কিতাবুস সুনান (আলমুজতাবা) - ইমাম নাসায়ী রহঃ

৪৭. ঈমান এবং ঈমানের শাখা প্রশাখার বিবরণ

হাদীস নং: ৪৯৯৫
আন্তর্জতিক নং: ৪৯৯৫

পরিচ্ছেদঃ মুমিনের পরিচয়

৪৯৯৪. কুতায়বা (রাহঃ) ......... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেনঃ মুসলিম ঐ ব্যক্তি যার হাত ও রসনা হতে অন্য মানুষ নিরাপদ থাকে। আর মু’মিন ঐ ব্যক্তি যার থেকে অন্য লোক নিজের জান ও মালকে নিরাপদ মনে করে।

হাদীসের ব্যাখ্যাঃ

এটি একটি বিখ্যাত হাদীস। ইমাম বুখারী রাহ. সহীহ বুখারীর ঈমান-অধ্যায়েও তা এনেছেন, রিকাক অধ্যায়েও এনেছেন। এই হাদীস শরীফে আমাদের জীবন যাপনের এক গুরুত্বপূর্ণ নীতি উল্লেখিত হয়েছে। যে নীতি অবলম্বন করা হলে পার্থিব জীবনও শান্তিময় হবে, পরকালীন জীবনও শান্তিময় হবে। আমরা যদি কুরআন-সুন্নাহর নসসমূহ পাঠ করি তাহলে দুধরনের নস দেখতে পাই : এক. যেসব আয়াত-হাদীসে নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের নির্দিষ্ট শিক্ষা পাই। যেমন কারো সাথে সাক্ষাতের সময় সালাম করা, সালামের জবাব দেওয়া, হাঁচি দিলে আলহামদু লিল্লাহ বলা ইত্যাদি। দুই. যে সব আয়াত-হাদীসে কর্ম ও আচরণের মূলনীতি পাই। যে মূলনীতি সামনে রেখে জীবনের অসংখ্য ক্ষেত্রে সঠিক করণীয় নির্ধারণ করা যায়। আমাদের আজকের উপস্থাপিত মোবারক হাদীসটি এই শ্রেণির একটি হাদীস, যা মুসলমানদের দ্বীনদারী ও সামষ্টিক জীবনের মূলনীতি। হাদীস শরীফের বাণী ও শিক্ষা المُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ المُسْلِمُونَ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ. মুসলিম সে, যার জিহ্বা ও হাত থেকে মুসলিমেরা নিরাপদ থাকে। মানুষের সাথে মানুষের আচরণ প্রকাশিত হয় কথার দ্বারা বা কাজের দ্বারা। এ দুটির অনিষ্ট থেকে নিরাপদ হওয়া মানে ঐ ব্যক্তি থেকেই নিরাপদ হয়ে যাওয়া। সহীহ মুসলিমের ভাষ্যকার আল্লামা নববী রাহ. বলেন- مَعْنَاهُ مَنْ لَمْ يُؤْذِ مُسْلِمًا بِقَوْلٍ وَلَا فِعْلٍ وَخَصَّ الْيَدَ بِالذِّكْرِ لِأَنَّ مُعْظَمَ الْأَفْعَالِ بِهَا، وَقَدْ جَاءَ الْقُرْآنُ الْعَزِيزُ بِإِضَافَةِ الِاكْتِسَابِ وَالْأَفْعَالِ إِلَيْهَا. হাদীসের অর্থ : (মুসলিম সে,) যে তার কথা বা কাজের দ্বারা কোনো মুসলিমকে কষ্ট দেয় না। হাদীসে হাতের উল্লেখের তাৎপর্য হচ্ছে, অধিকাংশ কর্ম এরই দ্বারা হয়ে থাকে। আর কুরআনে আযীযে মানুষের কর্মকে হাতের সাথেই সম্বন্ধ করা হয়েছে। এরও তাৎপর্য সেটিই, যা উপরে বলা হয়েছে। (শরহে মুসলিম নববী, হাদীস ৪০-এর আলোচনায়) এই হাদীসের শিক্ষা, কামিল মুসলিম হতে হলে কথা ও কাজ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এমন কোনো অন্যায় কথা বলা যাবে না, যার দ্বারা কেউ কষ্ট পায়, তেমনি এমন কোনো কাজ করা যাবে না, যা কারো কষ্টের কারণ হয়। এটি এমন এক মূলনীতি, যা আমাদের সামষ্টিক জীবনের অসংখ্য ক্ষেত্রে অনুসরণীয়। আর যে ক্ষেত্রেই এই মূলনীতি অনুসরণ করা হবে সেখানেই শান্তি ও রহমত আসবে। আমরা যদি পারিবারিক জীবনে এই মূলনীতি অনুসরণ করি- ‘মুসলিম সে, যার জিহ্বা ও হাত থেকে মুসলিমেরা নিরাপদ থাকে’, তাহলে আমাদের পারিবারিক জীবন অনেক