আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৪৬- জিহাদের বিধানাবলী অধ্যায়

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৩১৪৫
১৯৫৯. নবী (ﷺ) ইসলামের প্রতি যাদের মন আকৃষ্ট করার প্রয়োজন তাদেরকে ও অন্যদেরকে খুমুস ইত্যাদি থেকে দান করতেন।
২৯২৪। মুসা ইবনে ইসমাঈল (রাহঃ) .... আমর ইবনে তাগলিব (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এক দলকে দিলেন আর এক দলকে দিলেন না। তারা যেন এতে মনক্ষুণ্ণ হলেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, আমি এমন লোকদের দেই, যাদের সম্পর্ক বিগড়ে যাওয়া কিংবা ধৈর্যহারা হওয়ার আশঙ্কা করি। আর অন্যদল যাদের অন্তরে আল্লাহ তাআলা যে কল্যাণ ও অমুখাপেক্ষিতা দান করেছেন, তার উপর ছেড়ে দেই। আর আমর ইবনে তাগলিব (রাযিঃ) তাদের অন্তর্ভুক্ত।
আমর ইবনে তাগলিব (রাযিঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমার সম্পর্কে যা বলেছেন, তার পরিবর্তে যদি আমাকে লাল বর্ণের উট দেওয়া হতো তাতে আমি এতখানি খুশী হতাম না। আর আবু আসিম (রাহঃ) জারীর (রাহঃ) থেকে হাদীসটি এতটুকু অতিরিক্তসহ বর্ণনা করেছেন যে, হাসান (রাহঃ) বলেন, আমাকে আমর ইবনে তাগলিব (রাযিঃ) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- এর নিকট কিছু মাল অথবা বন্দী আনীত হয়, তখন তিনি তা বণ্টন করেন।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

সামগ্রিকভাবে সাহাবায়ে কেরাম নিতান্তই গরীব ছিলেন। তাদের অধিকাংশেরই অর্থকষ্ট নিবারণের জন্য সাহায্যের প্রয়োজন থাকতই। তা সত্ত্বেও তারা কারও কাছে কিছু চাইতেন না। তবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে যখন গনীমত বা সদাকা-যাকাতের মাল আসত, তখন স্বাভাবিকভাবেই তা থেকে তাদের কিছু পাওয়ার আশা থাকত। এ হাদীছে একবারের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে কিছু মালামাল বা যুদ্ধবন্দীরূপে দাস-দাসী নিয়ে আসা হলে তিনি সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে তা বণ্টন করতে থাকেন। কিন্তু তিনি সকলকেই দিলেন না। কাউকে দিলেন এবং কাউকে বাদ রাখলেন। যারা বাদ পড়েছিলেন, তাদের মনে উদ্বেগ দেখা দিল। কী কারণে তাদের দেওয়া হল না? তবে কি তাদের মধ্যে কোনও কমতি আছে? এরূপ নানা ভাবনায় তারা কিছুটা মনঃক্ষুণ্ণও হলেন। বিষয়টা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কানে পৌঁছে গেল। তিনি তাদের ডাকলেন এবং তাদের সামনে পরিষ্কার করে দিলেন যে, যাদেরকে দিলেন কী কারণে দিলেন এবং যাদেরকে দিলেন না কী কারণে দিলেন না। তিনি এ কথাও বললেন যে, আমি যাকে দিই তার তুলনায় যাকে দিই না সে আমার কাছে বেশি প্রিয় হয়ে থাকে। তিনি বললেন-
وَلَكِنِّي إِنَّمَا أعْطِي أَقْوَامًا لِمَا أَرَى فِي قُلُوْبِهِمْ مِنَ الْجَزَعِ وَالْهَلَعِ (বস্তুত আমি তো এমনসব লোককেই দিই, যাদের অন্তরে অস্থিরতা ও দ্বিধাগ্রস্ততা আছে বলে লক্ষ করি)। অর্থাৎ যাদের ব্যাপারে আশঙ্কা হয় যে, না দিলে তারা অস্থির হয়ে পড়বে, অভাব- অনটনে ধৈর্য রক্ষা করতে পারবে না কিংবা বঞ্চিত হওয়ার কারণে অশান্ত হয়ে পড়বে, তাদেরকে দিয়ে থাকি, যাতে তারা অধৈর্য ও অশান্ত না হয়। এমনিভাবে ঈমানের উপর যাদের দৃঢ়তা আসেনি, এখনও পর্যন্ত কিছুটা অপূর্ণতা আছে, তাদেরকেও দিই, যাতে পুরোপুরিভাবে তারা দীনের উপর মজবুত হয়ে যায়।

وَأَكِلُ أَقْوَامًا إِلَى مَا جَعَلَ اللهُ فِي قُلُوبِهِمْ مِنَ الْغِنَى وَالْخَيْرِ (আর যাদের অন্তরে আল্লাহ তা'আলা ঐশ্বর্য ও কল্যাণ দিয়েছেন, সেরকম লোকদেরকে আমি সে অবস্থার উপর ন্যস্ত করি)। অর্থাৎ অন্তরে ঐশ্বর্য থাকার কারণে অর্থ-সম্পদের অভাবকে যারা বিশেষ গুরুত্ব দেয় না, যাদের অন্তরে আল্লাহ তা'আলার উপর পরিপূর্ণ ভরসা আছে এবং যারা পূর্ণ ঈমানদারও বটে, ঈমানের উপর মজবুতির কারণে দুনিয়ার উপর আখিরাতকেই অগ্রাধিকার দেয়, আমি তাদেরকে দেওয়ার বিশেষ প্রয়োজন মনে করি না। আমি তাদেরকে তাদের তাওয়াক্কুল ও ঈমানের পরিপক্কতার উপর ছেড়ে দিই।

এই বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাদেরকে দেননি, তাদের ঈমান ও তাওয়াক্কুলের উপর নিজ আস্থা ব্যক্ত করেন এবং তাদেরকে আখিরাতের প্রতি আরও বেশি মনোযোগী হতে অনুপ্রাণিত করেন।

যাদের প্রতি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর গভীর আস্থা থাকার কথা ব্যক্ত করেন, হযরত আমর ইবন তাগলিব রাযি.-ও তাদের একজন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ প্রশংসায় তিনি যারপরনাই খুশি হন। সুতরাং তিনি এই বলে নিজ অনুভূতি প্রকাশ করেন যে-
فَوَاللهِ مَا أُحِبُّ أَنَّ لِي بِكَلِمَةِ رَسُوْلِ اللَّهِ ﷺ حُمْرَ النَّعَمِ (আল্লাহর কসম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ কথার বিনিময়ে আমি একপাল লাল উটও গ্রহণ করতে পসন্দ করব না)। অর্থাৎ আমাকে এ কথা বলার পরিবর্তে যদি আমাকে একপাল লাল উটও দেওয়া হতো, তবে তাও আমার পসন্দ হতো না। কেননা একপাল লাল উট যত দামিই হোক না কেন, তা সীমিত ও ক্ষণস্থায়ীই বটে। পক্ষান্তরে আমার সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলেছেন তা আমার ঈমানের পক্ষে সাক্ষ্য। ঈমানের বিনিময়ে আখিরাতে যে পুরস্কার পাওয়া যাবে, তা অসীম ও অফুরন্ত। তার সঙ্গে একপাল লাল উটের কোনও তুলনাই চলে না।

এর দ্বারা ধারণা পাওয়া যায় যে, সাহাবায়ে কেরাম দুনিয়ার বিপরীতে আখিরাতকে কতটা প্রাধান্য দিতেন এবং তারা দুনিয়ার সামান্য অর্থের উপর কতটা সন্তুষ্ট ছিলেন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. যাকে অর্থসাহায্য না করলে অধৈর্য হয়ে পড়ার ভয় থাকে, তাকে সাহায্য করা চাই।

খ. অর্থসাহায্য করলে দীনের প্রতি অধিকতর আনুগত্য প্রকাশ করবে বলে যার ব্যাপারে আশা থাকে, তাকে অর্থসাহায্য করা কাম্য।

গ. আখিরাতের উচ্চমর্যাদা অনুসারে যে দুনিয়ায় সচ্ছলতা লাভ হবে-এমন কোনও কথা নেই।

ঘ. অর্থ-সম্পদের প্রতি স্বভাবগতভাবেই মানুষের আগ্রহ থাকে। কাজেই সে আগ্রহে কোনও দোষ নেই, যদি না তাতে সীমালঙ্ঘন করা হয়।

ঙ. অর্থ-সম্পদের কমতি থাকা বা কাঙ্ক্ষিত সম্পদ লাভে বঞ্চিত থাকা দুর্ভাগ্য নয়; বরং অনেক সময় তা ব্যক্তির পক্ষে কল্যাণকরই হয়ে থাকে।

চ. কারও কোনও কাজে যদি অন্যের মনে মন্দ ধারণা জন্মায়, তবে তা নিরসন করে দেওয়া উচিত।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন