ফিকহুস সুনান ওয়াল আসার

৩. নামাযের অধ্যায়

হাদীস নং: ১০৬৮
ঘা, ক্ষত, ব্যাথা বা জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য দুআ
(১০৬৮) আয়িশা রা. বলেন, কোনো মানুষ তার দেহের কোথাও কষ্ট পেলে অথবা তার দেহে ঘা বা ক্ষত হলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজ আঙ্গুল এভাবে নিয়ে (শাহাদত আঙ্গুলি মাটিতে রেখে উঠিয়ে নিয়ে**) বলতেন, 'আল্লাহর নামে, আমাদের যমিনের মাটি, আমাদের একজনের থুতুর সাথে, যেন রোগমুক্তি লাভ করে আমাদের অসুস্থ ব্যক্তি, আমাদের প্রভুর অনুমতিক্রমে’।
عن عائشة رضي الله عنها أن رسول الله صلى الله عليه وسلم كان إذا اشتكى الإنسان الشيء منه أو كانت به قرحة أو جرح قال النبي صلى الله عليه وسلم بإصبعه هكذا: باسم الله تربة أرضنا بريقة بعضنا ليشفى سقيمنا بإذن ربنا

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছটিতে বলা হয়েছে, কারও শরীরের কোনও অঙ্গে ফোঁড়া হলে বা জখম হলে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাটির সঙ্গে থুথু মিশিয়ে তা নিজ শাহাদাত আঙ্গুল দ্বারা ফোঁড়া বা জখমের স্থানে লাগিয়ে দিতেন আর দু'আ পড়তেন- بسم الله تُربة أرضنا بريقة بعضنا يشفى به سَقِيمُنا بإذن رَبَّنَا (আল্লাহর নামে আমাদের ভূমির মাটি আমাদের কারও থুথুর সঙ্গে, আমাদের প্রতিপালকের নির্দেশে এর দ্বারা আমাদের রুগ্ন ব্যক্তি আরোগ্য লাভ করুক)। অন্যান্য বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, তিনি প্রথমে থুথু দ্বারা নিজ আঙ্গুল ভেজাতেন। তারপর সেই ভেজা আঙ্গুল মাটিতে রাখতেন। তাতে আঙ্গুলে যে মাটি লাগত, তা ফোঁড়া বা জখমের স্থানে লাগিয়ে দিতেন।

দু'আটিতে বলা হয়েছে- থুথু মিশ্রিত মাটি দ্বারা আল্লাহ তা'আলা নিজ ইচ্ছায় তাঁর বান্দাকে শিফা দান করেন। থুথু মিশ্রিত মাটি দ্বারা কীভাবে শিফা অর্জিত হয়, তা বোঝা জরুরি নয়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনও কাজই আল্লাহ তা'আলার ইশারা ছাড়া করতেন না। এটাও তাঁর ইশারায়ই তিনি করেছেন। তার মানে আল্লাহ তা'আলা তাঁকে জানিয়েছেন যে, তিনি এ পন্থায়ও মানুষকে শিফা দান করে থাকেন। আল্লাহ তা'আলা যে-কোনও পন্থায়ই নিজ ইচ্ছা পূরণ করতে পারেন। তিনি তো 'হও' বললেই সব হয়ে যায়। এ দুনিয়া দারুল আসবাব। এখানে তাঁর রীতি হল কাজকর্মে কোনও একটা উপকরণ ব্যবহার করা। সে হিসেবেই থুথু ও মাটির ব্যবহার। উপশম মূলত হয় আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছায়। থুথু ও মাটির ব্যবহার একটা উপকরণ মাত্র। এর মধ্যে উপশমের শক্তি থাকা জরুরি নয়। উপশম হয় কেবলই আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছায়। ব্যস এটাই চূড়ান্ত কথা।

উলামায়ে কেরাম থুথু ও মাটির ব্যবহারের ভেতর এই তাৎপর্য খুঁজে পেয়েছেন যে, মাটি মানবসৃষ্টির আদি উপকরণ। পরবর্তীতে মানবপ্রজন্মের ধারা চালু করা হয়েছে পুরুষের শুক্রাণু ও নারীর ডিম্বানু দ্বারা, যার প্রতি থুথু দ্বারা ইঙ্গিত করা হয়েছে। এ ইঙ্গিত যথার্থ হয়েছে এ হিসেবে যে, উভয়টিই মানবশরীরের বর্জ্য। চিকিৎসার এ পদ্ধতি দ্বারা যেন বলা হচ্ছে, হে আল্লাহ! আপনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন নিতান্ত তুচ্ছ জিনিস থেকে। যার সৃষ্টির ভিত্তি এমন তুচ্ছ বস্তুর উপর, তার রোগ-ব্যাধি আপনার কাছে না জানি কতটা তুচ্ছ। কাজেই এর উপশম ও আরোগ্যবিধান আপনার কাছে কোনও বিষয়ই নয়। সুতরাং হে আল্লাহ! সহজেই আপনি একে আরোগ্য দান করুন।

এভাবে কোনও প্রাকৃতিক বস্তুর ব্যবহারযোগে দু'আ পাঠ করার দ্বারা যে চিকিৎসা করা হয়, তাকে রুকয়া (رقية) বলা হয়। কোনও বস্তুর ব্যবহার ছাড়া কেবল হাত বুলানো ও দু'আ পড়া কিংবা দু'আ পড়ে ফুঁ দিলেও তাকে রুকয়া বলা হয়। এককথায় দু’আ ও ঝাড়ফুঁক হচ্ছে রুকয়া। দু'আ কুরআন মাজীদের কোনও আয়াতও হতে পারে, হতে পারে হাদীছের কোনও বাক্য কিংবা আল্লাহ তা'আলার কোনও নাম। তাছাড়া ভালো অর্থপূর্ণ কোনও বাক্য ব্যবহার দ্বারাও রুকয়া করা যায়। বোঝা গেল রুকয়া করা ও মন্ত্রপাঠ করা এক জিনিস নয়। কেননা মন্ত্রে যা বলা হয় তার অর্থ কেউ বোঝে না। অনেক সময় তার অর্থ হয় সম্পূর্ণ কুফরী কথা। তাই মন্ত্রপাঠ সম্পূর্ণ হারাম ও নাজায়েয। কিন্তু রুকয়া জায়েয। সুন্নাহ দ্বারা এর বৈধতা প্রমাণিত।

জাহিলী যুগে মানুষ মন্ত্রপাঠ দ্বারা ঝাড়ফুঁক করত। তখন তারা একেও 'রুকয়া'-ই বলত। যেহেতু মন্ত্রের ভেতর দুর্বোধ্য বা কুফুরী কথা থাকে, তাই নবী কারীম সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা নিষিদ্ধ করে দেন। পরে তিনি নিজেই বিভিন্ন দু'আর মাধ্যমে রুকয়া করতে শুরু করেন এবং সাহাবায়ে কেরামকেও তা শিখিয়ে দেন। এমনকি তিনি রুকয়ার আর্থিক বিনিময় গ্রহণকেও অনুমোদন করেন।

ইমাম ইবন হাজার রহ. বলেন, তিনটি শর্ত সাপেক্ষে রুকয়া বৈধ। (ক) রুকয়া আল্লাহর কালাম বা তাঁর নামসমূহ কিংবা তাঁর গুণাবলি দ্বারা করতে হবে। (খ) আরবী ভাষা কিংবা এমন কোনও ভাষার কথা দ্বারা হতে হবে, যার অর্থ বোধগম্য। (গ) বিশ্বাস রাখতে হবে রুকয়ার নিজস্ব কোনও ক্ষমতা নেই। আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছায় তা ক্রিয়াশীল হয়।

লক্ষণীয়, তিনটি শর্তেরই সারমর্ম হল তাওহীদী বিশ্বাসের সংরক্ষণ। অর্থাৎ সতর্ক থাকতে হবে যাতে বিশ্বাস ও কর্ম কোনওদিক দিয়েই নিজ আকীদাকে শিরকের মলিনতা স্পর্শ করতে না পারে।

রোগ-ব্যাধি, বিষধর প্রাণীর দংশন, কুদৃষ্টি, জাদুর প্রভাব, জিন্ন ও মানবশত্রু হতে আত্মরক্ষা ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে রুকয়া বৈধ। একবার নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মু সালামা রাযি.-এর ঘরে একটি দাসীকে দেখতে পেলেন যে, তার চেহারা কালো কালো দাগে ভরে গেছে। তিনি বললেন-
اسْتَرْقُوْا لَهَا، فَإِنَّ بِهَا النَّظْرَةَ
'তোমরা তাকে রুকয়া করাও। কারণ তার নজর লেগেছে’।
(সহীহ বুখারী : ৫৭৩৯; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর : ৮০১; হাকিম, আল মুস্তাদরাক: ৭৪৮৬; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা : ১৯৫৮৫; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ২২৪৫)

উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি আাসাল্লাম আমাকে কুদৃষ্টির বেলায় রুকয়ার অনুমতি দিয়েছেন। -(সহীহ বুখারী: ৫৭৩৮)
কুদৃষ্টিও যে লাগে, এতে কোনও সন্দেহ নেই। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
الْعَيْنُ حَقٌّ
'নজর লাগার বিষয়টি সত্য’।
(সহীহ বুখারী : ৫৭৪০; সহীহ মুসলিম: ২২০; সুনানে আবু দাউদ: ৩৮৭৯; জামে তিরমিযী: ২০৬১; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা: ৭৫৭৩; সুনানে ইবন মাজাহ : ৩৫০৬; মুসনাদে আহমদ : ২৪৭৬; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ২৩৫৯৪; হাকিম, আল মুস্তাদরাক: ৫৭৪২)

জাদুর প্রভাব থেকে মুক্তির জন্য সর্বাপেক্ষা কার্যকর রুকয়া হল সূরা নাস ও সূরা ফালাক পড়ে দম করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও এটা করতেন। তিনি এ দুই সূরার সঙ্গে সূরা ইখলাস পড়ে দুই হাতে ফুঁ দিতেন। তারপর মাথা থেকে পা পর্যন্ত শরীরের যতদূর সম্ভব মুছে নিতেন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. রুকয়া অর্থাৎ ঝাড়ফুঁক করা জায়েয।

খ. ঝাড়ফুঁকে হাদীছে বর্ণিত দু'আ বেশি কার্যকর।

গ. যে-কোনও চিকিৎসায় এ বিশ্বাস রাখা জরুরি যে, উপকারলাভ কেবল আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছায়ই হতে পারে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন
ফিকহুস সুনান - হাদীস নং ১০৬৮ | মুসলিম বাংলা