ফিকহুস সুনান ওয়াল আসার

১- সামগ্রিক মূলনীতিসমূহ

হাদীস নং: ৫৮
আল্লাহর বন্ধুগণের (ওলিগণের) মর্যাদা
(৫৮) আবু হুরাইরা রা. রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেছেন, আল্লাহ বলেছেন, 'যে ব্যক্তি আমার কোনো ওলির (বন্ধুর) সাথে শত্রুতা করবে আমি তার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করি। আমার নৈকট্য অর্জন ও ওলি হওয়ার জন্য বান্দা যত কাজ করে তন্মধ্যে সবচেয়ে আমি ভালোবাসি যে কাজ আমি ফরয করেছি। (ফরয কাজ পালন করাই আমার ওলি হওয়ার জন্য সর্বপ্রথম ও সবচেয়ে প্রিয় কাজ)। এরপর বান্দা যখন সর্বদা নফল ইবাদত পালনের মাধ্যমে আমার নৈকট্য ও বেলায়াতের পথে অগ্রসর হতে থাকে তখন আমি তাকে ভালোবাসি'।
عن أبي هريرة رضي الله عنه مرفوعا: إن الله قال من عادى لي وليا فقد آذنته بالحرب وما تقرب إلي عبدي بشيء أحب إلي مما افترضت عليه وما يزال عبدي يتقرب إلي بالنوافل حتى أحبه

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এটি একটি হাদীছে কুদসী। 'হাদীছে কুদসী' বলা হয় এমন হাদীছকে, যার ভাব আল্লাহর, ভাষা রাসূলের এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা ব্যক্ত করেন আল্লাহর বরাতে। কুরআন মাজীদের সঙ্গে এর পার্থক্য এই যে, কুরআনের ভাষা অলৌকিক, কোনও মানুষের পক্ষে তার ছোট্ট একটি সূরার মত বাক্যমালা তৈরি করা সম্ভব নয়, কিন্তু হাদীছে কুদসীর ভাষা অলৌকিক নয়। কুরআন মাজীদ না বুঝে তিলাওয়াত করলেও ছাওয়াব হয়, কিন্তু হাদীছ যদি 'হাদীছে কুদসী'-ও হয়, তবুও তার তিলাওয়াতে ছাওয়াবের কোনও ওয়াদা নেই। কুরআন মাজীদ অপবিত্র অবস্থায় স্পর্শ করা জায়েয নয়, কিন্তু সর্বপ্রকার হাদীছই অপবিত্র অবস্থায়ও স্পর্শ করা যায়।

এ হাদীছে মৌলিকভাবে তিনটি বিষয় বর্ণিত হয়েছে।

ক. আল্লাহর ওলীর সঙ্গে দুশমনী করার পরিণাম;

খ. আল্লাহর ওলী হওয়ার উপায়;

গ. আল্লাহর ওলীর মর্যাদা ও মাহাত্ম্য।

আল্লাহর ওলীর সঙ্গে দুশমনি করার পরিণাম

এ হাদীছে আল্লাহ তা'আলা বলেন, যে ব্যক্তি আমার কোনও বন্ধুর সাথে শত্রুতা করে, আমি তার সঙ্গে যুদ্ধের ঘোষণা দিই। অর্থাৎ আমার বন্ধুর সঙ্গে শত্রুতার কারণে সে আমারও শত্রু হয়ে যায়। তাই আমি তার সঙ্গে শত্রুর মত আচরণ করি।
এটা একটা কঠিন সতর্কবাণী। ওলীর শত্রুকে আল্লাহ নিজ শত্রুরূপে গণ্য করেছেন। এবং তার সঙ্গে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছেন। আল্লাহ তা'আলা যার সঙ্গে যুদ্ধের ঘোষণা দেন, সে কখনও সফল হতে পারে কি? তার জন্য তো ধ্বংস অনিবার্য। আল্লাহ তা'আলা এক অসীম শক্তিমান সত্তা। কোনও মাখলুক যত বড়ই শক্তিশালী হোক, তার ক্ষমতা যত বিপুল হোক, সর্বাবস্থায়ই তার শক্তি ও ক্ষমতা সীমিত। অসীম শক্তিমানের বিরুদ্ধে সসীম ক্ষমতাবানের কোনও তুলনা হয় না। এ দুইয়ের মধ্যে কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে না। কাজেই আল্লাহ তা'আলা যদি কাউকে শাস্তি দিতে চান তা ঠেকানোর সাধ্য কারও নেই।
আল্লাহ তাঁর ওলীর শত্রুকে যেভাবে ইচ্ছা শাস্তি দিতে পারেন। অতীতে এর বিভিন্ন রকম নজির আছে। আল্লাহর ওলীকে কষ্ট দেওয়ার ফলে কারও অপমৃত্যু হয়েছে, কেউ অন্ধ, কেউ বিকলাঙ্গ হয়ে গেছে, কেউ অগ্নিকাণ্ডের শিকার হয়েছে, কেউ বা অন্য কোনও বিপদে পড়েছে।
অনেক সময় আল্লাহ কাকে কিভাবে শাস্তি দেন তা উপলব্ধিও করা যায় না। ফলে শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তি বুঝতে পারে না যে, সে শাস্তিভোগের ভেতর দিয়ে চলছে। এরকম শাস্তিই বেশি ভয়ানক। অনেক সময় আল্লাহর ওলীর দুশমন বেশ বেঁচে-বর্তে থাকে। মনে করা হয় তার দিন তো ভালোই কাটছে। প্রকৃতপক্ষে তার দিন ভালো কাটে না। কেননা আল্লাহ তা'আলা তার ন্যায়-অন্যায়বোধ লোপ করে দেন। পাপাচারকে তার কাছে প্রিয় করে তোলেন। সে শত্রুতা করে মজা পায়। অন্যায়-অনাচারে আনন্দ বোধ করে। তা করে এই জন্যে যে, তার স্বভাবপ্রকৃতি বিকৃত হয়ে গেছে। বোধবুদ্ধি নষ্ট হয়ে গেছে। মনের সুকুমারবৃত্তির বিলোপ ঘটেছে। ফলে আকৃতিতে মানুষ থাকলেও প্রকৃতিতে মানুষ থাকে না। মানবরূপের অমানুষ হয়ে যায়। এ তো সাক্ষাৎ শাস্তি! এককালে আল্লাহ তা'আলা আকৃতি বিকৃত করার শাস্তিও দিতেন। কঠিন পাপীকে শূকর, বানর বানিয়ে দিতেন। এ উম্মতকে সেরকম শাস্তি দেওয়া হয় না। তবে স্বভাবপ্রকৃতি বিকৃত করার শাস্তি দেওয়া হয়ে থাকে, যা অনেক সময় মানুষ বুঝতে পারে না। ফলে সে আরও বেশি পাপাচারে লিপ্ত হয় এবং একপর্যায়ে ঈমানহারা হয়ে জাহান্নামের ইন্ধনে পরিণত হয়। এমন ঘটনাও আছে যে, এককালের দীনের খাদেম ও প্রচারক পরবর্তীকালে বেদীন-বেঈমান হয়ে কবরে চলে গেছে। একবার দীনী গবেষক এবং সুবক্তা ও সুলেখক পরবর্তীকালে নাস্তিক বা ভণ্ড নবী সেজে বসেছে। অনুসন্ধান করে দেখা গেছে তার এ পরিণতি কোনও আল্লাহওয়ালাকে কষ্ট দেওয়া বা কোনও বুযুর্গের সঙ্গে বেআদবী করার ফল। কাজেই এ ব্যাপারে খুব সাবধান হওয়া উচিত। আল্লাহ তা'আলা আমাদের হেফাজত করুন।

আল্লাহর ওলী হওয়ার উপায়

'ওলী' শব্দের অর্থ বুঝতে পারলে ওলী হওয়ার উপায় সহজেই বোঝা যাবে। ٌُوَلِىّ (ওলী) শব্দটির উৎপত্তি وَلْىٌُ থেকে, যার অর্থ নিকটবর্তী হওয়া। সে হিসেবে وَلِىٌُ অর্থ নিকটবর্তী ও ঘনিষ্ঠ। অথবা এর উৎপত্তি وِلايَةٌ থেকে, যার অর্থ ভালোবাসা, বন্ধুত্ব করা ও আসক্ত হওয়া। সে হিসেবে ٌُوَلِىّ মানে বন্ধু ও প্রিয়জন। উভয় অর্থের মধ্যে মিল স্পষ্ট। যে ব্যক্তি কারও বন্ধু ও ভালোবাসার পাত্র, সে তার ঘনিষ্ঠ ও নিকটবর্তীও বটে। যারা আল্লাহর ওলী, তারা কোনও উপায়ে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করে। ফলে তাঁর মহব্বত ও ভালোবাসার পাত্র হয়ে যায়। তা কী উপায়ে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা যায়? কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

أَلَا إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللَّهِ لَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ (62) الَّذِينَ آمَنُوا وَكَانُوا يَتَّقُونَ (63)

অর্থ : স্মরণ রেখ, যারা আল্লাহর বন্ধু তাদের কোনও ভয় থাকবে না এবং তারা দুঃখিতও হবে না। তারা সেইসব লোক, যারা ঈমান এনেছে এবং তাকওয়া অবলম্বন করেছে।সূরা ইউনুস, আয়াত ৬১-৬২

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-

إِنْ أَوْلِيَاؤُهُ إِلَّا الْمُتَّقُونَ

অর্থ : তাঁর ওলী তো ওই সকল লোক, যারা তাকওয়া অবলম্বন করে চলে।সূরা আনফাল, আয়াত ৩৪
তাকওয়া অবলম্বন করা মানে আল্লাহ তা'আলার আদেশ-নিষেধ মেনে চলা এবং মনের সম্পর্ক গায়রুল্লাহ থেকে ছিন্ন করে আল্লাহর সঙ্গে এমনভাবে স্থাপন করা যে, প্রত্যেকটি কাজে কেবল তাঁর সন্তুষ্টিই হয় লক্ষ্যবস্তু আর তাঁর নৈকট্য ও ভালোবাসা পাওয়াই হয় তার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান। যাদের মনের অবস্থা এরকম হয়, তারা ফরয- ওয়াজিব আদায়ের পাশাপাশি বেশি বেশি নফল আমলে যত্নবান থাকে, সর্বক্ষণ তাঁর যিকর-আযকারে রত থাকে এবং একমুহূর্তও তাঁর স্মরণ থেকে গাফেল হয় না।
এ হাদীছে আল্লাহর ওলী হওয়ার উপায় বলা হয়েছে 'ইবাদত-বন্দেগীকে। এটা যেন ওই সকল আয়াতেরই ব্যাখ্যা, যাতে তাকওয়া-পরহেযগারীকে ওলীর গুণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ হাদীছে কুদসীতে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেছেন, ফরয আমলই তাঁর কাছে সবচে' বেশি প্রিয়। এর মাধ্যমেই তাঁর নৈকট্য বেশি লাভ হয়। আল্লাহর নৈকট্যলাভের জন্য এর সমতুল্য অন্য কোনও আমল নেই।
ফরয আমল দুই প্রকার- হাক্কুল্লাহ ও হাক্কুল ইবাদ। নামায, রোযা ইত্যাদি হচ্ছে হাক্কুল্লাহ- আল্লাহর হক। বান্দার হক নানারকম। এর মধ্যে রয়েছে পিতামাতার হক, ছেলেমেয়ের হক, স্বামী-স্ত্রীর হক, প্রতিবেশীর হক, ছোট ও বড়র হক, 'উলামায়ে কিরামের হক, বিভিন্ন রকমের আমানত আদায়, সত্য কথা বলা, ওয়াদা রক্ষা করা, ন্যায়বিচার করা ইত্যাদি। এ সবই ফরয। আল্লাহর ওলী হওয়ার জন্য এসব ফরয আদায় করা অবশ্যকর্তব্য। নফলের তুলনায় এর গুরুত্ব অনেক অনেক বেশি। কেননা নফল আমল আদায় করলে ছাওয়াব পাওয়া যায়, কিন্তু আদায় না করলে কোনও গুনাহ নেই এবং কোনও শাস্তিও নেই। পক্ষান্তরে ফরয আমল আদায় করলে তার ছাওয়াব তো আছেই, সেইসঙ্গে আদায় না করলে হয় কঠিন গুনাহ এবং সে কারণে বান্দা শাস্তির উপযুক্ত হয়ে যায়, যা তাওবা ছাড়া মাফও হয় না। সুতরাং নফল অপেক্ষা ফরয বেশি পূর্ণাঙ্গ। তাই আল্লাহর নৈকট্য লাভের পক্ষেও বেশি সহায়ক।
প্রকাশ থাকে যে, আল্লাহ তা'আলা যেসব কাজ হারাম করেছেন তা থেকে বেঁচে থাকাও ফরয। সুতরাং ফরয আমলের কথা বললে হারাম থেকে বেঁচে থাকার বিষয়টাও চলে আসে। যদি কোনও ব্যক্তি হারাম কাজ থেকে বেঁচে না থাকে, তবে সে ফরয তরকের গুনাহে লিপ্ত হল। এ অবস্থায় নফল দ্বারা তার পক্ষে বেশি অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়। বরং কোনও হারাম তো এমন আছে, যাতে লিপ্ত হলে নফল তো বটেই, ফরয কাজও আটকে যায়, যেমন হারাম উপার্জন। যার পানাহার হালাল নয়, পরিধানের কাপড়ও হারাম টাকায় কেনা, আল্লাহ তা'আলার কাছে তার কোনও ইবাদত-বন্দেগী কবুল হয় না। সুতরাং আল্লাহর নৈকট্যকামীর কর্তব্য এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা।
অনেকে এ বিষয়টা বোঝে না। তারা অনেক নফল আমলে বেশ যত্নবান থাকে। অন্যদিকে বহু ফরয আদায়ে অবহেলা করে। হারাম উপার্জন থেকেও বেঁচে থাকে না। এবং অন্যান্য নিষিদ্ধ কাজে লিপ্ত হতেও দ্বিধাবোধ করে না। হয়তো রাতভর তাহাজ্জুদ পড়ে। কিন্তু পিতামাতার হক আদায় করে না। হয়তো পাগড়ি বেঁধে চলাফেরা করে। অপরদিকে প্রতিবেশীকেও কষ্ট দেয়। দাওয়াতের কাজে দিনরাত ব্যস্ত থাকে। অপরদিকে মীরাছের প্রাপ্য অংশ থেকে বোনকে বঞ্চিত করে কিংবা আমানত আদায়ে অবহেলা করে আর এভাবে হারাম পানাহারে লিপ্ত থাকে।
এরকম আরও উদাহরণ দেওয়া যায়, যাতে সুন্নত ও নফলে আগ্রহের পাশাপাশি ফরয-ওয়াজিবে অবহেলা প্রদর্শন করা হয়। এটা নিতান্তই ভুল। ফরয অবজ্ঞা করে যতবেশিই নফল আদায় করা হোক না কেন, তা দ্বারা কোনওদিন আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যাবে না। আল্লাহর নৈকট্যলাভের জন্য ফরয হচ্ছে মূল ভিত্তি। নফল সে ভিত্তির উপর স্থাপিত দালান-কোঠা। ভিত্তি মজবুত না করে যদি উপরে উপরে ইট গাঁথা হয়, তবে তা দিয়ে দালান-কোঠা হয় না। তদ্রূপ ফরয আদায় না করে যতই নফল আমল করা হোক, তা দিয়ে বেলায়েত হাসিল হবে না। এজন্যই আল্লাহ তা'আলা এ হাদীছে প্রথমে ফরয আদায় করার কথা বলেছেন, যাতে বেলায়েতের ভিত্তি স্থাপিত হয়ে যায়। তারপর নফলের কথা বলেছেন।
আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন, আমার বান্দা নফলের মাধ্যমে আমার নৈকট্য অর্জন করতে থাকে। পরিশেষে আমি তাকে ভালোবেসে ফেলি। প্রকাশ থাকে যে, যত রকম ফরয ইবাদত আছে তার প্রত্যেকটির সমজাতীয় নফলও আছে। যেমন, ফরয নামাযের পাশাপাশি নফল নামায, যাকাতের পাশাপাশি নফল দান-সদাকা, ফরয হজ্জের পর নফল হজ্জ এবং ফরয রোযার সঙ্গে নফল রোযা। এমনিভাবে কুরআন তিলাওয়াত, যিকর-আযকার, বিভিন্ন কাজের আগের পরের দু'আ ও দুরূদ শরীফ পাঠ- এগুলোও অনেক মূল্যবান নফল আমল। এগুলোর মাধ্যমেও আল্লাহ তা'আলার নৈকট্য লাভ করা যায়।
কুরআন মাজীদ আল্লাহর কালাম। আল্লাহর নিকট থেকে মানুষের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে। বুযুর্গানে দীন বলেন, যে জিনিস আল্লাহর নিকট থেকে মানুষের কাছে এসেছে, আল্লাহর নৈকট্য লাভের পক্ষে তা অনেক বড় অবলম্বন। সুতরাং যে ব্যক্তি যত বেশি কুরআন তিলাওয়াত করবে, আল্লাহর নৈকট্যও তার তত বেশি অর্জিত হবে। বস্তুত কুরআন তিলাওয়াত শ্রেষ্ঠতম যিকর। আর যিকর সম্পর্কে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-

فَاذْكُرُونِي أَذْكُرْكُمْ

তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমিও তোমাদের স্মরণ করব।সূরা বাকারা, আয়াত ১৫২
যিকরের মর্যাদা ও মহিমা বোঝার জন্য এরচে' বড় সনদ আর কী হতে পারে? যে কাজ করলে আল্লাহ স্বয়ং বান্দাকে স্মরণ করেন, সে কাজ কতই না মহিমাপূর্ণ।
বান্দার হকের ক্ষেত্রেও ফরযের পাশাপাশি নফল আমলও আছে। পিতামাতার যতটুকু সেবাযত্ন করা ফরয, কেউ যদি তারচে' বেশি করে তবে তা নফল হবে। কিন্তু সে নফল অনেক মূল্যবান। বেশি বেশি খেদমত করে যে যত তাদেরকে খুশি করতে পারবে, দুনিয়া ও আখিরাতে সে ততই লাভবান হবে। অনুরূপ আল্লাহ তা'আলার সৃষ্টিমালার প্রতি নিজ কর্তব্যপালনের পর অতিরিক্ত যত সেবা দান করা যাবে, আল্লাহ তা'আলার ততই বেশি সন্তুষ্টি লাভ হবে। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে- “সৃষ্টিমালা আল্লাহর পরিবার। আল্লাহর সর্বাপেক্ষা প্রিয় বান্দা সে-ই, যে আল্লাহর পরিবারের সদস্যবর্গের প্রতি বেশি সময় থাকে”। আল্লাহর প্রিয় হওয়া তাঁর ওলী হওয়াই তো বটে। সুতরাং আল্লাহর ওলী হওয়ার একটা বড় মাধ্যম এটাও যে, প্রাণভরে তাঁর সৃষ্টিসমূহের সেবা করা হবে।

আল্লাহর ওলীর মর্যাদা ও মাহাত্ম্য

এ হাদীছে আল্লাহ তা'আলা তাঁর ওলীর তিনটি ফযীলত বয়ান করেছেন।

ক. তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঠিক ব্যবহার হওয়া;

খ. তার দু'আ কবুল হওয়া;

গ. বিপদ-আপদ থেকে তাকে রক্ষা করা।

আল্লাহ তা'আলা জানান যে, বান্দা যখন ফরয ইবাদতের পাশাপাশি নফল আমলে রত থাকে, তখন আল্লাহ তা'আলা তাকে ভালোবেসে ফেলেন। এভাবে বান্দা আল্লাহর ওলী ও বন্ধুতে পরিণত হয়ে যায়। আর যখন সে তাঁর ওলী হয়ে যায় এবং তিনি তাকে ভালোবেসে ফেলেন, তখন তিনি তার কান, চোখ, হাত ও পায়ে পরিণত হয়ে যান। এর অর্থ আল্লাহ তা'আলার মানবরূপ ধারণ করা নয়, তিনি মানুষে পরিণত হয়ে যান এমন নয়; বরং মানুষ যাতে এসব অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সঠিক ব্যবহার করতে পারে সে ব্যাপারে তিনি তার সাহায্য করেন। মানুষ বেশিরভাগ গুনাহ এসব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দ্বারাই করে থাকে। কিন্তু মানুষ যখন আল্লাহর ওলী ও বন্ধুতে পরিণত হয়ে যায়, তখন আল্লাহর সাহায্যে সে গুনাহ থেকে বাঁচতে সক্ষম হয় এবং এসব অঙ্গকে নেক কাজে ব্যবহার করার সুযোগ পায়। সে তার কান দিয়ে কোনও অবৈধ ও অহেতুক কথা শোনে না। এমন কথাই শোনে, যাতে আল্লাহ সন্তুষ্ট হন। সে তার চোখ দিয়ে কোনও অবৈধ বস্তু দেখে না; বরং এমন জিনিস দেখে, যাতে পুণ্য অর্জিত হয়। সে তার হাত দিয়ে কোনও হারাম বস্তু স্পর্শ করে না; বরং এমন কাজ করে, যাতে আমিরাতের সঞ্চয় হয়। এবং সে তার পা দিয়ে কোনও অবৈধ পথে চলে না; বরং এমন পথে চলে, যাতে দুনিয়া ও আখিরাতের প্রভূত কল্যাণ সাধিত হয়।
আল্লাহ তা'আলা বলেন, সে আমার কাছে যদি কিছু চায়, তাকে তা দান করি। অর্থাৎ বান্দা যখন ফরয ও নফল ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে ও তাঁর ওলী হয়ে যায়, তখন সে 'মুস্তাজাবুদ্দা'ওয়া' হয়ে যায়। 'মুস্তাজাবুদ্দা'ওয়া' বলে এমন ব্যক্তিকে, যার দু'আ আল্লাহ কবুল করেন। আমরা অতীতের এমন বহু ওলী-বুযুর্গ সম্পর্কে জানতে পারি, যাদের দু'আ আল্লাহ তা'আলা কবুল করতেন। তাদের দু'আ কবুলের অনেক বিস্ময়কর ঘটনা বর্ণিত আছে। এমন অনেক ঘটনাও আছে, যা তাদের কারামাত হিসেবে স্বীকৃত।
এমনিতে তো আল্লাহর কাছে দু'আর দরজা সকলের জন্যই খোলা। কিন্তু এমন অনেক গুনাহ আছে, যা দু'আ কবুলের পক্ষে বাধা। যেমন, মদ পান করা, হারাম পানাহার করা, মুসলিম ব্যক্তির প্রতি ঘৃণা পোষণ করা ইত্যাদি। ওলী-বুযুর্গগণ যেহেতু এ জাতীয় গুনাহ থেকে দূরে থাকেন, তাই তাদের দু'আ কবুলে কোনও বাধা থাকে না। তারা আল্লাহর কাছে যে দু'আই করেন, আল্লাহ নিজ হিকমত অনুযায়ী তা কবুল করে থাকেন।
ওলী-বুযুর্গদের এটাও একটা ফযীলত যে, তারা আল্লাহর কাছে যখন কোনও অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করেন, তখন আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে তা থেকে রক্ষা করেন। বস্তুত এক বন্ধুর সঙ্গে অপর বন্ধুর আচরণ এমনই হয়ে থাকে। আল্লাহ তা'আলা যেহেতু অসীম ক্ষমতার মালিক, তাই তিনি নিজ ওলী ও বন্ধুর সব মনোবাঞ্ছাই পূরণ করেন। আর এটা তো স্পষ্ট যে, ওলী ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলার কাছে অবাঞ্ছনীয় কিছু প্রার্থনা করেন না। তার দীন ও আখিরাতের পক্ষে যা ক্ষতিকর, যা তার ঈমান ও আমলে সালিহার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ, তিনি কেবল তা থেকেই বাঁচতে চাবেন। আল্লাহ তা'আলাও তাকে নিজ দয়ায় সেরকম পরিস্থিতি থেকে বাঁচিয়ে নেন। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে তাঁর মর্জি মোতাবেক আমল করার তাওফীক দান করুন, আমীন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. ফরয আমল সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। এটাই আল্লাহর নৈকট্য লাভের ভিত্তি।

খ. নফল ইবাদত-বন্দেগীকে অবহেলা করা উচিত নয়। এটা আল্লাহর ওলীগণের শান। এর মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্যলাভ ত্বরান্বিত হয়।

গ. আল্লাহর নৈকট্যলাভ গুনাহ হতে আত্মরক্ষার পক্ষে সহায়ক। আল্লাহ তা'আলা ওলী- বুযুর্গদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে গুনাহের কাজে ব্যবহার করা থেকে হেফাজত করেন।

ঘ. ইবাদত-বন্দেগীতে যত্নবান থাকাটা বালা-মসিবত থেকে আত্মরক্ষার পক্ষেও সহায়ক।

ঙ. ফরয ও নফল ইবাদত-বন্দেগী যত বেশি করা যায়, ততই দু'আ কবুলের বেশি আশা থাকে।

চ. শরী'আতের অনুসরণ ছাড়া কখনও ওলী-বুযুর্গ হওয়া যায় না। সুতরাং খাঁটি বুযুর্গের আলামত হল শরী'আতের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ।

ছ. যে ব্যক্তি ওলী-বুযুর্গের সঙ্গে শত্রুতা করে, সে আল্লাহর শত্রু হয়ে যায়। সুতরাং ওলী-বুযুর্গদের সঙ্গে শত্রুতা করা, তাদের মনে কষ্ট দেওয়া এবং তাদের সঙ্গে বেআদবী করা থেকে যথাসম্ভব বেঁচে থাকা উচিত।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন
ফিকহুস সুনান - হাদীস নং ৫৮ | মুসলিম বাংলা