মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)
৩০- নবীজী সাঃ এর মর্যাদা ও শামাঈল অধ্যায়
হাদীস নং: ৫৮৪৬
প্রথম অনুচ্ছেদ - রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর নুবুওয়্যাতপ্রাপ্তি ও ওয়াহীর সূচনা
৫৮৪৬। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, যখন (ভীতি প্রদর্শন সম্পৰ্কীয়) আয়াত (অর্থাৎ) "তুমি তোমার নিকটতম আত্মীয়দিগকে হুঁশিয়ার করিয়া দাও" নাযিল হইল, তখন নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাফা পাহাড়ে আরোহণ করিয়া – হে বনী ফিহর! হে বনী আদী! বলিয়া কুরাইশদের গোত্রসমূহকে ডাক দিলেন। অবশেষে তথায় সকলে সমবেত হইল। এমন কি যাহারা স্বয়ং উপস্থিত হইতে পারে নাই, তাহারা প্রতিনিধি পাঠাইয়া জানিতে চাহিল যে, ব্যাপার কি? বিশেষতঃ আবু লাহাব এবং কুরাইশের সর্বসাধারণ লোকেরাও আসিল। তখন নবী (ছাঃ) বলিলেন: বল তো! যদি আমি তোমাদিগকে বলি যে, (শত্রুপক্ষের) একদল অশ্বারোহী এই পাহাড়ের অপর প্রান্ত হইতে—অপর এক বর্ণনামতে একদল অশ্বারোহী উপত্যকার এক প্রাপ্ত হইতে বাহির হইয়া অতর্কিতে তোমাদের উপর আক্রমণ করিতে চায়, তোমরা কি আমার এই কথাটি বিশ্বাস করিবে? তাহারা সকলে বলিয়া উঠিল, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। কেননা, বিগত দিনে তোমাকে আমরা সত্যবাদীই পাইয়াছি। তখন রাসূলুল্লাহ্ (ছাঃ) বলিলেন, তোমাদের সম্মুখে আগত এক কঠিন আযাব সম্পর্কে আমি তোমাদেরকে সতর্ক করিতেছি। এতদূশ্রবণে আবু লাহাব বলিয়া উঠিল, তোমার সর্বনাশ হউক। এই জন্যই কি তুমি আমাদিগকে একত্রিত করিয়াছ? বর্ণনাকারী বলেন, তখনই আয়াত – (অর্থাৎ,) “আবু লাহাবের উভয় হাত ধ্বংস হউক, এবং সে ধ্বংস হইয়াছে," নাযিল হইল। — মোত্তাঃ
وَعَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ: لَمَّا نَزَلَتْ [وَأَنْذِرْ عشيرتك الْأَقْرَبين] خَرَجَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَتَّى صَعِدَ الصَّفَا فَجَعَلَ يُنَادِي: «يَا بَنِي فِهْرٍ يَا بني عدي» لبطون قُرَيْش حَتَّى اجْتَمعُوا فَجَعَلَ الرَّجُلُ إِذَا لَمْ يَسْتَطِعْ أَنْ يَخْرُجَ أَرْسَلَ رَسُولًا لِيَنْظُرَ مَا هُوَ فَجَاءَ أَبُو لَهَبٍ وَقُرَيْشٌ فَقَالَ: أَرَأَيْتُمْ إِنْ أَخْبَرْتُكُمْ أَنَّ خيَلاً تخرجُ منْ سَفْحِ هَذَا الْجَبَلِ - وَفِي رِوَايَةٍ: أَنَّ خَيْلًا تَخْرُجُ بِالْوَادِي تُرِيدُ أَنْ تُغِيرَ عَلَيْكُمْ - أَكُنْتُمْ مُصَدِّقِيَّ؟ قَالُوا: نَعَمْ مَا جَرَّبْنَا عَلَيْكَ إِلَّا صِدْقًا. قَالَ: «فَإِنِّي نَذِيرٌ لَكُمْ بَيْنَ يَدَيْ عَذَابٌ شديدٍ» . قَالَ أَبُو لهبٍ: تبّاً لكَ أَلِهَذَا جَمَعْتَنَا؟ فَنَزَلَتْ: [تَبَّتْ يَدَا أَبِي لَهَبٍ وَتَبَّ] مُتَّفق عَلَيْهِ
হাদীসের ব্যাখ্যা:
আল্লাহ তাআলার বাণী - {وَأَنْذِرْ عَشِيرَتَكَ الْأَقْرَبِينَ} ‘তোমার নিকটাত্মীয়স্বজনকে সতর্ক কর’
عَشِيرَة অর্থ জ্ঞাতিগোষ্ঠী। الْأَقْرَبِينَ অর্থ নিকটবর্তী। এ আয়াতে জ্ঞাতিগোষ্ঠীর মধ্যে যারা নিকটবর্তী, তাদেরকে সতর্ক করার হুকুম দেওয়া হয়েছে। বুঝানো উদ্দেশ্য তারা যে ভ্রান্ত ধর্মের অনুসরণ করে নিজেদেরকে জাহান্নামের শাস্তির উপযুক্ত করে ফেলছে, এ ব্যাপারে যেন তাদেরকে সাবধান করা হয় এবং সত্য-সঠিক দীন ইসলামের দিকে ডাকা হয়। সর্বপ্রথম এ আয়াত নাযিলের মাধ্যমেই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দাওয়াত ও তাবলীগের হুকুম দেওয়া হয়েছে।
লক্ষণীয়, দাওয়াত ও তাবলীগের সর্বপ্রথম হুকুমে নিকটতম আত্মীয়-স্বজনকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। তাদের থেকেই দাওয়াতী কার্যক্রমের সূচনা করতে বলা হয়েছে। এর এক কারণ তো এই যে, দীন-দুনিয়ার সকল ব্যাপারেই অন্যদের তুলনায় আত্মীয়-স্বজন ও নিকটতম লোকজন অগ্রাধিকার রাখে। এ কারণেই দেখা যায় জাহান্নাম থেকে বাঁচানোর মেহনতে পরিবারবর্গকে প্রথম স্থান দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا
'হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদেরকে ও নিজেদের পরিবারবর্গকে জাহান্নাম থেকে বাঁচাও।১০১
তাছাড়া দাওয়াতী কার্যক্রমে নিকটবর্তী আত্মীয়-স্বজনকে অগ্রাধিকার দেওয়া হলে তাতে সাড়া পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি, যেহেতু দাওয়াতদাতা তথা নবীর নবুওয়াতপূর্ব জীবনের বিশ্বস্ততা ও সত্যবাদিতা সম্পর্কে তারা ওয়াকিফহাল থাকে। ফলে তাদের পক্ষে এ বিশ্বাস রাখা সহজ যে, তিনি যা বলবেন সত্যই বলবেন। এতে করে তুলনামূলক অল্প মেহনতেই সত্যদীনের একদল অনুসারী গড়ে উঠতে পারে, যারা দাওয়াতী কার্যক্রমে তাঁর পূর্ণ সহযোগিতা দান করবে এবং নিজেরাও সত্যদীনের প্রচার-প্রসারে সক্রিয় ভূমিকা রাখবে।
দাওয়াতী কার্যক্রমের সূচনা নিকটাত্মীয়দের থেকে করা হলে তার একটা ফায়দা এইও যে, তারা দাওয়াত গ্রহণ না করলেও অন্ততপক্ষে শত্রুতা ও বিরোধিতায় অতটা কঠোর ও নির্মম হবে না, যেমনটা দূরবর্তী ও অনাত্মীয়দের দিক থেকে হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ কথা সত্য যে, মক্কার কাফের ও মুশরিকগণ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাওয়াতী কাজের কঠোর বিরোধিতা করেছিল, কিন্তু তারপরও তাদের সে বিরোধিতা তায়েফের লোকজন যেমনটা করেছিল অতটা নির্মম ছিল না। এমনিভাবে এ কথাও সত্য যে, তাঁর সর্বাপেক্ষা নিকটবর্তী গোত্র বনূ হাশিম শুরু থেকেই তাঁর প্রতি নমনীয় আচরণ করেছিল; বরং আবূ লাহাবের মত বিচ্ছিন্ন কিছু লোক ছাড়া এ গোত্রের অধিকাংশ লোক ইসলাম গ্রহণ না করলেও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তাঁর সহযোগিতাও করেছিল। একপর্যায়ে তো তাঁর চাচা হামযা রাযি. ইসলাম গ্রহণ করে নেন এবং তাঁর ইসলামগ্রহণ অন্যদের মধ্যে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে।
