রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
ভূমিকা অধ্যায়
হাদীস নং:
ইয়াকীন ও তাওয়াক্কুল।
ঘুমের সময় আল্লাহর প্রতি নির্ভরতা ও ঘুমের দু‘আ
হাদীছ নং :৮০
হযরত আবূ উমারা বারা’ ইবন ‘আযিব রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, হে অমুক! তুমি যখন তোমার বিছানায় যাবে তখন বলবে-
اللَّهُمَّ أَسْلَمْتُ نَفْسِي إِلَيْكَ، وَوَجَّهْتُ وَجْهِي إِلَيْكَ، وَفَوَّضْتُ أَمْرِي إِلَيْكَ، وَأَلْجَأْتُ ظَهْرِي إِلَيْكَ، رَغْبَةً وَرَهْبَةً إِلَيْكَ، لَا مَلْجَأَ، وَلَا مَنْجَى مِنْكَ إِلَّا إِلَيْكَ، آمَنْتُ بِكِتَابِكَ الَّذِي أَنْزَلْتَ، وَنَبِيِّكَ الَّذِي أَرْسَلْتَ،
হে আল্লাহ! আমি নিজেকে আপনার নিকট সমর্পণ করলাম, আমি নিজ চেহারা আপনার অভিমুখী করলাম, আমি আমার যাবতীয় বিষয় আপনার নিকট ন্যস্ত করলাম এবং আমি আমার পিঠকে আপনার আশ্রয়ে দিলাম- আপনার কাছে আশা ও ভয়ের সাথে। আপনি ছাড়া কোনও আশ্রয়ের জায়গা নেই এবং আপনি ছাড়া নেই নাজাতের কোনও স্থান। আমি ঈমান এনেছি আপনার ওই কিতাবের প্রতি, যা আপনি নাযিল করেছেন এবং আপনার ওই নবীর প্রতি, যাঁকে আপনি পাঠিয়েছেন।'
তুমি যদি (এই দু'আ পড় এবং) ওই রাতেই মারা যাও, তবে তোমার মৃত্যু হবে 'ফিতরাত' অর্থাৎ ইসলামের উপর। আর যদি ভোরে জেগে ওঠ, তবে বিরাট কল্যাণ লাভ করবে। -বুখারী ও মুসলিম
বুখারী ও মুসলিমের অপর এক বর্ণনায় আছে, হযরত বারা' রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বলেছেন, তুমি যখন বিছানায় যাবে তখন নামাযের ওযূর মত ওযূ করবে। তারপর ডানকাতে শোবে এবং বলবে- (এ বলে) তিনি উপরের দু'আটি উল্লেখ করলেন। তারপর তিনি বললেন, এটিই যেন হয় তোমার সর্বশেষ কথা।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬৩১৩, সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৭১০ সুনানে আবু দাউদ, হাদীছ নং ৫০৪৬; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ৩৩৯৪)
হাদীছ নং :৮০
হযরত আবূ উমারা বারা’ ইবন ‘আযিব রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, হে অমুক! তুমি যখন তোমার বিছানায় যাবে তখন বলবে-
اللَّهُمَّ أَسْلَمْتُ نَفْسِي إِلَيْكَ، وَوَجَّهْتُ وَجْهِي إِلَيْكَ، وَفَوَّضْتُ أَمْرِي إِلَيْكَ، وَأَلْجَأْتُ ظَهْرِي إِلَيْكَ، رَغْبَةً وَرَهْبَةً إِلَيْكَ، لَا مَلْجَأَ، وَلَا مَنْجَى مِنْكَ إِلَّا إِلَيْكَ، آمَنْتُ بِكِتَابِكَ الَّذِي أَنْزَلْتَ، وَنَبِيِّكَ الَّذِي أَرْسَلْتَ،
