মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)
৯- কুরআনের ফাযাঈল অধ্যায়
হাদীস নং: ২২১১
২. প্রথম অনুচ্ছেদ - কিরাআতের ভিন্নতা ও কুরআন সংকলন প্রসঙ্গে
২২১১। হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) বলেন, আমি হেশাম ইবনে হাকীম ইবনে হেযামকে সূরা ‘ফোরকান' পড়িতে শুনিলাম আমি যেভাবে উহা পড়ি তাহা হইতে ভিন্নতররূপে, অথচ স্বয়ং রাসূলুল্লাহ্ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে উহা পড়াইয়াছেন। অতএব, আমি তাহার উপর ঝাঁপাইয়া পড়িতে উদ্যত হইলাম কিন্তু (তখন সে নামায পড়িতেছিল। তাই) নামায শেষ করা পর্যন্ত তাহাকে সময় দিলাম। অতঃপর আমি তাহাকে তাহার চাদর গলায় পেঁচাইয়া রাসূলুল্লাহ্ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট লইয়া গেলাম এবং বলিলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আপনি যেরূপে আমাকে পড়াইয়াছেন তাহা হইতে ভিন্নতররূপে আমি ইহাকে সূরা 'ফোরকান’ পড়িতে শুনিয়াছি। তখন রাসূলুল্লাহ্ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলিলেনঃ তাহাকে ছাড়িয়া দাও এবং হেশামকে বলিলেন, হেশাম, তুমি উহা পড় তো দেখি! সে উহা আমি তাহাকে যেরূপ পড়িতে শুনিয়াছিলাম সেরূপই পড়িল। শুনিয়া রাসূলুল্লাহ্ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলিলেন, এইরূপেও ইহা নাযিল হইয়াছে। অতঃপর আমাকে বলিলেন, তুমি পড় দেখি! সুতরাং আমিও পড়িলাম। শুনিয়া তিনি বলিলেন, ইহা এইরূপেও নাযিল হইয়াছে। বস্তুতঃ এই কোরআন সাত রীতিতে নাযিল করা হইয়াছে। সুতরাং তোমাদের (যাহার জন্য) যাহা সহজ হয় তাহাই পড়িবে। —মোত্তাঃ, কিন্তু পাঠ মুসলিমের।
بَابُ اِخْتِلَافِ الْقِرَاءَاتِ وَجَمْعِ الْقُرْاٰنِ
وَعَنْ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: سَمِعْتُ هِشَامَ بْنَ حَكِيمِ بْنِ حِزَامٍ يقْرَأ سُورَة الْفرْقَان على غير مَا أقرؤوها. وَكَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَقْرَأَنِيهَا فَكِدْتُ أَنْ أَعْجَلَ عَلَيْهِ ثُمَّ أَمْهَلْتُهُ حَتَّى انْصَرَفَ ثُمَّ لَبَّبْتُهُ بِرِدَائِهِ فَجِئْتُ بِهِ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ. فَقلت يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنِّي سَمِعْتُ هَذَا يَقْرَأُ سُورَةَ الْفُرْقَانِ عَلَى غَيْرِ مَا