শান্তিময় হবে। আমরা যদি আমাদের কর্মস্থলে এই মূলনীতি অনুসরণ করি- ‘মুসলিম সে, যার জিহ্বা ও হাত থেকে মুসলিমেরা নিরাপদ থাকে’, তাহলে আমাদের কর্মস্থল শান্তিময় হবে। আমাদের লেনদেনের জন্য মূলনীতি- ‘মুসলিম সে, যার জিহ্বা ও হাত থেকে মুসলিমেরা নিরাপদ থাকে’। আমাদের রাস্তা-ঘাটে চলাচলের মূলনীতি- ‘মুসলিম সে, যার জিহ্বা ও হাত থেকে মুসলিমেরা নিরাপদ থাকে’। আমাদের পর্ব-উৎসবের ক্ষেত্রে মূলনীতি- ‘মুসলিম সে, যার জিহ্বা ও হাত থেকে মুসলিমেরা নিরাপদ থাকে’। আমাদের আইন-আদালতের ক্ষেত্রে মূলনীতি- ‘মুসলিম সে, যার জিহ্বা ও হাত থেকে মুসলিমেরা নিরাপদ থাকে’। আমাদের রাজনৈতিক সকল কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে মূলনীতি- ‘মুসলিম সে, যার জিহ্বা ও হাত থেকে মুসলিমেরা নিরাপদ থাকে’। আমাদের শিক্ষা-দীক্ষা, অধ্যয়ন-অধ্যাপনার ক্ষেত্রে মূলনীতি- ‘মুসলিম সে, যার জিহ্বা ও হাত থেকে মুসলিমেরা নিরাপদ থাকে’। আমাদের সাহিত্য-সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে মূলনীতি- ‘মুসলিম সে, যার জিহ্বা ও হাত থেকে মুসলিমেরা নিরাপদ থাকে’। চিন্তা করলে দেখা যাবে, জীবনের সকল ক্ষেত্রে এই মূলনীতি প্রযোজ্য এবং এই মূলনীতির অনুসরণ আমাদের কথা ও কাজে এনে দিতে পারে এক ভিন্ন মাত্রা। আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ককে নিয়ে যেতে পারে এক অনন্য উচ্চতায়। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক, বাবা-সন্তানের সম্পর্ক, শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্ক, কর্তা-কর্মচারীর সম্পর্ক, সঙ্গী-সহকর্মী সম্পর্ক, পাড়া-পড়শি সম্পর্ক, আত্মীয়-স্বজনের সম্পর্ক ইত্যাদি সকল সম্পর্কে এনে দিতে পারে আলাদা স্থিতি ও মাধুর্য। এই সবকিছু হতে পারে একটি মাত্র বাণীর স্মরণ ও অনুসরণের মাধ্যমে। আর তা হচ্ছে- المُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ المُسْلِمُونَ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ. মুসলিম সে, যার জিহ্বা ও হাত থেকে মুসলিমেরা নিরাপদ থাকে। হাদীস শরীফের এই বাণী আমাদের সচেতন করছে যে, দ্বীনদারী ও নেক আমলের ক্ষেত্রে মুমিনকে বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে। দ্বীনদারীর প্রাণসত্তা হচ্ছে আল্লাহ তাআলার আদেশ পালন করা, তাঁর নিষেধ করা বিষয় থেকে বেঁচে থাকা- একথাটা চেতনা ও স্মরণে জাগ্রত রাখতে হবে। দ্বীনদারীর বাহ্যিক সকল কাঠামোকে দ্বীনের এই মর্মবাণীর সাথে মিলিয়ে চিন্তা করতে হবে। তাই হাদীসের এ বাণী আমাদের জীবনের অনেক ক্ষেত্রে আমাদের জন্য চেতনা-উন্মেষক এক নীতি। সহীহ বুখারীর ভাষ্যকার হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. যথার্থই বলেছেন- هَذَا الْحَدِيثُ مِنْ جَوَامِعِ الْكَلِمِ الّتِي أُوتِيَهَا صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে ‘জাওয়ামিউল কালিম’ শ্রেণির বাণী প্রদত্ত হয়েছেন উপরোক্ত হাদীসটি তার অন্যতম। -ফাতহুল বারী ১১/৩১৯ ‘জাওয়ামিল কালিম’ অর্থ ঐসব বাণী, যার শব্দ-বাক্য সুসংক্ষিপ্ত কিন্তু অর্থ-মর্ম অতি গভীর ও বিস্তৃত।


tahqiq

তাহকীক:

তাহকীক চলমান