হে আল্লাহ! আমি নিজেকে আপনার নিকট সমর্পণ করলাম, আমি নিজ চেহারা আপনার অভিমুখী করলাম, আমি আমার যাবতীয় বিষয় আপনার নিকট ন্যস্ত করলাম এবং আমি আমার পিঠকে আপনার আশ্রয়ে দিলাম- আপনার কাছে আশা ও ভয়ের সাথে। আপনি ছাড়া কোনও আশ্রয়ের জায়গা নেই এবং আপনি ছাড়া নেই নাজাতের কোনও স্থান। আমি ঈমান এনেছি আপনার ওই কিতাবের প্রতি, যা আপনি নাযিল করেছেন এবং আপনার ওই নবীর প্রতি, যাঁকে আপনি পাঠিয়েছেন।'
তুমি যদি (এই দু'আ পড় এবং) ওই রাতেই মারা যাও, তবে তোমার মৃত্যু হবে 'ফিতরাত' অর্থাৎ ইসলামের উপর। আর যদি ভোরে জেগে ওঠ, তবে বিরাট কল্যাণ লাভ করবে। -বুখারী ও মুসলিম
বুখারী ও মুসলিমের অপর এক বর্ণনায় আছে, হযরত বারা' রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বলেছেন, তুমি যখন বিছানায় যাবে তখন নামাযের ওযূর মত ওযূ করবে। তারপর ডানকাতে শোবে এবং বলবে- (এ বলে) তিনি উপরের দু'আটি উল্লেখ করলেন। তারপর তিনি বললেন, এটিই যেন হয় তোমার সর্বশেষ কথা।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬৩১৩, সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৭১০ সুনানে আবু দাউদ, হাদীছ নং ৫০৪৬; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ৩৩৯৪)
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে ঘুমের আদব ও নিয়ম শিক্ষা দিয়েছেন। এতে ঘুমের তিনটি আদব বলা হয়েছে।
ক. ওযুর সাথে ঘুমানো।
খ. ডান কাতে ঘুমানো।
গ. ঘুমের দু'আ পড়া।
প্রথমে বলেছেন- যখন বিছানায় যাবে তখন নামাযের ওযূর মত ওযূ করবে। বোঝা গেল ওযুর সাথে ঘুমানো মুস্তাহাব। ঘুম যেহেতু মৃত্যুর ভাই, তাই ঘুমের আগে মৃত্যুর প্রস্তুতির মত প্রস্তুত হয়ে ঘুমানো উচিত। ওযূ সে প্রস্তুতিরই অংশ। বান্দা যদি ওযুর সাথে ঘুমায় আর এ অবস্থায় তার মৃত্যু হয়ে যায়, তবে সে মৃত্যু হবে তার শারীরিক পবিত্রতার সাথে। ফলে তার হাশরও পবিত্রতার সাথে হবে। মুজাহিদ রহ. থেকে বর্ণিত আছে, হযরত ইব্ন 'আব্বাস রাযি, তাকে উপদেশ দেন, তুমি কিছুতেই ওযূ ছাড়া ঘুমাবে না। কেননা রূহ যে অবস্থায় কবজ করা হয়, (হাশরের দিন) সে অবস্থায়ই তার পুনরুত্থান হবে।ফাতহুল বারী, ১১ খণ্ড, ১৩২ পৃষ্ঠা।
তাছাড়া ওযূর সাথে ঘুমালে সে ঘুম 'ইবাদতে পরিণত হয়ে যায়। এক বর্ণনায় আছে, যে ব্যক্তি পবিত্র অবস্থায় শয্যাগ্রহণ করে এবং যিকরের সাথে ঘুমায়, তার বিছানা নামাযের স্থানে পরিণত হয়ে যায় এবং যতক্ষণ না সে জাগ্রত হয়, ততক্ষণ সে (ঘুমানো সত্ত্বেও) নামায ও যিকরের ভেতর থাকে।ফাতহুল বারী, ১১খণ্ড, ১৩২ পৃষ্ঠা।
ওযূ অবস্থায় ঘুমালে সে ঘুমও মধুর, নিখুঁত ও নিরাপদ হয়। তখন শয়তান তার ক্ষতি করার সুযোগ পায় না। শয়তান পবিত্র ব্যক্তি হতে দূরে থাকে। এ অবস্থায় স্বপ্ন দেখলে সে স্বপ্নও সাধারণত সঠিক হয়। মোটকথা ওযূ অবস্থায় ঘুমানোর ভেতর নানা রকম উপকার নিহিত আছে। প্রত্যেকের উচিত এর উপর আমল করা।
দ্বিতীয় আদব বলা হয়েছে ডান কাতে ঘুমানো। নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও ডান কাতে ঘুমাতেন। চিকিৎসাবিদগণ এর বিভিন্ন উপকার ব্যাখ্যা করেছেন। বিশেষত ডান কাতে ঘুমালে সে ঘুম মাত্রাতিরিক্ত গভীর হয় না। ফলে যখন জাগ্রত হওয়া দরকার তখন জাগা সহজ হয়। সবচে' বড় কথা এটা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নত। আর সুন্নতের অনুসরণ করার মধ্যেই দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ নিহিত।
তৃতীয় আদব ঘুমের দু'আ পড়া। ঘুমের বিভিন্ন দু'আ আছে। এ হাদীছে একটি পূর্ণাঙ্গ দু'আ শেখানো হয়েছে। এর প্রথম অংশে আছে নিজের ইসলাম ও আত্মনিবেদনের প্রকাশ। আর দ্বিতীয় অংশে আছে আন্তরিক ঈমান ও বিশ্বাসের ঘোষণা।
ইসলাম ও আত্মসমর্পণের প্রকাশে চারটি কথা বলা হয়েছে। প্রথমে বলা হয়েছে-- اللَّهُمَّ أَسْلَمْتُ نَفْسِي إِلَيْكَ 'হে আল্লাহ! আমি নিজেকে আপনার প্রতি সমর্পণ করলাম।' অর্থাৎ আমার সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে আপনার আদেশ-নিষেধের অধীন করে দিলাম। আপনি যা কিছু আদেশ করেছেন তা মানতে বাধ্য থাকব। আর যা-কিছু নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকব।
তারপর বলা হয়েছে- وَوَجَّهْتُ وَجْهِي إِلَيْكَ আমার চেহারাকে আপনার অভিমুখী করলাম।' অর্থাৎ আপনার প্রতি আনুগত্য ও আত্মসমর্পণের ক্ষেত্রে আমার মধ্যে কোনও মুনাফিকী ও কপটতা নেই। আমি রিয়া ও লোকদেখানোর মানসিকতা থেকেও বাঁচতে চাই। এভাবে প্রকাশ্য ও গুপ্ত সর্বপ্রকার শিরক থেকে মুক্ত হয়ে নিজেকে কেবল আপনার দিকেই ফিরিয়ে দিলাম। কোনও মাখলুকের কাছ থেকে কোনওকিছু পাওয়ার আশায় নয়। বরং কেবল আপনার সন্তুষ্টির জন্যই আমি নিজেকে ইসলাম ও আনুগত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত করলাম।
তৃতীয় বাক্যে বলা হয়েছে- وَفَوَّضْتُ أَمْرِي إِلَيْكَ আমার যাবতীয় বিষয় আপনার উপর ন্যস্ত করলাম। এটা তাওয়াক্কুল ও আল্লাহনির্ভরতার প্রকাশ। অর্থাৎ জাগ্রত অবস্থায় তো আমি আপনার হুকুম মোতাবেক নিজ করণীয় কাজ করতে সচেষ্ট ছিলাম। কিন্তু ঘুমের অবস্থায় আমার পক্ষে কোনওকিছূই করা সম্ভব নয়। বস্তুত সর্বাবস্থায় আপনার ইচ্ছাই কার্যকর হয়ে থাকে। জাগ্রত অবস্থায় আমি চেষ্টা করলেও বাস্তবে ঘটে কেবল তা-ই যা আপনি ইচ্ছা করেন। সুতরাং জাগ্রত ও ঘুমন্ত সর্বাবস্থায় আমার যাবতীয় বিষয়ে একান্ত আপনার উপরই আমি নির্ভরশীল থাকলাম।
