মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)

৬- জানাযা-কাফন-দাফনের অধ্যায়

হাদীস নং: ১৬৭৫
৫. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - জানাযার সাথে চলা ও সালাতের বর্ণনা
১৬৭৫। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) যখন জানাযার নামায পড়িতেন, বলিতেন, “আল্লাহ্! ক্ষমা কর তুমি আমাদের জিন্দাদিগকে ও আমাদের মুর্দাদিগকে, আমাদের উপস্থিতদিগকে ও আমাদের অনুপস্থিতদিগকে, আমাদের ছোট দিগকে ও আমাদের বড়দিগকে, আমাদের পুরুষদিগকে ও আমাদের নারীদিগকে। আল্লাহ্! তুমি আমাদের মধ্যে যাহাকে জিন্দা রাখিবে, জিন্দা রাখ তাহাকে ইসলামের সাথে এবং আমাদের মধ্যে যাহাকে মৃত্যু দান করিবে, মৃত্যু দান কর তাহাকে ঈমানের সাথে। আল্লাহ্! বঞ্চিত করিও না আমাদিগকে তাহার (মৃত্যুতে যে আমাদের কষ্ট হইয়াছে উহার) সওয়াব হইতে এবং বিপদে ফেলিও না আমাদিগকে তাহার (মৃত্যুর) পরে। – আহমদ, আবু দাউদ, তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ্
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا صَلَّى عَلَى الْجَنَازَةِ قَالَ: «اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِحَيِّنَا وَمَيِّتِنَا وَشَاهِدِنَا وَغَائِبِنَا وَصَغِيرِنَا وَكَبِيرِنَا وَذَكَرِنَا وَأُنْثَانَا. اللَّهُمَّ مَنْ أَحْيَيْتَهُ مِنَّا فَأَحْيِهِ عَلَى الْإِسْلَامِ وَمَنْ تَوَفَّيْتَهُ مِنَّا فَتَوَفَّهُ عَلَى الْإِيمَانِ. اللَّهُمَّ لَا تَحْرِمْنَا أَجْرَهُ وَلَا تَفْتِنَّا بَعْدَهُ» . رَوَاهُ أَحْمَدُ وَأَبُو دَاوُدَ وَالتِّرْمِذِيُّ وَابْنُ مَاجَهْ

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছটি তিনজন সাহাবী থেকে বর্ণিত। হযরত আবু হুরায়রা রাযি., আবু কাতাদা রাযি. এবং অজ্ঞাতনামা জনৈক সাহাবী। অজ্ঞাতনামা সে সাহাবী থেকে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন তাঁর পুত্র আবু ইবরাহীম আল-আশহালী। আশহাল আনসারদের একটি শাখার এক পূর্বপুরুষের নাম। তার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে তার বংশধরদেরকে আশহালী বলা হয়ে থাকে। অজ্ঞাতনামা এই সাহাবী এ গোত্রেরই লোক ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানা যায় না।

এ হাদীছটিতে জানাযার নামাযের মশহুর একটি দু'আ বর্ণিত হয়েছে। এ দু'আটি অনেকেরই মুখস্থ আছে। এতে জীবিত, মৃত, ছোট, বড়, পুরুষ, নারী, উপস্থিত ও অনুপস্থিত সকলের জন্যই পাঁচটি বিষয় প্রার্থনা করা হয়েছে। তার মধ্যে সর্বপ্রথম হল পাপমার্জনা। বলা হয়েছে- ...اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِحَيِّنَا وَمَيِّتِنَا (আল্লাহ! আপনি ক্ষমা করুন আমাদের জীবিতকে, মৃতকে...)। অর্থাৎ সমস্ত মুমিন-মুসলিম নর-নারীর সগীরা-কবীরা সবরকম গুনাহ ক্ষমা করে দিন। যদিও মূল উদ্দেশ্য মায়্যিতের জন্য দু'আ করা, কিন্তু দু'আ যত ব্যাপক হয় ততোই তা কবুলের সম্ভাবনা বেশি। আল্লাহ তা'আলার ক্ষমাশীলতা সর্বব্যাপী। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّ رَبَّكَ وَاسِعُ الْمَغْفِرَةِ
'নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক প্রশস্ত ক্ষমাশীল’। (সূরা নাজম, আয়াত ৩২)

তাই ক্ষমাপ্রার্থনাসহ যে-কোনও কল্যাণের দু'আয় ব্যাপকভাবে সবাইকে শামিল করে নেওয়া চাই। বিশেষত অন্যের গুনাহের মাগফিরাত কামনাকালে নিজ গুনাহের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করা তো অধিকতর জরুরি। অন্যের গুনাহের জন্য ক্ষমা চাইব আর নিজ গুনাহের কথা ভুলে থাকব, এটা কী করে সম্ভব? এটা নিজ সম্পর্কে এক রকম সুধারণার মধ্যে পড়ে, যদিও তা মুখে না বলা হয়।

এ দু'আয় প্রথমে যে গুনাহের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করা হয়েছে, এটাও দু'আর এক নিয়ম। প্রথমে গুনাহের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করা বিনয় ও বন্দেগীর দাবি। একজন গুনাহগারের পক্ষে গুনাহের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনার পরেই অন্য কিছু কামনা করা সাজে। গুনাহের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা না করে অন্যকিছু কমনা করা এক রকম ধৃষ্টতা। বান্দার পক্ষে তা কিছুতেই শোভনীয় নয়।

লক্ষণীয়, মাগফিরাতের দু'আয় صغير (ছোট)-কেও শামিল রাখা হয়েছে। ছোট দ্বারা যদি তুলনামূলক ছোটকে বোঝানো হয়, অর্থাৎ এমন ছোট, যে বালেগ বটে কিন্তু অন্যান্য বয়স্কদের তুলনায় বয়সে ছোট, তবে কোনও প্রশ্ন থাকে না। কেননা এরূপ ছোট গুনাহগার হতে পারে। তাই তারও মাগফিরাত প্রয়োজন। পক্ষান্তরে ছোট যদি হয় নাবালেগ, তখন তার তো কোনও গুনাহ নেই। এ অবস্থায় তার জন্য মাগফিরাতের দু'আ করার কী অর্থ?

কেউ কেউ বলেছেন, এ ক্ষেত্রে মাগফিরাত দ্বারা মর্যাদা উঁচু করা বোঝানো উদ্দেশ্য। যেন বলা হচ্ছে, হে আল্লাহ! আপনি এ শিশুকে উচ্চমর্যাদা দান করুন। এমনও হতে পারে যে, এর দ্বারা উদ্দেশ্য শিশুর পরবর্তী জীবন। অর্থাৎ বড় হওয়ার পর তার দ্বারা যদি কোনও গুনাহ হয়ে যায়, তবে আপনি তার জন্য মাগফিরাত নসীব করুন। কারও কারও মতে এখানে ছোটর উল্লেখ কেবলই দু'আর ভেতর অধিকতর ব্যাপকতা আনয়নের জন্য, যেহেতু দু'আ যত বেশি ব্যাপক হয়, ততো বেশি কবুলের সম্ভাবনা থাকে।

দু'আটির দ্বিতীয় বিষয়বস্তু হল ইসলামের উপর অবিচল থাকার কামনা। বলা হয়েছে– اللهم مَنْ أَحْيَيْتَهُ مِنَّا فَأَحْيِهِ عَلَى الْإِسْلام (হে আল্লাহ! আপনি আমাদের মধ্যে যাকে জীবিত রাখেন, তাকে জীবিত রাখুন ইসলামের উপর)। অর্থাৎ আমরা যে ইসলামের উপর আছি, এটা আপনারই দান। হে আল্লাহ! মৃত্যু পর্যন্ত আমাদের উপর আপনার এ দান অব্যাহত রাখুন। আমরা যেন কোনও অবস্থায়ই ইসলাম থেকে সরে না যাই। যতদিন জীবিত থাকি, যেন মুসলিমরূপেই জীবিত থাকি। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যেন ইসলামের শিক্ষা মেনে চলি।

দু'আটির তৃতীয় বিষয় হল ঈমানের সঙ্গে মৃত্যু। বলা হয়েছে– وَمَنْ تَوَفَّيْتَهُ مِنَّا فَتَوَفَّهُ عَلَى الْإِيمَانِ (আর যাকে মৃত্যুদান করেন, তাকে মৃত্যুদান করুন ঈমানের উপর)। ঈমানের সঙ্গে মৃত্যু মানবজীবনের পরম কামনা। এটা মানুষের জন্য সর্বাপেক্ষা জরুরি বিষয়। কেউ যদি সারা জীবনও ইসলামের উপর জীবনযাপন করে, কিন্তু মৃত্যু ঈমানের সঙ্গে না হয়, তবে সে কিছুতেই নাজাত পাবে না। নাজাতের জন্য ঈমানের সঙ্গে মৃত্যু জরুরি। অনেক সময় মুমিন-মুসলিম ব্যক্তিও শয়তানের ধোঁকায় পড়ে ঈমানহারা হয়ে যায় এবং বেঈমান অবস্থায়ই তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে শয়তানও জোর তৎপরতা চালায়। এটা তার জন্য মানুষকে ঈমানহারা করার শেষ সুযোগ। মৃত্যুযন্ত্রণার ভেতর শয়তানের কুমন্ত্রণায় পড়ে অনেকে ঈমান হারিয়েও ফেলে। তাই ঈমানের সঙ্গে যাতে মৃত্যু হয়, প্রত্যেকেরই সেই আশা ও চেষ্টা থাকা উচিত। সে চেষ্টা হচ্ছে সর্বদা ঈমান সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং ঈমানের সঙ্গে মৃত্যু নসীব হওয়ার জন্য আল্লাহ তা'আলার কাছে দু'আ করতে থাকা। এ দু'আ অতীব জরুরি হওয়ায় জানাযার নামাযের মধ্যেও একে দাখিল করে দেওয়া হয়েছে।

দু'আটির চতুর্থ বিষয় হল মৃতব্যক্তির বিয়োগবেদনায় সবর করা ও আল্লাহ তা'আলার কাছে সে সবরের জন্য প্রতিদান পাওয়া। তাই বলা হয়েছে- اللَّهُمَّ لَا تَحْرِمْنَا أَجْرَهُ (হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে তার প্রতিদান থেকে বঞ্চিত করবেন না)। অর্থাৎ হে আল্লাহ! এই যে প্রিয়জনের মৃত্যুতে আমরা শোকার্ত হয়ে পড়েছি এবং আমরা তাকে হারানোর ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি, এতে আমাদেরকে ধৈর্যধারণের তাওফীক দিন। আর সে ধৈর্যের বিনিময়ে আমাদেরকে দোজাহানের প্রতিদান ও পুরস্কার দান করুন।

দু'আটির সর্বশেষ বিষয় হল- وَلَا تَفْتِنّا بَعْدَهُ (এবং তার পর আমাদেরকে ফিতনার সম্মুখীন করবেন না)। অর্থাৎ আমরা যেন তার মৃত্যু দ্বারা শিক্ষাগ্রহণ করি। আমরা যেন দুনিয়ার মায়ায় পড়ে আখিরাত ভুলে না যাই। শয়তানের প্রতারণার শিকার হয়ে যেন বিপথগামী না হই। বরং সর্বদা সরল-সঠিক পথে থাকি এবং মৃত্যুর পর আপনার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করি। কাজেই আপনি আমাদেরকে এমন কোনও ফিতনা ও পরীক্ষার সম্মুখীন করবেন না, যা আমাদের ঈমানকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. প্রত্যেক মুসলিমের উচিত মায়্যিতসহ জীবিত ও মৃত সকল মুমিন নর-নারীর জন্য কল্যাণকামী থাকা।

খ. গুনাহ থেকে মাগফিরাতলাভ সর্বাপেক্ষা জরুরি বিষয়। তাই যে-কোনও অবকাশে নিজের ও অন্যদের মাগফিরাতের জন্য আল্লাহ তা'আলার কাছে দু'আ করতে হবে।

গ. দু'আ যত ব্যাপক হয়, ততো বেশি কবুলের আশা থাকে। তাই যে-কোনও কল্যাণের দু'আয় নিজের সঙ্গে অন্যদেরও শামিল রাখা চাই।

ঘ. আখিরাতের নাজাতের জন্য ঈমানের সঙ্গে মৃত্যুবরণ জরুরি। তাই সদাসর্বদা নিজ ঈমান সম্পর্কে সচেতন থাকার পাশাপাশি আল্লাহ তা'আলার কাছে দু'আও করা উচিত যাতে তিনি ঈমানের সঙ্গে মৃত্যুদান করেন।

ঙ. প্রিয়ব্যক্তির বিয়োগবেদনায় সবর করলে আল্লাহ তা'আলার কাছে ছাওয়াব ও প্রতিদান পাওয়া যায়।

চ. যে-কারও মৃত্যু দ্বারা শিক্ষাগ্রহণ করা উচিত যে, একদিন আমারও এরকম সময় আসবে। অতঃপর সে শিক্ষা অনুযায়ী দুনিয়ার মোহ উপেক্ষা করে আখিরাতের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা কর্তব্য।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান