কিতাবুস সুনান (আলমুজতাবা) - ইমাম নাসায়ী রহঃ
৪৭. ঈমান এবং ঈমানের শাখা প্রশাখার বিবরণ
৪৯৯৫. আমর ইবনে আলী (রাহঃ) ......... আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছিঃ মুসলিম ঐ ব্যক্তি, যার হাত ও জবান হতে অন্য মুসলিম নিরাপদ থাকে, আর মুহাজির ঐ ব্যক্তি, যে আল্লাহর নিষিদ্ধ বস্তু থেকে দূরে থাকে।
হাদীসের ব্যাখ্যাঃ
এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলিম ব্যক্তির পরিচয় দিতে গিয়ে তার অন্যতম প্রধান একটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন, আর তা হচ্ছে নিজের জিহ্বা ও হাত দ্বারা অন্য কোনও মুসলিমকে কষ্ট না দেওয়া। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় কেবল এই একটি গুণ যার মধ্যে আছে সেই মুসলিম। এর অর্থ দাঁড়ায় যার মধ্যে এ গুণটি নেই সে মুসলিম নয়। প্রকৃতপক্ষে হাদীছটি দ্বারা সে কথা বোঝানো উদ্দেশ্য নয়। কেননা এক তো কোনও ব্যক্তিই কেবল এই একটি গুণ দ্বারাই মুসলিম হয়ে যায় না, আবার কোনও মুসলিম ব্যক্তির মধ্যে এ গুণটি না থাকলে সে ইসলাম থেকে খারিজও হয়ে যায় না। প্রকৃতপক্ষে এটি পরিপূর্ণ ও উৎকৃষ্ট মুসলিমের গুণ। যার মধ্যে এটি না থাকে কিন্তু ইসলামের অন্যান্য জরুরি বিষয়সমূহ থাকে, সে অবশ্যই মুসলিম থাকবে কিন্তু পরিপূর্ণ ও উৎকৃষ্ট মুসলিম বলে গণ্য হবে না। সুতরাং 'মুসলিম ওই ব্যক্তি'-এর অর্থ পরিপূর্ণ মুসলিম ওই ব্যক্তি। যেমন বলা হয়, পুরুষ তো যায়দ। তার মানে সে একজন উৎকৃষ্ট পুরুষ। অপর একটি হাদীছের দিকে লক্ষ করলে এটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে। عن أبي موسى قال سئل رسول الله ﷺ أي المسلمين أفضل؟ قال: من سلم المسلمون من لسانه ويده হযরত আবূ মূসা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হল, কোন্ মুসলিম শ্রেষ্ঠ? তিনি বললেন, যার জিহ্বা ও হাত থেকে মুসলিমগণ নিরাপদ থাকে। (জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৫০৪; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৬৭৯২; সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ১১; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৬৬) এ হাদীছে জিহ্বা ও হাত দ্বারা কাউকে কষ্ট না দেওয়াকে শ্রেষ্ঠ মুসলিমের গুণ বলা হয়েছে। বোঝা গেল এ গুণ কোনও মুসলিমের মধ্যে না থাকলে সে মুসলিম থাকবে বটে, কিন্তু শ্রেষ্ঠ মুসলিম বলে গণ্য হবে না। জিহ্বা দ্বারা কাউকে কষ্ট না দেওয়ার ব্যাখ্যা যার জিহ্বা থেকে মুসলিমগণ নিরাপদ থাকে অর্থাৎ সে তার জিহ্বা দ্বারা তাদেরকে কোনওরকম কষ্ট দেয় না, সে তাদেরকে গালি দেয় না, অভিশাপ দেয় না, গীবত করে না, চুগলখোরী করে না, ঝগড়া-ফাসাদে উস্কানি দেয় না এবং এমনিভাবে মুখের এমন কোনও ব্যবহার করে না, যা দ্বারা কেউ কষ্ট পেতে পারে বা কারও কোনও ক্ষতি হতে পারে। এস্থলে 'কথা দ্বারা কষ্ট দেয় না' –না বলে জিহ্বা দ্বারা কষ্ট না দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কেননা জিহ্বা দ্বারা যেমন কথা বলা হয়, তেমনি জিহ্বার এমন ব্যবহারও সম্ভব, যা দ্বারা অন্যে কষ্ট পেতে পারে, যেমন জিহ্বা বের করে ভেংচি কাটা। বোঝা গেল প্রকৃত মুসলিম কথা দ্বারাও কাউকে কষ্ট দেয় না এবং ব্যঙ্গ করে বা ভেংচি কেটেও কাউকে কষ্ট দেয় না। উল্লেখ্য, যখন থেকে লেখা ও কলমের ব্যবহার শুরু হয়েছে, তখন থেকে এ মাধ্যমটিও জিহ্বার বিকল্প গণ্য হয়ে আসছে। বলা হয়ে থাকে- القلم أحد اللسانين (কলম মানুষের দ্বিতীয় জিহ্বা)। সুতরাং লেখা বা কলমের ব্যবহার দ্বারা কাউকে কষ্ট দেওয়া হলে তাও এ হাদীছের অন্তর্ভুক্ত হবে। অর্থাৎ প্রকৃত মুসলিম তার লেখনী শক্তি দ্বারাও কষ্ট দেবে না। চাইলে এটাকে হাতেরও অন্তর্ভুক্ত করা যায়, যেহেতু লিখতে বা কলম ব্যবহার করতে হাতের প্রয়োজন হয়। সুতরাং কেউ লেখা দ্বারা অন্যের নিন্দা করলে বা কলম দ্বারা অন্যের ওপর অন্যায় আক্রমণ চালালে কিংবা একজনের লেখা দ্বারা অন্যের যে কোনওরকম ক্ষতি হয়ে গেলে সে পরিপূর্ণ মুসলিমরূপে গণ্য হবে না। হাত দ্বারা কষ্ট না দেওয়ার ব্যাখ্যা তারপর বলা হয়েছে, তার হাত থেকেও অন্য মুসলিম নিরাপদ থাকে। অর্থাৎ হাত দ্বারাও সে কাউকে কষ্ট দেয় না, কাউকে অন্যায়ভাবে মারধর করে না, যাতায়াত পথে কষ্টদায়ক জিনিস ফেলে না, কারও মাল কেড়ে নেয় না ইত্যাদি। 'হাত' দ্বারা অনেক সময় ক্ষমতা ও প্রভাবও বোঝানো হয়ে থাকে, যেমন বলা হয় এ বিষয়ে আমার কোনও হাত নেই মানে আমার ক্ষমতা নেই বা তার ওপর আমার কোনও হাত নেই অর্থাৎ তার ওপর আমার কোনও প্রভাব নেই। সুতরাং কেউ যদি ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটিয়ে অন্যের ক্ষতি করে, তাও হাত দ্বারা কষ্ট দেওয়ার অন্তর্ভুক্ত হবে। তাই প্রকৃত মুসলিম তার ক্ষমতা ও প্রভাবের অপব্যবহার করে না এবং এর দ্বারা অন্যের ক্ষতিসাধন হতে বিরত থাকে। কেবল জিহ্বা ও হাতের উল্লেখ করার কারণ অন্যের ক্ষতি করা বা অন্যকে কষ্ট দেওয়ার কাজ কেবল হাত ও মুখ দিয়েই হয় না, অন্যান্য অঙ্গ দ্বারাও হয়। তা সত্ত্বেও হাদীছে কেবল এ দু'টি অঙ্গের কথা বলা হয়েছে এ কারণে যে, বেশিরভাগ কষ্ট দেওয়ার কাজ এ দু'টি অঙ্গ দ্বারাই হয়ে থাকে। সুতরাং এ কথা বোঝা ঠিক হবে না যে, অন্যান্য অঙ্গ দ্বারা কাউকে কষ্ট দিলে তাতে দোষের কিছু নেই। অবশ্যই তা দোষের। প্রধান দুই অঙ্গের উল্লেখ দ্বারা বাকি অঙ্গসমূহকেও এর