চতুর্থ বাক্যে বলা হয়েছে- وَأَلْجَأْتُ ظَهْرِي إِلَيْكَ 'আমি আমার পৃষ্ঠদেশ আপনার আশ্রয়ে অর্পণ করলাম।' অর্থাৎ আপনি ছাড়া আর কেউ আমাকে হেফাজত করার ক্ষমতা রাখে না। তাই আমি আমার সত্তাকে আপনার হেফাজতে সমর্পণ করলাম। আপনি আমাকে সর্বপ্রকার বিপদ-আপদ ও দুঃখকষ্ট থেকে হেফাজত করুন। এটাও তাওয়াক্কুলেরই অংশ।
তারপর বলা হয়েছে- رَهْبَةً وَرَغْبَةً إِلَيْكَ আশা ও ভীতির সাথে। অর্থাৎ আমার যাবতীয় বিষয় আপনার উপর ন্যস্ত করলাম আপনার রহমতের আশায়। আর নিজেকে আপনার আশ্রয়ে অর্পণ করলাম আপনাকে ভয় করার সাথে। আমি দুনিয়া ও আখিরাতে আপনার রহমত ও দয়ার আশাবাদী, যেহেতু আপনার দয়া আপনার ক্রোধের উপর প্রবল। আপনি পরম দয়ালু। আবার যেহেতু আমি অনেক বড় গুনাহগার, তাই আপনার আযাবের ভয়ও আমার আছে। দুনিয়া ও আখিরাত উভয় স্থানেই আমি আমার পাপাচারের দুর্ভোগ পোহানোর ভয় রাখি। সে দুর্ভোগ যাতে আমাকে পোহাতে না হয়, তাই আমি নিজেকে আপনার হেফাজতে ন্যস্ত করেছি। বস্তুত এ আশা ও ভয়ের সমন্বিত রূপই ঈমান। প্রত্যেক মুমিনের অন্তরে এ দুই অবস্থা বিদ্যমান থাকা জরুরি।
এর পরের বাক্য হচ্ছে- لَا مَنْجَا وَلَا مَلْجَأَ مِنْكَ إِلَّا إِلَيْكَ আপনার ছাড়া আর কোনও আশ্রয়স্থল ও মুক্তির জায়গা নেই। এর দ্বারা আল্লাহ তা'আলার সর্বময় ক্ষমতার কথা ব্যক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ যাবতীয় কল্যাণ-অকল্যাণ ও লাভ-ক্ষতি আল্লাহরই হাতে। কেউ কোনও কল্যাণ লাভ করতে চাইলে তা কেবল আল্লাহরই কাছে লাভ করতে পারে। আর অকল্যাণ থেকে মুক্তি পেতে চাইলে তাও পেতে পারে কেবল আল্লাহরই কাছে। উভয় ক্ষেত্রেই বান্দার কর্তব্য কেবল তাঁরই শরণাপন্ন হওয়া এবং কেবল তাঁরই প্রতি নির্ভর করা। এ বাক্যটি তাওয়াক্কুল ও আল্লাহনির্ভরতার পরিশিষ্টস্বরূপ।
এর পরের দুই বাক্যে দেওয়া হয়েছে ঈমানের ঘোষণা। প্রথম বাক্য- آمَنْتُ بِكِتَابِكَ الَّذِي أَنْزَلْتَ 'আমি ঈমান এনেছি আপনার ওই কিতাবের প্রতি, যা আপনি নাযিল করেছেন। এর দ্বারা কেবল কুরআন মাজীদের প্রতি ঈমানের কথাও বোঝানো হতে পারে, আবার সমস্ত আসমানী কিতাবও বোঝানো হতে পারে। কিভাবের প্রতি সমানের অর্থ কিতাবে যা-কিছু বলা হয়েছে সবকিছুর প্রতি ঈমান রাখা। এর মধ্যে ঈমান বিশ্বাসের যাবতীয় বিষয়ই এসে গেছে। তা সত্ত্বেও বিশেষ গুরুত্বের কারণে পরবর্তী বাক্যে রাসূলের প্রতি বিশ্বাসের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
وَبِرَسُولِكَ الَّذِي أَرْسَلْت এবং (ঈমান আনলাম) আপনার ওই নবীর প্রতি, যাঁকে আপনি পাঠিয়েছেন। এ বাক্যেও নবী দ্বারা কেবল শেষনবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বোঝানো উদ্দেশ্য হতে পারে, আবার সকল নবী-রাসুলকেও বোঝানো হতে পারে। আল্লাহ তা'আলা যত নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন সকলের প্রতি এই বিশ্বাস রাখা জরুরি যে, প্রত্যেকেই হক ও সত্য নবী। কোনও একজন নবীকেও অবিশ্বাস করলে ঈমানদার হওয়া যায় না।
ওযূর দ্বারা বান্দার শারীরিক পবিত্রতা অর্জিত হয়। আর এ দু'আর মাধ্যমে অর্জিত হয় তার আত্মিক পবিত্রতা। বান্দা যখন এ দুই আমলের সাথে ঘুমায়, তখন সে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ উভয় রকম পবিত্রতার সাথে থাকে। ফলে এ অবস্থায় মৃত্যু হলে তার মৃত্যু হয় একজন পূর্ণাঙ্গ মুসলিমরূপে। তাই এ হাদীছের শেষে বলা হয়েছে- তুমি যদি এ অবস্থায় মারা যাও, তবে ফিতরাত অর্থাৎ স্বভাবধর্ম ইসলামের উপর তোমার মৃত্যু হবে। আর যদি ভোরে জেগে ওঠ, তবে কল্যাণ লাভ করবে। অর্থাৎ প্রভূত ছওয়াবের অধিকারী হবে। হাদীছে এ দু'আটি সবশেষে পড়তে বলা হয়েছে। এর দুই অর্থ হতে পারে।
ক. ঘুমের আগে যে সমস্ত দু'আ পড়া হবে, তার মধ্যে এটি পড়বে সবার শেষে। অন্যসব দু'আ আগে পড়ে নেবে।
খ. এ দু'আটি শেষে পড়ার অর্থ এরপর আর কোনও কথাবার্তা বলবে না। যদি ঘুম আসতে দেরি হয়, তবে যিকর করতে বাধা নেই। কিংবা ঘুম যাতে আসে সেজন্য অন্য কোনও দু'আ পড়লেও ক্ষতি নেই। কেবল দুনিয়াবী কথাবার্তা বলাই নিষেধ।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা শিক্ষা পাওয়া যায় যে, জাগ্রত ও ঘুমন্ত সর্বাবস্থায়ই বান্দার কর্তব্য আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল ও নির্ভর করা।
খ. এ হাদীছ দ্বারা ঘুমের আদব জানা যায়। যেমন, ওযূ করে শোওয়া, ডান কাতে শোওয়া ও ঘুমের দু'আ পড়া। এ ছাড়াও ঘুমের অনেক আদব আছে। যথাস্থানে তা উল্লেখ করা হবে ইনশাআল্লাহ।
গ. এ হাদীছ দ্বারা এ শিক্ষাও পাওয়া যায় যে, মু'মিন ব্যক্তির ঘুম অন্যদের মত হওয়া উচিত নয়। ঘুম যাতে ‘ইবাদতে পরিণত হয় এবং ঘুমের ভেতর মৃত্যু হয়ে গেলে সে মৃত্যু যাতে মুসলিমরূপে হয়, সে লক্ষ্যে যথাযথ প্রস্তুতির সাথেই ঘুমানো উচিত।
ক. ওযুর সাথে ঘুমানো।
খ. ডান কাতে ঘুমানো।
গ. ঘুমের দু'আ পড়া।
প্রথমে বলেছেন- যখন বিছানায় যাবে তখন নামাযের ওযূর মত ওযূ করবে। বোঝা গেল ওযুর সাথে ঘুমানো মুস্তাহাব। ঘুম যেহেতু মৃত্যুর ভাই, তাই ঘুমের আগে মৃত্যুর প্রস্তুতির মত প্রস্তুত হয়ে ঘুমানো উচিত। ওযূ সে প্রস্তুতিরই অংশ। বান্দা যদি ওযুর সাথে ঘুমায় আর এ অবস্থায় তার মৃত্যু হয়ে যায়, তবে সে মৃত্যু হবে তার শারীরিক পবিত্রতার সাথে। ফলে তার হাশরও পবিত্রতার সাথে হবে। মুজাহিদ রহ. থেকে বর্ণিত আছে, হযরত ইব্ন 'আব্বাস রাযি, তাকে উপদেশ দেন, তুমি কিছুতেই ওযূ ছাড়া ঘুমাবে না। কেননা রূহ যে অবস্থায় কবজ করা হয়, (হাশরের দিন) সে অবস্থায়ই তার পুনরুত্থান হবে।ফাতহুল বারী, ১১ খণ্ড, ১৩২ পৃষ্ঠা।
