আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
৫১- কুরআনের তাফসীর অধ্যায়
হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৪৭৭৭
২৪৮৮. আল্লাহ তাআলার বাণীঃ "নিশ্চয়ই আল্লাহ, তারই কাছে রয়েছে কিয়ামতের জ্ঞান (অর্থাৎ কখন কিয়ামত সংঘটিত হবে)।
৪৪১৯। ইসহাক (রাহঃ) ......... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, একদিন রাসূল (ﷺ) লোকদের সাথে বসেছিলেন। এক ব্যক্তি তাঁর নিকট এসে জিজ্ঞাসা করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! ঈমান কী? তিনি বললেন, “আল্লাহতে ঈমান আনবে এবং তাঁর ফিরিশতাগণ, তাঁর নবী ও রাসূলগণের প্রতি ঈমান আনবে এবং (কিয়ামতে) আল্লাহর দর্শন লাভ ও পুনরুত্থানের ওপর ঈমান আনবে।” লোকটি জিজ্ঞাসা করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! ইসলাম কী? তিনি বললেন, ইসলাম (হল) আল্লাহর ইবাদত করবে ও তার সঙ্গে অন্য কাউকে শরীক সাব্যস্ত করবে না এবং নামায কায়েম করবে, ফরয যাকাত দিবে ও রমযানের রোযা পালন করবে। লোকটি জিজ্ঞাসা করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! ইহ্সান কী? তিনি বললেন, ইহ্সান হচ্ছে আল্লাহর ইবাদত এমন একাগ্রতার সাথে করবে, যেন তুমি তাঁকে দেখছ। আর যদি তুমি তাঁকে দেখতে না পাও, তবে (মনে করবে) আল্লাহ্ তোমাকে দেখছেন।
লোকটি আরও জিজ্ঞাসা করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কখন কিয়ামত সংঘটিত হবে? রাসূল (ﷺ) বললেন, এ বিষয়ে প্রশ্নকারীর চাইতে যাকে প্রশ্ন করা হয়েছে, সে বেশী জানে না। তবে আমি তোমার কাছে এর (কিয়ামতের) কতগুলো লক্ষণ বলছি। তা হল, যখন দাসী তার মনিবকে প্রসব করবে, এটা তার (কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার) একটি নিদর্শন। আর যখন দেখবে, নগ্নপদ ও নগ্নদেহ লোকেরা মানুষের নেতা হবে, এও তার একটি লক্ষণ। এটি ঐ পাঁচটি বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত, যা আল্লাহ্ ছাড়া আর কেউ জানেন নাঃ
(১) ‘কিয়ামতের জ্ঞান কেবল আল্লাহর নিকটই রয়েছে। (২) তিনিই বৃষ্টি বর্ষণ করেন, (৩) তাঁরই জ্ঞানে রয়েছে, মাতৃগর্ভে কি আছে। এরপরে সে লোকটি চলে গেল। রাসূল (ﷺ) বললেন, তাকে আমার নিকট ফিরিয়ে আন। সাহাবাগণ তাঁকে ফিরিয়ে আনতে গেলেন, কিন্তু কিছুই দেখতে পাননি। রাসূল (ﷺ) বললেন, তিনি জিবরাঈল, লোকদের তাদের দ্বীন শিক্ষা দেয়ার জন্য এসেছিলেন।
লোকটি আরও জিজ্ঞাসা করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কখন কিয়ামত সংঘটিত হবে? রাসূল (ﷺ) বললেন, এ বিষয়ে প্রশ্নকারীর চাইতে যাকে প্রশ্ন করা হয়েছে, সে বেশী জানে না। তবে আমি তোমার কাছে এর (কিয়ামতের) কতগুলো লক্ষণ বলছি। তা হল, যখন দাসী তার মনিবকে প্রসব করবে, এটা তার (কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার) একটি নিদর্শন। আর যখন দেখবে, নগ্নপদ ও নগ্নদেহ লোকেরা মানুষের নেতা হবে, এও তার একটি লক্ষণ। এটি ঐ পাঁচটি বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত, যা আল্লাহ্ ছাড়া আর কেউ জানেন নাঃ
(১) ‘কিয়ামতের জ্ঞান কেবল আল্লাহর নিকটই রয়েছে। (২) তিনিই বৃষ্টি বর্ষণ করেন, (৩) তাঁরই জ্ঞানে রয়েছে, মাতৃগর্ভে কি আছে। এরপরে সে লোকটি চলে গেল। রাসূল (ﷺ) বললেন, তাকে আমার নিকট ফিরিয়ে আন। সাহাবাগণ তাঁকে ফিরিয়ে আনতে গেলেন, কিন্তু কিছুই দেখতে পাননি। রাসূল (ﷺ) বললেন, তিনি জিবরাঈল, লোকদের তাদের দ্বীন শিক্ষা দেয়ার জন্য এসেছিলেন।
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক হাদীছ। এর ভেতর রয়েছে সমগ্র দ্বীনের ব্যাখ্যা। ঈমান, ইসলাম ও ইহসান- এ তিনটি দ্বীনের প্রধান শাখা। এ হাদীছে এ শাখা তিনটির ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়েছে। বান্দার যাবতীয় প্রকাশ্য ও গুপ্ত আমল এর মধ্যে এসে গেছে। অন্তরের আমল ‘আকীদা-বিশ্বাস ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আমল 'ইবাদত-বন্দেগী সবই এ তিনটির অন্তর্ভুক্ত। নিয়ত ও উদ্দেশ্যকে সহীহ-শুদ্ধ করা এবং আখলাক-চরিত্র পরিশুদ্ধ করাও এর আওতাভুক্ত। সমস্ত আমলকে রিয়া ও লোকদেখানোর মানসিকতা থেকে মুক্ত রাখা এবং যাবতীয় পাপাচার থেকে আত্মরক্ষার বিষয়টাও এর অন্তর্ভুক্ত। শরী'আতের যাবতীয় 'ইলম এরই সাথে সম্পৃক্ত। ইমাম কুরতুবী রহ. বলেন, এ হাদীছটি ‘উম্মুস-সুন্নাহ' (সমস্ত হাদীছ ও সুন্নাহ’র মূল) নামে অভিহিত হওয়ার উপযুক্ত, যেহেতু হাদীছ ও সুন্নাহ সম্পর্কিত সমগ্র ইলমের সারসংক্ষেপ এর মধ্যে এসে গেছে। বলা যায় এটা সমগ্র দীনেরই সারসংক্ষেপ।
এ হাদীছে দ্বীনের ব্যাখ্যা দান করা হয়েছে প্রশ্নোত্তরের পন্থায়। হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্ন করেছেন এবং তিনি তার উত্তর দিয়েছেন। শেষে আছে, তিনি আগমন করেছিলেন সাহাবায়ে কিরামকে দীনের শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে। এর দ্বারা তাঁর সে উদ্দেশ্য পুরোপুরি সফল হয়েছে। তাই এ হাদীছটি ‘হাদীছে জিবরীল' নামে পরিচিত।
হযরত জিবরীল আলাইহিস সালামের আগমনের কারণ
সাহাবায়ে কিরাম নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দ্বীনের বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞেস করতেন। তিনিও তাঁদের শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে সে সকল প্রশ্নের উত্তর দিতেন। তাঁর সঙ্গে সাহাবায়ে কিরামের ছিল অত্যন্ত গভীর হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক। কোনও বিষয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করতে তাদের কুণ্ঠাবোধ হত না। এ কারণে কমনও কখনও তাদের পক্ষ থেকে এমন প্রশ্নও এসে যেত, যা জানার বিশেষ প্রয়োজন নেই। কিংবা দ্বীনের সংগে তার বিশেষ সম্পর্ক নেই। অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন অনেক সময় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। একপর্যায়ে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের অপ্রাসঙ্গিক কোনও প্রশ্নের কারণে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন এবং তাদেরকে প্রশ্ন করতে নিষেধ করে দেন। কুরআন মাজীদেরও আয়াত নাযিল হয়
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَسْأَلُوا عَنْ أَشْيَاءَ إِنْ تُبْدَ لَكُمْ تَسُؤْكُمْ
"হে মুমিনগণ! তোমরা এমন সব বিষয়ে প্রশ্ন করো না, যা প্রকাশ করা হলে। তোমাদের কাছে অপ্রীতিকর মনে হবে।”
সুতরাং সাহাবায়ে কিরাম প্রশ্ন করা একেবারেই ছেড়ে দিলেন। এতে তাদের অনেক সমস্যায় পড়তে হল। কেননা অনেক সময় এমন জরুরি বিষয়ও দেখা দেয়, যে সম্পর্কে জিজ্ঞেস না করলে তার সমাধান সম্ভব হয় না। একদিকে জিজ্ঞেস করলে অনুচিত বিষয়ে প্রশ্ন হয়ে যাওয়ার আশংকা, অন্যদিকে জিজ্ঞেস না করলে সমস্যার সমাধান না হওয়ার বিড়ম্বনা। তাঁরা এ উভয় সংকটের মধ্যে পড়ে গেলেন। এ জটিলতা নিরসনের লক্ষ্যে আল্লাহ তা'আলা হযরত জিবরীল আলাইহিস সালামকে পাঠালেন। তিনি এসে দ্বীনের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করে সাহাবায়ে কিরামের দীন শিক্ষার ব্যবস্থা করে দিলেন। সেইসংগে এর মাধ্যমে তাঁরা এই শিক্ষাও পেয়ে গেলেন যে, নবীকে দীন সম্পর্কে কী ধরনের প্রশ্ন করা উচিত এবং কী ধরনের প্রশ্ন করা উচিত না।
হযরত জিবরীল আলাইহিস সালামের অবাক করা যত আচরণ
হযরত জিবরীল আলাইহিস সালামের বেশভূষা, আচরণ ও কথাবার্তা ছিল অবাক করার মত। তিনি এসেছিলেন পরিপাটি বেশভূষায়। ধবধবে সাদা পোশাক, কালো পরিপাটি মাথার চুল। দেখলে মনে হয় খুব কাছাকাছি দূরত্ব থেকে কেতাদুরস্ত হয়ে আসা কোনও ভদ্রলোক। কাছের কোনও বাসিন্দা হলে সকলের চেনার কথা। কিন্তু কেউ তাঁকে চিনতে পারছে না, এ আগুন্তুক কে। সেই হিসেবে ধরে নিতে হয় ইনি দূরবর্তী কোনও এলাকার বাসিন্দা। কিন্তু তাই যদি হয়, তবে তো সফরের চিহ্ন থাকার কথা। পোশাক হবে ধুলোমলিন, মাথার চুল হবে ধূসর আলুথালু। কিন্তু সেরকম সফরের কোনও চিহ্ন তো তাঁর মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। তার অর্থ দাঁড়ায় তিনি দূর থেকে আসেননি। দূরেরও মন কাছেরও নন, এ কেমন অবাক ব্যাপার। যাহোক মজলিসে প্রবেশের পর তিনি আস্তে আস্তে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকটে এগিয়ে আসলেন। কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, তিনি জিজ্ঞেস করলেন, হে মুহাম্মাদ! কাছে আসব? তিনি বললেন, কাছে আসুন। তিনি কাছে এসে বসলেন। নিজ হাঁটু তাঁর হাঁটুর সাথে মিলিয়ে দিলেন এবং দু'হাত তাঁর উরুর উপর রাখলেন।
মুহাম্মাদ বলে সম্বোধন করা সাহাবায়ে কিরামের অভ্যাস ছিল না। এটা আদবের পরিপন্থী। তাঁরা তাঁকে রাসূলুল্লাহ বা নাবিয়্যুল্লাহ বলে সম্বোধন করতেন। কিন্তু এ আগুন্তক তাঁর নাম নিয়েই সম্বোধন করছে। তাদের পক্ষে এটাও হতচকিত করার মত ব্যাপার। তারপর আবার নিজের হাঁটু তাঁর হাঁটুর সংগে মিলিয়ে রাখছেন। এও এক অদ্ভুত আচরণ! বড়র সংগে ছোটর বিশেষত নবীর সংগে এ জাতীয় আচরণ কোনও আদবকেতার আওতায় পড়ে না। তারপর নিজের হাত তাঁর উরুর উপর রাখলেন। কার উরুর উপর? কোনও বর্ণনায় আছে নিজ ঊরুর উপর। আবার কোনও বর্ণনায় স্পষ্ট বলা হয়েছে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের উরুর উপর। হয়তো প্রথমে নিজ উরুর উপর রেখেছিলেন, পরে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের উরুর উপর রাখেন। এটা আরও বেশি অদ্ভুত আচরণ! নবী-রাসূলের সংগে উম্মতের কোনও সদস্যের এ জাতীয় আচরণ কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কিন্তু এ আগুম্ভক এ সবই করলেন।