أَقْرَأْتَنِيهَا. فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَرْسِلْهُ اقْرَأ فَقَرَأت الْقِرَاءَةَ الَّتِي سَمِعْتُهُ يَقْرَأُ. فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «هَكَذَا أُنْزِلَتْ» . ثُمَّ قَالَ لي: «اقْرَأ» . فَقَرَأت. فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «هَكَذَا أنزلت إِن الْقُرْآنَ أُنْزِلَ عَلَى سَبْعَةِ أَحْرُفٍ فَاقْرَءُوا مَا تيَسّر مِنْهُ» . مُتَّفق عَلَيْهِ. وَاللَّفْظ لمُسلم
হাদীসের ব্যাখ্যা:
কোরআন সঙ্কলনঃ
কোরআন পাক আল্লাহর নিকট লওহে মাহফুযে এক নির্দিষ্ট নিয়মে সাজানো রহিয়াছে। তাহা হইতে উহা তেইশ বৎসরে হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (ﷺ)-এর উপর আবশ্যক অনুসারে অল্প অল্প করিয়া নাযিল হইয়াছে। যখনই উহার যে আয়াত বা আয়াতসমূহ নাযিল হইয়াছে, তখনই হযরত জিব্রাঈল (আঃ) উহা লওহে মাহ্ফূযের তরতীব (ক্রম) অনুসারে কোন্ সূরায় কোন্ আয়াতের আগে বা পরে বসিবে তাহা বলিয়া দিয়াছেন এবং তদনুসারে হুযূর সাথে সাথে উহা মুখস্থ করিয়া লইয়াছেন এবং ওহীর লেখক (কাতেবীনে ওহী) সাহাবীগণ দ্বারা উহা হাড়, চামড়া ও খেজুর ডালা প্রভৃতির উপর লেখাইয়া লইয়াছেন। এতদ্ব্যতীত তিনি উহা সর্বদা নামাযে পড়িয়াছেন এবং প্রত্যেক রমযানে পূর্বে অবতীর্ণ সম্যক কোরআন হযরত জিব্রাঈল (আঃ)-কে পড়িয়া শুনাইয়াছেন। সাহাবীগণ নামাযে পড়ার এবং আল্লাহর কালামকে রক্ষা করার জন্য কেহ আংশিক আর কেহ পূর্ণ কোরআন সাথে সাথে হেফয করিয়া লইয়াছেন। মোটকথা, নবী করীম (ﷺ) আপন জীবনকালেই সমস্ত কোরআন লেখাইয়া লইয়াছেন এবং কোন কোন সাহাবীও নিজ নিজ ব্যবহারের জন্য উহা লেখিয়া লইয়াছেন, কিন্তু তাঁহার জীবনকালে বরাবর উহা অবতীর্ণ হইতে থাকায় লিখিত সমস্ত অংশ একত্র করিয়া কিতাব আকারে সাজানো সম্ভবপর হয় নাই।
নবী করীম (ﷺ)-এর ওফাতের অব্যবহিত পরেই ইয়ামামার যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং উহাতে বহু কোরআনের আলেম ও হাফেয সাহাবী শহীদ হন। ইহা দেখিয়া হযরত ওমর (রাঃ) খলীফা হযরত আবু বকর (রাঃ)-কে কোরআন পাকের লিখিত আয়াত সমূহকে হাফেযদের সাক্ষাতে একত্র করিয়া 'মাসহাফ' বা কিতাবরূপে সাজাইতে অনুরোধ করেন। তদনুসারে খলীফা আবু বকর (রাঃ) ওহীর লেখক ও কোরআনের হাফেয এবং কারী সাহাবী হযরত যায়দ ইবনে সাবেত আনসারীকে হযরত ওমরের সহযোগিতায় উহা সাজাইবার ভার দেন। যায়দ হাড়গোড়ে লিখিত আয়াতকে অন্ততঃ দুই জন সাহাবীর সাক্ষাতে ও তাঁহাদের উপস্থিতিতে কিতাবে লিপিবদ্ধ করেন এবং সাহাবীদের মধ্যে যাঁহাদের নিকট যাহা হেফয বা লিখিত ছিল, তাহার সহিতও উহা মিলাইয়া দেখেন।