তাছাড়া ওযূর সাথে ঘুমালে সে ঘুম 'ইবাদতে পরিণত হয়ে যায়। এক বর্ণনায় আছে, যে ব্যক্তি পবিত্র অবস্থায় শয্যাগ্রহণ করে এবং যিকরের সাথে ঘুমায়, তার বিছানা নামাযের স্থানে পরিণত হয়ে যায় এবং যতক্ষণ না সে জাগ্রত হয়, ততক্ষণ সে (ঘুমানো সত্ত্বেও) নামায ও যিকরের ভেতর থাকে।ফাতহুল বারী, ১১খণ্ড, ১৩২ পৃষ্ঠা।
ওযূ অবস্থায় ঘুমালে সে ঘুমও মধুর, নিখুঁত ও নিরাপদ হয়। তখন শয়তান তার ক্ষতি করার সুযোগ পায় না। শয়তান পবিত্র ব্যক্তি হতে দূরে থাকে। এ অবস্থায় স্বপ্ন দেখলে সে স্বপ্নও সাধারণত সঠিক হয়। মোটকথা ওযূ অবস্থায় ঘুমানোর ভেতর নানা রকম উপকার নিহিত আছে। প্রত্যেকের উচিত এর উপর আমল করা।
দ্বিতীয় আদব বলা হয়েছে ডান কাতে ঘুমানো। নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও ডান কাতে ঘুমাতেন। চিকিৎসাবিদগণ এর বিভিন্ন উপকার ব্যাখ্যা করেছেন। বিশেষত ডান কাতে ঘুমালে সে ঘুম মাত্রাতিরিক্ত গভীর হয় না। ফলে যখন জাগ্রত হওয়া দরকার তখন জাগা সহজ হয়। সবচে' বড় কথা এটা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নত। আর সুন্নতের অনুসরণ করার মধ্যেই দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ নিহিত।
তৃতীয় আদব ঘুমের দু'আ পড়া। ঘুমের বিভিন্ন দু'আ আছে। এ হাদীছে একটি পূর্ণাঙ্গ দু'আ শেখানো হয়েছে। এর প্রথম অংশে আছে নিজের ইসলাম ও আত্মনিবেদনের প্রকাশ। আর দ্বিতীয় অংশে আছে আন্তরিক ঈমান ও বিশ্বাসের ঘোষণা।
ইসলাম ও আত্মসমর্পণের প্রকাশে চারটি কথা বলা হয়েছে। প্রথমে বলা হয়েছে-- اللَّهُمَّ أَسْلَمْتُ نَفْسِي إِلَيْكَ 'হে আল্লাহ! আমি নিজেকে আপনার প্রতি সমর্পণ করলাম।' অর্থাৎ আমার সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে আপনার আদেশ-নিষেধের অধীন করে দিলাম। আপনি যা কিছু আদেশ করেছেন তা মানতে বাধ্য থাকব। আর যা-কিছু নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকব।
তারপর বলা হয়েছে- وَوَجَّهْتُ وَجْهِي إِلَيْكَ আমার চেহারাকে আপনার অভিমুখী করলাম।' অর্থাৎ আপনার প্রতি আনুগত্য ও আত্মসমর্পণের ক্ষেত্রে আমার মধ্যে কোনও মুনাফিকী ও কপটতা নেই। আমি রিয়া ও লোকদেখানোর মানসিকতা থেকেও বাঁচতে চাই। এভাবে প্রকাশ্য ও গুপ্ত সর্বপ্রকার শিরক থেকে মুক্ত হয়ে নিজেকে কেবল আপনার দিকেই ফিরিয়ে দিলাম। কোনও মাখলুকের কাছ থেকে কোনওকিছু পাওয়ার আশায় নয়। বরং কেবল আপনার সন্তুষ্টির জন্যই আমি নিজেকে ইসলাম ও আনুগত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত করলাম।
তৃতীয় বাক্যে বলা হয়েছে- وَفَوَّضْتُ أَمْرِي إِلَيْكَ আমার যাবতীয় বিষয় আপনার উপর ন্যস্ত করলাম। এটা তাওয়াক্কুল ও আল্লাহনির্ভরতার প্রকাশ। অর্থাৎ জাগ্রত অবস্থায় তো আমি আপনার হুকুম মোতাবেক নিজ করণীয় কাজ করতে সচেষ্ট ছিলাম। কিন্তু ঘুমের অবস্থায় আমার পক্ষে কোনওকিছূই করা সম্ভব নয়। বস্তুত সর্বাবস্থায় আপনার ইচ্ছাই কার্যকর হয়ে থাকে। জাগ্রত অবস্থায় আমি চেষ্টা করলেও বাস্তবে ঘটে কেবল তা-ই যা আপনি ইচ্ছা করেন। সুতরাং জাগ্রত ও ঘুমন্ত সর্বাবস্থায় আমার যাবতীয় বিষয়ে একান্ত আপনার উপরই আমি নির্ভরশীল থাকলাম।
চতুর্থ বাক্যে বলা হয়েছে- وَأَلْجَأْتُ ظَهْرِي إِلَيْكَ 'আমি আমার পৃষ্ঠদেশ আপনার আশ্রয়ে অর্পণ করলাম।' অর্থাৎ আপনি ছাড়া আর কেউ আমাকে হেফাজত করার ক্ষমতা রাখে না। তাই আমি আমার সত্তাকে আপনার হেফাজতে সমর্পণ করলাম। আপনি আমাকে সর্বপ্রকার বিপদ-আপদ ও দুঃখকষ্ট থেকে হেফাজত করুন। এটাও তাওয়াক্কুলেরই অংশ।
তারপর বলা হয়েছে- رَهْبَةً وَرَغْبَةً إِلَيْكَ আশা ও ভীতির সাথে। অর্থাৎ আমার যাবতীয় বিষয় আপনার উপর ন্যস্ত করলাম আপনার রহমতের আশায়। আর নিজেকে আপনার আশ্রয়ে অর্পণ করলাম আপনাকে ভয় করার সাথে। আমি দুনিয়া ও আখিরাতে আপনার রহমত ও দয়ার আশাবাদী, যেহেতু আপনার দয়া আপনার ক্রোধের উপর প্রবল। আপনি পরম দয়ালু। আবার যেহেতু আমি অনেক বড় গুনাহগার, তাই আপনার আযাবের ভয়ও আমার আছে। দুনিয়া ও আখিরাত উভয় স্থানেই আমি আমার পাপাচারের দুর্ভোগ পোহানোর ভয় রাখি। সে দুর্ভোগ যাতে আমাকে পোহাতে না হয়, তাই আমি নিজেকে আপনার হেফাজতে ন্যস্ত করেছি। বস্তুত এ আশা ও ভয়ের সমন্বিত রূপই ঈমান। প্রত্যেক মুমিনের অন্তরে এ দুই অবস্থা বিদ্যমান থাকা জরুরি।
এর পরের বাক্য হচ্ছে- لَا مَنْجَا وَلَا مَلْجَأَ مِنْكَ إِلَّا إِلَيْكَ আপনার ছাড়া আর কোনও আশ্রয়স্থল ও মুক্তির জায়গা নেই। এর দ্বারা আল্লাহ তা'আলার সর্বময় ক্ষমতার কথা ব্যক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ যাবতীয় কল্যাণ-অকল্যাণ ও লাভ-ক্ষতি আল্লাহরই হাতে। কেউ কোনও কল্যাণ লাভ করতে চাইলে তা কেবল আল্লাহরই কাছে লাভ করতে পারে। আর অকল্যাণ থেকে মুক্তি পেতে চাইলে তাও পেতে পারে কেবল আল্লাহরই কাছে। উভয় ক্ষেত্রেই বান্দার কর্তব্য কেবল তাঁরই শরণাপন্ন হওয়া এবং কেবল তাঁরই প্রতি নির্ভর করা। এ বাক্যটি তাওয়াক্কুল ও আল্লাহনির্ভরতার পরিশিষ্টস্বরূপ।
এর পরের দুই বাক্যে দেওয়া হয়েছে ঈমানের ঘোষণা। প্রথম বাক্য- آمَنْتُ بِكِتَابِكَ الَّذِي أَنْزَلْتَ 'আমি ঈমান এনেছি আপনার ওই কিতাবের প্রতি, যা আপনি নাযিল করেছেন। এর দ্বারা কেবল কুরআন মাজীদের প্রতি ঈমানের কথাও বোঝানো হতে পারে, আবার সমস্ত আসমানী কিতাবও বোঝানো হতে পারে। কিভাবের প্রতি সমানের অর্থ কিতাবে যা-কিছু বলা হয়েছে সবকিছুর প্রতি ঈমান রাখা। এর মধ্যে ঈমান বিশ্বাসের যাবতীয় বিষয়ই এসে গেছে। তা সত্ত্বেও বিশেষ গুরুত্বের কারণে পরবর্তী বাক্যে রাসূলের প্রতি বিশ্বাসের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
وَبِرَسُولِكَ الَّذِي أَرْسَلْت এবং (ঈমান আনলাম) আপনার ওই নবীর প্রতি, যাঁকে আপনি পাঠিয়েছেন। এ বাক্যেও নবী দ্বারা কেবল শেষনবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বোঝানো উদ্দেশ্য হতে পারে, আবার সকল নবী-রাসুলকেও বোঝানো হতে পারে। আল্লাহ তা'আলা যত নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন সকলের প্রতি এই বিশ্বাস রাখা জরুরি যে, প্রত্যেকেই হক ও সত্য নবী। কোনও একজন নবীকেও অবিশ্বাস করলে ঈমানদার হওয়া যায় না।
ওযূর দ্বারা বান্দার শারীরিক পবিত্রতা অর্জিত হয়। আর এ দু'আর মাধ্যমে অর্জিত হয় তার আত্মিক পবিত্রতা। বান্দা যখন এ দুই আমলের সাথে ঘুমায়, তখন সে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ উভয় রকম পবিত্রতার সাথে থাকে। ফলে এ অবস্থায় মৃত্যু হলে তার মৃত্যু হয় একজন পূর্ণাঙ্গ মুসলিমরূপে। তাই এ হাদীছের শেষে বলা হয়েছে- তুমি যদি এ অবস্থায় মারা যাও, তবে ফিতরাত অর্থাৎ স্বভাবধর্ম ইসলামের উপর তোমার মৃত্যু হবে। আর যদি ভোরে জেগে ওঠ, তবে কল্যাণ লাভ করবে। অর্থাৎ প্রভূত ছওয়াবের অধিকারী হবে। হাদীছে এ দু'আটি সবশেষে পড়তে বলা হয়েছে। এর দুই অর্থ হতে পারে।
ক. ঘুমের আগে যে সমস্ত দু'আ পড়া হবে, তার মধ্যে এটি পড়বে সবার শেষে। অন্যসব দু'আ আগে পড়ে নেবে।
খ. এ দু'আটি শেষে পড়ার অর্থ এরপর আর কোনও কথাবার্তা বলবে না। যদি ঘুম আসতে দেরি হয়, তবে যিকর করতে বাধা নেই। কিংবা ঘুম যাতে আসে সেজন্য অন্য কোনও দু'আ পড়লেও ক্ষতি নেই। কেবল দুনিয়াবী কথাবার্তা বলাই নিষেধ।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা শিক্ষা পাওয়া যায় যে, জাগ্রত ও ঘুমন্ত সর্বাবস্থায়ই বান্দার কর্তব্য আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল ও নির্ভর করা।
খ. এ হাদীছ দ্বারা ঘুমের আদব জানা যায়। যেমন, ওযূ করে শোওয়া, ডান কাতে শোওয়া ও ঘুমের দু'আ পড়া। এ ছাড়াও ঘুমের অনেক আদব আছে। যথাস্থানে তা উল্লেখ করা হবে ইনশাআল্লাহ।
গ. এ হাদীছ দ্বারা এ শিক্ষাও পাওয়া যায় যে, মু'মিন ব্যক্তির ঘুম অন্যদের মত হওয়া উচিত নয়। ঘুম যাতে ‘ইবাদতে পরিণত হয় এবং ঘুমের ভেতর মৃত্যু হয়ে গেলে সে মৃত্যু যাতে মুসলিমরূপে হয়, সে লক্ষ্যে যথাযথ প্রস্তুতির সাথেই ঘুমানো উচিত।