আরও অবাক করার মত বিষয় হল নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিটি উত্তরের পর তিনি মন্তব্য করছেন- আপনি সঠিক বলেছেন। কী আশ্চর্য! একদিকে জিজ্ঞেস করছেন। তার মানে যে বিষয়ে জিজ্ঞেস করছেন সে বিষয়ে তিনি অজ্ঞ। তাঁর তা জানা নেই। আবার উত্তর পাওয়ার পর বলছেন, আপনি সঠিক বলছেন। তার মানে সে বিষয়ে তাঁর জানা আছে। জানা আছে বলেই উত্তর সঠিক হয়েছে কি না বুঝতে পারছেন। তা যদি জানাই থাকে, তবে জিজ্ঞেস করবেন কেন? আর যদি জানা না থাকে, তবে সঠিক হয়েছে বলে মন্তব্য করবেন কেন? এ দুইয়ের মধ্যে কোনও সংগতি নেই। এ অসংগতিও সাহাবায়ে কিরামকে অবাক করেছে। কোনও কোনও রিওয়ায়েতে আছে, তারা বলে উঠেছেন- দেখ, সে জিজ্ঞেসও করছে আবার সঠিক বলে মন্তব্যও করছে। যেন সে তাঁরচে' বেশি জানে! অন্য বর্ণনায় আছে, আমরা তার মত লোক দেখিনি। যেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শেখাচ্ছে! তাই বলছে, সঠিক বলেছেন, সঠিক বলেছেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম এসব অবাক করা কাণ্ড কেন করলেন? আসলে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল সাহাবায়ে কিরামের মনোযোগ আকর্ষণ করা। তিনি যেহেতু তাঁদেরকে দ্বীনের শিক্ষাদান করার উদ্দেশ্যে এসেছিলেন, আর সেজন্য প্রশ্নোত্তরের পন্থা বেছে নিয়েছিলেন, তাই চাচ্ছিলেন তাদেরকে কৌতূহলী করে তুলে প্রশ্নকারী ও উত্তরদাতা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি পুরোপুরি মনোযোগী করে রাখতে। চোখ-কান, দেহ-মন, চিন্তা ও ধ্যান সবদিক থেকে ভালে তাঁদের প্রতি অভিনিবিষ্ট ও একপ্রচিত্ত করে রাখতে। সেজন্যই তিনি এসব অবা করেছেন। বলা বাহুল্য তাঁর সে উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল। সাহাবায়ে কিরাম পূর্ণ সাথে হযরত জিবরীল আলাইহিস সালামের প্রশ্ন ও নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের উত্তর শুনেছেন এবং দীনের সুস্পষ্ট শিক্ষা অর্জন করেছেন।
হযরত জিবরীল আলাইহিস সালামের প্রথম প্রশ্ন ও তার উত্তর
হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম প্রথম প্রশ্ন করলেন ইসলাম সম্পর্কে ইসলাম কী? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ইসলাম এই যে, তুমি সা দেবে আল্লাহ ছাড়া কোনও মাবুদ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসুল। আর নামায কায়েম করবে, যাকাত দেবে, রমযানের রোযা রাখবে এবং বায়তুল্লাহ য় যাওয়ার সামর্থ্য থাকলে হজ্জ করবে। এতে তিনি ইসলামের ব্যাখ্যা করেছেন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বাহ্যিক কাজকর্ম দ্বারা। প্রথম হচ্ছে এই সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনও মাবুদ নেই। এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল। এটা মুখের কাজ। আর নামায কায়েম করা, যাকাত দেওয়া, রোযা রাখা ও হজ্জ করা অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কাজ। এগুলো তিনভাগে বিভক্ত। শারীরিক, যেমন নামায পড়া ও রোযা রাখা। অর্থ সম্পদ সম্পর্কিত, যেমন যাকাত দেওয়া। তৃতীয়ত শারীরিক ও আর্থিক উভয় সংক্রান্ত, যেমন হজ্জ করা।
এখানে কেবল ইসলামের মৌলিক কার্যাবলীর উল্লেখ করা হয়েছে। কুরআন ও হাদীছের বিভিন্ন স্থানে ইতিবাচক ও নেতিবাচক বহু কাজের উল্লেখ আছে। তা সবই ইসলামের শাখা-প্রশাখা। বস্তুত বাহ্যিক কার্যাবলীর সবই ইসলামের আওতাধীন। বিভিন্ন হাদীছ দ্বারাই তা প্রমাণিত, যেমন এক হাদীছে বর্ণিত হয়েছে
المسلم من سلم المسلمون من لسانه ويده
‘মুসলিম সেই ব্যক্তি, যার জিহ্বা ও হাত থেকে অন্যান্য মুসলিম নিরাপদ থাকে।
অপর এক হাদীছে আছে, এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করল, ইসলামের কোন্ আমল শ্রেষ্ঠ? তিনি বললেন «تطعم الطعام وتقرأ السلام على من عرفت ومن لم تعرف» ইসলামের শ্রেষ্ঠ আমল যে, তুমি মানুষকে অন্ন করবে এবং পরিচিত-অপরিচিত সকলকে সালাম দিবে।'
মোটকথা, কুরআন ও হাদীছে যা-কিছু করার হুকুম দেওয়া হয়েছে তা সব করা এবং যা-কিছু করতে নিষেধ করা হয়েছে সেসব থেকে বিরত থাকার দ্বারা এক ব্যক্তি পূর্ণাঙ্গ মুসলিম হতে পারে। এ হাদীছে ইসলামের কেবল মৌলিক কাজসমূহই উল্লেখ করা হয়েছে। শরীর, সম্পদ ও যৌথভাবে উভয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত ইতিবাচক ও নেতিবাচক যাবতীয় কাজই এর আওতাধীন।
জিবরীল আলাইহিস সালামের দ্বিতীয় প্রশ্ন তার উত্তর
জিবরীল আলাইহিস-সালামের দ্বিতীয় প্রশ্ন ঈমান সম্পর্কে, নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিয়েছেন, ঈমান এই যে, তুমি আল্লাহ,তাঁর ফেরেশতাগণের প্রতি, তার কিতাবসমুহ, তাঁর রাসূলগণ, শেষদিবস এবং তাকদীরের ভালো-মন্দের প্রতি বিশ্বাস রাখবে।
লক্ষ্য করা যাচ্ছে, রাসুল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈমানের ব্যাখ্যায় ৬টি বিষয় উল্লেখ করেছেন, যার প্রত্যেকটিরই সম্পর্ক বিশ্বাসের সাথে। এই ছয়টি ঈমানের প্রধানতম অঙ্গ। মু'মিন হবার জন্য এর প্রত্যেকটিতে বিশ্বাস রাখা জরুরি। এর যে-কোনও একটিত অবিশ্বাস করলে মু'মিন থাকে না। এর প্রত্যেকটিরও আবার ব্যাখ্যা আছে। কুরআন-সুন্নাহ’য় সে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।
প্রত্যেকটিতে বিশ্বাস রাখতে হবে সেই ব্যাখ্যা মোতাবেক। যেমনঃ আল্লাহ ছাড়া কোনও মাবুদ নেই, এর দ্বারা তাওহীদের বিশ্বাস বোঝানো হয়েছে। তাওহীদ মানে একথা বিশ্বাস করা,এ বিশ্ব জগতের একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন। বিশ্বজগত সৃষ্টিতে তার কোনও শরীক নেই। তাঁর কোনও শুরু ও শেষ নেই। তিনি সদা ছিলেন, সদা থাকবেন। তিনি সকলের রক্ষাকর্তা। তিনি সর্বশক্তিমান সর্বজ্ঞ। তাঁর সত্তায় কোনও শরীক নেই, তেমনি তাঁর গুণাবলীতেও কোনও অংশীদার নেই। সৃষ্টির ইষ্ট অনিষ্টের তিনি একচ্ছত্র মালিক। তিনি কারও কোনও উপকার করতে চাইলে কেউ তা রদ করতে পারে না এবং কারও ক্ষতি করতে চাইলে কেউ তা ঠেকাতে না। তো তিনি একাই যখন সমস্ত উপকার-ক্ষতির মালিক, তখন মা'বৃদও কেবল তিনি একাই হতে পারেন। 'ইবাদত কেবল তাঁর একারই করা যেতে পারে। ‘ইবাদতে অন্য শরীক করার কোনও বৈধতা নেই।
এমনিভাবে রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাসের মানে- আল্লাহ 'তাআলা মানুষের হিদায়াতের জন্য হযরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে নিয়ে হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত বহু নবী-রাসুল পাঠিয়েছেন। তাদের সকলকেই নবী হিসেবে বিশ্বাস করা জরুরি। যে যুগে যে নবী আসেন, সে যুগের মানুষের কর্তব্য তাঁর অনুসরণ ও আনুগত্য করা এবং তাঁর আনীত বা প্রচারিত শরী'আত মেনে চলা।এ ধারার সর্বশেষ নবী ও রাসুল হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম। এখন কিয়ামত পর্যন্ত সারা জাহানের সমস্ত মানুষের কর্তব্য তাঁর প্রতি ঈমান আনা ও তাঁর আনীত শরী'আতের পাবন্দী করা। রাসূলগণের প্রতি এ ব্যাখ্যার সাথেই বিশ্বাস স্থাপন জরুরি। এছাড়া তাঁদের প্রতি বিশ্বাস যথার্থ বিশ্বাস বলে গণ্য হবে না।
এভাবেই ঈমানের বাকি চারটি মূল অঙ্গের প্রতিও কুরআন ও সুন্নাহ’য় প্রদত্ত ব্যাখ্যা অনুসারে বিশ্বাস রাখা অবশ্যকর্তব্য। মনগড়া ব্যাখ্যা অনুযায়ী এর কোনও একটি অঙ্গে বিশ্বাস আনয়ন করলে তা সত্যিকারের ঈমান বলে গৃহীত হবে না।
প্রকাশ থাকে যে, এ হাদীছে যে ঈমান ও ইসলামের আলাদা আলাদা ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে তা কেবলই শাব্দিক, পারিভাষিক ও তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে, ব্যবহারিক দিক থেকে নয়। তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে ঈমান হচ্ছে অন্তরের কাজ। অর্থাৎ যে সকল বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস রাখা জরুরি, আন্তরিকভাবে তা বিশ্বাস করা ও মেনে নেওয়া। আর ইসলাম হচ্ছে আল্লাহর কাছে বান্দার আত্মসমর্পণ ও আনুগত্যস্বীকার, যা বাহ্যিক কাজের দ্বারাই সম্ভব। তাই এক রেওয়ায়েতে আছে, ইসলাম হল প্রকাশ্য বিষয় আর ঈমান অন্তরের গুপ্ত বিষয়। অর্থাৎ ইসলাম বাহ্যিক কার্যাবলীর নাম, যা প্রকাশ্যে করা হয়ে থাকে। আর ঈমান তো বিশ্বাস, তা প্রকাশ পায় না, অন্তরে গোপন থাকে।
যে সকল হাদীছে ঈমান ও ইসলাম পাশাপাশি এসেছে, যেমন এই হাদীছে জিবরীলে, তাতে ঈমান ও ইসলামের এ তাত্ত্বিক দিকই বিবেচনায় রাখা হয়েছে এবং সেই হিসেবে উভয়টির মধ্যে পার্থক্য করা হয়েছে। কিন্তু যেসব হাদীছে ঈমান ও ইসলাম আলাদা আলাদাভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, তাতে উভয়টির ব্যবহারিক দিকই বিবেচিত হয়েছে। ব্যবহারিক দিক থেকে উভয়ের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য নেই। ব্যবহারিক দিক থেকে যা ঈমান তাই ইসলাম। এবং যে ব্যক্তি মু'মিন সেই মুসলিম। কেউ যদি উপরে বর্ণিত ছয়টি বিষয়ে বিশ্বাস রাখে কিন্তু নামায না পড়ে, যাকাত না দেয় দীনের বাহ্যিক কার্যাবলী পালন না করে, তবে তাত্ত্বিক বিচারে তাকে মু'মিন বলা হবে বটে, কিন্তু ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকে সে মু'মিন নামের উপযুক্ত থাকে না। এ শ্রেণীর লোককে ফাসিক বলা হয়ে থাকে। অনুরূপ যে বাহ্যিক কার্যাবলী যথাযথভাবে আঞ্জাম দেয় কিন্তু বিশ্বাসের মধ্যে ঘাটতি রয়েছে, তাকেও তাত্ত্বিক বিচারে মুসলিম বলা হবে বটে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে মুসিলম নয়। পরিভাষায় এরূপ লোককে মুনাফিক ও যিনদীক বলা হয়ে থাকে। প্রকৃত মুসলিম হওয়ার জন্য শরী'আতের অনুসরণ তথা বাহ্যিক কার্যাবলী আঞ্জাম দেওয়ার সাথে সাথে যথার্থ ‘আকীদা-বিশ্বাসেরও অধিকারী হতে হবে।
এমনিভাবে প্রকৃত মুমিন হতে হলে আকীদা-বিশ্বাস ঠিক রাখার পাশাপাশি শরী'আতেরও অনুসরণ করতে হবে।
কুরআন-হাদীছের ব্যাপক ব্যবহারের প্রতি লক্ষ করলে উপলব্ধি করা যায়, আল্লাহ তাআলা ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে পূর্ণাঙ্গ মুসলিম ও পূর্ণাঙ্গ মুমিনই কাম্য। অর্থাৎ প্রত্যেকেই যেন বিশুদ্ধ 'আকীদা-বিশ্বাস পোষণ করার পাশাপাশি বাহ্যিক কার্যাবলী তথ্য শরী'আতেরও অনুসরণ করে। কিংবা বলুন শরী'আতের অনুসরণ করার সাথে সাথে বিশুদ্ধ ‘আকীদা-বিশ্বাসেরও অধিকারী হয়। সেজন্যই দেখা যায় । বাহ্যিক কার্যাবলীর জন্য যেমন ইসলাম শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, তেমনি কোথাও কোথাও এর জন্য ঈমান শব্দও ব্যবহৃত হয়েছে। আলোচ্য হাদীছে যে সকল বিষয়কে ইসলাম শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করা হয়েছে, 'ওয়াফদু আব্দিল কায়স' শীর্ষক হাদীছে হুবহু এ বিষয়গুলোকেই সমান বলা হয়েছে। ঈমানের শাখা-প্রশাখা বিষয়ক সুপ্রসিদ্ধ হাদীছে আছে
الإيمانُ بضعٌ وسبعون شعبةً ، أعلاها قولُ لا إله إلا اللهُ ، وأدناها إماطةُ الأذى عن الطريقِ والْحَياءُ شُعْبَةٌ مِنَ الإيمانِ.
‘ঈমানের সত্তরটিরও বেশি শাখা আছে। তার মধ্যে সর্বোচ্চ শাখা হল এই সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনও মা'বুদ নেই। আর সর্বনিম্ন শাখা রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে দেওয়া। এবং লজ্জাশীলতা ঈমানের (গুরুত্বপূর্ণ) শাখা।” “এ হাদীছেও বাহ্যিক কার্যাবলীকে ঈমান নামে অভিহিত করা হয়েছে।
একবার এক যুদ্ধে শত্রুপক্ষের একজন বলে উঠল, আমি মুসলিম। তা সত্ত্বেও তাকে জনৈক সাহাবী হত্যা করলেন। তা জানতে পেরে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত নাখোশ হলেন এবং বললেন, কোনও মু'মিন ব্যক্তিকে হত্যা করতে আল্লাহ আমাকে নিষেধ করে দিয়েছেন। এখানে দেখা যাচ্ছে, যে ব্যক্তি নিজেকে মুসলিম বলেছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে মু'মিন নামে অভিহিত করেছেন। এর আরও বহু দৃষ্টান্ত আছে। সারকথা এই যে, কুরআন-হাদীছের সাধারণ ব্যবহারে ঈমান দ্বারা পূর্ণাঙ্গ ঈমান অর্থাৎ বিশ্বাসের সাথে কর্ম এবং ইসলাম দ্বারা পূর্ণাঙ্গ ইসলাম তথা কর্মের সাথে বিশ্বাসও বোঝানো হয়। সুতরাং সাধারণ ব্যবহারে বিশ্বাস ও কর্মের সমন্বিত রূপ তথা পূর্ণাঙ্গ ইসলাম ও পূর্ণাঙ্গ ঈমানের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই।
হযরত জিবরীল আলাইহিস সালামের তৃতীয় প্রশ্ন ও তার উত্তর
হযরত জিবরীল আলাইহিস সালামের তৃতীয় প্রশ্ন ছিল ইহসান সম্পর্কে। নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন- ইহসান এই যে, তুমি আল্লাহর "ইবাদত এমনভাবে করবে যেন তুমি তাকে দেখছ। আর যদি তুমি তাকে নাও দেখো,তবে তিনি তো তোমাকে অবশ্যই দেখছেন।
'ইহসান’-এর শাব্দিক অর্থ কোনও কাজ সুন্দরভাবে করা। এটা 'আদল'-এর উপরের স্তর। আদল হচ্ছে কোনও কাজ যথাযথ নিয়ম রক্ষা করে করা। তাতে কোনও ত্রুটি না রাখা। আর ইহসান হচ্ছে সে কাজ সুষ্ঠুরূপে সম্পন্ন করেই ক্ষান্ত না হওয়া, বরং তাতে আরও বাড়তি সৌন্দর্য আরোপ করা। কারও সাথে লেনদেন দ্বারা এ উদাহরণ দেওয়া যায় যে, শাহেদ হাশেমের কাছে যা পাবে, শাহেদ তা পুরোপুরি আদায় করে নিল। আর হাশেম তার কাছে যা পাবে তা পুরোপুরি পরিশোধ করল, এটা আদল। কেননা এ লেনদেন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা হয়েছে, কোনও ত্রুটি রাখা হয়নি। কিন্তু এতে বাড়তি কোনও সৌন্দর্য পাওয়া যায় না। কোনও মহানুভবতা লক্ষ করা যায়। না। তাই একে ইহসান বলা যাবে না। ইহসান হবে তখন, যখন হাশেম শাহেদকে তার প্রাপ্যের চেয়েও বেশি দেবে এবং সে তার কাছে যা পাবে তারচে' কম নেবে।
এ হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহসানের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তাতে এই বাড়তি সৌন্দর্যের ব্যাপারটা আছে। কেবল ফরয, ওয়াজিব আদায় করে ক্ষান্ত হলে যে 'ইবাদত হবে, তা হবে আদলের পর্যায়ে। ইহুসান হবে যখন সে ইবাদত করা হবে এ মনোভাবের সাথে, যেন ইবাদতকারী আল্লাহ তা'আলাকে দেখছে। এটা ইহসানের প্রথম স্তর। একে 'মুশাহাদা' বা আল্লাহদর্শন বলে। আমি আল্লাহ তা'আলাকে দেখছি, আমি তাঁর কাছে তিনি আমার সামনে অন্তরে এই ধ্যান থাকলে আল্লাহর ভয়, শ্রদ্ধাভক্তি এবং খুশূ'-হুযু' বেড়ে যাবে। ফলে ‘ইবাদতে বাড়তি যত্ন নেওয়া হবে এবং তাকে যতটা সম্ভব সুন্দর ও সুচারু করে তোলার চেষ্টা করা হবে। নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কিরামকে এরকম মনোভাবের সাথে ইবাদত-বন্দেগী করার হুকুম দিতেন। এবং সাধারণত সাহাবায়ে কিরাম এভাবেই ইবাদত-বন্দেগী করতেন। তাঁরা কেবল নামাযই নয়, অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগী এমনকি পার্থিব কাজকর্মও এমনভাবে আঞ্জাম দিতেন, যেন আল্লাহ সামনে আছেন এবং তাঁরা তাঁকে দেখতে পাচ্ছেন।
অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যদি তুমি তাঁকে নাও দেখ, তবে তিনি তো তোমাকে অবশ্যই দেখছেন। এ বাক্যের দু'রকম ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে।
এক ব্যাখ্যা অনুযায়ী এটা ইহসানের দ্বিতীয় স্তর। একে মুরাকাবা বলে। এর দ্বারা ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, যার পক্ষে ইহসানের প্রথম স্তরে উঠা অর্থাৎ মুশাহাদা বা আল্লাহদর্শন কঠিন মনে হয় সে ইহসানের দ্বিতীয় স্তর তথা মুরাকাবার সাথে ইবাদত করবে। সে চিন্তা করবে আল্লাহ আমাকে দেখছেন। তিনি আমার ভেতর-বাহির সবকিছু সম্পর্কে অবগত। এর দ্বারাও মূল উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে যাবে। অর্থাৎ এই ধ্যানের সাথে ইবাদত করলে সুন্দর ও সুচারুরূপে ইবাদত করা সম্ভব হবে। বুযুর্গানে দীন বলেন, তুমি আল্লাহকে ভয় কর তোমার প্রতি আল্লাহর শক্তি ও ক্ষমতা অনুপাতে এবং তাঁকে লজ্জা কর তোমার কাছে তাঁর নৈকট্য অনুসারে।
ইহসানের এ স্তরকে ইখলাসের মাকাম ও বলা হয়। যে ব্যক্তি এই ভাবনার সাথে ইবাদত করবে যে, আল্লাহ তা'আলা তাকে দেখছেন, তিনি তার কাছে আছেন এবং তিনি তার সম্পর্কে পূর্ণ অবগত, তখন তার ধ্যান গায়রুল্লাহ থেকে ছিন্ন হয়ে আল্লাহর প্রতি নিবেদিত থাকবে। তার লক্ষ্য মাখলুক থেকে সরে গিয়ে মা'বুদেরই অভিমুখী থাকবে। এরূপ ব্যক্তিকে বলা হয় মুখলিস।
ইবন হাজার আসকালানী রহ বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম মূলত এখানে ইহসানের দুটি স্তর উল্লেখ করেছেন। তার মধ্যে উচ্চতর স্তর হচ্ছে মুশাহাদা অর্থাৎ বান্দা এ মনোভাবের সাথে ইবাদত করবে, যেন সে নিজ চোখে তাকে দেখতে পাচ্ছে। প্রথম বাক্যে এই স্তর বর্ণিত হয়েছে। দ্বিতীয় বাক্যে বর্ণিত হয়েছে মুরাকাবার স্তর। অর্থাৎ সে চিন্তা করবে আল্লাহ তা'আলা তার সম্পর্কে পূর্ণ অবগত এবং তিনি তার কর্ম দেখছেন। আল্লাহ তা'আলার মা'রিফাত ও পরিচয় এবং তাঁর খাশয়াত ও ভীতির দ্বারা ইহসানের এই স্তরদু'টি অর্জিত হয়ে থাকে।
দ্বিতীয় ব্যাখ্যা অনুযায়ী 'তুমি তাঁকে দেখছ'- এ কথাটি দ্বারা ইহসানের দ্বিতীয় স্তর (মুরাকাবা) বোঝানো উদ্দেশ্য নয়; বরং এটি প্রথম বাক্যে বর্ণিত মুশাহাদার কারণস্বরূপ । অর্থাৎ বান্দাকে যখন হুকুম দেওয়া হল সে ইবাদতের ভেতর আল্লাহ তা'আলার মুরাকাবা করবে এবং তাঁকে নিজের সামনে হাজির বলে চিন্তা করবে, যেন সে তাঁকে দেখতে পাচ্ছে, তখন তার কাছে মনে হতে পারে ব্যাপারটা তো অনেক কঠিন। আমার মত দুর্বল বান্দার পক্ষে এমন কঠিন ধ্যান কিভাবে সম্ভব? এ বাক্যে বলে দেওয়া হয়েছে ব্যাপারটা খুব কঠিন নয়। কেননা তোমার তো ঈমান আছে যে, তিনি তোমাকে দেখছেন। তিনি তোমার ভেতর ও বাহির সম্পর্কে অবহিত। তোমার প্রকাশ্য ও গুপ্ত সবকিছুই জানেন। তাঁর কাছে তোমার কিছুই গোপন থাকে না। তো তুমি তোমার বিশ্বাসের এই স্তরটি যদি ধ্যান করতে থাক, তবে একপর্যায়ে তোমার পক্ষে পরবর্তী স্তরে আরোহন সহজ হয়ে যাবে। তখন তুমি এ ধ্যানও করতে পারবে যে, আল্লাহ আমার সামনে আছেন, আমি যেন তাঁকে দেখতে পাচ্ছি।
ইমাম নববী রহ. বলেন, আমদের কেউ যদি ইবাদত অবস্থায় এ চিন্তা করে যে, সে তার প্রতিপালককে দেখছে, তবে সে যথাসম্ভব খুশু-খুযু' রক্ষা করবে, সুন্দর ও সুচারুরূপে ইবাদত করবে, বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিখুঁতভাবে কাজে লাগাবে, পরিপূর্ণরূপে আল্লাহর অভিমুখী থাকবে এবং সর্বোতপ্রকারে তার ইবাদত পরিপূর্ণ করে তোলার চেষ্টা করবে। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছেন- তুমি সর্বাবস্থায় আল্লাহর ইবাদত কর তাঁকে নিজ চোখে দেখে ইবাদত করার মত। নিজ চোখে দেখা অবস্থায় ইবাদতে পূর্ণতা আসে এ কারণে যে, বান্দা জানে আল্লাহ তা'আলা তার সম্পর্কে পূর্ণ অবগত। আর তা জানে বলেই এ অবস্থায় সে কোনও ত্রুটি করে না। আর এ ব্যাপারটা তো ওই অবস্থায়ও বিদ্যমান থাকে, যখন সে তাঁকে দেখতে পায় না কিছু এ বিশ্বাস আছে যে, তিনি তাকে দেখেন। বস্তুত হাদীছের উদ্দেশ্য হচ্ছে বান্দাকে তার ইবাদতে ইখলাস ও মুরাকাবায় উদ্বুদ্ধ করা, যাতে তার ইবাদতে খুশু খুযু ইত্যাদি পরিপূর্ণরূপে বিদ্যমান থাকে। ইহসানের সাথে ইবাদত করলে তা অবশ্যই থাকবে। কেননা বুযুর্গানে দীন সালিহীনের সাহচর্য অবলম্বন করতে বলে থাকেন তো এ কারণেই যে, তা অন্যায়-অপরাধে লিপ্ত হওয়ার পথে বাধা হয়। তা বাধা হয় তাদের প্রতি ইহুতিরাম ও শ্রদ্ধাবোধের কারণে এবং তাদের লজ্জায়। সালিহীনের সম্মান রক্ষা তাদের লজ্জার কারণে যদি মানুষ অন্যায়-অনাচার থেকে দূরে থাকে, তাহলে যে আল্লাহ মানুষের ভেতর-বাহির সবকিছু সম্পর্কে অবগত এবং তার প্রকাশ্য-গুপ্ত সবকিছু জানেন তাঁর ধ্যান কেন ভুল-ত্রুটি করার পক্ষে বাধা হবে না? মোটকথা হাদীছ বোঝাচ্ছে, তুমি যখন আল্লাহ তা'আলাকে দেখছ বলে মনে কর, তখন তো ইবাদতের যাবতীয় আদর রক্ষা কর কেবল এ কারণে যে, তিনি তোমাকে দেখছেন। কেবল তুমি তাঁকে দেখছ- এ কারণে নয়। তো তিনি সর্বদাই তোমাকে দেখছেন। সুতরাং তাঁর ইবাদত সুন্দরভাবে। আদায় কর, যদিও তুমি তাঁকে দেখতে না পাও। সংক্ষেপ কথা- তুমি সর্বদা আল্লাহর ইবাদত সুন্দর ও সুচারুরূপে আদায় করতে থাক, কেননা তিনি তোমায় দেখছেন।
হযরত জিবরীল আলাইহিস সালামের চতুর্থ প্রশ্ন ও তার উত্তর
হযরত জিবরীল আলাইহিস সালামের চতুর্থ প্রশ্ন ছিল কিয়ামত সম্পর্কে যে, তা কবে সংঘটিত হবে? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বলেছেন, এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত ব্যক্তি জিজ্ঞাসাকারী অপেক্ষা বেশি জানে না। অর্থাৎ কিয়ামত কবে হবে সে সম্পর্কে সমস্ত মাখলুকের ‘ইলম একই পর্যায়ের। অর্থাৎ তারা কেউ তা জানে না। এ কারণেই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে এ কথা বলেননি যে, এ সম্পর্কে আমি আপনার চেয়ে বেশি জানি না। বাহ্যত সেরকম বলারই কথা ছিল। তা না বলে এরকম ব্যাপকতার সাথে বলেছেন এদিকে ইঙ্গিত করার জন্য যে, কিয়ামতের আগ পর্যন্ত এ প্রশ্ন যাকেই করা হবে সে কেবল অজ্ঞতাই প্রকাশ করতে পারবে। কারও পক্ষেই বলা সম্ভব হবে না যে, কিয়ামত কবে হবে। কোনও কালেই এ সম্পর্কে কোনও জিজ্ঞাসিত ব্যক্তি জিজ্ঞাসাকারী অপেক্ষা বেশি জানার প্রমাণ দিতে পারবে না। বস্তুত এ সম্পর্কিত জ্ঞান আল্লাহ তা'আলা তাঁর নিজের জন্য নির্দিষ্ট করে রেখেছেন। হযরত আবু হুরায়রা রাযি. বর্ণিত এক হাদীছে আছে, নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, এটা ওই পাঁচ বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত, যা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। তারপর তিনি পাঠ করেনঃ
إِنَّ اللَّهَ عِندَهُ عِلْمُ السَّاعَةِ وَيُنَزِّلُ الْغَيْثَ وَيَعْلَمُ مَا فِي الْأَرْحَامِ ۖ وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ مَّاذَا تَكْسِبُ غَدًا ۖ وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ بِأَيِّ أَرْضٍ تَمُوتُ ۚ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ
অর্থঃ নিশ্চয় আল্লাহর কাছেই কেয়ামতের জ্ঞান রয়েছে। তিনিই বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং গর্ভাশয়ে যা থাকে, তিনি তা জানেন। কেউ জানে না আগামীকল্য সে কি উপার্জন করবে এবং কেউ জানে না কোন দেশে সে মৃত্যুবরণ করবে। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সর্ববিষয়ে সম্যক জ্ঞাত।
কিয়ামতের আলামত
সবশেষে হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম কিয়ামতের আলামত জানতে চাইলেন। উত্তরে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- (ক) দাসী তার কর্ত্রীকে জন্ম দেবে এবং (খ) খালি পা ও নগ্ন শরীরের অভাবী মেষ রাখালদের দেখতে পাবে। (একসময়) উঁচু উঁচু ভবন নির্মাণে পরস্পর প্রতিযোগিতা করছে।
এখানে কিয়ামতের দু'টি আলামত বর্ণিত হয়েছে। (ক) দাসী দ্বারা তার কর্ত্রীর জন্ম দেওয়া। দাসী কিভাবে কর্ত্রীকে জন্ম দেবে, উলামায়ে কিরাম তার বিভিন্ন ব্যাখ্যা করেছেন। তার মধ্যে একটি এই- ছেলেমেয়ে তার মায়ের সাথে দাসীর মত আচরণ করবে। মনিব দাস-দাসীকে হুকুম দেয়। দাস-দাসী তা পালন করে। পালন না করলে। মেক দেওয়া হয়। ক্ষেত্রবিশেষে শাস্তি দেওয়া হয়। এর বিপরীত হয় না। দাস-দাসী মনিবকে হুকুম দেয় না। হুকুম দেওয়ার সাহস করে না। পিতামাতা ও সন্তানের। ব্যাপারটাও কিয়ামতের আগে এরকমই হবে। সন্তান পিতামাতাকে দাস-দাসীর মত হুকুম করবে। ধমক দিয়ে কথা বলবে। আরও বেশি হতভাগা হলে নির্যাতনও করবে। পিতামাতা সন্তানকে কোনও হুকুম দেওয়ার সাহস করবে না। ধমক দেওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। এককথায় কিয়ামতের আগে ব্যাপকভাবে পিতামাতার অবাধ্যতা করা হবে। সে কাল কি এসে গেল?
(খ) জুতা ও জামা-কাপড় নেই এমন অভাবী রাখালদের উঁচু উঁচু ভবন নির্মাণে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়া। এর মানে নিম্ন শ্রেণীর লোকের উপরে উঠে যাওয়া। তারা হবে দেশের নেতা, প্রচুর টাকা-পয়সার মালিক হয়ে যাবে এবং কে কার চেয়ে শানদার বাড়ি বানাতে পারে সেই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে পড়বে। হযরত হুযায়ফা রাযি. বর্ণিত এক হাদীছে আছে, ততদিন কিয়ামত সংঘটিত হবে না, যতদিন না দুনিয়ায় সর্বাপেক্ষা বিত্তবান হবে নিম্ন শ্রেণীর মানুষ। হযরত আবূ যর্র রাযি. বর্ণিত হাদীছে আছে, নিম্ন শ্রেণীর মানুষ প্রভাবশালী হয়ে যাবে। হযরত আনাস রাগি, বর্ণিত হাদীছে আছে, নির্বোধ শ্রণীর মানুষ সমষ্টিগত বিষয়ে কথা বলবে। এক বর্ণনায় আছে, ফাসিক লোকে জনসাধারণের বিষয়ে কথা বলবে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন 'আমর রা. বর্ণিত হাদীছে আছে, শ্রেষ্ঠ মানুষদের নিচে ফেলে রাখা হবে আর মন্দ লোকদের উপরে উঠে হবে। এক বর্ণনায় আছে, প্রত্যেক গোত্রের নেতৃত্ব দেবে মুনাফিক শ্রেণীর লোক। সবগুলো বর্ণনার সারমর্ম হল কিয়ামতের আগে অবস্থা সম্পূর্ণ উল্টে যাবে। জাহেল ও ফাসিক শ্রেণীর লোক বিপুল অর্থের মালিক হবে এবং সমাজের নেতৃত্ব দান করবে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাদীছে সংক্ষেপে বলেছেন
إذا وسد الأمر إلى غير أهله فالنظر الساعة
'যখন অযোগ্য লোকের উপর রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব অর্পণ করা হবে, তখন কিয়ামতের অপেক্ষা কর।"
হতদরিদ্র রাখালের ইলম ও আদব-কায়দা শেখার অবকাশ কোথায়? হঠাৎ করেই এরা যখন বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়ে যাবে এবং দেশের নেতৃত্ব লাভ করবে, তখন তাদের আচার-আচরণ কেমন হবে সহজেই অনুমেয়। তারা হালাল-হারাম নির্বিচারে নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত থাকবে। মানুষের হক আদায় তো করবেই না, উল্টো তাদের উপর জুলুম-নির্যাতন চালাবে। এ শ্রেণীর মানুষের কাছে দীনদার ও চরিত্রবান লোকের কোনও মর্যাদা থাকবে না। তারা তাকওয়া-পরহেযগারীর মূল্য দেবে না। সর্বদা অসৎ ও দুর্বৃত্তপরায়ণ লোকই তাদের ঘিরে রাখবে। তাদেরকে তারা বেশি আশ্রয়-প্রশ্রয় দেবে। তাদের উৎপাতে সমাজের শান্তি-শৃংখলা ধ্বংস হবে। সুশিক্ষা ও তালীম তরবিয়াতের মেহনত বন্ধ হয়ে যাবে। সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের পরিবেশ থাকবে না। ফলে মানুষের আখলাক-চরিত্রের ব্যাপক অবক্ষয় ঘটবে। সর্বত্র অন্যায়-অনাচার ছড়িয়ে পড়বে। সারা জাহান পাপাচারে পঙ্কিল হয়ে যাবে। এহেন পাপ পঙ্কিল জগতকে বাকি রাখার প্রয়োজন আল্লাহ তা'আলার থাকবে না। অচিরেই কিয়ামত হয়ে যাবে।
এ হাদীছে কিয়ামতের আলামত হিসেবে বিশেষভাবে উঁচু ভবন নির্মাণে প্রতিযোগিতার কথা বলা হয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের যমানায় উঁচু দালান-কোঠা নির্মাণের রেওয়াজ ছিল না। তখন বাড়ি-ঘর হত নিচু। কেবল প্রয়োজন পরিমাণ। উম্মাহাতুল মু'মিনীন (নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীগণ) এর ঘর কেমন ছিল? কতটুকু উঁচু ছিল? হযরত হাসান বসরী রহ. বলেন, আমি হযরত ‘উছমান রাযি.-এর আমলে তাঁদের ঘরে প্রবেশ করতাম। আমি উপরে হাত তুলে দেখেছি আমার হাত ছাদে লেগে যায়। উঁচু ঘর করার রেওয়াজ হয়েছে পরবর্তীকালে। যখন ইরান ও রোম পরাজিত হয়, তাদের দেশ মুসলমানদের অধিকারে আসে, তখন তাদের দেখাদেখি মুসলিমগণও বিশেষত মুসলিম রাজা-বাদশাগণ উঁচু অট্টালিকা নির্মাণে মনোযোগী হয়ে পড়ে। অধঃপতনের শুরু তখন থেকেই।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা ইহসান ও মুরাকাবার শিক্ষা পাওয়া যায়। সুন্দর আমল ও আদর্শ জীবন গড়ার লক্ষ্যে মুরাকাবার কোনও বিকল্প নেই। জীবনের প্রতিটি কাজেই 'আল্লাহ দেখছেন এ ধ্যান অন্তরে জাগ্রত রাখা উচিত।
খ. অজানা বিষয়ে প্রশ্ন করা জ্ঞান অর্জনের একটি উৎকৃষ্ট পন্থা।
গ. অন্যদের শিক্ষাদান করারও একটি ভালো উপায় তাদের সামনে 'আলেম ও জ্ঞানীজনকে প্রশ্ন করা।
ঘ. যে বিষয়ে জানা নেই, সে বিষয়ে কেউ জিজ্ঞেস করলে স্পষ্ট বলে দেওয়া উচিত আমি জানি না।
ঙ. নিজ বাসগৃহ প্রয়োজনের অতিরিক্ত বড় ও উঁচু করা পসন্দনীয় নয়।
এ হাদীছে এছাড়া আরও বহু শিক্ষা আছে। মনোযোগী পাঠকের পক্ষে সহজেই তা উপলব্ধি করা সম্ভব।
এ হাদীছে দ্বীনের ব্যাখ্যা দান করা হয়েছে প্রশ্নোত্তরের পন্থায়। হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্ন করেছেন এবং তিনি তার উত্তর দিয়েছেন। শেষে আছে, তিনি আগমন করেছিলেন সাহাবায়ে কিরামকে দীনের শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে। এর দ্বারা তাঁর সে উদ্দেশ্য পুরোপুরি সফল হয়েছে। তাই এ হাদীছটি ‘হাদীছে জিবরীল' নামে পরিচিত।
হযরত জিবরীল আলাইহিস সালামের আগমনের কারণ
সাহাবায়ে কিরাম নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দ্বীনের বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞেস করতেন। তিনিও তাঁদের শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে সে সকল প্রশ্নের উত্তর দিতেন। তাঁর সঙ্গে সাহাবায়ে কিরামের ছিল অত্যন্ত গভীর হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক। কোনও বিষয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করতে তাদের কুণ্ঠাবোধ হত না। এ কারণে কমনও কখনও তাদের পক্ষ থেকে এমন প্রশ্নও এসে যেত, যা জানার বিশেষ প্রয়োজন নেই। কিংবা দ্বীনের সংগে তার বিশেষ সম্পর্ক নেই। অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন অনেক সময় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। একপর্যায়ে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের অপ্রাসঙ্গিক কোনও প্রশ্নের কারণে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন এবং তাদেরকে প্রশ্ন করতে নিষেধ করে দেন। কুরআন মাজীদেরও আয়াত নাযিল হয়
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَسْأَلُوا عَنْ أَشْيَاءَ إِنْ تُبْدَ لَكُمْ تَسُؤْكُمْ
"হে মুমিনগণ! তোমরা এমন সব বিষয়ে প্রশ্ন করো না, যা প্রকাশ করা হলে। তোমাদের কাছে অপ্রীতিকর মনে হবে।”
সুতরাং সাহাবায়ে কিরাম প্রশ্ন করা একেবারেই ছেড়ে দিলেন। এতে তাদের অনেক সমস্যায় পড়তে হল। কেননা অনেক সময় এমন জরুরি বিষয়ও দেখা দেয়, যে সম্পর্কে জিজ্ঞেস না করলে তার সমাধান সম্ভব হয় না। একদিকে জিজ্ঞেস করলে অনুচিত বিষয়ে প্রশ্ন হয়ে যাওয়ার আশংকা, অন্যদিকে জিজ্ঞেস না করলে সমস্যার সমাধান না হওয়ার বিড়ম্বনা। তাঁরা এ উভয় সংকটের মধ্যে পড়ে গেলেন। এ জটিলতা নিরসনের লক্ষ্যে আল্লাহ তা'আলা হযরত জিবরীল আলাইহিস সালামকে পাঠালেন। তিনি এসে দ্বীনের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করে সাহাবায়ে কিরামের দীন শিক্ষার ব্যবস্থা করে দিলেন। সেইসংগে এর মাধ্যমে তাঁরা এই শিক্ষাও পেয়ে গেলেন যে, নবীকে দীন সম্পর্কে কী ধরনের প্রশ্ন করা উচিত এবং কী ধরনের প্রশ্ন করা উচিত না।
হযরত জিবরীল আলাইহিস সালামের অবাক করা যত আচরণ
হযরত জিবরীল আলাইহিস সালামের বেশভূষা, আচরণ ও কথাবার্তা ছিল অবাক করার মত। তিনি এসেছিলেন পরিপাটি বেশভূষায়। ধবধবে সাদা পোশাক, কালো পরিপাটি মাথার চুল। দেখলে মনে হয় খুব কাছাকাছি দূরত্ব থেকে কেতাদুরস্ত হয়ে আসা কোনও ভদ্রলোক। কাছের কোনও বাসিন্দা হলে সকলের চেনার কথা। কিন্তু কেউ তাঁকে চিনতে পারছে না, এ আগুন্তুক কে। সেই হিসেবে ধরে নিতে হয় ইনি দূরবর্তী কোনও এলাকার বাসিন্দা। কিন্তু তাই যদি হয়, তবে তো সফরের চিহ্ন থাকার কথা। পোশাক হবে ধুলোমলিন, মাথার চুল হবে ধূসর আলুথালু। কিন্তু সেরকম সফরের কোনও চিহ্ন তো তাঁর মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। তার অর্থ দাঁড়ায় তিনি দূর থেকে আসেননি। দূরেরও মন কাছেরও নন, এ কেমন অবাক ব্যাপার। যাহোক মজলিসে প্রবেশের পর তিনি আস্তে আস্তে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকটে এগিয়ে আসলেন। কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, তিনি জিজ্ঞেস করলেন, হে মুহাম্মাদ! কাছে আসব? তিনি বললেন, কাছে আসুন। তিনি কাছে এসে বসলেন। নিজ হাঁটু তাঁর হাঁটুর সাথে মিলিয়ে দিলেন এবং দু'হাত তাঁর উরুর উপর রাখলেন।
মুহাম্মাদ বলে সম্বোধন করা সাহাবায়ে কিরামের অভ্যাস ছিল না। এটা আদবের পরিপন্থী। তাঁরা তাঁকে রাসূলুল্লাহ বা নাবিয়্যুল্লাহ বলে সম্বোধন করতেন। কিন্তু এ আগুন্তক তাঁর নাম নিয়েই সম্বোধন করছে। তাদের পক্ষে এটাও হতচকিত করার মত ব্যাপার। তারপর আবার নিজের হাঁটু তাঁর হাঁটুর সংগে মিলিয়ে রাখছেন। এও এক অদ্ভুত আচরণ! বড়র সংগে ছোটর বিশেষত নবীর সংগে এ জাতীয় আচরণ কোনও আদবকেতার আওতায় পড়ে না। তারপর নিজের হাত তাঁর উরুর উপর রাখলেন। কার উরুর উপর? কোনও বর্ণনায় আছে নিজ ঊরুর উপর। আবার কোনও বর্ণনায় স্পষ্ট বলা হয়েছে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের উরুর উপর। হয়তো প্রথমে নিজ উরুর উপর রেখেছিলেন, পরে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের উরুর উপর রাখেন। এটা আরও বেশি অদ্ভুত আচরণ! নবী-রাসূলের সংগে উম্মতের কোনও সদস্যের এ জাতীয় আচরণ কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কিন্তু এ আগুম্ভক এ সবই করলেন।
