রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং:
অধ্যায় : ৩ সবর।
৩৭। যেকোনও কষ্ট-ক্লেশে সবর করলে গুনাহ মাফ হয়

হযরত আবু সাঈদ রাযি. ও আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, মুসলিম ব্যক্তির যে-কোনও ক্লান্তি, রোগ, দুশ্চিন্তা, দুঃখ, কষ্ট ও পেরেশানী দেখা দেয়, এমনকি তার যদি কোনও কাঁটাও বিদ্ধ হয়, তার বিনিময়ে আল্লাহ তাআলা তার পাপ মোচন করে থাকেন - বুখারী ও মুসলিম। (বুখারী শরীফ হাদীস নং ৫৬৪২, মুসলিম শরীফ হাদীস নং ২৫৭৩)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছ দ্বারা বোঝা যায় মু'মিন ব্যক্তির কোনওকিছুই বৃথা যায় না। সে যেকোনও দুঃখ-কষ্ট ও বালা-মসিবতে পড়ে, তাতেও পুরস্কৃত হয়। গুনাহ মাফ হয়। সে হিসেবে দুঃখ-কষ্ট তার পক্ষে এক নি'আমত ও রহমত। অবশ্য এটা নি'আমত হবে তখনই, যখন বান্দা তাতে সবর অবলম্বন করবে। সবর না করলে কষ্টের কষ্টও হল, আবার লাভও কিছু হল না। সবর না করলে কষ্ট লাঘব হবে এমন তো নয়। সুতরাং বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক হবে যে-কোনও কষ্ট-ক্লেশে অধৈর্য না হয়ে সবর অবলম্বন করা। তাতে কষ্ট হলেও সেই কষ্ট বৃথা যায় না। বরং পাপের বোঝা হালকা হয়। এমনকি সবর দ্বারা কষ্টও লাঘব হয়। অন্তরে যখন পুরস্কারের আশা থাকে, তখন কষ্ট বরদাশত করা সহজ হয়।

এ হাদীছে من خَطَاياهُ বলা হয়েছে। من অব্যয়টি অংশবোধক। অর্থাৎ সমস্ত গুনাহ নয়; বরং তার অংশবিশেষ মাফ হয়। 'উলামায়ে কিরাম বলেন, সগীরা গুনাহ মাফ হয়। কবীরা গুনাহ মাফের জন্য তাওবার প্রয়োজন হয়। গুনাহ অন্যের হক সংক্রান্ত হলে যে ব্যক্তির হক তার পক্ষ থেকেও ক্ষমালাভ জরুরি।

প্রকাশ থাকে যে, কষ্ট-ক্লেশ ও বালা-মসিবত দ্বারা গুনাহ মাফ হয় আর সে হিসেবে এটা এক নি'আমত বটে, কিন্তু তাই বলে আল্লাহর কাছে এ জাতীয় নি'আমত চাওয়া ঠিক নয়। অর্থাৎ এমন দু'আ করা ঠিক নয় যে, আল্লাহ তা'আলা যেন বালা-মসিবত দিয়ে গুনাহ মাফ করেন এবং আখিরাতের আযাব থেকে নিষ্কৃতি দেন। সে নিষ্কৃতি লাভের লক্ষ্যে তাওবা ও ইসতিগফার করাই বাঞ্ছনীয়। এ হাদীছে যে কষ্ট-ক্লেশের কথা বলা হয়েছে তা ওই কষ্ট-ক্লেশ, যা বান্দার চাওয়া ছাড়াই আল্লাহ তা'আলা নিজ ইচ্ছায় দিয়ে থাকেন। অর্থাৎ অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে যে বালা-মসিবত দেখা দেয়, তাতে কর্তব্য ধৈর্যধারণ করা। এই আশায় বালা-মসিবত আকাঙ্ক্ষা করা যে, তাতে ধৈর্যধারণ করব আর গুনাহ থেকে নিষ্কৃতি পাব, এটা এক ধরনের ধৃষ্টতা। বান্দার কাজ বাহাদুরী দেখানো নয়; বরং সর্বাবস্থায় নিজ দুর্বলতা ও অক্ষমতা প্রকাশ করা। এজন্যই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তা'আলার কাছে বিপদ-আপদ না চেয়ে বরং শান্তি, সুস্থতা ও নিরাপত্তা প্রার্থনার শিক্ষা দিয়েছেন। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-

يَا أَيُّهَا النَّاسُ، لَا تَتَمَنَّوْا لِقَاءَ الْعَدُوِّ، وَاسْأَلُوا اللَّهَ الْعَافِيَةَ، فَإِنْ لَقِيتُمُوهُمْ فَاصْبِرُوا

'হে লোকসকল! তোমরা শত্রুর সাক্ষাত কামনা করো না। বরং আল্লাহর কাছে নিরাপত্তা প্রার্থনা কর। তবে যখন শত্রুর মুখোমুখি হবে, তখন সবর অবলম্বন করো।”

এ প্রসঙ্গে হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মাক্কী রহ.-এর একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। একদিন তিনি নসীহত করতে গিয়ে বলছিলেন, রোগ-ব্যাধিও আল্লাহর এক নি'আমত। তিনি বিষয়টা ব্যাখ্যা করে বোঝাচ্ছিলেন। ঠিক এই মুহূর্তে এক অসুস্থ ব্যক্তির পক্ষ থেকে দু'আ চাওয়া হল, যেন আল্লাহ তা'আলা তাকে আরোগ্য দান করেন। এবার তিনি কী করবেন? তিনি কি আরোগ্যের জন্য দু'আ করবেন? তবে তো নি'আমত বিলুপ্তির দু'আ করা হবে। সবাই তাকিয়ে আছে তিনি কী করেন। কিন্তু আল্লাহওয়ালাদেরকে আল্লাহ তা'আলাই পথ দেখান। সঠিক কথা তিনি তাদের অন্তরে ইলহাম করেন। সুতরাং তিনি দু'আ করলেন, হে আল্লাহ! অসুখ-বিসুখ নি'আমত বটে, কিন্তু আমরা বড় দুর্বল দুঃখ-কষ্টের নি‘আমত সহ্য করা আমাদের পক্ষে কঠিন। সুতরাং আপনি অসুস্থতার নি'আমতকে সুস্থতার নি'আমত দ্বারা বদলে দিন। সুবহানাল্লাহ, কী চমৎকার হিকমতের কথা!

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. দুনিয়ায় যে-কোনও রকমের কষ্ট-ক্লেশ ও বিপদ-আপদ দেখা দিলে তাতে অধৈর্য না হয়ে ধৈর্যধারণ করা উচিত, যেহেতু তাতে গুনাহ মাফ হয়।

খ. দুঃখ-কষ্টকে অকল্যাণজনক মনে করা উচিত নয়; বরং তাও এক প্রকার রহমত।

গ. দুঃখ-কষ্ট ও বিপদ-আপদ চেয়ে নেওয়া উচিত নয়; বরং আল্লাহ তা'আলার কাছে সুস্থতা ও নিরাপত্তা কামনা করা উচিত।