মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)

৩১- সাহাবায়ে কিরামের রাঃ মানাকিব ও ফাযায়েল

হাদীস নং: ৬২৬৬
প্রথম অনুচ্ছেদ - ইয়ামান ও শাম (সিরিয়া) দেশের বর্ণনা এবং উওয়াইস করানী-এর আলোচনা
৬২৬৬। হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) হইতে বর্ণিত, একদা রাসুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলিয়াছেন ইয়ামন দেশ হইতে এক ব্যক্তি তোমাদের নিকট আসিবে। তাহার নাম হইবে “ওয়াইস।" একজন মাতা ছাড়া ইয়ামন দেশে তাঁহার আর কোন নিকটতম আত্মীয়-স্বজন থাকিবে না। তাঁহার দেহে ছিল শ্বেত-ব্যাধি। ইহার জন্য তিনি আল্লাহর কাছে দোআ করিয়াছিলেন। ফলে এক দিরহাম অথবা এক দীনার পরিমাণ জায়গা ব্যতীত আল্লাহ্ তা'আলা তাহার সেই রোগটি দূর করিয়া দিয়াছেন। সুতরাং, তোমাদের যে কেহ তাহার সাক্ষাৎ পাইবে, সে যেন নিজের মাগফিরাতের জন্য তাহার দ্বারা দো'আ করায়। অপর রেওয়ায়তে আছে, হযরত ওমর (রাঃ) বলিয়াছেন, আমি রাসুলুল্লাহ্ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলিতে শুনিয়াছি, তাবেয়ীদের মধ্যে সর্বোত্তম এক ব্যক্তি, তাহার নাম "ওয়াইস", তাহার শুধুমাত্র একজন মা রহিয়াছেন এবং তাহার শরীরে শ্বেত দাগ থাকিবে। সুতরাং, তোমরা নিজেদের মাগফিরাতের দোআর জন্য তাঁহার কাছে অনুরোধ করিবে। -মুসলিম
بَابُ ذِكْرِ الْيَمَنِ وَالشَّامِ وَذِكْرِ أُوَيْسٍ الْقَرَنِيِّ: الْفَصْل الأول
عَن عمر بن الْخطاب أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: إِنَّ رَجُلًا يَأْتِيكُمْ مِنَ الْيَمَنِ يُقَالُ لَهُ: أُوَيْسٌ لَا يَدَعُ بِالْيَمَنِ غَيْرَ أُمٍّ لَهُ قَدْ كَانَ بِهِ بَيَاضٌ فَدَعَا اللَّهَ فَأَذْهَبَهُ إِلَّا مَوْضِعَ الدِّينَارِ أَوِ الدِّرْهَمِ فَمَنْ لَقِيَهُ مِنْكُمْ فَلْيَسْتَغْفِرْ لَكُمْ وَفِي رِوَايَةٍ قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسلم يَقُولُ: إِنَّ خَيْرَ التَّابِعِينَ رَجُلٌ يُقَالُ لَهُ: أُويس وَله والدةٌ وَكَانَ بِهِ بَيَاض فَمُرُوهُ فليستغفر لكم . رَوَاهُ مُسلم

হাদীসের ব্যাখ্যা:

১. পৃথিবীর মানচিত্রে ভূখণ্ডের মূল কেন্দ্রস্থল হইল বায়তুল্লাহ্ বা কা'বা শরীফ। সুতরাং দিক নির্ণয়ের উহাই হইল কেন্দ্রবিন্দু। يمن “ইয়ামন” শব্দটি মূলত يمين “ইয়ামীন” হইতে উৎপন্ন এবং شام “শাম” উহার বিপরীত شمال “শিমাল” হইতে নির্গত। “ইয়ামন” (যাহার অর্থ ডান,) ভূখণ্ডটি কা'বা শরীফের ডানে অবস্থিত এবং “সিরিয়া” উহার বামে অবস্থিত। “কারন” ইয়ামন দেশের একটি বস্তি বা শহরের নাম। “ওয়াইস” একজন প্রসিদ্ধ যুগ-সাধক তাবেয়ী। ওয়াইস ছিলেন নবী (ﷺ)-এর যুগের লোক। তবে নিজ দেশে থাকিয়াই তিনি ঈমান আনিয়াছেন। তাঁহার একমাত্র মা ছাড়া দুনিয়াতে আর কোন পরিজন ছিল না। গোটা জীবন তিনি মায়ের খেদমতে আত্মোৎসর্গ করিয়াছিলেন। মায়ের খেদমতে বিঘ্ন ঘটিতে পারে, এই ধারণায় তিনি নবী (ﷺ)-এর সাহচর্য লাভ করা হইতেও বিরত রহিয়াছিলেন। অথচ নবী (ﷺ) তাঁহাকে চাক্ষুষ না দেখিয়াও সাহাবীগণের নিকট তাঁহার প্রশংসা করিয়া গিয়াছেন। দুনিয়াতে তিনি “আশেকে রাসূল” হিসাবে চিরস্মরণীয় হইয়া আছেন। তাঁহার জীবন-ইতিহাস খুবই রোমাঞ্চকর। সুতরাং বিভিন্ন কারণে ইয়ামন দেশের বর্ণনায় “ওয়াইস করনী”র আলোচনাকে বিশেষভাবে স্থান দেওয়া হইয়াছে।

তাবেয়ী অপেক্ষা সাহাবীর মর্যাদা অনেক বেশী, ইহাতে সন্দেহ নাই। তবে মর্যাদায় নিম্নস্তরের হইলেও নেককার, বুযুর্গ ব্যক্তির কাছে দোআর জন্য আবদার করা যায়।

২. হযরত উয়ায়স আল-কারনী রহ. একজন উচ্চস্তরের আল্লাহওয়ালা ছিলেন। তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগ পেয়েছিলেন। কিন্তু মায়ের খেদমতে নিয়োজিত থাকায় তাঁর পক্ষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাক্ষাতলাভ সম্ভব হয়নি। ফলে সাহাবী হওয়ার সৌভাগ্য তিনি লাভ করতে পারেননি। তবে তাবি‘ঈ হিসেবে তাঁর মর্যাদা অতি উচ্চে।

হাদীছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উক্তি বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি শ্রেষ্ঠতম তাবি'ঈ। অবশ্য সর্বশ্রেষ্ঠ তাবি'ঈ কে, এ সম্পর্কে বিভিন্ন মত আছে। কারও মতে হযরত সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব রহ.। কারও মতে হযরত যায়নুল আবিদীন আলী ইবনুল হুসায়ন রহ.। তাছাড়া আবূ উছমান নাহ্দী রহ., আলকামা রহ কায়স ইবন আবী হাযিম রহ. ও হাসান বসরী রহ.-কেও শ্রেষ্ঠতম তাবি'ঈ বলা হয়েছে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে যেহেতু স্পষ্টভাবে উয়ায়স আল-কারনী রহ.-কে শ্রেষ্ঠ তাবি'ঈর সনদ দেওয়া হয়েছে, তখন সাধারণভাবে তাঁকেই শ্রেষ্ঠ তাবি‘ঈ গণ্য করা উচিত। অন্য যাদেরকে শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে, তা বিশেষ বিশেষ বিবেচনায়। যেমন হযরত সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব রহ. শ্রেষ্ঠ ছিলেন তাফসীর, হাদীছ প্রভৃতি ইলমের বিবেচনায়। হযরত আলকামা রহ. শ্রেষ্ঠ ছিলেন ফকীহ হিসেবে। হযরত হাসান বসরী রহ. শ্রেষ্ঠ ছিলেন ইলম, যুহদ ইত্যাদির বিচারে। এভাবে একেকজন একেক বিবেচনায় শ্রেষ্ঠ তাবি'ঈ ছিলেন। কিন্তু আল্লাহ তাআলার কাছে মর্যাদা ও নৈকট্যের দিক থেকে উয়ায়স আল-কারনী রহ.-ই সবার সেরা।

উয়ায়স আল-কারনী রহ.-এর এত উচ্চমর্যাদার কারণ বিবিধ। তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য তাঁর মাতৃভক্তি। মায়ের সেবাযত্নে নিয়োজিত থাকার কারণে এমনকি তিনি সাহাবী হওয়ার সৌভাগ্যলাভকে পর্যন্ত ত্যাগ করেছিলেন।

তাঁর একটি বিশেষ গুণ ছিল প্রচারবিমুখতা। তিনি নিভৃত, অজ্ঞাত ও অখ্যাত জীবন ভালোবাসতেন। যেমন হাদীছে তাঁর এ উক্তি উদ্ধৃত হয়েছে যে- أَكُونُ فِي غَبْرَاءِ النَّاسِ أَحَبُّ إِلَيَّ (আমি গরীব ও অখ্যাত লোকদের একজন হয়ে থাকাই বেশি পসন্দ করি)। ফলে যখন তাঁর সম্পর্কে জানাজানি হয়ে গেল, তখন সম্পূর্ণ নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন। বিভিন্ন হাদীছ দ্বারা জানা যায়, অখ্যাত অজ্ঞাত থাকা আল্লাহ তাআলার কাছেও পসন্দ।

হযরত উয়ায়স রহ. ছিলেন অত্যন্ত দুনিয়াবিমুখ। দুনিয়ার প্রতি তাঁর বিন্দুমাত্র আসক্তি ও লোভ-লালসা ছিল না। খুবই গরীবানা হালে দিন কাটাতেন। হযরত উমর ফারূক রাযি. তাঁর সম্পর্কে ‍কূফার আমীরকে কিছু লিখে দিতে চাইলে তিনি তাতে অসম্মতি জানান এবং সাধারণ জীবনযাপনের প্রতিই নিজ আগ্রহ ব্যক্ত করেন। এসব গুণের প্রত্যেকটিই আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি ও নৈকট্যলাভের অতি বড় উপায়।

হাদীছে আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত উমর ফারূক রাযি.-কে হুকুম দিয়েছিলেন- যদি উয়ায়সের সাক্ষাত পান, তবে তার কাছে যেন গুনাহমাফীর দুআ চান।
এর দ্বারা এ কথা বোঝার কোনও সুযোগ নেই যে, তিনি হযরত উমর রাযি.-এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ ছিলেন। উয়ায়স আল-কারনী রহ. অনেক বড় বুযুর্গ ছিলেন বটে, কিন্তু ছিলেন তিনি একজন তাবি'ঈ। যে-কোনও তাবি'ঈ অপেক্ষা যে-কোনও সাহাবীর মর্যাদা অনেক উপরে। হযরত উমর ফারূক রাযি. শুধু সাহাবীই নন; সাহাবীদের মধ্যেও সর্বোচ্চ স্তরের। তিনি হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর পরেই এ উম্মতের শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তি। কাজেই তাঁর তুলনায় কোনও তাবি'ঈ বা অন্য কোনও ওলী-বুযুর্গের শ্রেষ্ঠ হওয়ার প্রশ্নই আসে না।

বস্তুত উয়ায়স আল-কারনী রহ.-এর কাছে গুনাহমাফীর দুআ চাইতে বলা হয়েছে বাড়তি ফযীলতলাভের উদ্দেশ্যে। আল্লাহ তাআলার নৈকট্য ও সন্তুষ্টির স্তর পরিক্রমার কোনও সীমা-পরিসীমা নেই। তাই নৈকট্যের কোনও স্তরে পৌঁছে ক্ষান্ত ও পরিতৃপ্ত হয়ে যাওয়ারও অবকাশ নেই। এ পথের অভিযাত্রীগণ আল্লাহ তাআলার নৈকট্যের যত উচ্চতায় উপনীত হতে থাকেন, ততই তাদের আরও উচ্চতায় উন্নীত হওয়ার আগ্রহ অদম্য হয়ে ওঠে। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রিয় সাহাবীদেরকে সে অদম্য আগ্রহে উদ্দীপিত করে তোলার প্রতি লক্ষ রাখতেন। উয়ায়স আল-কারনীর কাছে দুআ চাওয়ার উপদেশদান সেরকমই এক প্রণোদনাবিশেষ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও তো একবার হযরত উমর ফারূক রাযি.-কে বলেছিলেন-

لاَ تَنْسَنَا يَا أَخَيَّ مِنْ دُعَائِكَ

(ওহে প্রিয় ভাই! তোমার দুআয় আমাদের ভুলে যেও না),

তিনি আমাদেরকেও উৎসাহ দিয়েছেন যেন তাঁর জন্য রহমতের দুআ করি এবং তাঁর প্রতি সালাত ও সালাম পাঠ করি। আমাদেরকে তাঁর জন্য ওয়াসীলা ও মাকামে মাহমূদের দুআ করার শিক্ষাদান করা হয়েছে।

সুতরাং ছোট বড়'র কাছে, বড় ছোট'র কাছে, সাধারণ ব্যক্তি বুযুর্গের কাছে এবং বুযুর্গ ব্যক্তি সাধারণ লোকের কাছে, এমনিভাবে যে-কেউ যে-কারও কাছে দুআ চাইতে পারে। অবশ্য বিভিন্ন হাদীছ দ্বারা বিশেষভাবে আল্লাহওয়ালা ও নেককার ব্যক্তিদের কাছে দুআ চাওয়ার প্রতি উৎসাহ পাওয়া যায়।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. পিতা-মাতার সেবাযত্ন করা আল্লাহ তাআলার নৈকট্য ও সন্তুষ্টিলাভের একটি উপায়।

খ. প্রচারবিমুখ থাকা আল্লাহওয়ালাদের বৈশিষ্ট্য। এটি ইখলাস রক্ষার পক্ষে সহায়ক।

গ. তুচ্ছ বেশভূষা ও গরীবী হাল দেখে কাউকে হেলা করতে নেই, বাস্তবিকপক্ষে সে আল্লাহ তাআলার অনেক প্রিয় ও নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দা হতে পারে।

ঘ. আল্লাহওয়ালা ও নেককার ব্যক্তিদের কাছে দুআ চাওয়া উচিত, বিশেষত নিজ গুনাহমাফীর জন্য।
২. ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
মিশকাতুল মাসাবীহ - হাদীস নং ৬২৬৬ | মুসলিম বাংলা