রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং:
অধ্যায় : ৩ সবর।
৩৬। জুলুম-নির্যাতনে নবীগণের সবর এবং জালিমদের সাথে তাদের আচরণ:

হযরত আবু আব্দুর রহমান আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. বলেন, যেন আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখতে পাচ্ছি তিনি কোনও এক নবীর ঘটনা বর্ণনা করছেন। তাঁকে তাঁর জাতি মেরে রক্তাক্ত করে দিয়েছিল আর তিনি নিজ চেহারা থেকে রক্ত মুছছেন এবং বলছেন, হে আল্লাহ! আমার জাতিকে ক্ষমা করে দিন, কারণ তারা জানে না - বুখারী ও মুসলিম। (বুখারী শরীফ হাদীস নং ৩৪৭৭, মুসলিম শরীফ হাদীস নং ১৯৭২)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পূর্বকালের কোনও এক নবীর সবরের দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন। বর্ণনাকালে হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাযি. উপস্থিত ছিলেন। তিনি যে ভাষায় ও ভঙ্গীতে এবং যখন ও যে স্থানে এ ঘটনা বর্ণনা করেছিলেন, হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'উদ রাযি. তার কিছুই ভোলেননি। সবই তাঁর হুবহু স্মরণ ছিল। তাঁর যে সে কথা হুবহু স্মরণ ছিল, তার প্রতি দৃঢ়তা জ্ঞাপনের জন্য তিনি বলছেন- যেন আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখতে পাচ্ছি।
এটা কোন নবীর ঘটনা, হাদীছে তার উল্লেখ নেই। মুজাহিদ রহ. বলেন, তিনি হযরত নূহ আলাইহিস সালাম। কিন্তু হাফেজ ইবন হাজার আসকালানী রহ. তাতে আপত্তি করেছেন। তার মতে ইনি বনী ইসরাঈলের কোনও নবী হবেন। তিনি মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকতে গেলে মানুষ তাঁর ডাকে তো সাড়া দেয়ইনি, উল্টো কেন তিনি দেব-দেবীর পূজা-অর্চনার বিপরীতে এক আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী করতে বলেন, সেই অপরাধে তাঁর উপর জুলুম-নির্যাতন চালাতে থাকে। তারা মেরে মেরে তাঁকে রক্তাক্ত করে দিত। তা সত্ত্বেও তিনি ধৈর্যের সাথে আপন কাজে রত থাকতেন। কওমের বিরুদ্ধে তিনি বদ্দু'আ পর্যন্ত করেননি। বরং চেহারা থেকে রক্ত মুছতেন আর দু'আ করতেন, হে আল্লাহ! আমার কওমকে ক্ষমা করে দিন। তারা তো বোঝে না। বস্তুত চিরকাল এটাই ছিল নবী-রাসূলগণের আদর্শ। তাঁরা আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের হিদায়াতের জন্য আসতেন। মানুষ যাতে হিদায়াত পেয়ে যায়, সে লক্ষ্যে পরম কল্যাণকামিতার সাথে তাদেরকে বোঝাতেন। কিন্তু সবকালেই তাঁদের স্বজাতি তাঁদের বিরুদ্ধাচরণ করেছে। তাঁদেরকে কষ্ট দিয়েছে। তাঁদের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা করেছে। এমনকি তাঁদেরকে হত্যা করতেও চেয়েছে। বহুজনকে হত্যাও করেছে। কিন্তু নবীগণ কখনও আপন কর্তব্য থেকে পিছু হটেননি। ন্যায়ের ব্যাপারে কখনও কারও সংগে আপোষ করেননি। সকল জুলুম-নির্যাতন অকাতরে সহ্য করেছেন। তাদেরকে বোঝাতে থেকেছেন এবং তাদের জন্য আল্লাহ তা'আলার কাছে দু'আ করেছেন। নির্যাতন সহ্য করেছেন হযরত নূহ আলাইহিস সালাম, হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম, হযরত মূসা আলাইহিস সালাম ও হযরত ঈসা আলাইহিস সালামসহ সকল নবী-রাসূল। আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামকেও স্বজাতির পক্ষ থেকে সবরকম নিপীড়ন সহ্য করতে হয়েছে। তিনি যেহেতু সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল, তাই দা'ওয়াতী কার্যক্রমে তাঁকে কষ্ট-ক্লেশও সহ্য করতে হয়েছে সর্বাপেক্ষা বেশি। কাফির-মুশরিকগণ তাঁকে কষ্টদানের কোনও পন্থাই বাকি রাখেনি। তায়েফের লোকজন তাঁর উপর চালিয়েছিল অবর্ণনীয় অত্যাচার। তা সত্ত্বেও তিনি বদ্দু'আ না দিয়ে আল্লাহর কাছে তাদের মাগফিরাত কামনা করেন। বলেন-

اللهم اغفر لقومي فإنهم لا يعلمون

'হে আল্লাহ! আমার কওমকে ক্ষমা করুন। তারা তো জানে না।'
সকল নিগ্রহের মুখেও যখন তিনি আপন কাজে অবিচল থাকেন, তখন তাঁর কওম তাঁকে হত্যার চক্রান্ত করেছিল। অগত্যা তিনি দেশ থেকে মদীনা মুনাওয়ারায় হিজরত করতে বাধ্য হন। মদীনা মুনাওয়ারায়ও শত্রুপক্ষ তাঁকে শান্তিতে থাকতে দেয়নি। একের পর এক যুদ্ধে লিপ্ত থাকতে হয়েছে। তাতে মারাত্মকভাবে আহত হতে হয়েছে। রক্ত ঝরাতে হয়েছে। হত্যার ষড়যন্ত্র রুখতে হয়েছে। তাঁর সাহাবীগণকে জান-মাল কুরবানী করতে হয়েছে। রক্ত দিতে হয়েছে। করতে হয়েছে শাহাদাতবরণ। দীনের পথে দাওয়াতের এটাই সার্বজনীন চিত্র। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-

أَمْ حَسِبْتُمْ أَنْ تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَأْتِكُمْ مَثَلُ الَّذِينَ خَلَوْا مِنْ قَبْلِكُمْ مَسَّتْهُمُ الْبَأْسَاءُ وَالضَّرَّاءُ وَزُلْزِلُوا

অর্থ : (হে মুসলিমগণ!) তোমরা কি মনে করেছ, তোমরা জান্নাতে (এমনিতেই) প্রবেশ করবে, অথচ এখনও পর্যন্ত তোমাদের উপর সেই রকম অবস্থা আসেনি, যেমনটা এসেছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর। তাদেরকে স্পর্শ করেছিল অর্থ-সংকট ও দুঃখ-কষ্ট এবং তাদেরকে করা হয়েছিল প্রকম্পিত।
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-

وَلَقَدْ كُذِّبَتْ رُسُلٌ مِنْ قَبْلِكَ فَصَبَرُوا عَلَى مَا كُذِّبُوا وَأُوذُوا حَتَّى أَتَاهُمْ نَصْرُنَا وَلَا مُبَدِّلَ لِكَلِمَاتِ اللَّهِ وَلَقَدْ جَاءَكَ مِنْ نَبَإِ الْمُرْسَلِينَ

অর্থ : বস্তুত তোমার পূর্বে বহু রাসূলকে মিথ্যাবাদী বলা হয়েছিল, কিন্তু তাদেরকে যে মিথ্যাবাদী বলা হয়েছে ও কষ্ট দান করা হয়েছে, তাতে তারা ধৈর্য ধারণ করেছিল, যে পর্যন্ত না তাদের কাছে আমার সাহায্য পৌঁছেছে। এমন কেউ নেই, যে আল্লাহর কথা পরিবর্তন করতে পারে। (পূর্ববর্তী) রাসূলগণের কিছু ঘটনা তোমার কাছে তো পৌঁছেছেই।'
এরকম আরও বহু আয়াতে পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণের দাওয়াতী মেহনত, তার বিপরীতে কাফির-মুশরিকদের জুলুম-নির্যাতন এবং তাতে তাঁদের অটল-অবিচলতার বৃত্তান্ত তুলে ধরা হয়েছে। বহু হাদীছেও তা বিবৃত হয়েছে। আলোচ্য হাদীছেও সেরকম এক ঘটনাই বর্ণিত হয়েছে। এগুলো বর্ণনার উদ্দেশ্য দাওয়াতী কর্মীদের মনে সাহস যোগানো, তাদের অন্তরে সবর ও অবিচলতার হিম্মত সৃষ্টি এবং নবী-রাসূলগণের আদর্শ অনুসরণের প্রেরণা সঞ্চার করা, যেমন ইরশাদ হয়েছেঃ-

وَكُلًّا نَقُصُّ عَلَيْكَ مِنْ أَنْبَاءِ الرُّسُلِ مَا نُثَبِّتُ بِهِ فُؤَادَكَ

“(হে নবী!) আমি তোমাকে বিগত নবীগণের এমন সব ঘটনা শোনাচ্ছি, যা দ্বারা আমি তোমার অন্তরে শক্তি যোগাই।"
অন্যত্র ইরশাদ-

فَاصْبِرْ كَمَا صَبَرَ أُولُو الْعَزْمِ مِنَ الرُّسُلِ

‘সুতরাং (হে রাসূল!) তুমি সবর অবলম্বন কর, যেমন সবর অবলম্বন করেছিল দৃঢ় প্রতিজ্ঞ রাসূলগণ।
আরও ইরশাদ হয়েছে-

لَقَدْ كَانَ فِي قَصَصِهِمْ عِبْرَةٌ لِأُولِي الْأَلْبَابِ

‘নিশ্চয়ই তাদের ঘটনায় বোধসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য শিক্ষা গ্রহণের উপাদান আছে। *

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. দীনের পথে দাওয়াতের মেহনতে শত বিরোধিতা ও জুলুম-নির্যাতনের মুখে সবর করা অবশ্যকর্তব্য।

খ. দা'ওয়াতী কাজে জুলুম-নির্যাতন সহ্য করা নবীগণের সুন্নত।

গ. দা'ওয়াতী কাজে জুলুম-নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে বদদু'আ করা উচিত নয়; বরং হিদায়াতের জন্য দু'আ করাই নবীগণের আদর্শ।

ঘ. নেককাজে উজ্জীবিত করার একটি কার্যকরী পন্থা নবী-রাসূলগণ ও বুযুর্গানে দীনের দৃষ্টান্ত তুলে ধরা।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন