মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)
১৪- বিবাহ-শাদী সম্পর্কিত অধ্যায়
হাদীস নং: ৩১৫৯
৩. তৃতীয় অনুচ্ছেদ - বিয়ের প্রচার, প্রস্তাব ও শর্তাবলী প্রসঙ্গে
৩১৫৯। তাবেয়ী আমের ইবনে সা'দ (রঃ) বলেন, আমি একদা এক বিবাহে হযরত কারাযা ইবনে কা'ব আনসারী ও আবু মাসউদ আনসারীর নিকট পৌঁছিলাম। তখন দেখি কতক মেয়ে গান গাহিতেছে। ইহা দেখিয়া আমি বলিলাম, হে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাহাবীদ্বয় ও বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবীদ্বয় ! আপনাদের সম্মুখে কি এইরূপ করা হইতেছে ? তখন তাঁহারা বলিলেন, ইচ্ছা হয় বস এবং আমাদের সাথে শুন; আর ইচ্ছা হয় চলিয়া যাও। কেননা, বিবাহের সময় গানের ব্যাপারে আমাদেরকে রুখসত (অনুমতি) দেওয়া হইয়াছে। —নাসায়ী
وَعَنْ عَامِرِ بْنِ سَعْدٍ قَالَ: دَخَلْتُ عَلَى قَرَظَةَ بْنِ كَعْبٍ وَأَبِي مَسْعُودٍ الْأَنْصَارِيِّ فِي عُرْسٍ وَإِذَا جِوَارٍ يُغَنِّينَ فَقُلْتُ: أَيْ صَاحِبَيْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَهْلَ بَدْرٍ يُفْعَلُ هَذَا عِنْدَكُمْ؟ فَقَالَا: اجْلِسْ إِنْ شِئْتَ فَاسْمَعْ مَعَنَا وَإِنْ شِئْتَ فَاذْهَبْ فَإِنَّهُ قَدْ رَخَّصَ لَنَا فِي اللَّهْوِ عِنْدَ الْعُرْسِ. رَوَاهُ النَّسَائِيّ
হাদীসের ব্যাখ্যা:
শরীআতের আসল হুকুমের ব্যতিক্রমকে 'রুখসত' বলে। ইহাতে বুঝা গেল যে, গান তখনও সাধারণভাবেই নিষিদ্ধ ছিল। তাই আমের (রঃ) গান গাওয়া হইতেছে দেখিয়া বিস্ময় প্রকাশ করিলেন। বিবাহে যে ইহার ব্যতিক্রম তাহা তাঁহার জানা ছিল না। সাহাবীদ্বয়ের তাহা জানা ছিল।
পরিশিষ্ট
গান ও বাদ্য
(ক) কোরআনে রহিয়াছেঃ ........وَمِنَ النَّاسِ مَن يَشْتَرِي لَهْوَ الْحَدِيثِ
“মানুষের মধ্যে এমন লোকও রহিয়াছে, যে 'লাহভাল হাদীস' খরিদ করে (অবলম্বন করে), যাহাতে লোকদের আল্লাহর পথ হইতে বিপথগামী করিতে পারে। (সূরা লুকমান, আয়াত ৬)
'লাইভ' অর্থ, খেলাধুলা বা আমোদ-প্রমোদ ইত্যাদি, যাহার দিকে মানুষ আকৃষ্ট হয় এবং যাহা মানুষকে অন্য কাজ হইতে আবদ্ধ রাখে। 'হাদীস' অর্থ, বার্তা, কথা। এক সাথে ইহার অর্থ, যে কথা মানুষকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করে এবং অন্যদিক হইতে বিরত থাকে।
সাহাবীদের মধ্যে বিশিষ্ট জ্ঞানী সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ, কোরআন বিশেষজ্ঞ সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস এবং হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর ও হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ্ (রাঃ) 'লাহভাল হাদীস' বলিতে এখানে গানকেই বুঝিয়াছেন। তাবেয়ীনের মধ্যে হযরত সায়ীদ ইবনে জুবাইর, কাতাদা, নখয়ী, ইকরেমা, মায়মুন ইবনে মেহরান, মাকহুল, শামী ও হযরত হাসান বসরীও ইহার এ অর্থ করিয়াছেন। কুরতুবী তাঁহার এক তফসীরে বলেন, এ আয়াতের ব্যাখ্যাসমূহের মধ্যে ইহাই হইল উত্তম ব্যাখ্যা। হযরত ইবনে মাসউদ হলফ করিয়া এই ব্যাখ্যা করিয়াছেন। অপর একদল ইহার ব্যাখ্যায় বলিয়াছেন, “আহলে বাতেল ও খেলাধুলায় মত্ত ব্যক্তিগণ যাহা লইয়া মগ্ন থাকে তাহা।” এই ব্যাখ্যা আরও ব্যাপক। সুতরাং ইহাতেও গান শামিল রহিয়াছে।
(খ) কোরআনের অপর জায়গায় আল্লাহ্ রোষের সাথে বিদ্রুপ করিয়া শয়তানকে বলিতেছেনঃ
“(যাও,) তুমি তোমার ‘আওয়ায়' দ্বারা তাহাদের মধ্যে যাহাকে পার গোমরাহ কর।” (সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াত ৬৪) রঈসুল মুফাসসেরীন হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এখানে 'আওয়ায' অর্থেও গানকেই বুঝিয়াছেন। হাদীসে রহিয়াছেঃ
(গ) হযরত আনাস (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত আছে, নবী করীম (ﷺ) বলিয়াছেন, দুইটি 'আওয়ায' অভিশপ্ত ও অনাচারের প্রতি আহ্বায়ক। বাদ্যযন্ত্রের আওয়ায এবং সুর ও আনন্দ প্রকাশকালে শয়তানের আওয়ায়। (এখানে সুরকেই শয়তানের আওয়াযের সাথে তুলনা করা হইয়াছে।)
(ঘ) হযরত আলী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলিয়াছেন, আমার উম্মত যখন চৌদ্দটি কাজ করিবে, তাহাদের প্রতি বিপদ আপতিত হইবে। তন্মধ্যে তিনি বলিয়াছেন, “যখন গায়িকা ও বাদ্যযন্ত্র রাখা হইবে।”
(ঙ) হযরত আবু হুরায়রা ([রাঃ] ঐ হাদীসে) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলিয়াছেন, “যখন গায়িকা ও বাদ্যযন্ত্র প্রকাশ পাইবে।”
(চ) আবদুল্লাহ্ ইবনে মোবারক (তাঁহার সুনানে) হযরত আনাস প্রমুখাৎ বর্ণনা করিয়াছেন, “যে ব্যক্তি গায়িকার নিকট গান শুনিতে বসিয়াছে, কিয়ামতের দিন তাহার কানে সীসা গলাইয়া ঢালা হইবে।”
(ছ) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলিয়াছেন, গান মানুষের অন্তরে নেফাক বা কপটতার সৃষ্টি করে (অর্থাৎ, আল্লাহ্ হইতে দূরে সরাইয়া রাখে)।
এ সকল আয়াত, হাদীস ও আ-সার উদ্ধৃত করার পর বিখ্যাত তফসীরকার ও ফকীহ্ আল্লামা কুরতুবী (মৃত্যুঃ ৬৭১ হিজরী) বলেন, এ কারণেই ওলামারা গানকে হারাম বলিয়াছেন। গানে যখন নারীর আলোচনা ও তাহাদের রূপ বর্ণনা অথবা শরাব ইত্যাদির ন্যায় নিষিদ্ধ জিনিসের উল্লেখ থাকে, তখন বিনা মতভেদে উহা হারাম। হাঁ, যেসকল গান এসকল দোষ হইতে মুক্ত, উহার সামান্য পরিমাণ বিবাহ ও ঈদ ইত্যাদির ন্যায় খুশীর স্থলে অথবা কঠোর পরিশ্রমকালে মনে আনন্দ ও উৎসাহ সঞ্চারের জন্য জায়েয। কিন্তু এ যুগের (খৃষ্টীয় ১৩ শতকের মাঝামাঝি) সুফীরা বাদ্যযন্ত্র সহকারে সর্বদা গান শোনার যে নূতন রীতি আবিষ্কার করিয়াছেন তাহা নিশ্চয় হারাম।
