মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)
২৭- নম্রতা ও যুহদের অধ্যায়
হাদীস নং: ৫৩৭৩
প্রথম অনুচ্ছেদ - ভীতি প্রদর্শন ও সতর্কীকরণ
৫৩৭৩। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, যখন وَأَنذِرْ عَشِيرَتَكَ الْأَقْرَبِينَ অর্থঃ —তুমি তোমার নিকটাত্মীয়দিগকে সতর্ক কর' নাযিল হইল, তখন নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরাইশদিগকে ডাক দিলেন। তাহারা সমবেত হইল। তিনি ব্যাপকভাবে এবং বিশেষ বিশেষ গোত্রকে ডাক দিয়া সতর্কবাণী শুনাইলেন। তিনি বলিলেনঃ হে কা'ব ইবনে লুয়াইর বংশধর। তোমরা নিজেদেরকে দোযখের আগুন হইতে বাঁচাও! হে মুররা ইবনে কা'বের বংশধর। তোমরা নিজদিগকে জাহান্নামের আগুন হইতে বাঁচাও! হে আব্দে শাসের বংশধর ! তোমরা নিজদিগকে আগুন হইতে বাঁচাও! হে আব্দে মানাফের বংশধর। তোমরা জাহান্নামের আগুন হইতে নিজদিগকে মুক্ত কর। হে হাশেমের বংশধর। তোমরা নিজদিগকে জাহান্নামের আগুন হইতে বাঁচাও! হে আব্দুল মুত্তালিবের বংশধর। তোমরা নিজদিগকে দোযখের আগুন হইতে বাঁচাও। হে ফাতেমা। তুমি তোমার দেহকে দোযখের আগুন হইতে বাঁচাও। কেননা, আল্লাহর আযাব হইতে রক্ষা করিবার ক্ষমতা আমার নাই। তবে তোমাদের সহিত আত্মীয়তার সম্পর্ক রহিয়াছে, উহা আমি (দুনিয়াতে) সদ্ব্যবহার দ্বারা সিক্ত করিব। —মুসলিম। বুখারী ও মুসলিমের যৌথ বর্ণনায় আছে, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলিলেন: হে কুরাইশ সম্প্রদায়। (আমার উপরে ঈমান আনিয়া) তোমাদের জানকে খরিদ করিয়া লও (অর্থাৎ, দোযখের আগুন হইতে আত্মরক্ষা কর)। আমি তোমাদের উপর হইতে আল্লাহর আযাব কিছুই দূর করিতে পারিব না। হে আব্দে মানাফের বংশধর। আমি তোমাদের উপর হইতে আল্লাহ আযাব কিছুই দূর করিতে পারিব না। হে আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিব! আমি তোমার উপর হইতে আল্লাহর আযাব কিছুই দূর করিতে পারিব না। হে রাসূলুল্লাহর ফুফী সাফিয়্যা। আমি তোমাকে আল্লাহর আযাব হইতে বাঁচাইতে পারিব না। হে মুহাম্মাদের কন্যা ফাতেমা। আমার কাছে দুনিয়াবী মাল-সম্পদ হইতে যাহা ইচ্ছা তাহা চাহিতে পার, কিন্তু আমি তোমাকে আল্লাহর আযাব হইতে রক্ষা করিতে পারিব না।
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: لَمَّا نَزَلَتْ (وَأَنْذِرْ عشيرتك الْأَقْرَبين) دَعَا النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قُرَيْشًا فَاجْتَمَعُوا فَعَمَّ وَخَصَّ فَقَالَ: «يَا بَنِي كَعْبِ بْنِ لُؤَيٍّ أَنْقِذُوا أَنْفُسَكُمْ مِنَ النَّارِ يَا بَنِي مُرَّةَ بْنِ كَعْبٍ أَنْقِذُوا أَنْفُسَكُمْ مِنَ النَّارِ. يَا بَنِي عَبْدِ شَمْسٍ أَنْقِذُوا أَنْفُسَكُمْ من النَّار يَا بني عبد منَاف أَنْقِذُوا أَنفسكُم من النَّار. با بَنِي هَاشِمٍ أَنْقِذُوا أَنْفُسَكُمْ مِنَ النَّارِ. يَا بني عبد الْمطلب أَنْقِذُوا أَنفسكُم من النَّار. يَا فَاطِمَةُ أَنْقِذِي نَفْسَكِ مِنَ النَّارِ فَإِنِّي لَا أَمْلِكُ لَكُمْ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا غَيْرَ أَنَّ لَكُمْ رَحِمًا سَأَبُلُّهَا بِبَلَالِهَا» . رَوَاهُ مُسْلِمٌ وَفَى الْمُتَّفَقِ عَلَيْهِ قَالَ: «يَا مَعْشَرَ قُرَيْشٍ اشْتَرُوا أَنْفُسَكُمْ لَا أُغْنِي عَنْكُمْ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا وَيَا صَفِيَّةُ عَمَّةَ رَسُولِ اللَّهِ لَا أُغْنِي عَنْكِ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا. وَيَا فَاطِمَةُ بِنْتَ مُحَمَّدٍ سَلِينِي مَا شِئْتِ مِنْ مَالِي لَا أُغْنِي عَنْكِ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا»
হাদীসের ব্যাখ্যা:
عَشِيرَة অর্থ জ্ঞাতিগোষ্ঠী। الْأَقْرَبِينَ অর্থ নিকটবর্তী। এ আয়াতে জ্ঞাতিগোষ্ঠীর মধ্যে যারা নিকটবর্তী, তাদেরকে সতর্ক করার হুকুম দেওয়া হয়েছে। বুঝানো উদ্দেশ্য তারা যে ভ্রান্ত ধর্মের অনুসরণ করে নিজেদেরকে জাহান্নামের শাস্তির উপযুক্ত করে ফেলছে, এ ব্যাপারে যেন তাদেরকে সাবধান করা হয় এবং সত্য-সঠিক দীন ইসলামের দিকে ডাকা হয়। সর্বপ্রথম এ আয়াত নাযিলের মাধ্যমেই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দাওয়াত ও তাবলীগের হুকুম দেওয়া হয়েছে।
লক্ষণীয়, দাওয়াত ও তাবলীগের সর্বপ্রথম হুকুমে নিকটতম আত্মীয়-স্বজনকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। তাদের থেকেই দাওয়াতী কার্যক্রমের সূচনা করতে বলা হয়েছে। এর এক কারণ তো এই যে, দীন-দুনিয়ার সকল ব্যাপারেই অন্যদের তুলনায় আত্মীয়-স্বজন ও নিকটতম লোকজন অগ্রাধিকার রাখে। এ কারণেই দেখা যায় জাহান্নাম থেকে বাঁচানোর মেহনতে পরিবারবর্গকে প্রথম স্থান দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا
'হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদেরকে ও নিজেদের পরিবারবর্গকে জাহান্নাম থেকে বাঁচাও।১০১
তাছাড়া দাওয়াতী কার্যক্রমে নিকটবর্তী আত্মীয়-স্বজনকে অগ্রাধিকার দেওয়া হলে তাতে সাড়া পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি, যেহেতু দাওয়াতদাতা তথা নবীর নবুওয়াতপূর্ব জীবনের বিশ্বস্ততা ও সত্যবাদিতা সম্পর্কে তারা ওয়াকিফহাল থাকে। ফলে তাদের পক্ষে এ বিশ্বাস রাখা সহজ যে, তিনি যা বলবেন সত্যই বলবেন। এতে করে তুলনামূলক অল্প মেহনতেই সত্যদীনের একদল অনুসারী গড়ে উঠতে পারে, যারা দাওয়াতী কার্যক্রমে তাঁর পূর্ণ সহযোগিতা দান করবে এবং নিজেরাও সত্যদীনের প্রচার-প্রসারে সক্রিয় ভূমিকা রাখবে।
দাওয়াতী কার্যক্রমের সূচনা নিকটাত্মীয়দের থেকে করা হলে তার একটা ফায়দা এইও যে, তারা দাওয়াত গ্রহণ না করলেও অন্ততপক্ষে শত্রুতা ও বিরোধিতায় অতটা কঠোর ও নির্মম হবে না, যেমনটা দূরবর্তী ও অনাত্মীয়দের দিক থেকে হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ কথা সত্য যে, মক্কার কাফের ও মুশরিকগণ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাওয়াতী কাজের কঠোর বিরোধিতা করেছিল, কিন্তু তারপরও তাদের সে বিরোধিতা তায়েফের লোকজন যেমনটা করেছিল অতটা নির্মম ছিল না। এমনিভাবে এ কথাও সত্য যে, তাঁর সর্বাপেক্ষা নিকটবর্তী গোত্র বনূ হাশিম শুরু থেকেই তাঁর প্রতি নমনীয় আচরণ করেছিল; বরং আবূ লাহাবের মত বিচ্ছিন্ন কিছু লোক ছাড়া এ গোত্রের অধিকাংশ লোক ইসলাম গ্রহণ না করলেও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তাঁর সহযোগিতাও করেছিল। একপর্যায়ে তো তাঁর চাচা হামযা রাযি. ইসলাম গ্রহণ করে নেন এবং তাঁর ইসলামগ্রহণ অন্যদের মধ্যে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে।
যাহোক আল্লাহ তাআলার এ নির্দেশ মোতাবেক নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিকটতম লোকদের থেকে দাওয়াতী কার্যক্রম শুরু করে দেন। তিনি সাফা পাহাড়ে উঠে কুরায়শ গোত্রকে ডাক দেন। সর্বপ্রথম ডাক দেন বিস্তৃত পরিসরের কা'ব ইবন লুআঈ গোত্রকে। তারপর তাদের তুলনায় কিছুটা সংক্ষিপ্ত পরিসরের বনূ মুররাকে। তারপর বনূ আব্দে মানাফকে। তারপর বনু হাশিমকে। সবশেষে বনূ আব্দুল মুত্তালিবকে। এভাবে ক্রমান্বয়ে নিকটবর্তী গোত্রের দিকে নেমে আসতে থাকেন। প্রতি গোত্রকেই জাহান্নামের আযাব সম্পর্কে সতর্ক করেন। তাদেরকে সে আযাব থেকে আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করতে বলেন। গোত্রসমূহকে আহ্বান জানানোর পর পৃথকভাবে একেক ব্যক্তির নাম ধরেও সতর্ক করতে থাকেন। এ ক্ষেত্রেও ক্রমান্বয়ে বিশেষ থেকে বিশেষতম ব্যক্তিতে নেমে আসেন। সতর্ক করেন চাচা আব্বাস রাযি.-কে। তারপর ফুফু সাফিয়্যা রাযি.-কে। সবশেষে কন্যা ফাতিমা যাহরা রাযি.-কে।
সকলকে জানিয়ে দেন— فإِنِّي لَا أَمْلِكُ لَكُمْ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا (আমি তোমাদেরকে আল্লাহর আযাব থেকে কিছুমাত্র বাঁচানোর ক্ষমতা রাখি না)। অর্থাৎ তোমরা আমার আত্মীয় বটে,কিন্তু জেনে রেখ, আত্মীয়তার উপর নির্ভর করে জাহান্নামের শাস্তি থেকে বাঁচা যাবে না। তোমরা যদি ঈমান না আন, তবে আমি আল্লাহর আযাব থেকে তোমাদের বাচাতে পারব না। তা থেকে বাচা যাবে কেবলই ঈমান দ্বারা। সুতরাং তোমরা যদি জাহান্নাম থেকে বাচতে চাও, তবে ঈমান আনয়ন কর। শিরক ও কুফর ছেড়ে আল্লাহ তাআলার আনুগত্য কর। দেব-দেবীর পূজা ছেড়ে কেবল তাঁরই ইবাদত-বন্দেগী কর।
তারপর ইরশাদ করেন- غَيْرَ أَنَّ لَكُمْ رَحِمًا سَأَبُلُّهَا بِبَلَالِهَا (অবশ্য তোমাদের সঙ্গে আত্মীয়তা আছে। আমি তার আর্দ্রতা দ্বারা তোমাদেরকে সিঞ্চিত করব)। بَلَال অর্থ আর্দ্রতা, পানি। এ বাক্যে আত্মীয়তা ছিন্ন করাকে উত্তাপের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে এবং আত্মীয়তা রক্ষাকে উত্তাপ প্রশমিত করার সঙ্গে। উত্তাপ প্রশমিত করা হয় পানি দ্বারা। সুতরাং এ বাক্যে পানির মাধ্যমে উত্তাপ প্রশমিত করার দ্বারা আত্মীয়তা রক্ষা করা ও আত্মীয়কে সাহায্য-সহযোগিতা করা বুঝানো উদ্দেশ্য।১০২
হাদীছটির মর্ম হচ্ছে, আত্মীয়তা জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষায় কোনও কাজে আসবে না বটে, তবে দুনিয়ায় আত্মীয়তার হক আছে, এর দায় আছে। সুতরাং আমি আত্মীয়তার হক আদায়ার্থে তোমাদের সাহায্য-সহযোগিতা করে যাব।
হাদীছটির এ বর্ণনায় সংশ্লিষ্ট আয়াতটি নাযিল হওয়ার পর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাফা পাহাড়ে উঠে যেসব কথা বলেছিলেন, তার আংশিক উল্লেখ করা হয়েছে। প্রসিদ্ধ এক বর্ণনায় আছে, সূরা শু'আরার উল্লিখিত আয়াতটি নাযিল হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাফা পাহাড়ের চূড়ায় আরোহণ করলেন, তারপর একে একে ডাকতে থাকলেন- হে বনূ ফিহর, হে বনূ 'আদী। এভাবে কুরায়শের সকল গোত্রের নাম ধরে ডাকতে থাকলেন। তারা সবাই সেখানে উপস্থিত হলো। যারা নিজেরা আসতে পারেনি, প্রতিনিধি পাঠাল। তারপর সবাই অপেক্ষা করতে থাকল তিনি কী বলেন। শেষে তিনি বললেন, তোমরা বল তো আমি যদি তোমাদের বলি এ উপত্যকায় শত্রুদল অবস্থান করছে, তারা তোমাদের উপর হামলা চালাবে ও সবকিছু লুট করবে, তবে কি তোমরা আমার কথা বিশ্বাস করবে? তারা বলল, হাঁ, আমরা আমাদের অতীত অভিজ্ঞতায় সত্যবাদীরূপেই পেয়েছি। তখন তিনি বললেন, আমি আসন্ন কঠিন শাস্তি সম্পর্কে তোমাদের সতর্ক করছি। এ কথা শুনে আবূ লাহাব বলে উঠল, তুমি ধ্বংস হও, আমাদেরকে এজন্যই একত্র করেছ? এরই পরিপ্রেক্ষিতে লাহাব নাযিল হয়।১০৩
কোনও কোনও বর্ণনা দ্বারা জানা যায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর একাধিক দিন তাদেরকে ডেকে সতর্ক করেছিলেন। কাজেই এমনও হতে পারে যে, বিভিন্ন বর্ণনায় যে বিভিন্ন কথা এসেছে তা তিনি বিভিন্ন দিনে বলেছিলেন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. ইসলামী দাওয়াতের কার্যক্রম নিকটাত্মীয়দের থেকে শুরু করা উচিত।
খ. আখেরাতের মুক্তি বংশীয় পরিচয়ে নয়; বরং ঈমানের ভিত্তিতেই লাভ হবে।
গ. কোনও আত্মীয় অমুসলিম হলেও তার আত্মীয়তার হক সম্পূর্ণ বাতিল হয়ে যায় না। কাজেই তার বিপদ-আপদে খোঁজখবর রাখা চাই ।
ঘ. প্রত্যেকের জন্য সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আখেরাতের নাজাতের ফিকির করা।
১০১. সূরা তাহরীম (৬৬), আয়াত ৬
১০২. ইমাম নববী রহ. এ বাক্যটির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে একটি রূপকালঙ্কারের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। তা হচ্ছে, আত্মীয়তা ছিন্ন করাকে মনে মনে পানি দ্বারা নির্বাপণীয় উত্তাপের সঙ্গে তাশবীহ দেওয়া (উপমিত করা) হয়েছে। তারপর মুশাব্বাহ (উপমেয়)-এর উপর মুশাব্বাহ বিহী (উপমান)-এর অবিচ্ছেদ্য গুণ (লাযিম) 'পানি দ্বারা নির্বাপণ'-কে আরোপ করা হয়েছে। এভাবে বাক্যটিতে মনে মনে যে তাশবীহ হয়েছে সেটি ইস্তি' আরাহ মাকনিয়্যাহ, আর মুশাব্বাহ'র উপর মুশাব্বাহ বিহীর লাযিমের কল্পনা হলো তাখয়ীলিয়্যাহ।
১০৩. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৪৭৭০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২৮০১; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৬৫৫০; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৩১০৬
লক্ষণীয়, দাওয়াত ও তাবলীগের সর্বপ্রথম হুকুমে নিকটতম আত্মীয়-স্বজনকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। তাদের থেকেই দাওয়াতী কার্যক্রমের সূচনা করতে বলা হয়েছে। এর এক কারণ তো এই যে, দীন-দুনিয়ার সকল ব্যাপারেই অন্যদের তুলনায় আত্মীয়-স্বজন ও নিকটতম লোকজন অগ্রাধিকার রাখে। এ কারণেই দেখা যায় জাহান্নাম থেকে বাঁচানোর মেহনতে পরিবারবর্গকে প্রথম স্থান দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا
'হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদেরকে ও নিজেদের পরিবারবর্গকে জাহান্নাম থেকে বাঁচাও।১০১
তাছাড়া দাওয়াতী কার্যক্রমে নিকটবর্তী আত্মীয়-স্বজনকে অগ্রাধিকার দেওয়া হলে তাতে সাড়া পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি, যেহেতু দাওয়াতদাতা তথা নবীর নবুওয়াতপূর্ব জীবনের বিশ্বস্ততা ও সত্যবাদিতা সম্পর্কে তারা ওয়াকিফহাল থাকে। ফলে তাদের পক্ষে এ বিশ্বাস রাখা সহজ যে, তিনি যা বলবেন সত্যই বলবেন। এতে করে তুলনামূলক অল্প মেহনতেই সত্যদীনের একদল অনুসারী গড়ে উঠতে পারে, যারা দাওয়াতী কার্যক্রমে তাঁর পূর্ণ সহযোগিতা দান করবে এবং নিজেরাও সত্যদীনের প্রচার-প্রসারে সক্রিয় ভূমিকা রাখবে।
দাওয়াতী কার্যক্রমের সূচনা নিকটাত্মীয়দের থেকে করা হলে তার একটা ফায়দা এইও যে, তারা দাওয়াত গ্রহণ না করলেও অন্ততপক্ষে শত্রুতা ও বিরোধিতায় অতটা কঠোর ও নির্মম হবে না, যেমনটা দূরবর্তী ও অনাত্মীয়দের দিক থেকে হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ কথা সত্য যে, মক্কার কাফের ও মুশরিকগণ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাওয়াতী কাজের কঠোর বিরোধিতা করেছিল, কিন্তু তারপরও তাদের সে বিরোধিতা তায়েফের লোকজন যেমনটা করেছিল অতটা নির্মম ছিল না। এমনিভাবে এ কথাও সত্য যে, তাঁর সর্বাপেক্ষা নিকটবর্তী গোত্র বনূ হাশিম শুরু থেকেই তাঁর প্রতি নমনীয় আচরণ করেছিল; বরং আবূ লাহাবের মত বিচ্ছিন্ন কিছু লোক ছাড়া এ গোত্রের অধিকাংশ লোক ইসলাম গ্রহণ না করলেও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তাঁর সহযোগিতাও করেছিল। একপর্যায়ে তো তাঁর চাচা হামযা রাযি. ইসলাম গ্রহণ করে নেন এবং তাঁর ইসলামগ্রহণ অন্যদের মধ্যে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে।