এভাবে কোরআন পাক কিতাব আকারে লিপিবদ্ধ হওয়ার পর উহার খণ্ডসমূহ খলীফা হযরত আবু বকর, অতঃপর খলীফা হযরত ওমর, তাঁহার পর তাঁহার কন্যা ও হুযুরের সহধর্মিণী বিবি হাফসার নিকট রক্ষিত থাকে এবং উহা হইতে জনসাধারণ আপন আপন পাঠের জন্য অনুলিপি করিতে থাকে। কিন্তু অনুলিপিকালে কেহ কেহ কোন কোন শব্দে আপন আপন গোত্রীয় রীতির অনুসরণ করে। আর এই গোত্রীয় রীতিতে কোরআন পাঠের অনুমতি তাহাদিগকে হুযূরের যমানায় দেওয়া হইয়াছিল। ফলে বিভিন্ন গোত্রে কোরআন পাকের বিভিন্ন পাঠ প্রচলিত হইয়া পড়ে।
খলীফা হযরত ওসমান গনীর খেলাফতের প্রথম দিকে আর্মেনিয়া ও আযারবাইজান যুদ্ধ চলাকালে হেজায ও শামের বিভিন্ন গোত্রের মুসলমানদের মধ্যে কোরআন পাকের বিভিন্ন পাঠ দেখিয়া এবং ইহার ভাবী পরিণাম চিন্তা করিয়া দূরদর্শী সাহাবী হযরত হুযায়ফা ইবনে ইয়ামান চিন্তিত হইয়া পড়েন এবং মদীনায় আসিয়া কোরআন পাকের একপাঠে সকলকে বাধ্য করার জন্য খলীফাকে অনুরোধ করেন। খলীফা পঞ্চাশ হাজার সাহাবীকে একত্র করিয়া এ ব্যাপারে তাঁহাদের পরামর্শ গ্রহণ করেন। অতঃপর বিবি হাফসার নিকট হইতে কোরআন পাকের সেই আসল কপি তলব করিয়া লন এবং সেই হযরত যায়দ ইবনে সাবেত আনসারীকে তিনজন কুরাইশী সাহাবী আবদুল্লাহ্ ইবনে যুবায়র, সায়ীদ ইবনুল আস ও আবদুর রহমান ইবনে হারেস সমভিব্যাহারে ইহার বিভিন্ন অনুলিপি প্রস্তুত করিতে নির্দেশ দেন এবং কুরাইশী তিনজনকে বলিয়া দেন যে, “যখন আপনাদের এবং যায়দের মধ্যে কোন শব্দের উচ্চারণ বা বানানে মতভেদ দেখা দিবে, আপনারা উহা কুরাইশদের রীতিতেই লিপিবদ্ধ করিবেন। কেননা, কোরআন তাহাদের ভাষায়, তাহাদের রীতিতেই নাযিল হইয়াছে।"
এইরূপে কোরআন পাকের ছয় আর কাহারও মতে সাত কপি অনুলিপি প্রস্তুত হয়। খলীফা ইহার এক কপি মদীনায় রাখিয়া বাকী কপিসমূহের এক এক কপি মক্কা, শাম, ইয়ামন, বসরা ও কৃষ্ণায় আর কাহারও মতে সপ্তম কপি বাহরাইনে প্রেরণ করেন এবং ইহার হুবহু অনুকরণ করিতে লোকদিগকে বাধ্য করেন। ইহাছাড়া পূর্বের লিখা যাহার নিকট কোরআনের যে কপি ছিল তাহা জ্বালাইয়া দিতে নির্দেশ দেন এবং উম্মতে মুহাম্মদীকে কোরআন পাঠে মতভেদ হইতে চিরতরে রক্ষা করেন। (আল্লাহ্ তাঁহাকে ও হযরত হুযায়ফাকে সমস্ত উম্মতের পক্ষ হইতে মহান পুরস্কার দান করুন। আমীন!) এ কারণেই তিনি “জামেউল কোরআন” বা কোরআন একত্রকারী নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন—যদিও আসলে তিনি কোরআন একত্রকারী নহেন; বরং এক পাঠের পক্ষে লোকদিগকে একত্রকারী। ইহা ২৫ হিজরী সন অর্থাৎ, হযরত ওসমানের খেলাফত লাভের তৃতীয় এবং হুযূরের ওফাতের পনরতম বৎসরের ঘটনা।
বর্তমানে আমাদের মধ্যে যে কোরআন প্রচলিত রহিয়াছে, তাহা সেই মাসহাফে ওসমানীরই অবিকল নকল। অর্থাৎ, হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (ﷺ)-এর উপর যে কোরআন নাযিল হইয়াছে অবিকল তাহাই। একটি মাত্র অক্ষরেরও বেশ কম নাই। এমন কি তৎকালে আরবী লিপিশিল্প প্রাথমিক স্তরে থাকার কারণে মাসহাফে ওসমানীতে যে কয়টি শব্দ বর্তমান লিপি-পদ্ধতির বাতিক্রমে লেখা হইয়াছে, অদ্যাবধি তাহারই অনুকরণ করা হইয়াছে, যথা—'রহমত' শব্দ বর্তমান লিপি-পদ্ধতি অনুসারে গোল 'তা' দ্বারা رحمة লেখা হয়, কিন্তু মাসহাফে ওসমানীতে উহা চারি স্থলে লম্বা 'তা' দ্বারা رحمت লেখা হইয়াছে। এখন আমাদের কোরআনেও এইরূপই রহিয়াছে। এইরূপ আরও শব্দের উদাহরণ রহিয়াছে। পরে উমাইয়া খলীফা আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ান (মৃত্যু ৮৬ হিঃ) কোরআন পাকে যের-যবর দেওয়ার ব্যবস্থা করেন, যাহাতে অনারবরা উহা ভুল না পড়ে। ইহাতে কোন শব্দের আকার বা অর্থের ইতরবিশেষ ঘটে নাই। অতঃপর কেহ কেহ কোরআন পাকের সমস্ত আয়াত, শব্দ, অক্ষর এমন কি নোকতা বা বিন্দুসমূহ পর্যন্ত গণিয়া পড়িয়া রাখিয়াছেন। কোরআন পাকে মোট একশত চৌদ্দটি সূরা এবং হযরত ইবনে আব্বাসের গণনা অনুসারে ছয় হাযার ছয়শত ষোলটি বাক্য, পঁচাত্তর হাজার নয়শত চৌত্রিশটি শব্দ এবং তিন লক্ষ তেতাল্লিশ হাজার ছয় শত একত্রিশটি অক্ষর রহিয়াছে। (এতকান, ৫৭–৬০ )
পরবর্তী লোকেরা এক হাদীসের (১৯৫৬ নং) ইঙ্গিত অনুসারে সপ্তাহে একবার পড়ার জন্য উহাকে সাত মঞ্জিলে, মাসে একবার পড়ার জন্য ত্রিশ পারায় ভাগ করিয়াছেন। রমযানের তারাবীতে সাতাইশ তারিখে শবে কদরের রাত্রিতে খতম করার উদ্দেশ্যে উহাকে পাঁচ শত চল্লিশ রুকূতে ভাগ করা হইয়াছে। দৈনিক ২০ রাকআত করিয়া ২৭ দিনে ৫৪০ রাকআত হয়। আয়াত ও সূরাসমূহের বিন্যাস সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ ২১১৮ নং হাদীসের ব্যাখ্যায় দেখুন।
সকল ভাষারই আঞ্চলিক রীতি ভিন্ন ভিন্ন। আমরা বলি, যাইব, যাব, যাইমু, যাইবাম, পুত্র, পুত, পোয়া, হোলা ইত্যাদি। আরবী ভাষার আঞ্চলিক রীতিসমূহও বিভিন্ন ছিল ও আছে। নিরক্ষর ও বুড়াদের সুবিধার জন্য হুযূরের যমানায় কোরআন পাঠে বিভিন্ন রীতির অনুমোদন করা হইয়াছিল। (বিস্তারিত বিবরণ পরে আসিতেছে।)
কোরআন পাক আল্লাহর নিকট লওহে মাহফুযে এক নির্দিষ্ট নিয়মে সাজানো রহিয়াছে। তাহা হইতে উহা তেইশ বৎসরে হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (ﷺ)-এর উপর আবশ্যক অনুসারে অল্প অল্প করিয়া নাযিল হইয়াছে। যখনই উহার যে আয়াত বা আয়াতসমূহ নাযিল হইয়াছে, তখনই হযরত জিব্রাঈল (আঃ) উহা লওহে মাহ্ফূযের তরতীব (ক্রম) অনুসারে কোন্ সূরায় কোন্ আয়াতের আগে বা পরে বসিবে তাহা বলিয়া দিয়াছেন এবং তদনুসারে হুযূর সাথে সাথে উহা মুখস্থ করিয়া লইয়াছেন এবং ওহীর লেখক (কাতেবীনে ওহী) সাহাবীগণ দ্বারা উহা হাড়, চামড়া ও খেজুর ডালা প্রভৃতির উপর লেখাইয়া লইয়াছেন। এতদ্ব্যতীত তিনি উহা সর্বদা নামাযে পড়িয়াছেন এবং প্রত্যেক রমযানে পূর্বে অবতীর্ণ সম্যক কোরআন হযরত জিব্রাঈল (আঃ)-কে পড়িয়া শুনাইয়াছেন। সাহাবীগণ নামাযে পড়ার এবং আল্লাহর কালামকে রক্ষা করার জন্য কেহ আংশিক আর কেহ পূর্ণ কোরআন সাথে সাথে হেফয করিয়া লইয়াছেন। মোটকথা, নবী করীম (ﷺ) আপন জীবনকালেই সমস্ত কোরআন লেখাইয়া লইয়াছেন এবং কোন কোন সাহাবীও নিজ নিজ ব্যবহারের জন্য উহা লেখিয়া লইয়াছেন, কিন্তু তাঁহার জীবনকালে বরাবর উহা অবতীর্ণ হইতে থাকায় লিখিত সমস্ত অংশ একত্র করিয়া কিতাব আকারে সাজানো সম্ভবপর হয় নাই।
নবী করীম (ﷺ)-এর ওফাতের অব্যবহিত পরেই ইয়ামামার যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং উহাতে বহু কোরআনের আলেম ও হাফেয সাহাবী শহীদ হন। ইহা দেখিয়া হযরত ওমর (রাঃ) খলীফা হযরত আবু বকর (রাঃ)-কে কোরআন পাকের লিখিত আয়াত সমূহকে হাফেযদের সাক্ষাতে একত্র করিয়া 'মাসহাফ' বা কিতাবরূপে সাজাইতে অনুরোধ করেন। তদনুসারে খলীফা আবু বকর (রাঃ) ওহীর লেখক ও কোরআনের হাফেয এবং কারী সাহাবী হযরত যায়দ ইবনে সাবেত আনসারীকে হযরত ওমরের সহযোগিতায় উহা সাজাইবার ভার দেন। যায়দ হাড়গোড়ে লিখিত আয়াতকে অন্ততঃ দুই জন সাহাবীর সাক্ষাতে ও তাঁহাদের উপস্থিতিতে কিতাবে লিপিবদ্ধ করেন এবং সাহাবীদের মধ্যে যাঁহাদের নিকট যাহা হেফয বা লিখিত ছিল, তাহার সহিতও উহা মিলাইয়া দেখেন।