যাহোক আল্লাহ তাআলার এ নির্দেশ মোতাবেক নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিকটতম লোকদের থেকে দাওয়াতী কার্যক্রম শুরু করে দেন। তিনি সাফা পাহাড়ে উঠে কুরায়শ গোত্রকে ডাক দেন। সর্বপ্রথম ডাক দেন বিস্তৃত পরিসরের কা'ব ইবন লুআঈ গোত্রকে। তারপর তাদের তুলনায় কিছুটা সংক্ষিপ্ত পরিসরের বনূ মুররাকে। তারপর বনূ আব্দে মানাফকে। তারপর বনু হাশিমকে। সবশেষে বনূ আব্দুল মুত্তালিবকে। এভাবে ক্রমান্বয়ে নিকটবর্তী গোত্রের দিকে নেমে আসতে থাকেন। প্রতি গোত্রকেই জাহান্নামের আযাব সম্পর্কে সতর্ক করেন। তাদেরকে সে আযাব থেকে আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করতে বলেন। গোত্রসমূহকে আহ্বান জানানোর পর পৃথকভাবে একেক ব্যক্তির নাম ধরেও সতর্ক করতে থাকেন। এ ক্ষেত্রেও ক্রমান্বয়ে বিশেষ থেকে বিশেষতম ব্যক্তিতে নেমে আসেন। সতর্ক করেন চাচা আব্বাস রাযি.-কে। তারপর ফুফু সাফিয়্যা রাযি.-কে। সবশেষে কন্যা ফাতিমা যাহরা রাযি.-কে।
হাদীসে আছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছিলেন, তোমরা বল তো আমি যদি তোমাদের বলি এ উপত্যকায় শত্রুদল অবস্থান করছে, তারা তোমাদের উপর হামলা চালাবে ও সবকিছু লুট করবে, তবে কি তোমরা আমার কথা বিশ্বাস করবে? তারা বলল, হাঁ, আমরা আমাদের অতীত অভিজ্ঞতায় সত্যবাদীরূপেই পেয়েছি। তখন তিনি বললেন, আমি আসন্ন কঠিন শাস্তি সম্পর্কে তোমাদের সতর্ক করছি। এ কথা শুনে আবূ লাহাব বলে উঠল, তুমি ধ্বংস হও, আমাদেরকে এজন্যই একত্র করেছ? এরই পরিপ্রেক্ষিতে সূরা লাহাব নাযিল হয়।১০২
হাদীসে আছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছিলেন— (আমি তোমাদেরকে আল্লাহর আযাব থেকে কিছুমাত্র বাঁচানোর ক্ষমতা রাখি না)। অর্থাৎ তোমরা আমার আত্মীয় বটে,কিন্তু জেনে রেখ, আত্মীয়তার উপর নির্ভর করে জাহান্নামের শাস্তি থেকে বাঁচা যাবে না। তোমরা যদি ঈমান না আন, তবে আমি আল্লাহর আযাব থেকে তোমাদের বাচাতে পারব না। তা থেকে বাচা যাবে কেবলই ঈমান দ্বারা। সুতরাং তোমরা যদি জাহান্নাম থেকে বাচতে চাও, তবে ঈমান আনয়ন কর। শিরক ও কুফর ছেড়ে আল্লাহ তাআলার আনুগত্য কর। দেব-দেবীর পূজা ছেড়ে কেবল তাঁরই ইবাদত-বন্দেগী কর।
হাদীসে আছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছিলেন- غَيْرَ أَنَّ لَكُمْ رَحِمًا سَأَبُلُّهَا بِبَلَالِهَا (অবশ্য তোমাদের সঙ্গে আত্মীয়তা আছে। আমি তার আর্দ্রতা দ্বারা তোমাদেরকে সিঞ্চিত করব)। بَلَال অর্থ আর্দ্রতা, পানি। এ বাক্যে আত্মীয়তা ছিন্ন করাকে উত্তাপের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে এবং আত্মীয়তা রক্ষাকে উত্তাপ প্রশমিত করার সঙ্গে। উত্তাপ প্রশমিত করা হয় পানি দ্বারা। সুতরাং এ বাক্যে পানির মাধ্যমে উত্তাপ প্রশমিত করার দ্বারা আত্মীয়তা রক্ষা করা ও আত্মীয়কে সাহায্য-সহযোগিতা করা বুঝানো উদ্দেশ্য। মর্ম হচ্ছে, আত্মীয়তা জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষায় কোনও কাজে আসবে না বটে, তবে দুনিয়ায় আত্মীয়তার হক আছে, এর দায় আছে। সুতরাং আমি আত্মীয়তার হক আদায়ার্থে তোমাদের সাহায্য-সহযোগিতা করে যাব।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. ইসলামী দাওয়াতের কার্যক্রম নিকটাত্মীয়দের থেকে শুরু করা উচিত।
খ. আখেরাতের মুক্তি বংশীয় পরিচয়ে নয়; বরং ঈমানের ভিত্তিতেই লাভ হবে।
গ. কোনও আত্মীয় অমুসলিম হলেও তার আত্মীয়তার হক সম্পূর্ণ বাতিল হয়ে যায় না। কাজেই তার বিপদ-আপদে খোঁজখবর রাখা চাই ।
ঘ. প্রত্যেকের জন্য সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আখেরাতের নাজাতের ফিকির করা।
১০১. সূরা তাহরীম (৬৬), আয়াত ৬
১০২. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৪৭৭০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২৮০১; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৬৫৫০; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৩১০৬
عَشِيرَة অর্থ জ্ঞাতিগোষ্ঠী। الْأَقْرَبِينَ অর্থ নিকটবর্তী। এ আয়াতে জ্ঞাতিগোষ্ঠীর মধ্যে যারা নিকটবর্তী, তাদেরকে সতর্ক করার হুকুম দেওয়া হয়েছে। বুঝানো উদ্দেশ্য তারা যে ভ্রান্ত ধর্মের অনুসরণ করে নিজেদেরকে জাহান্নামের শাস্তির উপযুক্ত করে ফেলছে, এ ব্যাপারে যেন তাদেরকে সাবধান করা হয় এবং সত্য-সঠিক দীন ইসলামের দিকে ডাকা হয়। সর্বপ্রথম এ আয়াত নাযিলের মাধ্যমেই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দাওয়াত ও তাবলীগের হুকুম দেওয়া হয়েছে।
লক্ষণীয়, দাওয়াত ও তাবলীগের সর্বপ্রথম হুকুমে নিকটতম আত্মীয়-স্বজনকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। তাদের থেকেই দাওয়াতী কার্যক্রমের সূচনা করতে বলা হয়েছে। এর এক কারণ তো এই যে, দীন-দুনিয়ার সকল ব্যাপারেই অন্যদের তুলনায় আত্মীয়-স্বজন ও নিকটতম লোকজন অগ্রাধিকার রাখে। এ কারণেই দেখা যায় জাহান্নাম থেকে বাঁচানোর মেহনতে পরিবারবর্গকে প্রথম স্থান দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا
'হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদেরকে ও নিজেদের পরিবারবর্গকে জাহান্নাম থেকে বাঁচাও।১০১
