রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং:
হাজ্জাজ ইবন ইউসুফের পরিচয়

হাজ্জাজ ইবন ইউসুফ ছিলেন বিখ্যাত ছাকীফ গোত্রের লোক। উমাইয়া বংশীয় খলিফা আব্দুল মালিক ইবন মারওয়ানের আমলে তিনি ইরাকের গভর্নর ছিলেন। একজন জালেম শাসক হিসেবে তার কুখ্যাতি আছে। বহু সংখ্যক সাহাবী ও বিশিষ্ট তাবিঈকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছেন। হযরত 'আব্দুল্লাহ ইবন যুবায়র রাযি.-কে হত্যা করার জন্য পবিত্র কা‘বা অবরোধ, কামান দ্বারা তার ভেতর গোলাবর্ষণ, হারামাইন শরীফাইনের অধিবাসীদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ, বিলম্বে নামায আদায় করা-সহ তার স্বৈরাচারী কর্মকাণ্ডের তালিকা অনেক দীর্ঘ। তবে এতসব কুকীর্তির পাশাপাশি বহু সুকীর্তির জন্যও তিনি ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় হয়ে আছেন। যেমন, কুরআন মাজীদের প্রতি বিশেষ মহব্বত ও সম্মান প্রদর্শন, উগ্র খারিজী সম্প্রদায়ের দমন ও ইতিহাসখ্যাত মুসলিম সেনানায়কদের মাধ্যমে ইসলামের দিগ্বিজয়। দীর্ঘ বিশ বছর দুর্দান্ত প্রতাপের সাথে শাসনকার্য পরিচালনার পর হিজরী ৯৫ সালের রমযান মাসে তিনি ইন্তিকাল করেন।
ভবিষ্যৎ-অপেক্ষা বর্তমানই শ্রেষ্ঠ, প্রত্যেকের উচিত বর্তমানকে কাজে লাগানো
হাদীছ নং: ৯২

যুবায়র ইবন আদী রহ. বলেন, আমরা হযরত আনাস ইবন মালিক রাযি.-এর কাছে এসে হাজ্জাজ (ইবন ইউসুফ)-এর যে জুলুম-অত্যাচার ভোগ করছিলাম সে সম্পর্কে অভিযোগ করলাম। তিনি বললেন, ধৈর্য ধর। কেননা যে যমানাই আসে তার তুলনায় পরের যমানাটি বেশি মন্দ, যাবত না তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের সাথে মিলিত হবে। এ কথা আমি তোমাদের নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে শুনেছি। -বুখারী।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৭০৬৮; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৬০৬; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১২৩৬৯)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

যুবায়র ইবন আদী ছিলেন 'রায়' অঞ্চলের বিচারপতি। তিনি একজন উচ্চস্তরের ফকীহ ও নির্ভরযোগ্য মুহাদ্দিছও ছিলেন। হাজ্জাজের স্বৈরশাসন ও নিষ্ঠুরতায় সে কালের শান্তিকামী সমস্ত মানুষই অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিলেন। সকলেই সময় শুনছিল কবে তার জুলুমনিপীড়ন থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। কিন্তু কষ্টের সময় যেন আর ফুরায় না। বিখ্যাত সাহাবী হযরত আনাস ইবন মালিক রাযি. তখন জীবিত। হাজ্জাজ ইবন ইউসুফ তাঁর সঙ্গেও ন্যাক্কারজনক আচরণ করেছিলেন। এজন্য খলিফা আব্দুল মালিক ইবন মারওয়ান হাজ্জাজকে কঠিন ভাষায় তিরস্কার করেছিলেন। যাহোক, আর সব মুক্তিকামী মানুষের মত যুবায়র ইবন 'আদী রহ.-ও মনেপ্রাণে কামনা করছিলেন যাতে হাজ্জাজের দুঃশাসন থেকে মানুষের নাজাত লাভ হয়। সেজন্যই তিনি মহান সাহাবী হযরত আনাস ইবন মালিক রাযি.-এর কাছে হাজ্জাজের জুলুমনির্যাতনের কথা ব্যক্ত করেন। হয়তো আশা ছিল এ ব্যাপারে তিনি আল্লাহ তা'আলার কাছে খাস করে দু'আ করবেন।
হযরত আনাস রাযি. একটা বাস্তব অবস্থার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং ধৈর্যধারণ করতে বলেন। তিনি বলেন, প্রত্যেক পরবর্তীকাল তার আগের কাল অপেক্ষা মন্দ হয়ে থাকে। তাই প্রত্যেকের উচিত বর্তমান সময়কে নষ্ট না করে কতবেশি নেক কাজ করা যায় সেই চেষ্টা করা। কেননা কোনও কালই কষ্টক্লেশ থেকে মুক্ত হয় না। বরং যে কাল যায় তুলনামূলকভাবে সেটিই ভালো যায়, পরের কালটি আরও বেশি কষ্টক্লেশপূর্ণ হয়। কাজেই বর্তমান সময়টা কষ্টের এই অজুহাতে আমল থেকে বিরত থাকলে পরে কখনওই আমলের সুযোগ হবে না, যেহেতু পরের সময়টা আরও বেশি কষ্টের হবে।
প্রত্যেক পরবর্তী সময় যে আগের সময় অপেক্ষা মন্দ হয়ে থাকে, এটা একটা প্রাকৃতিক রীতি, যা আল্লাহ তা'আলা আগে থেকেই চালু করে রেখেছেন। যুগ যুগব্যাপী এরকমই চলে আসছে। হাঁ, মাঝেমধ্যে কখনও এমনও হয় যে, পরের সময়টা আগের চেয়ে তুলনামূলকভাবে ভালো। কিন্তু সেটা ব্যতিক্রম। সে ব্যতিক্রমও আল্লাহ তা'আলারই ইচ্ছার প্রকাশ। সব ব্যাপারেই আল্লাহ তা'আলা ব্যতিক্রম কিছু করেন,যাতে মানুষ বুঝতে পারে আল্লাহ কোনও নিয়মের মুখাপেক্ষী নন। নিয়ম তাঁরই সৃষ্টি এবং চাইলে তিনি নিয়মের ব্যতিক্রমও করতে পারেন।
“উলামায়ে কিরামের কেউ কেউ বলেন, প্রত্যেক পরবর্তীকাল যে আগের কাল অপেক্ষা মন্দ হয়, এর কারণ মহানবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের নূরানী কাল হতে দূরে সরে যাওয়া। সর্বোত্তম কাল ছিল সাহাবায়ে কিরামের কাল। কারণ তা নবুওয়াতী নূর ও বরকত দ্বারা প্লাবিত ছিল। দ্বিতীয় পর্যায়ে ছিল তাবিঈদের যুগ। নবীযুগ থেকে একটু দূরে সরে যাওয়ায় তা সাহাবায়ে কিরামের যুগের মত অতবেশি নবুওয়াতী নূর ও বরকতের প্লাবন লাভ করতে পারেনি। তাই এ যুগটি সাহাবী-যুগের মত হতে পারেনি। কিন্তু পরবর্তী যুগ অপেক্ষা যেহেতু নবুওয়াতী যুগের কাছে ছিল, তাই পরের যে-কোনও যুগ অপেক্ষা এই যুগটি উত্তম ছিল। এভাবেই পর্যায়ক্রমে প্রত্যেক যুগ তার পূর্ববর্তী যুগ অপেক্ষা নবীযুগ থেকে দূরে সরতে থেকেছে আর বরকতও কমতে থেকেছে। পর্যায়ক্রমে বরকত কমে যাওয়ায় ফিতনাফাসাদও বাড়তে থেকেছে। সে ফিতনাফাসাদ বিভিন্ন রকমের।
এক ফিতনা হয়েছে দীনের ছদ্মাবরণে। সাহাবায়ে কিরাম ও তাবিঈগণ দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়ার পর যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, পরবর্তীকালে অনেক বড় বড় 'উলামা ও ফুকাহা জন্ম নিলেও সে শূন্যতা পুরোপুরি পূরণ হওয়া সম্ভব হয়নি। সে শূন্যতা ছিল “ইলম ও আমলের। তা পুরোপুরি পূরণ না হওয়ায় অজ্ঞতা ও অজ্ঞতাজনিত বেআমলীর ক্রমবিস্তার হয়েছে। অজ্ঞতা থেকে বিদ'আতী কার্যক্রমও জন্ম নিয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে নতুন নতুন দল ও উপদল। এদের মধ্যে পরস্পর কোন্দল ও হানাহানি হয়েছে। এভাবে উম্মতের মধ্যে পর্যায়ক্রমে অশান্তি ও অস্থিরতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
আরেক ফিতনা ফাসাদ দেখা দিয়েছে দুনিয়াকে কেন্দ্র করে। একসময় শাসন ছিল পুরোপুরি ইসলামী। অর্থাৎ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের রেখে যাওয়া তরীকার খেলাফত। সাহাবায়ে কিরামের আমল শেষ হলে খেলাফতী ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসে। ক্রমে রাজ্যশাসনের ব্যাপারটা পুরোপুরি দীন ও ঈমানকেন্দ্রিক না থেকে দুনিয়ামুখী হয়ে পড়ে। মানুষের মধ্যে ক্ষমতা দখল ও ক্ষমতা ধরে রাখার লোভলালসা দেখা দিতে থাকে। ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে মারামারি ও হানাহানি শুরু হয়ে যায়। ফলে মানুষের জান, মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা হারিয়ে যেতে থাকে। মানুষের দুঃখকষ্ট ও সামাজিক অন্যায়-অনাচার বাড়তেই থাকে। এভাবে প্রত্যেক পরবর্তীকাল আগের কাল অপেক্ষা বেশি দুঃখজনক ও বেশি অনাচারপূর্ণ হয়ে যায়।
মোটকথা সময়ের ক্রম-অবক্ষয় প্রকৃতির এক অমোঘ বাস্তবতা। সামান্য ব্যতিক্রম বাদ দিলে এভাবেই যুগের পর যুগ চলে আসছে। হযরত আনাস রাযি. সে বাস্তবতার দিকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
কারও মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, পরবর্তীকালেও তো অনেক বড় বড় মানুষ জন্ম নিয়েছেন, অনেক বড় বড় ফকীহ ও মুজতাহিদ উম্মতের অসামান্য খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন, ইমাম আবূ হানীফা রহ., ইমাম মালিক রহ., ইমাম শাফি'ঈ রহ. ও ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল রহ.-এর মত ফকীহগণের বিস্ময়কর ইলমী খেদমত দ্বারা শত শত বছর যাবৎ বিশ্বের অসংখ্য মুসলিম উপকৃত হয়ে আসছে, আশা করা যায় অনাগত ভবিষ্যতেও তাদের সে কল্যাণধারা জারি থাকবে, পরবর্তীকালীন বুযুর্গানে দীনের মধ্যে এমন অনেকের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, যারা পূর্ববর্তীকালীন আওলিয়া কিরামের সাথে তুলনীয়, এমতাবস্থায় প্রতিটি পরবর্তীকাল পূর্ববর্তীকাল অপেক্ষা মন্দ, সাধারণভাবে এ কথা কী করে বলা যায়? এ প্রশ্নটি শক্তিশালী হয় একটি হাদীছের কারণেও। মহানবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

