মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)

২৮- ফিতনাসমূহ ও কিয়ামতের আলামতের বর্ণনা

হাদীস নং: ৫৪৮৩
- ফিতনাসমূহ ও কিয়ামতের আলামতের বর্ণনা
প্রথম অনুচ্ছেদ - কিয়ামতের পূর্বলক্ষণসমূহ এবং দাজ্জালের বর্ণনা
৫৪৮৩। হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে উমর (রাঃ) হইতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ্ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলিলেন: আমি অদ্যরাত্রে (স্বপ্নে দেখিয়াছি যে, আমি কা'বা শরীফের নিকটে উপস্থিত। তথায় আমি গৌরবর্ণের এক লোককে দেখিতে পাইলাম। যিনি তোমার দেখা গৌরবর্ণের সর্বাপেক্ষা সুন্দর লোকদের অন্যতম। তাহার লম্বা চুল ছিল, যাহা তোমার দেখা সর্বাপেক্ষা সুন্দর বাবরী চুলের অন্যতম ছিল। যেইগুলিকে সে আঁচড়াইয়া পরিপাটি করিয়া রাখিয়াছিল উক্ত চুল হইতে ফোঁটা ফোঁটা পানি ঝরিয়া পড়িতেছিল। তিনি দুই ব্যক্তির কাঁধের উপর ভর করিয়া কা'বা ঘরের তাওয়াফ করিতেছিলেন। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম; এই লোকটি কে? উত্তরে (ফেরেশ্তাগণ) বলিলেন, ইনি মাসীহ্ ইবনে মারইয়াম। অতঃপর আমি আরেক লোককে দেখিলাম, যাহার চুলগুলি ছিল সম্পূর্ণ কোঁকড়ান, জটবাধা। আর তাহার ডান চক্ষু ছিল। কানা, দেখিতে যেন চক্ষুটি ফোলা আঙ্গুরের মত। লোকদের মধ্যে (ইহুদী) ইবনে কাতানের
সহিত যাহার বহুলাংশে সাদৃশ্য বা মিল রহিয়াছে। সেও দুই ব্যক্তির কাধে ভর করিয়া কা'বা ঘর তাওয়াফ করিতেছে। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম; এই লোকটি কে? উত্তরে তাহারা বলিলেন, ইহা মাসীহে দাজ্জাল। মোত্তাঃ। অপর এক রেওয়ায়তে তিনি দাজ্জালের বর্ণনায় বলিয়াছেনঃ সে লাল বর্ণের, মোটা দেহ, মাথার চুল কোঁকড়ানো, ডান চক্ষু কানা, মানুষের মধ্যে ইবনে কাতানই উহার কাছাকাছি সাদৃশ্য। আর আবু হোরায়রার বর্ণিত হাদীস لَا تَقُومُ السَّاعَةُ মহাযুদ্ধ অধ্যায়ে বর্ণিত হইয়াছে। আর ইবনে উমরের হাদীস قَامَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي النَّاس অচিরেই- ابْن الصياد-এর ঘটনায় বর্ণনা করিব إِن شَاءَ الله تَعَالَى
كتاب الفتن
وَعَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: رَأَيْتُنِي اللَّيْلَةَ عِنْدَ الْكَعْبَةِ فَرَأَيْتُ رَجُلًا آدَمَ كَأَحْسَنِ مَا أَنْتَ رَاءٍ مِنْ أُدْمِ الرِّجَالِ لَهُ لِمَّةٌ كَأَحْسَنِ مَا أَنْتَ رَاءٍ مِنَ اللِّمَمِ قد رجَّلَها فَهِيَ تقطر مَاء متكأ عَلَى عَوَاتِقِ رَجُلَيْنِ يَطُوفُ بِالْبَيْتِ فَسَأَلْتُ: مَنْ هَذَا؟ فَقَالُوا: هَذَا الْمَسِيح بن مَرْيَمَ قَالَ: ثُمَّ إِذَا أَنَا بَرْجُلٍ جَعْدٍ قَطَطٍ أَعْوَرِ الْعَيْنِ الْيُمْنَى كَأَنَّ عَيْنَهُ عِنَبَةٌ طَافِيَةٌ كَأَشْبَهِ مَنْ رَأَيْتُ مِنَ النَّاسِ بِابْنِ قَطَنٍ وَاضِعًا يَدَيْهِ عَلَى مَنْكِبَيْ رَجُلَيْنِ يَطُوفُ بِالْبَيْتِ فَسَأَلْتُ مَنْ هَذَا؟ فَقَالُوا: هَذَا الْمَسِيحُ الدَّجَّالُ . مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ. وَفِي رِوَايَةٍ: قَالَ فِي الدَّجَّالِ: «رَجُلٌ أَحْمَرُ جَسِيمٌ جَعْدُ الرَّأْسِ أَعْوَرُ عَيْنِ الْيُمْنَى أَقْرَبُ النَّاسِ بِهِ شَبَهًا ابْنُ قَطَنٍ» وَذَكَرَ حَدِيثَ أَبِي هُرَيْرَةَ: «لَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى تَطْلُعَ الشَّمْسُ مِنْ مَغْرِبِهَا» فِي «بَابِ الْمَلَاحِمِ» وَسَنَذْكُرُ حَدِيثَ ابْنِ عُمَرَ: قَامَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي النَّاس فِي «بَاب قصَّة ابْن الصياد» إِن شَاءَ الله تَعَالَى

হাদীসের ব্যাখ্যা:

দাজ্জাল সম্পর্কে সতর্কীকরণ

বিদায় হজ্জের দীর্ঘ ভাষণে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিভিন্ন জরুরি বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করেন। তার মধ্যে একটা ছিল দাজ্জাল সম্পর্কে সতর্ক করা ও তার কিছু আলামত বলে দেওয়া।

দাজ্জালকে ‘মাসীহুদ-দাজ্জাল' বলা হয়ে থাকে। ‘মাসীহ' শব্দের বিভিন্ন অর্থ আছে, যেমন- অত্যধিক ভ্রমণকারী, হাতের স্পর্শে রোগ নিরাময়কারী। দাজ্জালের মধ্যে এ দু'টি বিশেষত্ব থাকবে। হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকেও মাসীহ বলা হয়ে থাকে। কেননা তিনিও দাওয়াতী কাজে খুব সফর করতেন এবং তাঁর হাতের স্পর্শে অন্ধ ও কুষ্ঠ রোগী নিরাময় লাভ করত। এদিক থেকে দাজ্জালের সঙ্গে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের সাদৃশ্য আছে। তাই তো দাজ্জালকে বধ করার জন্য হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে এখনও পর্যন্ত আসমানে জীবিত ও নিরাপদ রাখা হয়েছে। দাজ্জালের আবির্ভাবের পর তাঁকে দুনিয়ায় পাঠানো হবে। তাঁর হাতেই দাজ্জালের বিনাশ ঘটবে।

'মাসীহ'-এর আরেক অর্থ- যা মুছে ফেলা হয়েছে। দাজ্জালের ডান চোখের স্থান মুছে ফেলা। অর্থাৎ সেখানে চোখ নেই। জায়গাটি সম্পূর্ণ ভরাট, সমতল। তার থাকবে শুধু বাম চোখ। তাও উপরের দিকে তোলা।

নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাজ্জালের চোখকে এমন একটি আঙ্গুরদানার সাথে তুলনা করেছেন, যে দানাটি সন্নিবদ্ধ আঙ্গুর থোকার ওপর আলাদাভাবে ভাসমান। এমনিই ডান চোখ নেই। সে জায়গাটি চামড়া দিয়ে ঢাকা সম্পূর্ণ সমতল। আছে কেবল বাম চোখ। তাও এভাবে উপরে তোলা। তিনি জানানঃ-

إنَّ ربكم ليس بأعور، وإنه أعور عين اليمنى، كأن عينه عنبة طافية

তোমাদের প্রতিপালক কানা নন, অথচ সে হবে ডান চোখের কানা। তার চোখ যেন (আঙ্গুরের থোকার) উপরে ভেসে থাকা একটি আঙ্গুর।

এই যার চোখের অবস্থা, দেখতে সে কতই না কুৎসিত ও বীভৎস হবে! নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাজ্জালের এই বিদঘুটে রূপটির প্রতি বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এ কারণে যে, দাজ্জাল অনেক তেলেসমাতি দেখাবে- মৃতকে জীবিত করবে, বৃষ্টি নামিয়ে দেখাবে, আবার বৃষ্টি বন্ধ করে খরার অবস্থা বানাবে, সঙ্গে জান্নাত ও জাহান্নামের আকৃতি রাখবে আর এসবের ভিত্তিতে নিজেকে আল্লাহ বলে দাবি করবে। তো ঈমানদার ব্যক্তি যাতে এসব দেখে বিভ্রান্ত না হয়, তাই বিশেষভাবে বিদঘুটে চোখের আলামতটি উল্লেখ করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলছেন- সে যদি তোমাদের মধ্যে আত্মপ্রকাশ করে, তবে তার অবস্থা সম্পর্কে তোমাদের যা-কিছুই অজানা থাকুক না কেন, এ বিষয়টা তো অজানা থাকতে পারে না যে, তোমাদের প্রতিপালক কানা নন, অথচ সে হবে ডান চোখের কানা। তার চোখ যেন (আঙ্গুরের থোকার) উপরে ভেসে থাকা একটি আঙ্গুর।

বস্তুত দাজ্জালের ফিতনা হবে অত্যন্ত ভয়ংকর। আল্লাহ তা'আলা যাকে হেফাজত করবেন কেবল সে-ই তার ফিতনা থেকে বাঁচতে পারবে। তার ফিতনা এমনকি কবরবাসীদেরকেও স্পর্শ করবে। এজন্যই হযরত নূহ আলাইহিস সালাম থেকে পরবর্তী সমস্ত নবী-রাসূল আপন আপন উম্মতকে তার ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। তবে আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার ব্যাপারে সর্বাপেক্ষা বেশি স্পষ্ট ধারণা দিয়েছেন। তার আলামতসমূহের মধ্যে একটা বিশেষ আলামত এই যে, তার কপালে ك ف ر লেখা থাকবে। তা দেখে মু'মিনগণ বুঝে ফেলবে যে, সে এক ঘোর কাফের। যার কুফর এতই পূর্ণাঙ্গ ও বলিষ্ঠ যে, তার আছর অন্তর ও দেহের স্থূলতা ভেদ করে কপালেও পরিস্ফুট হবে। মোটকথা কেউ যাতে তার ফিতনায় পড়ে ঈমান না হারায় সেজন্য তিনি তার আলামতসমূহ পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। আমাদেরকে তার ফিতনা থেকে বাঁচার দু'আও শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। যেমন একটি দু'আ হচ্ছে-

«اللهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ النَّارِ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ فِتْنَةِ الْمَسِيحِ الدَّجَّالِ ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنَ فِتْنَةِ الْمَحْيَا وَالْمَمَاتِ»

হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই কবরের আযাব থেকে, আপনার কাছে আশ্রয় চাই জাহান্নামের আযাব থেকে, আপনার কাছে আশ্রয় চাই মাসীহুদ-দাজ্জালের ফিতনা থেকে এবং আপনার কাছে আশ্রয় চাই জীবন ও মৃত্যুর যাবতীয় ফিতনা থেকে। (সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৮৩২; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৫৮৮; সুনানে আবু দাউদ, হাদীছ নং ৮৮০; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ৩৪৯৪; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ১৩০৯; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৯০৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২১৬৭)

এ দু'আটি নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও পড়তেন। এক হাদীছে তিনি ইরশাদ করেনঃ-

من حفظ عشر آيات من أول سورة الكهف، عصم من فتنة الدجال

যে ব্যক্তি সূরা কাহফের প্রথম দশ আয়াত মুখস্থ করবে, তাকে দাজ্জালের ফিতনা থেকে রক্ষা করা হবে। (সহীহ মুসলিম,হাদীছ নং ৮০৯; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৩২৩; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ৩১০৫; নাসাঈ, হাদীছ নং ৮০২৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২১৭১২; মুস্তাদরাক হাকিম, হাদীছ নং ৩৩৯১: শু'আবুল ঈমান, হাদীছ নং ৬৬৮৩)

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. কিয়ামতের আগে দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটবে। তাঁর ফিতনা সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, এটা সত্য। এতে বিশ্বাস রাখতে হবে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
মিশকাতুল মাসাবীহ - হাদীস নং ৫৪৮৩ | মুসলিম বাংলা