অতঃপর কুরতুবী গানের বিপক্ষে চারি ইমামের প্রত্যেকের মত পৃথক পৃথকভাবে উল্লেখ করিয়াছেন। (তফসীরে কুরতুবী, ১৪ খৃঃ পূঃ ৫১–৫৬ দ্রষ্টব্য)
পরবর্তী যুগের শ্রেষ্ঠ তফসীরকার আল্লামা সৈয়দ আলুসী বাগদাদী সূরা লুকমানে “লাহভাল হাদীস”-এর তফসীরে গান-বাদ্য সম্পর্কে সুদীর্ঘ আলোচনা করিয়াছেন এবং গান-বাদ্যসহ উহা হারাম হওয়া সম্বন্ধে সুফিয়াদের বহু দলীল-প্রমাণ উপস্থিত করিয়াছেন। এছাড়া আমাদের ফকীহগণ গান-বাদ্যকে হারাম বলিয়াছেন। এ সম্বন্ধে পৃথক একটি পুস্তক লেখার বাসনায় এখানে ইহার আলোচনা সংক্ষেপে করা গেল।
পরিশিষ্ট
গান ও বাদ্য
(ক) কোরআনে রহিয়াছেঃ ........وَمِنَ النَّاسِ مَن يَشْتَرِي لَهْوَ الْحَدِيثِ
“মানুষের মধ্যে এমন লোকও রহিয়াছে, যে 'লাহভাল হাদীস' খরিদ করে (অবলম্বন করে), যাহাতে লোকদের আল্লাহর পথ হইতে বিপথগামী করিতে পারে। (সূরা লুকমান, আয়াত ৬)
'লাইভ' অর্থ, খেলাধুলা বা আমোদ-প্রমোদ ইত্যাদি, যাহার দিকে মানুষ আকৃষ্ট হয় এবং যাহা মানুষকে অন্য কাজ হইতে আবদ্ধ রাখে। 'হাদীস' অর্থ, বার্তা, কথা। এক সাথে ইহার অর্থ, যে কথা মানুষকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করে এবং অন্যদিক হইতে বিরত থাকে।
সাহাবীদের মধ্যে বিশিষ্ট জ্ঞানী সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ, কোরআন বিশেষজ্ঞ সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস এবং হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর ও হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ্ (রাঃ) 'লাহভাল হাদীস' বলিতে এখানে গানকেই বুঝিয়াছেন। তাবেয়ীনের মধ্যে হযরত সায়ীদ ইবনে জুবাইর, কাতাদা, নখয়ী, ইকরেমা, মায়মুন ইবনে মেহরান, মাকহুল, শামী ও হযরত হাসান বসরীও ইহার এ অর্থ করিয়াছেন। কুরতুবী তাঁহার এক তফসীরে বলেন, এ আয়াতের ব্যাখ্যাসমূহের মধ্যে ইহাই হইল উত্তম ব্যাখ্যা। হযরত ইবনে মাসউদ হলফ করিয়া এই ব্যাখ্যা করিয়াছেন। অপর একদল ইহার ব্যাখ্যায় বলিয়াছেন, “আহলে বাতেল ও খেলাধুলায় মত্ত ব্যক্তিগণ যাহা লইয়া মগ্ন থাকে তাহা।” এই ব্যাখ্যা আরও ব্যাপক। সুতরাং ইহাতেও গান শামিল রহিয়াছে।
(খ) কোরআনের অপর জায়গায় আল্লাহ্ রোষের সাথে বিদ্রুপ করিয়া শয়তানকে বলিতেছেনঃ
“(যাও,) তুমি তোমার ‘আওয়ায়' দ্বারা তাহাদের মধ্যে যাহাকে পার গোমরাহ কর।” (সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াত ৬৪) রঈসুল মুফাসসেরীন হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এখানে 'আওয়ায' অর্থেও গানকেই বুঝিয়াছেন। হাদীসে রহিয়াছেঃ
(গ) হযরত আনাস (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত আছে, নবী করীম (ﷺ) বলিয়াছেন, দুইটি 'আওয়ায' অভিশপ্ত ও অনাচারের প্রতি আহ্বায়ক। বাদ্যযন্ত্রের আওয়ায এবং সুর ও আনন্দ প্রকাশকালে শয়তানের আওয়ায়। (এখানে সুরকেই শয়তানের আওয়াযের সাথে তুলনা করা হইয়াছে।)
(ঘ) হযরত আলী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলিয়াছেন, আমার উম্মত যখন চৌদ্দটি কাজ করিবে, তাহাদের প্রতি বিপদ আপতিত হইবে। তন্মধ্যে তিনি বলিয়াছেন, “যখন গায়িকা ও বাদ্যযন্ত্র রাখা হইবে।”
(ঙ) হযরত আবু হুরায়রা ([রাঃ] ঐ হাদীসে) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলিয়াছেন, “যখন গায়িকা ও বাদ্যযন্ত্র প্রকাশ পাইবে।”
(চ) আবদুল্লাহ্ ইবনে মোবারক (তাঁহার সুনানে) হযরত আনাস প্রমুখাৎ বর্ণনা করিয়াছেন, “যে ব্যক্তি গায়িকার নিকট গান শুনিতে বসিয়াছে, কিয়ামতের দিন তাহার কানে সীসা গলাইয়া ঢালা হইবে।”
(ছ) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলিয়াছেন, গান মানুষের অন্তরে নেফাক বা কপটতার সৃষ্টি করে (অর্থাৎ, আল্লাহ্ হইতে দূরে সরাইয়া রাখে)।
এ সকল আয়াত, হাদীস ও আ-সার উদ্ধৃত করার পর বিখ্যাত তফসীরকার ও ফকীহ্ আল্লামা কুরতুবী (মৃত্যুঃ ৬৭১ হিজরী) বলেন, এ কারণেই ওলামারা গানকে হারাম বলিয়াছেন। গানে যখন নারীর আলোচনা ও তাহাদের রূপ বর্ণনা অথবা শরাব ইত্যাদির ন্যায় নিষিদ্ধ জিনিসের উল্লেখ থাকে, তখন বিনা মতভেদে উহা হারাম। হাঁ, যেসকল গান এসকল দোষ হইতে মুক্ত, উহার সামান্য পরিমাণ বিবাহ ও ঈদ ইত্যাদির ন্যায় খুশীর স্থলে অথবা কঠোর পরিশ্রমকালে মনে আনন্দ ও উৎসাহ সঞ্চারের জন্য জায়েয। কিন্তু এ যুগের (খৃষ্টীয় ১৩ শতকের মাঝামাঝি) সুফীরা বাদ্যযন্ত্র সহকারে সর্বদা গান শোনার যে নূতন রীতি আবিষ্কার করিয়াছেন তাহা নিশ্চয় হারাম।
অতঃপর কুরতুবী গানের বিপক্ষে চারি ইমামের প্রত্যেকের মত পৃথক পৃথকভাবে উল্লেখ করিয়াছেন। (তফসীরে কুরতুবী, ১৪ খৃঃ পূঃ ৫১–৫৬ দ্রষ্টব্য)
পরবর্তী যুগের শ্রেষ্ঠ তফসীরকার আল্লামা সৈয়দ আলুসী বাগদাদী সূরা লুকমানে “লাহভাল হাদীস”-এর তফসীরে গান-বাদ্য সম্পর্কে সুদীর্ঘ আলোচনা করিয়াছেন এবং গান-বাদ্যসহ উহা হারাম হওয়া সম্বন্ধে সুফিয়াদের বহু দলীল-প্রমাণ উপস্থিত করিয়াছেন। এছাড়া আমাদের ফকীহগণ গান-বাদ্যকে হারাম বলিয়াছেন। এ সম্বন্ধে পৃথক একটি পুস্তক লেখার বাসনায় এখানে ইহার আলোচনা সংক্ষেপে করা গেল।