مَثَلُ أُمَّتِي مَثَلُ الْمَطَرِ، لَا يُدْرَى أَوَّلُهُ خَيْرٌ أَمْ آخِرُهُ

“আমার উম্মতের দৃষ্টান্ত বৃষ্টির মত। জানা যায় না, তার প্রথমটা বেশি ভালো না শেষেরটা।জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৮৬৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১২৩২৭: তবারানী, আল- মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ৬৫; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৭২২৬
এ হাদীছ দ্বারা বোঝা যায় এ উম্মতের পরবর্তীকালের লোকদের মধ্যেও প্রথমদিকের লোকদের মত উৎকৃষ্ট মানুষের জন্ম হতে পারে। অথচ আলোচ্য হাদীছে সাধারণভাবেই পরবর্তীকালকে পূর্ববর্তীকাল অপেক্ষা মন্দ সাব্যস্ত করা হয়েছে। এর কী উত্তর?
উত্তর : প্রকৃতপক্ষে উভয় হাদীছের মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। কেননা প্রথম হাদীছে যমানা সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, প্রত্যেক পরের যমানা পূর্বের যমানা অপেক্ষা মন্দ হবে। এটা বলা হয়েছে মানুষের আনুপাতিক হার হিসেবে। অর্থাৎ তুলনামূলকভাবে পরবর্তীকাল অপেক্ষা পূর্ববর্তীকালের লোকজন বেশি ভালো হয়ে থাকে। ভালোদের সংখ্যা মন্দদের তুলনায় পূর্বের কালে যেমন থাকে, পরের কালে সে হারে থাকে না। ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে। যদিও দু-চারজনের বেলায় এর ব্যতিক্রম ঘটতে পারে। সেই ব্যতিক্রমের কথাই পরের হাদীছে বলা হয়েছে। এমন হতে পারে যে, পরবর্তীকালের কোনও কোনও ব্যক্তি 'ইলম, আমল ও জ্ঞানগরিমায় পূর্ববর্তীকালের বহু লোককে টপকে গেছে। এমনিভাবে এটাও সম্ভব যে, পূর্বকালের কোনও কোনও ব্যক্তি এত মন্দ এবং এমন নিষ্ঠুর ও পাপিষ্ঠ, যার তুলনা পরবর্তী শত শত বছরেও পাওয়া যায় না। কিন্তু এটা কেবলই ব্যক্তিবিচারে। সমষ্টিগতভাবে লক্ষ করলে এরকম পাওয়া যাবে না। বরং সমষ্টিগতভাবে মানুষের ইলম ও আমল, জ্ঞান ও গরিমা, তাকওয়া-পরহেযগারী ও দীনদারী ক্রমান্বয়ে নিচের দিকেই নামছে। আর মন্দ লোকের সংখ্যা যখন বাড়তে থাকে, তখন পরিবেশের উপর তার মন্দ প্রভাবও বাড়তে থাকে। ফলে প্রত্যেক পূর্ববর্তীকাল অপেক্ষা পরবর্তীকালীন দীনী পরিবেশ উত্তরোত্তর মন্দ হতে থাকে। ক্রমবর্ধমান সেই মন্দত্বের দিকে লক্ষ করে বলা হয়েছে- প্রত্যেক পরের কাল আগের কাল অপেক্ষা বেশি মন্দ। আর পৃথক পৃথক ব্যক্তির দিকে লক্ষ করে এ উম্মতকে বৃষ্টির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, যা দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য পরবর্তীকালেও পূর্ববর্তীকালের মত ভালো ভালো লোকের জন্ম হতে পারে। সুতরাং দুই হাদীছের মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। উভয় হাদীছের বক্তব্যই সত্য ও বাস্তবসম্মত।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ


ক. এ হাদীছেরও প্রধান শিক্ষা- বর্তমান সময়কে কাজে লাগাও। কোনও আমলকে আগামী দিনের জন্য রেখে দিও না।

খ. শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে অভিযোগ করার কোনও ফায়দা নেই। সময়ের বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে ধৈর্যধারণ করলে মনে শক্তি পাওয়া যায় এবং তাতে আমল করা সহজ হয়।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন
রিয়াযুস সালিহীন - হাদীস নং ৯২ | মুসলিম বাংলা