শরহু মাআ’নিল আছার- ইমাম ত্বহাবী রহঃ

২১. মাকরুহ বিষয়াদির বর্ণনা

হাদীস নং: ৬৯২৫
মু'আনাকা বা কোলাকুলি করা প্রসঙ্গে
৬৯২৫। ইবন আবী দাউদ (রাহঃ) .... আয়েশা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, যায়দ ইবন হারিসা (রাযিঃ) মদীনা আগমন করলেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমার গৃহে ছিলেন। তিনি এসে দরজায় আওয়াজ দিলেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জামা ব্যতীত খালি গায়ে তাঁর দিকে উঠে গেলেন। আল্লাহর কসম! আমি তাঁকে ইতিপূর্বে এভাবে কখনও খালি গায়ে দেখিনি। অনন্তর তিনি তার সঙ্গে মু'আনাকা করলেন এবং তাকে চুমু দিলেন।

সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সাহাবাদের থেকেও (তাঁদের আমল) বর্ণিত আছে।
6925 - حَدَّثَنَا ابْنُ أَبِي دَاوُدَ، قَالَ: ثنا إِبْرَاهِيمُ بْنُ يَحْيَى بْنِ مُحَمَّدٍ الشَّجَرِيُّ، قَالَ: حَدَّثَنِي مُحَمَّدُ بْنُ يَحْيَى بْنِ عَبَّادٍ قَالَ: أَخْبَرَنِي ابْنُ إِسْحَاقَ، عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ مُسْلِمِ بْنِ شِهَابٍ الزُّهْرِيِّ، عَنْ عُرْوَةَ بْنِ الزُّبَيْرِ، عَنْ عَائِشَةَ، رَضِيَ اللهُ عَنْهَا قَالَتْ: قَدِمَ زَيْدُ بْنُ حَارِثَةَ الْمَدِينَةَ , وَرَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي بَيْتِي , فَأَتَاهُ , فَقَرَعَ الْبَابَ , فَقَامَ إِلَيْهِ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عُرْيَانًا , وَاللهِ مَا رَأَيْتُهُ عُرْيَانًا قَبْلَهُ , فَاعْتَنَقَهُ وَقَبَّلَهُ " وَقَدْ رُوِيَ فِي ذَلِكَ عَنْ أَصْحَابِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ

হাদীসের ব্যাখ্যা:

একবার হযরত যায়দ ইবন হারিছা রাযি. কোনও এক সফর থেকে মদীনায় ফিরে আসেন। তিনি ছিলেন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র। শৈশবে তাঁকে এক দস্যুদল লুণ্ঠন করে নিয়ে গিয়েছিল। তারা তাঁকে বাজারে বিক্রি করে দেয়। এক পর্যায়ে তিনি একজন দাসরূপে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহচর্যে আসেন। তিনি তাঁর আদর-যত্নে এত বেশি অনুরক্ত হয়ে উঠেছিলেন যে, তাঁর পিতা ও চাচা তাঁকে দাসত্বের জীবন থেকে মুক্ত করে নিয়ে যেতে চাইলে তিনি তাতে রাজি হননি। নিজ পিতা-মাতার উপর তিনি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন। তখনও প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুওয়াত লাভ করেননি। তিনি যায়দের সে অনুরাগ ও ত্যাগের যথাযথ মূল্যও দিয়েছিলেন। তিনি তাঁকে নিজ পুত্র বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। ফলে তাঁকে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পুত্র বলে পরিচয় দেওয়া হত। পরে আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে অন্যের পুত্রকে নিজ পুত্র বলে পরিচয় দিতে নিষেধ করে দেওয়া হয়। তখন থেকে তিনি ফের নিজ পিতা হারিছার নামেই পরিচয় দিতে থাকেন। তবে হযরত যায়দ রাযি.-এর প্রতি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এবং তাঁর প্রতি হযরত যায়দ রাযি.-এর মহব্বত আগের মতোই দৃঢ়বদ্ধ ছিল। বরং তা দিন দিন বৃদ্ধিই পাচ্ছিল। গভীর সে মহব্বতের পরিচয় আলোচ্য এ হাদীছের ভেতর দিয়েও ফুটে ওঠে। সফর থেকে ফিরে এসে প্রথমেই তিনি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন। তাঁর আগমনে তিনিও আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন। তাঁর অভ্যাস ছিল অতিথি আসলে পূর্ণ পোশাকে সাক্ষাৎ করা। অর্থাৎ লুঙ্গি ও চাদর উভয়ই পরিধান করে সামনে আসতেন। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম হল। লুঙ্গি পরা অবস্থায়ই তিনি দরজার দিকে এগিয়ে আসলেন। গায়ে চাদর জড়ানোর মতো দেরিটুকুও করলেন না। খালিগায়ে চাদর হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে চললেন। দরজা খুলেই পরম প্রিয়পাত্রকে জড়িয়ে ধরলেন। তাঁর সঙ্গে মু'আনাকা করলেন এবং তাঁকে চুম্বন করলেন।

বোঝা গেল কেউ যখন সফর থেকে ফিরে আসে বা যখন কোনও প্রিয়পাত্রের সঙ্গে দেখা হয়, তখন তার সঙ্গে মু'আনাকাও করা যেতে পারে। এটা মুস্তাহাব। মু'আনাকা (معانقة) শব্দটির উৎপত্তি عنق থেকে। عنق অর্থ গর্দান। মু'আনাকা মূলত একজনের গর্দানের সঙ্গে আরেকজনের গর্দান মেলানোর দ্বারা হয়। কেউ কেউ বুকের ডান পাশও মিলিয়ে থাকে। আবার কেউ সম্পূর্ণ বুক দিয়ে জড়িয়েও ধরে। সর্বাবস্থায় তা মু'আনাকা বলেই গণ্য হবে। এটা মহব্বত ও ভালোবাসার প্রকাশ।

হাদীছটি দ্বারা প্রমাণ হয়, প্রিয়জনের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে চুম্বন করাও জায়েয। এটা হাতে, কপালে বা গালে হতে পারে। ছেলেমেয়ে পিতা-মাতাকে, পিতা-মাতা তার ছেলেমেয়েকে চুম্বন করার দ্বারা মহব্বত ও স্নেহ-মমতার প্রকাশ করলে শরী'আতে তাতে কোনও বাধা নেই। বরং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও এটা করতেন। বিভিন্ন বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, তিনি নিজ কন্যাদের ও নাতি-নাতনীদের চুম্বন করতেন। সাহাবায়ে কেরামের মধ্যেও এর রেওয়াজ ছিল। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. একবার জ্বরে ভুগছিলেন। হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি. তাঁকে দেখতে এসে তাঁর গালে চুম্বন করেন এবং বলেন, মা'গো তুমি কেমন আছ? (সহীহ বুখারী: ৩৯১৮; সুনানে আবু দাউদ: ৫২২২)

পিতা-মাতা যেমন ছেলেমেয়েকে আদর করে চুমু খেতে পারে, তেমনি ছেলেমেয়েও পিতা-মাতাকে চুম্বন করতে পারে। হযরত ফাতিমা রাযি. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে চুম্বন করতেন। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রাযি. বর্ণনা করেন-
مَا رَأَيْتُ أَحَدًا كَانَ أَشْبَهَ حَدِيثًا وَكَلَامًا بِرَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنْ فَاطِمَةَ. وَكَانَتْ إِذَا دَخَلَتْ عَلَيْهِ قَامَ إِلَيْهَا فَرَحَّبَ بِهَا وَقَبَّلَهَا وَأَجْلَسَهَا فِي مَجْلِسِهِ وَكَانَ إِذَا دَخَلَ عَلَيْهَا قَامَتْ إِلَيْهِ فَأَخَذَتْ بِيَدِهِ فرحبت وَقَبَّلَتْهُ وَأَجْلَسَتْهُ فِي مَجْلِسِهَا فَدَخَلَتْ عَلَيْهِ فِي مرضه الذي توفي فرحب بها وقبلها
'আমি কথাবার্তায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে ফাতিমার চেয়ে বেশি সাদৃশ্যপূর্ণ আর কাউকে দেখিনি। ফাতিমা যখন তাঁর কাছে আসতেন, তিনি উঠে তার দিকে এগিয়ে যেতেন, তাকে স্বাগত জানাতেন, তাকে চুম্বন করতেন এবং তাঁকে নিজের জায়গায় বসাতেন। অনুরূপ তিনিও যখন ফাতিমার কাছে যেতেন, তখন ফাতিমা উঠে তাঁর কাছে এগিয়ে আসতেন, তাঁর হাত ধরতেন, তাঁকে স্বাগত জানাতেন, তাঁকে চুম্বন করতেন এবং তাঁকে নিজের জায়গায় বসাতেন। তাঁর অন্তিম রোগের সময়ও ফাতিমা তার কাছে আসলে তিনি তাকে স্বাগত জানান এবং তাকে চুম্বন করেন’। (সুনানে আবু দাউদ: ৫২১৮; জামে' তিরমিযী: ৩৮৭২; বুখারী, আল আদাবুল মুফরাদ: ৯৭১; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা : ৮৩১১; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৬৯৫৩; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ৪০৮৯; হাকিম, আল মুস্তাদরাক: ৪৭৩২; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা : ১৩৫৭৮)

কোনও বুযুর্গ ও সম্মানী ব্যক্তিকেও সম্মান ও ভক্তিমূলকভাবে চুম্বন করা যায়।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. প্রিয় ব্যক্তির আগমন হলে আনন্দের সঙ্গে তাকে অভ্যর্থনা জানানো চাই।

খ. দরজায় টোকা দিয়ে নিজ উপস্থিতি সম্পর্কে অবগত করা যেতে পারে।

গ. প্রিয় ব্যক্তিকে অভ্যর্থনা জানানোর সময় মু'আনাকা ও চুম্বন করা জায়েয।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
ত্বহাবী শরীফ - হাদীস নং ৬৯২৫ | মুসলিম বাংলা