মুসনাদে ইমাম আযম আবু হানীফা রহঃ

৮. বিবাহ-শাদীর অধ্যায়

হাদীস নং: ২৬২
মহিলাদের অশুভ হওয়া
হাদীস নং- ২৬২

হযরত ইবন বুরায়দা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ একবার রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সামনে কোন বস্তুর অশুভ হওয়া সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। তখন তিনি ইরশাদ করেন : অশুভ হওয়া বিষয়টি ঘর, ঘোড়া এবং নারীর সাথে সম্পৃক্ত। ঘরের অশুভ হলো সংকীর্ণ হওয়া এবং প্রতিবেশী খারাপ বা দুষ্ট প্রকৃতির হওয়া। ঘোড়ার অশুভ হলো তা অবাধ্য হওয়া। নারীর অশুভ হলো সে বন্ধ্যা হওয়া।
অন্য এক রেওয়ায়েতে আছে, যদি কোন বস্তুর মধ্যে অশুভ থাকে, তবে তা ঘর, নারী এবংঘোড়ার মধ্যে আছে। ঘরের অশুভ হলো এর সংকীর্ণ হওয়া। নারীর অশুভ হলো সে দুশ্চরিত্রা ও বন্ধ্যা হওয়া। ঘোড়ার অশুভ হলো এর অবাধ্যতা ও মুখে জোর হওয়া।
عَنْ عَلْقَمَةَ بْنِ مَرْثَدٍ، عَنِ ابْنِ بُرَيْدَةَ، قَالَ: تَذَاكَرُوا الشُّؤْمَ ذَاتَ يَوْمٍ عِنْدَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَ: " الشُّؤْمُ فِي: الدَّارِ، وَالْمَرْأَةِ، وَالْفَرَسِ، فَشُؤْمُ الدَّارِ: أَنْ تَكُونَ ضَيِّقَةً لَهَا جِيرَانٌ سُوءٌ، وَشُؤْمُ الْفَرَسِ: أَنْ تَكُونَ جَمُوحًا، وَشُؤْمُ الْمَرْأَةِ: أَنْ تَكُونَ عَاقِرًا ".
زَادَ الْحَسَنُ بْنُ سُفْيَانَ: «سَيِّئَةَ الْخُلُقِ عَاقِرًا» .
وَفِي رِوَايَةٍ: «إِنْ يَكُنِ الشُّؤْمُ فِي شَيْءٍ، فَفِي الدَّارِ وَالْفَرَسِ وَالْمَرْأَةِ، فَأَمَّا الدَّارُ، فَشُؤْمُهَا ضِيقُهَا، وَأَمَّا الْمَرْأَةُ، فَشُؤْمُهَا سُوءُ خُلُقِهَا وَعُقْرُ رَحِمَهَا، وَأَمَّا شُؤْمُ الْفَرَسِ، فَأَنْ يَكُونَ جَمُوحًا»

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এই হাদীস দু'টি সিহাহ সিত্তাহর (বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, আবূ দাউদ, নাসাঈ ও ইবন মাজাহ) বিভিন্ন স্থানে বর্ণিত রয়েছে। এরদ্বারা অশুভ বা অমঙ্গলের বিষয়টি ব্যাখ্যার অবকাশ ও সুযোগ রয়েছে। কেননা এ সম্পর্কে বাক্যের পার্থক্যসহ কয়েকটি বর্ণনা রয়েছে এবং উলামায়ে কিরামেরও এ সম্পর্কে মতপার্থক্য রয়েছে। কোন কোন বর্ণনায় স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, ঘর, ঘোড়া ও নারী এ তিন বস্তুর মধ্যে অশুভ ও অমঙ্গল রয়েছে। যেমন ইমাম আবূ হানীফা (র) বর্ণিত প্রথম হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে। কোন কোন হাদীসে তা শর্তের সাথে যুক্ত। যেমন দ্বিতীয় হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে। এ হাদীসের ব্যাখ্যায়ও উলামায়ে কিরামের মতপার্থক্য রয়েছে।
এ হাদীসে نحوست বা অমঙ্গলের প্রমাণ রয়েছে। যেমন কোন বস্তুর মধ্যে অমঙ্গল বা অশুভ নেই কিন্তু এই তিনিটির মধ্যে ছাড়া। আবার কারো মতে এ হাদীসের অমঙ্গলের (نحوست) প্রমাণ নেই। তাদের মত হলো এটা ধারণা বা অনুমানের সাথে যুক্ত। যদি অমঙ্গল হতো, তা হলে এ তিন বস্তুর মধ্যেই হতো। সেহেতু অশুভ বা অমঙ্গল বলতে কিছু নেই। তাই এগুলোর মধ্যে অমঙ্গল ও অশুভতা নেই। এটা সম্পর্কে যেমন বলা হয়েছে। لو كان شئى سابق القدر لسبقته اتلعين "যদি কোন বস্তু তকদীর ও ভাগ্য থেকে অগ্রগামী হতো, তা হলে বদনজর এর উপর অগ্রগামী হতো।” (কিন্তু যেহেতু কোন বস্তু তাকদীর থেকে অগ্রগামী হতে পারে না, তাই বদনজর ও অগ্রগামী হতে পারবে না)।
ইমাম আরাবী (র) স্বীয় তাফসীর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, যদি আল্লাহ তাআলা কোন বস্তুর মধ্যে অশুভ বা অমঙ্গল সৃষ্টি করতেন তা হলে এ সমস্ত বস্তুর মধ্যে করতেন। ইমাম মাযেরী (র) এর ব্যাখ্যায় বলেছেন, যদি অশুভ বা অমঙ্গল যথার্থ হতো, তাহলে এ সমস্ত বস্তু এবং এগুলোর দৃষ্টিকোণ থেকে এর অধিকতর দাবিদার বা অধিকারী ছিল। কেননা এগুলো সম্পর্কে অন্তরে অমঙ্গলের ধারণা সৃষ্টি হয়ে থাকে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ অর্থবোধক দুটি বর্ণনার ব্যাখ্যা ঐ হাদীসের দ্বারা হতে পারে যাতে نحوست বা অমঙ্গলের প্রমাণ রয়েছে। যেমন উপর বর্ণিত প্রথম হাদীসে অথবা মুসলিম শরীফে বর্ণিত إنما الشؤم في الثلاثة (তিনটি বস্তুর মধ্যে অমঙ্গল বিদ্যমান) এবং বুখারী শরীফের বিবাহ অধ্যায়ে হযরত আবদুল্লাহ ইবন উমর (রা) থেকে বর্ণিত الشؤم في الدار والمرأة والفرس (গৃহ, নারী ও ঘোড়ার মধ্যে অমঙ্গল রয়েছে) হাদীসের দ্বারা বিষয়টি প্রমাণিত হয়।

অতঃপর نحوست বা অমঙ্গলের অর্থ কি, এ বিষয়েও মতপার্থক্য রয়েছে। এর প্রকৃত ও বাহ্যিক অর্থ হলো এই যে, এ তিনটি বস্তু বরকতহীন এবং ধ্বংসের কারণ। অথবা এ তিনটি বস্তু দুঃখ-কষ্ট, দুঃশ্চিন্তা সৃষ্টি এবং পরিনাম খারাপ হওয়ার কারণ। প্রথম ধারণাটি হযরত ইমাম মালিক (র) থেকে বর্ণিত রয়েছে। আবূ দাঊদ শরীফে ইবন কাসিম (র)-এর সূত্রে হযরত ইমাম মালিক (র) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি এর ব্যাখ্যায় বলেছেন, এমন অনেক ঘর রয়েছে যেখানে মানুষ বসবাস করেছে এবং ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। অতঃপর অন্য লোক আগমণ করেছে এবং তারাও ধ্বংস হয়েছে। এরপর বলেছেন, আমাদের নিকট এর ব্যাখ্যা এটাই। তবে তিনি এটাও বলেছেন যে, نحوست বা অমঙ্গল তকদীর বা ভাগ্য দ্বারা তৈরি হয়। এটা নয় যে, তা এর বিপরীত হবে।
পক্ষান্তরে যারা বিপরীত ধারণা পোষণ করেন। তাদের সামনে অন্য বর্ণনাসমূহ রয়েছে যা অমঙ্গলের ব্যাখ্যা করে। এ ব্যাখ্যার মধ্যেও বিভিন্ন বাক্য রয়েছে। এ হাদীসে شؤم এর যে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, কারো কারো মতে তা হলো এই যে, ঘোড়ার অমঙ্গলের অর্থ এর উপর জিহাদ করা যাবে না। নারীদের অশুভ ও অমঙ্গল হলো তাদের মাহর অনেক বেশী সাব্যস্ত করা। তিবরানী নামক গ্রন্থে উম্মুল মুমিনীন হযরত আসমা (রা)-এর হাদীস বর্ণিত আছেঃ إِنَّ مِنْ شَقَاءِ الْمَرْءِ فِي الدُّنْيَا ثَلاَثَةً : سُوءَ الدَّارِ ، وَسُوءَ الْمَرْأَةِ ، وَسُوءَ الدَّابَّةِ “পৃথিবীতে মানুষের দুর্ভাগ্য ঘর, নারী এবং সওয়ারী (আরোহণের জন্তু) মন্দ হওয়া।” এরদ্বারা شؤم এর আরো অধিক স্পষ্ট ব্যাখা হলো।
হযরত ইমাম আহমদ (র) হযরত সাদ ইবন আবী ওয়াক্কাস (রা) থেকে মরফূ রেওয়ায়েত করেনঃ مـن سـادة ابن أدم المرأة الصالحة والمـسكـن الصـالـح ! والمركب الصالح ومن شقاء ابن آدم ثلثة المرأة السوء والمسكن السوء والمركب السوء
"আদম সন্তান তথা মানুষের সৌভাগ্য তিনটি বস্তুর দ্বারা প্রকাশ হয়ে থাকে। সচ্চরিত্র নারী, আরামদায়ক উপযুক্ত ঘর এবং আরামদায়ক সওয়ারী। আবার মানুষের দুর্ভাগ্য তিনটি বস্তুর মাধ্যমে প্রকাশ হয়ে থাকে। অসচ্চরিত্র নারী, প্রশান্তিময় ঘর বা বাড়ি এবং অশান্ত বা অবাধ্য সওয়ারী ।
বলা চলে দুর্ভাগ্য ও সৌভাগ্য এ সমস্ত বস্তুর ভালমন্দের মধ্যে নিহিত। যদি এ সব কিছু ভাল হয়, তবে তার ভাগ্য ভাল। সওয়ারী সর্বদা কাজে ব্যবহৃত হয়, যদি তা অক্ষম ও অবাধ্য হয় তবে তা সওয়ারী নয়, বরং এটা হয় তখন বিপদ। মোট কথা সমস্ত তাফসীরের দৃষ্টিকোণ থেকে -এর প্রয়োগ এমন সব বস্তুর উপর করা হয়েছে, যা মানুষ অপসন্দ করে থাকে এবং তা তাদের স্বভাববিরুদ্ধ। পরবর্তীতে এটা তাদের জন্য দুশ্চিন্তারও কারণ হয়ে থাকে।
ইরশাদে সারী নামক গ্রন্থে শায়খ তকীউদ্দীন আস-সুবকী (র) থেকে বর্ণনা করা হয়েছে, তিনি বলেছেন : এ সমস্ত বস্তুর সাথে نحوست বা অশুভ ও অমঙ্গলকে এভাবে সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে যে, এগুলোর পক্ষ থেকে শত্রুতা ও বিশৃংখলার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু এজন্য নয় যে, এগুলোর মধ্যে কিছু প্রভাব বা প্রতিক্রিয়া রয়েছে যা কেউ কেউ মনে করে অথবা তকদীর ও ভাগ্যে এগুলোর অধিকার রয়েছে। কোন আলিমই এর প্রবক্তা নন, বরং এ ধরনের উক্তি শুধু মূর্খতা ছাড়া আর কিছুই নয়। কেননা শরীয়ত এরূপ ব্যক্তিকে যে ভাগ্য তারকা থেকে পানি বর্ষণের বর্ণনাকারী হয়, তাকে কাফির বলে আখ্যায়িত করেছে। সুতরাং যে ব্যক্তি মহিলাদের প্রতি মন্দ বা অনিষ্টতার আরোপ করে, সে ব্যক্তিও ঐ দলের অন্তর্ভুক্ত হবে। অবশ্য এরূপ হতে পারে যে, কোন ঘটনা তকদীর ও ভাগ্যের অনুকূল হয় এবং মানুষ স্বাভাবিকভাবে এর থেকে বিমুখ হয়ে থাকে। তখন মানুষ এটা পরিত্যাগ করে থাকে। তবে এ ধারণা করে না যে, এ অনিষ্টতা এগুলো থেকে ছড়িয়ে থাকে।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
মুসনাদে আবু হানীফা রহঃ - হাদীস নং ২৬২ | মুসলিম বাংলা