শরহু মাআ’নিল আছার- ইমাম ত্বহাবী রহঃ

৩. জানাযা-কাফন-দাফনের অধ্যায়

হাদীস নং: ২৭৬৪
জানাযার সাথে কোন দিক হয়ে চলা
২৭৬৪। ইব্‌ন আবী মারইয়াম (রাহঃ).... মুজাহিদ (রাহঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, আমি আব্দুল্লাহ ইব্‌ন উমর (রাযিঃ)-এর সাথে বসা ছিলাম। (এমন সময়) একটি জানাযা অতিক্রম করছিল; এতে ইব্‌ন উমর (রাযিঃ) দাঁড়িয়ে গেলেন। এরপর তিনি (আমাকে) বললেন, দাঁড়াও! যেহেতু আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে তাঁর কাছ দিয়ে অতিক্রমকারী এক ইয়াহুদী জানাযার জন্য উঠে দাঁড়াতে দেখেছি। তাঁকে বলা হল আপনি কি এর অনুসরণ করার ইচ্ছা রাখেন? জানাযার অনুসরণে তো ছওয়াব রয়েছে। তাই আমরা জানাযার সাথে চলতে লাগলাম। তারপর তিনি তাকিয়ে কিছু সংখ্যক লোকদের দেখতে পেলেন এবং বললেনঃ জানাযার সম্মুখে এরা কারা? আমি বললাম, তারা জানাযার পরিজন। তিনি বললেনঃ জানাযার সাথে তাদের কি? বরং তারা এর প্রান্তে (ডানে-বামে) অথবা পিছনে চলবে। তিনি চালছিলেন, হঠাৎ তিনি এক চিৎকার করে ক্রন্দনকারিণী আওয়াজ শুনতে পেয়ে আমাকে পিছনের দিকে ঘুরিয়ে দিলেন এবং আমার হাত ধারণপূর্বক উক্ত ক্রনদনকারিণী স্ত্রীলোকটির সম্মুখে গিয়ে তাকে সম্বোধন করে দোষারোপ করলেন এবং বললেন, তুমি আমাদের এই জানাযার (ছাওয়াব থেকে) বঞ্চিত করে দিয়েছ। হে মুজাহিদ! যাও, তুমি নিশ্চই ছওয়াব চাচ্ছ, আর এই মহিলাটি চাচ্ছে গুনাহ (পাপ)। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদেরকে যে জানাযার সাথে চিৎকার করে ক্রন্দনকারী থাকে তা অনুসরণ করতে নিষেধ করেছেন।

প্রশ্নঃ যদি কোন প্রশ্নকারী প্রশ্ন উত্থাপন করে বলেন যে, জানাযার অগ্রভাগে চলা অপেক্ষা পিছনে চলা কিভাবে উত্তম হতে পারে? অথচ উমার ইব্‌নুল খাত্তাব (রাযিঃ) নবী করীম রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাহাবীগণের উপস্থিতিতে যায়নাব (রাযিঃ)-এর জানাযায় লোকদের এর সম্মুখে অগ্রসর করে দিচ্ছিলেন। এতে প্রমাণিত হয় যে, তিনি এর পিছনে চলাকে মোটেও জায়েজ মনে করতেন না। তা না হলে অবশ্যই তিনি তা সেই ব্যক্তির জন্য বৈধ করতেন যে ব্যক্তি জানাযার পিছনে চলে।

উত্তরঃ উত্তরে তাঁকে বলা হবেঃ আপনি যা উল্লেখ করেছেন তা কিভাবে সম্ভব? অথচ আলী ইব্‌ন আবী তালিব (রাযিঃ) বলেছেনঃ তাঁরা অর্থাৎ আবু বকর (রাযিঃ) ও উমর (রাযিঃ) জানেন যে, জানাযার আগে আগে চলা অপেক্ষা এর পিছনে চলা উত্তম। তারপর তিনি (উমর রা) এই বিষয়টি করেছেন, যা আপনি উল্লেখ করেছেন।
কিন্তু আমাদের মতে তিনি তা করেছেন (আল্লাহ্‌ই ভাল জানেন) বিশেষ কারণে, যেহেতু এর পিছনে স্ত্রীলোকগণ ছিলো, এই জন্য তিনি পুরুষদের জন্য মহিলাদের সাথে মিশে যাওয়াকে খারাপ মনে করেছেন। অতএব উক্ত কারণে তিনি তাদেরকে জানাযার সম্মুখভাগে চলার নির্দেশ দিয়েছেন। এজন্য নির্দেশ দেননি যে, তা (আগে চলে) পিছনে চলা অপেক্ষা উত্তম। আমি ইউনুস (রাহঃ) কে ইব্‌ন ওয়াহব (রাহঃ) থেকে উল্লেখ করেতে শুনেছি, তিনি শুনেছেন সেই ব্যক্তি থেকে যিনি এরূপ বলেছেন। আর যে অর্থ এই হাদীসের ব্যাখ্যা করা হয়েছে এটি-ই উত্তম। যাতে আলী (রাযিঃ), আবু বকর (রাযিঃ) ও উমর (রাযিঃ) থেকে যা উল্লেখ করেছেন তার সাথে সাংঘর্ষিক না হয়।
2764 - حَدَّثَنَا ابْنُ أَبِي مَرْيَمَ، قَالَ: ثنا الْفِرْيَابِيُّ، قَالَ: ثنا إِسْرَائِيلُ، قَالَ: ثنا أَبُو يَحْيَى، عَنْ مُجَاهِدٍ، قَالَ: " كُنْتُ مَعَ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا جَالِسًا , فَمَرَّتْ جِنَازَةٌ , فَقَامَ ابْنُ عُمَرَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا، ثُمَّ قَالَ: قُمْ , فَإِنِّي رَأَيْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَامَ لِجِنَازَةِ يَهُودِيٍّ مَرَّتْ عَلَيْهِ. فَقِيلَ: هَلْ لَكَ أَنْ تَتْبَعَهَا , فَإِنَّ فِي اتِّبَاعِ الْجِنَازَةِ أَجْرًا؟ فَانْطَلَقْنَا نَمْشِي مَعَهَا , فَنَظَرَ فَرَأَى نَاسًا , فَقَالَ: مَا أُولَئِكَ الَّذِينَ بَيْنَ يَدَيِ الْجِنَازَةِ؟ قُلْتُ: هُمْ أَهْلُ الْجِنَازَةِ , فَقَالَ: مَا هُمْ مَعَ الْجِنَازَةِ , وَلَكِنْ كَتِفَيْهَا أَوْ وَرَاءَهَا. فَبَيْنَمَا هُوَ يَمْشِي إِذْ سَمِعَ رَانَّةً , فَاسْتَدَارَنِي وَهُوَ قَابِضٌ عَلَى يَدِي فَاسْتَقْبَلَهَا , فَقَالَ لَهَا شَرًّا , حَرَمْتِينَا هَذِهِ الْجِنَازَةَ اذْهَبْ يَا مُجَاهِدُ , فَإِنَّكَ تُرِيدُ الْأَجْرَ , وَهَذِهِ تُرِيدُ الْوِزْرَ , إِنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نَهَانَا أَنْ نَتْبَعَ الْجِنَازَةَ مَعَهَا رَانَّةٌ " فَإِنْ قَالَ قَائِلٌ: وَكَيْفَ يَجُوزُ أَنْ يَكُونَ الْمَشْيُ خَلَفَ الْجِنَازَةِ أَفْضَلَ مِنَ الْمَشْيِ أَمَامَهَا؟ وَقَدْ كَانَ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ بِحَضْرَةِ أَصْحَابِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي جِنَازَةِ زَيْنَبَ , يُقَدِّمَ النَّاسَ أَمَامَهَا فَذَلِكَ دَلِيلٌ عَلَى أَنَّهُ كَانَ لَا يَرَى الْمَشْيَ خَلْفَهَا أَصْلًا , وَلَوْلَا ذَلِكَ لَأَبَاحَهُ لِمَنْ مَشَى خَلْفَهَا. قِيلَ لَهُ: وَكَيْفَ يَجُوزُ مَا ذَكَرْتُ؟ . وَقَدْ قَالَ عَلِيُّ بْنُ أَبِي طَالِبٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ: إِنَّهُمَا، يُرِيدُ أَبَا بَكْرٍ وَعُمَرَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا، يَعْلَمَانِ أَنَّ الْمَشْيَ خَلْفَهَا أَفْضَلُ مِنَ الْمَشْيِ أَمَامَهَا , ثُمَّ يَفْعَلُ هَذَا الْمَعْنَى الَّذِي ذَكَرْتُ؟ [ص:485] وَلَكِنَّهُ فَعَلَ ذَلِكَ، عِنْدَنَا وَاللهُ أَعْلَمُ، لِعَارِضٍ , إِمَّا لِنِسَاءٍ كُنَّ خَلْفَهَا , فَكَرِهَ لِلرِّجَالِ مُخَالَطَتَهُنَّ , فَأَمَرَهُمْ بِتَقَدُّمِ الْجِنَازَةِ لِذَلِكَ الْعَارِضِ لَا لِأَنَّهُ أَفْضَلُ مِنَ الْمَشْيِ خَلْفَهَا. وَقَدْ سَمِعْتُ يُونُسُ يَذْكُرُ عَنِ ابْنِ وَهْبٍ أَنَّهُ سَمِعَ مَنْ يَقُولُ ذَلِكَ , وَهُوَ أَوْلَى مَا حُمِلَ عَلَيْهِ مَعْنَى ذَلِكَ الْحَدِيثِ , حَتَّى لَا يُضَادَّ مَا ذَكَرَهُ عَلِيٌّ عَنْ أَبِي بَكْرٍ وَعُمَرَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا

হাদীসের ব্যাখ্যা:

জানাযায় অংশগ্রহণ করা।
সমস্ত মুসলিম ভাই-ভাই। বরং সব মুসলিম মিলে একদেহতুল্য। কাজেই কোনও মুসলিমের মৃত্যু হওয়া যেন কারও দেহের একটি অঙ্গ ছিন্ন হওয়া। অঙ্গের ছিন্ন হওয়া যেমন প্রত্যেকের জন্য শোকের বিষয়, তেমনি কোনও মুসলিম ভাইয়ের মৃত্যুতেও শোক ও দুঃখ বোধ করা ইসলামী ভ্রাতৃত্বের দাবি। সবচে' বড় কথা যার মৃত্যু হল সে এতদিন দুনিয়ায় আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে মিলেমিশে ছিল। এখন সে একা হয়ে গেছে। কারও পক্ষে এখন তার পাশে দাঁড়ানো সম্ভবই নয়। তবে কি তাকে এভাবে নিঃসঙ্গ ছেড়ে দেওয়া হবে? তার জন্য কিছুই করার সুযোগ নেই? হাঁ, সুযোগ আছে। কারও শারীরিক বা আর্থিক সাহায্যই বড় সাহায্য নয়। এরচে'ও বড় সাহায্য হল দীনী ও ঈমানী সাহায্য। যে সাহায্য কবর ও হাশরে কাজে আসে, তার মত উপকার আর হয় না। মৃত্যু দ্বারা যে ব্যক্তি একা হয়ে গেল, এখন সে সাহায্যই তার প্রয়োজন। ইসলাম আমাদেরকে সেরকম সাহায্যের পথ দেখিয়েছে। এরকম সাহায্যের সর্বপ্রধান ব্যবস্থা জানাযার নামায়। এটা কবরযাত্রীর জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশ। আল্লাহ যেন তাকে মাফ করে দেন সে দুআই জানাযায় নামাযে করা হয়ে থাকে। মুমিনগণ নামাযের রূপে তার জন্য এ দুআ করলে অবশ্যই তা কবুল হওয়ার আশা থাকে। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. বর্ণিত এক হাদীছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- ما من ميت تصلي عليه أمة من المسلمين يبلغون مائة، كلهم يشفعون له، إلا شفعوا فيه “একশ সংখ্যক মুসলিমের একটি দল যে মায়্যিতের জানাযার নামায আদায় করে এবং তারা তার জন্য সুপারিশ করে, তার জন্য তাদের সুপারিশ অবশ্যই কবুল হয়।
হযরত আব্দুল্লাহ ইব্ন আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- ما من رجل مسلم يموت، فيقوم على جنازته أربعون رجلا، لا يشركون بالله شيئا، إلا شفعهم الله فيه “কোনও মুসলিম ব্যক্তি যদি মারা যায়, তারপর আল্লাহর সঙ্গে কোনওকিছুকে শরীক করে না এমন চল্লিশ জন লোক তার জানাযা পড়ে, তবে আল্লাহ তাআলা তার পক্ষে তাদের সুপারিশ অবশ্যই কবুল করেন।
জীবিতদের যে আমল দ্বারা মৃত ব্যক্তির এত বড় উপকার হয়, অত্যন্ত আগ্রহ উদ্দীপনার সঙ্গেই তাতে শরীক হওয়া চাই। এর ফযীলতও অনেক। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- من شهد الجنازة حتى يصلي فله قيراط، ومن شهد حتى تدفن كان له قيراطان، قيل : وما القيراطان؟ قال: مثل الجبلين العظيمين “যে ব্যক্তি মায়্যিতের সাথে তার জানাযার নামায আদায় করা পর্যন্ত হাজির থাকে,সে এক কীরাত ছাওয়াব লাভ করে। আর যে ব্যক্তি তাকে দাফন করা পর্যন্ত হাজির থাকে, সে দুই কীরাত ছাওয়াব লাভ করে। জিজ্ঞেস করা হল, দুই কীরাত কী? তিনি বললেন, দুটি বড় বড় পাহাড়ের সমান।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. জানাযায় অংশগ্রহণ করা একটি অবশ্যপালনীয় আমল এবং এটা মৃতব্যক্তি ও তার পরিবারবর্গের হক।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
ত্বহাবী শরীফ - হাদীস নং ২৭৬৪ | মুসলিম বাংলা