তাছাড়া দাওয়াতী কার্যক্রমে নিকটবর্তী আত্মীয়-স্বজনকে অগ্রাধিকার দেওয়া হলে তাতে সাড়া পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি, যেহেতু দাওয়াতদাতা তথা নবীর নবুওয়াতপূর্ব জীবনের বিশ্বস্ততা ও সত্যবাদিতা সম্পর্কে তারা ওয়াকিফহাল থাকে। ফলে তাদের পক্ষে এ বিশ্বাস রাখা সহজ যে, তিনি যা বলবেন সত্যই বলবেন। এতে করে তুলনামূলক অল্প মেহনতেই সত্যদীনের একদল অনুসারী গড়ে উঠতে পারে, যারা দাওয়াতী কার্যক্রমে তাঁর পূর্ণ সহযোগিতা দান করবে এবং নিজেরাও সত্যদীনের প্রচার-প্রসারে সক্রিয় ভূমিকা রাখবে।
দাওয়াতী কার্যক্রমের সূচনা নিকটাত্মীয়দের থেকে করা হলে তার একটা ফায়দা এইও যে, তারা দাওয়াত গ্রহণ না করলেও অন্ততপক্ষে শত্রুতা ও বিরোধিতায় অতটা কঠোর ও নির্মম হবে না, যেমনটা দূরবর্তী ও অনাত্মীয়দের দিক থেকে হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ কথা সত্য যে, মক্কার কাফের ও মুশরিকগণ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাওয়াতী কাজের কঠোর বিরোধিতা করেছিল, কিন্তু তারপরও তাদের সে বিরোধিতা তায়েফের লোকজন যেমনটা করেছিল অতটা নির্মম ছিল না। এমনিভাবে এ কথাও সত্য যে, তাঁর সর্বাপেক্ষা নিকটবর্তী গোত্র বনূ হাশিম শুরু থেকেই তাঁর প্রতি নমনীয় আচরণ করেছিল; বরং আবূ লাহাবের মত বিচ্ছিন্ন কিছু লোক ছাড়া এ গোত্রের অধিকাংশ লোক ইসলাম গ্রহণ না করলেও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তাঁর সহযোগিতাও করেছিল। একপর্যায়ে তো তাঁর চাচা হামযা রাযি. ইসলাম গ্রহণ করে নেন এবং তাঁর ইসলামগ্রহণ অন্যদের মধ্যে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে।
যাহোক আল্লাহ তাআলার এ নির্দেশ মোতাবেক নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিকটতম লোকদের থেকে দাওয়াতী কার্যক্রম শুরু করে দেন। তিনি সাফা পাহাড়ে উঠে কুরায়শ গোত্রকে ডাক দেন। সর্বপ্রথম ডাক দেন বিস্তৃত পরিসরের কা'ব ইবন লুআঈ গোত্রকে। তারপর তাদের তুলনায় কিছুটা সংক্ষিপ্ত পরিসরের বনূ মুররাকে। তারপর বনূ আব্দে মানাফকে। তারপর বনু হাশিমকে। সবশেষে বনূ আব্দুল মুত্তালিবকে। এভাবে ক্রমান্বয়ে নিকটবর্তী গোত্রের দিকে নেমে আসতে থাকেন। প্রতি গোত্রকেই জাহান্নামের আযাব সম্পর্কে সতর্ক করেন। তাদেরকে সে আযাব থেকে আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করতে বলেন। গোত্রসমূহকে আহ্বান জানানোর পর পৃথকভাবে একেক ব্যক্তির নাম ধরেও সতর্ক করতে থাকেন। এ ক্ষেত্রেও ক্রমান্বয়ে বিশেষ থেকে বিশেষতম ব্যক্তিতে নেমে আসেন। সতর্ক করেন চাচা আব্বাস রাযি.-কে। তারপর ফুফু সাফিয়্যা রাযি.-কে। সবশেষে কন্যা ফাতিমা যাহরা রাযি.-কে।
হাদীসে আছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছিলেন, তোমরা বল তো আমি যদি তোমাদের বলি এ উপত্যকায় শত্রুদল অবস্থান করছে, তারা তোমাদের উপর হামলা চালাবে ও সবকিছু লুট করবে, তবে কি তোমরা আমার কথা বিশ্বাস করবে? তারা বলল, হাঁ, আমরা আমাদের অতীত অভিজ্ঞতায় সত্যবাদীরূপেই পেয়েছি। তখন তিনি বললেন, আমি আসন্ন কঠিন শাস্তি সম্পর্কে তোমাদের সতর্ক করছি। এ কথা শুনে আবূ লাহাব বলে উঠল, তুমি ধ্বংস হও, আমাদেরকে এজন্যই একত্র করেছ? এরই পরিপ্রেক্ষিতে সূরা লাহাব নাযিল হয়।১০২
হাদীসে আছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছিলেন— (আমি তোমাদেরকে আল্লাহর আযাব থেকে কিছুমাত্র বাঁচানোর ক্ষমতা রাখি না)। অর্থাৎ তোমরা আমার আত্মীয় বটে,কিন্তু জেনে রেখ, আত্মীয়তার উপর নির্ভর করে জাহান্নামের শাস্তি থেকে বাঁচা যাবে না। তোমরা যদি ঈমান না আন, তবে আমি আল্লাহর আযাব থেকে তোমাদের বাচাতে পারব না। তা থেকে বাচা যাবে কেবলই ঈমান দ্বারা। সুতরাং তোমরা যদি জাহান্নাম থেকে বাচতে চাও, তবে ঈমান আনয়ন কর। শিরক ও কুফর ছেড়ে আল্লাহ তাআলার আনুগত্য কর। দেব-দেবীর পূজা ছেড়ে কেবল তাঁরই ইবাদত-বন্দেগী কর।
হাদীসে আছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছিলেন- غَيْرَ أَنَّ لَكُمْ رَحِمًا سَأَبُلُّهَا بِبَلَالِهَا (অবশ্য তোমাদের সঙ্গে আত্মীয়তা আছে। আমি তার আর্দ্রতা দ্বারা তোমাদেরকে সিঞ্চিত করব)। بَلَال অর্থ আর্দ্রতা, পানি। এ বাক্যে আত্মীয়তা ছিন্ন করাকে উত্তাপের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে এবং আত্মীয়তা রক্ষাকে উত্তাপ প্রশমিত করার সঙ্গে। উত্তাপ প্রশমিত করা হয় পানি দ্বারা। সুতরাং এ বাক্যে পানির মাধ্যমে উত্তাপ প্রশমিত করার দ্বারা আত্মীয়তা রক্ষা করা ও আত্মীয়কে সাহায্য-সহযোগিতা করা বুঝানো উদ্দেশ্য। মর্ম হচ্ছে, আত্মীয়তা জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষায় কোনও কাজে আসবে না বটে, তবে দুনিয়ায় আত্মীয়তার হক আছে, এর দায় আছে। সুতরাং আমি আত্মীয়তার হক আদায়ার্থে তোমাদের সাহায্য-সহযোগিতা করে যাব।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. ইসলামী দাওয়াতের কার্যক্রম নিকটাত্মীয়দের থেকে শুরু করা উচিত।
খ. আখেরাতের মুক্তি বংশীয় পরিচয়ে নয়; বরং ঈমানের ভিত্তিতেই লাভ হবে।
গ. কোনও আত্মীয় অমুসলিম হলেও তার আত্মীয়তার হক সম্পূর্ণ বাতিল হয়ে যায় না। কাজেই তার বিপদ-আপদে খোঁজখবর রাখা চাই ।
ঘ. প্রত্যেকের জন্য সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আখেরাতের নাজাতের ফিকির করা।
১০১. সূরা তাহরীম (৬৬), আয়াত ৬
১০২. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৪৭৭০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২৮০১; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৬৫৫০; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৩১০৬
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