অন্তর্ভুক্ত করে ফেলা হয়েছে। প্রধান অঙ্গের উল্লেখ দ্বারা সকল অঙ্গকে বোঝানোর প্রচলন সব ভাষাতেই আছে। কাজেই হাদীছের অর্থ বুঝতে হবে এরকম যে, প্রকৃত মুসলিম সেই ব্যক্তি, যে তার জিহ্বা, হাত এবং অন্য যে-কোনও অঙ্গ দ্বারা মানুষকে কষ্ট দেওয়া হতে বিরত থাকে। হাত ও জিহ্বার মধ্যেও আবার জিহ্বার কথা আগে বলা হয়েছে। এর কারণ কষ্টদানের ব্যাপারটা হাতেরচে'ও জিহ্বার দ্বারা বেশি হয়ে থাকে। জিহ্বার আওতা অতি বিস্তৃত। হাত দ্বারা কেবল হাতের গণ্ডির মধ্যে থাকা লোককে কষ্ট দেওয়া যায়। কিন্তু জিহ্বা দ্বারা কষ্ট দেওয়া হয়ে থাকে দূর-দুরান্তের লোককেও। গীবত, পরনিন্দা ও অপবাদ দেওয়ার কাজ তো আড়ালেই করা হয়। এমনিভাবে হাত দিয়ে কষ্ট দেওয়া যায় কেবল উপস্থিত লোককে, আর জিহ্বা দিয়ে কষ্ট দেওয়া যায় কেবল উপস্থিত ও বর্তমানকালের লোককেই নয়; বরং অতীতকালের লোকদেরকেও। এমনকি চাইলে ভবিষ্যৎকালের লোকদেরকেও এর আওতায় ফেলা যায়। এ হাদীছে কেবল মুসলিমদের কষ্টদান থেকে বিরত থাকার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য হাদীছ দ্বারা জানা যায়, অন্যায়ভাবে কষ্ট দেওয়া কাউকেই জায়েয নয়, তা মুসলিম হোক বা অমুসলিম। এমনকি শুধু শুধু কোনও পশু-পাখি ও পোকা-মাকড়কেও কষ্ট দেওয়া জায়েয নয়। এক হাদীছে জানানো হয়েছে, এক মহিলা একটি বিড়ালকে না খাইয়ে মারার কারণে জাহান্নামী হয়েছে। একবার পিঁপড়ার বাসা আগুনে পুড়ে দেওয়ার কারণে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- إنه لا ينبغي أن يعذب بالنار إلا رب النار আগুনের সৃষ্টিকর্তা ছাড়া অন্য কারও আগুন দিয়ে শাস্তি দেওয়া উচিত নয়। (মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৪০১৮; মুসান্নাফ আব্দুর রাযযাক, হাদীছ নং ৯৪১৪; আত- তাবারানী, আল-মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ১০৩৭৪) নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো পশু যবাইয়ের ক্ষেত্রেও ছুরি ভালোভাবে ধার দিয়ে নেওয়ার হুকুম করেছেন, যাতে পশুর কষ্ট কিছুটা হলেও কম হয়। পশু পালনের ক্ষেত্রেও তাঁর স্পষ্ট নির্দেশ আছে যেন ঠিকভাবে তাদের দানাপানি দেওয়া হয় এবং তাদেরকে অহেতুক কষ্ট না দেওয়া হয়। যেখানে পশুপাখি ও কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রেও তিনি দয়ার আচরণ করতে বলেছেন, সেখানে মানুষের প্রতি কিভাবে জুলুম করার সুযোগ থাকতে পারে, তা হোক না সে অমুসলিম? সুতরাং আলোচ্য হাদীছেরই কোনও কোনও বর্ণনায় আছেঃ- المؤمن من أمنه الناس على دمائهم وأموالهم মুমিন ওই ব্যক্তি, যাকে মানুষ তাদের জান-মালের ব্যাপারে নিরাপদ মনে করে। (জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৬২৭: মুসনাদুল বাযযার, হাদীছ নং ৮৯৪১; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৪৯৯৫; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ১৮০: মুস্তাদরাক হাকিম, হাদীছ নং ২২) এ হাদীছে সাধারণভাবে সমস্ত মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা দানকে মু'মিনের বৈশিষ্ট্য সাব্যস্ত করা হয়েছে। হাদীছের প্রথম অংশে যে বিশেষভাবে মুসলিম ব্যক্তির নিরাপত্তা দানের কথা বলা হয়েছে তা এ কারণে যে, মুসলিমগণ পরস্পর ভাই-ভাই। আর ভাই-ভাই হওয়ার সুবাদে সাধারণ মানুষ অপেক্ষা মুসলিম ব্যক্তিকে কষ্টদান করা থেকে বিরত থাকার গুরুত্ব অনেক বেশি। তাছাড়া অমুসলিম রাষ্ট্রের সাথে জিহাদের অবকাশ আসলে তখন যুদ্ধরত অমুসলিমদের জান-মালের নিরাপত্তা বাকি থাকে না। সেদিক থেকে তাদের তুলনায় মুসলিম নর-নারীর জানমালের নিরাপত্তায় ব্যাপকতা রয়েছে। প্রকাশ থাকে যে, মুসলিম ও অমুসলিম যে-কোনও ব্যক্তিকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকার যে শিক্ষা ইসলামে দেওয়া হয়েছে তা থেকে ওইসকল ক্ষেত্র ব্যতিক্রম গণ্য হবে, যেসকল ক্ষেত্রে কষ্ট দেওয়াটা শরী'আতেরই হুকুম, যেমন মদপান করলে শাস্তি দেওয়া, চুরি করলে হাত কাটা এবং এভাবে অন্যান্য হুদূদের বিধান কার্যকর করা। প্রকৃত মুহাজির ও হিজরতের প্রকারভেদ মুহাজির শব্দটি 'হিজরত' থেকে উৎপন্ন। হিজরত অর্থ ত্যাগ করা। এ অর্থ হিসেবে হিজরত দুই প্রকার। ক. জাহেরী বা প্রকাশ্য হিজরত এবং খ. বাতেনী বা গুপ্ত হিজরত। জাহেরী হিজরত হচ্ছে নিজের দীন ও ঈমান হেফাজত করার উদ্দেশ্যে নিজ দেশ পরিত্যাগ করে অন্যত্র গমন করা, যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কিরাম মক্কা মুকারামা ত্যাগ করে মদীনা মুনাউওয়ারায় গমন করেছিলেন। বাতেনী হিজরত বলা হয় 'নফসে আম্মারা' (অসৎকাজের নির্দেশদাতা মন) যেসকল মন্দ কাজের প্রতি উৎসাহ দেয় তা পরিত্যাগ করা। এ হাদীছে সেদিকে ইশারা করে বলা হয়েছেঃ- والمهاجر من هجر ما نهى الله عنه ‘আর মুহাজির ওই ব্যক্তি, যে পরিত্যাগ করে ওইসকল বিষয়, যা আল্লাহ তাআলা নিষেধ করেছেন।' অপর এক বর্ণনায় আছে, নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, কোন্ হিজরত শ্রেষ্ঠ? তিনি উত্তরে বলেনঃ- من هجر ما حرم الله যে ব্যক্তি আল্লাহর হারাম করা বিষয়সমূহ পরিত্যাগ করে (তাঁর এই পরিত্যাগই হচ্ছে শ্রেষ্ঠতম হিজরত)। (সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ১৪৪৯; মুসনাদুল বাযযার, হাদীছ নং ২৪৩৫; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ২৫২৬; আত-তাবারানী,মুসনাদুশ শামিয়্যীন, হাদীছ নং ২৬১৬; ইবন মানদা, কিতাবুল ঈমান, হাদীছ নং ৩১২) কেননা প্রকাশ্য হিজরতে কাফেরদের শত্রুতা হতে নিজেকে রক্ষা করা হয় আর এ তপ্ত হিজরতে নিজেকে রক্ষা করা হয় নফসের শত্রুতা থেকে। প্রকৃতপক্ষে কাফেরের শত্রুতা অপেক্ষা নফসের শত্রুতা বেশি কঠিন ও বেশি ক্ষতিকর। কারণ নফস সর্বদা ব্যক্তির সঙ্গে থাকে এবং তার সত্তার সাথে অবিচ্ছেদ্য হয়ে থাকে। তাই তার পক্ষে সবসময়ই মানুষের ক্ষতি করা সম্ভব, যা কাফের শত্রু দ্বারা সম্ভব হয় না। সে সর্বদাই চায় ব্যক্তিকে সর্বপ্রকার কল্যাণ থেকে বঞ্চিত রাখতে। একদিকে সে মানুষকে নেককাজে নিরুৎসাহিত করে, অন্যদিকে মন্দকাজের প্রলোভন দেয়। কাজেই যে ব্যক্তি এহেন নফসকে দমন করে হারাম কাজ থেকে নিজেকে রক্ষা করে এবং নিজেকে নেককাজে নিয়োজিত রাখে, সে তো শ্রেষ্ঠতম মুহাজির হবেই। অপরদিকে কোনও দেশত্যাগকারী দেশ ত্যাগ করা সত্ত্বেও যদি হারাম ও নিষিদ্ধ কাজ ত্যাগ না করে, তবে তো তার দেশত্যাগের কোনও সার্থকতা থাকে না। এরকম মুহাজির অপেক্ষা গুপ্ত মুহাজির, যে কিনা দেশে অবস্থান করা সত্ত্বেও হারাম কাজ পরিত্যাগ করে চলে, সে কতই না শ্রেয়। তবে হাঁ, যে মুহাজির দেশত্যাগের পাশাপাশি নিষিদ্ধ কাজও ত্যাগ করে চলে, তার সঙ্গে কাউকে তুলনা করা চলে না। কেননা তার মধ্যে উভয়প্রকার হিজরতেরই সমন্বয় ঘটেছে। মদীনার মুহাজিরগণ তো সেরকমেরই ছিলেন। কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াতে তাদের প্রভূত ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছেঃ- الَّذِينَ آمَنُوا وَهَاجَرُوا وَجَاهَدُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ أَعْظَمُ دَرَجَةً عِنْدَ اللَّهِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْفَائِزُونَ يُبَشِّرُهُمْ رَبُّهُمْ بِرَحْمَةٍ مِنْهُ وَرِضْوَانٍ وَجَنَّاتٍ لَهُمْ فِيهَا نَعِيمٌ مُقِيمٌ যারা ঈমান এনেছে, আল্লাহর পথে হিজরত করেছে এবং নিজেদের জান-মাল দ্বারা আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে, তারা আল্লাহর কাছে মর্যাদায় অনেক শ্রেষ্ঠ এবং তারাই সফলকাম। তাদের প্রতিপালক তাদেরকে নিজের পক্ষ থেকে রহমত, সন্তুষ্টি ও এমন উদ্যানসমূহের সুসংবাদ দিচ্ছেন, যার ভেতর তাদের জন্য রয়েছে স্থায়ী নিআমত। (সূরা তাওবা (৯), আয়াত ২০-২১) যেসকল সাহাবী মক্কা মুকাররামা থেকে হিজরত করে মদীনা মুনাউওয়ারায় এসেছিলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে লক্ষ্য করে যে আল্লাহর নিষিদ্ধ করা বিষয় পরিহারকে প্রকৃত মুহাজিররূপে উল্লেখ করলেন তার কারণ সম্ভবত এই যে, তারা দীন ও ঈমান হেফাজত করার লক্ষ্যে দেশত্যাগের মত যে বিশাল ত্যাগ স্বীকার করেছেন এবং এ কারণে আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে তাদের প্রভূত প্রশংসাও করা হয়েছে, তার ওপর নির্ভর করে যাতে অন্যান্য আমলের প্রতি তাদের শিথিলতা দেখা না দেয়। তিনি মূলত তাদেরকে সর্বতোভাবে গড়ে তুলতে যত্নবান ছিলেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল পরবর্তীকালের লোকদের জন্য তাদেরকে আদর্শরূপে পেশ করা। সেজন্যই শরীআতের যাবতীয় আদেশ-নিষেধ পালনের প্রতি তাদেরকে উদ্দীপিত করে রাখতেন। এ হাদীছটিও সে উদ্দীপনা প্রদানেরই অংশবিশেষ। এমনও হতে পারে যে, মক্কা বিজয়ের পর যখন মক্কা মুকাররামা থেকে মদীনায় হিজরতের সুযোগ শেষ হয়ে গেল, তখন যাদের মনে এ মহান কাজের সুযোগ লাভ থেকে বঞ্চিত হওয়ার আক্ষেপ ছিল, এ হাদীছ দ্বারা তাদের মনোরঞ্জন করা হয়েছে। যেন বলা হচ্ছে, তোমরা আক্ষেপ করছ কেন, এক হিজরত থেকে বঞ্চিত হয়েছ তাতে কী, অন্য হিজরতের তো সুযোগ বাকি আছে? আর তা হচ্ছে সর্বপ্রকার নিষিদ্ধ কাজ পরিত্যাগ করা। প্রকাশ্য হিজরতেরও তো উদ্দেশ্য সেটাই। শিরক ও কুফরসহ সর্বপ্রকার বেঈমানী থেকে নিজেকে রক্ষা করাই হয়ে থাকে দেশত্যাগের উদ্দেশ্য। তোমরাও যদি সর্বপ্রকার বেঈমানী ও পাপাচার পরিহার করে চল, তবে দেশত্যাগ না করেও তোমরা হিজরতকারী গণ্য হবে এবং হিজরতের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অর্জিত হয়ে যাবে। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে এই প্রকৃত হিজরতের জন্য কবূল করুন। হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ ক. আমাদেরকে হাতের ব্যবহারে সাবধান হতে হবে, যাতে কোনও মুসলিম নর-নারী এর দ্বারা কষ্ট না পায়। খ. প্রকৃত মুসলিম হতে চাইলে যবানের ব্যবহার করতে হবে সচেতনভাবে, যাতে এর দ্বারা কোনও মুসলিমকে কষ্ট দিয়ে না ফেলি। গ. পরিপূর্ণ মুসলিম হতে চাইলে ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি দ্বারাও কাউকে কষ্ট দেওয়া যাবে না। ঘ. কলমও একরকম যবান। কাজেই এর ক্ষতিকর ব্যবহার থেকেও বিরত থাকতে হবে। ঙ. প্রকৃত মুসলিম হওয়ার জন্য এটাও জরুরি যে, নিজের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সচেতনভাবে ব্যবহার করা হবে, যাতে কোনও অঙ্গ দ্বারাই কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হয় বা কষ্ট না পায়। চ কেবল মুসলিম নর-নারী নয়; আমার দ্বারা যাতে অমুসলিম নর-নারীরও জান, মাল ও ইজ্জতের কোনও ক্ষতি না হয়ে যায় সে ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে। ছ. সর্বপ্রকার নিষিদ্ধ ও নাজায়েয কাজ পরিহার করে চলতে হবে। সেরকম চলতে পারলে আমরাও হিজরতের মহিমা অর্জন করতে পারব।

তাহকীক:
তাহকীক নিষ্প্রয়োজন