এভাবে কোরআন পাক কিতাব আকারে লিপিবদ্ধ হওয়ার পর উহার খণ্ডসমূহ খলীফা হযরত আবু বকর, অতঃপর খলীফা হযরত ওমর, তাঁহার পর তাঁহার কন্যা ও হুযুরের সহধর্মিণী বিবি হাফসার নিকট রক্ষিত থাকে এবং উহা হইতে জনসাধারণ আপন আপন পাঠের জন্য অনুলিপি করিতে থাকে। কিন্তু অনুলিপিকালে কেহ কেহ কোন কোন শব্দে আপন আপন গোত্রীয় রীতির অনুসরণ করে। আর এই গোত্রীয় রীতিতে কোরআন পাঠের অনুমতি তাহাদিগকে হুযূরের যমানায় দেওয়া হইয়াছিল। ফলে বিভিন্ন গোত্রে কোরআন পাকের বিভিন্ন পাঠ প্রচলিত হইয়া পড়ে।
খলীফা হযরত ওসমান গনীর খেলাফতের প্রথম দিকে আর্মেনিয়া ও আযারবাইজান যুদ্ধ চলাকালে হেজায ও শামের বিভিন্ন গোত্রের মুসলমানদের মধ্যে কোরআন পাকের বিভিন্ন পাঠ দেখিয়া এবং ইহার ভাবী পরিণাম চিন্তা করিয়া দূরদর্শী সাহাবী হযরত হুযায়ফা ইবনে ইয়ামান চিন্তিত হইয়া পড়েন এবং মদীনায় আসিয়া কোরআন পাকের একপাঠে সকলকে বাধ্য করার জন্য খলীফাকে অনুরোধ করেন। খলীফা পঞ্চাশ হাজার সাহাবীকে একত্র করিয়া এ ব্যাপারে তাঁহাদের পরামর্শ গ্রহণ করেন। অতঃপর বিবি হাফসার নিকট হইতে কোরআন পাকের সেই আসল কপি তলব করিয়া লন এবং সেই হযরত যায়দ ইবনে সাবেত আনসারীকে তিনজন কুরাইশী সাহাবী আবদুল্লাহ্ ইবনে যুবায়র, সায়ীদ ইবনুল আস ও আবদুর রহমান ইবনে হারেস সমভিব্যাহারে ইহার বিভিন্ন অনুলিপি প্রস্তুত করিতে নির্দেশ দেন এবং কুরাইশী তিনজনকে বলিয়া দেন যে, “যখন আপনাদের এবং যায়দের মধ্যে কোন শব্দের উচ্চারণ বা বানানে মতভেদ দেখা দিবে, আপনারা উহা কুরাইশদের রীতিতেই লিপিবদ্ধ করিবেন। কেননা, কোরআন তাহাদের ভাষায়, তাহাদের রীতিতেই নাযিল হইয়াছে।"
এইরূপে কোরআন পাকের ছয় আর কাহারও মতে সাত কপি অনুলিপি প্রস্তুত হয়। খলীফা ইহার এক কপি মদীনায় রাখিয়া বাকী কপিসমূহের এক এক কপি মক্কা, শাম, ইয়ামন, বসরা ও কৃষ্ণায় আর কাহারও মতে সপ্তম কপি বাহরাইনে প্রেরণ করেন এবং ইহার হুবহু অনুকরণ করিতে লোকদিগকে বাধ্য করেন। ইহাছাড়া পূর্বের লিখা যাহার নিকট কোরআনের যে কপি ছিল তাহা জ্বালাইয়া দিতে নির্দেশ দেন এবং উম্মতে মুহাম্মদীকে কোরআন পাঠে মতভেদ হইতে চিরতরে রক্ষা করেন। (আল্লাহ্ তাঁহাকে ও হযরত হুযায়ফাকে সমস্ত উম্মতের পক্ষ হইতে মহান পুরস্কার দান করুন। আমীন!) এ কারণেই তিনি “জামেউল কোরআন” বা কোরআন একত্রকারী নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন—যদিও আসলে তিনি কোরআন একত্রকারী নহেন; বরং এক পাঠের পক্ষে লোকদিগকে একত্রকারী। ইহা ২৫ হিজরী সন অর্থাৎ, হযরত ওসমানের খেলাফত লাভের তৃতীয় এবং হুযূরের ওফাতের পনরতম বৎসরের ঘটনা।