আরও অবাক করার মত বিষয় হল নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিটি উত্তরের পর তিনি মন্তব্য করছেন- আপনি সঠিক বলেছেন। কী আশ্চর্য! একদিকে জিজ্ঞেস করছেন। তার মানে যে বিষয়ে জিজ্ঞেস করছেন সে বিষয়ে তিনি অজ্ঞ। তাঁর তা জানা নেই। আবার উত্তর পাওয়ার পর বলছেন, আপনি সঠিক বলছেন। তার মানে সে বিষয়ে তাঁর জানা আছে। জানা আছে বলেই উত্তর সঠিক হয়েছে কি না বুঝতে পারছেন। তা যদি জানাই থাকে, তবে জিজ্ঞেস করবেন কেন? আর যদি জানা না থাকে, তবে সঠিক হয়েছে বলে মন্তব্য করবেন কেন? এ দুইয়ের মধ্যে কোনও সংগতি নেই। এ অসংগতিও সাহাবায়ে কিরামকে অবাক করেছে। কোনও কোনও রিওয়ায়েতে আছে, তারা বলে উঠেছেন- দেখ, সে জিজ্ঞেসও করছে আবার সঠিক বলে মন্তব্যও করছে। যেন সে তাঁরচে' বেশি জানে! অন্য বর্ণনায় আছে, আমরা তার মত লোক দেখিনি। যেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শেখাচ্ছে! তাই বলছে, সঠিক বলেছেন, সঠিক বলেছেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম এসব অবাক করা কাণ্ড কেন করলেন? আসলে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল সাহাবায়ে কিরামের মনোযোগ আকর্ষণ করা। তিনি যেহেতু তাঁদেরকে দ্বীনের শিক্ষাদান করার উদ্দেশ্যে এসেছিলেন, আর সেজন্য প্রশ্নোত্তরের পন্থা বেছে নিয়েছিলেন, তাই চাচ্ছিলেন তাদেরকে কৌতূহলী করে তুলে প্রশ্নকারী ও উত্তরদাতা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি পুরোপুরি মনোযোগী করে রাখতে। চোখ-কান, দেহ-মন, চিন্তা ও ধ্যান সবদিক থেকে ভালে তাঁদের প্রতি অভিনিবিষ্ট ও একপ্রচিত্ত করে রাখতে। সেজন্যই তিনি এসব অবা করেছেন। বলা বাহুল্য তাঁর সে উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল। সাহাবায়ে কিরাম পূর্ণ সাথে হযরত জিবরীল আলাইহিস সালামের প্রশ্ন ও নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের উত্তর শুনেছেন এবং দীনের সুস্পষ্ট শিক্ষা অর্জন করেছেন।
হযরত জিবরীল আলাইহিস সালামের প্রথম প্রশ্ন ও তার উত্তর
হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম প্রথম প্রশ্ন করলেন ইসলাম সম্পর্কে ইসলাম কী? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ইসলাম এই যে, তুমি সা দেবে আল্লাহ ছাড়া কোনও মাবুদ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসুল। আর নামায কায়েম করবে, যাকাত দেবে, রমযানের রোযা রাখবে এবং বায়তুল্লাহ য় যাওয়ার সামর্থ্য থাকলে হজ্জ করবে। এতে তিনি ইসলামের ব্যাখ্যা করেছেন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বাহ্যিক কাজকর্ম দ্বারা। প্রথম হচ্ছে এই সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনও মাবুদ নেই। এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল। এটা মুখের কাজ। আর নামায কায়েম করা, যাকাত দেওয়া, রোযা রাখা ও হজ্জ করা অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কাজ। এগুলো তিনভাগে বিভক্ত। শারীরিক, যেমন নামায পড়া ও রোযা রাখা। অর্থ সম্পদ সম্পর্কিত, যেমন যাকাত দেওয়া। তৃতীয়ত শারীরিক ও আর্থিক উভয় সংক্রান্ত, যেমন হজ্জ করা।
এখানে কেবল ইসলামের মৌলিক কার্যাবলীর উল্লেখ করা হয়েছে। কুরআন ও হাদীছের বিভিন্ন স্থানে ইতিবাচক ও নেতিবাচক বহু কাজের উল্লেখ আছে। তা সবই ইসলামের শাখা-প্রশাখা। বস্তুত বাহ্যিক কার্যাবলীর সবই ইসলামের আওতাধীন। বিভিন্ন হাদীছ দ্বারাই তা প্রমাণিত, যেমন এক হাদীছে বর্ণিত হয়েছে
المسلم من سلم المسلمون من لسانه ويده
‘মুসলিম সেই ব্যক্তি, যার জিহ্বা ও হাত থেকে অন্যান্য মুসলিম নিরাপদ থাকে।
অপর এক হাদীছে আছে, এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করল, ইসলামের কোন্ আমল শ্রেষ্ঠ? তিনি বললেন «تطعم الطعام وتقرأ السلام على من عرفت ومن لم تعرف» ইসলামের শ্রেষ্ঠ আমল যে, তুমি মানুষকে অন্ন করবে এবং পরিচিত-অপরিচিত সকলকে সালাম দিবে।'
মোটকথা, কুরআন ও হাদীছে যা-কিছু করার হুকুম দেওয়া হয়েছে তা সব করা এবং যা-কিছু করতে নিষেধ করা হয়েছে সেসব থেকে বিরত থাকার দ্বারা এক ব্যক্তি পূর্ণাঙ্গ মুসলিম হতে পারে। এ হাদীছে ইসলামের কেবল মৌলিক কাজসমূহই উল্লেখ করা হয়েছে। শরীর, সম্পদ ও যৌথভাবে উভয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত ইতিবাচক ও নেতিবাচক যাবতীয় কাজই এর আওতাধীন।
জিবরীল আলাইহিস সালামের দ্বিতীয় প্রশ্ন তার উত্তর
জিবরীল আলাইহিস-সালামের দ্বিতীয় প্রশ্ন ঈমান সম্পর্কে, নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিয়েছেন, ঈমান এই যে, তুমি আল্লাহ,তাঁর ফেরেশতাগণের প্রতি, তার কিতাবসমুহ, তাঁর রাসূলগণ, শেষদিবস এবং তাকদীরের ভালো-মন্দের প্রতি বিশ্বাস রাখবে।
লক্ষ্য করা যাচ্ছে, রাসুল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈমানের ব্যাখ্যায় ৬টি বিষয় উল্লেখ করেছেন, যার প্রত্যেকটিরই সম্পর্ক বিশ্বাসের সাথে। এই ছয়টি ঈমানের প্রধানতম অঙ্গ। মু'মিন হবার জন্য এর প্রত্যেকটিতে বিশ্বাস রাখা জরুরি। এর যে-কোনও একটিত অবিশ্বাস করলে মু'মিন থাকে না। এর প্রত্যেকটিরও আবার ব্যাখ্যা আছে। কুরআন-সুন্নাহ’য় সে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।
প্রত্যেকটিতে বিশ্বাস রাখতে হবে সেই ব্যাখ্যা মোতাবেক। যেমনঃ আল্লাহ ছাড়া কোনও মাবুদ নেই, এর দ্বারা তাওহীদের বিশ্বাস বোঝানো হয়েছে। তাওহীদ মানে একথা বিশ্বাস করা,এ বিশ্ব জগতের একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন। বিশ্বজগত সৃষ্টিতে তার কোনও শরীক নেই। তাঁর কোনও শুরু ও শেষ নেই। তিনি সদা ছিলেন, সদা থাকবেন। তিনি সকলের রক্ষাকর্তা। তিনি সর্বশক্তিমান সর্বজ্ঞ। তাঁর সত্তায় কোনও শরীক নেই, তেমনি তাঁর গুণাবলীতেও কোনও অংশীদার নেই। সৃষ্টির ইষ্ট অনিষ্টের তিনি একচ্ছত্র মালিক। তিনি কারও কোনও উপকার করতে চাইলে কেউ তা রদ করতে পারে না এবং কারও ক্ষতি করতে চাইলে কেউ তা ঠেকাতে না। তো তিনি একাই যখন সমস্ত উপকার-ক্ষতির মালিক, তখন মা'বৃদও কেবল তিনি একাই হতে পারেন। 'ইবাদত কেবল তাঁর একারই করা যেতে পারে। ‘ইবাদতে অন্য শরীক করার কোনও বৈধতা নেই।
এমনিভাবে রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাসের মানে- আল্লাহ 'তাআলা মানুষের হিদায়াতের জন্য হযরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে নিয়ে হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত বহু নবী-রাসুল পাঠিয়েছেন। তাদের সকলকেই নবী হিসেবে বিশ্বাস করা জরুরি। যে যুগে যে নবী আসেন, সে যুগের মানুষের কর্তব্য তাঁর অনুসরণ ও আনুগত্য করা এবং তাঁর আনীত বা প্রচারিত শরী'আত মেনে চলা।এ ধারার সর্বশেষ নবী ও রাসুল হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম। এখন কিয়ামত পর্যন্ত সারা জাহানের সমস্ত মানুষের কর্তব্য তাঁর প্রতি ঈমান আনা ও তাঁর আনীত শরী'আতের পাবন্দী করা। রাসূলগণের প্রতি এ ব্যাখ্যার সাথেই বিশ্বাস স্থাপন জরুরি। এছাড়া তাঁদের প্রতি বিশ্বাস যথার্থ বিশ্বাস বলে গণ্য হবে না।
এভাবেই ঈমানের বাকি চারটি মূল অঙ্গের প্রতিও কুরআন ও সুন্নাহ’য় প্রদত্ত ব্যাখ্যা অনুসারে বিশ্বাস রাখা অবশ্যকর্তব্য। মনগড়া ব্যাখ্যা অনুযায়ী এর কোনও একটি অঙ্গে বিশ্বাস আনয়ন করলে তা সত্যিকারের ঈমান বলে গৃহীত হবে না।
প্রকাশ থাকে যে, এ হাদীছে যে ঈমান ও ইসলামের আলাদা আলাদা ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে তা কেবলই শাব্দিক, পারিভাষিক ও তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে, ব্যবহারিক দিক থেকে নয়। তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে ঈমান হচ্ছে অন্তরের কাজ। অর্থাৎ যে সকল বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস রাখা জরুরি, আন্তরিকভাবে তা বিশ্বাস করা ও মেনে নেওয়া। আর ইসলাম হচ্ছে আল্লাহর কাছে বান্দার আত্মসমর্পণ ও আনুগত্যস্বীকার, যা বাহ্যিক কাজের দ্বারাই সম্ভব। তাই এক রেওয়ায়েতে আছে, ইসলাম হল প্রকাশ্য বিষয় আর ঈমান অন্তরের গুপ্ত বিষয়। অর্থাৎ ইসলাম বাহ্যিক কার্যাবলীর নাম, যা প্রকাশ্যে করা হয়ে থাকে। আর ঈমান তো বিশ্বাস, তা প্রকাশ পায় না, অন্তরে গোপন থাকে।
যে সকল হাদীছে ঈমান ও ইসলাম পাশাপাশি এসেছে, যেমন এই হাদীছে জিবরীলে, তাতে ঈমান ও ইসলামের এ তাত্ত্বিক দিকই বিবেচনায় রাখা হয়েছে এবং সেই হিসেবে উভয়টির মধ্যে পার্থক্য করা হয়েছে। কিন্তু যেসব হাদীছে ঈমান ও ইসলাম আলাদা আলাদাভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, তাতে উভয়টির ব্যবহারিক দিকই বিবেচিত হয়েছে। ব্যবহারিক দিক থেকে উভয়ের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য নেই। ব্যবহারিক দিক থেকে যা ঈমান তাই ইসলাম। এবং যে ব্যক্তি মু'মিন সেই মুসলিম। কেউ যদি উপরে বর্ণিত ছয়টি বিষয়ে বিশ্বাস রাখে কিন্তু নামায না পড়ে, যাকাত না দেয় দীনের বাহ্যিক কার্যাবলী পালন না করে, তবে তাত্ত্বিক বিচারে তাকে মু'মিন বলা হবে বটে, কিন্তু ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকে সে মু'মিন নামের উপযুক্ত থাকে না। এ শ্রেণীর লোককে ফাসিক বলা হয়ে থাকে। অনুরূপ যে বাহ্যিক কার্যাবলী যথাযথভাবে আঞ্জাম দেয় কিন্তু বিশ্বাসের মধ্যে ঘাটতি রয়েছে, তাকেও তাত্ত্বিক বিচারে মুসলিম বলা হবে বটে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে মুসিলম নয়। পরিভাষায় এরূপ লোককে মুনাফিক ও যিনদীক বলা হয়ে থাকে। প্রকৃত মুসলিম হওয়ার জন্য শরী'আতের অনুসরণ তথা বাহ্যিক কার্যাবলী আঞ্জাম দেওয়ার সাথে সাথে যথার্থ ‘আকীদা-বিশ্বাসেরও অধিকারী হতে হবে।
এমনিভাবে প্রকৃত মুমিন হতে হলে আকীদা-বিশ্বাস ঠিক রাখার পাশাপাশি শরী'আতেরও অনুসরণ করতে হবে।
কুরআন-হাদীছের ব্যাপক ব্যবহারের প্রতি লক্ষ করলে উপলব্ধি করা যায়, আল্লাহ তাআলা ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে পূর্ণাঙ্গ মুসলিম ও পূর্ণাঙ্গ মুমিনই কাম্য। অর্থাৎ প্রত্যেকেই যেন বিশুদ্ধ 'আকীদা-বিশ্বাস পোষণ করার পাশাপাশি বাহ্যিক কার্যাবলী তথ্য শরী'আতেরও অনুসরণ করে। কিংবা বলুন শরী'আতের অনুসরণ করার সাথে সাথে বিশুদ্ধ ‘আকীদা-বিশ্বাসেরও অধিকারী হয়। সেজন্যই দেখা যায় । বাহ্যিক কার্যাবলীর জন্য যেমন ইসলাম শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, তেমনি কোথাও কোথাও এর জন্য ঈমান শব্দও ব্যবহৃত হয়েছে। আলোচ্য হাদীছে যে সকল বিষয়কে ইসলাম শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করা হয়েছে, 'ওয়াফদু আব্দিল কায়স' শীর্ষক হাদীছে হুবহু এ বিষয়গুলোকেই সমান বলা হয়েছে। ঈমানের শাখা-প্রশাখা বিষয়ক সুপ্রসিদ্ধ হাদীছে আছে
الإيمانُ بضعٌ وسبعون شعبةً ، أعلاها قولُ لا إله إلا اللهُ ، وأدناها إماطةُ الأذى عن الطريقِ والْحَياءُ شُعْبَةٌ مِنَ الإيمانِ.
