রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
ভূমিকা অধ্যায়
হাদীস নং:
ইয়াকীন ও তাওয়াক্কুল।
হিজরতকালে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের আল্লাহনির্ভরতা কেমন ছিল
হাদীছ নং : ৮১
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক ‘আব্দুল্লাহ ইবন ‘উছমান ইবন ‘আমির ইবন ‘উমর ইবন কা‘ব ইবন সা‘দ ইবন তাইম ইবন মুররা ইবন কা‘ব ইবন লুআঈ ইবন গালিব আল-কুরাশী আত-তাইমী রাযি. থেকে বর্ণিত, [প্রকাশ থাকে যে, তিনি নিজে এবং তাঁর পিতা ও মাতা সকলেই সাহাবী ছিলেন] তিনি বলেন, (মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের সময়) আমরা (ছাওর পাহাড়ের) গুহায় থাকা অবস্থায় আমি মুশরিকদের পা দেখতে পেলাম। তারা একদম আমাদের মাথার উপর ছিল। তখন আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তাদের কোনও একজন যদি তার পায়ের নিচে তাকায়, তবে অবশ্যই আমাদের দেখতে পাবে। তিনি বললেন, হে আবূ বকর! ওই দুইজন সম্পর্কে তোমার কী ধারণা, যাদের তৃতীয়জন আল্লাহ? -বুখারী ও মুসলিম।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৩৬৫৩, ৩৯২২, ৪৬৬৩; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৩৮১; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ৩০৯৬)
হাদীছ নং : ৮১
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক ‘আব্দুল্লাহ ইবন ‘উছমান ইবন ‘আমির ইবন ‘উমর ইবন কা‘ব ইবন সা‘দ ইবন তাইম ইবন মুররা ইবন কা‘ব ইবন লুআঈ ইবন গালিব আল-কুরাশী আত-তাইমী রাযি. থেকে বর্ণিত, [প্রকাশ থাকে যে, তিনি নিজে এবং তাঁর পিতা ও মাতা সকলেই সাহাবী ছিলেন] তিনি বলেন, (মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের সময়) আমরা (ছাওর পাহাড়ের) গুহায় থাকা অবস্থায় আমি মুশরিকদের পা দেখতে পেলাম। তারা একদম আমাদের মাথার উপর ছিল। তখন আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তাদের কোনও একজন যদি তার পায়ের নিচে তাকায়, তবে অবশ্যই আমাদের দেখতে পাবে। তিনি বললেন, হে আবূ বকর! ওই দুইজন সম্পর্কে তোমার কী ধারণা, যাদের তৃতীয়জন আল্লাহ? -বুখারী ও মুসলিম।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৩৬৫৩, ৩৯২২, ৪৬৬৩; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৩৮১; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ৩০৯৬)
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরতকালীন ঘটনার একটি অংশ বর্ণিত হয়েছে। কাফেরদের জুলুম-নিপীড়নে মক্কা মুকাররামায় যখন মুসলিমদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠে এবং দীন ও ঈমান নিয়ে সেখানে তাদের নিরাপন অবস্থান অসম্ভব হয়ে পড়ে, তখন আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে হিজরতের অনুমতি দেওয়া হয়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রিয় সাহাবীগণকে মদীনা মুনাওয়ারায় চলে যেতে বলেন। তারা একের পর এক সেখানে চলে যান। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. ও হিজরতের জন্য প্রস্তুত হয়ে যান। কিন্তু নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের সঙ্গী হওয়ার জন্য তাঁকে অপেক্ষা করতে বলেন। এ অবস্থায় মুশরিকগণ তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে।