যাহোক আল্লাহ তাআলার এ নির্দেশ মোতাবেক নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিকটতম লোকদের থেকে দাওয়াতী কার্যক্রম শুরু করে দেন। তিনি সাফা পাহাড়ে উঠে কুরায়শ গোত্রকে ডাক দেন। সর্বপ্রথম ডাক দেন বিস্তৃত পরিসরের কা'ব ইবন লুআঈ গোত্রকে। তারপর তাদের তুলনায় কিছুটা সংক্ষিপ্ত পরিসরের বনূ মুররাকে। তারপর বনূ আব্দে মানাফকে। তারপর বনু হাশিমকে। সবশেষে বনূ আব্দুল মুত্তালিবকে। এভাবে ক্রমান্বয়ে নিকটবর্তী গোত্রের দিকে নেমে আসতে থাকেন। প্রতি গোত্রকেই জাহান্নামের আযাব সম্পর্কে সতর্ক করেন। তাদেরকে সে আযাব থেকে আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করতে বলেন। গোত্রসমূহকে আহ্বান জানানোর পর পৃথকভাবে একেক ব্যক্তির নাম ধরেও সতর্ক করতে থাকেন। এ ক্ষেত্রেও ক্রমান্বয়ে বিশেষ থেকে বিশেষতম ব্যক্তিতে নেমে আসেন। সতর্ক করেন চাচা আব্বাস রাযি.-কে। তারপর ফুফু সাফিয়্যা রাযি.-কে। সবশেষে কন্যা ফাতিমা যাহরা রাযি.-কে।
সকলকে জানিয়ে দেন— فإِنِّي لَا أَمْلِكُ لَكُمْ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا (আমি তোমাদেরকে আল্লাহর আযাব থেকে কিছুমাত্র বাঁচানোর ক্ষমতা রাখি না)। অর্থাৎ তোমরা আমার আত্মীয় বটে,কিন্তু জেনে রেখ, আত্মীয়তার উপর নির্ভর করে জাহান্নামের শাস্তি থেকে বাঁচা যাবে না। তোমরা যদি ঈমান না আন, তবে আমি আল্লাহর আযাব থেকে তোমাদের বাচাতে পারব না। তা থেকে বাচা যাবে কেবলই ঈমান দ্বারা। সুতরাং তোমরা যদি জাহান্নাম থেকে বাচতে চাও, তবে ঈমান আনয়ন কর। শিরক ও কুফর ছেড়ে আল্লাহ তাআলার আনুগত্য কর। দেব-দেবীর পূজা ছেড়ে কেবল তাঁরই ইবাদত-বন্দেগী কর।
তারপর ইরশাদ করেন- غَيْرَ أَنَّ لَكُمْ رَحِمًا سَأَبُلُّهَا بِبَلَالِهَا (অবশ্য তোমাদের সঙ্গে আত্মীয়তা আছে। আমি তার আর্দ্রতা দ্বারা তোমাদেরকে সিঞ্চিত করব)। بَلَال অর্থ আর্দ্রতা, পানি। এ বাক্যে আত্মীয়তা ছিন্ন করাকে উত্তাপের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে এবং আত্মীয়তা রক্ষাকে উত্তাপ প্রশমিত করার সঙ্গে। উত্তাপ প্রশমিত করা হয় পানি দ্বারা। সুতরাং এ বাক্যে পানির মাধ্যমে উত্তাপ প্রশমিত করার দ্বারা আত্মীয়তা রক্ষা করা ও আত্মীয়কে সাহায্য-সহযোগিতা করা বুঝানো উদ্দেশ্য।১০২
হাদীছটির মর্ম হচ্ছে, আত্মীয়তা জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষায় কোনও কাজে আসবে না বটে, তবে দুনিয়ায় আত্মীয়তার হক আছে, এর দায় আছে। সুতরাং আমি আত্মীয়তার হক আদায়ার্থে তোমাদের সাহায্য-সহযোগিতা করে যাব।
হাদীছটির এ বর্ণনায় সংশ্লিষ্ট আয়াতটি নাযিল হওয়ার পর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাফা পাহাড়ে উঠে যেসব কথা বলেছিলেন, তার আংশিক উল্লেখ করা হয়েছে। প্রসিদ্ধ এক বর্ণনায় আছে, সূরা শু'আরার উল্লিখিত আয়াতটি নাযিল হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাফা পাহাড়ের চূড়ায় আরোহণ করলেন, তারপর একে একে ডাকতে থাকলেন- হে বনূ ফিহর, হে বনূ 'আদী। এভাবে কুরায়শের সকল গোত্রের নাম ধরে ডাকতে থাকলেন। তারা সবাই সেখানে উপস্থিত হলো। যারা নিজেরা আসতে পারেনি, প্রতিনিধি পাঠাল। তারপর সবাই অপেক্ষা করতে থাকল তিনি কী বলেন। শেষে তিনি বললেন, তোমরা বল তো আমি যদি তোমাদের বলি এ উপত্যকায় শত্রুদল অবস্থান করছে, তারা তোমাদের উপর হামলা চালাবে ও সবকিছু লুট করবে, তবে কি তোমরা আমার কথা বিশ্বাস করবে? তারা বলল, হাঁ, আমরা আমাদের অতীত অভিজ্ঞতায় সত্যবাদীরূপেই পেয়েছি। তখন তিনি বললেন, আমি আসন্ন কঠিন শাস্তি সম্পর্কে তোমাদের সতর্ক করছি। এ কথা শুনে আবূ লাহাব বলে উঠল, তুমি ধ্বংস হও, আমাদেরকে এজন্যই একত্র করেছ? এরই পরিপ্রেক্ষিতে লাহাব নাযিল হয়।১০৩
কোনও কোনও বর্ণনা দ্বারা জানা যায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর একাধিক দিন তাদেরকে ডেকে সতর্ক করেছিলেন। কাজেই এমনও হতে পারে যে, বিভিন্ন বর্ণনায় যে বিভিন্ন কথা এসেছে তা তিনি বিভিন্ন দিনে বলেছিলেন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. ইসলামী দাওয়াতের কার্যক্রম নিকটাত্মীয়দের থেকে শুরু করা উচিত।
খ. আখেরাতের মুক্তি বংশীয় পরিচয়ে নয়; বরং ঈমানের ভিত্তিতেই লাভ হবে।
গ. কোনও আত্মীয় অমুসলিম হলেও তার আত্মীয়তার হক সম্পূর্ণ বাতিল হয়ে যায় না। কাজেই তার বিপদ-আপদে খোঁজখবর রাখা চাই ।
ঘ. প্রত্যেকের জন্য সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আখেরাতের নাজাতের ফিকির করা।
১০১. সূরা তাহরীম (৬৬), আয়াত ৬
১০২. ইমাম নববী রহ. এ বাক্যটির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে একটি রূপকালঙ্কারের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। তা হচ্ছে, আত্মীয়তা ছিন্ন করাকে মনে মনে পানি দ্বারা নির্বাপণীয় উত্তাপের সঙ্গে তাশবীহ দেওয়া (উপমিত করা) হয়েছে। তারপর মুশাব্বাহ (উপমেয়)-এর উপর মুশাব্বাহ বিহী (উপমান)-এর অবিচ্ছেদ্য গুণ (লাযিম) 'পানি দ্বারা নির্বাপণ'-কে আরোপ করা হয়েছে। এভাবে বাক্যটিতে মনে মনে যে তাশবীহ হয়েছে সেটি ইস্তি' আরাহ মাকনিয়্যাহ, আর মুশাব্বাহ'র উপর মুশাব্বাহ বিহীর লাযিমের কল্পনা হলো তাখয়ীলিয়্যাহ।
১০৩. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৪৭৭০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২৮০১; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৬৫৫০; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৩১০৬
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