বর্তমানে আমাদের মধ্যে যে কোরআন প্রচলিত রহিয়াছে, তাহা সেই মাসহাফে ওসমানীরই অবিকল নকল। অর্থাৎ, হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (ﷺ)-এর উপর যে কোরআন নাযিল হইয়াছে অবিকল তাহাই। একটি মাত্র অক্ষরেরও বেশ কম নাই। এমন কি তৎকালে আরবী লিপিশিল্প প্রাথমিক স্তরে থাকার কারণে মাসহাফে ওসমানীতে যে কয়টি শব্দ বর্তমান লিপি-পদ্ধতির বাতিক্রমে লেখা হইয়াছে, অদ্যাবধি তাহারই অনুকরণ করা হইয়াছে, যথা—'রহমত' শব্দ বর্তমান লিপি-পদ্ধতি অনুসারে গোল 'তা' দ্বারা رحمة লেখা হয়, কিন্তু মাসহাফে ওসমানীতে উহা চারি স্থলে লম্বা 'তা' দ্বারা رحمت লেখা হইয়াছে। এখন আমাদের কোরআনেও এইরূপই রহিয়াছে। এইরূপ আরও শব্দের উদাহরণ রহিয়াছে। পরে উমাইয়া খলীফা আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ান (মৃত্যু ৮৬ হিঃ) কোরআন পাকে যের-যবর দেওয়ার ব্যবস্থা করেন, যাহাতে অনারবরা উহা ভুল না পড়ে। ইহাতে কোন শব্দের আকার বা অর্থের ইতরবিশেষ ঘটে নাই। অতঃপর কেহ কেহ কোরআন পাকের সমস্ত আয়াত, শব্দ, অক্ষর এমন কি নোকতা বা বিন্দুসমূহ পর্যন্ত গণিয়া পড়িয়া রাখিয়াছেন। কোরআন পাকে মোট একশত চৌদ্দটি সূরা এবং হযরত ইবনে আব্বাসের গণনা অনুসারে ছয় হাযার ছয়শত ষোলটি বাক্য, পঁচাত্তর হাজার নয়শত চৌত্রিশটি শব্দ এবং তিন লক্ষ তেতাল্লিশ হাজার ছয় শত একত্রিশটি অক্ষর রহিয়াছে। (এতকান, ৫৭–৬০ )
পরবর্তী লোকেরা এক হাদীসের (১৯৫৬ নং) ইঙ্গিত অনুসারে সপ্তাহে একবার পড়ার জন্য উহাকে সাত মঞ্জিলে, মাসে একবার পড়ার জন্য ত্রিশ পারায় ভাগ করিয়াছেন। রমযানের তারাবীতে সাতাইশ তারিখে শবে কদরের রাত্রিতে খতম করার উদ্দেশ্যে উহাকে পাঁচ শত চল্লিশ রুকূতে ভাগ করা হইয়াছে। দৈনিক ২০ রাকআত করিয়া ২৭ দিনে ৫৪০ রাকআত হয়। আয়াত ও সূরাসমূহের বিন্যাস সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ ২১১৮ নং হাদীসের ব্যাখ্যায় দেখুন।
সকল ভাষারই আঞ্চলিক রীতি ভিন্ন ভিন্ন। আমরা বলি, যাইব, যাব, যাইমু, যাইবাম, পুত্র, পুত, পোয়া, হোলা ইত্যাদি। আরবী ভাষার আঞ্চলিক রীতিসমূহও বিভিন্ন ছিল ও আছে। নিরক্ষর ও বুড়াদের সুবিধার জন্য হুযূরের যমানায় কোরআন পাঠে বিভিন্ন রীতির অনুমোদন করা হইয়াছিল। (বিস্তারিত বিবরণ পরে আসিতেছে।)