মুশরিকদের সিদ্ধান্ত হয়েছিল প্রত্যেক গোত্র থেকে একেকজন এ দুষ্কর্মে অংশগ্রহণ করবে। সে মোতাবেক তারা একদিন একাট্টা হয় এবং রাতের বেলা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘর অবরোধ করে। উদ্দেশ্য ছিল যখনই তিনি নামাযের জন্য ঘর থেকে বের হবেন, তখন একযোগে তাঁর উপর হামলা করবে। এদিকে ওহী মারফত আল্লাহ তা'আলা তাঁকে তাদের এ দুরভিসন্ধির কথা জানিয়ে দেন এবং হিজরতের হুকুম দিয়ে দেন। সুতরাং তিনি অবরুদ্ধ অবস্থায়ই সূরা ইয়াসীন পড়তে পড়তে তাদের সম্মুখ দিয়ে বের হয়ে যান। আল্লাহ তা'আলা তাঁকে তাদের চোখের আড়াল করে রাখেন। কেউ তাঁকে দেখতে পেল না। তিনি সোজা হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি.-এর বাড়িতে চলে যান।
হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি, আগে থেকেই মানসিকভাবে হিজরতের জন্য প্রস্তুত ছিলেন এবং এজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও করে রেখেছিলেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু "আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে নিয়ে বের হয়ে পড়েন। প্রথমে ছাওর পাহাড়ে চলে যান। এ পাহাড়ের গুহায় তিনদিন আত্মগোপন করে থাকেন। এদিকে মুশরিকগণ চারদিকে তাঁকে খুঁজতে থাকল। ঘোষণা করে দিল, যে তাঁকে ধরে আনতে পারবে তাকে একশ উট পুরস্কার দেওয়া হবে। অনুরূপ পুরস্কারের ঘোষণা হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি, সম্পর্কেও দেওয়া হল। সুতরাং চারদিকে খোঁজাখুঁজির ধুম পড়ে গেল।
একদল লোক তাঁদের খোঁজে ছাওর পাহাড়েও পৌঁছে গেল। তারা পাহাড়ে এদিক সেদিক তল্লাশি চালিয়ে যখন গুহার মুখে গিয়ে পৌঁছল, তখন ভেতর থেকে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. তাদের দেখে ফেললেন। তিনি ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। এই বুঝি ধরা পড়ে গেলেন। তাঁর ভয় নিজেকে নিয়ে নয়। তিনি তো নিজেকে উৎসর্গ করেই দিয়েছেন। ভয় প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিয়ে। তাঁকে গ্রেফতার করতে পারলে নির্ঘাত হত্যা করবে। এখন তো গ্রেফতার হয়ে যাওয়াটা প্রায় নিশ্চিত। যে-কেউ গুহার ভেতর উঁকি দিলেই তাঁদের দেখে ফেলবে। উকি নাই বা দেবে কেন? তারা তো তাঁকে খুঁজতেই বের হয়েছে। সম্ভাব্য সকল স্থানেই চোখ বুলাবে। পাহাড়ের গুহা যে লুকানোর উপযুক্ত জায়গা, তা তো তাদের অজানা নয়। কাজেই পাহাড়ের এত উঁচুতে উঠে এসেছে আর গুহার ভেতর খোঁজ নেবে না তাও কি ভাবা যায়, বিশেষত তারা যখন গুহার একদম মুখের উপর?
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. চরম উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় বলে উঠলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তাদের কোনও একজনও যদি তার পায়ের নিচে তাকায় অবশ্যই আমাদের দেখে ফেলবে! কিন্তু পাহাড়ের গুহায় অবস্থানকারী নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের আল্লাহনির্ভরতা যে পাহাড় অপেক্ষাও বেশি অবিচল, শত্রুর হাতের নাগালের ভেতর এসে যাওয়া সত্ত্বেও তাঁর সে অবিচল আস্থায় বিন্দুমাত্র চিড় ধরেনি। তাঁর জীবনরক্ষার জন্য যিনি অস্থির, সেই গুহাসঙ্গীকে তিনি এই আশ্বাসবাণী শোনাচ্ছেন- ما ظنك يا أبا بكر باثنين الله ثالثهما “হে আবূ বকর! ওই দুইজন সম্পর্কে তোমার কী ধারণা, যাদের তৃতীয়জন আল্লাহ?" অর্থাৎ যেই দু'জনের সঙ্গে তৃতীয়জনরূপে সর্বশক্তিমান আল্লাহ তা'আলা আছেন, তাদের কোনও ক্ষতি করার সাধ্য কার আছে? তুমি নিশ্চিন্ত থাক হে আবূ বকর! কেউ আমাদের কোনও ক্ষতি করতে পারবে না। তিনি হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি-কে লক্ষ্য করে আরও একটি বাক্য বলেছিলেন, যা কুরআন মাজীদে বিবৃত হয়েছে। তিনি বলেছিলেন–- لَا تَحْزَنْ إِنَّ اللَّهَ مَعَنَا অর্থ : চিন্তা করো না, আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন।
অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলা যখন আমাদের সঙ্গে আছেন, তখন আর আমাদের কিসের ভয়? আল্লাহ তাআলা তখন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্তরে বিশেষ এক ধরনের প্রশান্তি, স্থিরতা, নিশ্চিন্ততা ও নির্ভীকতা সঞ্চার করে দিয়েছিলেন। তাঁর এ আশ্বাসবাণীতে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-ও শান্ত হয়ে যান। সব শঙ্কা ও দুশ্চিন্তা তাঁর অন্তর থেকে দূর হয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শত্রুর কবল থেকে যে অবশ্যই হেফাজত করবেন, এ বিশ্বাস তাঁর অন্তরে ছেয়ে যায়। তাঁর জানা আছে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ কথা নিজের থেকে বলেননি, আল্লাহ তা'আলাই তাঁর অন্তরে এ কথা সঞ্চারিত করেছেন। প্রকৃতপক্ষে এটা আল্লাহরই কথা, যা পরে কুরআন মাজীদের আয়াতরূপে নাযিল হয়েছে। সুতরাং এ আশ্বাসবাণীর ভেতর আল্লাহর ওয়াদা নিহিত রয়েছে। হেফাজতের ওয়াদা। তাঁর ওয়াদার কোনও ব্যতিক্রম হয় না। কাজেই তাতে আস্থা না রাখার কোনও অবকাশ নেই।
আল্লাহ তা'আলা তাঁর এ ওয়াদা অকল্পনীয় ও অলৌকিকভাবে পূরণ করেছেন। সে সম্পর্কে কুরআন মাজীদে সংক্ষেপে ইরশাদ হয়েছে–- فَأَنْزَلَ اللَّهُ سَكِينَتَهُ عَلَيْهِ وَأَيَّدَهُ بِجُنُودٍ لَمْ تَرَوْهَا অর্থ : সুতরাং আল্লাহ তার প্রতি নিজের পক্ষ থেকে প্রশান্তি বর্ষণ করলেন এবংএমন বাহিনী দ্বারা তার সাহায্য করলেন, যা তোমরা দেখনি।
অর্থাৎ ফিরিশতাদের বাহিনী দ্বারা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-কে সাহায্য করলেন। তাঁদেরকে সাহায্য করার জন্য যে সমস্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, মাকড়সার জালও তার একটি। দেখতে না দেখতে গুহার মুখে মাকড়সা জাল টানিয়ে দিল। মুশরিকগণ যখন সেই জাল দেখল, তখন সেখানে কোনও মানুষ থাকার সম্ভাবনা নাকচ করে দিল। ভেতরে মানুষ ঢুকলে এখানে মাকড়সার জাল থাকে কী করে? তারা হতাশ হয়ে ফিরে গেল। এভাবে আল্লাহ তা'আলা তাদের হাত থেকে গুহার বন্ধুদ্বয়কে রক্ষা করলেন। কুরআন মাজীদে মাকড়সার জালকে বলা হয়েছে সর্বাপেক্ষা দুর্বল ঘর। সেই দুর্বল ঘর দিয়ে সুরক্ষিত ও সুদৃঢ় দুর্গের কাজ নিয়ে নেওয়া হল।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা আল্লাহ তা'আলার প্রতি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের চূড়ান্ত পর্যায়ের তাওয়াক্কুল সম্পর্কে জানার পাশাপাশি এই শিক্ষা লাভ হয় যে, যতবড় কঠিন বিপদই হোক বান্দা তাতে আল্লাহ তা'আলার প্রতি সত্যিকার তাওয়াক্কুল করলে আল্লাহ তা'আলা অবশ্যই তাকে সাহায্য করেন এবং সেই বিপদ থেকে তাকে উদ্ধার করেন।
খ. এ হাদীছ দ্বারা জানা যায় হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. এ উম্মতের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। সুতরাং এ বিষয়ে কোনও মুমিনের বিন্দুমাত্র সন্দেহ পোষণ করা উচিত নয়।
গ. প্রত্যেকের উচিত তার কোনও সঙ্গী বা মু'মিন ভাই আসন্ন বিপদের আশঙ্কায় অস্থির হয়ে পড়লে তাকে আল্লাহর প্রতি ভরসার উপদেশ দেওয়া এবং তাঁর সাহায্যের প্রতি আশান্বিত করে তোলা।
ঘ. বান্দাকে সাহায্য করার জন্য আল্লাহ তা'আলা কোনও আসবাব-উপকরণের মুখাপেক্ষী নন। বান্দা যেসব উপায়-উপকরণের মাধ্যমে সাহায্য লাভের আশা করে থাকে, তিনি তার বাইরে এমন পন্থায়ও সাহায্য করে থাকেন যা বান্দার কল্পনায়ও আসে না। সুতরাং বিশেষ উপায়ে সাহায্য লাভের আশায় না থেকে আল্লাহর প্রতি চূড়ান্ত তাওয়াক্কুল করাই আসল কথা। বান্দার সেটাই করা উচিত।
ঙ. পাহাড়ের গুহায় আত্মগোপন করার দ্বারা এ শিক্ষাও পাওয়া যায় যে, বিপদ আপদ থেকে আত্মরক্ষার জন্য কোনও বাহ্যিক উপায় অবলম্বন করা তাওয়াক্কুলের পরিপন্থি নয়।
মুশরিকদের সিদ্ধান্ত হয়েছিল প্রত্যেক গোত্র থেকে একেকজন এ দুষ্কর্মে অংশগ্রহণ করবে। সে মোতাবেক তারা একদিন একাট্টা হয় এবং রাতের বেলা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘর অবরোধ করে। উদ্দেশ্য ছিল যখনই তিনি নামাযের জন্য ঘর থেকে বের হবেন, তখন একযোগে তাঁর উপর হামলা করবে। এদিকে ওহী মারফত আল্লাহ তা'আলা তাঁকে তাদের এ দুরভিসন্ধির কথা জানিয়ে দেন এবং হিজরতের হুকুম দিয়ে দেন। সুতরাং তিনি অবরুদ্ধ অবস্থায়ই সূরা ইয়াসীন পড়তে পড়তে তাদের সম্মুখ দিয়ে বের হয়ে যান। আল্লাহ তা'আলা তাঁকে তাদের চোখের আড়াল করে রাখেন। কেউ তাঁকে দেখতে পেল না। তিনি সোজা হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি.-এর বাড়িতে চলে যান।
হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি, আগে থেকেই মানসিকভাবে হিজরতের জন্য প্রস্তুত ছিলেন এবং এজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও করে রেখেছিলেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু "আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে নিয়ে বের হয়ে পড়েন। প্রথমে ছাওর পাহাড়ে চলে যান। এ পাহাড়ের গুহায় তিনদিন আত্মগোপন করে থাকেন। এদিকে মুশরিকগণ চারদিকে তাঁকে খুঁজতে থাকল। ঘোষণা করে দিল, যে তাঁকে ধরে আনতে পারবে তাকে একশ উট পুরস্কার দেওয়া হবে। অনুরূপ পুরস্কারের ঘোষণা হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি, সম্পর্কেও দেওয়া হল। সুতরাং চারদিকে খোঁজাখুঁজির ধুম পড়ে গেল।
একদল লোক তাঁদের খোঁজে ছাওর পাহাড়েও পৌঁছে গেল। তারা পাহাড়ে এদিক সেদিক তল্লাশি চালিয়ে যখন গুহার মুখে গিয়ে পৌঁছল, তখন ভেতর থেকে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. তাদের দেখে ফেললেন। তিনি ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। এই বুঝি ধরা পড়ে গেলেন। তাঁর ভয় নিজেকে নিয়ে নয়। তিনি তো নিজেকে উৎসর্গ করেই দিয়েছেন। ভয় প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিয়ে। তাঁকে গ্রেফতার করতে পারলে নির্ঘাত হত্যা করবে। এখন তো গ্রেফতার হয়ে যাওয়াটা প্রায় নিশ্চিত। যে-কেউ গুহার ভেতর উঁকি দিলেই তাঁদের দেখে ফেলবে। উকি নাই বা দেবে কেন? তারা তো তাঁকে খুঁজতেই বের হয়েছে। সম্ভাব্য সকল স্থানেই চোখ বুলাবে। পাহাড়ের গুহা যে লুকানোর উপযুক্ত জায়গা, তা তো তাদের অজানা নয়। কাজেই পাহাড়ের এত উঁচুতে উঠে এসেছে আর গুহার ভেতর খোঁজ নেবে না তাও কি ভাবা যায়, বিশেষত তারা যখন গুহার একদম মুখের উপর?
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. চরম উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় বলে উঠলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তাদের কোনও একজনও যদি তার পায়ের নিচে তাকায় অবশ্যই আমাদের দেখে ফেলবে! কিন্তু পাহাড়ের গুহায় অবস্থানকারী নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের আল্লাহনির্ভরতা যে পাহাড় অপেক্ষাও বেশি অবিচল, শত্রুর হাতের নাগালের ভেতর এসে যাওয়া সত্ত্বেও তাঁর সে অবিচল আস্থায় বিন্দুমাত্র চিড় ধরেনি। তাঁর জীবনরক্ষার জন্য যিনি অস্থির, সেই গুহাসঙ্গীকে তিনি এই আশ্বাসবাণী শোনাচ্ছেন- ما ظنك يا أبا بكر باثنين الله ثالثهما “হে আবূ বকর! ওই দুইজন সম্পর্কে তোমার কী ধারণা, যাদের তৃতীয়জন আল্লাহ?" অর্থাৎ যেই দু'জনের সঙ্গে তৃতীয়জনরূপে সর্বশক্তিমান আল্লাহ তা'আলা আছেন, তাদের কোনও ক্ষতি করার সাধ্য কার আছে? তুমি নিশ্চিন্ত থাক হে আবূ বকর! কেউ আমাদের কোনও ক্ষতি করতে পারবে না। তিনি হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি-কে লক্ষ্য করে আরও একটি বাক্য বলেছিলেন, যা কুরআন মাজীদে বিবৃত হয়েছে। তিনি বলেছিলেন–- لَا تَحْزَنْ إِنَّ اللَّهَ مَعَنَا অর্থ : চিন্তা করো না, আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন।
অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলা যখন আমাদের সঙ্গে আছেন, তখন আর আমাদের কিসের ভয়? আল্লাহ তাআলা তখন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্তরে বিশেষ এক ধরনের প্রশান্তি, স্থিরতা, নিশ্চিন্ততা ও নির্ভীকতা সঞ্চার করে দিয়েছিলেন। তাঁর এ আশ্বাসবাণীতে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-ও শান্ত হয়ে যান। সব শঙ্কা ও দুশ্চিন্তা তাঁর অন্তর থেকে দূর হয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শত্রুর কবল থেকে যে অবশ্যই হেফাজত করবেন, এ বিশ্বাস তাঁর অন্তরে ছেয়ে যায়। তাঁর জানা আছে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ কথা নিজের থেকে বলেননি, আল্লাহ তা'আলাই তাঁর অন্তরে এ কথা সঞ্চারিত করেছেন। প্রকৃতপক্ষে এটা আল্লাহরই কথা, যা পরে কুরআন মাজীদের আয়াতরূপে নাযিল হয়েছে। সুতরাং এ আশ্বাসবাণীর ভেতর আল্লাহর ওয়াদা নিহিত রয়েছে। হেফাজতের ওয়াদা। তাঁর ওয়াদার কোনও ব্যতিক্রম হয় না। কাজেই তাতে আস্থা না রাখার কোনও অবকাশ নেই।
আল্লাহ তা'আলা তাঁর এ ওয়াদা অকল্পনীয় ও অলৌকিকভাবে পূরণ করেছেন। সে সম্পর্কে কুরআন মাজীদে সংক্ষেপে ইরশাদ হয়েছে–- فَأَنْزَلَ اللَّهُ سَكِينَتَهُ عَلَيْهِ وَأَيَّدَهُ بِجُنُودٍ لَمْ تَرَوْهَا অর্থ : সুতরাং আল্লাহ তার প্রতি নিজের পক্ষ থেকে প্রশান্তি বর্ষণ করলেন এবংএমন বাহিনী দ্বারা তার সাহায্য করলেন, যা তোমরা দেখনি।
অর্থাৎ ফিরিশতাদের বাহিনী দ্বারা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-কে সাহায্য করলেন। তাঁদেরকে সাহায্য করার জন্য যে সমস্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, মাকড়সার জালও তার একটি। দেখতে না দেখতে গুহার মুখে মাকড়সা জাল টানিয়ে দিল। মুশরিকগণ যখন সেই জাল দেখল, তখন সেখানে কোনও মানুষ থাকার সম্ভাবনা নাকচ করে দিল। ভেতরে মানুষ ঢুকলে এখানে মাকড়সার জাল থাকে কী করে? তারা হতাশ হয়ে ফিরে গেল। এভাবে আল্লাহ তা'আলা তাদের হাত থেকে গুহার বন্ধুদ্বয়কে রক্ষা করলেন। কুরআন মাজীদে মাকড়সার জালকে বলা হয়েছে সর্বাপেক্ষা দুর্বল ঘর। সেই দুর্বল ঘর দিয়ে সুরক্ষিত ও সুদৃঢ় দুর্গের কাজ নিয়ে নেওয়া হল।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা আল্লাহ তা'আলার প্রতি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের চূড়ান্ত পর্যায়ের তাওয়াক্কুল সম্পর্কে জানার পাশাপাশি এই শিক্ষা লাভ হয় যে, যতবড় কঠিন বিপদই হোক বান্দা তাতে আল্লাহ তা'আলার প্রতি সত্যিকার তাওয়াক্কুল করলে আল্লাহ তা'আলা অবশ্যই তাকে সাহায্য করেন এবং সেই বিপদ থেকে তাকে উদ্ধার করেন।
খ. এ হাদীছ দ্বারা জানা যায় হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. এ উম্মতের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। সুতরাং এ বিষয়ে কোনও মুমিনের বিন্দুমাত্র সন্দেহ পোষণ করা উচিত নয়।
গ. প্রত্যেকের উচিত তার কোনও সঙ্গী বা মু'মিন ভাই আসন্ন বিপদের আশঙ্কায় অস্থির হয়ে পড়লে তাকে আল্লাহর প্রতি ভরসার উপদেশ দেওয়া এবং তাঁর সাহায্যের প্রতি আশান্বিত করে তোলা।
ঘ. বান্দাকে সাহায্য করার জন্য আল্লাহ তা'আলা কোনও আসবাব-উপকরণের মুখাপেক্ষী নন। বান্দা যেসব উপায়-উপকরণের মাধ্যমে সাহায্য লাভের আশা করে থাকে, তিনি তার বাইরে এমন পন্থায়ও সাহায্য করে থাকেন যা বান্দার কল্পনায়ও আসে না। সুতরাং বিশেষ উপায়ে সাহায্য লাভের আশায় না থেকে আল্লাহর প্রতি চূড়ান্ত তাওয়াক্কুল করাই আসল কথা। বান্দার সেটাই করা উচিত।
ঙ. পাহাড়ের গুহায় আত্মগোপন করার দ্বারা এ শিক্ষাও পাওয়া যায় যে, বিপদ আপদ থেকে আত্মরক্ষার জন্য কোনও বাহ্যিক উপায় অবলম্বন করা তাওয়াক্কুলের পরিপন্থি নয়।