‘ঈমানের সত্তরটিরও বেশি শাখা আছে। তার মধ্যে সর্বোচ্চ শাখা হল এই সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনও মা'বুদ নেই। আর সর্বনিম্ন শাখা রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে দেওয়া। এবং লজ্জাশীলতা ঈমানের (গুরুত্বপূর্ণ) শাখা।” “এ হাদীছেও বাহ্যিক কার্যাবলীকে ঈমান নামে অভিহিত করা হয়েছে।
একবার এক যুদ্ধে শত্রুপক্ষের একজন বলে উঠল, আমি মুসলিম। তা সত্ত্বেও তাকে জনৈক সাহাবী হত্যা করলেন। তা জানতে পেরে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত নাখোশ হলেন এবং বললেন, কোনও মু'মিন ব্যক্তিকে হত্যা করতে আল্লাহ আমাকে নিষেধ করে দিয়েছেন। এখানে দেখা যাচ্ছে, যে ব্যক্তি নিজেকে মুসলিম বলেছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে মু'মিন নামে অভিহিত করেছেন। এর আরও বহু দৃষ্টান্ত আছে। সারকথা এই যে, কুরআন-হাদীছের সাধারণ ব্যবহারে ঈমান দ্বারা পূর্ণাঙ্গ ঈমান অর্থাৎ বিশ্বাসের সাথে কর্ম এবং ইসলাম দ্বারা পূর্ণাঙ্গ ইসলাম তথা কর্মের সাথে বিশ্বাসও বোঝানো হয়। সুতরাং সাধারণ ব্যবহারে বিশ্বাস ও কর্মের সমন্বিত রূপ তথা পূর্ণাঙ্গ ইসলাম ও পূর্ণাঙ্গ ঈমানের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই।
হযরত জিবরীল আলাইহিস সালামের তৃতীয় প্রশ্ন ও তার উত্তর
হযরত জিবরীল আলাইহিস সালামের তৃতীয় প্রশ্ন ছিল ইহসান সম্পর্কে। নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন- ইহসান এই যে, তুমি আল্লাহর "ইবাদত এমনভাবে করবে যেন তুমি তাকে দেখছ। আর যদি তুমি তাকে নাও দেখো,তবে তিনি তো তোমাকে অবশ্যই দেখছেন।
'ইহসান’-এর শাব্দিক অর্থ কোনও কাজ সুন্দরভাবে করা। এটা 'আদল'-এর উপরের স্তর। আদল হচ্ছে কোনও কাজ যথাযথ নিয়ম রক্ষা করে করা। তাতে কোনও ত্রুটি না রাখা। আর ইহসান হচ্ছে সে কাজ সুষ্ঠুরূপে সম্পন্ন করেই ক্ষান্ত না হওয়া, বরং তাতে আরও বাড়তি সৌন্দর্য আরোপ করা। কারও সাথে লেনদেন দ্বারা এ উদাহরণ দেওয়া যায় যে, শাহেদ হাশেমের কাছে যা পাবে, শাহেদ তা পুরোপুরি আদায় করে নিল। আর হাশেম তার কাছে যা পাবে তা পুরোপুরি পরিশোধ করল, এটা আদল। কেননা এ লেনদেন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা হয়েছে, কোনও ত্রুটি রাখা হয়নি। কিন্তু এতে বাড়তি কোনও সৌন্দর্য পাওয়া যায় না। কোনও মহানুভবতা লক্ষ করা যায়। না। তাই একে ইহসান বলা যাবে না। ইহসান হবে তখন, যখন হাশেম শাহেদকে তার প্রাপ্যের চেয়েও বেশি দেবে এবং সে তার কাছে যা পাবে তারচে' কম নেবে।
এ হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহসানের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তাতে এই বাড়তি সৌন্দর্যের ব্যাপারটা আছে। কেবল ফরয, ওয়াজিব আদায় করে ক্ষান্ত হলে যে 'ইবাদত হবে, তা হবে আদলের পর্যায়ে। ইহুসান হবে যখন সে ইবাদত করা হবে এ মনোভাবের সাথে, যেন ইবাদতকারী আল্লাহ তা'আলাকে দেখছে। এটা ইহসানের প্রথম স্তর। একে 'মুশাহাদা' বা আল্লাহদর্শন বলে। আমি আল্লাহ তা'আলাকে দেখছি, আমি তাঁর কাছে তিনি আমার সামনে অন্তরে এই ধ্যান থাকলে আল্লাহর ভয়, শ্রদ্ধাভক্তি এবং খুশূ'-হুযু' বেড়ে যাবে। ফলে ‘ইবাদতে বাড়তি যত্ন নেওয়া হবে এবং তাকে যতটা সম্ভব সুন্দর ও সুচারু করে তোলার চেষ্টা করা হবে। নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কিরামকে এরকম মনোভাবের সাথে ইবাদত-বন্দেগী করার হুকুম দিতেন। এবং সাধারণত সাহাবায়ে কিরাম এভাবেই ইবাদত-বন্দেগী করতেন। তাঁরা কেবল নামাযই নয়, অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগী এমনকি পার্থিব কাজকর্মও এমনভাবে আঞ্জাম দিতেন, যেন আল্লাহ সামনে আছেন এবং তাঁরা তাঁকে দেখতে পাচ্ছেন।
অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যদি তুমি তাঁকে নাও দেখ, তবে তিনি তো তোমাকে অবশ্যই দেখছেন। এ বাক্যের দু'রকম ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে।
এক ব্যাখ্যা অনুযায়ী এটা ইহসানের দ্বিতীয় স্তর। একে মুরাকাবা বলে। এর দ্বারা ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, যার পক্ষে ইহসানের প্রথম স্তরে উঠা অর্থাৎ মুশাহাদা বা আল্লাহদর্শন কঠিন মনে হয় সে ইহসানের দ্বিতীয় স্তর তথা মুরাকাবার সাথে ইবাদত করবে। সে চিন্তা করবে আল্লাহ আমাকে দেখছেন। তিনি আমার ভেতর-বাহির সবকিছু সম্পর্কে অবগত। এর দ্বারাও মূল উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে যাবে। অর্থাৎ এই ধ্যানের সাথে ইবাদত করলে সুন্দর ও সুচারুরূপে ইবাদত করা সম্ভব হবে। বুযুর্গানে দীন বলেন, তুমি আল্লাহকে ভয় কর তোমার প্রতি আল্লাহর শক্তি ও ক্ষমতা অনুপাতে এবং তাঁকে লজ্জা কর তোমার কাছে তাঁর নৈকট্য অনুসারে।
ইহসানের এ স্তরকে ইখলাসের মাকাম ও বলা হয়। যে ব্যক্তি এই ভাবনার সাথে ইবাদত করবে যে, আল্লাহ তা'আলা তাকে দেখছেন, তিনি তার কাছে আছেন এবং তিনি তার সম্পর্কে পূর্ণ অবগত, তখন তার ধ্যান গায়রুল্লাহ থেকে ছিন্ন হয়ে আল্লাহর প্রতি নিবেদিত থাকবে। তার লক্ষ্য মাখলুক থেকে সরে গিয়ে মা'বুদেরই অভিমুখী থাকবে। এরূপ ব্যক্তিকে বলা হয় মুখলিস।
ইবন হাজার আসকালানী রহ বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম মূলত এখানে ইহসানের দুটি স্তর উল্লেখ করেছেন। তার মধ্যে উচ্চতর স্তর হচ্ছে মুশাহাদা অর্থাৎ বান্দা এ মনোভাবের সাথে ইবাদত করবে, যেন সে নিজ চোখে তাকে দেখতে পাচ্ছে। প্রথম বাক্যে এই স্তর বর্ণিত হয়েছে। দ্বিতীয় বাক্যে বর্ণিত হয়েছে মুরাকাবার স্তর। অর্থাৎ সে চিন্তা করবে আল্লাহ তা'আলা তার সম্পর্কে পূর্ণ অবগত এবং তিনি তার কর্ম দেখছেন। আল্লাহ তা'আলার মা'রিফাত ও পরিচয় এবং তাঁর খাশয়াত ও ভীতির দ্বারা ইহসানের এই স্তরদু'টি অর্জিত হয়ে থাকে।
দ্বিতীয় ব্যাখ্যা অনুযায়ী 'তুমি তাঁকে দেখছ'- এ কথাটি দ্বারা ইহসানের দ্বিতীয় স্তর (মুরাকাবা) বোঝানো উদ্দেশ্য নয়; বরং এটি প্রথম বাক্যে বর্ণিত মুশাহাদার কারণস্বরূপ । অর্থাৎ বান্দাকে যখন হুকুম দেওয়া হল সে ইবাদতের ভেতর আল্লাহ তা'আলার মুরাকাবা করবে এবং তাঁকে নিজের সামনে হাজির বলে চিন্তা করবে, যেন সে তাঁকে দেখতে পাচ্ছে, তখন তার কাছে মনে হতে পারে ব্যাপারটা তো অনেক কঠিন। আমার মত দুর্বল বান্দার পক্ষে এমন কঠিন ধ্যান কিভাবে সম্ভব? এ বাক্যে বলে দেওয়া হয়েছে ব্যাপারটা খুব কঠিন নয়। কেননা তোমার তো ঈমান আছে যে, তিনি তোমাকে দেখছেন। তিনি তোমার ভেতর ও বাহির সম্পর্কে অবহিত। তোমার প্রকাশ্য ও গুপ্ত সবকিছুই জানেন। তাঁর কাছে তোমার কিছুই গোপন থাকে না। তো তুমি তোমার বিশ্বাসের এই স্তরটি যদি ধ্যান করতে থাক, তবে একপর্যায়ে তোমার পক্ষে পরবর্তী স্তরে আরোহন সহজ হয়ে যাবে। তখন তুমি এ ধ্যানও করতে পারবে যে, আল্লাহ আমার সামনে আছেন, আমি যেন তাঁকে দেখতে পাচ্ছি।
ইমাম নববী রহ. বলেন, আমদের কেউ যদি ইবাদত অবস্থায় এ চিন্তা করে যে, সে তার প্রতিপালককে দেখছে, তবে সে যথাসম্ভব খুশু-খুযু' রক্ষা করবে, সুন্দর ও সুচারুরূপে ইবাদত করবে, বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিখুঁতভাবে কাজে লাগাবে, পরিপূর্ণরূপে আল্লাহর অভিমুখী থাকবে এবং সর্বোতপ্রকারে তার ইবাদত পরিপূর্ণ করে তোলার চেষ্টা করবে। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছেন- তুমি সর্বাবস্থায় আল্লাহর ইবাদত কর তাঁকে নিজ চোখে দেখে ইবাদত করার মত। নিজ চোখে দেখা অবস্থায় ইবাদতে পূর্ণতা আসে এ কারণে যে, বান্দা জানে আল্লাহ তা'আলা তার সম্পর্কে পূর্ণ অবগত। আর তা জানে বলেই এ অবস্থায় সে কোনও ত্রুটি করে না। আর এ ব্যাপারটা তো ওই অবস্থায়ও বিদ্যমান থাকে, যখন সে তাঁকে দেখতে পায় না কিছু এ বিশ্বাস আছে যে, তিনি তাকে দেখেন। বস্তুত হাদীছের উদ্দেশ্য হচ্ছে বান্দাকে তার ইবাদতে ইখলাস ও মুরাকাবায় উদ্বুদ্ধ করা, যাতে তার ইবাদতে খুশু খুযু ইত্যাদি পরিপূর্ণরূপে বিদ্যমান থাকে। ইহসানের সাথে ইবাদত করলে তা অবশ্যই থাকবে। কেননা বুযুর্গানে দীন সালিহীনের সাহচর্য অবলম্বন করতে বলে থাকেন তো এ কারণেই যে, তা অন্যায়-অপরাধে লিপ্ত হওয়ার পথে বাধা হয়। তা বাধা হয় তাদের প্রতি ইহুতিরাম ও শ্রদ্ধাবোধের কারণে এবং তাদের লজ্জায়। সালিহীনের সম্মান রক্ষা তাদের লজ্জার কারণে যদি মানুষ অন্যায়-অনাচার থেকে দূরে থাকে, তাহলে যে আল্লাহ মানুষের ভেতর-বাহির সবকিছু সম্পর্কে অবগত এবং তার প্রকাশ্য-গুপ্ত সবকিছু জানেন তাঁর ধ্যান কেন ভুল-ত্রুটি করার পক্ষে বাধা হবে না? মোটকথা হাদীছ বোঝাচ্ছে, তুমি যখন আল্লাহ তা'আলাকে দেখছ বলে মনে কর, তখন তো ইবাদতের যাবতীয় আদর রক্ষা কর কেবল এ কারণে যে, তিনি তোমাকে দেখছেন। কেবল তুমি তাঁকে দেখছ- এ কারণে নয়। তো তিনি সর্বদাই তোমাকে দেখছেন। সুতরাং তাঁর ইবাদত সুন্দরভাবে। আদায় কর, যদিও তুমি তাঁকে দেখতে না পাও। সংক্ষেপ কথা- তুমি সর্বদা আল্লাহর ইবাদত সুন্দর ও সুচারুরূপে আদায় করতে থাক, কেননা তিনি তোমায় দেখছেন।
হযরত জিবরীল আলাইহিস সালামের চতুর্থ প্রশ্ন ও তার উত্তর
হযরত জিবরীল আলাইহিস সালামের চতুর্থ প্রশ্ন ছিল কিয়ামত সম্পর্কে যে, তা কবে সংঘটিত হবে? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বলেছেন, এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত ব্যক্তি জিজ্ঞাসাকারী অপেক্ষা বেশি জানে না। অর্থাৎ কিয়ামত কবে হবে সে সম্পর্কে সমস্ত মাখলুকের ‘ইলম একই পর্যায়ের। অর্থাৎ তারা কেউ তা জানে না। এ কারণেই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে এ কথা বলেননি যে, এ সম্পর্কে আমি আপনার চেয়ে বেশি জানি না। বাহ্যত সেরকম বলারই কথা ছিল। তা না বলে এরকম ব্যাপকতার সাথে বলেছেন এদিকে ইঙ্গিত করার জন্য যে, কিয়ামতের আগ পর্যন্ত এ প্রশ্ন যাকেই করা হবে সে কেবল অজ্ঞতাই প্রকাশ করতে পারবে। কারও পক্ষেই বলা সম্ভব হবে না যে, কিয়ামত কবে হবে। কোনও কালেই এ সম্পর্কে কোনও জিজ্ঞাসিত ব্যক্তি জিজ্ঞাসাকারী অপেক্ষা বেশি জানার প্রমাণ দিতে পারবে না। বস্তুত এ সম্পর্কিত জ্ঞান আল্লাহ তা'আলা তাঁর নিজের জন্য নির্দিষ্ট করে রেখেছেন। হযরত আবু হুরায়রা রাযি. বর্ণিত এক হাদীছে আছে, নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, এটা ওই পাঁচ বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত, যা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। তারপর তিনি পাঠ করেনঃ
إِنَّ اللَّهَ عِندَهُ عِلْمُ السَّاعَةِ وَيُنَزِّلُ الْغَيْثَ وَيَعْلَمُ مَا فِي الْأَرْحَامِ ۖ وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ مَّاذَا تَكْسِبُ غَدًا ۖ وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ بِأَيِّ أَرْضٍ تَمُوتُ ۚ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ
অর্থঃ নিশ্চয় আল্লাহর কাছেই কেয়ামতের জ্ঞান রয়েছে। তিনিই বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং গর্ভাশয়ে যা থাকে, তিনি তা জানেন। কেউ জানে না আগামীকল্য সে কি উপার্জন করবে এবং কেউ জানে না কোন দেশে সে মৃত্যুবরণ করবে। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সর্ববিষয়ে সম্যক জ্ঞাত।
কিয়ামতের আলামত
সবশেষে হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম কিয়ামতের আলামত জানতে চাইলেন। উত্তরে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- (ক) দাসী তার কর্ত্রীকে জন্ম দেবে এবং (খ) খালি পা ও নগ্ন শরীরের অভাবী মেষ রাখালদের দেখতে পাবে। (একসময়) উঁচু উঁচু ভবন নির্মাণে পরস্পর প্রতিযোগিতা করছে।
এখানে কিয়ামতের দু'টি আলামত বর্ণিত হয়েছে। (ক) দাসী দ্বারা তার কর্ত্রীর জন্ম দেওয়া। দাসী কিভাবে কর্ত্রীকে জন্ম দেবে, উলামায়ে কিরাম তার বিভিন্ন ব্যাখ্যা করেছেন। তার মধ্যে একটি এই- ছেলেমেয়ে তার মায়ের সাথে দাসীর মত আচরণ করবে। মনিব দাস-দাসীকে হুকুম দেয়। দাস-দাসী তা পালন করে। পালন না করলে। মেক দেওয়া হয়। ক্ষেত্রবিশেষে শাস্তি দেওয়া হয়। এর বিপরীত হয় না। দাস-দাসী মনিবকে হুকুম দেয় না। হুকুম দেওয়ার সাহস করে না। পিতামাতা ও সন্তানের। ব্যাপারটাও কিয়ামতের আগে এরকমই হবে। সন্তান পিতামাতাকে দাস-দাসীর মত হুকুম করবে। ধমক দিয়ে কথা বলবে। আরও বেশি হতভাগা হলে নির্যাতনও করবে। পিতামাতা সন্তানকে কোনও হুকুম দেওয়ার সাহস করবে না। ধমক দেওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। এককথায় কিয়ামতের আগে ব্যাপকভাবে পিতামাতার অবাধ্যতা করা হবে। সে কাল কি এসে গেল?
(খ) জুতা ও জামা-কাপড় নেই এমন অভাবী রাখালদের উঁচু উঁচু ভবন নির্মাণে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়া। এর মানে নিম্ন শ্রেণীর লোকের উপরে উঠে যাওয়া। তারা হবে দেশের নেতা, প্রচুর টাকা-পয়সার মালিক হয়ে যাবে এবং কে কার চেয়ে শানদার বাড়ি বানাতে পারে সেই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে পড়বে। হযরত হুযায়ফা রাযি. বর্ণিত এক হাদীছে আছে, ততদিন কিয়ামত সংঘটিত হবে না, যতদিন না দুনিয়ায় সর্বাপেক্ষা বিত্তবান হবে নিম্ন শ্রেণীর মানুষ। হযরত আবূ যর্র রাযি. বর্ণিত হাদীছে আছে, নিম্ন শ্রেণীর মানুষ প্রভাবশালী হয়ে যাবে। হযরত আনাস রাগি, বর্ণিত হাদীছে আছে, নির্বোধ শ্রণীর মানুষ সমষ্টিগত বিষয়ে কথা বলবে। এক বর্ণনায় আছে, ফাসিক লোকে জনসাধারণের বিষয়ে কথা বলবে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন 'আমর রা. বর্ণিত হাদীছে আছে, শ্রেষ্ঠ মানুষদের নিচে ফেলে রাখা হবে আর মন্দ লোকদের উপরে উঠে হবে। এক বর্ণনায় আছে, প্রত্যেক গোত্রের নেতৃত্ব দেবে মুনাফিক শ্রেণীর লোক। সবগুলো বর্ণনার সারমর্ম হল কিয়ামতের আগে অবস্থা সম্পূর্ণ উল্টে যাবে। জাহেল ও ফাসিক শ্রেণীর লোক বিপুল অর্থের মালিক হবে এবং সমাজের নেতৃত্ব দান করবে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাদীছে সংক্ষেপে বলেছেন
إذا وسد الأمر إلى غير أهله فالنظر الساعة
'যখন অযোগ্য লোকের উপর রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব অর্পণ করা হবে, তখন কিয়ামতের অপেক্ষা কর।"
হতদরিদ্র রাখালের ইলম ও আদব-কায়দা শেখার অবকাশ কোথায়? হঠাৎ করেই এরা যখন বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়ে যাবে এবং দেশের নেতৃত্ব লাভ করবে, তখন তাদের আচার-আচরণ কেমন হবে সহজেই অনুমেয়। তারা হালাল-হারাম নির্বিচারে নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত থাকবে। মানুষের হক আদায় তো করবেই না, উল্টো তাদের উপর জুলুম-নির্যাতন চালাবে। এ শ্রেণীর মানুষের কাছে দীনদার ও চরিত্রবান লোকের কোনও মর্যাদা থাকবে না। তারা তাকওয়া-পরহেযগারীর মূল্য দেবে না। সর্বদা অসৎ ও দুর্বৃত্তপরায়ণ লোকই তাদের ঘিরে রাখবে। তাদেরকে তারা বেশি আশ্রয়-প্রশ্রয় দেবে। তাদের উৎপাতে সমাজের শান্তি-শৃংখলা ধ্বংস হবে। সুশিক্ষা ও তালীম তরবিয়াতের মেহনত বন্ধ হয়ে যাবে। সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের পরিবেশ থাকবে না। ফলে মানুষের আখলাক-চরিত্রের ব্যাপক অবক্ষয় ঘটবে। সর্বত্র অন্যায়-অনাচার ছড়িয়ে পড়বে। সারা জাহান পাপাচারে পঙ্কিল হয়ে যাবে। এহেন পাপ পঙ্কিল জগতকে বাকি রাখার প্রয়োজন আল্লাহ তা'আলার থাকবে না। অচিরেই কিয়ামত হয়ে যাবে।
এ হাদীছে কিয়ামতের আলামত হিসেবে বিশেষভাবে উঁচু ভবন নির্মাণে প্রতিযোগিতার কথা বলা হয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের যমানায় উঁচু দালান-কোঠা নির্মাণের রেওয়াজ ছিল না। তখন বাড়ি-ঘর হত নিচু। কেবল প্রয়োজন পরিমাণ। উম্মাহাতুল মু'মিনীন (নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীগণ) এর ঘর কেমন ছিল? কতটুকু উঁচু ছিল? হযরত হাসান বসরী রহ. বলেন, আমি হযরত ‘উছমান রাযি.-এর আমলে তাঁদের ঘরে প্রবেশ করতাম। আমি উপরে হাত তুলে দেখেছি আমার হাত ছাদে লেগে যায়। উঁচু ঘর করার রেওয়াজ হয়েছে পরবর্তীকালে। যখন ইরান ও রোম পরাজিত হয়, তাদের দেশ মুসলমানদের অধিকারে আসে, তখন তাদের দেখাদেখি মুসলিমগণও বিশেষত মুসলিম রাজা-বাদশাগণ উঁচু অট্টালিকা নির্মাণে মনোযোগী হয়ে পড়ে। অধঃপতনের শুরু তখন থেকেই।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা ইহসান ও মুরাকাবার শিক্ষা পাওয়া যায়। সুন্দর আমল ও আদর্শ জীবন গড়ার লক্ষ্যে মুরাকাবার কোনও বিকল্প নেই। জীবনের প্রতিটি কাজেই 'আল্লাহ দেখছেন এ ধ্যান অন্তরে জাগ্রত রাখা উচিত।
খ. অজানা বিষয়ে প্রশ্ন করা জ্ঞান অর্জনের একটি উৎকৃষ্ট পন্থা।
গ. অন্যদের শিক্ষাদান করারও একটি ভালো উপায় তাদের সামনে 'আলেম ও জ্ঞানীজনকে প্রশ্ন করা।
ঘ. যে বিষয়ে জানা নেই, সে বিষয়ে কেউ জিজ্ঞেস করলে স্পষ্ট বলে দেওয়া উচিত আমি জানি না।
ঙ. নিজ বাসগৃহ প্রয়োজনের অতিরিক্ত বড় ও উঁচু করা পসন্দনীয় নয়।
এ হাদীছে এছাড়া আরও বহু শিক্ষা আছে। মনোযোগী পাঠকের পক্ষে সহজেই তা উপলব্ধি করা সম্ভব।
