফল আমলে রত থাকে, তখন আল্লাহ তা'আলা তাকে ভালোবেসে ফেলেন। এভাবে বান্দা আল্লাহর ওলী ও বন্ধুতে পরিণত হয়ে যায়। আর যখন সে তাঁর ওলী হয়ে যায় এবং তিনি তাকে ভালোবেসে ফেলেন, তখন তিনি তার কান, চোখ, হাত ও পায়ে পরিণত হয়ে যান। এর অর্থ আল্লাহ তা'আলার মানবরূপ ধারণ করা নয়, তিনি মানুষে পরিণত হয়ে যান এমন নয়; বরং মানুষ যাতে এসব অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সঠিক ব্যবহার করতে পারে সে ব্যাপারে তিনি তার সাহায্য করেন। মানুষ বেশিরভাগ গুনাহ এসব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দ্বারাই করে থাকে। কিন্তু মানুষ যখন আল্লাহর ওলী ও বন্ধুতে পরিণত হয়ে যায়, তখন আল্লাহর সাহায্যে সে গুনাহ থেকে বাঁচতে সক্ষম হয় এবং এসব অঙ্গকে নেক কাজে ব্যবহার করার সুযোগ পায়। সে তার কান দিয়ে কোনও অবৈধ ও অহেতুক কথা শোনে না। এমন কথাই শোনে, যাতে আল্লাহ সন্তুষ্ট হন। সে তার চোখ দিয়ে কোনও অবৈধ বস্তু দেখে না; বরং এমন জিনিস দেখে, যাতে পুণ্য অর্জিত হয়। সে তার হাত দিয়ে কোনও হারাম বস্তু স্পর্শ করে না; বরং এমন কাজ করে, যাতে আমিরাতের সঞ্চয় হয়। এবং সে তার পা দিয়ে কোনও অবৈধ পথে চলে না; বরং এমন পথে চলে, যাতে দুনিয়া ও আখিরাতের প্রভূত কল্যাণ সাধিত হয়।
আল্লাহ তা'আলা বলেন, সে আমার কাছে যদি কিছু চায়, তাকে তা দান করি। অর্থাৎ বান্দা যখন ফরয ও নফল ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে ও তাঁর ওলী হয়ে যায়, তখন সে 'মুস্তাজাবুদ্দা'ওয়া' হয়ে যায়। 'মুস্তাজাবুদ্দা'ওয়া' বলে এমন ব্যক্তিকে, যার দু'আ আল্লাহ কবুল করেন। আমরা অতীতের এমন বহু ওলী-বুযুর্গ সম্পর্কে জানতে পারি, যাদের দু'আ আল্লাহ তা'আলা কবুল করতেন। তাদের দু'আ কবুলের অনেক বিস্ময়কর ঘটনা বর্ণিত আছে। এমন অনেক ঘটনাও আছে, যা তাদের কারামাত হিসেবে স্বীকৃত।
এমনিতে তো আল্লাহর কাছে দু'আর দরজা সকলের জন্যই খোলা। কিন্তু এমন অনেক গুনাহ আছে, যা দু'আ কবুলের পক্ষে বাধা। যেমন, মদ পান করা, হারাম পানাহার করা, মুসলিম ব্যক্তির প্রতি ঘৃণা পোষণ করা ইত্যাদি। ওলী-বুযুর্গগণ যেহেতু এ জাতীয় গুনাহ থেকে দূরে থাকেন, তাই তাদের দু'আ কবুলে কোনও বাধা থাকে না। তারা আল্লাহর কাছে যে দু'আই করেন, আল্লাহ নিজ হিকমত অনুযায়ী তা কবুল করে থাকেন।
ওলী-বুযুর্গদের এটাও একটা ফযীলত যে, তারা আল্লাহর কাছে যখন কোনও অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করেন, তখন আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে তা থেকে রক্ষা করেন। বস্তুত এক বন্ধুর সঙ্গে অপর বন্ধুর আচরণ এমনই হয়ে থাকে। আল্লাহ তা'আলা যেহেতু অসীম ক্ষমতার মালিক, তাই তিনি নিজ ওলী ও বন্ধুর সব মনোবাঞ্ছাই পূরণ করেন। আর এটা তো স্পষ্ট যে, ওলী ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলার কাছে অবাঞ্ছনীয় কিছু প্রার্থনা করেন না। তার দীন ও আখিরাতের পক্ষে যা ক্ষতিকর, যা তার ঈমান ও আমলে সালিহার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ, তিনি কেবল তা থেকেই বাঁচতে চাবেন। আল্লাহ তা'আলাও তাকে নিজ দয়ায় সেরকম পরিস্থিতি থেকে বাঁচিয়ে নেন। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে তাঁর মর্জি মোতাবেক আমল করার তাওফীক দান করুন, আমীন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. ফরয আমল সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। এটাই আল্লাহর নৈকট্য লাভের ভিত্তি।

খ. নফল ইবাদত-বন্দেগীকে অবহেলা করা উচিত নয়। এটা আল্লাহর ওলীগণের শান। এর মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্যলাভ ত্বরান্বিত হয়।

গ. আল্লাহর নৈকট্যলাভ গুনাহ হতে আত্মরক্ষার পক্ষে সহায়ক। আল্লাহ তা'আলা ওলী- বুযুর্গদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে গুনাহের কাজে ব্যবহার করা থেকে হেফাজত করেন।

ঘ. ইবাদত-বন্দেগীতে যত্নবান থাকাটা বালা-মসিবত থেকে আত্মরক্ষার পক্ষেও সহায়ক।

ঙ. ফরয ও নফল ইবাদত-বন্দেগী যত বেশি করা যায়, ততই দু'আ কবুলের বেশি আশা থাকে।

চ. শরী'আতের অনুসরণ ছাড়া কখনও ওলী-বুযুর্গ হওয়া যায় না। সুতরাং খাঁটি বুযুর্গের আলামত হল শরী'আতের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ।

ছ. যে ব্যক্তি ওলী-বুযুর্গের সঙ্গে শত্রুতা করে, সে আল্লাহর শত্রু হয়ে যায়। সুতরাং ওলী-বুযুর্গদের সঙ্গে শত্রুতা করা, তাদের মনে কষ্ট দেওয়া এবং তাদের সঙ্গে বেআদবী করা থেকে যথাসম্ভব বেঁচে থাকা উচিত।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন