ফিকহুস সুনান ওয়াল আসার

৫. রোযার অধ্যায়

হাদীস নং: ১৩১১
বিসাল বা ইফতার বিহীন একটানা সিয়াম থেকে নিষেধাজ্ঞা
(১৩১১) আবু হুরাইরা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইফতার না-করে একটানা কয়েকদিন সিয়াম পালন করতে নিষেধ করেন। তখন মুসলিমগণের মধ্য থেকে একব্যক্তি বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি তো ইফতার-বিহীন একটানা সিয়াম পালন করেন। তিনি বলেন, তোমাদের মধ্যে আমার মতো কে আছ? আমার প্রভু আমার রাত্রি যাপনকালে আমাকে খাওয়ান এবং পান করান।
عن أبي هريرة رضي الله عنه قال: نهى رسول الله صلى الله عليه وسلم عن الوصال في الصوم فقال له رجل من المسلمين إنك تواصل يا رسول الله قال وأيكم مثلي؟ إني أبيت يطعمني ربي ويسقين

হাদীসের ব্যাখ্যা:

‘বিসাল' বলা হয় যেসকল কারণে রোযা ভেঙে যায়, রাতের বেলাও তা থেকে বিরত থাকাকে। এভাবে রোযা রাখাকে 'সওমে বিসাল' বলে।
এ হাদীছে জানানো হয়েছে যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবীগণকে এরূপ রোযা রাখতে নিষেধ করেছেন। তিনি তা নিষেধ করেছিলেন সাহাবীদের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে। কেননা সারাদিন রোযা রাখার পর রাতেও যদি পানাহার না হয় আর এভাবে দিন-রাত সমানে রোযা অবস্থায় কাটানো হয়, তবে তাতে অতিরিক্ত কষ্ট হওয়াই স্বাভাবিক। এ কষ্টের বিনিময়ে অতিরিক্ত ছাওয়াবের আশা থাকলেও কথা ছিল। কিন্তু এরূপ রোযায় ছাওয়াবের সম্ভাবনা কম। কেননা এক তো আল্লাহ তাআলার হুকুম হচ্ছে কেবল দিনের বেলায় রোযা রাখা। তিনি ইরশাদ করেনঃ- ثُمَّ أَتِمُّوا الصِّيَامَ إِلَى اللَّيْلِ ‘তারপর রাতের আগমন পর্যন্ত রোযা পূর্ণ কর।
অর্থাৎ রোযা দিনের বেলায়ই। রাত এসে গেলে রোযা শেষ। এ সময় রোযার হুকুম করা হয়নি; বরং হুকুম করা হয়েছে ইফতার করতে। তা সত্ত্বেও রোযা রাখলে হুকুমের বরখেলাফ করা হয়। শরীআতের হুকুমের বরখেলাফ করে ছাওয়াবের আশা থাকে কী করে? এক রেওয়ায়েতেও আছেঃ- إن الله لم يكتب الصيام بالليل، فمن صام فقد تعني ولا أخر له 'আল্লাহ তাআলা রাতে রোযার বিধান দেননি। কাজেই যে ব্যক্তি রাতে রোয়া রাখল সে কেবল কষ্টই করল, তার জন্য কোনও ছাওয়াব নেই।[১]
অপর এক বর্ণনায় আছে, বাশীর ইব্ন খাসাসিয়্যাহ'র স্ত্রী লায়লা দুই দিন যুক্তভাবে (অর্থাৎ রাতে পানাহার না করে) রোযা রাখার ইচ্ছা করলে বাশীর তাকে এই বলে নিষেধ করলেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরূপ করতে নিষেধ করেছেন এবং তিনি ইরশাদ করেনঃ- يفعل ذلك النصارى ولكن صوموا كما أمركم الله تعالى: «أتموا الصيام إلى الليل فإذا كان الليل فأفطروا এটা করে খৃষ্টানগণ। তোমরা বরং সেভাবেই রোযা রাখবে, যেমনটা আল্লাহ আদেশ করেছেন যে, তোমরা রোযা পূর্ণ কর রাত পর্যন্ত। কাজেই যখন রাত এসে যায়, তখন ইফতার করবে।[২]
এসব রেওয়ায়েত দ্বারা বোঝা যায় দিনের সঙ্গে রাত যুক্ত করে রোযা রাখার দ্বারা ছাওয়াব পাওয়ার সম্ভাবনা কম। সে ক্ষেত্রে শুধু শুধুই বাড়তি কষ্ট করা হয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাই এরূপ রোযা রাখতে নিষেধ করেছেন।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেন সাওমে বিসাল করতেন
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে অনেক সময় এরূপ একটানা নফল রোযা রাখতেন। এতে সাহাবায়ে কেরামের অন্তরে প্রশ্ন জাগে যে, তাদেরকে নিষেধ করা সত্ত্বেও তিনি নিজে কেন এরূপ রোযা রাখেন? তাই বললেনঃ- انك تواصل ‘আপনি যে এরূপ রোযা রাখেন?'। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা আপনার আগের পরের সব দোষত্রুটি ক্ষমা করে দিয়েছেন, তা সত্ত্বেও আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে আপনি দিবারাত্র সমানে রোযা রেখে থাকেন? আমরা তো আপনার মত মাসূম নই। কাজেই গুনাহ মাফ করানো ও আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি লাভের জন্য আমাদের পক্ষেই তো এরূপ রোযা রাখা বেশি সমীচীন? তিনি এর উত্তর দিলেনঃ- انى لست كهيئتكم 'আমি তোমাদের মত নই'। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার যে নৈকট্য আমার অর্জিত আছে, সেরকম তোমাদের নেই এবং তাঁর কাছে আমার যে উঁচু মর্যাদা সংরক্ষিত আছে তাও তোমাদের জন্য নেই। বুখারী শরীফের এক বর্ণনায় আছে أيكم مثلي তোমাদের মধ্যে আমার মত কে আছে?”। অর্থাৎ নৈকট্য ও উচ্চমর্যাদা এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্যে তোমরা কেউ আমার মত নও। কাজেই আমি সওমে বিসাল করি বলে তোমরাও তা করবে, এমনটা হতে পারে না। কেন তা হতে পারে না তিনি তার ব্যাখ্যা দান করেন যে- إني أبيت يطعمني ربي ويسقيني 'আমি এ অবস্থায় রাত যাপন করি যে, আমার প্রতিপালক আমাকে পানাহার করান'। ইমাম নববী রহ. এর ব্যাখ্যা করেনঃ- يجعل في قوة من أكل وشرب 'আল্লাহ তাআলা পানাহারকারী ব্যক্তির মত শক্তি আমাকে দান করেন'। এটাই অধিকাংশ উলামার ব্যাখ্যা। এ হিসেবে পানাহার করানো কথাটি রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ পানাহার করার দ্বারা পানাহারের ফল ও ফায়দা বোঝানো উদ্দেশ্য।যেন বলা হয়েছে, পানাহার করার দ্বারা শরীরে যে শক্তি অর্জিত হয়, আল্লাহ তা'আলা পানাহার ছাড়াই আমাকে সে শক্তি দান করে থাকেন। ফলে আমি কোনও কষ্ট-ক্লান্তি ছাড়াই এরূপ ইবাদত-বন্দেগী করতে পারি।
এমন হতে পারে যে, হাদীছে পানাহার দ্বারা ইবাদতের আস্বাদ ও গভীর ভাবাবেগ বোঝানো হয়েছে। বস্তুত আল্লাহ তাআলার শ্রেষ্ঠত্ব ও বড়ত্বের চিন্তাভাবনা, তাঁকে ধ্যান করার আনন্দ ও আস্বাদ, তাঁর মা'রিফাতের সাগরে অবগাহন, তাঁর প্রেম ভালোবাসায় প্রাণ জুড়ানো, তাঁর কাছে মুনাজাত ও তাঁর সঙ্গে নিভৃত আলাপ এবং তাঁর প্রতি দেহমনের অভিনিবেশ বান্দাকে পানাহারের কথা ভুলিয়ে দেয়। এসকল গুণে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্থান ছিল সবচে' উঁচুতে। কাজেই এ হাদীছে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁকে পানাহার করানোর কথা দ্বারা এ আধ্যাত্মিক ভাবাবেগের কথা বোঝানোও অসম্ভব নয়। ইমাম ইবনুল কায়্যিম রহ. হাদীছটির এরকম ব্যাখ্যাই করেছেন।তিনি বলেন, অনেক সময় এ (আধ্যাত্মিক) খাদ্য শারীরিক খাদ্য অপেক্ষাও উত্তম হয়ে থাকে। যার সামান্যতম রুচিবোধ ও অভিজ্ঞতা আছে সে জানে, আত্মিক ও রূহানী খাদ্যের কারণে অনেক সময় মানুষের বিভিন্ন দৈহিক খাদ্যের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়।
কারও কারও মতে, এ হাদীছে সত্যিকারের পানাহারই বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সম্মানার্থে তাঁর জন্য জান্নাত থেকে খাদ্য-পানীয় নিয়ে আসা হত। এটা ছিল তাঁর মু'জিযা। তাই তা খাওয়ার দ্বারা তাঁর রোযা ভাঙত না। রোযা ভাঙ্গে দুনিয়ার পানাহার দ্বারা। এ খাবারকে অনেকটা ঘুমন্ত ব্যক্তির পানাহারের সঙ্গে তুলনা করা চলে। অনেক সময় ঘুমন্ত ব্যক্তি স্বপ্নে যে খাবার খায় তাতে সে পরিতৃপ্তি বোধ করে। এ পরিতৃপ্তি অবস্থায় যখন তার ঘুম ভাঙে, তখনও সে বেশ সজীবতা বোধ করে থাকে। তাতে তার রোযা ভাঙে না এবং ছাওয়াবও কিছু কমে না।
ইমাম ইব্ন হাজার রহ. বলেন, এর সারকথা হচ্ছে তিনি তাঁর (নবুওয়াতী) সমুচ্চ শান ও ভাবের ভেতর নিমগ্ন থাকতেন। ফলে কোনও মানবীয় অবস্থা তখন তাঁর মধ্যে প্রভাব বিস্তার করত না।
মোটকথা রোযা অবস্থায় প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পানাহারকে অধিকাংশ আলেম প্রতীকী অর্থে ধরেছেন। তাদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী এ পানাহার দ্বারা রূহানী পানাহার তথা আল্লাহ তাআলার ইশক ও মহব্বতের আস্বাদ এবং তাঁর ইবাদত-বন্দেগীর আনন্দ ও মজা বোঝানো হয়েছে। এ হালতের কারণে রাতে পানাহার ছাড়াও তিনি একটানা রোযা রাখতে পারতেন, তাতে তাঁর অতিরিক্ত কষ্ট ক্লেশ বোধ হত না। আর কোনও কোনও আলেমের মতে এর দ্বারা অলৌকিকভাবে জান্নাতী পানাহার বোঝানো হয়েছে, যা দ্বারা রোযা নষ্ট হয় না।
ব্যাখ্যা যাই হোক না কেন, রাত-দিন মিলিয়ে সওমে বিসাল বা টানা রোযা রাখার বিষয়টি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য বিশেষ নিয়ম। এটা অন্যদের জন্য প্রযোজ্য নয়। আমাদের জন্য নিয়ম এটাই যে, শেষরাতে সাহরী খেয়ে দিনের বেলা রোযা রাখব এবং সূর্যাস্ত হলে ইফতার করব। ইফতার ও সাহরীর মাঝখানের সময়টায় পানাহার করা না করা প্রত্যেকের এখতিয়ারাধীন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারা উম্মতের প্রতি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দয়ামায়ার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি উম্মতের প্রতি মমত্ববশেই সওমে বিসাল করতে নিষেধ করেছেন।

খ. এর দ্বারা তাঁর সমুচ্চ আল্লাহপ্রেম সম্পর্কেও ধারণা লাভ হয় যে, তিনি ইবাদতের আস্বাদ লাভকে ‘পানাহার করা' শব্দে ব্যক্ত করেছেন।

গ. এ হাদীছ দ্বারা শিক্ষা পাওয়া যায় যে, উস্তায ও অভিভাবকের কোনও কাজে মনে প্রশ্ন জাগলে তার সামনে তা উল্লেখ করে সে প্রশ্নের জবাব জেনে নেওয়া চাই।

ঘ. উস্তায ও শায়খের উচিত নিজের কোনও ব্যতিক্রম কাজ থাকলে শাগরিদ ও ভক্ত-অনুরক্তদের সামনে তার সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিয়ে তাদের মনের কৌতূহল মিটিয়ে দেওয়া।

ঙ. এ হাদীছ দ্বারা জানা যায়, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খাস কিছু আমলও ছিল, যা অন্যদের জন্য প্রযোজ্য নয়।

চ. এ হাদীছ দ্বারা আল্লাহ তাআলার এ কুদরত সম্পর্কেও অবগতি লাভ হয় যে, তিনি প্রকাশ্য আসবাব-উপকরণ ছাড়াও সে আসবাব-উপকরণ সম্পর্কিত ফলাফল সংঘটিত করতে পারেন, যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সওমে বিসালে বাহ্যিক পানাহার ছাড়াও তাঁর ক্ষুধা ও পিপাসা নিবারণ করা।

[১] দ্রষ্টব্য : ফাতহুল বারী, খ. ৪, পৃ. ২৫৮

[২] তাবারানী, আল-মু'জামুল কাবীর : ১২৩১; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২১৯৫৫ (صحيح ابن حجر في الفتح)
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন